প্রেম তরঙ্গ পর্ব-০৮

0
225

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_৮

বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌছালাম সবেমাত্র। এরই মাঝে আচমকা এক অবিশ্বাস্য কান্ড। আমি ভাবিনি আমার কল্পনা সত্যি হবে। একটু আগের উন্মাদনায় ভরপুর ভাবনা বাস্তবে রূপ নেবে। বাড়ির ডান দিকে ছোট বড় মাঝারি গাছের মেলা। তারই মাঝে কেউ সাদা প্রাইভেট কার রেখে দাড়িয়ে আছে লাল পাঞ্জাবি পরে। বিজলির দ্যুতিতে থেমে থেমে স্পষ্ট দৃষ্টিতে নজরে পরছে তাকে। ভিজে একাকার দশায় স্থির দাড়িয়ে সে গাড়ির সাথে। আমি তীন ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তিনি বগঝদার, আদর্শ পথিক হয়ে হাঁটছেন। আমার হাতে ছাতা। আমি পরপর দুবার করে দৃষ্টি বিনিময় করলাম তীন ও তিতাসের দিকে। অতঃপর হুট করে তীন ভাইয়াকে তাড়া দিয়ে বলে উঠলাম

— ভাইয়া, দরজা খুলুন জলদি। জোরে বৃষ্টি আসছে।

ভাইয়া আম্মুকে ডাকছিলো বাইরে থেকে। এবার আমার কথায় উনি গ্রিলের ফাঁকে হাত দিয়ে ছিটকিনি খেলার প্রয়াসে মত্ত হলেন। আমি সন্তপর্ণে দৃষ্টি নিয়ে গেলাম তিতাসের দিকে। হাত পা কাঁপছে আমার। তিতাস সত্যিই আসলো? মনে প্রাণে এতোক্ষণ তাকে চাইলেও এখন যেন আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমারেখার মাঝ বরাবর পরে আছি।

— তিথি, ভেতরে যাও।

তীন ভাইয়ার ডাকে তার দিকে চাইলাম। হাতের ছাতাটা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম ঘরময় আঁধার। তীন ভাইয়া পকেট থেকে ফোন বের করলেন। টর্চ জ্বালিয়ে আমায় কিছু বলার আগেই আমি হুট করে তাকে দু ধাক্কায় আমার রুমে প্রবেশ করিয়েই বলে উঠলাম ঝটপট

— ভাইয়া এখন আর আপনার বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। আপনি আজ আমাদের এখানে থেকে যান। আমার ঘরেই থাকেন। আমি মিলির ঘরে থাকবো। ঠিক আছে গুড নাইট। আপনি তাহলে ঘুমিয়ে পরুন।

কথাগুলো থতমত ভাব নিয়ে আওড়েই আমি আচমকা বন্ধ করে দিলাম দরজা। তারপর ছাতা ছুড়ে দিলাম অনির্দিষ্ট এক দিকে। তীন ভাইয়া বোধ হয় থতমত খেয়ে গেছে। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। প্রেমিকা হিসেবে আমার একটাই চেষ্টা, আমার প্রেমের তরঙ্গ যাকে নিয়ে তার সম্পর্কে যেন কেউ না জানে। পরবর্তীতে যেন একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন আমার না হতে হয়।

.
বৃষ্টির বেগকেও যেন হার মানিয়ে আমি ছুটলাম তিতাসের দিকে। অবুঝ মন আমার আপ্লুত। সে যেন ভুলে গেলো তিতাস বিবাহিত। কণাকে দু দুবার বিয়ে করেছে। এমন ভুলো মন নিয়ে যখন আমি তিতাসের সম্মুখে গেলাম তখন বুকের ধুকপুক বেড়ে তুঙ্গে। তিতাস অসাড় হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার অতি আকর্ষণীয় চুলগুলো পানিতে ভিজে নেতিয়ে পরেছে। আমি চোখ বুলিয়ে গেলাম তার পুরো মুখে। আমার এই দর্শন মুহূর্তে হঠাৎ তিতাস এগিয়ে এলো আমার দিকে। বলল হঠাৎ

— ওড়নাটা পেতে দাও তো!

আমি অবাক হলাম তার কথা শুনে। সে আবারও বলল

— তিথি ওড়নার এক আঁচল উঁচু করে ধরলো।

আমি তার কথামতো বোবার ন্যায় কাঁপা কাঁপা হাতে আমার ওড়নার একাংশ পেতে দিলাম। মুখে ছিল অজস্র প্রশ্ন, কথা কিন্তু কিছুই বলা হলো না। তিতাস যেন স্বাভাবিক। যেন তার সনে আমার এমন কিছুই ঘটেনি দিন দশেক পূর্বে যার কারণে আমার বুক পুড়ে যায়নি। আমি দগ্ধ হইনি।

— তিথি, এইগুলো নিয়ে যাও। এরা আমাকে খুব পোড়চ্ছে। আমায় পাগল বানিয়ে দিচ্ছে এগুলো।

আমার দৃষ্টি ছিল তিতাসের মুখের দিকে। হঠাৎ কর্ণকুহরে তার ভাঙা ভাঙা গলার স্বর পৌঁছাতেই চমকে তাকালাম ওড়নার পানে। একে একে চোখে ধরা দিলো দু’টো ওয়ালেট, দু’টো ঘড়ি, একটা রিং,। বৃষ্টির পানিতে তারা যেন অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। আমি তিতাসের দিকে আহত দৃষ্টিতে চাইলাম। তার চোখ দু’টো লাল। গাড়ির আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার হলদে ফর্সা মুখের সুন্দর অবয়বে বিষাদের ছায়া। আমি যেন থমকে গেলাম। প্রিয়র বিষাদ মাখা মুখের প্রতিচ্ছবি বড্ড কষ্টে ফেলে দিলো আমায়। এ কেমন বেহায়া প্রেম। আমার তো উচিত তাকে ঘৃণা করা। সে আমার ওপর বিশ্বাস রাখেনি।

— এগুলো ফিরিয়ে দিতেই এসেছিলে?

বড্ড কঠিন হবার চেষ্টা করলাম। গলার স্বরে নেমে আনলাম কঠোরতা। সফল বোধ হয় ততটা হইনি। তিতাসও পাল্টা জবাব দিয়ে দিলো

— হ্যা। ক্যারেন দেখলে কি সমস্যা হবে? তুমি না হয় এগুলো কোনো পুকুরে ফেলে দিও। ক্যারেন দেখবে না।

— এই কাজটা তো তুমিও করতে পারতে। ঢাকায় বোধ হয় পুকুর, দিঘি, জলাশয়ের অভাব ছিল না। নাকি কণার জন্য ভয়ে একেবারে লুকিয়ে চুরিরে এখানে এসে পরেছো।

আমার কথায় তিতাস শক্ত দৃষ্টিতে চাইলো আমার দিকে। আমিও বুকের ব্যাথা লুকিয়ে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তিতাস কিয়ৎক্ষণ পরখ করে গেলো আমায়।

— তোমার গায়ের পাঞ্জাবিটাও তো আমি দিয়েছি। ওটা দেবে না?

আমার কথায় তিতাস হঠাৎ থমকে গেলো। থতমত খেয়ে গেলো। অতঃপর আকস্মিক ভাবে তার চোখে চলে এলো জল। সে স্থির থাকতে পারলো না। হুট করে গাড়ির সাথে দেহ ঠেকিয়ে ঠোঁটের ভাজে কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো। কিন্তু সফল হলো না। চোখ তো আর মানবে তার কথা।শুনবে না বরণ। অঝোর ধারায় বৃষ্টি কমে গেলো আকাশের বুকের। কিন্তু এবার শুরু হলো তিতাসের চোখের। তিতাস ধ্যান জ্ঞান ভুলে হঠাৎ আক্রোশ আর আকাশসম ভালোবাসা নিয়ে উচ্চস্বরে ভাঙা গলায় বলল

— আমি ভালো নেই তিথি। আমি ভালো থাকতে পারছি না। আমি যেন মিনিটে মিনিটে খুন হচ্ছি ভেতরে ভেতরে। তুমি কেন এমন করলে? আমার অনেক কষ্ট হয়। আমি কিভাবে অন্য কাউকে আপন করবো বলো? তুমি নিশ্চয়ই ভালো আছো তাই না? আমার সাথে বেইমানি করে অনেক ভালো আছো। তুমি আমার তিন বছরের ভালোবাসা ছেড়ে কিভাবে পারলে ক্যারেনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে? আমি পারলে এই বুকটা ফারি দিয়ে তোমাকে দেখাতাম এখানে কেমন দহন হয়। তোমাকে যেদিন ক্যারেন বিয়ে করলো সেদিন আমার অসহ্য যন্ত্রণা হয়েছে। আমার বেঁচে থাকা কষ্ট হয়ে…. গে…

তিতাসের গলা ক্রমশই চেপে গেলো। সে চোখে ফুটিয়ে তুলল অজস্র ব্যাথা, কথা। আমি নীরবে তাকে দর্শন করে গেলাম। বুঝলাম ওবুকেও দহন হয়েছে। আমার চাইতে কি বেশি হয়েছে?

— তিথি, আমার মন থেকে তুমি বেরিয়ে যাও প্লিজ। আমায় ভালো থাকতে দাও।

— যদি একই কথা আমিও বলি?

— বিশ্বাস করবো না আমি। কারণ আমার চোখে এখনও ভাসে, ছাদের দৃশ্য।

— ওটা ক্যারেনের ষড়য…

— ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বেইমানগুলো।

আমায় থমকে দিয়ে তিতাস হঠাৎ বলে উঠলো কথাটা। ঠিক তীক্ষ্ণ ধারালো এক কাঁটার মতো কথাটা আমর বুকে এসে বিধলো। মুখের মথা মুখেই রেখে দিলাম। তিতাস গাড়িতে উঠে পরলো। একটা সময় গাড়ি ছুটিয়ে শা করে চলে গেলো আমার সম্মুখ হতে। ছেড়ে গেলো সে আমায়। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি আঁধারে পরে রইলাম। গাড়ির আলোটা যতক্ষণ আমার দৃষ্টিতে রইলো ততক্ষণ তাকিয়েই থাকলাম। অতঃপর চলে এলাম ধীর পায়ে বাড়ির গেটের নিকট। দু’ধারে দু’টো বসার আসন আছে। বাইরে এতক্ষণে লাইটের ধবধবে আলো দেখা যাচ্ছে। কারেন্ট চলে এসেছে বোধ হয়। আমি ওড়নার জিনিসগুলোর দিকে ফিরে চাইলাম। নীরবে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিতে ভুলল না আমার মন। একটা ওয়ালেট হাতে তুলে নিলাম। অজান্তেই ভাজ খুলে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ এরই মাঝে চোখে পরলো একটা সাদা কাগজ। কৌতুহল নিয়ে কাগজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই তা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। সেই সাথে তড়িৎ গতিতে ভিজলো আমার আঁখি। তিতাস লিখেছে এই কাগজে

” আমি সত্যিই ভালো নেই তিথি? অনেক কষ্ট হয় আমার। কল্পনাতীত, সীমাহীন। মৃত্যু যন্ত্রণার মতো। আমি মারা যাচ্ছি তিথি। মানুষের আসল মরণের যন্ত্রণা তবুও একক্ষণে সমাপ্ত হয়। কিন্তু আমার যন্ত্রণা তো শেষে হচ্ছে না, তিথি? যতোদিন দেহে প্রাণ আছে ততদিন বোধ হয় আমি এভাবেই খুন হতে থাকবো। কিন্তু আমি মুক্তি চাই এই যন্ত্রণা থেকে। আমি আর আমার হৃদপিণ্ড থেকে তিথির হৃদপিণ্ডে প্রেম পাঠাতে চাই না। আমি এই প্রেম তরঙ্গ বন্ধ করতে চাই। আটকাতে চাই।”

চলবে….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)