প্রেম তরঙ্গ পর্ব-০৯

0
204

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_৯

তিতাস চলে যাওয়ার দু’দিন হতে চলল। সময় যেন গেলো পাখির ডানার দ্বারা উড়ে উড়ে। তীন ভাইয়া বেজায় জ্বরে পরে ঢাকায় যেতে পারালেন না। আমার কিঞ্চিৎ অপরাধ বোধ হলো এ নিয়ে। বড় আম্মা আমায় তেমন বকাবকি না করলেও আম্মু আমায় বকে গেছেন অনর্গল। বড় বাবা থাকেন যশোরের কোনো এক জায়গায় চাকরির সূত্রে। তিনি রেজিস্ট্রি অফিসের হাকিম। বড় মা সেই সূত্রে বাসাতে একা এক ছেলে নিয়ে। আম্মু এই দু’দিন বড় আম্মার কাছেই আছেন। কোনো রান্না বান্না করছেন না আমাদের বাড়িতে। ওখানেই বড় আম্মার সাথে মিলে তীন ভাইয়ার আদর যত্নে মগ্ন। ওখান থেকেই তিনি স্কুলে যাতায়াত করছেন। ফলস্বরূপ রান্নাবান্না, বাড়ির কাজকর্ম চেপেছে আমার আর মিলির ওপর। আব্বু তো সারাদিন প্রায় বাইরেই থাকে। বাড়িতে আমি আর মিলি পরে থাকি। এরমাঝে আমি আবার বলেও দিয়েছি আমি আর ঢাকায় পড়বো না। এ শুনে আম্মুর মাথা আরো গরম। এক প্রকার রাগ নিয়েই তিনি বড় আম্মার বাড়িতে আছেন।

— আপু?

হঠাৎ মিলির ডাক। আমি আমার ঘরে বিছানার ওপর বসে চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। পেছন ঘুরে মিলির পানে দৃষ্টি তাক করে বললাম

— হুম

— তিতাস ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার।

মুখে কথা আনয়নের পূর্বেই চোখে জল আনলো মিলি। আমি চমকে উঠলাম। চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি মিলিতে মেলে দিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মিলি আবারও হুট করে ফুপিয়ে উঠলো। বিছানার একাংশে বসে দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে তার এক হাত উঁচু করলো। মুঠ খুলে দিয়ে আমার নজরে ধারিয়ে দিলো এক সাদা কাগজ। মুখে বলল

— এটা আমার ঘরে পেয়েছি। কি হয়েছে তোদের?

আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম মিলি হতে। তার পূর্বে ওর হাত থেকে শীতল মেজাজে চিরকুটটা নিয়ে নিলাম। মিলি আমায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল।

— কি হয়েছে আপু বল না? তিতাস ভাইয়া এতো কষ্টে কেন আছে?

আমি ক্ষণকাল চুপ রইলাম মিলির প্রশ্নে। চোখ ছলছল করে উঠলো আমার। গলায় খুব শক্ত এক দানার যেন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। মিলি আবারও আমায় ধাক্কা দিয়ে একই প্রশ্ন করে গেলো। আমি এবার বলে উঠলাম স্পষ্ট কন্ঠে

— তিতাস আমাকে ভুল বুঝে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।

মিলি যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। এরপর ওর আকুলতা, কৌতুহল জন্মে গেলো সীমাহীন। আমিও বলে দিলাম সবটা। ক্যারেন থেকে শুরু করে কণার কর্মকাণ্ড এবং তিতাসের দুদিন আগে আসার কথাও। মিলি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তারপর হুট করে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে বলল

— তুই কেন ভাইয়াকে সব ক্লিয়ার করে বলিসনি?

— চেষ্টা করেছিলাম। জেদ দেখালো আমাকে।

— তাই বলে বিয়ে? কিন্তু তুই কেন ইংরেজকে বিয়ে করলি?

— ও বাড়ির সবার জোরজারিতে আর খানিকটা আমার জেদে। তিতাসের ওপর রাগ নিয়ে। সে যদি আমাকে অবিশ্বাস করে তাহলে আমিও তার চোখের সামনেই থেকে তাকে পোড়াতে চাই। এমন একটা ভুল ধারণা নিয়ে। কিন্তু আমি পারিনি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শুধু পুড়েছি। বুঝেছি তিতাস ছাড়া অন্য কাউকে আপন করা, ভালোবাসা তিথির সম্ভব নয়।

— আমি তিতাস ভাইকে সব বলে দেবো।

হুট করে মিলি কথাটা বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো। আমি চমকে ওর এক হাত টেনে নিয়ে থমকে দিলাম ওকে।

— মিলি তুই কিছু বলবি না ওকে। সহ্য করতে পারবে না তিতাস। ভুলের জন্য বারবার আফসোস করবে। পাগল হয়ে যাবে।

— এতো ভালোবাসিস?

— জানিনা।

মিলি তাকিয়ে রইলো অপলক আমার দিকে। তারপর হুট করেই ও চেঁচিয়ে বলে উঠলো

— আপু তুই কিভাবে সহ্য করছিস এই কষ্ট? ভালোবাসা এতো কষ্টের কেন?

— ভালোবাসা কষ্টের না মিলি। আমার ভালোবাসা অনেক সুন্দর ছিল। কিন্তু ক্যারেন কষ্টের করে দিলো।

— এই ক্যারেন কণা…..

মিলি আর কিছু বলতে পারলো না। সে আমার হাত থেকে হাত ছুটিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আমি নিশ্চুপ বসে রইলাম। প্রায় মিনিট দুয়েক পর। মিলির ঘর হতে ভেসে এলো মিলির কন্ঠ। আমাদের দুবোনের রুম মাত্র একটা দেয়াল দিয়ে পৃথক করা। দু ঘরের মাঝে একটা দরজা আছে। তা খোলা থাকায় স্পষ্ট সবকিছু কর্ণধারায় এসে ধাক্কা খায়।

— আপু আমর কি কোনোই পথ নেই তিতাস ভাইয়ের সাথে তোর মিল হওয়ার?

আমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। কেবলই মৌনতাকে সঙ্গ দিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম জানালা দিয়ে বাইরে।

.
সেদিনও গেলো আমার বিষন্ন মন নিয়ে। তারপর দিন। তীন ভাইয়ার জ্বর কমে গেলো। তিনি চলে গেলেন ঢাকায়। বড় আম্মার বাড়িতে সেদিন আমার আর মিলিরও যাওয়া হলো। এই দু’দিন মিলির হাতের রান্না খেয়ে রফাদফা অবস্থা আমার। বড় আম্মার বাড়িতে গিয়ে দেখি হরেক পদের খাবার রান্না করা হয়েছে। আমাকে আর মিলিকে আম্মু তুলে খাইয়ে দিলেন। আরো জানিয়ে দিলেন আজ নাকি এ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। বড় আম্মুর মা-বাবা, ভাই, বোনেরা আসবে। আমাকে আম্মু খাইয়ে দিয়ে হঠাৎ কোনো এক ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়ে কানে ফিসফিস করে বললেন

” দুপুরের পর আমার পেঁয়াজ রঙের শাড়িটা পড়ে সুন্দর করে একটু সাজগোছ করে আসিস।”

আমি আম্মুর কথা পাত্তা দিলাম না। আর না কারণ জানতে চাইলাম। উল্টো তার কাছে বিশ হাজার টাকা চেয়ে বসলাম। আমার ফোনের জন্য। বললাম, আমার ফোন ছিনতাই হয়ে গেছে ঢাকা থেকে আসতে। টাকা দাও। আম্মু একটা চাবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করলেন আমাকে আর মিলিকে।

.
টাকা নিয়ে তৈরি হয়ে দুবোন বেরিয়ে পরলাম মার্কেটের উদ্দেশ্যে। তারপূর্বে আব্বুকে ফোন করে ফোনের শো-রুমে অপেক্ষা করতে বললাম। একটা অটো ভ্যান আব্বু ইতিমধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছে। মিলি বোরখা হিজাব পরে আমার পূর্বেই তৈরি হয়ে ভ্যানে উঠে পরলো। আমি আসতেই সে জুড়ে দিলো গল্প। এই এলাকার প্রত্যেকটা ভ্যান, অটো চালক দেখি তাকে ” আম্মা”। আমি মৃদু হাসলাম। হঠাৎই মিলিকে বলে উঠলাম

— মিলি তোর জীবনটা অনেক সুন্দর। আমার মতো ভুল কিন্তু তুই কখনো করিস না।

— হয়ে গেছে সেই ভুল আপুনি। তার সনে আমার সনে, ভাব হয়েছে মনে মনে।

আমি মিলির কথায় কেঁপে উঠলাম। তড়বড় করে চমকে প্রশ্ন করলাম

— কে সে?

মিলি চলতি ফ্যানের ওপাশে বসা ছিল। হুট করে সে ঝুঁকে এলো আমার দিকে। ফিসফিস কন্ঠে বলল

— বলব একদিন। তবে জানো আপু? আমার প্রিয় ভীষণ বাঁকা। হাইলা লোকের লাঙ্গলের চেয়েও বেশি বাঁকা। আকাশের জনম বাঁকা চাদের চেয়েও বেশি বাঁকা।

— খুব ভালোবাসিস তাকে?

— এসে গেছি আমরা। নেমে পর আপু।

মিলির কথায় আমি গিলে ফেললাম কৌতুহল। ভ্যান থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম দুই তলা এক মার্কেটের দিকে। মিলি হাঁটছিল আমার আগে আগে। আমি তার পিছু পিছু। প্রায় সাত আট কদম এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত কিছু নজরে এলো আমার। ক্যারেনকে দেখলাম মনে হয়! বুকটা আমার ধ্বক করে উঠলো। আমি ভালোভাবে নজর করলাম। একটা দোকান থেকে ক্যারেন বেরিয়ে আসছে। হাতে তার পানির বোতল। আমার হাত পা কাঁপা শুরু হলো। অশাড় হয়ে আসা মস্তিষ্ক নিয়ে হুট করে দৌড়ে মিলি বরাবর চলেগেলাম। খপ করে ধরে ফেললাম মিলির হাত। মিলি চমকে উঠলো। প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আমার দিকে

— আরে, কি হলো তোর?

— মিলি এখনই বাসায় চল বনু। আমার কান্না আসছে। তাড়াতাড়ি। না হলে আমি সেন্সলেস হয়ে যাবো।

মিলি ভয় পেলো। আমার কথা জড়িয়ে আসছে। আমি মিলির হাত টেনে ক্রমশ ক্যারেনের বিপরীতমুখে চলছি।

— কি হয়েছে আপু?

— ক্যারেন এসেছে মিলি। কেন এলো এই লোকটা? এলাকায় জানাজানি হলে কি হবে? আব্বুর মানসম্মান?

চোখ দিয়ে আমার জল গড়িয়ে পরলো। মিলি স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে পরখ করলো। কিন্তু আমি কোনোমতেই পেছনে তাকাচ্ছি না।পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। ক্যারেনের বিষয় জানাজানি হলে সব শেষ! সব! আমিই তো ঢাকায় যেতাম দু’দিন পর। তাকে ডিভোর্স দিতে। ও কেন আসলো?ঠিকানা পেলো কোথায়?

চলবে…