বাড়িয়ে দাও তোমার হাত পর্ব-০২

0
202

#বাড়িয়ে_দাও_তোমার_হাত
#দ্বিতীয়_পর্ব
#হুমাইরা_হাসান
____________________

– আপনি সে না যার জন্য ভরা রাস্তায় আমার ওড়না উড়ে গিয়েছিলো! আপনার জন্যেই তো আমায় চূড়ান্ত অপমান হতে হয়েছিলো!

বাসর ঘরে বউয়ের প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়ার পর এমন ভয়ংকর বাক্যে যে কেও আশ্চর্যান্বিত হবার মতো হলেও মিহির কোনোরূপ অভিব্যক্তি দেখালো না, যেনো নিতান্তই স্বাভাবিক কোনো ঘটনা। কিন্তু ওর অপরপাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার চোখে মুখে বিব্রতবোধ আর হতবিহ্বলতা সব মিলিয়ে ক্রোধের একটা স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠেছে। সুইচবোর্ডের কাছ থেকে সরে শাড়ির কুচিটা ধরে এগিয়ে এলো মাসনুন। মিহিরকে ওভাবে ভূতের মতো ধীমি পায়ে এগিয়ে আসতে দেখেই ও এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে লাইট জ্বেলে মিহিরের চেহারাটা দেখার পরেই এমন অদ্ভুত একটা কথা বলে দিয়েছে। এগিয়ে এসে মিহিরের সোজাসুজি দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ভাষায় জিগ্যেস করলো,

– আপনি বিয়ের আগে আমাকে দেখেননি? জানতেন না যে যাকে বিয়ে করছেন সেই ওইদিন রাস্তায় দেখা মেয়েটা?

মিহির মৃদুভাবে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলে মাসনুন কেমন অদ্ভুত চোখে তাকালো মিহিরের দিকে। বেশ লম্বা চওড়া একটা ছেলে। উজ্জ্বল শ্যামরঙা মুখ, ভাসা ভাসা দুটি চোখ। এক হাত পকেটে গুঁজে খুব সাধারণ একটা খয়েরী রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পরনে। মাসনুনের ভাবতে এখনো অবাক লাগে এই লোকটা ওর স্বামী! এই কিছুক্ষণ আগেই ও কবুল বলে নিজেই নিজেকে এই মানুষের বউ রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বামী! অর্থাৎ ওর সম্পূর্ণ সত্ত্বার একমাত্র অধিকারী এই মানুষটা।যার কাছে নিজেকে নিজের শরীরটাকে বিলিয়ে দিতে হবে নিঃশব্দে। ভাবতেই চোখ- মুখ ধাঁধিয়ে আসে মাসনুনের। বুকের পিঞ্জিরাবদ্ধ যন্ত্রটা কেমন বেসামাল ধুকপুকানির তালে শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। অনেকটা অসন্তুষ্ট ও হলো, যেই লোকটা চাইলেই সেদিন ওকে ওত বড় একটা অপমান হতে বাঁচাতে পারতো অথচ তা করেনি সে কী না ওরই রক্ষক হবে! আলগোছে সামনে থেকে সরে এসে খাটের এক কোণায় দাঁড়ায়, আবারও কী একটা মনে হতেই মিহিরের সামনে এগিয়ে গিয়ে পায়ের দিকে ঝুঁকতে নিলেই মিহির তড়িৎ গতিতে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। মাসনুন বিরক্তি ভরা চোখে মুখে তাকিয়ে সোজা হয়ে বলল,

– বউ কী আমি না আপনি!

মিহির ভীষণ ভাবে থতমত খেলো এমন অবান্তর একটা প্রশ্নে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,

– এটা কেমন প্রশ্ন! অবশ্যই তুমি

– তাহলে আপনি লজ্জা পেয়ে পিছনে যাচ্ছেন কেনো। আমি তো আর আপনাকে জোর জবরদস্তি করবো না

মিহির বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো মাসনুনের দিকে। সুবহান কবির ভুল বলেছিলেন, তার মেয়ে একটু না অনেক বেশিই স্পষ্টভাষী৷ না হলে বাসরঘরে মেয়েদের গুটিয়ে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা চিরচারিত রূপটাকে দেদারসে উপেক্ষা করে এমন কথার তীর কেও ছুড়ে দিতে পারে! মিহিরের বিস্মিত চেহারাটাকে ভীষণ ভাবে অগ্রাহ্য করে মাসনুন এগিয়ে এসে ওর সামনে ঝুঁকে পায়ে সালাম করে সোজা বিছানায় গিয়ে বসলো৷ মিহিরের দ্বিধাদ্বন্দ্বিত মুখটা দেখে ওর অস্বস্তির কারণটা বোধহয় ঠাওর করতে পারলো মাসনুন। কিয়ৎকাল বাদে বলল,

– যেহেতু চেনা-জানা নেই তাই অস্বস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক তবে আমি কিন্তু ওসব সোফা বা নিচে শোবার কাহিনী আমি পারবো না। ওসব সিনেমার নাটক আমার দ্বারা হবেনা। আপনার যদি আমার সাথে এক খাটে শুতে অসুবিধা হয় তো অন্যঘর দেখিয়ে দিন আমি সেখানেই শুয়ে পড়বো৷

মিহির প্রত্যুত্তরের বদলে এগিয়ে এলো। মাসনুনের ওপর পাশে খাটের কিনারায় বসে বলল,

– তোমার বাবার সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিলো। আমি তাকে বলেছিলাম বিয়ের আগে তোমাকে যেনো আমার বিষয়ে সবটা বলে দেন। কতটুকু বলেছেন জানিনা তবে বলে রাখা ভালো এই বিয়েটা সম্পূর্ণ আমার পরিবারের মতে আর তাদের ইচ্ছেতেই করা হয়েছে।

– আর আপনার?

মাসনুনের কৌতূহলী প্রশ্ন আর দৃষ্টি দুটোই বিদ্ধ মিহিরের শানিত চেহারা পানে। মাসনুন খুব খুঁতিয়ে লক্ষ্য করলো লোকটার কথা বলার সময় চোখ নামিয়ে নেওয়া আর তার কথা বলার ভঙ্গিমা অত্যন্ত ভদ্রসূচক আর বিনয়ী আচরণ। মাসনুনের তীক্ষ্ণ নজরে চোখ না মিলিয়েই মিহির বলল,

– এই বয়সে এসে বিয়ে করার ইচ্ছে আর হয়নি। আমার দুটো সন্তান আছে তা নিশ্চয়ই আপনাকে জানানো হয়েছে। আমার আপনার কাছে একটাই অনুরোধ আপনি ওদের যত্ন করবেন। মায়ের স্নেহ ভীষণ দরকার ওদের। আপনি শুধু ওদের ভালোবাসবেন আপনার সবকিছুর দ্বায়িত্ব আমি নেবো ইনশাআল্লাহ।

মাসনুনের কেমন বেখেয়ালি লাগলো মিহিরের কথা গুলো। মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, গলার ভেতর কুন্ডলী পাকাচ্ছে তবে মুখ হতে বাহিরে আসার উপক্রম টুকু আর হয়ে উঠছেনা। ওর ভাবনার মাঝেই মিহির বলল,

– বিয়ে যেহেতু দুজন স্বেচ্ছায় করেছি তবে আলাদা ঘরে থাকার এই ব্যাপারটা ভীষণ দৃষ্টিকটু। আমার সাথে থাকতে খুব অসুবিধা না হলে আপনি এখানেই থাকতে পারেন৷

বলে অবিলম্বেই আবারও বলতে আরম্ভ করলো যে,

– দেখুন আমি জানি বিয়ের পর সমস্ত দ্বায়িত্ব, কর্তব্যের পাশাপাশি স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার ও একটা ব্যাপার থাকে। তবে আমি এখনি এসব ভাবতে চাইনা। আশা করি বুঝতে পারছেন আমি কী বোঝাতে চেয়েছি।

মাসনুন নির্লিপ্ত মুখাবয়বে থাকলেও ভেতর দিয়ে কেমন একটা জড়ত্ব জড়ীভূত হলো। আর যাই হোক এসব ব্যাপারে আগ্রহ বা কথা বাড়ানোর মতো কাজ খুব কম মেয়েই পারবে। ওউ তাদের ব্যতিক্রম নয়। তবে ওর তো অন্যকিছু জানার আছে। কেমন একটা তটস্থ হয়ে বলল,

– বিয়ের আগে আমি আপনার ব্যাপারে নাম ছাড়া দুটো কথা শুনেছি। এক আপনার দুটো বাচ্চা আছে আর..

– দ্বিতীয় টা হলো আমি পঙ্গু। তাই তো?

মিহিরের পুরুষালী গলাটা যেনো এবার একটু বেশিই স্পষ্ট শোনালো৷ মোহর আড়ষ্টভাব নিয়েই তাকালো পাশে বসা পুরুষের পানে। ভেতরের আড়ষ্টতা ঠেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,

– আপনাকে আমি পুরোদস্তুর সুস্থ মানুষই দেখছি।

স্মিত হাসলো মিহির। মাসনুনের অত্যন্ত বিব্রতবোধ মিশ্রিত মুখাবয়বে চেয়ে বলল,

– ভুল দেখছেন। আমি আসলেই পঙ্গু

কথাটি বলেই ডান পাশের প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখ হাতের দিকে নিজের বাঁ হাতটা এগিয়ে নিলো। ঠিক যেমন নির্জীব কোনো বস্তুকে নিজ সামর্থ্যে নড়াতে হয় সেভাবেই ডান হাতের কবজিটা বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে পকেট থেকে বের করে বলল,

– আমার এই হাতটা অচল৷ এক কথার অকেজো বলতে পারেন৷ ঘরের অপ্রয়োজনীয় আসবাবের মতোই এর ভূমিকা।

মাসনুন হতবিহ্বল চোখে চেয়ে থেকে বলল,

– তার মানে সেদিন আপনি ইচ্ছে করে..

– একটা মেয়ের শরীর থেকে ওড়না উড়ে যাবে আর আমি দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখবো এতটা অমানুষও নোই আমি। আমি চেয়েছি ওড়নাটাকে ধরতে কিন্তু আমি পঙ্গু। আমার হাতটা কাজ করে না, অন্যহাতে আমার ছেলের হাত ধরে রেখেছিলাম তাই আমি চাইলেও আপনাকে সাহায্য করতে পারিনি।

মাসনুনের খেদানুভব হলো। নিজের ওপরেই ক্ষোভ আঁছড়ে পড়লো। খুব ভুল বুঝেছিলো ও লোকটাকে। মাস খানেক আগেই রাস্তা পার হওয়ার সময় ঠিক মাঝ বরাবর আসলে পাশ দিয়ে একটা অটো যাওয়ার সময় খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই গায়ের ওড়নাটা চলন্ত অটোর সাথে বিঁধে যায়। আর কাকতালীয় ঘটনার মতো মিহির ও ওর ছেলের হাত ধরে পাশ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছিলো। এক হাত পকেটে আর অন্যহাতের করপুটে ছেলের কব্জি। মিহিরের সামনে থেকে অটো যাওয়ার সময় মাসনুন সাহায্য চেয়ে বলেছিলো এক হাতে ওড়নাটা টান দিয়ে ধরতে। কিন্তু মাসনুন তো জানে না মিহিরের হাতটা অচল। তাই ভরা রাস্তায় নাইবা নিজের ছেলের হাতটা ছাড়তে পেরেছে নাইবা অকেজো হাতটা চালিয়ে মাসনুন কে সাহায্য করতে পেরেছে। কল্মষতায় মনটা ছোট হলো মাসনুনের, মানুষকে না জেনে না বুঝেই সেদিন অনেক কথা শুনিয়েছিলো, আজও বলল একটু আগেই। অথচ লোকটার এই ছোট্ট অসহায়ত্বের বড় ভারটুকু ও আন্দাজ করতে পারেনি। নির্বিণ্ণ মনে মুখ চিরে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে তার আগেই মিহির বলল,

– আপনি স্যরি বলবেন না। এটা সবক্ষেত্রেই হয়৷ আমায় শুরুতে মানুষ ভুল বুঝে পরে সত্যটা জানতে পেরে অনুকংপা দেখায়৷ বিশ্বাস করুন আমার সিমপ্যাথির দরকার নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো আপনি সুশ্রী, শিক্ষিতা। আপনার অবশ্যই আমার চেয়ে ভালো মানুষ প্রাপ্য। সেখানে আমি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমি বারবার আংকেল কে বলেওছি আমার ব্যাপারটা আপনাকে জানাতে তবুও কীভাবে রাজি হলেন আমি জানি না।

মাসনুনের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো৷ কিন্তু খুব এক অজানা দ্বিধায় সমস্ত স্পষ্টভাষা গুলোও সমবায় হয়ে গেলো। ওর বাবা বলেছিলো, “ মারে তোর হয়তো মনে হতে পারে যে বাবা নিশ্চয় তোকে নিয়ে ভাবে না বলে এমন একটা বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে চিনি। আর এও জানি যে তুই খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবি কেনো তোর বাবা মিহিরকেই নির্বাচন করেছে তোর যোগ্য হিসেবে। ” কথাটার মর্মার্থ একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছে হয়তো এখন। তবে ও সত্যিই এমন কোনো আচরণ করতে চাইনা যাতে মিহিরের মনে হয় ও সহানুভূতি প্রদর্শন করছে।
রাতটা আর কোনো কথার বিনিময় ছাড়াই পার হলো। মিহির বিছানার একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লে মাসনুন ও দ্বিতীয়টি বলার সুযোগ পেলো না।

বাইরে গুটি কয়েক মানুষের গল্পগুজব মৌমাছির গুঞ্জনের মতো কানে এলেই ঘুম আলগা হয়ে এলো মাসনুনের৷ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো পাশ ফিরে স্থানটা শূন্য দেখে সারা ঘরে চোখ বুলায়। অথচ মিহির নামক মানুষটার উপস্থিতি কোত্থাও নেই৷ লম্বা একটা হাই তুলে খাট থেকে নেমে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা অল্পবয়সী মেয়ে যে কাল রাতে ওকে এখানে রেখে গেছিলো আরেকজন বৃদ্ধা ঢুকলো গুটি পায়ে। বৃদ্ধাকে মনে হয় মাসনুন চিনতে পারলো, গতদিনেই পরিচয় করিয়েছিলো। ইনি মিহিরের দাদী। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা মুড়িয়ে নিলো মাসনুন বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিলেও বৃদ্ধা উত্তর না দিয়ে বরং এগিয়ে এসে মাসনুনের মাথা থেকে ঘোমটা টান দিয়ে সরিয়ে চুলের গোছা আলগা করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো। মাসনুন শুধু বিব্রত না বেশ বিস্মিত হলো এহেন কাণ্ডে। মাসনুনের চুল থেকে হাত সরিয়ে বৃদ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

– ছোট তো না দুজনে। বিয়ে যখন করেছো সংসার ও তো করতেই হবে। বুঝিনা এখনকার ছোকরা ছুকড়ি দের ন্যাকা। আমরা কী বিয়ে করিনি!

মাসনুন হতবিহ্বল হয়ে বলল,

– মানে? কী বলছেন?

– বোঝা লাগবে না আর। খুকী আমার! নাও ধরো, আর গোসল করে এটা পরে আমায় উদ্ধার করো।

বলে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার হাত থেকে একটা শাড়ি মাসনুনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মাসনুন হতবাক হলেও তা প্রকাশ করার জায়গা পেলো না। দ্বিধাগ্রস্ত কুণ্ঠামনে শাড়িটা নিয়ে আবারও ঢুকলো বাথরুমে।

…..

– তা মেয়ে তো ভালোই পড়াশোনা করেছে, আগেও কী করবে নাকি রোকেয়া আপা?

– মাত্র বিয়ে হলো, এসেছে থাক কিছুদিন। তারপর নাহয় এসব ভাবা যাবে।

রোকেয়া বেগম অর্থাৎ মিহিরের মা চা-নাস্তার ট্রে টা এনে সেন্টার টেবিলে রেখে বসলেন সামনে। মাসনুন নির্লিপ্ত চোখখানা তুলে একবার তাকালো শ্বাশুড়ির পানে। ছেলের মতোই শ্যাম গড়নের মুখ। বড় বড় চোখ দু’টো। এইটুকু সময় দেখে যা বুঝলো সেও কথাচোরা স্বভাবের।

– এত ভাবাভাবির কী আছে? বিয়া করছে সংসার পোলাপাইন সামলাক। এত পড়নের কামডা কী!

বৃদ্ধার কথায় এবার ব্যাপাক মেজাজ খারাপ হলো মাসনুনের। রুষ্ট মনে চুপ করে বসে রইলো। কারণ নিজের মুখের ব্যবহার করে এখনই কারো চক্ষুশূল হতে চাইনা ও। নেহাৎ পাড়ার দুটো মহিলা এসেছিলো ওকে দেখতে। তার জন্যেই এমন সঙ সেজে বসে থাকতে হচ্ছে। তন্মধ্যে দরজার কাছে দুটো বাচ্চার হাসির শব্দ কানে এলো। সাথে একটা পুরুষোচিত গলারও৷ মাসনুন কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।

– মিহির কাল মাত্র বিয়ে করে এলে আর আজও ছেলেমেয়ে নিয়ে বেরিয়েছ এত সকালে
আজ নাহয় বউকেই সময় দিতে।

টুসকি মারা স্বভাবের পাড়ার মহিলাটা এবার এবার পড়লো মিহিরের পেছনে। মিহির চশমার ফাঁকে বড় বড় চাহনি মেলে তাকালো এদিকে। অতঃপর আবারও দুটো বাচ্চার হাত ধরে ভেতরে এগিয়ে এলো। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। ছেলেটা বোধহয় বড়, তবে খুব বেশি হলে বয়স সাত কিংবা আট হবে, এর বেশি নয়। ওরা এগিয়ে আসলে সোফাতে বসে থাকা মহিলা দুটো উঠে দাঁড়ালো। বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মাসনুন। মিহিরের মা রোকেয়া বেগম ওকে ডেকে বললেন,

– এদিকে আই মিহির।

মিহির বাচ্চাদুটোর হাত ধরে শ্লথ গতিতে এগিয়ে এলে পাশে বসতে বললেন তার মা। মিহিরের দাদী খুব গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমা এঁটে বললেন,

– দেখো বউ। আমাদের বাড়িতে লোকজন বলতে তোমার শ্বাশুড়ি আমি মিহির আর বাচ্চাদুটো। মিহিরের চাচাতো ভাইবোন আছে কয়েকটা কিন্তু ওরা এ বাড়ি কমই আসে। মোদ্দাকথা হলো বাচ্চা দুটোর দেখভালের জন্য একটা মায়ের প্রয়োজন। তুমি বুঝতে পারছো তো তোমার দ্বায়িত্বটা?

মাসনুন কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। বৃদ্ধা। এরকম আরও কিছু আদেশ সূচক মন্তব্য করে উঠে গেলে মিহিরের মা নম্র স্বরে বললেন,

– উনি একটু রাগচটা মানুষ। যাকে তাকে যা তা বলে দেয়। ওসব ধোরো না। তোমার যেকোনো প্রয়োজন বা সমস্যার কথা আমায় বলিও আর ওরা হলো রোহান আর রুহি আমার..

– আমার ছেলেমেয়ে

মায়ের মুখের শেষ কথাটুকু কেড়ে নিজেই বলল মিহির। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত ঠেকলেও মাসনুন মন্তব্য করলো না। ছেলেটা উঠে এসে মাসনুনের পাশে বসে বলল,

– তুমি আমাদের মা?

গোলগাল ফর্সা টুকটুকে মুখটা ভীষণ আদুরে। মাসনুন নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে পারলোনা। এক হাত এগিয়ে ওর গালে রেখে চোখ টিপে সম্মতি দিলো। মেয়েটা মিহিরের গা ঘেঁষেই বসে আছে। মাসনুন ডাকলেও এলো না। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা সেরে মিহির উঠে ঘরে গেলে রোকেয়া বেগম রোহান আর রুহিকে নিয়ে ওদের ঘরের দিকে গেলো আর মাসনুনকে নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে বললে মাসনুন উপায় না পেয়ে নিজেও ঘরেই এলো। চোখ ঘুরিয়ে দিনের আলোয় ঘরটা দেখতে লাগলো। একটা খাট,ড্রেসিং টেবিল, বুক সেল্ফ,আলমারি, একটা ছোট টেবিল দিয়ে খুব বড় না হলেও ছোট না ঘরটা। ওর ভাবনার মাঝেই মিহির গোসল করে বেরিয়ে এলো। মাসনুনের দিকে এক পলক চেয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। বা হাতে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মাসনুন লক্ষ্য করলো লোকটা উলটো করে বোতাম লাগাচ্ছে। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো, মিহিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– আপনি শার্টের বোতাম উলটো করে লাগাচ্ছেন কেনো?

মিহির শুনলেও উত্তর করলো না। মাসনুন বেশ কড়া গলায় বলল,

– কেও প্রশ্ন করলে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না! নাকি আমাকেই পছন্দ হচ্ছে না?

হুট করেই এমন ক্ষ্যাপাটে গলাটা যেনো অপ্রত্যাশিত ছিলো। মিহির বোকা বোকা চাহনি মেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,

– এমনি।

মাসনুন বসা থেকে উঠে এলো। নিজ উদ্যোগেই শার্টের বোতাম গুলো খুলে পুনরায় লাগিয়ে দিয়ে বলল,

– সাহায্য লাগলে মুখ ফুটে বললে তো গায়ের কোনো অংশ পচে যাবে না!

– আমিই পারবো।

মিহিরের জবাবে আড়চোখে তাকালো মাসনুন। মিহির হয়তো ভড়কালো কিঞ্চিৎ। কিন্তু তা প্রকাশ না করে চুল আঁচড়ে বের হতে লাগলে মাসনুন পেছন থেকে ডেকে বলল,

– দাঁড়ান

.
.
.
চলমান