বাড়িয়ে দাও তোমার হাত পর্ব-০৫

0
171

#বাড়িয়ে_দাও_তোমার_হাত
#পঞ্চম_পর্ব
#হুমাইরা_হাসান
_____________________

চশমার আড়ালে একজোড়া চঞ্চল চোখ চোরা নজরে আড়চোখে বারংবার দেখছে মোহনীয় চিত্তে আর তারই বাঁ দিকে চেয়ার টেবিলে বসা মানুষটার চোখজোড়া স্থির, নিষ্প্রভ। পদ্মলোচন আঁখি, খাড়া নাক, খোঁপা করা চুলের গোছা সানন্দে এলিয়ে অগোছালো ভাবে পড়ে আছে ফর্সা ঘাড়, পিঠময়। পাতলা ওষ্ঠদ্বয়ের ভাঁজে কলম চেপে খানিক ভাবুক ভঙ্গিমায় স্থির হচ্ছে আবার খাতার বুকে কলমের ঘসঘস শব্দ তুলে লিখছে। কাল বাদে পরশু মাসনুনের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। সেই তাগিদেই সকাল থেকে বই নিয়ে বসে আছে টেবিলে। আজ শুক্রবার হওয়ায় মিহির ও বাড়িতেই। খাটের ওপর বসে ব্যবসার হিসেব মেলানোর কাজে বসেছে৷ কিন্তু কাজ শুধু নামমাত্রই হয়ে রইলো, চোখ দু’টো তো মিনিটে তিনবার সত্তর ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরছে৷ নাকের ডগা থেকে চশমাটা তর্জনী তুলে চোখের কাছে ঠেলে নিজের কাজে মনোনিবেশ করার প্রয়াস করলো মিহির। কিন্তু সে চেষ্টায় দেদারসে এক বালতি জল ঢেলে দিবো মাসনুনের প্রতি সুপ্ত আগ্রহটুকু৷ দীর্ঘক্ষণ নিচে তাকিয়ে থেকে ঘাড় ধরে এসেছে বলে চেয়ারের গায়ে ঘাড় এলিয়ে চোখ বুজলো মাসনুন৷ মিহির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। ফজরের নামাজ পড়ে পড়তে বসেছে মাসনুন, মিহির ও মসজিদ থেকে ফিরে আর ঘুমায়নি। মাসনুনের চেহারায় ক্ষীণ ক্লান্তির অবসাদটা লক্ষ্য করে মিহির কাগজ ফেলে উঠে এলো। বাড়িটা জুড়ে এখনো নিস্তব্ধতা বিরাজমান। ছুটির দিনগুলোতে রোকেয়া বেগম একটু দেরীতে ঘুম থেকে ওঠেন। আর মিহিরের দাদী এমনিতেও নয়টার আগে ঘর থেকে খুব একটা বের হন না। মিহির নিঃশব্দে নিচে রান্নাঘরে এসে দু’কাপ চা বানিয়ে একহাতে ট্রে তুলে বেরিয়ে এলো। সিড়ি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ নিজের সামনে দাদীর সামনে পড়তে ভীষণ রকম অপ্রস্তুত বোধ করলো। ঠিক এই মুহূর্তে ওনার দেখা পাওয়াটা যেনো একেবারেই ধারণাতে আসেনি। মিহিরের বিব্রতবোধে একীভূত মুখ আর আপাদমস্তক পরখ করে এক হাতের তালুতে রাখা ট্রে খানা দেখে বলিরেখার ভাঁজযুক্ত কপালে আরও কয়েকটা ভাঁজ ফেলে বৃদ্ধা বললেন,

– মিহির! সকাল সকাল চা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

– ঘরে দাদী।

অত্যাধিক বিনয়ের সহিত বললেও অপরপক্ষ হতে সাথে সাথে আবারও প্রশ্ন এলো,

– এত সকালে তোকে কে চা করে দিলো? রোকেয়া উঠে পড়েছে?

বলে রান্নাঘরের দিকে চোখ তুলে কৌতূহলী নজর বুলালো। কিন্তু শূন্যস্থান দেখে জিজ্ঞাংসুক দৃষ্টিতে মিহিরের দিকে তাকালে মিহির নিচু গলায় বলে,

– চা আমি করেছি দাদী।

আছিয়া খাতুন নামক মিহিরের দাদী কিয়ৎকাল নির্বিকার চেয়ে অতঃপর বেশ কড়া শব্দে বললেন,

– ওহ সাত সকালে বউয়ের জন্য চা করতে এসেছিস রে হতচ্ছাড়া! ক্যান তোর বউয়ের ঘুম ভাঙেনি?

– সেটা নয় দাদী। আসলে ও খুব সকালে উঠেছে তো অনেকক্ষণ ধরে..

– অনেকক্ষণ ধরে পড়ে তোর বউয়ের মাথা গরম হয়েছে তাই তো? তো ঠান্ডা করতে বরফ নিয়ে যা না , চা দিলে তো উলটে আরও আগুন হবে আর তুই সেই আগুনে ঝ-লসাবি ঢেমনা।

মিহিরের মুখের কথা ছিনিয়ে নিজেই কতগুলো রুষ্টবাক্য ছুড়ে দিয়ে ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে রইলেন বৃদ্ধা৷ মিহির মুখখানা বেজায় রকম কালো করে বলল,

– দাদী কতবার বলেছি আমাকে এই ঢেমনা শব্দটা বলবে না। এটা শুনতে আমার অসহ্য লাগে।

– অসহ্য লাগে তো চা খা ঢেমনা। বিয়ে দিতে না দিতে বউ পাগলা হয়েছে। যাহ্ দূর হ সামনে থেকে গিয়ে বউ সেবা কর গে।

বলে সাদা শাড়ির কুচি ধরে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। মিহির মুখ ফুলিয়ে উপরে ওঠার জন্য দু’কদম এগোলে পেছন থেকে আছিয়া খাতুন ডেকে বললেন,

– বলছি চা যখন বানিয়েছিস তাহলে আমিও খেয়েই হাঁটতে বের হই। সকাল করে পেটে চা না পড়লে গা পিত্তি জ্বলে আমার।

মিহিরের মুখটা এবার করুণতর রূপ নিলো। কেমন অসহায় প্রাণীর মতো অবলা মুখে বলল,

– আসলে দাদী . .

– এখন কী এটা বলবি যে তোর আর তোর মাস্টারনি বউয়ের জন্য দুই কাপই বানিয়েছিলি!

– হু।

মিহিরের দাদীর অবসাদাচ্ছন্ন মুখের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই এমন সম্মতি সূচক বাক্যের উত্তর পেয়ে যেনো ভীষণ রকম তেঁতে উঠলেন মহিলা। কপালের প্রসারিত হওয়া ভাঁজগুলো আবারও জড়ো করে খ্যাঁক করে বললেন,

– ঢেমনা! সাধে কী ঢেমনা বলেছি তোকে। দূর হ! দূর হ আমার সামনে থেকে। তোর মতো বউ সেবক কে আমি দু চোক্ষে দেখতে পারছিনা।

মিহিরের একটু হাসিই পেলো যেনো দাদীর রণচণ্ডী রূপটা দেখে। কিন্তু তা আর মুখে প্রকাশ করার সাহস টা যোগালো না। কারণ এই মুহুর্তে দাদীকে রাগানোর মতো কাজটা আর করার ইচ্ছে নেই। এমনিতেই ক্ষেপে গেছে। তাই চুপচাপ সিড়ি পার করে উপরে উঠে তরতর করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো জান বাঁচিয়ে। আছিয়া খাতুন ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে গজগজ করে বললেন,

– বউ পাগলা ঢেমনা।

এতটুকু বলে গজরাতে বেরিয়ে গেলেন। মিহির ঘরে এসে মন্থর পায়ে এগিয়ে এলো মাসনুনের দিকে। আবারও বইয়ে মুখ গুঁজেছে মেয়েটা। নিঃশব্দে এগিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালে মাসনুন পাশ ফিরে মিহিরকে ট্রে-সমেত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাপক রকম অবাক হলো। এক হাতে ধরে রাখা ট্রে-খানা জলদি করে নিজের হাতে তুলে নিয়ে রাখলো। মিহিরকে জিগ্যেস করলো,

– আপনি চা করে আনলেন?

মিহির ঘাড় নাড়ালো ধীরে। মাসনুন খানিক চুপ থেকে বলল,

– চা খাবেন এটা আমাকে বললে খুব ক্ষতি হতো? একা একা করতে কে বলেছে আপনাকে?

– অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিলেন, ভাবলাম মাথা ধরেছে হয়তো। না খেলে সমস্যা নেই আমি নিয়ে যাচ্ছি

বলে এক হাত এগোলে মাসনুন হাতের কবজিটা ধরে কড়া গলায় বলল,

– বলেছি আপনাকে আমি খাবো না! নিচ্ছেন কেনো?

মিহির চুপ করে সরে গেলো। ও তো ভালোর জন্যেই চা বানাতে গেছিলো। এখন একের পর এক সবাই ওকে ধমকাচ্ছে। মনে মনে একটু রুষ্ট হলো যেনো। এগিয়ে এসে খাটের ওপর বসে কাগজ গুলো গোছাতে লাগলো। মিহিরের স্তব্ধ মুখটা বাঁকা চোখে পরখ করে এগিয়ে এলো মাসনুন। চায়ের একটা কাপ এগিয়ে বলল,

– ধরুন।

মিহির চশমার পড়া চোখটা বড় বড় করে তাকালে মাসনুন ওর হাতে কাপটা ধরিয়ে বলল,

– এনেছেন তো দুটো আমি একা খাবো নাকি?

বলে নিজে মিহিরের হাত থেকে কাগজ গুলো নিয়ে সবটা গুছিয়ে সরিয়ে রেখে কাছাকাছি বসলো। চায়ের কাপে দুবার চুমুক দিয়ে কেমন কৌতূহলী চোখে তাকালো পাশে বসা লোকটার দিকে। মিহির একটু স্বাভাবিক বোধ করলেও মাসনুনের এমন অদ্ভুত চাহনিতে বিব্রত হলো। আড়ষ্টভাব নিয়ে বলল,

– কী?

– চিনি কী চায়ে দিয়েছেন নাকি নিজের শরীরে?

মাসনুনের কথাটি শুনে নিজের দিকে তাকালো এবার। গায়ের সবুজ রঙের টি-শার্টে, হাতের দিকে চিনির ছোট্ট দানাগুলো লেগে আছে। কাপটা দ্রুত নামিয়ে রেখে বাঁ হাতে ঝারতে ঝারতে বলল,

– আসলে এক হাত দিয়ে চিনির কৌটা খুলতে গিয়ে ছিটকে গেছিলো। তখন লেগেছে বোধহয়, খেয়াল করিনি।

মাসনুন ফিক করে হেসে দিলো। মিহির ঘাড় তুলে চমকিত নজরে তাকালো মাসনুনের দিকে। যেনো চশমার গ্লাস ভেদ করে ওর বিস্মিত নজরটা বেরিয়ে আসবে। মাসনুন এবাড়িতে আসা এতগুলো দিনে এর আগে এভাবে হেসেছে কী না মনে করতে পারলোনা। মাসনুন এবার হাসি থামিয়ে বলল,

– এভাবে তাকানোর কী আছে? আমি কী হাসতেও পারবোনা?

মিহির নিরুত্তর নিজের চোখদুটো সরিয়ে নিলো। মিহিরকে অতিমাত্রায় অপ্রতিভ, হতবিহ্বল করে দিয়ে মাসনুন এগিয়ে এসে আরও কাছাকাছি বসলো। নিজের ওড়নার আঁচল তুলে মিহিরের গলা মুখে লেগে থাকা চিনির কণা গুলো মুছে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

– একা একা রান্নাঘরে যাবার দরকার নেই। যা লাগবে আমায় বলবেন। আপনি বোবা হতে পারেন আমি কানে কালা নোই।

মিহির নিশ্চুপ রইলেই মাসনুন আবারও বলে,

– সারা গায়ে তো চিনি মাখিয়েছেন। গোসল করে নিবেন, না তো পিঁপড়ে আপনাকেই খেয়ে ফেলবে।

বলে আবারও হেসে ফেললো। সরে গিয়ে নিজের কাপের চা শেষ করে উঠে টেবিলে বসলো। আরও কিছুক্ষণ পড়ার পরে ঠিক সাড়ে আটটার দিকে ঘর থেকে বেরোলো। রোকেয়া বেগম একটু আগেই উঠেছেন৷ মাসনুন রুহি আর রোহানকে ডেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে আনলো। দুজনের জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনে দিলে ওরা খাওয়া শেষ হতেই মিহির নেমে দুজনকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলো। মিহিরের এই স্বভাবটা মাসনুনের খুব পছন্দের। হার রোজ নিয়ম করে ফজরের নামাজ পড়ে নিজের কাজ গুলো সেরে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়। শুক্রবার একটু দেরীতে বের হলেও মিস করে না। রুহি ছোট বলে খুব সহজেই ওকে বাঁ হাতে তুলে কোলে নেয় আর রোহান ওর পকেটে গুঁজে রাখা হাতটা ধরেই কত আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। মাসনুন মাঝে মধ্যেই ভাবে কত সানন্দে দুটো বাচ্চা নিজের চাচাকে বাবা বলে সম্বোধন করে বেড়ে উঠছে তার হাত ধরে। আর মিহির ও নিজের সন্তানের পরিচয়ে গড়ে তুলছে। খেতে বসলে নিজের বাঁ হাতের চামচে করে দুজনের গালে খাবার তুলে দেয় তবুও একচুল অভিযোগ রাখতে দেয়না৷ আবার বাচ্চাটাও কেমন মিহিরের নিষ্প্রাণ হাতটা ধরেই হেঁটে বেড়ায় অথচ একবারও অভিযোগ তুলে বলে না ‘বাবা তুমি রুহিকেই শুধু কোলে নাও! আমায় নাওনা কেনো? মাসনুন ভারী অবাক হয়, যেখানে আজকের সময়ে অন্যের ঘাড়ে পা রেখে মানুষ উপরে ওঠার রাস্তা খুঁজে নেয়। মানুষ বেঁচে থাকলেও তার কদর না করে স্বার্থপরের মতো এড়িয়ে যায় সেখানে নিজের অসুবিধাকে অগ্রাহ্য করে লোকটা কীভাবে ভাইয়ের ঋণ বাবা হয়ে শোধ করছে! মাসনুন একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারে যে পেলেপুষে, বুকে ধরে বড় করা বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার মতো অমানুষ ও যেমন আমাদের সমাজে আছে তেমনি ভাইয়ের অবদান কে কখনও না ভুলে তার প্রতিদান স্বরূপ এতটা প্রতিদান দেওয়ার মতো মানুষ ও আছে।

•••

দুপুরে জুম্মার নামাজের পর রোহানকে নিয়ে মসজিদ থেকে ফিরেছে মিহির। ওকে নিচে রুহির সাথে রেখে উপরে উঠে এলো। হন্তদন্ত হয়ে দরজাটা খুললেও অকস্মাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মাথার টুপিটায় হাতটা দ্রুতগতিতে বাড়ালেও খুব রোমন্থন গতিতে হাতটা নামিয়ে আনলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে সামনে চেয়ে রইলেন। মাসনুন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিহিরের দিকে, চোখাচোখি হলে মিহির নিজের চোখটা ফিরিয়ে নেয়। টুপিটা রেখে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা পকেটে গুঁজে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলেও চোখদুটো কেমন অবাধ্যের মতো পাশ ফিরে চলে যাচ্ছে বেগুনি রঙের শাড়ি পরিহিতা শুভ্র রমণীর পানে। স্নিগ্ধ, অপরূপ সৌন্দর্য্যে মোহাবিষ্ট হচ্ছে মিহির নিমিষেই। ওর ধ্যান ভঙ্গুর হলো ফোনের রিংটোনের শব্দে। মাসনুন কুচি ছেড়ে ফোনটা তুলে কানে ধরে বলল,

– আসসালামু আলাইকুম আব্বু! কেমন আছো?

ওপাশ থেকে সুবহান কবির খুব উচ্ছ্বাসিত স্বরে বললেন,

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?

– ভালো আছি আব্বু। আম্মু কোথায়?

– এইতো পাশেই..

বেশ কিছুক্ষণ বাবার সাথে কথা বলল মাসনুন। বিয়ের পরদিন স্বাভাবিক ভাবে বাপের বাড়িতে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও মাসনুনের যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দূরত্ব টা বেশ খানিক এবং মিহিরের বাড়ি থেকেও কিছুদিন পর যেতে বলেছিলো। সবটা সেরে উঠতেই আবার পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিলো। এখান থেকে মাসনুনের ভার্সিটি কাছাকাছি হওয়ায় বেশ সুবিধা হয় তাই পরীক্ষাটা শেষ করে যাবে বলে জানালো। ফোনটা রেখে আবারও শাড়ির কুচিতে হাত দিলো। চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে রেখেছে মাসনুন। ঠিক এই কারণেই শাড়ি নামক ঝামেলাযুক্ত বস্তুটা ওর কম পছন্দ। কুচির ভাঁজগুলো কোনো ভাবেই ঠিক রাখতে পারেনা। মাসনুনের চরম বিরক্তিকে মুহুর্তেই দক্ষিণা বাতাসের ন্যায় শীতল করে দিয়ে মিহির এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। বাঁ হাতের আঙুলে শাড়ির কুচি গুলো টান করে সাজিয়ে দিলো। অবশেষে যেনো শান্তি মিললো মাসনুনের খুঁতখুঁতে মনটায়। গালটা প্রসারিত হলো কিঞ্চিৎ। তবে মিহিরকে ধন্যবাদ দেওয়ার আগে ও ক্ষীণ স্বরে বলল,

– শাড়ি পরেছেন যে?

– এমনিই।

মিহির আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নিচে নামলে আছিয়া খাতুনের মুখোমুখি হলে ভ্রু কুঁচকে এলো তার দৃষ্টি দেখে। সকালের ঘটনার পর থেকে আর দাদীর মুখোমুখি হতে হয়নি কিন্তু এখন বৃদ্ধার চোখ মুখ দেখে আবারও অস্বস্তি জেঁকে ধরলো। তবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রোহান আর রুহির পাশে গিয়ে বসলেই কানে এলো সেই কণ্ঠস্বরটা,

– কী রে বউ সেবক। বউ ছাড়াই খেতে চলে এলি তোর বউ রাগ করবেনা তো?

ওখানে শুধু মিহির একাই নয় আজ ওর চাচাতো দুই বোন সিমি আর ভাই শিহাব ও ছিলো। ওরা আজ ছুটি পেয়ে ঘুরতে এসেছে। ওদের সামনে এহেন কথা বলায় খুব বেশি অস্বস্তিতে পড়লো মিহির৷ ও জানে ওর দাদী মানুষটা এমনই। কিন্তু ত বলে ছোটদের সামনে!

– বউ সেবক! সেটা আবার কাকে বলছো দাদী?

সিমির কৌতূহলী কণ্ঠের প্রশ্নে আছিয়া খাতুন মিহিরকে দেখিয়ে বলল,

– ওই যে দেখতে পাচ্ছিস না ঢেমনাটাকে! সাত সকালে বউয়ের জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে এসে চিনি দিয়ে গোসল করেছিল। কোই আমায় তো একগ্লাস পানিও দিস না রে।

সকালের ঘটনার রেশ ধরে এখনো এইরকম হেনস্তা করায় খুব বিরক্ত হলো মিহির। এখন নিজের কপাল নিজেরই চাপড়ানোর মতো ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিচ্ছে। ততক্ষণে মাসনুন ও নেমে এসেছে,আছিয়া খাতুনের কথা গুলো বেশ স্পষ্ট ভাবেই কানে বিঁধেছে ওর। দাদীর কথার প্রত্যুত্তর করতে চাইলেও মাসনুনকে দেখে মুখখানা শুকিয়ে এলো মিহিরের। মনে মনে বলল,

– এই খোটা টা যদি রাগী ম্যাডামকে দেয় তাহলে আজ আমায় ভস্ম করে দেবে।

মাসনুন কুঞ্চিত ললাটে এগিয়ে এলে ওকে দেখে সিমি স-উৎসাহে বলল,

– এইতো ভাবী এসেছে। সেই যে বিয়ের পরদিন দেখে গেলাম তারপর তো আর দেখায় হলো না।

মাসনুন স্মিত হেসে এগোলো। রোকেয়া বেগমের সাথে খাবার গুলো এনে বেড়ে দিলো। রোহান আর রুহির জন্য খাবার নিয়ে খাইয়ে দিতে বসলে ওদিকে মিহির সিমি আর শিহাবের সাথে টেবিলে বসলো। ঠিক তখনই আছিয়া খাতুন আবারও নিজের কথার তুবড়ি ছুটিয়ে বললেন,

– বউকে ছাড়া খেতে বসলি ক্যান মিহির! বউকে ছাড়া চা খাসনা ভাত খেতে বসেছিস ক্যান? তুই না বউ পাগলা!

মিহির খাবারের চামচ টা মুখে তুললেও দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো। দাদীর দিকে না চাইলেও আড়চোখে মাসনুনের দিকে তাকালো। মাসনুন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে মিহিরের দিকে, যার ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলো না এক চুল। মনে মনে নিজের অজান্তেই বলল,

– এই বুড়িটার জন্য আজ আমার খবর কাগজে উঠবে, কনফার্ম।

.
.
.
চলমান

#Humu_❤️