বাবুই পাখি পর্ব-০৩

0
970

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩
Writer-Afnan Lara
.
সকাল হয়েছে আরও আগেই।এখনও বালিশ জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে পুতুল।ইমাদ সবার আগে উঠেছিল।রুটি চারটা বানিয়ে হটপটে ঢুকিয়ে এখন ডিম ভাজছে সে।ডিম ভাজার ঘ্রান নাকে এসে লাগতেই পুতুল উঠে গেলো।মাথায় হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে তার নিজের বাসায় নেই।তড়িগড়ি করে বিছানা ছেড়ে রুম থেকে বের হলো সে।ইমাদ ডিম উল্টাতে উল্টাতে বললো,”ফ্রেশ হয়ে নিন।নাস্তা অলমোস্ট ডান।আমায় আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।আজ আমাদের লাস্ট ডে ”
.
পুতুল এক দৌড়ে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।ইমাদ বাবাকে ফোন করলো জানার জন্য যে তিনি আসবেন কিনা।বাবা জানালো আরও কটাদিন পর আসবেন।তাই ব্যাগটা গুছিয়ে সোফার উপর এনে রাখলো সে।পুতুল গায়ের ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এসে ডাইনিং টেবিলের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।ইমাদ মাথা তুলে বললো,”আমার বাসায় এক্সট্রা তোয়ালে নেই।আসার সময় নিয়ে আসবো।আপাতত ওড়না দিয়েই চালান।পুতুল অবাক হয়ে বললো,”আমি তো কদিন পর চলে যাব।শুধু শুধু তোয়ালে কিনতে যাবেন কেন।?”
.
-“তোয়ালে একটার দাম আর কতই হবে।আপনাকে ওসব ভাবতে হবে না।নাস্তাটা করে নিন।আমি দুপুরে আসার পথে খাবার কিনে আনবো”
.
পুতুল ব্রু কুঁচকে বললো,”কিনে আনবেন কেন?আপনার বাসায় তো চাল ডাল সব আছে।আমি রান্না করতে পারি”
.
-“পারলে??আপনি মেহমান।আর মেহমানকে দিয়ে কাজ করানো যায় না।সুতরাং আমি কিনে আনবো।ফ্রিজে অনেক খাবার আছে।খিধে পেলে খাবেন”
.
-“হ্যাঁ দেখলাম।দশ দিনের পুরোনো পিজ্জা ও আছে”
.
-“সময়ের কারণে ফেলতে পারিনা।আপনি আবার ফ্রিজ চেক করলে ফেলে দিয়েন।এখন রুটি মুখে দেন”
.
পুতুল মুখে হাত দিয়ে হেসে চেয়ার টেনে বসলো।চুপচাপ খাচ্ছে আর ইমাদকে দেখছে সে।ইমাদ চা বসিয়ে এসে রুটি হাতে টিভি দেখছে।পুতুল হালকা কেশে বললো,”আপনি খাচ্ছেন না যে?”
.
-“খাবো।আমি চা দিয়ে রুটি দিয়ে খাই।ডিমটা আপনার জন্য ভাজলাম”
.
-“ওহ!ভাজা দেখে মনে হয় এক্সপার্ট। তো আগে কে খেতো?”
.
-“আমার বাবা খায় ডিম।বাবা কদিনের জন্য অফিসের কাজে বাহিরে গেছে”
.
-“ওহ আচ্ছা।আপনার মা,ভাই, বোন তারা কি গ্রামের বাড়িতে থাকে?”
.
-“নাহ।এখানেই থাকে”
.
পুতুল এদিক ওদিকে তাকিয়ে বললো,”কোথায়?”
.
-“খাওয়ার সময় এত কথা বলতে হয় না।এত প্রশ্ন করবেন না।একদিনের পরিচয়ে ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করা যুক্তিযুক্ত নাহ”
.
পুতুল ব্রু কুঁচকে পানি খেয়ে বললো,”আমিও সকালে চা খাই”
.
ইমাদ চ্যানেল পাল্টে বললো”জ্বী।আপনার জন্য ও দিয়েছি”
.
-“আমি রেডি করে আনি?”
.
-“বললাম না মেহমানকে দিয়ে কাজ করাই না আমি।আমার অভ্যাস আছে এসব করার।সুতরাং খাওয়া শেষ হলে বসে টিভি দেখেন।হিন্দি সিরিয়াল দেখেন তাই তো?জি বাংলা দিলাম।রিমলি চলে।বসে বসে দেখেন।আমি আনতেছি”
.
পুতুল টিভির দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি সিরিয়াল দেখি না।দুরন্ত চ্যানেলে সিসিমপুর দেখি এসময়ে।”
.
ইমাদ রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো,”চ্যানেল ৩৫ এ দুরন্ত।কেন যে এমন বাচ্চা মেয়েদের তাদের ফ্যামিলি বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে!”
.
-“কি বললেন?আমি মোটেও বাচ্চা না।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট আমি”
.
ইমাদ চা ঢালতে ঢালতে বললো,”আর আমার পড়াশুনা শেষ।আজ লাস্ট দিন”
.
-“আপনার সাথে মেলান কেন?আপনার তো সব সেট করা।
কেউ জোর করে নাই।জোর করলে বুঝতেন”
.
ইমাদ ঠাস করে ট্রেটা সেন্টার টেবিলের উপর এনে রেখে বললো,”জোরটা আমার সাথেও হয়েছে।আপনি বুঝবেন না।চা খান”
.
-“আপনার সাথেও?”
.
কলিংবেল বেজে উঠলো।ইমাদ পুতুলের হাত ধরে টান দিয়ে রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,”দরজা ভেতর থেকে লক করেন”
.
পুতুল দরজা লক করলো তার রুমের।ইমাদ বড় করে শ্বাস নিয়ে দরজা খুললো।ওপারে সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে।হলুদ রঙের সেলোয়ার কামিজ পরে চুলটাকে বেনি করে বেশ দারুন সেজে এসেছে সে ইমাদের বাসায়।ইমাদ হাসার চেষ্টা করে বললো,”এসময়ে তুমি?”
.
-“কেন আসতে পারি না?ভেতরে আসতে বলবে না?”
.
-“আরে আসে আসো।”
.
সিনথিয়া রুমে ঢুকেই সেন্টার টেবিলের উপর দুকাপ চা দেখে বললো,”আঙ্কেল বাসায়?কিন্তু আন্টি যে বললো তিনি নাকি কোথায় গেছে কাজের জন্য”
.
-“হ্যাঁ।”
.
-“তাহলে দুকাপ চা কিসের?”
.
-“আমার প্রচণ্ড মাথাব্যাথা করছে তাই দুকাপ বানালাম।”
.
সিনথিয়া সোফায় বসে এক কাপ হাতে নিয়ে বললো,”তুমি কি নতুন পারফিউম ইউজ করা শুরু করেছো??অন্যরকম স্মেল আসছে রুম থেকে”
.
ইমাদ মাথা চুলকে বললো,”হ্যাঁ।কিসের জন্য আসছো?”
.
-“তোমার সাথে ভার্সিটিতে যাব।আজ তো তোমাদের লাস্ট ডে।পার্টিতে থাকতে চাই।জলদি রেডি হয়ে আসো”
.
ইমাদ নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেলো।সিনথিয়া টিভি দেখছে।পুতুল বিছানায় বসে মুখে হাত দিয়ে রেখেছে।মনে হচ্ছে সে লুকোচুরি খেলছে।ধরা খেলেই আউট।দম বন্ধ লাগছে।কথা বার্তায় বুঝলো সিনথিয়া এসেছে।
এদিকে সিনথিয়াকে দেখার প্রবল ইচ্ছা কানের কাছে এসে বলছে দরজা ফাঁক করে দেখে আসো পুতুল!!!!
অনেক ভেবে দরজা খুললো পুতুল।একটু ফাঁক করার আগেই সামনে ইমাদ এসে দরজার সামনে পর্দা টানিয়ে বললো,”এই রুমটা অনেকদিন বন্ধ পড়ে আছে।পর্দা টানালাম।মেহমান তো আসে না”
.
সিনথিয়া চায়ের কাপ রেখে বললো”হ্যাঁ ঠিক আছে।রেডি হলে?”
.
-“হুম।চলো যাই।”
.
সিনথিয়া আছে বলে বাধ্য হয়ে ইমাদ মেইন দরজা বাহিরে দিয়ে লক করলো।পুতুল এবার বের হয়েছে রুম থেকে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো সে।সিনথিয়াকে নিয়ে ইমাদ একটা রিকশায় উঠেছে।আরেকদিকে গেছে বলে মুখ দেখলো না পুতুল
তাই মন খারাপ করে টিভি অন করে বসলো সে।।
——
-“তোমার মেয়ে মুখে চুনকালি লাগিয়ে ছাড়লো”
.
-“সব তোমার কারণে হয়েছে।কি দরকার ছিল এত জোর করার?পুতুল সাইমনকে পছন্দ করে না আগেও বলেছিল”
.
-“ওর পছন্দ কেমন?সাইমন আমার চোখে বেস্ট একটা ছেলে ওর জন্য।নিজের ভালো বোঝে না সে”
.
আসাদ নিউজপেপার টেবিলে ছুঁড়ে মেরে বললো,”এরপর ওকে বিয়ে দিতে খুঁজবো না।একেবারে খুন করার জন্য খুঁজবো”
.
-“এভাবে বলিস না।তোর বোন হয়”
.
-“বোন?কিসের বোন মা??মানইজ্জত কিছু রেখেছে সে?সামনে পেলে মেরে ফেলবো ওরে।”
.
-“আসাদ থামো।পুতুলকে পেলে আমরা সাইমনের সাথে বিয়ে দিয়ে ছাড়বো।সাইমন বলেছে ওকেই বিয়ে করবে।চিন্তার কিছু নেই।এখন ওকে খুঁজতে হবে আপাত ”
.
-“ঠিক বলেছো বাবা”
.——-
সিনথিয়া হঠাৎ ইমাদের হাত চেপে ধরলো।ইমাদ হালকা নড়ে বললো,”আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি সিনথিয়া”
.
-“হয়নি তো কি হয়েছে? মানুষ বিয়ের আগে কিস ও করে ফেলে আর তুমি আমায় হাত ধরতে মানা করছো?চলো না রেস্টুরেন্টে যাই।ডেটে”
.
-“নাহ।বিয়ে ঠিক হয়নি এখনও।আমি আমার জব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।”
.
-“তো কি হয়েছে?আমি কি ডিস্টার্ব করছি নাকি।তুমি তোমার ক্যারিয়ার সামলাও।আর আমি তোমায় সামলাই”
.
ইমাদ চুপ হয়ে আছে।কিছু বলছে না।সিনথিয়া হাতটা সরিয়ে বললো,”আমায় কি তোমার পছন্দ না?”
.
ইমাদ ফোন টিপতে টিপতে বললো,”আমার মা তোমায় পছন্দ করেছে।মায়ের পছন্দই আমার পছন্দ”
.
-“তোমার মায়ের পছন্দ আস্ক করছি না আমি।তোমার মত জানতে চাইছি”
.
-“বললাম তো।মা যা বলবে তাই হবে।ভার্সিটি এসে গেছে।থামান মামা।”
.
ইমাদ রিকশা থেকে নেমে টাকা দিয়ে হেঁটে চলে গেলো।
সিনথিয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো নিচে।সে ইমাদের চলে যাওয়া দেখছে
-“একটা মানুষকে ভালোবাসা যতটা সহজ তার থেকে সেই ভালোবাসাটা আশা করা ঠিক তেমনই কঠিন।বিয়ের কথা চলছে দুমাস হলো।অথচ সে আজ পর্যন্ত আমার চোখে চোখ রেখে হাসেনি।তার চোখে আমি আমার জন্য কিছু দেখি না।সে আমায় ভালোবাসা তো দূরে থাক পছন্দ ও করে না।আমি জানি তার মা বাধ্য করেছে বিয়েতে মত দিতে।আর আমি বেঈমানের মতন খুশিতে প্রতিদিন আনন্দ করি।আমি অন্যায় করছি তার সাথে।আমি চাইলে এই বিয়েটা আটকে রাখতে পারি।জানি সে বিয়েটা চায় না।মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বিয়েতে মত দিয়েছে তারপরেও আমি স্বার্থপরের মতন তাকে সব কিছুতে জোর করছি।”
—–
পুতুল পুরো বাসা পরিষ্কার করছে।একা আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়।
ইমাদের আলমারি বাদে ওর সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে সে।আলমারি ধরলো না।যদি তাকে বকে সে ভয়ে।ঝাড়ু দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ওয়াসরুমে আসলো সে।বাথরুম পরিষ্কার করবে নাকি করবে না সেটাই ভাবছে।
——
-“কিরে ইমাদ?ঐ মেয়েটার কি করলি?”
.
একটা পেস্ট কালারের চেয়ার টেনে বসে ইমাদ বললো,”সে বিরাট কাহিনী”
.
রিজবি ওর সামনে বরাবর চেয়ার টেনে বসে বললো,”বল শুনি”
.
-“বাকিরা কই?শুধু কি তুই কাহিনী শুনবি?”
.
রিজবি মাথা তুলে চঞ্চল, দিদার আর টুটুলকে ডাক দিলো।দিদার একটা কাজে গেছে বলে আসতে পারেনি।তবে বাকিরা এসে বসেছে।ইমাদ ওদেরকে পুরো ঘটনাটা বললো
রিজবি ইয়া বড় হা করে বললো,”সিনথিয়া জানলে কাঁচা গিলে খাবে তোকে”
.
-“জানবে কি করে?”
.
-“কতদিন এভাবে থাকবি?”
.
-“জানি না।তবে যেটা ঠিক মনে হলো সেটা করলাম।এটাও জানি না এরপরে কি হবে।ঐ মেয়েটার সুরক্ষা জরুরি”
.
-“ঐ মেয়েটার চৌদ্দ গুষ্টি যদি তোর পিছে লাগে?”
.
-“আমাকে চিনবে কি করে?ওরা যদি আমার পিছে লাগে তবে আমিও ওদের পিছে লাগবো।”
.
টুটুল হাসতে হাসতে শেষ।ওরা হাসা দেখে বাকিরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
.
-“আরে ভাই সিনথিয়া ভাবী আসছে তাই হেসে তোরে সতর্ক করে দিলাম”
.
সবাই একসাথে পেছনে তাকালো।সিনথিয়া ইমাদের পাশে বসে বললো,”কি খবর তোমাদের?”
.
-“ভালো আপু।তোমার?”
.
-“ভালো।তোমাদের বন্ধু আমায় যেমন রাখছে আর কি।একটু রোমান্টিকতা তো শেখাতে পারো।একদমই নিরামিষ টাইপের”
.
ইমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো,”আমায় রোমান্টিকতা শেখাতে হবে না।যার জন্য আসার সেটা এমনিতেই এসে যাবে।জোর করে কিছু হয় না।”
.
সিনথিয়া মুচকি হেসে বললো,”তা সেটা কবে আসবে?”
.
ইমাদ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে গেলো।সিনথিয়া মন খারাপ করে রিজবির দিকে তাকিয়ে বললো,”কি করলে ইমাদের মন মত হবে বলো?”
.
-“ওকে একটু একা থাকতে দিন।সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবে”
.
ইমাদ দূরে গিয়ে বসেছে।মায়ের কল এসেছে।রিসিভ করে কানে ধরতেই মা এক গাদা বক্তব্য শুনিয়ে দিলেন।সব সিনথিয়াকে নিয়ে।সিনথিয়ার সাথে ভালো করে কথা না বললেই মায়ের কাছে বিচার দেয়।মায়ের কথা শেষ হওয়ার পর ইমাদ বললো,”সরি।নেক্সট টাইম ঠিক করে কথা বলবো”
.
-“তোর বাবা ফিরেছে?”
.
-“না।কদিন পর ফিরবে”
.
-“একা একা কি করিস?আমার বাসায় এসে লাঞ্চ করিস।আমার কাছে থাকলে কি হয় তোর?”
.
-“পনেরো দিন তোমার কাছে ছিলাম।এবার বাবার কাছে পনেরো দিন থাকতে হবে।হিসাব না মানলে বাবা রাগ করবে”
.
-“এখন তো তোর বাবা নাই।এখন থাকলে কি সে রাঙামাটিতে থেকে দেখবে?%
.
-“না পসিবল না।আমার জব নিয়ে অনেক কিছু রেডি করতে হবে।”
.
-“আমার এখানে এসে করা যায় না?”
.
-“সিনথিয়ার ফ্যামিলি আসবে?তাই এমন করছো?”
.
-“ঠিক ধরেছিস।উনারা এঙ্গেজমেন্টটা করাতে চাইছেন খুব করে”
.
-“সম্ভব নাহ।বিয়েতে রাজি হয়েছি তোমার মতে।বিয়েটা হবে আমার মতে।আমি যেদিন বলবো সেদিন।সব কিছুর তারিখ আমার মতে হবে”
.
-“তুই তো পরে পরে বলে এক মাস শেষ করেছিস”
.
চলবে”””