বাবুই পাখি পর্ব-০৪

0
817

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪
Writer-Afnan Lara
.
-“আচ্ছা সময় করে আসবো।তবে এখন না।একটা কাজে বিজি আছি।বাই”
.
ইমাদ সিনথিয়ার ভয়ে স্টেজের পেছনের সাইডের দিকে চলে গেছে।ফোনে আবারও কল আসছে দেখে ফোন চেক না করেই কানে ধরে সে বললো,”বললাম তো সময় করে একদিন আসবো”
.
-“আমি বলছি”
.
-“কে?”
.
-“পুতুল চৌধুরী”
.
-“আপনি!আপনার কাছে ফোন আছে?আমার নাম্বার পেলেন কই!
কোনো সমস্যা হয়েছে?আমি আসবো?”
.
-“নাহ।আপনার বাসায় ল্যান্ডলাইনের নাম্বার এটা।চেক করে দেখুন।আর আপনার নাম্বারটা কাল রাতেই মুখস্ত হয়ে গেছে আমার।
কল করলাম বলতে যে আসার সময় খাবার কিনে আনতে হবে না।
আমি আমার বাবারই বাধ্য মেয়ে ছিলাম না।আর আপনি তো!!!যাই হোক
দুইটা পদ রেঁধেছি।বেশি না।সময় করে এসে খেয়ে যাবেন।”
.
-“আপনাকে মানা করেছিলাম।ঠিক আছে জলদি আসবো। এখানে আমার কাজ প্রায় শেষের দিকে।”
.
-“কোথায় জলদি যাবে ইমাদ?”
.
ইমাদ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললো,”দিদার কল করেছিল সিনথিয়া!তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে পারো।আমার অনেক কাজ।তোমায় টাইম দিতে পারছি না”
.
-“জানোই তো আমি এই ভার্সিটিতে পড়ি না।
কাউকেই তেমন একটা চিনি না।তোমার সাথে থাকতে সহজ ফিল করছি।
.
-“আমি তোমার সাথে কখন মিসবিহেভ করেছিলাম?সব কথা মাকে বলতে যাও কেন?এমনটা করে তুমি আমার চোখে আরও নিচে নামছো এর বেশি কিছু না”
.
কথাটা বলে ইমাদ পাশ কেটে চলে গেলো।সিনথিয়া মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে।ইমাদ ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা দোকানে এসেছে তোয়ালে কিনবে বলে।সেই দোকানে আসাদ ও এসেছে রুমাল কিনতে।ইমাদকে দেখে ব্রু কুঁচকে বললো,”আপনাকে মনে হয় কোথায় যেন দেখেছি”
.
ইমাদ গায়ের শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে দাঁত কেলিয়ে তোয়ালের প্যাকেটটা হাতে মুঠোবন্দি করে ধরে বললো,”কাল রাতে সামওয়ান স্পেশালকে চুম্বন করতে দেখেছিলেন”
.
আসাদ বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,”ওহ হ্যাঁ তুমি সেই ছেলেটা না??আবার বলছো এসব।আজকালকার ছেলেরা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে পথ চলে!”
.
-“তাই তো তোয়ালে নিলাম।এখন থেকে এটা দিয়ে ঢেকে করবো।হ্যাপি?”
.
আসাদ মুখ বাঁকিয়ে এক সাইডে চলে গেছে।ইমাদ হাসতে হাসতে চলে আসলো।
——
পুতুল টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে এক এক করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে বারান্দায় এসে বড় করে শ্বাস নিলো।ওপারে যে উর্মি আন্টির বারান্দা সে জানত না।বড় করে শ্বাস নিয়ে ডান পাশে তাকিয়ে উনাকে দেখে কাশি উঠে গেছে তার।কাশতে কাশতে এক দৌড় দেওয়া ধরতেই আন্টি বললেন,”লুকাতে হবে না।দেখে ফেললাম”
.
পুতুল ঢোক গিলে আমতা আমতা করছে।আন্টি চেয়ারে বসে বললেন,”বিয়ের আগে এভাবে থাকা ঠিক না বুঝলে মেয়ে?অজান্তেই ভুল হয়ে যেতে পারে।ভুলটা বিয়ের পরে হওয়ায় ভালো বলে মনে করি আমি”
.
পুতুল গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললো,”আন্টি উনি তো বাসায় নেই।আমি জাস্ট রান্না করতে এসেছিলাম।উনার বাবা নেই তো বাসায়।বাহিরে থেকে কিনে খাবে বললেন তাই আমিই বানিয়ে দিতে আসলাম”
.
-“আমাকে বললেই হতো।কুচোচিংড়ি দিয়ে লাউ রেঁধেছি।এটা তো ইমাদের পছন্দের খাবার।
যেদিন রান্না করি সেদিন এক বাটি পাঠাই।অবশ্য আজও পাঠাতাম।আরিয়ান এখনও আসেনি।ওকে দিয়ে পাঠাবো।”
.
-“আরিয়ান কে?”
.
-“আমার নাতি।আপন না।উপরের তলার ফ্ল্যাটে থাকে।”
.
-“ওহ আচ্ছা।”
.
পুতুল কোনোরকমে কেটে পড়েছে।দম ফেলার পর মনে আসলো কোথা থেকে আওয়াজ আসছে।ছুটে গেলো সে ওয়াসরুমে।ভুলে ঝর্না অন করে সে এতক্ষণ বাহিরে ছিল।
—-
দুপুর ১টার সময়ে ইমাদ বাসায় ফিরেছে।দরজার লক খুলে বুঝলো ভেতর থেকেও লক করা তাই কলিংবেলে চাপ দিলো। পুতুল ছুটে এসে দরজা খুলে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললো,”আমি না একটা ভুল করে ফেলেছি”
.
ইমাদ পুতুলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললো,”আপনি এত ভিজলেন কি করে?”
.
-“ঐ আসলে আমার রুমে যে ওয়াসরুম আছে ওটার ঝর্না কিছুতেই অফ করতে পারছি না।”
.
ইমাদ চাবিটা পুতুলের হাতে ধরিয়ে গেলো সেদিকে।
নিজে বহুত চেষ্টা করেও কলটা অফ করতে পারলো না।
নিজেও এক গাদা ভিজে বের হয়ে দাঁড়ালো এখন।
পুতুল চোরের মতন লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে।ইমাদের ভেজা চুল বেয়ে পানি পড়ছে নিচে।হাত দিয়ে চুলগুলোকে মুঠোবন্দি করে চেপে পানি ফেলতে ফেলতে সে নিজের রুমে চলে গেলো।
সবসময় গরুর ঘরের মতন হয়ে থাকা তার রুমটা আজ মানুষের রুম বলে মনে হচ্ছে।এটা যে পুতুলের কাজ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।আলমারি খুলে ভেতরে আগোছালো জামাকাপড় দেখতে পেয়ে সে এটাও বুঝতে পারলো পুতুল আলমারিতে হাত দেয়নি।এরপর নিজের একটা টিশার্ট নিতেই ওর মাথায় আসলো পুতুল ও একই ভাবে ভিজেছে।রুম থেকে বেরিয়ে সোফার উপর থেকে তোয়ালের ব্যাগটা নিয়ে পুতুলকে ডাক দিলো সে।পুতুল ছুটে এসে বললো,”সরি আমি আসলে….”
.
-“নিন এটা দিয়ে চুল মুছে নিন।আমার বাসায় তো মেয়েদের জামাকাপড় নাই।সারাক্ষণ এমন ভেজা জামায় থাকবেন?”
.
পুতুল একটা হাঁচি দিয়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে চলে গেলো।ইমাদ নিজের রুমে ফিরে এসেছে।গায়ের জামা পাল্টে বিছানায় বসে আছে এখন।পুতুল তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতেছে রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে।ওয়াসরুম থেকে ঝর্নার পানি পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে কানে।কিরকম একটা অস্বস্তি কাজ করছে মাথায়।হালকা কাশির আওয়াজ পেয়ে পুতুল চমকে পেছনে তাকালো।ইমাদ তার একটা পাঞ্জাবি বিছানার উপর রেখে চলে গেছে।পুতুল ব্রু কুঁচকে পাঞ্জাবিটার দিকে তাকিয়ে আছে
-“নায়করা নায়িকাকে তাদের শার্ট দেয় শুনেছিলাম।তবে আমায় দেখি পাঞ্জাবি দিলো।
বিয়ে ঠিক করা নায়ক তাই হয়ত!”
.
হাসতে হাসতে পাঞ্জাবিটা হাতে নিলো পুতুল।ইমাদ চেয়ার টেনে খেতে বসেছে।এক লোকমা মুখে দিয়ে পুতুলকে তার পাঞ্জাবি পরে আসতে দেখে হেসে ফেললো সে।পুতুল মাথা নিচু করে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
ইমাদ হাসি আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।সেসময়ে কলিংবেল বেজে উঠতেই পুতুল বললো সে দরজা খুলবে।ইমাদ বললো আগে দেখতে যে কে এসেছে।পুতুল দরজার ফুটো দিয়ে চেক করে খুললো।ওপারে আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে।পাঁচ/ছয় বছরের বাচ্চা।হাতে এক বাটি তরকারি।পুতুলকে ছেলেদের পাঞ্জাবি পরে থাকতে দেখে ফিক করে হেসে দিলো সে
তারপর বললো,”তুমি মেয়ে না ছেলে?”
.
-“মেয়ে”
.
-“তাহলে ছেলেদের পোশাক পরেছো কেন?হিহিহিহি!”
.
পুতুল বাটিটা নিয়ে লজ্জায় নড়তেও পারছে না।ইমাদ পাশে দাঁড়িয়ে বললো,”বড়দের নিয়ে হাসাহাসি করা ব্যাড ম্যানার্স আরিয়ান!!এগুলো কে পাঠালো?”
.
-“নানুমণি।আচ্ছা উনি কে?”
.
-“আমি সিনথিয়া”
.
-“উহু!তুমি সিনথিয়া মামানি না।আমি সিনথিয়া মামানিকে দেখেছি।তার নাক মোটা আর চুলে একটু একটু গোলাপি রঙকরা।তোমার চুলতো কালো।”
.
ইমাদ ফিস ফিস করে বললো,”আরিয়ান সিনথিয়াকে একবার দেখেছে”
.
পুতুল জিভে কামড় দিয়ে চলে গেলো।আরিয়ান বললো,”আজ বিকালে ছাদে খেলতে যাবে আমার সঙ্গে?”
.
-“নাহ।আমার অনেক কাজ।আরেকদিন খেলবো।”
—–
পুতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোবট হয়ে গেছে।ইমাদ চেয়ারে বসে ওদিকে তাকিয়ে বললো,”আমি সন্ধ্যায় বাজারের দিকে যাব একবার।আসার পথে থ্রি পিস কিনে আনবো নাহয়।কতদিন এক জামায় থাকবেন”
.
পুতুল ইমাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোয়ালেতে টাকা খরচ করেছেন আর লাগবে না।এমনিতেও চলে যাব দুদিন পর”
.
-“আমাদের বাসায় মেহমান আসলে মাকে দেখতাম মেহমানের বাচ্চাকে নতুন জামা কিনে দিতো তারা চলে যাওয়ার সময়।তাই আমি ট্রেন্ড ফলো করবো।”
.
পুতুল কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,”আমি বাচ্চা না”
.
-“আমার বয়সে ছোট তাই আপনি বাচ্চা।তাছাড়া আজ তোয়ালে কিনতে যেয়ে আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল।কে জানে থ্রি পিস কিনতে গেলে হয়ত আপনার বাবার দেখা পেয়ে যাব।”
.
পুতুল ব্রু কুঁচকে বললো,”আমার বাবাকে দেখে কি করবেন?”
.
-“বাহ!!মাংসটা অনেক জোস!!!”
.
পুতুল এগিয়ে এসে বললো,”আমার প্রশ্নের জবাব না দেওয়া আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই না?”
.
ইমাদ খেয়েই যাচ্ছে।পুতুল মুখ বাঁকিয়ে বললো,”ওটা মাংস না”
.
ইমাদ মাথা তুলে বললো,”তাহলে কি?”
.
-“কাঁচা কাঠাল।এঁচোড়”
.
ইমাদ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বললো,”কিহ!!!”
.
পুতুল দৌড়ে দূরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,”কেন?আপনি খান না?আপনার এলার্জি আছে?”
.
-“কাঁঠালটা কি রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ঐ গাছটা থেকে নিছেন?”
.
পুতুল দাঁত কেলিয়ে চোখ মেরে বললো,”একদম!কি সুন্দর!!গাছ থেকে কেটে নিয়েছি।গ্রিল ছিল বলে টুকরো করে কেটে কেটে নিছি।ইজি হয়ে গেলো।
রেঁধেও ফেললাম।”
.
ইমাদ মাথায় হাত দিয়ে কাশতে কাশতে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো
পুতুল এক পা দু পা করে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে।ইমাদ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে।
কাঁপা কাঁপা গলায় পুতুল প্রশ্ন করলো আসলেই কি হয়েছে।তার কি কোনো ভুল হয়েছে!
ইমাদ ঘাঁড় বাঁকিয়ে বললো,”ভুল??আপনি কি করেছেন জানেন?বারুদে আগুন ধরাই দিছেন।”
.
-“মানে বুঝলাম না”
.
-“মানেটা সহজ।দুই মিনিটে বুঝে যাবেন।”
.
পুতুল মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকালো।দূর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে।আওয়াজটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।একেবারে এখন দরজার ওপার থেকে আওয়াজটা আসছে।পুতুল চোখ বড় করে ইমাদের দিকে তাকালো।ইমাদ মাথায় হাত দিয়ে বললো,”নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে বসে থাকেন।আমি সামলাচ্ছি”
.
পুতুল মাথা নাড়িয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগালো।ইমাদ আস্তে করে দরজা খুললো।ওপারে দুজন বয়স্ক আঙ্কেল আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন।উনারা হলেন মিঃরাখাল উদ্দিন এবং তার স্ত্রী জাকিয়া খাতুন।এই বিল্ডিংয়ের মালিক উনারা।জাকিয়া খাতুনের হাতে রুটি বেলার বেলুন আর রাখাল উদ্দিনের হাতে টর্চ লাইট।
ইমাদ দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,”আসুন না ভেতরে আসুন”
.
-“আসবো তো অবশ্যই।তোমার এত বড় সাহস!! তুমি আমার একমাত্র গাছের একমাত্র কাঁচা কাঁঠাল কেটে নিয়ে ফেলছো।কতবার মানা করেছিলাম তোমায়?”
.
জাকিয়া খতুন শুঁকতে শুঁকতে ভেতরে ঢুকে এঁচোড়ের তরকারি দেখে চোখ বড় করে বললেন,”আহারে আমার বাচ্চাটারে রেঁধে ফেললো”
.
রাখাল উদ্দিন ভেতরে এসে আরও রেগে গিয়ে বললেন,”বের করে দিব বাসা থেকে!”
.
পুতুল দরজা ফাঁক করে দেখছে সব।
-“বিষয়টা এবার ক্লিয়ার হলো।”
নিজেকে মারতে মন চাচ্ছে তার।কত বড় ভুল করলো সে।সে ভেবেছিল এটা ইমাদের।একদম জানালার সাথে লেগেছিল বলে সে নিয়েছে।এটা যে মালিকের গাছ কে জানত!!
.
-“আহারে আমার বাচ্চাটা!!!ওগো কিছু করো”
.
আরিয়ান চিপস খেতে খেতে বললো,”শুনলাম ইমাদ
মামা নাকি বাচ্চা রান্না করছে।মামানি টু কই?”
.
ইমাদ ইশারা করলো চুপ থাকতে।জাকিয়া খাতুন কান্না থামিয়ে বললেন,”কিসের মামানি টু?”
.
-“না কিছু না।সরি আন্টি ক্ষমা চাচ্ছি।আর এমন হবে না”
.
-“ওগো আমার বাচ্চাটা।”
.
আরিয়ান মাথা উঁচু করে বললো”হাঁড় গোড় সহ রেঁধেছো নাকি?”
.
-“চুপ থাকো বেয়াদব ছেলে।আমি ঐরকম বাচ্চার কথা বলছি না।কাঁঠালটা আমার বাচ্চার মতন ছিল।আহারে!!
.
চলবে”””