বাবুই পাখি পর্ব-০৭

0
768

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৭
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল খুশি মনে নাচতে নাচতে রুমে চলে গেছে।সিনথিয়া সকাল থেকে কয়েকবার কল করেছিল। ইমাদ ব্যস্ত ছিল বলে রিসিভ করতে পারেনি যার কারণে এখন সে নিজেই এসে হাজির ওর বাসায়।সে ভেবেছে ইমাদের বাবা এখনও আসেনি।কলিংবেল বাজার পর ইমাদ উঠে এসে দরজা খুললো।আজ আর চেক করে খোলেনি।সিনথিয়াকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো যে সে কেন এসেছে।
.
সিনথিয়া ইমাদের গলা জড়িয়ে কাছে এসে বললো,”কেন আসতে পারি না?”
.
ইমাদ গলা থেকে হাত সরিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো,”এত রাতে তোমার আসাটা বেমানান”
.
-“আমি তোমায় কল করেছিলাম।তুমি রিসিভ করছো না বলে নিজেই এলাম”
.
কথাটা বলো সিনথিয়া ভেতর থেকে দরজা লাগালো।পুতুল উঁকি মেরে দেখছে পর্দার আড়াল দিয়ে।সিনথিয়া ইমাদের কাছে এসে বললো,”কফি খাবে?”
.
-“না ভাত খাচ্ছি অফিস থেকে এলাম সবে।তুমি যাও এখন।বাবা এসে পড়বে”
.
-“আঙ্কেল এসেছেন?”
.
-“হ্যাঁ”
.
-“আঙ্কেল তো নাকি দেরি করে ফেরে।তাহলে আমি উনি আসা অবধি থাকি”
.
-“যেটা বললাম সেটা করো”
.
সিনথিয়া ইমাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,”যাব না”
.
পুতুল সরে আসলো ওখান থেকে।বারান্দায় গিয়ে নিচে রোডের দিকে চেয়ে রইলো।ইমাদের হবু বউ সিনথিয়া সেটা বুঝতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
-“কিন্তু একটা বিষয় মাথায় ঢুকে না সিনথিয়া আপুর থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন কেন উনি?অবশ্য আমাকে দেখে মনে হয়।
আরেকটা কথা হলো উনার মা অন্য জায়গায় থাকে কেন?বাবা মা দুজনে আলাদা থাকছে।অনেক কথা আছে।যা উনি আমায় বলতে চাইছেন না।”
.
কিছু ভাঙ্গচুরের আওয়াজ আসতেই পুতুল ছুটে দরজা পর্যন্ত আসলো।ইমাদ এক জায়গায় আর সিনথিয়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।ফ্লোরের উপর কাঁচের গ্লাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে।
সিনথিয়া রেগে রেগে বললো,”তুমি আমায় ভালোবাসো না কেন?চেষ্টা করলেই পারা যায়।আহামরি কিছু না এটা”
.
ইমাদ কপাল কুঁচকে বললো,”ভালোবাসা চেষ্টা দিয়ে হয় না।
তুমি তো ভালোবাসার মানেই জানো না।জোর দিয়ে আজ পর্যন্ত কিছু হয়নি।আমার বাবা আমার মাকে ধরে রাখতে পেরেছে?না মা বাবাকে ধরে রাখতে পেরেছে?দুজনে আলাদা থাকছে।আমি এবং আমার নানা নানু,দাদা দাদু সবাই চেষ্টা করেও দুজনের মন গলাতে পারেনি।আর তুমি আছো আমার মন গলানো নিয়ে।আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবো একবার।আমার তোমার প্রতি ফিলিংস আসে না তো আমি কি করবো?তুমি সব দিক দিয়ে পারফেক্ট বাট আমার জন্য না।তুমি চাইলেই মাকে বলে বিয়েটা ভাঙ্গতে পারো।কিন্তু না তুমি তো সেটা করবা না।কারণ তুমি চাও জোর করেই বিয়েটা হোক
আর তুমি এটাও জানো মায়ের কথার উপর আমি কথা বলতে পারি না।”
.
-“হ্যাঁ ঠিক বলেছো।বিয়ে করলে তোমাকেই করবো।যদি এটা জোর খাটানো হয় তো হবে।বাট বিয়ে আমাকে করতে হবে তোমায়।”
.
-“শুনো সিনথিয়া জেনে শুনে নিজের পায়ে কুড়াল মারছো।জীবনে আমার থেকে একটুখানি ভালোবাসা তুমি পাবে না।মনে রেখো”
.
-“সেটা পরেরটা পরে দেখা যাবে।বাই”
——-
সিনথিয়া চলে যাওয়ার পর ইমাদ দরজাটা লাগালো।পুতুল রুম থেকে বেরিয়ে নিচে পরে থাকা কাঁচগুলো দেখছে।ইমাদ ডাস্টবিন এনে ওগুলো উঠাচ্ছে। পুতুল আস্তে করে বললো,”আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?”
.
-“নাহ।কাউকেই বাসি না।এসময়টাতে একা থাকতে চাই।চাকরি পেয়েছি আজকে একদিন ও হলো না আর মা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে আছে”
.
-“আপনি বলুন আরও পরে করবেন”
.
-“বলে বলে দুই মাস হয়েছে।
এবার মায়ের আকুতি আরও বেড়ে গেছে।মাঝে মাঝে মন চায় মা বাবার এই টানাপোড়নে কোথাও একটা চলে যাই।বাবা বলে আমি মাকে বেশি ভালোবাসি আর মা বলে আমি বাবাকে বেশি ভালোবাসি।অথচ তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে না।দূজনের এই মনমালিন্যের জন্য আজ আমি ভালোবাসা কি সেটাই ভুলে যাচ্ছি।তারা যেভাবে লাইফটা লিড করছে আমাকেও তাতে জড়াচ্ছে।জোর করে কি একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া যায়??
যায়!!!তবে সুখে থাকা যায় না
তারা আমার সুখ নিয়ে ভাবে না।”
.
পুতুল চোরের মতন কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে এবার একটু ঢোক গিলে আস্তে করে বললো,”কফি খাবেন?”
.
-“হুম”
.
-“আচ্ছা আমি বানাই”
——-
-“এই যে নানি!এই মেয়েটাকে দেখেছেন আশেপাশে??”
.
-“তোমরা কে বাবা?কাউকে খুঁজছো নাকি?”
.
-“এই যে এই মেয়েটাকে দেখেছেন কোথাও?”
.
-“এ্যাহ?কি বললে?তোমরা হারাই গেছো?”
.
-“আরে ভাই থুক্কু নানি!জেঠি! একটু বলেন এই মেয়েটাকে কোথাও দেখেছেন?”
.
-“এরকম চেঁচাও কেন?আমি কি বয়রা নাকি?আজকালকার পোলাপান বড়দের সাথে হুদাই চেঁচিয়ে কথা বলে”
.
-“আজব তো!দুইশবার বলার পরেও যদি না শুনেন তখন তো চেঁচিয়েই বলতে হয় তাই না?”
.
-“আমি চোখে কম দেখতেছি।আমার চশমাটা বাসায় ফেলে এসেছি।দাঁড়াও চশমা নিয়ে আসি।”
.
-“চল নানির সাথে।পরে উপরে গিয়ে বলবে চশমা দিয়েও দেখি না”
.
পুতুলের ভাইয়া আসাদ তার দুজন সঙ্গী এবং সাইমন চললো উর্মি আন্টির সঙ্গে তার বাসায়।
বাসায় এসে আন্টি অনেক খুঁজে চশমা পেলেন।তাও পুতুলের ভাইয়াকে দিয়ে খুঁজিয়েছেন।
এরপর চোখে দিয়ে ছবিটা দেখে বললেন,”আরে এ তো সিনথিয়া।”
.
-“না।ও আমার বোন পুতুল।”
.
-“ঘাউড়ামি করবা না বাবা।আমি সিনথিয়াকে ভালোমতন চিনি।ঐদিন ও তো ওর সাথে কথা হয়েছিল আমার। ইমাদের হবু বউ তো ও”
.
-“বস মনে হয় কোথাকার কোন মেয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে।ছেড়ে দেন।হুদাই সময় নষ্ট করতাছে”
.
-“কি হলো?তোমরা কি ফিসফিস করছো?”
.
-“না মানে আমরা যাচ্ছি সেটা বললাম”
.
-“কি বললে?তোমরা থাকছো?কিন্তু কেন থাকবা এখানে?অপরিচিত মানুষকে আমি আমার বাসায় থাকতে দেই না”
.
-“আজিব তো।এরে তোরা আমারে ধর নাহলে এই বুড়িরে ছাদ থেকে ফালাই দিব আমি”
.
-“কি বললে?তোমরা ছাদ থেকে লাফ দিবা??আত্নহত্যা মহাপাপ সেটা জানো তো?”
.
-“বস কুল ডাউন।চলুন যাই আমরা”
.
-“কোথা থেকে উঠে আসে কে জানে।দেখে কেমন গুণ্ডাপাণ্ডা মনে হয়।
চশমা ছাড়া বুঝতে পারিনি।নাহলে আসতেও দিতাম না।তরকারি কিনতে গিয়ে কার না কার সাথে দেখা হয়ে গেলো।”
—–
-“একটা কথা বলবো?”
.
-“হুম বলুন”
.
-“সিনথিয়া আপুর কফি খেলেন না।আর আমার হাতের কফি খাচ্ছেন”
.
-“আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়নি”
.
-“না সেটা নয়।বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই তো আপনার উচিত ছিল আপুর হাতের কফি খাওয়া।সেটা বললাম”
.
-“পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আলাদা।একজনের সাথে আরেকজনের তুলনা একেবারেই খাটে না।তাও মানুষ তুলনা করেই চলে।
একজনের একেক গুন।সবার এক গুন না।সুতরাং মানুষকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।তুলনা জিনিসটা জিনিসের সাথেই করা উচিত।মানুষে মানুষে না”
.
-“আপনি অনেক কঠিন কথা বলেন”
.
-“আমি মানুষটাই কঠিন।যে যেমন রুপ দেখে তেমন বিবেচনা করে।
সিনথিয়ার কাছে আমি অনুভূতিহীন একটা মানুষ।মায়ের কাছে বেপরোয়া। আর বাবার কাছে নিরামিষ ”
.
-“আর আমার কাছে একজন ভালো মানুষ”
.
ইমাদ ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,”বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিলেন কেন?”
.
-“যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাকে পছন্দ হয়নি”
.
-“তার মানে পছন্দ হলে করতেন?”
.
-“হ্যাঁ।বিয়ে অনেক জরুরি একটা বিষয়।একটা জরুরি সিদ্ধান্ত।সারাজীবনের ব্যাপার এটা।ভেবেচিন্তে কদম ফেলা উচিত।আমার জীবনটা বাঁচাতেই পালালাম।”
.
-“ভালো করেছেন।তবে এরকমটা আর কতদিন?মানে আমার বাসা থেকে তো এরপরে আপনার বান্ধুবীর বাসায়।যে বান্ধবী মেহমান এসেছে বলে বিপদে পড়া বান্ধুবীকে আসতে মানা করে সে আপনাকে কতদিন রাখবে?”
.
-“একটা চাকরি পেলে ভালো হতো”
.
-“আমার চাকরি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।আর আপনি তো জুনিয়র।”
.
-“দেখি ভাগ্য কতদূর নিয়ে যায়”
.
-“আমি আপনাকে ততদিন রাখতে পারবো যতদিন বাবা আপনাকে দেখে না ফেলে।আমার সমস্যা নেই।
তবে আমার মনে হয় আপনার বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত।তারা হয়ত তাদের ভুলটা বুঝতে পেরেছে ”
.
-“ভয় লাগে।বাবাকে বুঝতে পারি না।যদি আবারও সাইমনের সাথে বিয়ে ঠিক করে তাহলে?আর তো পালাতে পারবো না আমি।”
.
-“দেবে না।আচ্ছা আপনার ইচ্ছা সেসব।টিভি দেখুন বসে বসে।আমি আমার অফিসের কাজ করবো এখন”
.
কথাটা বলে ইমাদ উঠে চলে গেলো গেস্ট রুমের দিকে।পুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়েই চোখ কপালে তুলে ফেলেছে।
তার ভাইয়া আর সাইমন নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর এদিক ওদিকে ইশারা করছে।
পুতুল সাথে সাথে লুকিয়ে পড়লো।ভয়ে গা কাঁপছে।তারা এখনও ওকে খুঁজছে এই ভেবে।পুতুল ছুটে ইমাদের কাছে এসো বললো,”ওরা এসে গেছে”
.
-“কারা?”
.
-“ভাইয়া আর সাইমন”
.
-“কোথায়?”
.
-“বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।”
.
-“এদিকে তাকায়নি তো?”
.
-“নাহ।”
.
-“ঠিক আছে সমস্যা নেই।আপনি সেদিন এই পথ দিয়ে গিয়েছিলেন বলেন তারা আবারও এখানে দেখতে এসেছে।আমার বাসায় আপনি সেফ।ধরা খাবেন না”
.
পুতুল মাথা নাড়িয়ে চলে আসলো টিভির সামনে।নিচে বসে টিভিটা অন করলো সে।বুকের ভেতর ভয় জেগেছে।যদি তারা এখানে চলে আসে।তাহলে কি হবে।
-“কি করে রেহায় পাবো আমি?আমাকে যদি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।কি হবে আমার।”
.
ইমাদ কাজ সেরে এসে দেখলো পুতুল টিভি অন করে মুখটা আরেকদিকে ফিরিয়ে রেখেছে।টিভি দেখছে না।অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।
.
ইমাদ দুষ্টুমি করে ফিসফিস করে বললো,”ঐ যে দেখেন সাইমন এসে পড়েছে”
.
পুতুল চমকে পেছনে তাকালো।ইমাদ হাসতে হাসতে সোফায় বসেছে।পুতুল ভ্যাঁত করে কেঁদে ফেলেছে ততক্ষণে।কান্না করতে করতে বললো,”আমাকে বের করে দিবেন না প্লিজ”
.
ইমাদ বোকার মতন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তারপর বললো,”বের করে দিচ্ছি কই??আমি বললাম বাবা দেখে ফেললে”
.
-“আমি কোথাই যাব”
.
-“কান্না থামানা প্লিজ।এভাবে কাঁদছেন কেন?
আপনাকে আপনার বাসায় ফেরত যেতে বলেছি তাই??আচ্ছা যাইয়েন না আপনি।এখানেই থাকুন।আমার সমস্যা নেই তো”
.
পুতুল ওড়না দিয়ে নাক মুছে কেঁদেই যাচ্ছে।
ইমাদ পড়েছে মহাঝামেলায়।ভালোই ভালোই আইডিয়া দিল আর মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।
-“এই জন্য হয়ত মা বলে আমার আইডিয়া দেওয়া আর ভিক্টিমকে পানিতে ফেলে দেওয়া সেম ব্যাপার।আর জীবনে কাউকে আইডিয়া দেবো না।আরে আপনি কান্না থামান দয়া করে!!”
.
পুতুল চোখ মুছতে মুছতে রুমের ভেতরে চলে গেছে।ইমাদ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
-“মেয়ে মানুষকে বোঝা আসলেই কঠিন ব্যাপার।সিনথিয়াকে বুঝতে পারি কিন্তু এই মেয়েটাকে বুঝতে আমার নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে তাও বুঝি না আমার ভুলটা কোথায়?”
.
ইমাদ পর্দা সরিয়ে দেখলো পুতুল আরেকদিকে ফিরে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে।ইমাদ একটু এগিয়ে এসে বললো,”ছাদে যাবেন?।ঘুরতে যাবেন?ভেলপুরি খাওয়াবো”
.
পুতুল চুপ করে আছে তাও
.
-“বোরকা পরিয়ে নেওয়াবো।
আপনার ভাইয়া দেখেও চিনবে না
আচ্ছা ভেলপুরির সাথে আইসক্রিম ও খাওয়াবো।চলুন।আপনার মন ভালো করার দায়িত্ব আমার”
.
পুতুল লাফ দিয়ে উঠে পড়েছে কথাটা শুনে।তারপর বিছানা থেকে নেমে বললো,”বোরকা কই?”
চলবে””