বাবুই পাখি পর্ব-০৮

0
708

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৮
Writer-Afnan Lara
.
-“নিচে আপনার ভাইয়া আর তার চৌদ্দ গুষ্টি এসে হাজির হয়ে আছে।আপনাকে নিয়ে শেয়ালের হাতে তুলে দিতে পারি না।আর আপনি তো মুরগী”
.
-“আপনি মারপিট জানেন না?”
.
-“এটা সিনেমা না।মারপিট বলতে চড় মারতে পারি।আর কিছু পারি না।আমি সাধাসিধে মানুষ।খাই দাই আর ঘুমাই।এখন থেকে অফিসের কাজ ও যোগ হলো।তবে ভেলপুরি খাওয়ানোর বদলে আপনাকে একটা দারুন পরিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি আমার আছে বেশ।”
.
পুতুল মুখটা ফ্যাকাসে করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো।কিছু বললো না।
ইমাদ মুচকি হেসে শার্টটা ঠিক করে বললো,”পূর্নিমার চাঁদটা দেখিয়ে দিতে পারি।মনটা ভালো না হয়ে যাবে কই?”
.
পুতুলের মুখে হাসি ফুটে গেছে।কারণ চাঁদ আর আকাশ তার অনেক পছন্দের।সুযোগ পেলেই দেখতে হাজির হয়।তাই আর মানা করলো না সে।মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ইমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো সে।ইমাদ ওকে নিয়ে ছাদে আসলো।ছাদে এই প্রথম আসা পুতুলের।ইমাদদের ছাদে বেশ অনেকগুলো গাছ।সব ফলপাকোড় আর কিছু শাকসবজিও আছে।তবে ফুল গাছের দেখা পেলো না পুতুল।ছাদের কোণায় একটা বাঁশের সাথে বাতি আটকে রাখা।
পুতুল একটা কুমড়ো ধরতে যেতেই ইমাদ ওর হাত আটকে বললো,”এই ভুল করবেন না।একবার কাঁঠাল কেটে আমায় জ্যান্ত নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন।এবার কুমড়ো নিয়ে সাগরে ফেলে দিয়েন না।”
.
পুতুল কপাল কুঁচকে বললো,”এসব ও ঐ আঙ্কেল আন্টিদের নাকি?”
.
-“হ্যাঁ।তবে সবার কোণায় পিচ্চি কমলা গাছ দেখছেন?ওটা আরিয়ানের পার্সোনাল গাছ।”
.
-“হাহা!!”
.
পুতুল হাসতে হাসতে ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালো এবার।ইমাদ একটা কুমড়ো ফুল ছিঁড়ে নিলো।তারপর পুতুলের দিকে তাকালো।পুতুল চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করছে।বাতাসে তার মাথার থেকে ওড়না সরে গেছে।ইমাদ ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখছিল।তারপর কি মনে করে ফুলটা ওর কানে গুজে দিলো সে
পুতুল চমকে কানে হাত দিয়ে ইমাদের দিকে তাকালো।ইমাদ মাথা হেলিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,”আমি নিরামিষ মানুষ।আমার বাসার ছাদেও সব নিরামিষ তরকারি।তাই গিফট হিসেবে নিরামিষ তরকারির ফুলই দিলাম নাহয়”
.
পুতুল ফিক করে হেসে ফেলেছে।ইমাদ উল্টো দিকে ঘুরে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বললো,”কাল আমার একটা ফ্রেন্ডের এঙ্গেজমেন্ট।যাবেন আমার সাথে?”
.
-“আপনার ফ্রেন্ড কিছু বললে?”
.
ইমাদ দূরের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বললো,”সে সিনথিয়াকে দেখেনি”
.
পুতুলের মুখের হাসি আজ থামতে গিয়েও থামছেনা।ইমাদ যেন চ্যালেঞ্জ ধরেছে ওর মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার।আরও বিশ মিনিট থেকে বাসায় চলে আসলো দুজন।পুতুল তার জন্য আনা জামাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।ইমাদ উঁকি মেরে বললো,”আমার মায়ের একটা শাড়ী আছে।বেগুনি রঙের।ওটা পরে যাবেন?”
.
-“আপনার মায়ের শাড়ী এখানে কি করে?”
.
-“বাবার আলমারিতে রাখা”
.
পুতুল ব্রু কুঁচকে বললো,”ঠিক বুঝলাম না।আপনার বাবা মা তো একে অপরকে দেখতে পারে না।তাহলে আপনার মায়ের শাড়ী আলমারিতে কেন তাও আপনার বাবার আলমারিতে”
.
-“হয়তবা বাবা মা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।কিন্তু ঐ যে ইগো!কেউ কারোর কাছে হার মানবে না।বিষয়টা তেমন”
.
-“কিন্তু এমন করে আর কি লাভ হলো।উনারা আলাদাই রয়ে গেলেন”
.
-“সেটা যদি বুঝতো তো এতগুলো বছর নষ্ট হতো না।যাই হোক বাবা আসতে আরও দেরি।টিভি দেখলে দেখতে পারেন।আমি একটু বাহিরে থেকে ঘুরে আসি
ছেলে মানুষ রাতে বের না হলে তা ঠিক মানায় না।
বেমানান লাগে বেশ।”
.
পুতুল মাথা নাড়িয়ে এসে দরজা লাগালো
ইমাদ বাসার নিচে এসে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসেছে।মিনিট পাঁচেক বাদে দেখা হয়ে গেলো পুতুলের ভাইয়া আর হবুর সঙ্গে।ইমাদ জানত এমনটাই হবে।
ওরা ইমাদের সামনা সামনি বসে আলাপ জমিয়েছে।
—-
-“আসাদ ভাই এখন কি হবে?পুতুলকে তো পাচ্ছি না কিছুতেই।আমার কিন্তু ওকেই চাই।”
.
-“আরে ধৈর্য্য ধরো।পালিয়ে থাকবে কদিন?ঠিক বের করবো।বিয়ে তো তোমাকেই করতে হবে।একবার হাতের নাগালে পাই ওরে।মেরে হাঁড়গোড় ভেঙে বিয়ের পিড়িতে বসাবো।”

ইমাদের কাশি উঠে গেছে কথাটা শুনে।আসাদ ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,”আপনি সেই না?ঐ যে চুম্বন ব্যাক্তি”
.
-“চুম্বন ব্যাক্তি আবার কি ভাই?”
.
-“তোমার মনে নেই??যে রাতে পুতুল পালিয়েছিলো সেদিন এই ছেলেটাকেে দেখেছিলাম ঐসব করতে?”
.
-“ওহ হ্যাঁ।”
.
-“ভাইয়া আপনার দোয়া থাকলে বিয়ে সাদি করে বাচ্চা কাচ্চা দিয়ে ঘর পূর্ন করে ফেলবো।”
.
-“যাই হোক।এই মেয়েটাকে চেনেন?দেখেছেন কোথাও?”
.
-“আপনি কে ভাই।উনার কি হোন?”
.
-“হবু জামাই।এবার বলুন চিনেন কিনা”
.
-“হুম দেখেছি মনে হয়।”
.
-“কোথায়?”
.
-“এউ যে আপনার ফোনে।”
.
-“ধুর মিয়া।আচ্ছা এই এলাকার সবাই কি পাগল?তখন একবার এক বয়স্ক মহিলার পাল্লায় পড়েছিলাম।হ্যাঁ বললে শুনে না।না বললে শুনে হ্যাঁ।সব আজব মানুষ”
.
ইমাদ হাসি থামিয়ে চা খাওয়াতে মন দিলো।
আসাদ আর সাইমন চলে গেছে।পুতুল শাড়ীটা গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ৩২টা দাঁত বের করে শুধু হেসেই যাচ্ছে।
—-
-“কিও দোস্ত কি খবর”
.
-“আরে রিজবি।আয় বস।হঠাৎ এদিকে এলি?”
.
-“ঐ যে এ্যানার সাথে মিট করতে”
.
-“কোথাকার?”
.
-“এখানকার”
.
-“মামা আরেকটা চা দেন তো।আগে বল কোন বাসা”
.
-“তোদের বাসা।ঐ যে আরিয়ান নামের পিচ্চি ছেলেটাকে চিনিস তো?”
.
-“হুম চিনি।”
.
-“ওর বড় বোন।আমার ক্রাশ”
.
-“যেভাবে বললি আমি ভাবলাম প্রেম করছিস।”
.
-“আরে নাহ।প্রেম করি তো।তারে প্রোপোজ করলাম আর সে সুরসুর করে রাজি হয়ে গেলো।ভাবতে পারিস কতবড় হ্যান্ডসাম ছেলে হলে সাথে সাথে এক্সেপ্ট করে মেয়েরা?”
.
-“হুম তা তো বুঝলাম।কিন্তু তুই কি জানিস এ্যানার বাবা কি পরিমান রাগী?”
.
-“আরে রাখ শ্বশুরের কথা।আমার শালা আছে না?সে বিয়েটা ঠিক করে দিবে।”
.
-“ঐ বান্দরটা?”
.
-“ঠিক করে বল তো।”
.
-“এখন কেন এলি সেটা বল।”
.
-“তোর বাসার ওপরের তলা চেক কর।বুঝে যাবি”
.
ইমাদ কৌতুহল নিয়ে উপরে তাকালো।
এ্যানা ত্যাড়াব্যাকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের বারান্দায়।ইমাদ চোখ সরাতে গিয়ে দেখতে পেলো পুতুলকে।সে রুমে শাড়ীটা নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দূর থেকে
.
-“আচ্ছা আমি আসি।তুই দেখতে থাক তোর প্রেয়সী রে”
—-
ইমাদ বাসায় ফিরে আসলো সোজা।পুতুল শাড়ীটা রেখে এসে দরজা খুলে দিয়েছে।ইমাদ গেস্ট রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,”মায়ের শাড়ীটা এত পছন্দ হয়েছে বুঝি?”
.
-“হ্যাঁ।কেন?মানে এই প্রশ্ন করলেন হঠাৎ”
.
-“রাস্তা থেকে দেখছিলাম শাড়ী নিয়ে কেমন ঘুরঘুর করছিলেন”
.
পুতুল জিভে কামড় দিয়ে বললো,”আসলে আমার শাড়ীর প্রতি দূর্বলতা কাজ করে।”
.
-“বুঝলাম।তাহলে আপনাকে শাড়ী ব্যবসায়ী দেখে বিয়ে দিতে হবে”
.
-“ধুর!ডিনার করবেন কখন?”
.
-“আজ আর খাব না।তখন না খেলাম?”
.
-“তখন তো দুপুরের খাবার খেয়েছেন।এখন তো রাতের খাবার সময়”
.
-“না।আমার পেট ভর্তি।আমি কিছু কাজ করে শুয়ে পড়বো”
.
ইমাদ কথা শেষ করতে না করতেই দেখলো সিনথিয়ার কল এসেছে।কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই সিনথিয়া কথা বলা শুরু করে দিলো দুনিয়ার যত আবোলতাবোল কথা আছে।
পুতুল ইমাদের চলে যাওয়া দেখে টিভিটা অন করে বসলো সোফায়।সিনথিয়ার সব কথার উত্তরে ইমাদ হ্যাঁ/না তে উত্তর দিচ্ছে।পুতুল কান খাঁড়া করে শুনছিল।এরপর কিসের একটা ভাবনা মাথায় আসতেই কানে হাত দিয়ে টিভি দেখায় মন দিলো সে।ভাবনাটা ছিল ইমাদ আর সিনথিয়াকে নিয়ে।সে কেন শুনছে এই ভেবে এখন সে লজ্জিত।
ইমাদ ফোন এক পাশে রেখে হুমমম না হুম এসব বলতে বলতে কাজ করছে।পুতুলের টিভিতে মন বসছেই না তাই টিভিটা অফ করে রুমে চলে আসলো সে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিচে বসে সে বারান্দায় ঝুলতে থাকা অপরাজিত ফুলগাছটা দেখছে।একটুও নড়ছে না ফুলগাছটা।কারণ বাতাস নেই।তাই এবার সে নিচ থেকে উঠে গাছটার কাছে এসে হাত দিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে টবটাকে ঘুরিয়ে দিলো।এরপর কি মনে করে সোফার রুমের ল্যান্ডলাইনের কাছে গিয়ে ঘেঁষে বসলো।বিশ পনেরো মিনিট বসে থেকে বুকে সাহস নিয়ে কল করলো মাকে।
মা রিসিভ করেই সালাম দিলেন
ভেবেছেন আননউন নাম্বার। পুতুল হ্যালো বলতেই কেঁদে ফেলেছেন তিনি।পুতুল ও কাঁদছে।
একটা সময় কান্না থামিয়ে সে বললো,”একটা কথা বলো শুধু।আমি যদি ফিরে আসি তোমরা কি আমার সাথে আবার জোর করবে?”
.
-“না রে মা তুই শুধু একবার ফিরে আয়।
তোর বাবা বলেছে তুই যেমনটা বলবি তেমনই হবে।”
.
-“সত্যি বলছো?”
.
-“হ্যাঁ।আজই চলে আয়।আমি কথা দিচ্ছি কেউ তোর গায়ে একটা টোকাও দিতে পারবে না”
.
-“তাহলে পরশু আসবো।কাল না।বাই”
.
পুতুল লাইনটা কেটে চুপ করে থাকলো।মাকে ফোন করেছে কারণ সে চায় না আর ইমাদের কাছে থাকতে একসাথে।এভাবে আর কতদিন?মানুষ কি বলবে?
.
সেদিন আর পুতুল রুম ছেড়ে বের হয়নি।রুমেই ছিল।বাবা এসেছেন তার রুমে রেস্ট নিয়েছেন। ডিনার করেছেন।ইমাদ সাথে সাথেই ছিল।পুতুলের খবর নেয়নি কারণ সে ভেবেছে পুতুল লুকিয়ে আছে।ইচ্ছে করেই উঁকিবুকি মারছে না।
বাবা ঘুমাতে যাওয়ার পর ইমাদ একবার দেখতে আসলো পুতুলকে।কাঁথা মুড়িয়ে মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছে সে।ইমাদ আর ডিস্টার্ব করলো না তাকে।
পরেরদিন বাবা চলে যাওয়ার পর ইমাদ অফিসে যাওয়ার আগে ডাকতে গেলো পুতুলকে কারণ পুতুলের এখনও খবর নেই।রুমে নক করে এসে দেখলো পুতুল উঠে বসে আছে মুখটা গম্ভীর করে।
.
-“কি হলো?নাস্তা করবেন না?”
.
-“হুম”
.
-“রেডি হয়ে থাকিয়েন।
বিকালে আপনাকে নিয়ে ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো।”
.
-“আচ্ছা”
.
-“শরীর খারাপ?”
.
-“উহু।মন খারাপ।কারণ বলতে চাইছি না।
সাবধানে যাবেন।”
.
ইমাদ ভ্রু কুঁচকে চলে গেলো অফিসের দিকে।
পুতুল বারান্দায় এসে ওর চলে যাওয়া দেখলো।রিকশায় চড়ে গেছে সে।যতদূর ওকে দেখা যায় ততদূর অবধি তাকিয়ে রইলো সে।
.
দুপুরের রান্না করেছিল অন্যমনস্ক হয়ে যার কারণে লবণ বেশি দিয়ে ফেলেছিল।নিজে খায়নি বলে বুঝতে পারেনি পুতুল।
ইমাদ খেতে বসে লেবু চিপে প্লেটে দিতে দিতে বললো,”কোনো কারণে কি আপনার কষ্ট হচ্ছে?।আমাকে বলতে পারেন”
.
-“না।কেন জিজ্ঞেস করলেন?”
.
-“তরকারিতে লবণটা একটু বেশি হয়েছে।আপনার রান্না কিন্তু পটু হাতের।এতদিন যা বুঝলাম।তাই আজ বেমিল হলো কেন বুঝলাম না।
.
পুতুল লথাটা শুনে এক চামচ মুখে দিয়ে চোখ কপালে তুলে বললো,”ইশ!!অতিরিক্ত পড়ে গেছে। আমি একেবারে বুঝতে পারিনি”
.
-“তার মানে আপনি দুপুরের খাবার খাননি”
.
-“ভালো লাগছিল না”
.
-“এখন বসুন।লেবু কেটেছি।লেবু দিয়ে খান।
লবণ কম লাগবে।”
.
-“পরে খেয়ে নেবো।”
.
-“অনুষ্ঠানে গেলে খাবার পাবেন রাতে।ততক্ষণ কি হাওয়া খেয়ে থাকবেন?”
.
-“বললাম না খিধে নেই”
.
পুতুল রাগ করে চলে গেলো রুমের দিকে।
ইমাদ বুঝতে পারছে না পুতুল এমন কেন করছে।তার পর মনে করার চেষ্টা করলো ঠিক কখন থেকে ওর মন খারাপ।
চলবে””