বাবুই পাখি পর্ব-০৯

0
782

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৯
Writer-Afnan Lara
.
-“ওহ আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার।সিনথিয়ার কল আসার পর থেকে ম্যাডামের মন খারাপ।কিন্তু মন খারাপের কি আছে?”
.
পুতুল গাল ফুলিয়ে আয়নার সামনে বসে জট যুক্ত চুলে চিরুনি বুলাচ্ছে।চিরুনিটা ইমাদের।
টানছে ধীরে ধীরে কিন্তু জোর দিচ্ছে না।চোখ তার বারান্দার দিকে।
-“অপরাজিতা ফুলটার দিকে তাকালে হিংসা হয় সবসময়।কেন এই ফুল ফুটে থাকে।আমরা মানুষজাতি কেন চোয়েও সবসময় ফুটে থাকতে পারি না।
আউচ!!এই চুল ও না!!একদম কেটে ফেলে দেবো।দুদিন না আঁচড়ালেই বাবুই পাখির বাসা হয়ে থাকে মাথায়
আশ্চর্য! কার এত সময় যে বসে বসে চুলের জট খুলবে?
আমিও কম না।মেজাজ খারাপের ভেতর বসেছি চুলের জট নিয়ে”
.
-“আমি আঁচড়ে দেবো?”
.
-“দরকার নেই।আমার হেয়ার কেয়ার আমি নিজেই করতে জানি।
কারোর হেল্প লাগবেনা”
.
-“আচ্ছা তাহলে জলদি করুন।আর ত্রিশ মিনিট আছে।বের হতে হবে তো।ওদের বাসায় যেতেও সময় লাগবে।”
.
-“হুম।জলদি করছি।
মেয়েদের সাজগোজের কাজ তো।একটু সময় লাগবেই।এসব জানাকে বলে কমন সেন্স। আর আপনি আমায় তাড়া দিচ্ছেন?”
.
-“বুঝি না আপনাদের রেডি হতে এত সময় লাগে কি জন্যে?আমাদের তো এদিক থেকে ওদিক তাকালেই রেডি ফিটফাট হয়ে যাওয়া যায়।”
.
পুতুল ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,”কারণটা হলো আপনাদের আমাদের মতন লম্বা চুল নেই।নরম কোমল ত্বক নেই।শাড়ী পরার ঝামেলা নাই।থাকলে বুঝতেন”
.
-“এভাবে রুডলি কথা বলার কারন কি কাল রাতে আমার সিনথিয়ার সাথে কথা বলা?”
.
পুতুল চোখটা বড় করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে কি ভেবে চোখ নামিয়ে ফেলেছে তারপর দম আটকে রেখে বলে ফেললো ওরকম কিছু না।
.
ইমাদ হেসে দিয়ে বললো,”বুঝলাম।আর বোঝাতে হবে না”
.
পুতুল চুলগুলোকে পিঠের উপর নিয়ে মাথায় চড় মেরে বললো,”বোকা তুই পুতুল!
এমন বিহেভ করিস যে মানুষ বুঝে যায়।থাক বুঝলেও কি।কিছুই করার নেই আর।আমি আর থাকছি না।কাল এসময়ে বাবার বাসায় থাকবো।”
—-
ইমাদের মায়ের শাড়ীটা পরে তৈরি হয়ে নিয়েছে পুতুল।ইমাদের সঙ্গে এখন রাস্তার কিণারায় দাঁড়িয়ে আছে সিএনজির অপেক্ষায়।ওর বন্ধুর বাড়ি দূরে বলে সিএনজিতে যেতে হবে তাদের।ইমাদ বললো,”একটু হাঁটতে হবে।
এখানে সিনএনজি নজরে পড়ছে না।তাই এবার তারা হাঁটা ধরেছে।এক গলি শেষ করে আরেক গলিতে পা রাখতেই ইমাদ থমকে গেলো
পুতুলের হাত ধরে পাশের একটা ফুলগাছের ভিতরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলো ওকে।পুতুল কিছুই বুঝলো না।শুধু মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলো।
ইমাদ শার্টটা ঠিক করে রোবটের মতন রোডে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে।একজন মহিলা হাতে তরকারির ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে এদিকেই আসছেন।এসেই ইমাদকে এক পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে হেসে বললেন,”কেমন আছিস?”
.
-“ভালো।তুমি কেমন আছো?”
.
পুতুল মাথাটা ব্যাঁকা করে দেখছে।মহিলার চেহারা একদম ইমাদের সাথে মেলে।ওর মা নাকি?
.
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
.
-“একটা ফ্রেন্ডের এঙ্গেজমেন্টে”
.
-“সিনথিয়াকে নিয়ে যেতে পারতি।একা কেন যাচ্ছিস??আচ্ছা আমি যাই।দরজায় লক করে বের হইনি।পপিকে পাহারা দিতে বলে এসেছি।”
.
-“ঠিক আছে।”
.
ইমাদের মা পাশের বিল্ডিংটার ভেতরে চলে গেলেন।পুতুল ফুল গাছটার ভেতর থেকে এসে গা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,”আপনার আম্মু এখানে থাকেন?এত কাছে?”
.
-“হ্যাঁ।দেখেছেন দুজনে কত কাছে থাকে অথচ একজনে আরেকজনের মুখ ও দেখতে চায় না”
.
-“হুম।জানতাম না এত কাছে থাকে।”
.
ইমাদ পুতুলের মাথার উপর থেকে একটা পাতা নিয়ে ফেলে দিয়ে হাঁটা ধরলো
——–
-“দেখেছেন খালা?”
.
-“হুম দেখলাম।ইমাদের সঙ্গে একটা মেয়ে”
.
-“মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর”
.
-“তা তো বুঝলাম কিন্তু সে আমার ইমাদের সাথে কি করে?তাও সেজেগুজে।আমি তো টেরই পায়নি যে সে ফুলগাছটার পাশে ছিল।আর ইমাদ ও বললো না কিছু”
.
-“দেখছেন কেমন হাসছিল ইমাদ ভাইয়ে?”
.
-“হুমমম।সিনথিয়ার সাথে তো জীবনে এমন হাসতে দেখিনি ওকে।শুন একটা কথা।খবরদার এই কথা সিনথিয়া যেন না জানে”
.
-“আইচ্ছা খালা কমু না।”
—–
-“সিএনজি পেলাম অবশেষে।আমার তো মনে হচ্ছিল সারাদিন হেঁটেই পার হয়ে যেতে হবে।”
.
পুতুল চুপ করে বাহিরের দৃশ্য দেখছে।ইমাদের বন্ধু খোকনের বাসায় আসতে আসতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগলো।এত সময় লাগতো না।
জ্যাম ছিল বলেই দেরি হয়ে গেছে।পুতুলকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতেই খোকন কথা থেকে এসে ইমাদকে জড়িয়ে ধরলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো এটা সিনথিয়া কিনা।ইমাদ মাথা নাড়ালো।
পুতুল সালাম দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।ইমাদ ওকে বসতে বলে খোকনের সাথে চলে গেলো অন্যদিকে।পুতুল এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সামনে পড়লো ওর নিজের বাবা আর মায়ের।তারা দুজন হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে সামনের জনের সাথে কথা বলছে।
পুতুল চোখ কপালে তুলে আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেলো।যেতে যেতে ওখান থেকে বেরিয়ে বাহিরে চলে আসলো সে।ইমাদ খোকনের সাথে কথা বলে পুতুলকে খুঁজতে গিয়ে পেলো না বলে বাসা থেকে বের হলো দেখার জন্য।পুতুল মাথায় ঘোমটা দিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।ইমাদ ওর শাড়ী দেখে চিনলো।কাছে এসে বললো,”আপনার ভাইয়াকে দেখলেন নাকি?”
.
-“বাবা মাকে দেখলাম”
.
-“মজা করছেন না তো?”
.
-“মুড নাই মজা করার”
.
-“এখন কি করি?তারা কোথায়?আপনাকে দেখেছে নাকি দেখেনি?”
.
-“দেখেনি।”
.
-“আচ্ছা চলুন।
আর থাকা যাবে না।”
.
-“কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট?”
.
-“আমি খোকনকে বুঝিয়ে দেবো।
চলুন আমার সাথে।”
.
ইমাদ ফোন বের করে খোকনকে ফোন করতে করতে পুতুলের হাত ধরে বেরিয়ে আসলো ঐ জায়গা থেকে।দুজনে সেই আবারও হাঁটছে সিএনজির জন্য।
পুতুল গলা ঠিক করে বললো,”ভাবছি কাল বাসায় ফিরে যাব”
.
ইমাদ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,”একদমই না”
.
-“কেন?আমি আর থেকে কি হবে?”
.
-“আপনার ভাইয়ার কথা শুনলাম কাল সন্ধ্যায়।যতদূর বুঝলাম আপনাকে পেলেই খপ করে ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে।”
.
-“সত্যি?”
.
-“হুম”
.
-“আমি যে মাকে ফোন করে বলে দিলাম কাল ফিরবো”
.
-“আবার ফোন করে বলেন যে আসতে পারবেন না”
.
-“ফোনই করবো না।
মা কি সুন্দর করে বললো এখন থেকে আমি যা চাইবো তাই হবে।আর তারা মনের ভেতর এসব পুষে রেখেছিল?
আপনাকে না জানিয়ে গেলে হয়ত এতক্ষণে বিয়েটাও দিয়ে দিতো আমার”
.
-“হয়ত আমি এটা না বললে আপনি চলেও যেতেন।দোষ আমারই।”
.
-“সিএনজি পাচ্ছি না কেন?”
.
-“এই রোডটা শেষ হলেই পাবো।বাদাম ভাজা খাবেন?”
.
-“হ্যাঁ।”
.
ইমাদ দশ টাকার বাদাম কিনে পুতুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,”সিনথিয়াকে নিয়ে কখনও এরকম টাইম স্পেন্ড করা হয়নি”
.
-“আপনাদের কদিন বাদে বিয়ে।আমার মতে আপনার উনার সাথে কিছু টাইম স্পেন্ড করা উচিত।আপনি উনাকে বুঝবেন।উনি আপনাকে বুঝবে”
.
-“আমি তা চাইছি না।মোট কথা সিনথিয়াকে আমার ভালো লাগে না।
চেয়েও মনে জায়গা দিতে পারি না কি করবো?মন বারবার চেঁচিয়ে বলছে এটা ঠিক না”
.
-“আচ্ছা তাহলে কি ঠিক?”
.
-“সেটা তো বলছে না মন।আপনি বলে দিন।শুনি একটু”
.
-“আমার কথা তো বললামই! আপুকে নিয়ে ঘুরতে যান।ডেটে যান দেখবেন তাকে ভাল্লাগছে।”
.
ইমাদ বাদামে ফু দিয়ে বললো,”বেশ তবে কাল ওকে বাসায় ডাকবো।সারাদিন দুজনে সুন্দর সময় কাটাবো”
.
পুতুল হাঁটা থামিয়ে ফেলে আবারও হাঁটা ধরেছে চুপচাপ।এরপর ঢোক গিলে উপরের দিকে চেয়ে বললো,”আমাকে দেখে ফেললে?”
.
-“আপনি তো এক রুমে পড়ে থাকবেন।দেখবে আর কই?সিনথিয়া রান্না করলে আমি সময় নিয়ে আপনাকে আবার দিয়েও আসবো।আপনার ছুটি”
.
পুতুল মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,”আচ্ছা ভালো আইডিয়া”
.
-“হুম।”
—–
বাসায় ফেরার পর পুতুল শাড়ীটা বদলে থ্রি পিস পরে ইমাদের বারান্দার ফুল গাছটা ছুঁয়ে দেখতে দেখতে বললো,”পুতুল তুই একটা গাধী!কি দরকার ছিল ওমন বুদ্ধি দেওয়ার।যে লোকটা ঐ মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছে বলে তোর মন খারাপ হয়েছে আবার সেই লোকটাকেই ঐ মেয়েটাকে নিয়ে কাল ডেটিংয়ের বুদ্ধি দিলি তুই।তোর সাথে এমনই হওয়া উচিত।ভালো হইছে”
.
-“কাকে বকছেন শুনি?”
.
পুতুল চমকে নড়েচড়ে দাঁড়ালো।ইমাদ কফির মগ রেলিংয়ের উপর রেখে হেসে বললো,”আমার ভালো কিছু ফ্রেন্ড আছে।চাইলে ছবি দেখাতে পারি।কে জানে আপনার পছন্দ হলেও হয়ে যেতে পারে”
.
-“বিয়ের ভয়ে বাসা থেকে পালিয়ে এখানে উঠেছি। এখন আপনিও শুরু করলেন।
আপনি বিয়ে করছেন করুন না।আমার বিষয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই আপনার।”
.
-“হুম তা ঠিক।আপনার তো আমার আর সিনথিয়ার কথা বলা দেখে খারাপ লাগছে তাই বললাম”
.
পুতুল নড়েচড়ে বললো,”নাহ,কে বললো,আমার খারাপ লাগবে কেন।আমার তো ভালো লাগছে। আরও ভালো লাগবে।যত খুশি প্রেম করেন”
.
কথাটা বলে পুতুল চলে গেলো রুমের দিকে।ইমাদ মিটমিট করে হাসছে।সে একটা বিষয় বুঝছে না। পুতুল জ্বলছে কেন?।আর ওকে জ্বালাতেই বা ভাল্লাগছে কেন।
—–
রাতে ইমাদ পুতুলের সাথে ডিনার করতে বসেছে।পুতুল বসতে চায়নি।সে জোর করেই বসিয়েছে।তরকারি আরও বেশি লবণাক্ত হয়ে গেছিলো।খাওয়াই যাচ্ছে না।পুতুল আর ইমাদ কোনোরকমে ডিম ভেজে খেয়েছে।পুতুল ইমাদের বাবার কথা ভেবে আরেকবার তরকারি রান্না করে রেখে দিলো।ইমাদ মানা করেছিল।সল বলেছে বাহিরে থেকে এনে রাখবে।কিন্তু পুতুল শুনেনি।
বাবা খেতে বসে জিজ্ঞেস করেছিল খাবার নতুন রান্না করেছে কিনা।ইমাদ বললো নতুনই।দুপুরের খাবার কম হয়েছে তাই।বাবা খেতে খেতে আবারও বললেন ইমাদের হাতের রান্না ইদানিং বেশ মজার হয়।
আগে এত মজার হতো না।
.
ইমাদ মাথা চুলকে তার রুমের দিকে তাকালো।পুতুল হাসছে পর্দার আড়ালে থেকে।
.
-“জানিস আজ মিসেস রওনককে দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলো”
.
ইমাদ মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে বললো,”তুমি যেতে পারতে তার সঙ্গে হাওয়া খেতে”
.
-“মিসেস রওনক আমায় বাসায় ঢুকতে দিতো?”
.
-“কেন দেবে না?”
.
-“দরকার নাই।আমার কাছে আমার ইগোর দাম আছে”
.
ইমাদ পুতুলের দিকে তাকাতেই দেখলো সে ইশারা করছে আসার জন্য।তাই সে ওখানে আসতেই পুতুল বললো,”আপনার বাবার গার্লফ্রেন্ড নাকি রওনক?”
.
-“রওনক আমার মায়ের নাম। বোকা মেয়ে!”
.
-“বাপরে!!আপনার বাবা আবার লুকিয়ে লুকিয়ে তার বউকে দেখে?”
.
-“ওরা দুজন দুজনকে ফলো করে কিন্তু ঐ যে ইগো!! সেটার কারনে তারা তাদের জায়গায় হেঁটেই চলেছে তাও পথ শেষ হওয়ার নাম নিচ্ছে না।”
.
-“বুঝলাম।
আমি তো আরও ভাবলাম না জানি আবার কোন আন্টির প্রেমে পড়লো আঙ্কেল।”
.
-“নাহ আমার বাবা মাকেই ভালোবাসে।।”
.
-“এটা ভালো।আপনার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলো”
.
-“আমার মায়ের সাথে মিশলে আপনি আরও দিবানা হয়ে যাবেন”
.
-“একদিন তার বাসা থেকে ঘুরে আসবো।বাসা চেনা হয়ে গেছে”
.
-“নিশ্চয় যাবেন।।এখন গুড নাইট”
.
-“ইমাদ শুনছিস?”
.
-“হুম বাবা বলো।”
.
পুতুল সাথে সাথে দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়েছে।
চলবে””