বাবুই পাখি পর্ব-১০+১১

0
763

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১০
Writer-Afnan Lara
.
-“তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
.
কথাটা বলেই বাবা বিছানায় গিয়ে বসলেন।ইমাদ দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।কারণ তার পেছনেই পুতুল।সে যদি বাবার মতন বিছানায় এসে বসে তো নির্ঘাত আজ পুতুল ধরা খাবে।বাবা ইমাদের রুমটা একবার দেখে নিয়ে বললেন,”আমার মনে হয় সিনথিয়াকে তোর পছন্দ না”
.
ইমাদ চোখ ঘুরিয়ে বললো,”কে বলেছে?ওকে আমার বেশ পছন্দ”
.
-“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল।দেয়াল ঘড়ি দেখছিস কেন?”
.
-“না মানে সত্যিটাই তো বললাম বাবা।এতদিন পর এটা জিজ্ঞেস করছো কেন?”
.
-“তোর মিজান আঙ্কেলের কথা মনে আছে?”
.
-“হুম।আমাদের প্রতিবেশী।কেন বলোতো?কি করেছে উনি?”
.
-“উনি আজ তোকে একটা মেয়ের সাথে কোথাও যেতে দেখেছে।তাও হ্যাপিলি।
আমি যতদূর তোকে চিনি তোর পাশে তোর ছেলে বন্ধুরা থাকে সবসময়।জীবনে কোনো মেয়ে বন্ধু বানাসনি।এরপর সিনথিয়াকে দেখেছি।তাহলে ঐ মেয়েটা কে ছিল?মিজান আমায় বললো সে সিনথিয়া ছিল না।সিনথিয়াকে সে দেখেছে কারণ আমিই তোদের পরিচয় করে দিয়েছিলাম।এখন আমি জানতে চাই আমার ছেলে ঠিক কাকে বিয়ে করতে চায়?”
.
ইমাদ হালকা কেশে বললো,”ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল
তারপর চিনছে না দেখে এগিয়ে দিলাম।মিজান আঙ্কেল ভুল বুঝেছে”
.
-“সেটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু তোর যে কিছু একটা হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছি।কথা হলো তুই আমাকে বিষয়টা বলতে চাইছিস না।কারণ কি?”
.
-“বাবা কিছুই হয়নি।আমি ঠিক আছি”
.
-“তার মানে ঐ সিনথিয়ার জামাই হতে চাস?ডিসিশান ফাইনাল?”
.
-“হুম”
.
-“ভালো।খুব ভালো।তোর মায়ের পছন্দের কথা আর কি বলবো।একদম বাজে”
.
-“মা কিন্তু তোমায় পছন্দ করে বিয়ে করেছিল”
.
-“ঐ হাজারে একটা পছন্দ জোস হয়।এই আর কি।
আমি জোস হলাম।বাকি সব বাজে বাজে বাজে”
.
-“থাক আর বলতে হবে না।”
.
-“হুম।যাচ্ছি ঘুমাতে।তুইও ঘুমিয়ে পড়।”
—–
বাবা যাওয়ার পর পুতুলকে ঘুমাতে বলে ইমাদ দরজা খুলে বের হতেই বাবার সাথে ধাক্কা খেলো।ভীতুর মতন চেয়ে আছে আপাতত।
বাবা ব্রু কুঁচকে ওকে দেখতে দেখতে সোফায় গিয়ে বসলেন তারপর বললেন,”কই যাস?গেস্ট রুমে?ওখানে কি?”
.
-“আমি তো পানি খেতে এলাম।”
.
-“নে আমার হাতের গ্লাসটা ধর।পানি খেয়ে যা।
আজ দেখবো তুই রাতের বেলা রুম থেকে কেন বের হস।”
.
ইমাদ পানি খেয়ে চুপচাপ রুমে ঢুকে গিয়ে দরজা লাগালো।পুতুল মিটমিট করে হাসছে শুধু।
.
-“হাসেন আরও ভালো করে হাসেন”
.
-“আপনি প্লিজ ফিসফিস করে কথা বলবেন না।এত জোরে মানুষ ভাষণ ও দেয় না”
.
ইমাদ মুখে হাত দিয়ে বিছানায় বসে বললো,”আসলে আমি ফিসফিস করে কথা বলতে জানি না”
.
-“আপনার বাবা কি আজ সোফা থেকে নড়বেন না?যদি না নড়ে তো আমি বলে দিচ্ছি আমি আজ নিচে শুবো”
.
ইমাদ ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,”বেশি বকরবকর করলে বিছানার সাথে বেঁধে রেখে দেবো।চেনেন আমায়?”
.
-“জ্বী।ইমাদ হাসান অমি”
.
-“আমার পুরো নাম জানলেন কি করে?”
.
-“আপনার সব বইখাতা পড়া হয়ে গেছে আমার।কাল অফিস থেকে আসার পথে কিছু ম্যাগাজিন আনবেন।”
.
-“আনবো।যাই দেখে আসি বাবা সরেছে কিনা”
.
ইমাদ দরজা খুলতেই দেখলো বাবা কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
.
-“কি হুম??আবার পানি তৃষ্ণা পেয়েছে?পানি খাবি?”
.
-“না মানে।এমনি দেখতে এলাম লাইট অফ করেছো কিনা!
.
.-“না অফ করবো না।আমি আজ এখানেই ঘুমাবো”
.
ইমাদ ঢোক গিলে রুমে ফিরে এসেছে।পুতুল নিচে বিছানা পেতে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়েছে যাতে ইমাদ ওকে উঠাতে না পারে।ইমাদ কপাল কুঁচকে বিছানায় বসে পড়েছে।
-“যা বোঝা গেলো খুব শীঘ্রই বাবার কাছে ধরা খাবো।মা ও তো এত গোয়েন্দাগিরি করতো না যতটা বাবা করছে।”
—–
-“ছেলেটার হলোটা কি??সব ঠিক মনে হচ্ছে না।এ বিষয়ে আলাপ করতে হবে ওর মায়ের সাথে।কিন্তু আমি কেন আলাপ করবো?সে নিজে থেকে কখনও কল করে আমায়?
ফোন বাজছে মনে হয়।
ফোনটা কই রাখলাম আবার।এই তো পেলাম।হ্যালো কে?”
.
-“খালা!!!! খালু ফোন ধরছে ধরেন ধরেন”
.
-“হুম।হ্যালো”
.
-“কে আপনি?আপনি কার খালা?”
.
-“আমি রওনক বলছি”
.
-“ওহহহহহ হো ওহহহ হো।এটা কি মিসেস রওনক নাকি?”
.
-“হ্যাঁ”
.
-“বাহ্!কি সৌভাগ্য আমার।মিসেস রওনক আমায় ফোন করেছে।নিজের ইগোকে সাইডে রেখে এতগুলো বছর পর উনি আমায় কল করেছে।এই খুশি আমি কোথায় রাখবো?”
.
-“শুনো।তোমায় আমি কল করিনি।পপি করেছে।আর আমি ধরেছি”
.
-“ওকে দিয়ে কল তুমি করাইছো।টাঙানো আর ঝুলানো দুইটাই সেইম জিনিস”
.
-“যাই হোক তোমার ত্যাড়া কথার সাথে তাল মেলানোর সময় আমার নেই।কথা বলতে ফোন করেছিলাম ইমাদকে নিয়ে”
.
-“বলেন শুনি।”
.
-“ইমাদের হাবভাব ঠিক মনে হয় তোমার?”
.
বাবা সোফায় বসে থুতনির নিচে হাত নিয়ে বললেন,”এতদিন আমার ছেলে ভালোই ছিল।তবে রাঙামাটি থেকে আসার পর থেকে ওকে বেশ অন্যরকম লাগে।কেমন যেন খাপ ছাড়া।
তার উপর পাকা রাঁধে।ভালো ভালো ডিস।অথচ ইমাদ জীবনে ডিম ভাজি,আলুর ভর্তা, ডাল আর টেনেটুনে মুরগীর মাংস রান্না করা ছাড়া কিছুই রাঁধতে জানত না। সেই ছেলে আমার দিনে দুইটা পদ রান্না করে।আবার যে ছেলে তার রুম থেকেই বের হতো না। টেনেও বের করতে পারতাম না এখন সে উদগ্রীব হয়ে থাকে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য।বিষয়টা বেশ এলোমেলো লাগে।মিজান বললো একটা মেয়ের সাথে দেখেছে আজ।তুমি কিছু জানো ঐ মেয়ের কথা?”
.
-“জানি মানে!!ঐ মেয়েটা ইমাদের কত কাছের লোক সেটা প্রমাণ করে ওর গায়ে থাকা আমার বেগুনি রঙের শাড়ীটা।আমি বুঝলাম না ওটা ঐ মেয়েটা পেলো কই।”
.
ইমাদের বাবা জিভে কামড় দিয়ে বললেন,”ওটা আমার কাছে ছিল।মানে এমনেই পড়ে ছিল।কদিন পর ফালাই দিতাম।”
.
-“মিথ্যে বলবা না।তুমি ওটা আমার স্মৃতি হিসেবে রাখছো। বেশ ভালোমতন জানি আমি”
.
-“যাই হোক!
শাড়ীটা তাহলে ইমাদ নিয়ে ঐ মেয়েটাকে দিয়েছে”
.
-“রাইট।কিন্তু কথা হলো কেন দিয়েছে।সিনথিয়াকে দিলেও এল কথা ছিল।অন্য একটা মেয়েকে দেওয়ার মানে বুঝো?”
.
-“রাখো তোমার বুন্দিয়া!!তোমার ছেলে প্রেমে পড়ছে ওটা বুঝো”
.
-“কিহহহ!এটা হতে পারে না।ওর তো কদিন পরে সিনথিয়ার সাথে বিয়ে”
.
-“তুমি করলার সাথে পটলের বিয়ে দিলে সেটা হবে?খাটে?”
.
-“না”
.
-“করলার সাথে আলুর বিয়ে দেওয়া যায়।পটলের না।
তাহলেই করলা ভাজি হয়।বুঝছো?”
.
-“না বুঝিনি”
.
-“তো শুনো।তোমার ছেলে সিনথিয়াকে পছন্দ করেনা।যতদূর বুঝলাম আজকের মেয়েটাকে সে পছন্দ করে।”
.
-“না এটা হয় না।তুমি জানো কাল পরশুর দিকে ওদের এঙ্গেজমেন্ট।আর ঐ মেয়েটাও বলিহারি।একটা মেয়ের হবু বরের সঙ্গে কিভাবে ঘুরাফিরা করে সে?”
.
-“ইমাদ তো বাচ্চা ছেলে না।
এনাফ ম্যাচিউর।সে মেয়েটাকে পাত্তা দিয়েছে বলেই আমরা ওর পাশে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছি।নাহলে তো সিনথিয়াকে দেখতাম।”
.
-“আমার মনে হয় ইমাদের সাথে কথা বলা উচিত।”
.
-“হ্যাঁ বলো।ছেলেরে তো সাদা পোটি পরাই রাখছো।তুমি যার সাথে ওরে বিয়ে দিতে চাইবে তাকেই ওর বিয়ে করতে হবে।তা নাহলে কি জানি একটা ডায়ালগ মারো।ওহ হ্যাঁ “মরা মুখ দেখবি”
.
-“চুপ করো!!
সিধা কথা বলা তোমার একেবারেই স্বভাব থেকে উঠে গেছে।”
.
-“তাহলে মানছো আমার স্বভাবে আগে সিধা কথা বলা ছিল?”
.
-“বাই”
.
-“টাটা”
—–
ইমাদ গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
ঘুম আসছে না।কারণ দুটো।একটা হলো বাবা সোফার রুম থেকে নড়ছে না।আর আরেকটা হলো পুতুল নিচে শুয়ে পড়েছে।
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ইমাদ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে এখন।
আকাশে দূরত্বে থাকা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ইমাদ কিঞ্চিত হেসে গানের দুটো লাইন গাইলো।
-“ওহে কি করিলে বলো পাইবো তাহারে,,,”
“””রাখিব আঁখিতে আঁখিতে””””
.
গানটা কাউকে উদ্দেশ্য করে ছিল না।মন ভালো করার জন্যই এই দু লাইন গাওয়া।কিছু কিছু গান কাউকে ডেডিকেট করে হয় না।গান একান্তই নিজের জন্য ও গাওয়া যায়।কেন সবসময় আরেকজনের জন্য গাইতে হবে?
নিজের জন্য ও তো গাওয়া যায়।ইমাদ নিজের জন্যই গেয়েছে।অপরাজিতা ফুলগাছটা বাতাসে দুলছে।ইমাদ একটা ফুল নিয়ে চাঁদের আলোয় সেটা উউল্টেপাল্টে দেখছে।তারপর কি মনে করে পুতুলের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে দিলো।পুতুল ভয় পেয়ে উঠে পড়েছে।ইমাদ এগিয়ে এসে বললো,”বিছানায় এসে শুয়ে পড়ুন নাহলে সারারাত এমন করে ডিস্টার্ব করবো”
.
-“করেন।দেখি কতদূর পারেন”
.
ইমাদ তার আলমারিটা খুলে এলোমেলো হয়ে থাকা জামাগুলোতে হাত বুলিয়ে একটা একটা করে পুতুলের গায়ে মারতে মারতে বললো,”অনেকদিন গুছানো হয় না।এখন গুছাবো।এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে।”
.
পুতুল রেগে বিছানায় এসে বসলো।ইমাদ হাসলো কিন্তু হাসি দেখালো না ওকে।
হাসি থামিয়ে একটা একটা করে জামা গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখছে এখন।সব গুছনো শেষে পিছন ফিরে দেখলো পুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই রুমের আলো নিভিয়ে সে নিচে বসে থাকলো চুপচাপ।ওদিকে বাবা সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।তাও নিজের রুমে গেলেন না।ইমাদ বাধ্য হয়েই আজ পুতুলের সাথে রইলো এই রুমে।সকালে রান্নাঘরে ঢুকার আগে বাবা নিউজপেপার নিয়ে হাজির হলেন ওর সামনে।ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললেন,
“বিমোহিত ঘটনা ছেপেছে আজ খবরে”””
“””আমি শিহরিত তাই দেখে নিরবে”””
“”ওগো বিনোদিনী তুমি মোরে রেখে গেলে কই”””
“””আমি ভাতের সঙ্গে খাই পুঁটি আর কই”””
.
-“বাবা তোমার শরীর খারাপ?”
.
-“নাহ তো।কেন আমার কবিতা তোর ভাল্লাগেনি?”
.
-“না যেভাবে সিরিয়াস লুক নিয়েছিলে।আমি ভাবলাম কিছু বলবে হয়ত।বাট তুমি তো কবিতা শুরু করলে”
.
-“মন চাইলো তোকে দেখে কবিতা বলার।কেমন লাগলো সেটা বললি না”
.
-“তোমার কবিতা শুনে আমি বিমোহিত”
.
-“দারুন মন্তব্য। তোর মন্তব্যে টুকুস করে লাভ রিয়েক্ট দিলাম যা!!
চা বানিয়ে আন মোর জন্য”
.
ইমাদ আড় চোখে তাকিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে
বাবা কবিতার বাকি লাইন বলতে বলতে সোফায় এসে বসলেন।পুতুল কান খাঁড়া করে কবিতা শুনার চেষ্টা করছে।
.
-“ওগো মহারাণী। একবার দেখা দাও মোরে”””
“”আমাকে তোমার অপেক্ষা খাচ্ছে কুচি কুচি করে”””
.
পুতুল ফিক করে হেসে লুকিয়ে পড়লো।বাবা মাথা উঁচু করে বললেন,”ইমাদ তোর রুমে কি কেউ আছে?হাসির আওয়াজ পেলাম।কবিতায় মগ্ন বলে উঠতে পারছি না।
গিয়ে দেখ তো।”
.
ইমাদ চোরের মতন এসে দরজা বাহিরে দিয়ে লাগিয়ে চলে গেলো আবার।
.
-“””জনম জনম তোমারই অপেক্ষা করবো আমি””
“””আমাদের ছেলের নাম ইমাদ হাসান অমি!!!””””
.
ইমাদ রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে বললো,”বাবা??মা ফোন দিয়েছিল নাকি তুমি দিয়েছো?”
.
-“হেহ!!আমি ক্যান দেবো।আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না?তোর মা দিছে।তারপর আমি কথা বলছি।আমার ঠেকা পড়ে নাই এতো”
.
-“সত্যি?মা ফোন দিছিল??বিশ্বাস হয় না।ফোন দিয়ে কি বললো?”
.
-“বাবা মায়ের পার্সোনাল কথা শুনতে হবে না তোর।নিজের কাজ কর যা!
সব খালি তাকে জানতে হবে।কবিতা প্র্যাকটিস করতে দে আমায়।
চলবে”””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১১
Writer-Afnan Lara
.
আজ ইমাদ বাবার সঙ্গেই বেরিয়ে গেছে।
পুতুল বাসার দরজা লক করে সেও বেরিয়ে পড়েছে।উদ্দেশ্য হলো ইমাদের মায়ের বাসা।সেখানে যাওয়ার এক দারুন প্ল্যান করে রেখেছে সে।আর তা হলো সে বই বিক্রি করার নাম করে যাবে।ইমাদ প্রচুর বই পড়ে।এত সুন্দর করে পড়ে যে বই দেখলে কেউ বলবে না ওটা কয়েক বছর পুরোনো বই।তাই বই সব একটা ব্যাগে পুরে হেঁটে চললো সে।
ইমাদের মায়ের সাথে আলাপ করার অনেক ইচ্ছা তার।এমনও হতে পারে এতদিনের যে বিবাদ লেগে ছিল তা সে মেটাতে পারবে।এটা ভাঙ্গা পরিবারকে আবারও গড়িয়ে দেওয়াও হতে পারে।
টিং টং!!
.
পপি এসে দরজা খুললো।পুতুলকে দেখেই ইয়া বড় চোখ করে এক দৌড় মারলো সে ভেতরের রুমের দিকে।পুতুল মূর্তির মতন বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলার পর শুধু ড্রয়িং রুমটাই দেখা যাচ্ছে। পপি ফিরে আসলো ইমাদের মাকে নিয়ে।সারা মুখে মাস্ক লাগিয়ে রুপ চর্চা করছিলেন তিনি।এগিয়ে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে বললেন,”কে তুমি?”
.
-“আমি আসলে…”
.
-“থাক বলতে হবে না।তুমি সেই না যে কাল আমার ইমাদের সঙ্গে ওর বন্ধুর এঙ্গেজমেন্টে গেছিলে?”
.
পুতুল ঢোক গিলে পিছোচ্ছে। সে একদমই জানত না ইমাদের মা ওকে চিনে ফেলেছে।ওকে পিছোতে দেখে ইমাদের মা এগিয়ে এসে খপ করে ওর হাতটা ধরে বাসায় ঢুকালেন।পপিকে বললেন দরজা লাগাতে।
.
-“বসো এখানে।তোমার সাথে অনেক কথা আছে আমার”।
.
-“জ্বী আন্টি বলুন”
.
-“তুমি ইমাদকে কতদিন হলো চেনো?”
.
-“অল্প কদিন হয়েছে”
.
-“সিনথিয়ার সাথে ওর বিয়ে সেটা জানো?’
.
-“জ্বী”
.
-“ওহ।ইমাদ তোমার কেমন ফ্রেন্ড?”
.
-“এমনি নরমাল ফ্রেন্ড আমরা।বেশি কিছু না”
.
-“তাহলে ও আমার শাড়ীটা তোমায় কেন দিলো?তুমি নিলেই বা কেন?তোমার কি শাড়ী নেই?”
.
-“ইয়ে মানে আমার মায়ের শাড়ী পছন্দ হচ্ছিলো না তো তাই…”
.
-“ব্যাগে কি ওসব?”
.
-“বই”
.
-“ওহ।দেখি?”
.
ইমাদের মা বইগুলো হাতে নিয়ে দেখলেন সব হুমায়ূন আহমেদের লেখা বই।ইমাদ পড়ে এসব বই।তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,”এগুলো আনছো কেন?”
.
-“না মানে….”
.
-“এগুলো তো ইমাদ পড়ে।ওর বাসা থেকে আনোনি তো আবার?”
.
-“(কি ঝামেলা।এত প্রশ্ন কেন করছে?মাথা ঘুরছে আমার।এখন কি করবো?)
.
-“কি হলো উত্তর দাও।”
.
-“না এগুলো আমার।একটা ফ্রেন্ডকে দেবো বলে এনেছি”
.
-“ওহ।আমার শাড়ীটা ইমাদকে ফেরত দিয়েছো?”
.
-“হুম”
.
-“ওর কদিন পর এঙ্গেজমেন্ট।আসার দরকার নাই তোমার।সিনথিয়াকে চেনো তো?”
.
-“হুম চিনি”
.
-“ভালো তাহলে।সবই তো জানো।তো এটা বলো এখানে কেন এসেছো?”
.
-“ইমাদ ভাইয়ার বাবা অনেক অসুস্থ। তার পরেও তিনি অফিসে গেছেন।ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনেননি।এতই অসুস্থ যে তিনি হাঁটতেও পারছিলেন না।ইমাদ ভাইয়া বললো আর কি”
.
-“ইমাদের মা ভ্রু কুঁচকে বললেন”তো?”
.
-“তো ইমাদ ভাইয়া একা আর কি সেবা করবে।আপনি যদি আসতেন”
.
-“জীবনেও না”
.
-“তাহলে আমি যাই সেবা করতে?ইমাদ ভাইয়া তো আছেই”
.
-“না তুমি কেন যাবে।পপি সিনথিয়ারে ফোন দে তো”
.
-“খালা সিনথিয়া ম্যাডাম তো তার নানির বাড়ি গেছে। আপনারে কইসিলো না?”
.
-“ওহ তাই তো।”
.
-“আপনি যাবেন না যখন!!!বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হবে”
.
-“এটা নতুন না।এই কটা বছরে সে অনেকবার সিক হয়েছে।এমনি এমনি ভালো হয়ে যাবে”
.
-“তার বুকটা হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে গেছিল।আমার মনে হয় হার্টে প্রব্লেম”
.
-“কি বলছো।তুমি সিউর?”
.
-“একদম”
.
-“পপি কি বলিস?”
.
-“খালা আর কত রাগ করে থাকবেন।একবার গিয়ে দেখে আসেন”
.
-“না না আন্টি!!”
.
-“কি না?”
.
-“এখন তো উনি অফিসে।আসবেন রাতের বারোটায়।তখন আসিয়েন”
.
-“তুমি জানো কিভাবে এসব?”
.
-“ইমাদ ভাইয়া বললো।”
.
“ভালো।নাম কি তোমার?কোথায় থাকো?বাবা কি করে?বাসায় আর কে কে আছে?কিসে পড়ো?”
.
-“আমার নাম পুতুল চৌধুরী।আমি থাকি মতিঝিলে।বাবা ব্যবসায়ী।বাসায় আমি আমার মা,বাবা আর বড় ভাইয়া থাকি।আর আমি অনার্সে পড়ি।”
.
-“ওহহ!!ইমাদের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ো?”
.
-“হুম।”
.
-“ভালো।যেতে পারো এখন।ইমাদকে বলে দিবা আমি আজ একটু ওকে দেখতে আসবো”
.
পুতুল এক গাল হাসি নিয়ে চলে গেলো।প্ল্যান সাকসেস।হাসতে হাসতে বাসায় এসে দেখলো ইমাদ সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে ওর অপেক্ষা করছে।
.
-“একি আপনি অফিসে যাননি??”
.
-“গেছিলাম।গিয়ে জানলাম আজ ছুটি।কিসের যেন কাজ চলছে অফিসে।রেনোভেটের।আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”
.
-“আপনার মায়ের বাসায়”
.
-“আর ইউ সিরিয়াস?”
.
-“এক্কেবারে।”
.
-“কিন্তু কেন?আর আপনার হাতে ওটা কিসের ব্যাগ?”
.
পুতুল পানি এনে ইমাদের দিকে ধরে বললো,”আগে পানি খান।আজ আপনার মা এই বাসায় আসবে।”
.
ইমাদ চোখ বড় করে বললো,”কিহ!!কেন?”
.
-“হেহে।এমন প্ল্যান করেছি না।ওদের মিলিয়েই ছাড়বো।”
.
-“কেন আসছে?”
.
-“বললাম আপনার বাবা অসুস্থ।”
.
ইমাদ দাঁত কেলিয়ে ব্রু নাঁচিয়ে বললো,”দারুন।তবে এই বুদ্ধি আমিও সঁপে ছিলাম লাভ হয়নি।তা আপনি কি মধু ঢাললেন?”
.
-“মধুতে জিরা গুরা দিয়েছি মিক্স করে।বলেছি হার্ট প্রব্লেম”
.
-“আরও দারুন।তবে একটা কথা জানতে চাই। আপনি আমার মা বাবাকে মেলাতে চান কেন?আপনার কি লাভ?”
.
-“আপনি আমায় সাহায্য করেছেন এতদিন।আমার ও তো উচিত আপনাকে হেল্প করা।আর আমি জানি আপনি আপনার মা বাবার সঙ্গে ভালো থাকবেন।তারা একসাথে থাকলে আপনার মন ভালো থাকবে।এই মেয়েটার এইটুকুই ইচ্ছা”
.
-“সেই সুখ আপনি দেখতে পারবেন না।
আফসোস।”
.
কথাটা বলে ইমাদ গেস্ট রুমের দিকে চলে গেছে।পুতুল রোবটের মতন দাঁড়িয়ে থাকলো কথাটা শুনে।রেললাইনের মতন চলছে কথাটা মাথার চারপাশে।ডুগুরডুগুর।
-“হ্যাঁ আমি কিভাবে দেখবো।দেখবে সিনথিয়া আপু।খোঁচা মারলেন?নাকি সবসময় কঠিন কথা বলেন বলে আজও বললেন?”
ভাবতে ভাবতে পুতুল রান্নাঘরে চলে এসেছে।আজ ঝাল দিয়ে বেগুনের তরকারি বানাবে।আর সাথে মসুর ডাল।আরেকটা পদ হলো রুই মাছের বড় বড় পিস ভাজি করবে।
-“ব্যস হয়ে গেলো মেনু।কলিংবেল বাজছে।ইমাদ ভাইয়ার মা এসে পড়েননি তো?তাহলে আমি শেষ।”
.
ইমাদ তোয়ালে নিয়েছিল গোসল করবে বলে।রান্নাঘরের দিকে এক নজর তাকিয়ে দরজা খুলতে গেলো সে।পুতুল দেয়াল ধরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে এসেছে।আরিয়ান এসেছে খেলবে বলে।পুতুল এক চুলায় মাছ ভাজি করছে আর আরেক চুলায় দুধ গরম করতে দিয়েছে।ইমাদ এসে বলেছে আরিয়ান খাবে।আরিয়ান পিছু পিছু এসে বললো,”মামানি টু তুমি কি সারাদিন এখানে থাকো?”
.
-“নাহ।মাঝে মাঝে”
.
-“তাহলে মামানি ওয়ান আসেনা কেন?”
.
-“আরিয়ান চলো আমরা লুডু খেলবো।মামানিকে প্রশ্ন করা বন্ধ করো।”
.
আরিয়ান মাথা নাড়িয়ে চলে যেতেই পুতুল খুন্তি উপরে তুলে বললো,”আমি আপনার বউ??মামানি কে?!”
.
-“আরিয়ানকে বুঝাতে বললাম।এরকম রাগেন কে
আপনি আমার বউ কেন হবেন।আমার বউ তো সিনথিয়া”
.
পুতুল খুন্তিটা নামিয়ে বললো,”যান তো এখান থেকে।আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।কাজের সময় মন আরেকদিকে থাকলে লবণ বেশি দিয়ে ফেলি আমি”
.
ইমাদ মুচকি হেসে চলে গেছে।
গ্রীষ্মের দুপুর বেলার কড়া রোদ গ্রিলের জানালা পেরিয়ে পুতুলের হাতের উপর পড়ছে।আর সে চুপচাপ মাছ ভোজে চলেছে।আজকে যখন ইমাদের মা আসবে তাকে ইমাদের রুমে লুকিয়ে থাকতে হবে সারাক্ষণ। খাটের তলায় ও জায়গা হতে পারে।কিন্তু উনাদের এক করতে হলে এটা সামান্য ব্যাপার।
সমস্যা আরেক জায়গায়।বাসায় আসার পর এসে যদি দেখে ইমাদ ভাইয়ার বাবা একেবারেই সুস্থ তখন কি হবে?
-“ধুর কি ঝামেলা।আচ্ছা আসলেই হলো।পরেরটা পরে দেখা যাবে।এই যে ভাইয়া এসে আরিয়ানের জন্য দুধের গ্লাসটা নিয়ে যান।আমি কাজে ব্যস্ত আছি।রান্নাঘর থেকে নড়লেই মাছ পুড়ে যাবে”
.
-“আসছি।আরিয়ান তুমি কিন্তু চিটিং করবে না।আমি যদি এসে দেখি কাঁচা গুটি হেঁটে নিমিষেই পাকনা হয়ে গেছে তো খেলা বন্ধ”
.
-“ওকে ফাইন।”
.
ইমাদ এসে গ্লাসটা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় দেখলো পুতুল মাছে ময়দা ঢালছে।ইমাদ ওর হাত আটকে বললো,”এটা চিকেন ফ্রাই না”
.
-“ওহ সরি।খেয়াল করিনি!
.
-“কি ভাবছেন বলুন তো?”
.
-“আপনার মাকে তো বলে দিলাম আপনার বাবা সিক
কিন্তু এসে যদি দেখে উনি একেবারে সুস্থ -সবল তখন কি হবে?”
.
-“সেটাও তো কথা।আচ্ছা বাবাকে টেম্পোরারি সিক করার দায়িত্ব আমার।আপনাকে এত ভাবতে হবে না।আপনি বরং সুন্দর করে মাছ ভাজেন।নুন হলুদের সাথে মরিচের গুড়াও দিয়েন”
.
-“জানি।আইছে আমাকে শেখাতে।আপনার বাবা আমার কত তারিফ করে সেটা দেখেও তো আপনার বোঝা উচিত আমি কত ভালো রান্না করি।সেটা তো বলেন না উল্টে এমন ভাবে কথা বলেন যেন আমি রান্না জানি না”
.
ইমাদ মুখটা বাঁকিয়ে বললো,”এত রাগ?”
.
-“যান আপনি।”
—–
-“একে তো এত এত কড়া রোদ! আরও মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।আরেক দিকে বিপদে পড়ার আশঙ্কা নাড়া দিচ্ছে ক্রমশ।রেহায় পাবো কি করে কে জানে!”
.
আরিয়ান আরও কিছুক্ষণ থেকে তার পর চলে গেছে।ইমাদ বসে বসে বই পড়েছে।পুতুল টেবিল সাজিয়ে চলে গেছে গোসল করবে বলে।মাথা ঠাণ্ডা করা জরুরি।গোসল করলে পুরোটা ঠাণ্ডা না হলে একটুখানি ঠাণ্ডা হবে মাথাটা।
.
-“ঝর্নার পানি বৃষ্টির মতন ঝরে গায়ে পড়ছে।নিচে বসে এক দৃষ্টিতে তা দেখছে পুতুল।মনে হয় বৃষ্টি হয় কিন্তু নাহ!!
এসবকে বৃষ্টির সাথে মেলানো যায় না।বৃষ্টি কি শুধু পানি নিয়ে আসে?বৃষ্টি আসে এক রাশ হাওয়া নিয়ে।হেলেদুলে আসে সেসব।
মাথার শুকনো চুল উড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে।মনকে সতেজ করতে।
তারপর বৃষ্টির তোড়ে গাছপালা নুইয়ে পড়ার দৃশ্য।বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর ভেজা মাটির গন্ধ।এসব কি আর এই ঝর্না দিতে পারে?হয়ত এত গরমে বৃষ্টি হতে পারে।ইশ কত ভালো লাগবে তখন।বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা হাতে ভিজবো।টুপ টাপ বৃষ্টি দেখবো।মনটা তখন ১০০% ভালো থাকবে।
কতই না ভালো হবে।আমি চাই এখন বৃষ্টি হোক।
খুব করে হোক।মনটা কেমন বিষাদময় হয়ে আছে।আর নাহহহ।এর বেশি পানির নিচে থাকলে জ্বর এসে যাবে।
উঠে পড়ি”
.
পুতুল গায়ের পানি মুছে তোয়ালে মাথায় পেঁচিয়ে শুকনো জামা পরে নিলো।
তারপর রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ইমাদ খালি প্লেট নিয়ে বসে আছে ওর অপেক্ষায়।পুতুল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে কাছে এসে বললো,”খাওয়া শুরু করুন না”
.
-“ভাবলাম আপনার সঙ্গে খাব।কিন্তু আপনি তো মেয়ে মানুষ..গোসল করতে ১৪ঘন্টা…”
.
-“চুপ!!এটার জন্য ও উত্তর একই থাকবে।আপনাদের আমাদের মতন বড় চুল না।কোমল ত্বক না।হাজার টেনসন নাই মাথায় আরর…”
.
-“হইছে।খিধাকে তালাবন্ধ রাখতে চাইছি না।খাবার দিন।আজ দুপুরে ভাত ঘুম দেবো”
.
-“দিচ্ছি।”
.
পুতুল কাছে এসে ভাত বাড়তে বাড়তে বললো,”সিনথিয়া আপু নাকি তার নানু বাড়ি গেছে”
.
-“মা আপনার সঙ্গে সিনথিয়াকে নিয়ে আলাপ করেছে?”
.
-“হুম।কেন করবে না।আপনি তো সিনথিয়া আপুর হবু বর।আন্টির সাধ্য হলে তার সাথে দেখাও করিয়ে দিতেন।”
চলবে””