বাবুই পাখি পর্ব-১২+১৩

0
769

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১২
Writer-Afnan Lara
.
-“মেয়েটা জ্বলছে।খুব দারুণ ভাবে জ্বলছে সে।মেয়েদের জ্বলতে দেখাকে দারুণ বলা ঠিক নয়।তবে আমি দারুণ বলছি কারণ এই মেয়েটা আমার বিষয়ে জ্বলছে।অন্য একটা মেয়ের নাম আমার সাথে জড়িয়েছে বলেই তার এত জ্বলা জ্বলা ভাব।মাঝে মাঝে ভাবি এরকম জ্বলতে জ্বলতে কবে না জানি গ্রিল হিউম্যান হয়ে যায়।”
.
-“ওমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?খেয়ে বলুন লবণ ঠিক আছে কিনা।আমি আজ হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে রান্না সেরেছি।জানি না কেমন হয়েছে।টেস্ট করার মুড ও ছিল না।যদি লবণ বেশি হয়ে থাকে তবে সেটা আপনার দোষ।আমাকে নানান কথায় চরকার মতন ঘুরিয়ে গেছিলেন ঠিক দুবার”
.
-“লবণ হলেও আমি খাব।লবণ না হলেও সেই আমিই খাব।তাহলে এতে দোষ চাপাচাপির কি হলো?আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
একটা কথা বলি।আপনি না খুব চিন্তা করেন।এত চিন্তার কিছু নেই।আমার বিয়ের দেরি আছে”
.
পুতুল চোখটা বড় করে দু সেকেন্ড চেয়ে রইলো।এরপর এমন একটা ভাব ধরলো যেন ইমাদের কথাটায় একটু খানিও সত্যতা নেই।চোখ স্বাভাবিক করে উত্তরে সে বললো,”আপনার বিয়ে হলেও আমার কি আর না হলেও আমার কি।”
.
-“আপনার তো অনেক কিছু যায় আসে।এই ধরুন খাবারে লবণ বেশি পড়েছে কিনা সেটা নিয়ে যে মনে সংশয় ধরেছিল সেটা আর থাকবে না।কি ঠিক বললাম তো?”
.
পুতুল এবার চটে গেছে।নিজের প্লেটটা হাতে নিয়ে সোফায় এসে বসলো সে।ইমাদের সঙ্গে আজ একসাথে এক টেবিলে বসে খাওয়ার শখ তার নেই।বেশি সত্যবাদী মানুষ তার পছন্দ না।
-“আর এই ছেলেটা একের পর এক সত্যি বলেই যাচ্ছে।যেন আমার মনের বইটা তার চোখের সামনে অটোমেটিক পাতা উল্টাচ্ছে।কি সুন্দর করে লাইন বাই লাইন বলে দিতে পারে।এতই যখন বুঝে তখন বলুক না এখন আমি কি ভাবছি?”
.
ইমাদ পুতুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।এরপর নিজের প্লেটের ভাতগুলোকে তরকারিতে মিশিয়ে একসাথ করে গোল করে লোকমা বানিয়ে মুখে পুরলো শান্তভাবে। লোকমা অর্ধেক চিবিয়ে বললো,”আমি সব বুঝতে পারি বলে অবাক হচ্ছেন”
.
পুতুলের খাওয়া উঠে গেছে।আর কিছু ভাববে না এটা ভেবে নিলো সে।ইমাদ নিদারুণ ভাবে ভাতটা শেষ করে আরেকটু ভাত প্লেটে নিয়েছে।
বেগুনের তরকারিটা বেশ হয়েছে।কিছু কিছু বেগুনের টুকরো গুলো তরকারিতে মিশে তরকারিটাকে ঘন করে তুলেছে।
-“মন চায় শুধু ঝোল নিই।ভাত কম ঝোল বেশি ভাল্লাগছে আজ।”
.
পুতুল ইমাদের আর কোনো কথা শুনতে না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজেও খাওয়া শুরু করেছে।
তার রান্না করা খাবার খুব ভালো হয়েছে অথচ সে স্বাদটা বুঝতে পারছে না।ভাতে হাত রেখে আকাশ পাতাল আঁকছে আঙ্গুল দিয়ে।ভাবতে না চেয়েও ভাবছে।কত শত ভাবনা তার।তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভাবনা হলো ইমাদের মা আসার পর কি ঘটবে।আপাতত এটাই ভাবছে পুতুল।
ইমাদ আর সিনথিয়ার টপিক পরে আসবে।একসাথে আসলে মাথার মগজ গুলে জুস হয়ে যাবে।
ইমাদ খাওয়া শেষ করে হাই তুলে গেস্ট রুমে গিয়ে ধপাস করে বিছানার মাঝখানে শুয়ে পড়েছে।যেন এক বালক পাঁচ তলা দালান থেকে লাফিয়ে মরে পড়ে আছে।ঠিক সেরকম লাগে।
পুতুল খাবার শেষ করলো কিছুক্ষন টিভি দেখে।টিভি না দেখলে তার খাওয়া জমে না।খেতে খেতে এবার বুঝতে পারলো আসলেই তার রান্না ভালো হয়েছে।ইমাদের বাবা খুশি হবেন অনেক।প্লেট ধুয়ে রেখে রান্নাঘর থেকে আসার সময় পুতুল খেয়াল করলো পশ্চিম পাশে দূরের আকাশটা কালো রঙ ধারণ করেছে।আস্তে আস্তে এদিকটাও কালো হয়ে আসছে।
-“তার মানে বৃষ্টি হবে।কি মজার একটা ব্যাপার!!মন সতেজ হবে।কফি খেতে খেতে গান শুনা যাবে।তারপর ঠাণ্ডায় একটু ঘুম।বিকালে উঠে বাদাম ভাজা সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা।ভাবতেই মনটা তাজা তাজা হয়ে আসছে।”
.
মনের সুখে পুতুল ওড়না গলায় পেঁচিয়ে দরজা খুলে এক ছুটে ছাদে এসে হাজির।দরজা এমনি লক করে রেখে এসেছে।যে কেউ ঢুকে পড়তে পারবে।কিন্তু অতোসব পুতুল ভাবেনি কারণ তার ধারণা চোর ডাকাত আসলে আর যাই হোক ইমাদকে তুলে নিয়ে যাবে না।
কালো মেঘ আস্তে ধীরে উড়ে আসছে মনে হয় খালি চোখে।কিন্তু চোখটাকে ক্ষীণ করে শুধু মেঘটার উপর কন্সান্ট্রেট করলে বোঝা যায় মেঘটার গতিবেগ অনেক বেশি।এত জোরে বিমান ও চলে না।
-“ইশ আমি যদি এরকম মেঘের উপর চেপে বসতে পারতাম!তাহলে ৮০দিন কেন!!!
৮০মিনিটে পুরো বিশ্ব ঘোরা হয়ে যেতো আমার।মনে হয় আকাশটা মাথার উপর চলে এসেছে।এবার বুঝি বৃষ্টি হবে।
“””আয় বৃষ্টি চেপে”””
“””ধান দেবো মেপে”””
.
-“চড় দিব গালে!!”
.
পুতুল ছড়া বন্ধ করে বোকার মতন পাশে তাকিয়ে আছে।ইমাদ অগ্নি দৃষ্টিতে ওকে দেখছে।কোমড়ে হাত রেখে।রাগে ফুঁসছে সে।পুতুল কপাল কুঁচকে বললো,”চড় দিবেন বললেন?কিন্তু কেন?আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি?”
.
-“এখন যে বজ্রপাত হবে আপনার মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে??এরকম সময়ে কেউ ছাদে আসে?নায়িকা ভাব নিচ্ছেন??জানেন সিনেমাতে এরকম যত সিন আছে সব আর্টিফিশিয়াল?
নায়িকার মাথার উপর ছাতা ধরে একজন,আরেকজন বোতল থেকে পানি পিঁচপিঁচ করে মারে নায়িকার গায়ে আর আরেকজন হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে চুল উড়ায়।
আর উনি এসব রেখে ছাদে এসেছেন সিনেমার মতো ভাব নিতে”
.
-“আশ্চর্য!আমি নিজেকে নায়িকা ভাববো কেন?আমি তো এমনি এলাম।একটু বৃষ্টিবিলাস করতে।ব্যস এইটুকুই”
.
-“আর সময় পেলেন না?এখন যে বজ্রপাত শুরু হবে জানেন?”
.
ইমাদের কথা শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে গেলো বজ্রপাত। ইমাদ ভয় পেলো।কিন্তু পুতুল পেলো না।
ইমাদ এত ভয় পেয়েছে যে পুতুলের ডান হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে।পুতুল মিটমিট করে কিছুক্ষন হেসে বললো,”ভয় তো আমার পাবার কথা তাই না?”
.
-“চলেন এখন।অনেক হয়েছে সিনেমার সিন।আর একটু হলে হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেতো।এই কমবয়সে মরতে চাই না।বিয়ে করা হলো না,হানিমুনে যাওয়া হলো না, বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা হলো না”
.
-“আপনার এত স্বপ্ন?তাহলে সিনথিয়া আপুকে হ্যাঁ বলতে দুই পা এগিয়ে আরও চার পা পিছান কেন বলুন তো?”
.
-“সেসব আপনার জানার কাম্য নয়।বাচ্চারা এবিসিডি ছাড়া অন্য কিছু মাথায় নিতে পারে না।যার আই কিউ যেমন আর কি।অবশ্য আপনার ও এমন সুবুদ্ধি হবে তবে সেটা আজ থেকে পাঁচ বছর পর।”
—-
পুতুল ইমাদের পিছু পিছু বাসায় চলে এসেছে।বৃষ্টিতে ভিজা হলো না বলে এতক্ষণ সতেজ রাখা মনটা তার ভীষণরকম ভাবে খারাপ হয়ে গেছে।ইমাদ সেটা বুঝতে পেরে বলে গেলো সে কফি বানাতে যাচ্ছে।পুতুলের মনে লাড্ডু ফুটলেও দ্বিতীয় বার আরেকটি লাড্ডু ফুটে গেলো আর তার কারণ হলো ছাদে না হোক বারান্দায় তো ভেজা যায়?
এই দারুণ বুদ্ধিটা নিয়ে পুতুল এসে হাজির ইমাদের রুমের বারান্দায়।হাত দুটোকে ভাসমান রেখে বৃষ্টি অনুভব করছে সে।মায়ের বকুনির জন্য বৃষ্টিতে ভেজা হয়ে উঠত না।কিন্তু -“আজ কোনো ধরা বাঁধা নেই।যত পারি ভেজা যাবে।”
.
ইমাদ গরম পানি ফুটতে দেখছে।পানি ফুটতে ফুটতে যখন তিন কাপ কমে দু কাপ হবে তখন সে ঐ গরম পানি কফির দুটো কাপে ঢালবে।তার আগে কাপে দুধের গুড়ি দুচামচ করে দিয়ে রেখেছে।সাথে চিনি।পানি ফুটতে ফুটতে কমে এসেছে দেখে এবার ইমাদ চুলা বন্ধ করে দিলো।সাথে সাথে না ঢাললে মনে হয় এই বুঝি পানি ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।অথচ এই পানি এতক্ষণ ফুটছিল।উপরে বাষ্প উঠছিল।পাতিল থেকে পানি ঢাললো সে উপর থেকে।এত উপর থেকে ঢেলেছে যে ফ্যানা হয়ে গেছে।চামচ দিয়ে হালকা নাড়া দিয়ে কফির বোয়ামটা হাতে নিয়ে ভেতরে শুকনো চামচ ঢুকিয়ে দু চামচ করে কফি দিলো।এরপর শুরু হলো আবার গুলানো।
বরাবরের মতন ইমাদ বেশ ভালো কফি বানায়।তবে সেটা অবশ্য মুড আর পরিবেশের উপর নির্ভর করে।মুড ভালো না থাকলে কফি কেমন পানসে পানসে হয়।
যেন ঐ তিন কাপ কমে আড়াই কাপ হয়েছে তাই স্বাদ পাওয়া যায় নাই বলে পানসে লাগে।তবে আজ ঠিকঠাক তিন কমে দুই হয়েছে।মানে নিশ্চয় কফি ভালো হয়েছে।কফির কাপ দুটোকে ট্রেতে নিয়ে ইমাদ সোফায় এসে বসে পুতুলকে ডাক দিলো।
পুতুল আসছে না দেখে সবার আগে সে চোখ রাখলো দরজার উপর।
-“নাহ!দরজা তো ভেতর থেকেই বন্ধ।তার মানে আমার অবাধ্য হয়ে ছাদে যায়নি।বাসাতেই আছে।তাহলে ডাকের সাড়া দিচ্ছে না কেন?!
.
কৌতুহল নিয়ে কফিতে চুমুক না দিয়েই ইমাদ তার রুমে চলে আসলো দেখার জন্য।ওমা!! পুতুল ভেজা বেড়ালের মতন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।দেখে মনে হয় এতক্ষণ বাঁদরের মতন লাফালাফি করছিল ইমাদকে দেখে থেমে গেছে।তবে মাথার থেকে বাঁদরামির ভূত নামেনি।হাতের আঙ্গুলের তিড়িংবিড়িং করা দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে।
পুতুল দাঁত কেলিয়ে বললো,”ভিজবেন?”
.
-“না থাক।
আমার এসবের বয়স নেই।”
.
-“কি বলেন এসব।আপনার আর কতই বা বয়স হয়েছে।২৫/২৬ এর বেশি তো আর না”
.
-“কাছাকাছি তবে এক হলো না।আমার বয়স ২৮।যতটা জোয়ান ভাবেন ততটা নয়।কিন্ডারগার্ডেনে পড়ছিলাম বলে আট বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম প্রাইমারি স্কুলে।তাই সব কিছুতে পিছিয়ে আছি।আমার জুনিয়ররা আমার ক্লাসমেট।বিষয়টা দারুণ না?”
.
পুতুল ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো তাও পারলো না।ইমাদ কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললো,”কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে পাতিলে দিয়ে গরম করার ভেজাল আমি করতে পারবো না।এসে খেয়ে যান বাহলে পরে হট কফিকে কোল্ড কফি হিসেবে খাবেন আমার কি!”
.
পুতুল মাথা নাড়িয়ে বারান্দা থেকে তড়িগড়ি করে আসতে গিয়ে বিরাট বড় হোচট খেয়ে নিচে বসে পড়েছে।ইমাদ হাসলো না কিন্তু যে পড়েছে সে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে।ইমাদ ওর হাত ধরে উঠিয়ে বললো,”কোমড় ভেঙ্গেছে?”
.
-“আরে না।আমার এত সহজে হাঁড় ভাঙ্গে না। আমি অনেক স্ট্রং”
.
কথাটা বলেই পুতুল ঠিক হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে একবার মাকে ডেকে নিলো।
ইমাদ ওকে বিছানা অবধি এনে বললো,”ব্যাথা না পেলে মাকে ডাকলেন কেন?”
.
-“মনে পড়ছিল তো তাই”
.
-“ভালো।আমাকে যদি বলেন ব্যাথা পেয়েছেন তাহলে কি আপনার প্রেস্টিজ নষ্ট হয়ে যাবে?এত ঘুরানোর কোনো গুরুত্বপূর্ন কারণ দেখছি না আমি।”
.
-“কফিটা এখানেই দিয়ে যান।কফি খেলে আমি ঠিক হয়ে যাব”
.
-“আমি বলি কি!!কফি খেতে খেতে আরেক ধাপ ভিজে আসেন।
একেবারে মন সতেজ হয়ে নিস্তেজ হয়ে যাবে”
.
পুতুল কপাল কুঁচকে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,”আর ভিজবো না।এই সিজনে লাস্ট ছিল”
.
-“ভালো।কফি এনে দিচ্ছি।আপনার কারণে আমার নিজের কফিটাও মনে হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।”
—–
পুতুল এত সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া পেয়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।ইমাদ সোফায় একটা বই নিয়ে বসেছে।
পড়তে পড়তে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।ঘুম ভাঙ্গলো কলিংবেলের আওয়াজে।চোখ ডলতে ডলতে ঝাপসা চোখে হেঁটে দরজাটা সে খুলে দিলো।
না করলো জিজ্ঞেস আর না করলো চেক।সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে দুটি ব্যাগ।একটাতে কমলা,আপেল আর লাল আঙ্গুর দেখা যায়
আর আরেকটাতে কাপড়চোপড়।
চলবে””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১৩
Writer-Afnan Lara
.
-“ম…..”
.
-“তোর মা আমি।ওরকম মমমম করছিস কেন?চিনতে পারিসনি নাকি বিশ্বাস হচ্ছে নাহহ?”
.
-“আরেহ না।একটু চমকে গেলাম।আসো না ভেতরে আসো।তুমি না রাত বারোটায় আসার কথা ছিল?”
.
-“রাত বারোটায় একা বের হওয়া য়ায়??তোর মাথায় ঢুকলো কি করে এটা?পারলে তো গিয়ে আনতে পারতি।সেটা তো আর করবি না।ঐ মেয়েটার সাথে কি তোর রীতিমত কথা হয়??আমি যে আসবো বললাম সেটা এত জলদি জানিয়ে দিলো?”
.
ইমাদ মাথা চুলকে তার রুমের দিকে তাকালো।দরজা খোলা তবে গোলাপি পর্দা ঝোলানো যার কারণে মা সেদিকে দুবার তাকানোর পরেও পুতুলকে দেখেননি।
ইমাদ মায়ের হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে জোরে জোরে বললো,”মা কি খাবে বলে।কফি নাকি চা?বাদাম নাকি মুড়ি?বিসকিট নাকি চানাচুর?”
.
-“কিছুই খাবো না।
তবে নুডুলস বানাতে পারিস।তা সব রুমের এমন লাইট অফ কেন?ঘুমাচ্ছিলি নাকি।দেখি ব্যাগ গুলো ধর।আমি সব রুম হেঁটে হেঁটে দেখি।কোন বছর বের হয়েছিলাম আর আসা হয়নি।
তোর বাবা যদি একটিবার আমার হাত ধরে বলত তো এতক্ষণে আমি এই বাসায় থাকতাম।বাহিরে নয়।তার ইগোই সব”
.
-“তোমার বুঝি ইগো নেই?”
.
-“আমাকে দোষারোপ করতে হবে না।তোর বাবা কম দোষারোপ করে না আমায়।তার চোখে আমি পৃথিবীর একমাত্র দোষী।সে ভালো মানুষ।এতই ভালো যে তার স্ত্রী যখন বাসা থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছিল সে একটিবার এসে হাত ধরেনি।সে যদি আমায় আটকাতো আমি যেতাম না।রওনকের এতটাও জেদ না যে কেউ মানাতে আসলে তাকে হেয় করবে।”
.
-“বাদ দাও।বসে টিভি দেখো।
রুম সব আগের মতই আর কি দেখবে?”
.
-“তোর কি রে?”
.
কথাটা বলে মা একটু ব্রু কুঁচকালেন তারপর সোজা গেলেন ইমাদের বাবার রুমের দিকে।
পুতুল হাই তুলতে তুলতে রুম থেকে বের হতেই দেখলো ইমাদ রোবটের মতন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।পুতুল কিছু বলার আগেই ইমাদ ওর হাত ধরে রুমের বারান্দায় এনে দাঁড় করিয়ে বললো,”এই ফুলের টবটা হাতে দাঁড়িয়ে থাকুন।মা যদি আমার রুমে এসেও যায় বারান্দায় আসতে দেবো না।ওয়াসরুম চেক করার অভ্যাস আছে মায়ের তাই আপনাকে ওখানে লুকাতে বলিনি”
.
-“আপনার মা এসে পড়েছে?”
.
-“হুম”
.
-“আমি শেষ।”
.
-“আমি অলরেডি শেষ।চুপচাপ টবটা হাতে দাঁড়িয়ে থাকুন।পরিস্থিতি আমি সামাল দিচ্ছি।”
.
-“ইমাদ??কিরে ওখানে কি করিস?তোকে না বললাম নুডুলস রান্না করতে।একি!! রুম থেকে এমন মেয়ে মেয়ে গন্ধ আসছে কেন।আমি তো ভাবলাম না জানি মেয়ে থাকে এই রুমে।রুমটা তো ভালোই গুছিয়ে রেখেছিস।অথচ তুি যে আগোছালো”
.
ইমাদ মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে মায়ের কথা শুনে যাচ্ছে।সামনে মা পেছনে পুতুল।কাকে রেখে কাকে লুকাবে সেই ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।আজ ধরা খেলে সে বকা খাবে ওটা ঠিক কিন্তু পুতুলের কি হবে তাই ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
-“মা জানলে ওকে এক মিনিট ও এই বাসায় থাকতে দেবে না।আর আমি ছাড়া পুতুলের কোথাও যাওয়ার জায়গা ও নেই।”
.
-“ইমাদ কথা কানে যায় না তোর?আজ আমার একটা মেয়ে থাকলে ফটাফট আমায় নুডুলস বানিয়ে খাওয়াতো।চল আমি বানাবো আর তুই আমায় হেল্প করবি”
.
ইমাদ মাথা নাড়িয়ে চললো মায়ের সাথে সাথে।পুতুল টবটা নিচে রেখে হাত ঝাড়ছে।পাঁচ কেজি ওজনের একটা টব।হাত ব্যাথা হয়ে গেছে।তার উপর মাটি,শ্যাওলা সব লেগে গেছে হাতে।সাবান দিয়ে ডলতে হবে।
বিরক্ত হয়ে পুতুল গেলো ওয়াসরুমের দিকে।
মা চুলায় গরম পানি বসিয়ে ইমাদের হাতে নুডুলসের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন কেটে দিতে।তারপর রান্নাঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে বললেন,”এরকম করে গোছানো কে শিখিয়েছে তোকে?বিশ্বাস কর!!আজ বাসায় ঢোকার পর আমার একবারের জন্য ও মনে হয়নি এই বাসায় দুইটা ছেলে থাকে।একদম মেয়েদের মতন সব সাজানো গোছানো।সিনথিয়া কি এখানে আসতো সবসময়?”
.
-“না!”
.
-“এরকম উঁচু গলায় বললি যে?ওরে কি বাসায় ও ঢুকতে দেস না?”
.
-“আমি না বললে ও শুনার মতন মেয়ে?সবসময় জোর করে ঢুকে”
.
-“তাই তো ওকে তোর জন্য পছন্দ করেছি।সব আদায় করে ছাড়বে”
.
-“জোর করে নেওয়া জিনিস টেকসই হয় না।এটা মাথায় রাখো”
.
-“কঠিন বাক্য ব্যবহার করে আমার মত পাল্টাতে চাচ্ছিস?জীবনেও পাল্টাবে না।সিনথিয়ার চোখে আমি তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছি।”
.
ইমাদ চুপচাপ নুডুসলের প্যাকেট কেটে গরম পানিতে ছেড়ে দিলো নুডুলস।পুতুল হাত ধুয়ে দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছে ইমাদের মাকে।সেলোয়ার কামিজ পরে এসেছেন তিনি।
-“ইমাদের মাকে দেখে মডার্ন মনে হয়।কথাবার্তাও পটু।তবে উনার মতন একজন মহিলা কিনা তার একটামাত্র ছেলের জন্য গায়ে পড়া টাইপ মেয়ে পছন্দ করতে গেলেন।এমনকি নিজের ছেলের মতের দিকে ফিরেও তাকাননি।যাই হোক এটা উনাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার।আমার কি।আমি শুধু দেখে যাই।এই দেখা না জানি আজকেই শেষ হয়।আন্টি আমাকে দেখলে নির্ঘাত বাসা থেকে বের করে দেবে।কি করবো তখন আমি।
নুডুলসের ঘ্রান নাকে এসে লাগছে।ইশ আমাকে যদি একটু দিতো।মজা করে খেতাম আর দোয়া করতাম মা ছেলেকে।
আমাকে তো দেবে না।আন্টিকে দেখে কিপটা মনে হয়।সোফার সামনের টেবিলটাতে ফলপাকোড় দেখা যাচ্ছে।মা সবসময় বলতো খিধে পেলে ফল খাও!রুপ বাড়বে খিধাও যাবে।যাই টুকুস করে একটা ফল নিয়ে চলে আসি”
.
পা টিপে টিপে পুতুল টেবিলটার কাছে আসলো।কাগজের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে খচরখচর করে একটা কমলা নিয়ে পালিয়ে গেলো সে।
নুডুলসের বাটি নিয়ে মিসেস রওনক সোফায় এসে বসলেন।বাটি এক পাশে রেখে কাগজের ব্যাগটা উপুড় করে সব কটা ফল ঢেলে দিলেন টেবিলের উপর।তারপর কপাল কুঁচকে বললেন,”কমলা ৬টা ছিল।আমি নিজ হাতে বেছে বেছে নিয়েছিলাম তাহলে আরেকটা গেলো কই?”
.
কথাটা বলে সুঁকে সুঁকে ইমাদের রুমের দিকে গেলেন তিনি।পুতুল খাটের তলায় বসে কমলা খাচ্ছে আর সিনথিয়ার চুলের উচ্চতা নিয়ে ভাবছে।”
.
-“কমলার ঘ্রান পাচ্ছিস ইমাদ?”
.
-“না তো”
.
-“কি বলিস?আমার নাকের যে পাওয়ার।।পাশের বাসায় আচার বানানোর জন্য পাঁচফোড়নের প্যাকেট হাতে নিলেও বলে দিতে পারি আচার বানানো হবে।তোর রুম থেকে তীব্র ভাবে কমলার খোসা ছাড়ানোর ঘ্রান আসছে।হুম আমি একেবারে সিউর”
.
-“মা তোমার মনে হয় সর্দি লেগেছে।আসো হিসটাসিন খাবে।”
.
-“কথা যদি তা না হয় তাহলে আমার আরেকটা কমলা গেলো কই?”
.
-“ঐ আসলে তুমি যখন এনেছিলে আমি গপাগপ একটা নিয়ে খেয়ে ফেলেছি।সরি”
.
-“তুই আবার কখন খেলি?আমি তো তোর সাথে সাথেই ছিলাম”
.
-“তুমি যখন বাবার রুমে গেছিলে তখন।”
.
-“ওহ।আচ্ছা চল নুডুলস খাবি।”
.
মা চলে গেছেন।ইমাদও যাচ্ছিলো।পুতুল খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে ইমাদের হাত টেনে ধরে আটকালো ওকে।ইমাদ ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না কারণ তার ফিসফিস করে কথা বলা আর চেঁচিয়ে বলা একই।তাই ইশারাতে জিজ্ঞেস করলো যে কি হয়েছে।
.
-“আমি নুডুলস খাবো।একটু দিন।ঐ যে মেলামাইনের ছোট পিরিচ আছে না? চায়ের কাপের তলায় দেয় ওগুলাতে করে দিলেও হবে।একটুখানি দিন।টমেটো দেওয়ায় আমার না খুব খেতে ইচ্ছে করছে।টমেটোর ঘ্রান পেয়েছি।”
.
ইমাদ ব্রু কুঁচকে চলে গেলো।
—–
ইমাদ মায়ের সামনে নুডুলসের বাটি নিয়ে বসে আছে।খাচ্ছে না।পুতুল আবদার করেছিল বলে এই নুডুলস তার গলা দিয়ে নামছে না।মা দুচামচ গিলে টিভিতে চ্যানেল পাল্টে বললেন,”কিরে খাচ্ছিস না কেন?ভালো হয়েছে তো”
.
-“আসলে আমার বারান্দায় কদিন ধরে পাখি উড়ে এসে খাবার খায়।ধান, চাল, গম এমন আর কি।তো আমি খাবার রাখি ওদের জন্য ওরাও খায়।”
.
-“তো?”
.
-“তো চাইছি একটু নুডুলস রাখবো।পাখির ও তো মন চায় ভিন্ন ধরনের খাবার খেতে।চিকেন,বিরিয়ানি,সুপ,মাছ,সবজি”
.
-“গরম পানি,গরম তরকারি,গরম ভাত,গরম কফি,গরম চা”
.
-“মা আমি ফান করছি না।সিরিয়াসলি বললাম।ওদের ও তো স্বাদ আহ্লাদ আছে তাই না?”
.
-“তো এখন পাখি নুডুলস ও খাবে?তোর নেকামো দেখে আমার মন চাচ্ছে পাখির জন্য বিরিয়ানি রান্না করতে”
.
ইমাদ দাঁত কেলিয়ে বাটি নিয়ে চলে গেলো তার রুমে।পুতুল দরজার সাথে কান পেতে ছিল।ইমাদ দরজা খুলতেই ধপাস করে নিচে পড়ে গেলো সে।ইমাদ বাটিটা ওর দিকে ধরে বললো,”নিন,খেয়ে উদ্ধার করুন আমায়।”
——
মা খাবার শেষ করে বাবার রুমে এসে ছবিগুলোতে হাত বুলাচ্ছেন আর পূর্বের মধুর স্মৃতি গুলো মনে করার চেষ্টিা করছেন।
-“আগে এরকম বর্ষামুখর একটা দিনে তাদের কত না প্রেম ছিল দুজনের মাঝে।ইমাদের বাবার সবচেয়ে ভালো একটা দিক হলো বৃষ্টি শুরু হলে বাগান কিংবা বারান্দা খুঁজে ফুল কুড়িয়ে এনে তার মাথায় গুঁজে দেওয়া।কি ভালো লাগত তখন।মন বলতো এই মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটাতে বিন্দু মাত্র কষ্ট পোহাতে হবে না।
অথচ এখন মনে হয় আমার সবই ভাবনা ভুল ছিল।তার কাছে আমি ভুল।আর সে ঠিক।আমি স্বার্থপর আর সে সৎ।
ভালো বেশ ভালো।এখন তো বুঝতে পারে আমি ছাড়া তার জীবন কেমন।কি আর বুঝবে এখন হয়ত তার অভ্যাস ও হয়ে গেছে।বুঝতে বুঝতে তিক্ত।প্রিয় মানুষ চলে যাওয়ার কষ্টর কাছে তার কাছে তার ইগোর দাম সবচাইতে বেশি।মন চায় এই ছবিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলি।
সব কটা ছবিতে ইমাদের পরে আমি ছিলাম।আর লোকটা আমাকেই ক্রপ করে কেটে দিছে।আমায় সে এত ঘৃনা করে।আর আমি আত্নসম্মান দূরে রেখে ফলপাকোড় নিয়ে এলাম তার সেবা করতে।ঠাণ্ডা পানির জায়গায় গরম পানি দিয়ে পোটি দেবো।মেজাজ বিগড়ে গেলো ছবিগুলো দেখে।উফ অসহ্য!
ইমাদ!!!”
.
-“হুম মা বলো।”
.
-“গেস্ট রুম ঠিক আছে?আমি সেখানে ঘুমাবো”
.
-“হুম ঠিক আছে।আসো না টিভি দেখবে ”
.
-“না।সিনথিয়াকে নিয়ে তোর সাথে কথা আছে।এখানে এসে বোস”
.
ইমাদ আস্তে হেঁটে মায়ের পাশে এসে বসলো বিছানায়।মা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর হাতটা ধরে বললেন,”ও খুব ভালো মেয়ে।তোর মা তো আর তোর জন্য খারাপ কাউকে ঠিক করতে পারে না।সে তোকে অনেক ভালো রাখবে”
.
-“মা আমি জানি সিনথিয়া আমায় ভালো রাখবে।তবে আমি তাকে ভালো রাখতে পারবো না।সে আমার থেকে ভালোবাসা পাবে না।বিয়েটা হয় পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করে।আর সেখানে আমি শুরু থেকে ওকে পছন্দ করি না।এই বিয়েতে আমার কোনো মতই নেই”
.
মা মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেললেন।দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন,”তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ?”
.
-“নাহ।কিন্তু অন্তত সিনথিয়াকে নয়।আমি এখন বিয়ে চাচ্ছি না।সময় চাই।আমি চাই তাকে বিয়ে করতে যাকে পেলে আমি মন থেকে হ্যাঁ বলতে পারবো।তখন আর পছন্দ অপছন্দের টপিক ঘোরাফেরা করবে না মুখের সামনে।তখন আমি সোজাসুজি বলতে পারবো আমি বিয়েতে রাজি।ব্যাপারটা বুঝো একটু”
.
-“বুঝতে চাই না।তোকে দু মাস ধরে সেম ভাবে বোঝাচ্ছি কিন্তু তুই বুঝতেই চাস না।
খালি একই কথা ঘুরেফিরে আসে।এখন আবার আরেকটা লাইন যোগ হয়েছে।আমি যখন সোজাসুজি বলতে পারবো আমি বিয়েতে রাজি তখন বিয়ে করবো।এতদিন তো বলতি বিয়েই করবি না”
চলবে””