বাবুই পাখি পর্ব-১৪+১৫

0
779

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১৪
Writer-Afnan Lara
.
-“মায়ের চোখজোড়া ওমন ঘুরতে দেখে ভীষণ ভয় হচ্ছে।না জানি কি ভাবছে।ছেলেরা বাবার সাথে সুন্দর করে লাইন বাই লাইন মিথ্যে কথা বলে ফেললেও মায়ের সাথে মিথ্যে বলতে পারে না।বললেও ধরা খায় দিন শেষ হতে না হতেই।
তার পরেও আমি মিথ্যে বলেছি এখন।কে জানে ঠিক কোন সময়ে ধরাটা খেয়ে বসবো।আচ্ছা মা আমি যাই রুমে।আমার অফিসের কাজ আছে”
.
-“যা তাহলে।
আমি একটু রেস্ট নিই।তোর বাবা আসলে তো শুরু করবে ঘ্যানঘ্যান।”
.
ইমাদ তার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।পুতুল পর্দার আড়ালে লুকিয়েছিল।ইমাদ দরজা লাগিয়েছে দেখে সে পর্দার ভেতর থেকে বের হলো।
ইমাদের ভাবগতি দেখে বোঝা যায় মায়ের বকুনি খেয়েছে।ইমাদ পুতুলের দিকে না তাকিয়েই অফিসের কটা ফাইল হাতে বসলো বিছানায়।পুতুল ওর সামনে বসে বললো,”আঙ্কেল কখন আসবে?”
.
-“জানি না।হয়ত বারোটায় আর নয়ত একটায়।কেন বলুনতো?”
.
-“না এমনি।আন্টি কি আপনার সাথে ঘুমাবে?”
.
-“সেটা করলে আজকেই ধরা খেতেন।মা গেস্ট রুমে ঘুমাবে।”
.
-“ইমাদ দরজা খোল।দরজা লাগিয়েছিস কেন?”
.
পুতুল এক ছুটে খাটের তলায় চলে গেছে।ইমাদ আস্তে করে নেমে গিয়ে দরজা খুললো।মা কোমড়ে হাত দিয়ে পুরো রুমটায় পায়চারি করে বললেন,”তোর বাবাকে ফোন দিয়ে বল চলে আসতে।অসুস্থ শরীরে অফিস করতে হবে না তার”
.
-“হুম বলছি।তুমি বললে হয়ত জলদি আসতে পারে।
আমার কথায় পাত্তা দেবে না”
.
-“তোর বাবা তোকে বেশি ভালোবাসে আমার চেয়েও।
আচ্ছা তুই আগে বল তারপর যদি না মানে তো আমি বলবো”
.
-“ঠিক আছে।”
.
ইমাদ বাবাকে ফোন করলো।শুরুতেই বললো চলে আসতে
.
-“চলে আসবো মানে?কেন আসবো?কি কারণ?”
.
-“তুমি তো অসুস্থ তাই জলদি চলে আসতে বলছি”
.
-“আমি অসুস্থ কে বললো তোকে।আমি তো একদম ফিট।”
.
-“হুম,অসুস্থ বলেই তো আসতে বলছি তোমাকে।জলদি চলে আসো কেমন?মা এসেছে তোমার কেয়ার করতে”
.
-“হোয়াট!কি বললি?তোর মা এসেছে তাও আমার কেয়ার করতে।এই পৈশাচিক খুশি আমি কোথায় ধরে রাখবো!
মিসেস রওনক তার ইগো বাদ দিয়ে বাসায় ব্যাক করেছে?তারে কও চলে যেতে।আমি ডিভোর্স পেপারে অলরেডি সাইন করে আলমারিতে রেখে দিছি।এখন সে আমার কাছে একজন অপরিচিত মহিলা।”
.
মা ইমাদকে থতমত খেতে দেখে ওর থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে কানে ধরে বললেন,”হ্যালো।আমি আসার কথা শুনেও তোমার আসতে মন চাচ্ছে না?মনে রাখো রওনক এমনি এমনি যাবে না।তার ছেলেকে নিয়ে চলে যাবে।তখন থেকো এই বাসায়।
আর আমাদের ডাকতে ডাকতে ফার্স্ট টাইম হার্ট এটাক করিও।”
.
-“শুনো!তোমার পাঠানো ডিভোর্স পেপারে আমি সাইন করেছি দুই বছর আগেই।তাহলে তুমি কোন অধিকারে আমার বাসায় আসছো?কে তুমি?তোমাকে চিনি না।”
.
-“আমি ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিলাম ঠিক তবে তুমি চেক করেছো আমি সাইন করেছি কিনা?আমি সাইন করিনি।সুতরাং ডিভোর্স হয়নি।তার মানে আমরা এখনও হাসবেন্ড ওয়াইফ।”
.
-“ওহ তাই নাকি।সাইন করোনি কেন?খুব তো দাপট দেখিয়ে নিজে থেকেই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিলে এখন সে দাপট গেলো কই?”
.
-“তোরে মরতে দেওয়া উচিত ছিল।বাই”
——
মা ইমাদের হাতে ফোন দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।ইমাদ ফোন কানে ধরতেই বাবা বললেন,”তোর মাকে বল আমি আসতেছি।এত কষ্ট করে এতবছরের ইগো বাদ দিয়ে আমার কেয়ার করতে এসেছেন।উনাকে আপ্যায়ন করা জরুরি”
.
-“মা দাঁড়াও।বাবা বললো আসতেছে”
.
-“আমি যাচ্ছি কই।জীবনে তোর বাবার কথায় পাত্তা দিছি আমি??আমি তো বের হলাম তার জন্য মরিচের শরবত বানাবো বলে।ওরে মরিচের শরবত খাওয়ালে রাগ কমবে আমার”
.
ইমাদ মায়ের হাত থেকে মরিচের বোয়ামটা কেড়ে নিয়ে বললো,”মা প্লিস রাখো এসব।বাবা আসছে তো।এত ঝগড়া করে লাভ আছে?বাবা না অসুস্থ? মাথা ঠাণ্ডা করো”
—–
পুতুল ওদের এসব কান্ড দেখছে আর হেসে যাচ্ছে।ইমাদের মা ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি নিয়ে সোফায় এসে বসেছেন।মিনিট দশেক পর ইমাদের বাবা এসে হাজির।দরজা খোলার পর ভেতর ঢুকতেই চোখ পড়লো ইমাদের মায়ের উপর।উনি টেবিলটার দিকে চেয়েছিলেন তারপর একটু ভাব নিয়ে তাকালেন।
.
-“মেহমানকে নাস্তা করিয়েছিস ইমাদ?”
.
-“হুম”
.
-“বসো এখানে।”
.
-“এখন থেকে কেয়ার শুরু করবেন নাকি?আমার কি অসুখ হয়েছিল যেন?”
.
-“মজা করবে না।কি অবস্থা করেছো নিজের। যেন ফু দিলেই উড়ে যাবে”
.
-“বলবা না যে কি অবস্থা করেছি নিজের।বলো কে এমন অবস্থা করেছে আমার”
.
-“কে?”
.
-“যিনি উত্তর জানতে চাইলেন উনি নিজেই দায়ী।”
.
ইমাদ আস্তে করে সরে এসেছে।পুতুল উঁকি মেরে এতক্ষণ দেখছিল।ইমাদ ওকে টেনে হিঁচড়ে ওখান থেকে সরিয়ে দরজা লাগিয়ে বললো,”উনাদের আলাদা সময় থাকতে দিলাম।এখন শুরু করবে কথা কাটাকাটি।”
—-
ইমাদ ফাইলের পাতা উল্টাচ্ছে আর পুতুল দরজার সাথে কান লাগিয়ে শুনার চেষ্টা করছে উনারা ঝগড়া করছে নাকি মধুর আলাপ জমিয়েছে।শেষে কিছুই শুনতে না পেয়ে মুখটা গম্ভীর করে ইমাদের পাশে এসে বসলো সে।ইমাদের ফোন বাজছে।সাইলেন্ট বলে সে খেয়াল করেনি।পুতুল খেয়াল করলো।সিনথিয়ার ফোন।সে এগিয়ে ধরলো ইমাদের দিকে।ইমাদ কপাল কুঁচকে কেটে দিলো।পুতুল অবাক হয়ে বললো,”কাটলেন কেন?”
.
-“ওখানে মা বাবার মধ্যে ঝগড়ার যুদ্ধ চলছে আর আমি এখানে প্রেমালাপ করবো?”
.
-“প্রেমালাপ হবে কেন।কোনো জরুরি সংবাদ ও তো হতে পারে।”
.
-“হবে না।সিনথিয়া আমাকে ফোন করে হাবিজাবি কথা বলার জন্য ইম্পর্টেন্ট কোনো কথাই সে বলতে জানে না।”
—-
পুতুল এক দৃষ্টিতে ইমাদের ফোন দেখছে।ইমাদ বিষয়টা খেয়াল করে একটু এগিয়ে দিয়ে বললো,”আমার ফোনে ভালো ভালো গেমস আছে।খেলতে পারেন”
.
পুতুল খপ করে ধরে ফেললো ফোনটা তারপর শুরু করলো গেমস খেলা।ওদিকে বাবা মায়ের ঝগড়া বেড়ে গেছে।ইমাদ ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।যখন সে ছোট ছিল!!ছোট না ঠিক।কিশোর ছিল ঠিক তখন থেকে মা বাবার মনমালিন্যটা ঘাড়ো হতে শুরু হয়।ধীরে ধীরে বাবার ধমক।উঁচু স্বরে কথা বলা।
তাতে মায়ের রাগ করা।আস্তে আস্তে সেই রাগটা বাসা ছেড়ে যাওয়ার মতন কঠিনতর হয়ে যাওয়া।
-“হুমমম।এরপর আর কি।সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন।এত সুন্দর পরিবার আমার।আগুন লেগে পুড়ে গেলো।সবসময় চেয়েছি তারা একসাথে থাকুক।এর আগেও তাদের এক করার চেষ্টা আমি অনেক করেছি।লাভ হয়নি।ঝগড়া করতে করতে একটাসময়ে আবারও তারা আলাদা হয়ে যায়।একটা সময় এসে হাল ছেড়ে দিয়েছি।”

-“থাক কাঁদিয়েন না”
.
-“আমি কাঁদছি না।আপনি এছাড়া আর সান্ত্বনা দিতে জানেন না?”
.
-“তো কি বলবো।গিয়ে মা বাবার সাথে মিলে ঝগড়া করেন তাহলো।আমি দেখি বসে বসে।এতক্ষণ ভালোই বিনোদন নিচ্ছিলাম।”
.
-“আপনি চুপ করে বসে থাকেন।কিছু বলতে হবে না আপনাকে।”
—–
বাবা মায়ের ঝগড়া শেষ হলো ৪৫মিনিট পর।যখন কোনো ঝগড়ার আওয়াজ আসছিল না তখন ইমাদ আস্তে করে তার রুমের দরজা খুললো।পুতুল ওর শার্টের কোণা ধরে সেও উঁকি মেরে দেখছে।
ড্রয়িং রুমে মা একা বসে আছেন সোফার উপর।বাবা নেই।তার কথা তার রুম থেকে আসছে।ইমাদ হাত পেছনে নিয়ে পুতুলের হাত তার শার্ট থেকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বের হলো।পুতুলের মন চাচ্ছে গিয়ে আন্টিকে বোঝাতে।কিন্তু সে গেলে উল্টো হিতের বিপরীত হয়ে যাবে।তার চেয়ে বরং এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা ভালো বলে মনে হয়।
ইমাদ কোথা থেকে এসে মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে পর্দা টেনে চলে গেছে।
-“আমাকে নিয়ে তার এত ভয় কিসের।চোখ দুটোই তো দেখা যাচ্ছিলো আমার।এরপরেও তিনি শুধু আমাকে লুকাতেই থাকেন আর কোনো কাজ নাই।”
.
রাগ করে পুতুল বিছানায় এসে বসে থাকলো।
-“একটা রুমে সারাটা দিন কি করে থাকা যায়।দমবন্ধ হয়ে যায় না??আমার তো মনে হয় মরেই যাব।বের হতেই পারছি না।আহারে আঙ্কেল আন্টিকে মিলানোর জন্য কত কষ্ট করছি আমি। আর সব কিছুর স্বাদ খাবে সিনথিয়া আপু।তার ও উচিত ছিল উনাদের এক করার চেষ্টা করা কিন্তু তা করলেন না কেন?
অবশ্য ইমাদ ভাইয়া বলেছিলেন তার বাবা নাকি সিনথিয়া আপুকে পছন্দ করেন না।তাই হয়ত।
কিন্তু পছন্দ না করাটা অন্য বিষয়।শ্বশুর শাশুড়িকে মিলালে তো লাভ একদিক দিয়ে হবেই।
যাই হোক কে জানে উনার মনে কি চলে।আমার আর কি।কাজের মধ্যে দুই।খাই আর শুই”
————
-“তোর বাবা কি বলেছিল জানিস?”
.
-“জানতে চাই না।অনেক তো হলো।এবার অন্তত থামো। বাদ দাও তোমরা দুজন।তোমাদের ছেলে হয়ে এসব দেখতে ভাল্লাগে আমার??সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি এসব।
এবার বন্ধ দাও।মন থেকে সুখী হতে পয়সা লাগে না।”
.
মা ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে পাতিল সব গুলোর ঢাকনা সরিয়ে দেখে বললেন,”তোর বাবাকে বল ফ্রেশ হয়ে আসতে।আমি প্লেট সাজাচ্ছি ”
.
-“বাবা তো এত জলদি ডিনার করবে না”
.
-“আমরাও করবো না।শুধু তোর বাবা ডিনার করবে।ঔষুধ খেতে হবে তো নাকি।”
.
বাবা তার রুমে থেকে উঁচু গলায় বললেন,”থাক আমায় আর ঔষুধ খাওয়ানের কেয়ার নিতে হবে না।নিজের খেয়াল নিজে রাখতে জানি।কিছু হয়নি আমার।অসুখ হলে ঔষুধ খাই না আর এখন তো পুরোপুরি সুস্থ”
.
-“তোর বাবা স্বীকার করতে চায় না আজ সকালে তার বুকে ব্যাথা হয়েছিল।”
.
ইমাদ ঢোক গিলে চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছে।পুতুল দরজার সাথে কান লাগিয়ে শুনার চেষ্টা করছে ওরা কি বলে।
.
-“তোর মাকে বলে দে আমি তোর সাথে খাবো।একা খেতে ভাল্লাগে না”
.
মা মুচকি হাসলেন।
মায়ের মুখে হাসি দেখে ইমাদের মুখেও হাসি ফুটলো।আজ কতটাদিন পর মাকে এমন করে হাসতে দেখেছে সে।
-“আগের বার হেসেছিল সিনথিয়াকে শাড়ী গিফট করার সময়।আর আজ হাসছে বাবার কথা শুনে।এদের এক করতে একটা দিয়াশলাই কাঠি ও সরানোর প্রয়োজন নেই।এমনি এমনিতেই যোগফল মিলে যাবে।শুধু প্রয়োজন দুজনের একসাথে থাকা।পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠলেই বর্তমান ভুলে অতীতে ফিরে থাকা যায় বর্তমানে পা রেখেই।আমিও তাই চাই।তারা যেন মনমালিন্য দূর করে একজন আরেকজনকে আবারও ভালোবাসুক।তাহলে আমি ভালো থাকবো।থ্যাংকস্ টু পুতুল।সে মাকে এখানে না আনলে আজ মায়ের মুখে হাসি দেখতাম না”
.
মা গেস্ট রুমের দিকে চলে গেলেন একটু শুবেন বলে।ইমাদ তার রুমে ফিরে আসলো
পুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাসার সামনের রোডটা দেখছিল।
-“এই নিয়ে চারটে রিকশা গেলো।তারপর দুটো বাইক।মানুষের আনাগোনা কমই।পাঁচ ছয়জন দেখা হলো শুধু।সবাইকে দেখে এই এরিয়ারই মনে হয়।সামনের দোকানগুলোতে আলো জ্বলছে।এক দুজন সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।আর আমি আমার কাজ নিয়ে বোর হচ্ছি।কতকাল এভাবে থাকা যাবে?একদিন না একদিন আমাকে তো ফিরে যেতেই হবে।আগে কত ভালো ছিলাম।বাবা মায়ের একটামাত্র মেয়ে বলে যা চাইতাম তাই পেতাম হাতের নাগালে।কখনও কোনো কমতি ছিল না।এরপর সাইমনের পরিবার এসে সব খারাপ করে দিলো।বিয়ে নিয়ে শুরু হলো জোরাজুরি।
চলবে””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১৫
Writer-Afnan Lara
.
-“আমি জানি উনার একা বদ্ধ ঘরে থাকতে সমস্যা হচ্ছে।কে বা এমন করে থাকতে পারে।উনার জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে মরেই যেতাম।উনি এসব সহ্য করছেন আমার কারণেই।জানি না কতদিন উনাকে এভাবে থাকতে হবে।এখন মনে হচ্ছে ধরা খেলেই ভালো।কিন্তু এই ভালো লাগাকে দূরে তালাবন্ধ রাখতে চাই কারণ আমি চাই না ধরা খেয়ে উনি উল্টে বিপদে পড়ুক।তখন আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকে যাওয়ার মতন অবস্থা হবে আমাদের দুজনেরই।দমবন্ধ হলে হোক।তাও এভাবে থাকাটাই ভালো বলে মনে করি।কিন্তু আআপাতত উনার দমবন্ধ হওয়াটাকে একটু দম ছাড়াতে পরিণত করতে পারি।উনাকে বাহিরে থেকে ঘুরিয়ে আনা যায়।সমস্যা হলো মা বাবার সামনে দিয়ে নিবো আনবো কি করে?ভাবতে হবে।প্রচুর ভাবতে হবে।মাথায় মনে হয় বুদ্ধি এসেছে।গিয়ে বলি উনাকে।উনি যা বলবেন তাই হবে”
.
হালকা কাশির আওয়াজ পেয়ে পুতুল পেছনে তাকালো।ইমাদ দাঁড়িয়ে আছে মুখটা মলিন করে।পুতুল জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থেকে বললো,”কিছু বলবেন?”
.
-“ঘুরতে যাবেন আমার সাথে?”
.
ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে পুতুল অবাক হলো।তারপর ঠিক বুঝতে পারলো ইমাদ তার মন ভালো করার জন্য এটা বলেছে।
-“ইমাদ ভাইয়া আমার কথা কেন এত ভাবে?তার লাভ কিসে এটাতে??
সিনথিয়া আপুকে নিয়েও তো এত ভাবতে দেখিনি।লোভ হয় এমন ভালো একটা মানুষের কেয়ার পেয়ে।দিনদিন লোভের পাল্লা বাড়িয়ে দিচ্ছেন উনি।আমি শেষে একটুখানিও না পেয়ে অসহায় হয়ে যাবো।”
-.
-“কি হলো?কি ভাবছেন?যাবেন না?”
.
-“হ্যাঁ।কিন্তু কিভাবে?”
.
-“ওসব আমার উপর ছেড়ে দিন।মাথায় ওড়না টেনে চলুন তো!”
.
ইমাদ রুমের দরজা খুলে এদিক ওদিক তাকালো।মায়ের রুমে বিছানায় তার হাত দেখা যায়।মানে শুয়ে আছে।বাবার রুমের দরজা বন্ধ।ইমাদ পুতুলের হাত ধরে টেনে টেনে আস্তে আস্তে বের হয়ে গেলো।বাসা থেকে বের হবার আগে দরজা বাহিরে দিয়ে লক করে ফেললো।বাবা মাকে একসাথে রাখতে আরেকটা বুদ্ধি এটা।যদি ইমাদকে খুঁজতে আবার বাবা মা বের হয়ে যেতেন তাই এই কারসাজি।
ফাঁকা রাস্তায় এখন হাঁটছে দুজন।হাতে হাত লাগতে গিয়েও লাগছে না।ইমাদের চোখ রাস্তার দিকে আর পুতুলের চোখ আশেপাশে।কেউ ওকে যেন দেখে না ফেলে।
একটু পথ হাঁটতে হাঁটতে সামনে পড়লো ফুচকা স্টল।পুতুল লাফিয়ে উঠলো ফুচকা খাবে বলে।ইমাদ ওকে সেদিকে নিয়ে গেলো।প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে ওকে বসতে দিলো।তারপর যাচ্ছিল ফুচকার অর্ডার দিতে। পুতুল ওর হাতটা ধরে আটকালো।ইমাদ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
.
-“ধন্যবাদ আমার মন খারাপ থাকলেই ভালো করে দেবার জন্য।
ঝাল বেশি দিতে বলবেন।”
.
ইমাদ মাথা নাড়ালো।কিছু বললো না।পুতুল নিঃশব্দে হাতটা ছেড়ে দিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে বসলো।ইমাদ চলে গেছে।
পুতুল গালে হাত দিয়ে ফুচকার স্টলটা দেখছে।হলুদ লিফলেট দিয়ে সাজানো।বড় বড় করে লেখা” ভাই ভাই ফুচকা হাউজ। ফুচকার সাথে এখানে চটপটি,ঝালমুড়িও পাওয়া যায়।”
পড়া শেষ করে পুতুল তার সামনের টেবিলটার উপর একটা হাত দেখতে পেলো।হাতটা দেখে মাথা উপরে তুললো হাতের মালিককে দেখতে।চোখের সামনে আসাদ ভাইয়াকে দেখে পুতুলের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে তার।আসাদ হাতটা টেবিল থেকে উঠিয়ে পুতুলের হাতটা ধরে নিলো।ওকে এক টানে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড় করালো সে।
পুতুল বুঝে গেছে তাকে আজ ভাইয়া নিয়েই ছাড়বে।শেষ রক্ষার জন্য হলেও সে একটিবার ইমাদকে ডেকেছিল।আওয়াজটা আস্তে ছিল।খুব জোরেই ডাকতে চেয়েছিল কিন্তু ভাইয়ার সাথে আরও পাঁচছয়জন দেখে সাহস করলো না ইমাদকে ডাকার।মারপিট এরা ভালো জানে তা পুতুলের জানা আছে।ছোট থেকে এরা সবাই ওর বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছে।একেকটার শক্তি অনেক বেশি।ইমাদকে মেরে কবর ও দিয়ে দিতে পারবে।
পুতুলকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে আসাদ।ইমাদ ফুচকার স্টলের এক পাশে দাঁড়িয়ে পুতুলের চলে যাওয়া দেখছিল।ওকে জোরজবরদস্তি করে নিয়ে যাওয়া দেখছিল।অথচ তার কিছুই করার নেই।তার অধিকার নেই একজন ভাইয়ের বিরোধিতা করার।সে পুতুলের কেউ হয় না।
পুতুলের চোখে মুখে না যাওয়ার অনীহা সে দেখেছে।হাত মুঠো করেছে।শরীর শক্ত করেছে কিন্তু তাও আটকানোর সাহসটুকু পায় নিই।তার চোখের সামনে ওরা পুতুলকে নিয়ে গেলো।আসাদ পুতুলের ভাই না হলে সে এতক্ষণে পুতুলকে নিয়ে বাসায় ও ফিরে যেতো।পুতুল চিৎকার কেন করেনি তার কারণ ও ইমাদ জানে।
—–
ঘড়ির কাঁটা নয়কে ছুঁই ছুঁই।ইমাদ এক রাশ খারাপ লাগা নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে।দরজা খুলতেই মা বাবা এসে সামনে হাজির হলেন।দুজনেই একই প্রশ্ন তাক করলেন ইমাদের দিকে।আর তা হলো ইমাদ কোথায় গিয়েছিল আর বাহিরে দিয়ে দরজা আটকালোই বা কেন।
.
ইমাদ উত্তরে বললো,”চা খেতে”
.
এরপর নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ফেলেছে সে।আজ সে পুতুলকে নিয়ে ঘুরতে না গেলে এমনটা হতোই না।সব দোষ তার।আজ তার জন্য পুতুলের বিয়ে হয়ে যাবে তাও ওর বিনাঅনুমতিতে।
এসব ভেবে মাথা ঠুকরে ঠুকরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ইমাদ।খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
——
-“কি করবি এখন এরে?”
.
-“কি আর করবো।কাল দুপুরে ওর বিয়ে দিয়ে দেবো।সাইমনকে বলে দিয়েছি শেরোয়ানি পরে চলে আসতে।ওর পরিবার ডালা সাজানো শুরুও করে দিয়েছে।ভাগ্য ভালো ওকে জলদি পেয়ে গেছি তা নাহলে কি যে হতো।”
.
-“ওর রুমের দরজা খুলবি না।একেবারে কাল দুপুরে দরজা খুলে এক কাপড়ে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবো।এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই একটুও।”
.
-“এসব কি বলছো আসাদের বাবা?মেয়েটা তখন পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে নাকি?”
.
-“একদিন না খেলে কেউ মরে না।ও যা করেছে ওকে মেরে ফেলিনি সেটা ওর সৌভাগ্য।বসে বসে আলহামদুলিল্লাহ্‌ পড়তে বলো।অন্য কোনো বাবা হলে মেরে হাঁড়গোড় ভেঙ্গে দিতো।আমার মেয়ে হয়ে কিনা বিয়ের আসর ছেড়ে পালায়।সাইমনের মতন একটা ভালো ছেলেকে হবু বর হিসেবে পেয়েছে বলে আজও লোকমুখে জানাজানি হয়নি।নাহলে সাইমনের জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে কথা পাঁচকান কেন পঞ্চাশ কান হয়ে যেতো।শুধু উনাদের সামনে আর আত্নীয়দের সামনে যা নাক কাটা গেলো এই আর কি।
ভাবো ও কি ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে।”
.
পুতুল ফ্লোরে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
-“আমার সাথে কি আর কখনওই উনার সাথে দেখা হবে না?আমি কি আর কোনোদিনই তাকে একটিবার দেখার সুযোগটুকুও পাবো না?ঘুরেফিরে সেই লোকটাকেই বিয়ে করতে হচ্ছে যাকে আমি পছন্দ করি না।তবে যা হয়েছে ভালোই।সিনথিয়া আপু আর উনার মাঝে এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি থাকলে বাধা সৃষ্টি হতো।আমারও উচিত নিয়তিকে মেনে নেওয়া।আমার সাথে এমন হবেই।তা নাহলে এত লুকিয়ে চুরিয়েও শেষে সাইমনের ধারে এসে ধরা খেতে হলো।তার সাথেই বিয়েটা হচ্ছে।আগামীকাল ঠিক দুপুর দুটো।আমার হাসি আমার সুখ সব শেষ হয়ে যাবে কাল”
—–
-“ইমাদ?দশটা বাজে।ডিনার করবি না?কতক্ষণ রুমে বসে থাকবি।দেখ আমি আর তোর বাবা খেতে বসেছি।খেতে আয়।কি হলো তোর?”
.
ইমাদ বালিশের নিচ থেকে মাথা তুলে বললো,”তোমরা খেয়ে নাও।আমার খিধে নেই”
.
-“বেগুনের তরকারিটা খুব ভালো হয়েছে দেখে মনে হয়।খাবি না?”
.
ইমাদের মনে পড়ে গেলো এটা পুতুল রেঁধেছিল।কিসব ভেবে উঠে পড়লো সে।দরজাটাও খুলে দিলো।মা অবাক হয়ে বললেন”ঘুমাচ্ছিলি নাকি?শরীর খারাপ?”
.
-“চলো ডিনার করবো।”
.
তিনজনে খেতে বসেছে।ইমাদ ভাতে হাত দিয়েই কেঁপে উঠলো।
-“পুতুলের কথা বড্ড মনে পড়ছে।কি করছে সে এখন।তার কি বিয়ে হয়ে গেছে?তাকে কি মারছে ওরা?”
.
-“ভাবছি কাল সিনথিয়ার পরিবারের সবাইকে ডাকবো।এঙ্গেজমেন্টটা কালই করে নেবো।আর দেরি নয়।ইমাদ তোর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না।তারা চেয়েছিল আমার আর তোর বাবাকে একসাথে দেখতে।কাল সেটাও হয়ে যাবে।চুপচাপ খেয়ে শান্তিতে একটা ঘুম দে।কাল একটা নতুন সকাল আর নতুন দিন।দিনটা তোর খুব ভালো যাবে দেখিস।”
.
ইমাদের গলা দিয়ে খাবার নামছে না।খাবার অসম্পূর্ন রেখেই উঠে চলে গেলো সে হাত ধুতে।ইমাদের বাবা চুপচাপ খাবার খাচ্ছেন।সিনথিয়াকে তার একটুও পছন্দ না।এদিকে ইমাদের ও পছন্দ না।তিনি চাচ্ছেন চরম বিরোধিতা করতে।কিন্তু তার বিরোধিতাতে দুই পয়সার লাভ ও হবে না তাই ভেবে চুপচাপ খাবার সাবাড়ে সময় পোহাচ্ছেন।মিসেস রওনক মনে মনে তালিকা বানাচ্ছেন কাল কি কি রাঁধবেন।
ইমাদ তার রুমে চলে এসেছে।রুনটা যেন পুতুলের অপেক্ষায় বিষাদময় হয়ে আছে।পুতুলের অনুপস্থিতি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
-“মাত্র কটা দিন!অথচ এত মিস করছি।হয়ত আমি উনাকে চলে যেতে আটকাতে পারলে এত মিস করা হতো না।আমার দোষেই উনাকে চলে যেতে হলো বলেই কষ্ট হচ্ছে।তাকে আমি আনতে পারি না?তার জীবন আরও একবার বাঁচাতে পারি না?”
——-
রাত যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না।পুতুল ফ্লোর থেকে এখনও ওঠেনি।পাশের রুমটা হলো ড্রয়িং রুম।বাবা আর ভাইয়ার সব কথা কানে আসছে।বিয়ের আলোচনা করেই যাচ্ছেন তারা। যেন আজ আর ঘুমাবেন না।
পারলে বিয়েটা আজই সেরে ফেলতেন।সাইমন একটা কাজে ঢাকার বাহিরে গেছে তানাহলে এতক্ষণে বিয়ে হয়ে যেতো।
.
পরেরদিন সকালটা আরও কষ্টের হলো।সারারাত চোখে ঘুম না এসে এসেছিল সকালের দিকে।চোখের পাতা এক করতে না করতেই তার রুমের দরজা খুলে গেলো।সাইমনের বোন তিনজন ঢুকেছে পুতুলের রুমে।তিনজনই মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।হাতের ডালা বিছানার উপর ঠাস করে রেখে জোর করে পুতুলকে নিচ থেকে তুললো তারা।যেন তারা রোবট।পর্দার আড়াল থেকে কেউ তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে।
পুতুলের শরীরে শক্তি নেই।চুপ করে আছে সে।ওরা ওকে দাঁড় করাতেই আসাদ কথা থেকে এসে এক মগ পানি ছুঁড়ে মারলো পুতুলের মুখে।পুতুল হকচকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবার।ওড়না দিয়ে মুখ মুছে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
আসাদ রেগে রেগে বললো,”এরে রেডি করিয়ে বসিয়ে রাখো।”
——–
-“ইমাদ জলদি করে একটা সাদা পাঞ্জাবি কিনে আন যা”
.
ইমাদ টেবিলের এক কোণায় বসে পাউরুটিতে জ্যাম লাগাচ্ছিলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”কেন?”
.
-“তোর আজ এঙ্গেজমেন্ট না?কি পরবি?একটা নতুন পাঞ্জাবি তো লাগবে নাকি?জলদি যা।আর আসার সময় কয়েকটা ফুল নিয়ে আসিস।গোলাপ!!সিনথিয়ার মাথায় গুঁজে সাজিয়ে দেবো।”
.
ইমাদ চুপচাপ তার রুমে চলে আসলো।বারান্দায় অপরাজিতা ফুলগাছটার বামপাশে পুতুলের ওড়না ঝুলছে।এটা পরে সে এই বাসায় এসেছিল।ওড়নাটাকে দড়ি থেকে ছুটিয়ে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো সে।তারপর আকাশের দিকে তাকালো
-“আচ্ছা পুতুলকে বাঁচানোর রাইট কি আমার আছে?আমি কি পারবো উনাকে সেভ করতে?আমি যদি যাই তাহলে কি উনার বিয়ে হবে না?নাকি হয়ে গেছে।দেরি হয়ে গেলো আমার?
আদৌ আমার যাওয়া উচিত কি?”
চলবে”””