বাবুই পাখি পর্ব-১৬+১৭

0
730

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১৬
Writer-Afnan Lara
.
প্রথমবার অনেক অনেক মানুষ এসেছিল বাড়িতে।আর এবার বিশ বাইশ জন।তাও বেশিরভাগই সাইমনদের বাসার।পুতুল বিছানার কিণারায় বসে প্রহর গুনছে।হাতে।দুই হাতে বিশ বার।মোট আশিবার গোনা হয়ে গেছে।বেলা বারোটা বাজে এখন।হইচই আরেকটু হলেও বেড়েছে।সাইমনের মা বাবা এসেছেন মিনিট পাঁচেক হলো।মুখ বাঁকিয়ে কতসব বলছেন পুতুলকে নিয়ে।
যেন পারছেন না গিলে খাচ্ছেন ওকে।তাদের ছেলে রাজপুত্র তারপরেও কেন যে রাজি হলো তাই ভেবে তারা বড্ড অবাক।অবশ্য এইসব কথা পুতুলের বাবা ভাইয়ের সামনে বরাবর বলেননি।
বলেছেন পুতুলদের দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের সামনে।আরও কত নিন্দা।বলে শেষ করা যাবে না।পুতুলের চরিত্র নিয়ে টানাটানি এত বেশি হচ্ছে যে একটাসময় বুঝি দড়িটা ছিঁড়েই যাবে।পুতুল সব শুনছে।মনে হয় যেন ওকে শুনিয়েই বলা হচ্ছে সব।অথচ এমন পরিবার নাকি হাজারে একটা পাওয়া যায়।পুতুলের নাকি সৌভাগ্য এমন একটা শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে বলে।ভালো বেশ ভালো।
.
ইমাদ পাঞ্জাবির দোকান থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি নিল।তার উপর খয়েরী রঙের সুক্ষ্ম ডিজাইন।হালকা পাতলা।গরমে পরতে অসুবিধা হবে না।পাঞ্জাবির প্যাকেটটা বাম হাতে ঝুলিয়ে সে এখন ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।গোলাপ দেখছে আর মাথার উপরের রোদটার তাপের প্রকোপ বোঝার চেষ্টা করছে।পরে মনে হলো সে তো এখানে গোলাপ কিনতে এসেছে।
-“হুট করেই চিন্তাভাবনা এক ছুটে পুতুলের কাছে চলে যায়।এই নিয়ে কতবার যে কাজ ভুলে গেলাম!!”
.
পাঁচ ছয়টা গোলাপ নিয়ে ইমাদ আবারও হাঁটা ধরলো।সামনে দুইটা পথ।মাঝখানে পিলার দাঁড়িয়ে আছে।ডান পাশের রোডে তার বাসা।আর বাম পাশের রোডে পুতুলদের বাসা।ডিসিশন নেওয়ার মোক্ষম সময় এটা।ঢোক গিলে ইমাদ বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো।যেন সে সব পারবে।
যুদ্ধ সে জিতবেই জিতবে।
-“এরপরেই নিশ্বাস ফেলার পর মনে হলো আমি বড়ই ভীতূ।আমার দ্বারা হবে না।আমি সব নষ্টের মূল।”
.
প্যাকেট আর ফুল নিয়ে সে বাসায় ফিরে গেলো।বাসা অবধি আসতেই দেখলো ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষ।কজন চেনামুখ দেখতে পেলো সে।সিনথিয়া,তার বাবা, মা আর ছোট বোন।ইমাদ সিনথিয়ার বাবা মাকে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে রুমে চলে আসলো।মা দরজা ফাঁক করে বলে গেছেন জলদি রেডি হয়ে আসতে।পুরো বাসা বিরিয়ানির ঘ্রানে ম ম করছে।সিনথিয়া কিছুক্ষন পরেই আসলো রুমে।নক করেই ভেতরে ঢুকে গেলো সে।ইমাদ সবে পাঞ্জাবির বোতাম লাগাচ্ছিলো।সিনথিয়াকে দেখে সোজা দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
.
সিনথিয়া কিঞ্চিত হেসে বিছানায় ছড়িয়ে থাকা গোলাপগুলো নিতে যেতেই ইমাদ তার আগেই ফুলগুলো নিয়ে নিলো।
সিনথিয়া প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে আছে।ইমাদ ফুলগুলোকে অন্য জায়গায় সরিয়ে বললো,”মা বলেছিল আনতে।পরে দেওয়া হবে”
.
-“ওহ।যেভাবে নিয়ে নিলে।আমি তো ভাবলাম কার জন্য না কার জন্য আনলে।আচ্ছা চুল ঠিক করে আসো।এঙ্গেজমেন্টটা একবার হোক।তারপর তোমার নিস্তার নেই।”
.
কথাটা বলে সিনথিয়া চলে গেছে।ইমাদ আয়নাতে নিজের এলোমেলো চুলগুলো দেখে নিলো।ঠিক করলো না।ফুলগুলোকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে রুম থেকে বের হলো সে।
——-
-“আশ্চর্য এসব কি বলছেন নাজিম ভাই??সাইমন আসবেনা মানে?খোলসা করে বলুন”
.
-“খোলসা করে বলার আর কি আছে।সাইমন ফোন দিয়ে বলেছে সে আসবেনা”
.
-“এখানে গেমস খেলা হচ্ছে না।আজ সাইমন আর পুতুলের বিয়ে।আর আপনি বলছেন সাইমন বললো আসবেনা।মানেটা কি?”
.
-“মানে সহজ।সে আসবেনা মানে সে বিয়েটা করবে না।সিম্পল।”
.
-“আপনারা কি এসব আগে থেকেই জানতেন?”
.
-“জানলে কি আর দশ হাজার টাকা নষ্ট করে পুনরায় বেনারসি আনতাম?যাই হোক ছেলের সুবুদ্ধি হয়েছে এটাই অনেক।আমরাও এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না।আপনার মেয়ের চরিত্রের দোষ আছে বলেই সে পালিয়ে গিয়ে এতদিন ছিল।ভালো মেয়ে হলে ঐদিনই পাওয়া যেতো তারে।”
.
কথা কাটাকাটি করে সাইমনের বাবা আর মা চলে গেছেন তাদের সব আত্নীয়দের নিয়ে।পুতুল সব শুনে দাঁত কেলালো কিন্তু বুঝতে দিলো না কাউকে।তার পাশ থেকে মা উঠে এসে বললেন,”যা হয়েছে ভালো হয়েছে।আমার মেয়ে কি ঠ্যাকা পড়েছে?ওর জন্য ছেলেদের লাইন লেগে যাবে দেখো”
.
-“লাইনের দরকার নাই।আসাদ যাও একটা ছেলে ধরে আনো।ওরে পুতুলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পুতুলকে বিদায় করবো আজকেই।আর মানসম্মান খোয়াতে চাই না।বহুত হইছে বেজ্জতি”
.
আসাদ হনহনিয়ে বের হতে গিয়ে ইমাদের সাথে ধাক্কা খেলো।ইমাদ ভয়ে শক্ত রোবটের মতন হয়ে গেছে।হাতের গোলাপগুলো কাঁপছে।কাঁপতে কাঁপতে সে বললো,”বিয়ে কি হয়ে গেছে?”
.
-“তুমি সেই না?”
.
-“হ্যাঁ।ঐ যে চুম্বন…..”
.
-“হইছে আর বলতে হবে না।এখানে আসছো কেন?”
.
-“দাওয়াত ছিল।আমি ছেলেপক্ষ।বিয়ে কি হয়ে গেছে?”
.
-“না হয়নি।ছেলেপক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে চলে গেছে।
সাথে করে সব ব্যাটালিয়ন নিয়ে গেছে।তুমিও যাইতে পারো”
.
-“ওহহ।ঠিক আছে।”
.
ইমাদ মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরেছে।”
.
-“এই দাঁড়াও”
.
-“জ্বী বলুন”
.
-“চলো আমার সাথে।”
.
আসাদ ইমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো ড্রয়িং রুমে।
.
-“কে এটা?”
.
-“এই ছেলেটা আমাদের পুতুলকে বিয়ে করবে।”
.
ইমাদ চোখ বড় করে আসাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”না ”
.
-“দেখতে তো ভালোই।কিসের চাকরি করো?”
.
-“না আমি বিয়ে করবো না।”
.
-“তোমাকে বললাম কিসের চাকরি করো?”
.
-“বললাম তো বিয়ে করবো না”
.
-“তুমি কি চাকরি করো তা পরেও বের করা যাবে।আচ্ছা আগে বলো আমাদের মেয়েকে না দেখে বিয়েতে অমত করছো কেন?”
.
-“আপনারা হুট করে আমাকে পেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিচ্ছেন কেন?”
.
-“এই ছেলে মহা বেয়াদব।প্রশ্ন করলে পাল্টা প্রশ্ন করে।আমার মেয়ে আরেক বেয়াদব।দুই বেয়াদবের বিয়ে দিলে মন্দ হবে না।”
.
-“দেখুন আমি বিয়ে করবো না।”
.
-“বাবা জোর করবে নাকি আরেকটা খুঁজতাম?”
.
-“এক কাজ কর কালামের সাথে বিয়ে ঠিক কর।”
.
কালাম এগিয়ে আসলো দাঁত কেলিয়ে।কালামকে দেখে ইমাদের চোখ কপালে।বিশাল দেহ লোকটার।পুতুলের হাত চেপে ধরলেই মরে যাবে সে।পুতুল তো একে প্রথম দেখে অজ্ঞানই হয়ে যাবে।”
.
-“বাছা তুমি যখন বিয়ে করবে না তখন যেতে পারো।এই তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?কালামরে একটা পাঞ্জাবি পরে আসতে বল।মেয়ের বডিগার্ডের সাথেই তার বিয়েটা দিয়ে দেবো।”
.
-“আসাদের বাবা তুমি পাগল হয়েছো?কালাম পুতুলের চেয়ে বয়সে কত বড়!!ওকে পুতুল মামা ডাকে ”
.
-“তো??এখন থেকে জামাই ডাকবে।এই তোরা জলদি কর।সময় বেশি নেই।”
.
ইমাদ দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে।পেছনে তাকিয়ে বললো,”আমি পুতুলকে বিয়ে করতে চাই”
.
আসাদ আর পুুতুলের বাবা তাকালেন ওর দিকে তারপর সোফায় বসে পড়ে বললেন,”পাঞ্জাবিতো পরেই আছো।বসে পড়ো।আর তোমরা সব রেডি করো জলদি”
——
দু পক্ষের কবুল বলা শেষ।বিয়েটা অবশেষে হয়েই গেলো।পুতুল এখনও জানে না তার সাথে কার বিয়ে হয়েছে।শুধু জানে সাইমনের সাথে হয়নি।বারান্দায় বসে গ্রিল কাটছিল স্টিলের স্কেল দিয়ে।জানে এটা দিয়ে লোহার গ্রিল কাটবে না তাও শেষ চেষ্টা করেছিল।পরে মা এসে বললো বিয়ে হবে।
ওপাশ থেকে হুজুরের কথা আর বাবার কথা ছাড়া আর কারোর কথা শোনা যায়নি।কে জানে কার সাথে বিয়ে হয়েছে।
বাবা দরজার ওপারে থেকে বললেন,”এরে নিয়ে বিদেয় হও।আর কখনও আসবে না”
.
পুতুলকে ধরে মা অনেক কান্নাকাটি করলেন।পুতুল কাঁদলো না।
মূর্তির মতন ঘোমটা টেনে বের হলো সে।আসাদ ভাইয়া গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
-“কি আনকমন বিয়ে!!
কনে যাওয়ার সময় আশেপাশে মানুষ ধরে না আর আমার বেলায় একটা পাখিও নেই কোথাও।পাশে আমার স্বামী।”
.
মাথার ঘোমটা টেনে সরিয়ে পুতুল কৌতুহল নিয়ে বললো,”একবার ঐ গলিতে যাবেন?একজনকে বিয়ের খবরটা দেওয়ার আছে”
.
ইমাদ রিকশা খুঁজছিল।পুতুলের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,”কাকে?”
.
পুতুল ভূত দেখার মতন চমকে ছিঁটকে দূরে চলে গেলো।বাসার বাউন্ডারির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
.
ইমাদ একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসে হাত বাড়িয়ে বললো,”আসুন।আরেকটা ঝড় গায়ের উপর দিয়ে যাওয়া বাকি।এর পরেই রঙধনু উঠবে।চিন্তা করবেন না”
.
পুতুলের মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে।হাত কাঁপছে তার।কাঁপা কাঁপা হাতটাকে উপরে তুলে জিজ্ঞেস করলো বিয়েটা কার সাথে হয়েছে।
.
-“কার সাথে আবার।আমার সাথে।আজ আবারও আপনার জীবনটা বাঁচিয়ে দিলাম।তবে বাঁচলাম কিনা জানি না।
আমার মনে হলো কালামের চেয়ে আমি একটু বেশি ভালো রাখবো আপনাকে। তাই তার জায়গায় আমি বসে গেলাম।আমাকে সহ্য করা যাবে?”
.
পুতুলের মুখে হাসি ফুটলো।এক ছুটে ইমাদের হাত ধরে ওর পাশে বসে পড়লো সে।ইমাদ ওর মুখে হাসি দেখে বললো,”হাসিটা লক করে রাখুন।আমার বাসার মানুষ আরও কঠিন।এবার তার রুপ দেখবেন”
.
পুতুল মুখটা আবার ফ্যাকাসে করে ফেললো।
রিকশা চলছে ধীরে ধীরে।পুতুল ইমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার মনে হাজারটা প্রশ্ন এসে দল বেঁধেছে।একটু সময় পেলে সব কিছুর উত্তর সে জানতে চাইবে।না জানি এরপর কি হতে যাচ্ছে।ইমাদের মা বাবা যদি না মানে তাহলে কি ইমাদ তাকে ছেড়ে দেবে?বিয়েটা অস্বীকার করবে?
তাহলে কি হবে শেষে?
.
বাসার সামনে এসে রিকশা থামলো।ইমাদ মানিব্যাগ বের করে টাকা দিচ্ছে।পুতুল মাথা তুলে দোতলায় ইমাদের রুমের বারান্দাটা দেখছে।ইমাদ পকেট হাতিয়ে গোলাপগুলো বের করে পুতুলের খোঁপায় আটকে দিলো।পুতুলের হুস নেই।সে ভয়ের চোটে সব ভুলে গেছে।শুধু মনে হচ্ছে আজ তার দুই কূলই যাবে।
.
ইমাদ হাঁটা শুরু করেছে দেখে সেও পিছু পিছু ছুটলো।কলিংবেল চাপতে হলো না।দরজা লক ছিল না।ইমাদ দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতর ঢুকতেই সিনথিয়ার বাবা ওকে দেখে বললেন,”কোথায় ছিলে তুমি?কটা বাজে খবর আছে তোমার?এঙ্গেজমেন্টটা দুপুরল হবার কথা ছিল তা কি জানতে না?”
.
উনি কথা শেষ করতে না করতেই পুতুলকে দেখতে পেলেন।পুতুল চোরের মতন ইমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।পুতুলকে বিয়ের সাজে দেখে ইমাদের মায়ের গলা শুকিয়ে গেছে।হনহনিয়ে দূর থেকে হেঁটে এসে ইমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”ও এখানে কেন?”
.
-“মা আমি পুতুলকে বিয়ে করেছি আজ।কিছুক্ষণ আগে”
.
সিনথিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
-“ইমাদ কি মজা করছে?এই মেয়েটা কে?আগে তো কখনও দেখিনি ইমাদের সাথে।তাহলে হঠাৎ বিয়ে?যে ছেলেটা আমাকে বিয়ে করতেই অমত জানাচ্ছিল আর আজ সে একটা মেয়েকে বিয়ে করে চলে আসলো?”
.
-“এসব কি বলিস?কিসের বিয়ে?কোথায় হলো বিয়ে?”
.
-“পুতুলদের বাসায়”
.
-“কেন করলি?তোর আজ সিনথিয়ার সাথে এঙ্গেজমেন্ট না?”
.
-“পুতুলকে আমি পছন্দ করি তাই বিয়ে করেছি।”
.
ইমাদের মা পুতুলের দিকে এগিয়ে আসতেই পুতুল ইমাদের পাঞ্জাবিটা মুঠো করে ধরলো।
ইমাদ আস্তে করে বললো,”মা আমি সজ্ঞানেই ওকে বিয়ে করেছি”
.
বাবা এগিয়ে এসে বললেন,”আমাদের সাথে আলাপ করা দরকার ছিল তোর।এটা ঠিক করিসনি”
চলবে””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_১৭
Writer-Afnan Lara
.
-“ঠিক না ভুল তা আমার দেখার বিষয় ছিল না।পুতুলের জীবনটা বাঁচাতেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তাছাড়া সব চেয়ে বড়কথা হলো ওকে আমি পছন্দ করি।রইলো কথা সিনথিয়ার।ওকে আমি শুরু থেকেই পছন্দ করতাম না।এই বিয়েটা সম্পূর্ন আমার অমতের ভিত্তিতে সামনে এগোচ্ছিল”
.
মা হাততালি দিলেন তারপর চোখ বড় করে একবার পুতুলকে দেখে নিয়ে বললেন,”বেশ।তাহলে এখানে কি?বিয়ে করেছো নিজের মতে।সুতরাং আমাদের সাথে আর যোগাযোগ তুমি রাখবে না।আমার ছেলে হয়ে আমারই কথার বিরুদ্ধে গেলে।এটা একদমই ঠিক করোনি।আর কখনও আমার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করবা না।তোমাকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন ছিল আমার।সেসব তো ভাঙ্গছোই সাথে করে সিনথিয়ার পরিবারের সামনে নাকটাও কেটে দিয়েছো”
.
-“তুমি তুমি করে বলছো কেন??”
.
-“তুই বলতাম আমার ছেলেকে।”
.
ইমাদ বাবার দিকে তাকালো।বাবা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”সিনথিয়াকে আমি পছন্দ করতাম না ঠিক কিন্তু তাই বলে তুমি অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনবে?আমি তোমার জীবনে কিছু হই না?একবার জানালে কি এমন হতো?”
.
-“বিয়েটা হতে দিতে না তোমরা।আমি কোন সিচুয়েশনে বিয়ে করেছি তা কেবল আমি জানি”
.
-“এই মেয়েকে আমরা মানি না।এবার বলো তুমি কি করবে ইমাদ?”
.
-“মা তুমি কি বলতে চাও খোলসা করে বলো তারপর আমি আমার উত্তর জানাচ্ছি”
.
-“এটা বলবো না যে এরে ছেড়ে দাও।কারণ বিয়ে তো বিয়েই।বিয়ে তো আর মুখের কথা না যে বললেই ছাড়া যাবে।আমার কথা হলো তুমি একটিবারের জন্য হলেও কেন আমাদের জানাওনি?”
.
-“বললাম তো আমি যদি এসব জানাতাম তোমরা বিয়েটা হতে দিতে না”
.
-“হ্যাঁ দিতাম না।কিন্তু এটা তুমি ঠিক করোনি।বাবা মা হিসেবে আমাদের ও মত থাকতে পারে।”
.
ইমাদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।পুতুল অসহায়ের মতন ইমাদের নিচু হওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে।তার বলার কিছু নেই।শুধু দেখার আছে।এখানে ইমাদকে ছেড়ে সবার মুখ কালো হয়ে আছে।কারোর কারোর মুখ রেগে লাল হয়ে আছে।যেমন সিনথিয়া,তার বাবা,মা আর বিশেষ করে ইমাদের মা।
.
ইমাদের মা ইমাদকে বকে কূল না পেয়ে এবার পুতুলের সামনে এসে দাঁড়ালেন।দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”আমার ছেলের বিয়ে ঠিক এটা আগেও তো বলেছিলাম তোমাকে।ছেলে আমার বিয়ে করতে চাইলো আর তুমি সাথে সাথে রাজি ও হয়ে গেলে?মানা করতে পারোনি?একবারও সিনথিয়ার কথা ভাবতে পারোনি?জানতাম আমি এমন কিছু হবে।তা নাহলে ভালো মেয়ে তো আর বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের সাথে ঘুরেফিরে না।তোমার মনে মনে এই ছিল এবার ক্লিয়ার হলাম।”
.
-“মা ওর দোষ নেই।ও জানতো না আমার সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে।”
.
-“নাটকের অনুবাদ করতে হবে না।যা বোঝার সব বোঝা হয়ে গেছে।আমি যাচ্ছি আমার বাসায়।আর জীবনে তোমার মুখ আমায় দেখাবে না।”
.
মা হনহনিয়ে চলে গেছেন।এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছে এবার।সিনথিয়া ইমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য থাকতে চেয়েছিল কিন্তু তার বাবা তাকে জোর করে নিয়ে গেছে। তাও সে মাঝপথ থেকে ছুটে আসলো।ইমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থেকে ওর দুহাত ধরে বললো,”আমি জানি তুমি এই মেয়েটাকে ভালোবাসো না।পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এমনটা করলে।
তুমি আমাকে ভালোবাসো।বলো এটা সত্যি??”
.
এমনিতেও মায়ের বকা খেয়ে ইমাদের হাল বেহাল হয়ে গেছে আর এখানে সিনথিয়া এসে আবার উদ্ভট কথা বলছে।
-“আরে ভাই পছন্দই তো করতাম না কোনোদিন আবার ভালোবাসা?
মন চাচ্ছে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলতে “কাঁচকলা”
.
-“কি হলো কিছু বলছো না কেন?”
.
-“সিনথিয়া তুমি এখন যাও।আর কি বলবো আমি?আমি স্পষ্টভাষী।যা বলার সোজাসুজি বলে দিয়েছি।”
.
সিনথিয়া যাওয়ার সময় পুতুলের দিকে চোখ বড় করে তাকালো।পুতুল ভয় পেয়ে চুপসে গেছে।একবার এক জনে ওর দিকে চেয়ে চোখ রাঙায়।রাঙানোরই কথা।দোষটা তারই।
-“এত সাজানো গোছানো বিয়ের কথা চলছিল আর আমি সব ভেঙ্গে দিলাম।সিনথিয়া আপুর জায়গায় আমি হলে আমি আমারই চুল ছিঁড়ে দিতাম।যাই হোক যেহেতু আমি ভোলাভালা ক্যারেক্টার সুতরাং সেভাবেই চুপ থাকি।”
.
ইমাদ শক্ত হয়ে এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।বাবা শান্ত গলায় বললেন,”তুমি ওকে নিয়ে এখানে থাকতে পারো।আমার সমস্যা নেই”
.
তিনি কথা শেষ করতে না করতেই দেখলেন ইমাদের মা তার জামাকাপড়ের ট্রলি নিয়ে হাজির।ইমাদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন,”কিন্তু আমার সমস্যা আছে।ও এখানে থাকতে পারবে তবে এই মেয়েটাকে নিয়ে নয়।”
.
ইমাদ পুতুলের হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে চলে আসলো।একটা শব্দ ও সে বললো না।দুজনে এখন রিকশার অপেক্ষা করছে।
পুতুল ইমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে একটু পিছিয়ে গেলো তারপর বললো,”আমি চাই না এতদিন পর মিলে যাওয়া পরিবারটিকে আবারও ভাঙ্গতে দিতে।”
.
ইমাদ পুতুলের দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা আবারও খপ করে ধরে বললো,”আপনি কি ভাবছেন আমি এত সহজে বাসা ছেড়ে দেওয়ার মতন লোক?আমি যাই করি তার পেছনে কারণ থাকে আর আজও কারণ আছে। মা আমাকে ছেড়ে এক সপ্তাহের বেশি থাকতে পারবে না তা জানি আমি।বা এক মাস।একদিন না একদিন তো ফিরিয়ে নেবেই।কিন্তু আজ আমি বের হয়ে আসলাম অন্য কারণে।মাকে দেখেছেন?আমাকে চলে যাওয়ার কথা বলেছে বাবার কাছে থাকতে এসে।মানে আমি না থাকলে উনি এই বাসায় থাকবেন।এই সুযোগ হাত ছাড়া করার মতন??কখনওই না।মনমালিন্য থেকে যদি দারুন কিছু হয় তবে সেটা গ্রহণযোগ্য।বুঝলেন?”
.
-“নাহ”
.
-“পরে বুঝাবো।এখন চলুন”
.
-“কিন্তু যাব কোথায়?আমার বাসায় তো আমারই জায়গা হবে না।আপনার কথা তো বাদই দিলাম।
বন্ধুবান্ধবরা তো এখন বিপদ দেখেছে এবার পল্টি খাবে।তাদের হাজার সমস্যা বেরিয়ে আসবে আমাদের রাখার কথা শুনলে”
.
-“রাইট।কিন্তু আমি এখানের কোনো অপশনেই যেতে চাচ্ছি না।আমরা যাচ্ছি বাসা বাড়ি খুঁজতে।চাকরি করি সুতরাং এত চিন্তার কিচ্ছু নেই”
.
-“এই সময়ে বাসা ভাড়া পাবো কই?”
.
-“ঐ যে হাসবেন্ড ওয়াইফ।পকেটে আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে।ব্যস হয়ে যাবে।চিন্তা নিয়েন না”
.
পুতুল বোকার মতন আবার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো।ইমাদ ওকে নিয়ে রিকশা চড়ে বেশি দূরে গেলো না।তিন গলি পেরিয়ে এক গলিতে আসলো।বাসা দেখে পুতুল তাকিয়ে আছে ইয়া বড় হা করে।বাসার সামনে আবার বড় করে সাইনবোর্ড ঝুলানো।সেখানে লেখা টু-লেট।
ইমাদ ওর হাত ধরে বললো,”মালিককে বলবেন পারিবারিক সমস্যার জেরে এখানো আসা।আর হ্যাঁ বলবেন বিয়ে হয়েছে পাঁচদিন হলো।শাড়ী এটা ভালো লেগেছে বলে এটাই পরে এসেছেন।ঠিক আছে?”
.
পুতুল মাথা নাড়ালো।ইমাদ ওর হাত ধরে হেঁটে চললো বাসার ভেতর।
মালিক থাকেন দোতলায়।কলিংবেলে চাপ দিলো ইমাদ।মালিক নিজেই দরজাটা খুললেন।ইমাদ আর পুতুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন,”পালিয়ে আসা বর বউ নাকি?
.
“নাহ তো।চাকরিসূত্রে আসা।বাসা ভাড়া নেবো।খুব জরুরি।”
.
মালিক পান চিবোতে চিবোতে বলেন,”চেনা চেনা মনে হচ্ছে।এই এলাকার নাকি?
তা বিয়ের কাগজপত্র আছে তো?”
.
-“ওসবের ব্যবস্থা করতে দুদিন লাগবে।তবে আমি তার আগে আপনাকে আমার পরিচয়টা দিতে চাই।মিসেস রওনকের ছেলে আমি।চিনেছেন?”
.
-“মিসেস রওনক!ওহ মনে পড়েছে।আমার নাতিনের স্কুলের টিচার না উনি?”
.
-“হ্যাঁ।আমি তার ছেলে ইমাদ হাসান অমি।”
.
-“চিনে ফেলেছি।আসো ভেতরে আসো।”
.
ইমাদ সোফায় গিয়ে বসলো।মালিক তমিজউদ্দিন ওর সামনা সামনি বসলেন।তারপর বললেন,”তা তোমার বাবা মায়ের আলাদা আলাদা দুটো বাসা থাকতে তুমি বাসা ভাড়া নিতে চাচ্ছো কেন?আর বিয়ে করলে কবে?কিছুই তো জানলাম না শুনলাম না।এতদিনের খোঁজখবর।মিসেস রওনক একবার দাওয়াত দিলেন না।”
.
-“হবে হবে সব হবে।তবে আপনার যদি আমার বিয়ে নিয়ে সংশয় থেকে থাকে তাহলে বলতে পারেন”
.
-“না তা কেন হবে?তুমি থাকতে পারো।চাবি দিচ্ছি।আর হ্যাঁ আজ রাতে এখানে এসে ডিনার করো।ফ্ল্যাট তো ফাঁকা বসবে কই?
শুবে কই?”
.
-“ওসব আপনাকে ভাবতে হবে না।নতুন বিবাহিত কাপলকে আলাদা থাকলে হলে একটু আকটু কষ্ট পোহাতে হয়।আমি এডভান্স দেবো নাকি মাস শেষেই নেবেন?এখন টাকা নিয়ে নিলে ভালো হয়।
শুধু শুধু পকেটে নিয়ে ঘোরার চেয়ে।”
.
-“তাহলে দাও।মাসে কিন্তু তেরো হাজার।এর বেশি না কম ও না।”
.
ইমাদ পুতুলের দিকে তাকালো।পুতুল সোফার পাশের প্লাস্টিকের ফুলের টবের ফুল নিয়ে খোঁচাখুচি করছিল।ইমাদ বললো,”সাড়ে বারো হাজার দেবো।
নতুন চাকরি তো।চলবে?”
.
-“আচ্ছা দিও।”
.
ইমাদ পুতুলকে নিয়ে হাঁটা ধরেছে।তৃতীয় তলার বাম পাশের ইউনিটে তাদের ফ্ল্যাট।ইমাদ চাবি দিয়ে লক খুলে বললো,”আসুন ভেতরে আসুন”
.
-“মশকরা করলেন নাকি সত্যি সত্যি বরণ করছেন।?”
.
-“দুটোই।”
.
পুতুল ভেতরে ঢুকেই ইমাদের দিকে তাকালো।ইমাদ ব্রু কুঁচকে বললো”বিয়ে সংক্রান্ত কিছু শুনতে চাচ্ছি না আপাতত।”
.
-“বলছিলাম আমার খিধে পেয়েছে।কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।”
.
-“ওহ।তমিজ আঙ্কেল বললো ডিনার করাবে।ততক্ষণ তো ওয়েট করতে পারবেন না মনে হয়।প্রায় দুই ঘন্টা লাগতে পারে
হয়তবা এরও বেশি।আর আমি আপনাকে যতদূর চিনি আপনি এতসময় না খেয়ে থাকতে পারবেন না। তার উপর কাল থেকে উপোস।ও মাই গড!!আপনি এখানে বসুন”
.
পুতুল কপাল কুঁচকে বললো,”বসবো টা কোথায়?সব দেখি ফ্লোর আর ফ্লোর।”
.
-“বসার জন্য সবসময় চেয়ার/মোড়া লাগে না।দাঁড়ান!”
.
ইমাদ নিচে ফ্লোরে হাত দিয়ে মুছে পুতুলকে টেনে বসিয়ে বললো,”এই যে হয়ে গেলো বসার জন্য ফ্লোর।”
.
পুতুল মাথা নাড়িয়ে হাত দিয়ে ফ্লোর আরেকটু মুছে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।তারপর শুয়ে শুয়ে বললো,”হয়ে গেলো আমার বিছানা”
.
ইমাদ পুতুলের মাথার নিচে হাত রেখে বললো,”মা হয়ত দেরিতে মানবে কিন্তু ততদিনে আমি এই বাসাটাকে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবো”
.
-“আমাদের বাবুই পাখির বাসা”
.
-“বসেন।আমি দেখি খাওয়ার কিছু কিনে আনি”
.
ইমাদ দরজা খুললো যাবে বলে।পুতুল সবগুলো রুমের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো,”জলদি আসবেন।আমার ভয় করে”
.
-“ওকে।”
.
ইমাদ চলে গেছে।পুতুল হেঁটে হেঁটে সব রুমের আলো জ্বলিয়ে দেখছে। কোন রুম কেমন।এক রুম একদম ছোট।বাকি রুম দুটো বড় বড়।আর রইলো ডাইনিং আর ড্রয়িং রুম।এসবের আকার ঠিক আছে।বেশ ভালোই দেখতে।
-“আহারে আমার শাশুড়ি আমায় কবে মেনে নেবে কে জানে।অবশ্য মানার কথাও না।তার অপছন্দে বিয়ে করেছেন উনি আমাকে।এটা তো একদমই মানা যায় না।উনার জায়গায় আমি হলে বাংলাদেশ থেকেই বের করিয়ে ছাড়তাম ছেলেকে।
যাই হোক।যা রাগ দেখানোর দেখিয়েছেন।ভালোই ভালোই এবার উচিত মেনে নেওয়া।কারণ দোষটা আমার।তার ছেলের না।
আমি বিপদে পড়েছি বলেই তো আমায় বিয়ে করেছেন উনি।আমার কেন জানি না কষ্ট হচ্ছে না।খুশিতে নাচার ইচ্ছা জাগছে খুব।সিনথিয়া আপুর জায়গাটা আমি পেলাম বলে কি??কে জানে!তবে আমার বরের জায়গায় উনাকে দেখে এত খুশি লেগেছিল। মন চেয়েছিল ধরে…
থাক বললাম না।এসব কি ভাবি আমি।ধুর ধুর।”
.
ইমাদ দশ পনেরো মিনিট পর বাসায় ফিরেছে।হাতে কেক,জুস আর দুইটা পাতিল।পুতুল পাতিল দেখে ফিক করে হেসে দিয়েছে।ইমাদ ব্রু কুঁচকে ওর হাতে পাতিল ধরিয়ে দিয়ে বললো,”সব আনতে হবে।পাতিল দিয়ে শুরু করলাম”
চলবে””