বিষাদের শহরে তুমি এলে পর্ব-০২

0
224

#বিষাদের_শহরে_তুমি_এলে
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

“পার্কের বেঞ্চে বসে আছে ইফাদ। গরমে পুরো শরীর তরতর করে ঘামছে। বিরক্ততে মুখটা কুঁচকে ফেলল। পাঁচ মিনিট হলো এখানে এসেছে সে। এতেই অসহ্য হয়ে পড়ছে। সে অপেক্ষা করতে একদম পছন্দ করে না। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শ্রেয়া আসলো। গাড়ি থেকে নেমে স্রুতিকে বিদায় দিয়ে, ইফাদের দিকে অগ্রসর হলো। দ্রুত পায়ে ইফাদের কাছে আসলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ইফাদের দিকে নজর দিল। একটা শুকনো ঢোক গিলে, নিম্ন স্বরে বলল। ”

–রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। তাই আসতে দেরি হয়েছে। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। শ্রেয়ার কথা শুনে, ইফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করল শ্রেয়ার দিকে, শ্রেয়া ভয়ে মাথা নিচু করল। শ্রেয়াকে হতভম্ব করে দিয়ে, ইফাদ রাগান্বিত হয়ে বলল।

–আমার এত কাছে বসেছো কেনো? দূরে সরো। তুমি ঐ মেয়েটার হাত ধরেছিলে। না জানি হাতের মধ্যে কত জীবানু লেগে আছে। বাহিরে থেকে আসলে, আমার থেকে দূরে থাকবে। নোংরা মানুষজন আমি পছন্দ করি না। ইফাদের কথা শুনে, শ্রেয়া বিস্ময় নয়নে ইফাদের দিকে, দৃষ্টিপাত করল। তার এমন খুত খুঁতে ছেলে একদম পছন্দ না। বিরক্ত হলো সে। প্রতি উওর না করে, চুপ করে বসে রইলো। কিন্তু মনটা যে, সায় দিল না। মনের মধ্যে জমে থাকা বাক্যটা প্রকাশ করে দিল।

–আমি বাহিরে থেকে এসেছি। তুমি কি বাসার মধ্যে শুয়ে আছো? শ্রেয়ার কথা শুনে, ইফাদ শ্রেয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করল। শ্রেয়া ইফাদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে, অন্যদিকে দৃষ্টি রাখলো। ইফাদ গম্ভীর হয়ে বলল।

–আমার কথার ওপরে কথা বলছো! সাহসের তারিফ করতে হয়। একে তো দেরি করে আসছো। আমাকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিয়েছো। আবার মুখে মুখে তর্ক করছো। শ্রেয়া নিরুত্তর রইলো। আবারো ইফাদের একটা অপছন্দের কাজ করে বসলো। শ্রেয়াকে নীরব হয়ে যেতে দেখে, ইফাদ হুংকার দিয়ে উঠলো।

–আমার সামনে আসলে, নীরবতা পালন করতে পারবে না। তোমার শব্দ ভান্ডারে যদি শব্দ না থাকে, তাহলে তুমি এখানে থেকে যেতে পারো৷ ইফাদের কথায় শ্রেয়ার মুখটা অপমানে চুপসে গেল। সে কি করেছে। পাঁচ মিনিট দেরি করে এসেছে। তার জন্য এত কথা শুনতে হবে।

–তুমি আমাকে ডেকেছিলে, তাই এখানে এসেছি। আমি কি নিজে যেচে তোমার কাছে এসেছি। কিছু বলার থাকলে, তুমি বলবে। আমি কেনো কিছু বলতে যাব। মুহুর্তের মধ্যে ইফাদের মুখের রঙ বদলে গেল। শ্রেয়া কাচুমাচু হয়ে আর একটু দূরে সরে গেল। ইফাদ উঠে দাঁড়ালো। শ্রেয়ার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে, শ্রেয়ার সামনা-সামনি গিয়ে দাঁড়ালো। শ্রেয়ার দৃষ্টি মাটির দিকে বিদ্যমান। শ্রেয়া মনে মনে আল্লাহকে সরন করতে লাগলো। ভুল জায়গায় তর্ক করে ফেলছে। ইফাদ যদি রেগে কিছু করে দেয়। তখন সে কি করবে। ইফাদ কিছু বলতে যাবে। তখনই আবিরের আগমন ঘটে। আবির এসে ইফাদের কাঁধে হাত রাখে, ইফাদ দ্রুত আবিরের হাত সরিয়ে দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

–তুই আমার কাঁধে হাত রাখলি কেনো? তুই হাত ধুয়েছিলি। কোন সাহসে আমার কাঁধে হাত রাখলি। তোর হাতে কত জীবানু ছিল। সব আমার শার্টে চলে এসেছে।

–তুই এত খুত খুঁতে স্বভাবে কেনো? ছেলে মানুষের খুত খুঁতে স্বভাবের হলে, একদম ভালো লাগে না। তোর এই স্বভাবের জন্য তোকে কেউ পছন্দ করে না। এখনো সময় আছে। নিজের স্বভাবটা পালতে ফেল। না হলে কপালে বউ জুটবে না।

–যে আমাকে ভালোবাসবে, আমি যেমন। আমাকে তেমন ভাবেই গ্রহণ করবে। নিজরে মনের মতো মানুষ পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর নিজের মনের মতো করে গুছিয়ে নেওয়া টাই হচ্ছে ভালোবাসা। রোদে পুড়ে আমার কাছে এসেছিস। তোর শরীর থেকে ঘামের বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে অবস্থান কর। ইফাদের কথা শুনে, আবির ললাটে হাত ঠেকিয়ে বিরক্ততে “চ” উচ্চারণ করল।

–তোকে ছেলে হতে, কে বলেছিল? তোর ছেলে না হয়ে, মেয়ে হওয়া উচিৎ ছিল।

–তোকে চরিত্রহীন হতে কে বলেছিল? তোর বিয়ের আগের তোর বউকে, তোর সব কীর্তির কথা বলে দিব। সারাদিন মেয়েদের পেছনে ঘুর ঘুর করিস। তোর লজ্জা করে না। ইফাদের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আবির। ইচ্ছে করছে, কষে দু’টো থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। নিজেকে দমিয়ে নিয়ে বলল।

–শ্রেয়ার বাসায় মেহমান আসছে। শ্রেয়ার আম্মু আমাকে বলছে, আমি যেনো শ্রেয়াকে বাসায় নিয়ে যাই। তুই অনুমতি দিলে, আমি শ্রেয়াকে নিয়ে যেতে পারি। আবিরের কথায় ইফাদ সোজাসাপটা জবাব দিল।

–তোর বোনকে আমি ধরে রেখেছি নাকি? নিয়ে যাবি। এতে বলার কি আছে?

–আরেক বার তুই আমার হাত ভেঙে দিয়েছিলি। আবার বলছিস। বলার কি আছে?

–ওহ্ তোর মনে আছে! আমি তো ভুলেই গিয়ে ছিলাম।

–মানুষ যখন কাউকে আঘাত করে। যে আঘাত প্রাপ্ত হয়। সে সারাজীবন মনে রাখে। আর যে আঘাত করে, সে কিছু দিনের মধ্যেই ভুলে যায়। তুই আমাকে আঘাত করেছিস। তাই তোর মনে নেই। আমি আঘাতটা সহ্য করেছি। তাই আমার মনে আছে। আমি কি অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করেছি।

আবিরের কথা শুনে, বিরক্ত হলো ইফাদ। অযথা কথা তার পছন্দ নয়। নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল। ইফাদ চলে যেতেই শ্রেয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল।

–এই ছেলের অ্যাটিটিউড আমার একদম পছন্দ হয় না। কিসের অহংকার দেখায় ও? না আছে রুপ আর না আছে গুন। এমন রগচটা ছেলের সাথে কেনো যে, রিলেশন করতে গিয়ে ছিলাম। প্রথমে দেখে আলাভোলা লাগছিল। শ্যাম বর্নের দেখে, ভেবেছি কিছু দিন রিলেশন করে ছেড়ে দিব। কিন্তু এই ছেলে যে, এত ধুরন্ধর কে জানতো?

–এই ছেলেকে আর বেশিদিন সহ্য করতে হবে না। তোর আব্বু আম্মু তোর বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে ফর্সা। শুধু আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। বউটা মারা গিয়েছে। কথা গুলো বলেই থামল আবির। শ্রেয়ার কপালে কয়েটা ভাজ পড়লো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

–ছেলের কি কোনো সন্তান আছে?

–না নেই। তবে ছেলেটা অনেক ভালো। তুই চাইলে বিয়ে করতে পারিস। অনেক সুখে থাকতে পারবি। এখন কথা না বলে বাসায় যাই চল। তোর জন্য সবাই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।

শ্রেয়া আর কথা বাড়ালো না। বাসার উদ্দেশ্য অগ্রসর হলো। বাসায় পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে শ্রেয়া। ছেলেকে শ্রেয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে। পাত্রপক্ষ আজকেই আংটি পড়িয়ে রেখে যেতে চায়। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে, চলে গেল পাত্রপক্ষ।

ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরলো ইফাদ। নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল ইফাদ। তখনই ইফাদের বাবার গম্ভীর কণ্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছলো। ইফাদ বিলম্ব করল না। স্থীর হয়ে দাঁড়ালো। বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করল।

–কিছু বলবে আব্বু?

–সারাদিন টো টো করে বেড়ালে হবে? সকালে খেয়ে বেড়িয়েছিলে?

–আজকে রান্না করেছে কে?

–তোমার সীমা আন্টি।

–তুমি জানো না। আমি আম্মুর হাতের রান্না ছাড়া খাই না। অযথা ডেকে বিরক্ত করবে না। তোমার সময়ের মূল্য না থাকতে পারে, কিন্তু আমার সময়ের মূল্য আছে।

–তোমার সময় কেমন সেটা আমার ভালো করে জানা আছে। সারাদিন টো টো করাই হচ্ছে, তোমার কাজ। বয়স তো কম হলো না। একটা বিয়েসাদী করো। ঘরে বউ আসলে তুমি যদি একটু সংসারী হও।

–আম্মুকে বলবো, বুড়ো বয়সে তার স্বামীর ভীমরতি ধরেছে। ইফাদের কথায় ইফাদের বাবা রক্তিম চোখে, ছেলের দিকে তাকালো। ইফাদ গা-ছাড়া ভাব নিয়ে, ওপরে চলে গেল। ইফাদের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেলেটাকে কি কেউ বাধ্য করতে পারবে না।

আজকে শ্রেয়ার বিয়ে। খুব জাঁকজমক ভাবে শ্রেয়াদের বাসাটা সাজানো হয়েছে। বাহারি রকমের ফুলে সেজে উঠেছে শ্রেয়ার বাড়ি। শ্রেয়াকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। শ্রেয়ার মুখে হাসির রেখা বিদ্যমান। তখনই শ্রেয়ার পাশে আবির এসে বসে। আবিরকে দেখে শ্রেয়া মুখটা গম্ভীর করে ফেলে।

–আজকে তোর বিয়ে, ইফাদ জানে, আজকে তোর বিয়ে? ইফাদকে এভাবে ঠকানো ঠিক হচ্ছে না। আমার মনে হয় ইফাদকে তোর বিয়ের কথাটা জানানো উচিৎ।

–তুই কি চাস আমার বিয়েটা ভেঙে যাক। আমি অসুখী হই। আমি ইফাদকে বিয়ে করলে, কোনোদিন সুখী হতে পারবো না। ইফাদের ব্যবহার অনেক খারাপ। ছেলেটা বড্ড এলোমেলো। আমার একটা কথাও শুনে না। আমাকে তার পায়ের নিচে রাখে। ইফাদ আদৌও আমাকে ভালোবাসে। আর ভালো বাসলেও আমার কোনো যায় আসে না। ওর মতো ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না। ইফাদের মতো ছেলেদের সাথে শুধু রিলেশনই করা যায়। স্বামী হবার কোনো যোগ্যতা ওরা রাখে না।

–আমি মানছি ইফাদ রগচটা ছেলে। তুই একটা মেয়ে। একটা মেয়ে চাইলেই একটা ছেলেকে গুছিয়ে দিতে পারে। তুই কি পারবি না। ইফাদকে গুছিয়ে নিতে?

–আমার সফল জামাই রেখে, আমি কেনো একটা বেকার ছেলের হাত ধরতে যাব। এসব ভালোবাসা দিয়ে কিছু হয় না। ভালোবাসতে হলে, আগে টাকা লাগে। যার টাকা আছে, তার ভালোবাসা আছে। যার টাকা নেই। তার ভালোবাসাও নেই।

–ইফাদ বেকার হতে পারে। কিন্তু ইফাদের বাবার কিসে কম আছে? বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ইফাদ। বিষয়টা ভেবে দেখতে পারিস।

–বন্ধুর হয়ে চামচামি করতে এসেছিস।

–শ্রেয়া!

–একদম চিৎকার করবি না। বোনের থেকে বন্ধুর দরদ বেশি। আবির একটা বাক্যও উচ্চারন করল না। দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করল। শ্রেয়া বিরক্ত মাখা মুখ করে, আবিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

বিয়ের আসরে বসে আছে শ্রেয়া। সেখানে আগমন ঘটে ইফাদের। ইফাদকে দেখে, অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো শ্রেয়ার। দূর থেকে রাজাকে শা*লা*ও বলা যায়। কাছে আসলে সব সাহস হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়। ইফাদ যত তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, শ্রেয়ার শরীরে ততই কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। ইফাদ শান্ত হয়ে শ্রেয়ার সামনে দাঁড়ালো।

–আজকে তোমার বিয়ে ছিল। আজকে তোমার বিয়ে, এই কথাটা আমাকে জানাওনি যে? তুমি কি ভেবেছিলে, আমার আড়ালে তুমি বিয়ে করে নিবে। আর আমি জানতেও পারবো না। আমি তোমার বিয়েটা হতে দিচ্ছি। তাই তোমার বিয়েটা হচ্ছে, পরক্ষনেই ভাবলাম। বেইমানদের এমনিতে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়। এরা আজ আমার সাথে বেইমানি করেছে, কাল অন্যের সাথে করবে না। তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার পরে আর কাউকে ঠকাতে না পারো। আমি তার ব্যবস্থা করে দিয়ে, তারপরে এখানে থেকে যাব। এই কণ্ঠনালী দিয়ে আমাকে কথা দিয়েছিলে, সারাজীবন আমার পাশে থাকবে। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু তুমি কথা রাখোনি। এবার আমি’ও আমার কথা রাখবো না। বলেছিলাম মুখে যাই বলি, শরীরে কখনো আঘাত করবো না। তুমি তোমার কথা রাখনি, ইফাদও তার কথা রাখবে না। কথাটা বলেই পকেট থেকে ছু*রি* বের করল। সবার দৃষ্টি ইফাদ আর শ্রেয়ার দিকে, সবাই হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে, এখানে কি হচ্ছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, ইফাদ শ্রেয়ার গ*লা* কে*টে* দিল। সাথে সাথে শ্রেয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। গ*লা* কা*টা* মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো। সবাই শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে, ইফাদ সবাইকে ভয় দেখায়। কোনো কথা না বলে, বিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। শ্রেয়ার বাবা কয়েকজনকে বলল ইফাদকে অনুসরণ করতে। কয়েকজন লোক ইফাদকে ফলো করতে লাগলো। শ্রেয়ার চক্ষু দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল। নিমিষেই মধ্যে চোখের সামনে সবকিছু আঁধার ঘনিয়ে এলো।

চলবে…..