বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০৭

0
58

#বুক_পিঞ্জরায় (০৭)
ফাতেমা তুজ জোহরা

সাত.

আয়শাকে নিয়ে সাফিয়া একটু রান্নাঘরের দিকে গেলো। আয়শা চাচ্ছিলো সাফিয়ার সাথে আলাদা করে একটু কথা বলতে। মেয়েটাকে এমন এক ছেলের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে, একটু কথাতো বলাই উচিৎ। এদিকে ঘরে মেহের, মাইশা ও রাবাব রয়ে গেলো। রাবাব একবার মেহের ও একবার মাইশার দিকে তাকাচ্ছে। দুবোনই মাশাল্লাহ। তবে ওদের বোরকা পড়া দেখে একটু অস্বস্তি হচ্ছে। বিয়ের আনন্দে সাজগোজের উপর বোরকা কেমন বেমানান লাগছে রাবাবের কাছে। রাবাব একটা আকাশী রঙের গাউন পড়ে মোটামুটি সাজগোজ করেছে। এই সাজ যেন এখন তার কাছে পানসে লাগছে।

মেহের আহামরি কোনো সুন্দরী নয়। তবে এই সাজে তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বিয়ের ফুল ফুটলে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়ে। মেহেরকেও সেইজন্য হয়তো এত আকর্ষণীয় লাগছে। বোরকাটা খুললে হয়তো সৌন্দর্য আরো ঠিকরে পড়বে। রাবাব মেহেরের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। ঘাড় কাত করে মেহেরের চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ভাইয়া এমন একজন মানুষকে রিজেক্ট কেন করলো তা মাথায় আসছে না।”

মাইশা চট করে বলে উঠলো, “জনাবা, আপনার ভাইয়া গর্ধভ না হলে এমনটা করতো না।”

রাবাব মাইশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “গর্ধভ কী ?”

মাইশা এক গাল হেসে বলল, “গর্ধভ হলো গাধা। গাধা না হলে কেউ এমন করে না।”

রাবাব কিঞ্চিৎ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “আমার ভাইয়াকে গাধা বলার তুমি কে ?”

মাইশা জবাব দিতে যাবে এমন সময় মেহের বলল, “চুপ থাকো মাইশা। এভাবে কারো সম্পর্কে বলা উচিত নয়, তাও আবার তার পরিবারের সামনে। মুখে লাগাম লাগাও। এমন যেন না শুনি।”

যদিও মেহের আস্তে করে এই কথাগুলো বলল, তবে ছোট বোনের প্রতি বড়ো বোনের স্নেহের শাসন রাবাবের হৃদয় ছুলো। তারও এখন ইচ্ছা হচ্ছে একটা বড়ো থাকা নিয়ে। একটা বড়ো বোন ছোট বোনের জন্য একজন আদর্শ গাইডলাইন হতে পারে। রাবাবের এই গাইডলাইনের অভাব বোধ করছে। মাইশার প্রতি যেই রাগটা এসেছিল তা আর এখন নেই রাবাবের। চুপ হয়ে গেলো সে-ও। অপরদিকে সাফিয়ার সাথে টুকটাক কথা সারলো আয়শা। তারপর ফিরে এলো মেয়েদের কাছে। আয়শা নিজে বোরকা খুলে মেয়েদেরও বোরকা খুলে ফেলতে বললেন। যেহেতু এঘরে পুরুষ কেউ নেই। আয়শার কথামতো মেহের ও মাইশা বোরকা খুলে ফেলে। জামদানী বেনারসি বেশ ধকলের শাড়ি। ফ্যানের নিচে বসে থেকেও দরদর করে ঘাম ঝড়ে চলেছে। বোরকাটা খুলে কিছুটা শান্তি লাগছে। সাফিয়া মেহেরকে দেখে হেসে পাশে বসলেন। বোকা মেহরাব এমন একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করতে চাইলো না সেটাই মাথায় ধরছে না সাফিয়ার। ধরছে না বললে ভুল হবে। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে বলে একটা কথা আছে। মেহরাবের অবস্থাও এমন। যেসব বন্ধুদের সাথে চলে তারা কোনো ভালো মানের ছেলে নয়। যেকারণে মেহরাবের চিন্তাভাবনাও সেরূপ হয়েছে।

কিছুক্ষণ পরেই রেদোয়ান দরজায় টোকা দিলো। সাফিয়া এগিয়ে গিয়ে মৃদু দরজা খুলে দিলে রেদোয়ান বলল, “কাজী সাহেব বিয়ে পড়াবে। ভেতরে যেতে হবে।”

সাফিয়া রেদোয়ানকে দু মিনিট দাঁড়াতে বলে কাবার্ডের দিকে গেলেন। সেখান থেকে বড় একটা চাদর বের করে বিছানার স্ট্যান্ডের উপর চাদর মেলে দিলেন। তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিলে রেদোয়ান কাজী সাহেবকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আসীরও পিছু পিছু এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। দুহাত তুলে দোয়া করলো সবাই। মেহের স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। হুট করে সম্পর্ক পালটে গেলো। সম্পর্কের নতুন ধাপগুলো কিভাবে শুরু করবে সেই নিয়ে ভাবনায় তলিয়ে আছে মেহের। রাবাব মেহেরের সঙ্গ ছাড়তেই চাইছে না। তার যেন সমস্ত আকর্ষণ এখন মেহেরের দিকে। মনে তার ভিষণ আনন্দ দোলা দিচ্ছে। আজ এত খুশি হবে বলে সে কখনো আশা করেনি।

মেহের ও মেহরাবকে একইসাথে বসানো হলো। এঘরে মুরুব্বীরা এখন কেউ নেই। আছে শুধু মেহের-মেহরাব, রাবাব, মাইশা ও আসীর। মাইশা ইতোমধ্যে মেহেরের হুকুম মতে বোরকা পড়ে ফেলেছে। বোনের সামনের সামনে পর্দাহীন না থাকতে বলেছে মেহের। অতিপ্রয়োজন ছাড়া যাতে কথা না বলে, সেই সম্পর্কেও হুশিয়ারি করে দিয়েছে। এদিকে মেহরাব মেহেরের দিকে তাকাচ্ছেই না। তার যেন বিন্দু ইচ্ছে নেই নতুন বউকে দেখার। সবাই মিষ্টিমুখ করা নিয়ে ব্যস্ত। রাবাব মেহরাবের হাতে কাঁটাচামচ দিয়ে একটা মিষ্টি ধরিয়ে দিয়ে বলল, “মিষ্টি বউকে নিজ হাতে মিষ্টিমুখ করাও ভাইয়া।”

মেহরাব চোখ পাকিয়ে তাকালো রাবাবের দিকে। তাকিয়ে বলল, “তোকে পাকনামি করতে কে বলেছে ? দূরে থাক এখন।”

রাবাব বলল, “তুমি একটা রস-কষহীন কুমির। বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন একটু মিষ্টির মতো রসালো হও।”

মেহরাব মৃদু ঝারি দিয়ে বলল, “যাবি, নাকি ধোলাই করতে হবে তোকে ?”

রাবাব ভেঙচি দিয়ে বলল, “যাচ্ছি যাচ্ছি। বড়ো ভাই না, ছাই। কথায় কথায় ঝারি দেয় শুধু। আমার ভাবির সাথে এভাবে কথা বললে তোমার খবর আছে হু।”

রাবাব চলে গেলো মেহরাবের পাশ হতে। মেহের চুপচাপ সব শুনছিল। ভাই-বোনের খুঁনসুটিতে তার কিছু বলার নেই। মেহরাব হাত থেকে মিষ্টির চামচটা রেখে দিলো সামনের প্লেটে। মেহের না তাকালেও তা বুঝতে পারলো। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। মেহের হাসাহাসির জোড়ালো আওয়াজ পেয়ে সামনের দিকে মাথা তুলে দেখলো মাইশা, আসীর ও রাবাব একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মেহের এমনভাবে আসীরকে ডাকলো যেন মেহের রেগে আছে। মেহেরের ডাকে সবাই চুপ। মেহরাবও তাকালো মেহেরের দিকে।

আসীরকে উদ্দেশ্য করে মেহের বলল, “আসীর, রাবাব তোমার নিজের মায়ের পেটের বোন নয়। সাবধান, এমন হাসি তামাশা যেন দ্বিতীয়বার আর না দেখি। আজই প্রথম, আজই শেষ।”

আসীর আন্দাজ করতে পারলো মেহের কি নিয়ে সাবধান করছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “দুঃখিত আপু, আর হবে না।”

মেহরাব অবাক হলো মেহেরের কাণ্ডে। আসীর ও রাবাব এখন দু’জন সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইন। তারা নিজেরদের মধ্যে দুষ্টুমি হাসিতামাশা করতেই পারে। তাই বলে মেহের এমন কর্কশ গলায় সাবধান করবে ? এটা মেহরাবের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলো। মেহরাব বলে উঠলো, “এটা কেমন ব্যবহার ? ওদের হাসিতামাশার সম্পর্ক। এখানে সাবধান করার কী আছে ?”

মেহের এবার শান্ত কণ্ঠে বলল, “সম্পর্ক কখনো হাসিতামাশার হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা প্রতিটা সম্পর্ক তার নিজস্ব সীমানায় সৌন্দর্য মণ্ডিত করে দিয়েছেন। সীমার বাহিরে কোনো কিছুই সুন্দর নয়।”

মেহরাব বলল, “বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্ক খারাপ কোথায় ?”

মেহের বলল, “আপনার মগজে সমস্যা। খারাপ কোথায় সেটা চোখ দিয়ে কিভাবে দেখবেন ?”

এমন সময় দু পরিবারের মুরুব্বীরা ঘরে প্রবেশ করলেন। আয়শা এসেই দ্রুত পায়ে এগোলেন মেহেরের দিকে। তারপর মেহেরের মাথায় হাত রেখে বললেন, “মেয়ে মানুষের গলার আওয়াজ বেশি হতে নেই। এটা সবসময়ই মনে রাখবে। তোমার বাবার সাথে আমি কেমন ব্যবহার করি তা নিশ্চয়ই দেখেছো। আশা করছি আমার থেকেও তুমি ভালো করে সংসার সামলাতে পারবে।”

মেহের শুধু এতটুকুই বলল, “ইনশাআল্লাহ।”

মাহফুজ রেদোয়ানকে বলল, “আজকে তাহলে আমরা দু বুড়া-বুড়ি বাড়ি ফিরে যাই। মাইশা থাকুক বোনের সাথে। আসীরও ব্যাক করবে। আগামীকাল ফিরা নায়রি করে ফেলো তাহলে। রেদোয়ান কোলাকুলি করলো মাহফুজের সাথে। তারপর বলল, “আমার আরেক মেয়ের যত্ন আশা করছি আমি ভালো করেই রাখবো। চিন্তা করো না বন্ধু।”

রেদোয়ানের সাথে মাহফুজ হাসলো। তারপর মাহফুজ মেহেরের কাছে গিয়ে টুকটাক কথা বলে বিদায় জানালো। সাথে করে খাবার প্যাক করে দিলো সাফিয়া। যাতে বাসায় পৌঁছে আর রান্না করতে না হয়। বেলা অনেকটাই আছে। সবে দুপুর। চাইলে আরো কিছু সময় থাকতে পারতো ওরা। কিন্তু কী ভেবে চলে গেলো তা বোধগম্য নয় মেহেরের। মাইশাকে রাবাব তার ঘরে নিয়ে গেলো। মেহরাবকে নেয়া হলো মেহরাবের ঘরে। দুপুরের আজান হওয়াতে মেহের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহরাব হুইল চেয়ারে করে বাহিরে চলে আসে। নিজের ঘরে অপছন্দের রমনী ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা তার মোটেও ভালো লাগছে না। মেহের জায়নামাজ খুঁজছে। কিন্তু পাবে বলে আশা নেই। এমন সময় সাফিয়া এলেন ঘরে। এসে মেহেরের হাতে এক সেট রেডিমেড থ্রিপিস আর একটা জায়নামাজ তুলে দিলেন। চলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “তুমি আমার আরেক মেয়ে। নিজের মায়ের কাছে যেভাবে যা চাইতে, আমার কাছেও চাইবে। যতদিন বেঁচে আছি, ইনশাআল্লাহ মায়ের অভাব বোধ হতে দেবো না।”
বাক্য দু’টো মেহেরের বেশ ভালো লাগলো। মনে প্রশান্তি জাগালো। সব শাশুড়ীই যদি নিজ মায়ের মতো হোন, তবে শান্তি বিদ্যমান। মেহের দরজা লাগিয়ে দিলো কাপড় পাল্টাতে।

চলবে…

দেরী করার জন্য দুঃখিত।