বেনে বৌ পর্ব-০৩

0
133

#বেনে_বৌ
#পর্ব-৩
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

“এক ছেলে যে বউ খাইলো বড় ছেলেরে দিয়াও সেই মাইয়্যাই আনবি?তোর মনে কি কোনো ডর ভয় নাই আবিদের মা?”

“না নাই।কবিতা আমার ছেলেকে কেন খাবে ভাবী?এটা কেমন কথা? হায়াত শেষ আমার ছেলেকে আল্লাহ নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।এখানে কবিতার কোনো দোষ নেই।”

“স্ত্রীর দোয়ায় বরকত মেলা।তোর বউ কেমনে দোয়া করলো যে স্বামীর প্রাণ বাঁচাইতে পারলো না?”

জায়ের কথা শুনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল আবিদের মা। মৃত্যুর উপর কারোর হাত নেই।এটা বয়স্ক সেকেলে যুগের মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ সে। এমন নয় কবিতা নিজ হাতে স্বামীকে মে’রে ফেলেছে। শাফিন এবং কবিতা লেখাপড়ার সুবাদে শহরে থাকতো। তারা নিজেদের খরচ নিজেরাই জুগিয়েছে। ছুটিতে গ্রামে এসে হুট করে শাফিনের গায়ে জ্বর দেখা দিলো।পেট খারাপ ছিল দিন দুয়েক।কবিতা অস্থির হয়ে উঠলেও শাফিন মাকে বলেছিল,
“মা আসার সময় আমরা পুরি, সমুচা খেয়েছিলাম।এজন্যই বোধ হয় এমন হলো।”

কিন্তু রাত পোহাতে না পোহাতেই শাফিনের অবস্থা বেগতিক হলো।তাকে নিয়ে ছুটলো সদর হাসপাতালে। জরুরী বিভাগে দেখানোর পর দ্রুত ভর্তি করা হলো।পরীক্ষার পর জানা গেল তার ডেঙ্গু হয়েছে এবং প্লাটিলেট কমেছে কয়েক গুণ।কত চেষ্টা, কত মেডিসিন, এই ডাক্তার ওই ডাক্তার, হাসপাতাল বদল কিছুতেই রক্তের প্লাটিলেট উঠলো না।শুশ্রী মুখে মৃত্যুর যন্ত্রণা দুই চোখে দেখতে পারছিল না কেউ।শেষ অবধি তার বাবাকে কেউ বলল কোনো এক হুজুরের পড়া পানি এনে দিতে।সেখানেই ছুটলেন ঝড় বাদলা মাথায় নিয়ে।কোনো কিছুই ফেরাতে পারলো না শাফিনকে।শাফিনের চলে যাওয়ার পর কবিতার জ্ঞান ছিল না তিন দিন।স্বামীর শেষ দেখাটাও তার ভাগ্যে জুটেনি। যেদিন জ্ঞান ফিরলো সেদিন থেকে কারোর সাথে কথা বলেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো আকাশের দিকে।হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে শাফিনের প্রতি ভালোবাসা, যত্ন এবং দায়িত্ব দেখে তাকে কোনো ভাবেই দোষ দিতে পারে না শাফিনের মা। আবিদের জন্য কবিতার থেকে ভালো মেয়ে অবশ্যই সে পাবে। অবিবাহিত, সসম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে পাবে কিন্তু কবিতা অনন্য। অন্যের ঘরে তাকে কোনো ভাবেই যেতে দিবে না। কবিতার অন্যত্র বিয়ে হলে, আবিদ অন্যত্র বিয়ে করলে ওরা কেউ মনে রাখবে না শাফিনকে।কেউ দু মুঠো চাল দান করবে না মৃত সন্তানটার জন্য। তবে কবিতা এ বাড়িতে থাকলে শাফিন কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকবে তাদের মাঝে।হয়তো সে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কিন্তু এই ভুল সিদ্ধান্তটা সে নিতে চায়। সমাজের বিরুদ্ধে, পরিবারের বিরুদ্ধে।

পুকুর পাড়ের পানিতে পা ডুবিয়ে শাফিনের সাথে কাটানো বিভিন্ন মুহুর্তের কথা মনে করছিল কবিতা।তাদের প্রথম প্রথম সংসার সাজানো, ইচ্ছে করে একটা প্লেট, একটা বালিশ কিনে আনার ঘটনা কিংবা শুরুর দিকে কেবল ভর্তা ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা।কবিতা তরকারি রান্নাটা তেমন পারতো না। প্রথম কয়েক দিন বাইরে থেকে খাবার কিনে আনলেও পরবর্তীতে কবিতার ফুড পয়জনিং হয়। কবিতার ভাইয়েরা দেখতে এসে শাফিন নয় কবিতার উপর ভীষণ রাগ করেছিল। সেদিন বোনের জন্য ফ্রিজ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনায় আরেক দফায় কথা কাটাকাটি হয় দুই পরিবারের। শাফিন নারাজ জিনিসপত্র নিতে, অপর দিকে কবিতার ভাইদের একটাই কথা,” তোমরা বিয়েটা নিজেরা নিজেরা করেছো।আমরা বিয়েতে অনুষ্ঠানে যে টাকা খরচ করতাম অন্তত সেটা দিয়ে তোমাদের উপহার দিতে দাও।”

অবশেষে অনেক বোঝানোর পর শাফিনকে রাজী করানো হয়।বিষয়টা শাফিনের বেশ খারাপ লেগেছিল।পরের মাসে টিউশনির বেতন পেয়ে সে পুরোটা কবিতার হাতে দিয়ে বলেছিল,
“আমি চেয়েছিলাম আমরা টুকটাক টাকা জমিয়ে জিনিসপত্র কিনবো।কিন্তু তুমি এসবে অভ্যস্ত।”

“তাতে কি?আমরা টাকা জমিয়ে আবার নতুন করে কিনবো না হলে ভাইদের বিয়েতে ঠিক এসব উপহার দিয়ে শোধ করে দিবো।”

আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হয়েছিল তার।তারা ঠিক এই ভাবেই গুছিয়ে নিয়েছিল।সব হলেও বালিশ একটা থেকে দুটো হতে দেয়নি ছেলেটা। তাদের মাঝে যতো মনোমালিন্য হোক না কেন রাতে সব মিটে যেত। স্মৃতি কতোই না সুন্দর স্মৃতি জমিয়ে রেখেছে কবিতা।

“ক্যান আই কল ইউ?”

ফোনে টুংটাং করা আসা ম্যাসেজের নোটিফিকেশন দেখে কবিতা ফোন হাতে নিলো।আবিদের ম্যাসেজ এসেছে। তার নাম্বারটা সেভ করা হয়নি। কাকতালীয় ভাবে কোনো দিন তাকে দেখেওনি কবিতা।সবসময় শাফিনের সাথে কথা হতো তার।ভিডিও কলে কথা বলতে বললে কবিতা বরাবর বলতো,
“তুমি ছাড়া কেউ আমাকে এতোটা কাছ থেকে কেন দেখবে শাফিন?আমার ভালো লাগে না।প্লিজ জোড় করো না।”

অথচ নিয়তির বিধানে আজ তার সাথে কথা বলতে হচ্ছে।নেট অন করে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলো।আবিদ অডিও কল রিসিভ করার পূর্বে দাম্ভিকতার সাথে হেসে তার বন্ধুকে বলল,
“ও জানিস কে?ও হচ্ছে আমার সকল সমস্যার মূল।ওকে বিয়ে না করলে আমার মা আমাকে ত্যাগ করবে।ওর জন্য আমি আমার চার বছরের ভালোবাসাকে ত্যাগ করছি।সুন্দর না বিষয়টা?”

কলটা কেটে গেছে। আবিদ এপাশ থেকে নিজে কল ব্যাক করলো।কল রিসিভ করে কবিতা নিশ্চুপ হয়ে আছে।আবিদ নিজ থেকে বলল,

“কয়েকটা শাড়ির ছবি পাঠাচ্ছি কবিতা।পছন্দ করে বলুন আপনার কোনটা চাই।”

“শাড়ি কেন?”

“নতুন বৌকে বিয়েতে শাড়ি দিবো না?”

“আমি শাফিন ছাড়া অন্য কারোর জন্য কখনো সাজিনি।এটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন?বিয়েটা চুক্তি মাত্র।আমাকে আমার কোনো বিষয়ে আপনি জোর করতে পারবেন না।”

“আপনার দ্বিতীয় বিয়ে হলেও আমার প্রথম বিয়ে কবিতা।আমি চাই আমার বিয়ের দিন আমার বউ লাল টুকটুকে শাড়ি পরবে।হোক সেই বিয়েটা চুক্তির সহিত।”

“আমি বাধ্যগত নই?”

“সময় বলে দিবে।শাড়ি কোনটা পছন্দ জানাবেন।আগামীকাল বা পরশু পৌঁছে যাবে। পছন্দ জানাতে সংকোচ করবেন না।”

রাগে ক্ষোভে কল কেটে দিলো কবিতা। সে শাড়ির ছবি না দেখেই ম্যাসেজ করলো তার সবগুলো পছন্দ।সে ভেবেছিক আবিদ কথা বাড়াবে কিন্তু রিপ্লাই এলো “ঠিক আছে।”

সমস্যার সমাধান হতে দেখে স্থির হলো কবিতা।অন্তত শাড়ি আসবে না অপর দিকে আবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে আমি এতোটা যন্ত্রণা দিবো যে আপনি আমায় ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে কবিতা।”

চলবে