বেনে বৌ পর্ব-০২

0
169

#বেনে_বৌ
#পর্ব- ২
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

“জামাই ম’রলে জামাই পাওয়া যায় কিন্তু পোলা ম’রলে পোলা পাওয়া যায় না।পোলার বউ বিয়া বইবো জামাই পাবো।মায়ের বুক যে খালি হবো সেই বুক খালি কি দিয়া ভরবো?”

পান খেতে খেতে কয়েক জন বয়স্ক মহিলা এসব আলোচনায় ব্যস্ত।তাদের চোখে কবিতার জন্য এতো দিন বেশ দয়া মায়া ছিল।তার শোকে তারাও দুই ফোঁটা পানি ফেলতে দ্বিধাবোধ করেনি।আহারে মেয়ের কি কষ্ট! এতো অল্প বয়সে গায়ে সাদা থান উঠলো?অথচ আজ নতুন করে সব শুরুর গল্পে তারাই যেন খল চরিত্র। তারা কোনো ভাবেই অবিবাহিত ছেলের সাথে কবিতার বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না।সেদিকে কোনো গ্রাহ্য নেই কবিতার পরিবারের। দিন কয়েক পূর্বে যখন তার বিয়ের কথাও চলছিল না সেই সময়ের কথা।তার ভাই কবির শহর থেকে ফেরার সময় বোনের জন্য নিয়ে এসেছিল লাল রঙের একটা থ্রি পিস।লাল রঙ বরাবর কবিতার বেশ পছন্দের। কবির কোথাও শুনেছিল নতুন কাপড় দেখলে মেয়েদের মন ভালো হয়, তারা খুশি হয়। তাই আগ পিছ না ভেবে বোনের জন্য লাল রঙের থ্রি-পিস কিনে এনেছিল। কবিতার হাতে দেওয়ার পর সে থ্রিপিসের ওড়নায় হাত রেখে বলেছিল,
“আমি বিধবা মানুষ ভাই।এসবে কি আমাকে মানায়?লোকে নানান কথা বলবে।”
“লোকের কথায় কি হয়েছে কবে?”
“লোকের কথাতেই সব হয়। লোকের কথাতে সমাজ চলে।”
“লোকের কথার ধার আমরা কখনো ধারিনি। আমরা নিজেদের খুশির কথা ভেবে চলেছি।হোক সেটা সাফিনের সাথে তোর বিয়ের কথাই।তখনো লোকে কম কথা বলেনি।আমরা কি শুনেছিলাম?আমরা তোর খুশিটা দেখেছি।”

কবিতা ক্ষীণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখপানে তাকিয়ে থাকে।চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে তার। শাফিনের কথায় ক্ষত ঘা’য়ে পুনরায় আঘাত লাগলো।মানুষটার দেহও যে পঁচে গেছে।মাটিতে মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।মৃত্যু কেন এত যন্ত্রণার হয়?যে মরে যায় সে এক দিকে বেঁচে যায়, ইহজাগতিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি হয় তার কিন্তু যাদের পিছনে ফেলে যায়, তাদের যন্ত্রণায় শেষ কোথায়? চলে যাওয়া মানুষকে এক পলক দেখার জন্য মনের আহাজারি কিংবা না দেখতে পাওয়ার দমবন্ধকর কষ্টের অনুভূতি সবার হয় না।কবিতার হয়, ভীষণ ভাবে হয়।সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যে মানুষটার মুখ দেখা হয়, হুট করেই একটা দিনের পর আর সেই মুখ দেখতে না পাওয়া কিংবা রাত হলে একই বালিশে মাথা রেখে, গায়ের উপর হাত রেখে ঘুমানোর অভ্যেসে যখন টান পড়ে তখন রাতের ঘুমটা উবে যাওয়ার ব্যাপারটা সবাই বুঝে না।বিচ্ছেদের এই সময়ে হারানোর যন্ত্রণাটা তারাই বুঝে যারা কখনো ভালোবেসেছিল।

পরদিন মায়ের সাথে পাশের বাড়িতে দর্জির কাছে কাপড় দিয়ে ফিরে আসার সময় গ্রামের কয়েকজনের টিপ্পনির শিকার হয় কবিতা।হাতের চুড়ি,নাকের ফুল পরা নিয়েও কতো কথা।সবার বেশ মায়া হয়েছিল সাফিনের মায়ের জন্য।ভদ্রমহিলা ছেলে হারিয়েছে আর কবিতা হারিয়েছে স্বামী।আবার বিয়ে হলেই তো পাবে।কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল কবিতা।তার বাবা দীর্ঘদিন মেয়ের মুখের দিকে তাকায়নি।একটা মাত্র ভয়ে।তাকিয়ে যদি দেখতে পায় মেয়েটা কাঁদছে,তার দুই চোখে পানি তাহলে সইবে কি করে?যুবতী মেয়ে বিধবা হয়েছে এরথেকে কঠিন সত্য পৃথিবীতে আর কিছুই নেই তার জন্য।মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটা কাঁদছে।ঠিক সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মেয়ের তিনি আবার বিয়ে দিবেন। অন্তত সমাজের মানুষের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য হলেও দিবেন।

লাল রঙা থ্রি- পিসটা আজ হাতে পেয়েছে কবিতা।ইতিমধ্যে তার বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে।আগামী শনিবার ফোনেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাকতালীয় ভাবে তার প্রথম বিয়েটাও হয়েছিল ফোনেই।পরবর্তীতে কোর্টে রেজিষ্ট্রেশন হয়।কারণ শাফিনের বয়স কাগজে কলমে ভুল ছিল। লাল রঙা থ্রি পিসটা পরে কেবল বসেছিল ওমনি ফোনে কল এলো।শাশুড়ি মায়ের নাম্বার দেখে দ্রুত কল রিসিভ করলো।

“কবিতা
” জি মা।”
“আবিদের সাথে কথা হলো?”
“হুম।”
“তুই তো কোনো দিন ওকে দেখলিই না মা।আমার ছেলেটাকে একটা বার দেখে নে।”
“তার প্রয়োজন নেই মা।আমার জন্য শাফিন নিজেই যথেষ্ট।”
“আবিদ নেটেই আছে।আমি গ্রুপে ভিডিও কল দিচ্ছি। এক মিনিট দাঁড়া।”

হৃদকম্পন কয়েকগুণ বেড়ে গেল কবিতার। তার দুই পায়েও যেন বল নেই।বিছানার একটা পাশ থেকে ওড়না তুলে নিয়ে মাথায় দিলো।ভিডিও কলে আবিদ এবং তার মা’কে দেখা যাচ্ছে।আবিদের দিকে তাকায়নি সে। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল।কল রিসিভ করার পূর্বে কবির যাচ্ছিলো দরজার সামনে দিয়ে। তাকে ডেকে এক মিনিটের মাঝে সবটা বলেছিল কবিতা।ভাইকে অনুরোধ করেছিল তার পাশে থাকতে।কবির বুঝতে পেরেছিল বোনের অস্বস্তি। তাই নিজ থেকে কথা বলল আবিদের সাথে।তাকে দেখা যাচ্ছে কোনো ক্যাফেতে বসে আছে। কবিতা সেই যে দৃষ্টি নামিয়েছে আর তুলেনি।টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো তার হাতে। দৃষ্টি এড়ালো না তার শাশুড়ি কিংবা আবিদের।আবিদ তবুও কিছু বলল না।সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে কল কেটে দিলো। কবির খেয়াল করেছিল আবিদের সাথে কবিতা ভালো মন্দ কোনো কথা বলেনি। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো জোর নেই ছোট্টবু। তুই রাজি না থাকলে আমাকে বল।আমি সব বন্ধ করে দিবো।প্রয়োজনে বাবার পায়ে ধরবো।তুই কি রাজি?তোকে কি বাবা বা বড় ভাই জোর করতেছে?”
“না ভাই। আমি রাজি, তোমরা প্রস্তুতি নিতে থাকো।”

নিজ রুমে ফিরে পড়ায় মন বসাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আবিদের।তার মানসপটে ভেসে উঠছে মানবী লাল পদ্মের ছবি।যেখানে জমে আছে কয়েক বিন্দু জল।হুট করেই গরম লাগছে তার। কোনো কিছু না ভেবেই কল দিলো তাকে।

“কবিতা, এটা আমাদের চুক্তির বিয়ে তবে কেন আপনি তখন কাঁদলেন?”
“আমার কান্নায় আপনার কি আসে যায়?”
“আপনি আমার দিকে তাকাতে ভয় পেয়েছিলেন?”
“আমি যেই দৃষ্টিতে শাফিনকে দেখতাম সেই দৃষ্টিতে আপনাকে কি করে দেখবো?”
“আপনি ভুলে কেন যাচ্ছেন এটা চুক্তির বিয়ে?”

কবিতা থমকালো।সত্যি তো, সে কেন ভুলে যাচ্ছে এটা চুক্তির বিয়ে।এখানে শাফিনের জায়গায় আবিদ আসার কোনো সম্ভাবনাই তো নেই।

চলবে