বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-১৬+১৭

0
380

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬

চোখে পানির বাঁধ মানছে না সায়রার। এই ভরা অনুষ্ঠানে কাঁদতেও পারছে না ঠিকঠাক করে। গলায় কান্না আঁটকে আসছে বার বার। কান্না আটকাতে গিয়ে চোখমুখের রঙ তার পাল্টে গেছে। ও ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে একটু একটু করে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দিতা। ওর চোখমুখ শুষ্ক! সায়রাকে দেখে মনে হয় সে নাটক করছে। মেয়েটার কষ্ট বুঝে তার খারাপ লাগছে। তবুও সে পারবে না তার ভাইয়ের সাথে ঐশানীর সম্পর্ক ভাঙতে। অবশ্য অনিন্দিতারও ধারণা ছিল না অভয় তাকে এবং সায়রাকে এতো বড় চমক দেবে। এজন্য যদি সে স্বার্থপর প্রমাণিত হয় হক।

লাইটিং, জাঁকজমকপূর্ণ জায়গাটি ছেড়ে বড় সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ায় সায়রা। আকাশের রঙ ঘন কালো। অনেক তাঁরা ঝিকিমিকি আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে অন্ধকার আকাশকে। আর আকাশে সেই সুন্দর চাঁদ সেটা তো আকাশকে আরো আলোকিত করেছে। কিন্তু সায়রার জীবনকে আলোকিত করার চাঁদ টা নেই। হারিয়ে ফেলেছে সে চিরতরে। আজ সে দেখেছে অভয় কতটা সুখি আছে ঐশানীর সাথে। ঐশানীকে সামান্য অপমান করায় যদি অভয়ের গায়ে লাগে আর তার স্ত্রী এর বদলে যদি সে জবাব দেয় অপমানের এটাকে ভালোবাসার প্রকাশ ছাড়া কি বলা যেতে পারে? সায়রা ওদের দুজনকে হাসতে দেখেছে। তার মানে ওরা দুজনেই সুখি। আড়াল থেকে দেখেই সে বেরিয়ে আসে। এখন হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে সে। খানিকক্ষণ পর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ওড়না ঠিক করে হাঁটা শুরু করল সামনের মেইন রাস্তার দিকে।

চোখ বুলিয়েও আড়ালে থাকা একজনকে চোখে পড়েনি সায়রার। সে হলো ইশান। গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে ব্যস্ত ছিল সে। অনিন্দিতা তাকে বাইরে বের করে দিয়েছে সিগারেট খাওয়ার জন্য। অনুষ্ঠানে নাকি সিগারেট এলাও না। গাছে ঠেস লাগিয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় দুটো সিগারেট শেষ করে তিন নম্বর সিগারেট ধরাতেই কারো হেঁচকি তোলা কান্নার আওয়াজ শুনে গাছের আড়াল থেকে ঘাড় কাঁত করে তাকায় সে। বেশ কিছুক্ষণ আগে ধাক্কা খাওয়া অত্যাধিক সুন্দরী মেয়েটিকে চিনতে তার খুব একটা ভুল হয় না। বিড়বিড় করে সে নিজেকে বলে….

–“ইশান, সিগারেট খেলেও নেশা চড়ে নাকি? উল্টাপাল্টা মেয়েদের দেখিস কেন? মেয়েটা তোর কি খুব বেশি পছন্দ হয়েছে নাকি?”
চোখটা ডলে ভালো করে তাকায় ইশান। সিউর হয় সে ভুল দেখছে না। মেয়েটা কাঁদছে। ইশান চোখ ছোট করে তাকায়। কাঁদার কোনো কারণ সে আন্দাজ করতে পারে না। মেয়েটাকে চলে যেতে দেখেই হাতের সিগারেট টা নিচে ফেলে দিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সায়রার পিছু নেয়।

সায়রা টলমল করে হাঁটছে। তার তিন হাত দূরেই হাঁটছে ইশান। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে সায়রার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে সে। সায়রা শোকে এতোটাই কাতর যে ওর খেয়ালেই নেই পাশেও কেউ রয়েছে। ইশান কি বলে কথা বলবে তা বুঝতে পারে না।
–“হেই মিস. সায়রা! কাঁদছেন কেন? অনুষ্ঠানে কি বিরিয়ানি খেতে পাননি?”
চমকে হাঁটা থামিয়ে পাশে তাকায় সায়রা। তার চমকটা কেন সে নিজেও জানে না। ইশানের পাশে হাঁটার জন্য নাকি এমন উদ্ভট কথার জন্য?
–“কে আপনি?”

–“আমাকে চিনলেন না? ওইযে বাংলোতে ঢুকতে ধাক্কা খেলেন। আমি কে তুমি নন্দিনী গানের দুটো লাইন গাইলাম!”
–“আপনার কি মনে হয় আমি ওখানে বিরিয়ানি খেতে গেছি?”
কান্নার মাঝে রাগ নিয়ে বলে সায়রা। ইশান হেঁসে উঠে বলে…..
–“আর কি বলব? এমন অনুষ্ঠানে কেউ কাঁদে তা শুনিনি। তাই বললাম। আপনি অভয়ের কোনো আত্মীয় হন?”
–“কেউ হই না আমি অভয়ের।”
কথাটা আরো দ্বিগুন রাগ নিয়ে বলে সায়রা। ইশান ঘটনার কিছুই বোঝে না।

–“প্লিজ আমার সাথে আর কোনো কথা বলবেন। আমি কোনো কথা বলতে রাজি নই। আর আমার পিছুও আসবেন না। বুঝতে পেরেছেন?”
সায়রা কাঠকাঠ গলায় কথাগুলো বলে হাঁটা ধরল। ইশান ঠোঁটজোড়া সরু করে সায়রার রাগ আর দুঃখের কারণ খুঁজেও পেলো না। কপাল কুঁচকে সায়রার হাঁটার দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থেকে বলল…..
–“অনুষ্ঠানে ঢুকল এমন ভাবে যেন ঐশানী ভাবির সতিন। আবার বের হলো এমন ভাবে যেন অভয় তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে হৃদয় একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কাঁচের মতো! আসলে ব্যাপার টা কি?”

রাতটা বেশ গভীর হয়েছে। ঐশানীর পরিবার ঐশানী আর অভয়কে নিতে এসেছে। সবার সাথে পরিচয় হয়ে কথাবার্তা বলে, খেয়েদেয়ে দুজনকে নিয়ে আবারও বাড়ির দিকে রওনা দেয় ঐশানীর পরিবার। গাড়িতে ঐশানীর পাশে বসেছে ঐশী। অন্যপাশে রয়েছে অভয়। অভয় একমনে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইমতিয়াজ সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে টুকটাক। মাঝেমধ্যে কিছু বলার জন্য উসখুস করছে ঐশী। ঐশানী স্ট্রেইট হয়ে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তার ডান পাশে অভয় বসেছে। অভয়ের পাশাপাশি বসার সুযোগ হলেও অভয়ের এতোটা কাছাকাছি বসেনি কখনো। গাড়িতে যখন ঝাঁকুনি হচ্ছে তখন ঐশানীর শরীর দুলছে। মাঝেমধ্যে না চাইতেও দুজন দুজনকে স্পর্শ করে ফেলছে। দুজনই দুজনের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন ভূত দেখছে।

ঐশীর উসখুস দেখে তাকে অন্যদিকে চাপা মেরে চোখ গরম করে বলে…..
–“আগের জন্মে ব্যাঙ ছিলি নাকি? গাড়িতে বসে লাফালাফি করছিস কেন? এমনি এদিকে আমার নিশ্বাস আঁটকে যাচ্ছে আর তুই নড়াচড়া করছিস! চুপচাপ বস।”
–“গাড়িতে তো যথেষ্ট অক্সিজেন আছে আপু। তোর নিশ্বাস আঁটকে আসছে কেন?”
ঐশানী ঐশীর দিকে এগিয়ে গিয়ে অভয়কে বাঁকা চোখে দেখে কানে কানে বলে….
–“ওইযে আমার পাশে বসেছে না? আমার মনে হয় হয় এই শ্যামলা ঘোড়া আমার ভাগের অক্সিজেন নিয়ে নিচ্ছে।”

–“তুই আমাকে অযথায় ব্যাঙের বংশধর বললি আপু। আমি তোকে ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন করার জন্য ভেতরের হার্ট টা ধুকপুক ধুকপুক করছিল। আর তুই কি-না আমাকে ইনসাল্ট করলি?”
ঐশানী ঠোঁট বাঁকিয়ে চুমুর মতো করে ঐশীকে বলে…..
–“আমার মতো জ্ঞানী ব্যক্তির থেকে কি ইন্টারেস্টিং প্রশ্নের উত্তর চাস তুই বলে ফেল।”
–“বলব?”
–“তো বলবি না?”
ঐশানীর আরো পাশ ঘেঁষে বসে ঐশী। মুখটা কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ধীরে বলে ওঠে…..
–“বাসর রাতে কোনো ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে? দুজন দুজনের কাছে এসেছিস?”

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ঐশানী। বাসর রাতের কথা মনে করতেই মনে পড়ে ঝগড়ার কথা আর শেষমেশ যার সাথে ঝগড়াটা হলো তার ওপরই বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ার কথাটা। ভাবনার ঘোর কাটতেই সে খেয়াল করল অভয় কাশতে শুরু করেছে। এমন ভাবে কাশছে যেন সে বিষম খেয়েছে। অবশ্য এটা বিষমের থেকে কম বড় কিছু নয়। অভয় ঐশানীর পাশেই বসে থাকায় ঐশী যতই ধীরে কথা বলুক না কেন সবই ওর কানে এসেছে। ফলে কথাগুলো শুনে বিষম খেয়ে বসে অভয়। কাশতে কাশতে বেহাল অবস্থা হয়ে যায় তার। পেছন থেকে অনিন্দিতা এগিয়ে দেয় পানির বোতল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাকে নিয়ে।

পানি খেয়ে শান্ত হয়ে বসে অন্যদিকে তাকায় সে। তার গালে আলতো গোলাপি ছোঁয়া। তা হয়ত দেখা যাচ্ছে না। হয়ত রাগে নয়ত লজ্জায়। ঐশী ঐশানীর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে…….
–“এই বল না। কোনো স্পেশাল কিছু হয়েছে?”
–“যদি গাড়িতে না থাকতাম তোর গলা চেপে ধরে মুখের জবান বন্ধ করে দিতাম। তাছাড়া তোকে বলিনি আমি? যে উনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন? এই তোর লজ্জা করে না? দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস। চরম বেয়াদব!”
ঐশী ঠোঁট উল্টে বলে…..
–“কিছুই হয়নি?”
–“না।”
–“কোথায় ভেবেছিলাম ইন্টারেস্টিং কথাবার্তা শুনব! ধুর!”

বিরক্ত হয়ে ঐশানীকে ধাক্কা দিয়ে বসে ঐশী। ঐশানী জায়গা না পেয়ে অভয়ের ওপরেই গিয়ে পড়ে অভয়ের দুহাত খামচে ধরে সিটের নিচে পড়া থেকে বাঁচতে গিয়ে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে আরো সবটা যেন উলোটপালোট হয়ে যায়। অভয় অপ্রস্তুত হয়ে অন্যহাত দিয়ে ঐশানীর ঘাড়ের একটু নিচে হাত দিয়ে চেপে ধরে। ঘটনা ঘটিয়ে নিজেই বোকা বনে যায় ঐশী। মুখ চেপে ধরে বসে থাকে সে। অনিন্দিতা তিনজনের কান্ড দেখে মৃদু আওয়াজে হাসতে শুরু করে।

যখন দুজনের মাঝে দূরত্বটা পাঁচিল তুলে ফেলে তখন হুট করেই ভাগ্যক্রমে যদি দুজন দুজনের কাছে এসে পড়ে তবে তাদের শরীরের প্রতিটা রগ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অচল হয়ে পড়ে।
ঐশানী আর অভয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। তারা অচল হয়ে পড়েছে। ঐশানী না পারছে উঠতে আর অভয় ঐশানীকে না পারছে সরাতে। দুজন দুজনের চোখে তাকিয়ে নির্বাক! তারা হয়ত নিজেদের নামে লিখা কোনো ভাষা খুঁজতে ব্যস্ত। অভয়ের মস্তিষ্ক তো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঐশী অনেকক্ষণ কিছু একটা ভেবে একটু এগিয়ে এসে ভয়ে ভয়ে বলে…..
–“আপু উঠতে পারছিস না? সারা রাস্তা এভাবে যাবি? ইয়ে মানে সামনে বড়রা বসেছে তো তাই বলছিলাম।”

ঐশানী ও অভয় হকচকিয়ে উঠে দুজন দুদিকে ছিটকে আসে। দুজনের ঘন ও গাঢ় শ্বাস পড়তে থাকে। আঁড়চোখে দুজন দুজনকে আবারও দেখে। ঐশানী চোখ সরিয়ে ঐশীর দিকে কটমট করে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে…..
–“তোর পেনসিল মার্কা প্রেমিক কে ঝড়ের দিনে হাওয়ায় ওর সঙ্গে তোকেও উড়িয়ে দেব। আর জায়গা পাসনি? সরাসরি উনার দিকে ফেলে দিলি?”
–“সরি। আমি বুঝতে পারিনি তো। আমার প্রেমিকের সাথে হাওয়ায় ভাসতে আমার কোনো সমস্যা নেই।” (লজ্জাবোধ করে)
ঐশানী ফুঁসে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। আর সামান্য রাস্তায় বাকি!

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। নতুন জামাই আর মেয়ে আসায় আড্ডার আসর জমেছিল আজ। একটু আগেই যে যার মনে ঘুমোতে চলে গেল। অভয় আর ঐশানীও রুমে চলে আসে। দুজন পরে বিপাকে। গলা খাঁকারি দিয়ে অভয় বলে…..
–“আজকেও কি গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে চাও?”
ঐশানী নিজের বালিশগুলো কোলে তুলে বলে…..
–“যেচে পড়ে আর বিপদ বাড়াবো না। তাছাড়াও এবার গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করলে রুম থেকে আমার মা আমাকেই বের করবে।”
–“তাহলে দুজন একসাথে একই খাটে ঘুমায়?”
অভয়ের প্রস্তাব শুনে ঐশানী বেডের দিকে তাকায়। তার বেড টা অনেকটাই বড়। কোনো উপায় না পেয়ে সে মাথা নাড়ায়। তারপর হুট করে বলে….
–“আপনার সায়রা কিছু মনে করবে না তো?”

–“জানি না।”
বলেই স্যান্ডেল খুলে শুয়ে পড়ে একধারে অভয়। ঐশানীও অন্যধারে শুয়ে পড়ে। মাঝখানে রাখে বড় বালিশ। দুজন একেবারেই ধারে শুয়েছে। যেন দুজন দুজনের স্পর্শ পেলে মহাপাপ হয়ে যাবে। ঐশানীর হার্টবিট বেড়েই চলেছে এতোটুকুতেই। তার পাশেই কিনা একজন পুরুষ শুয়ে আছে যে তার হয়েও তার নয়। সেকারণেই হয়ত ভয়টা বেশি। অশান্ত মনকে শান্ত করতে করতে একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসে ঐশানীর।

অভয়ের যখন ঘুম ভাঙে কাগজের খসখস আওয়াজে। দিনের গাঢ় আলোয় চোখমুখ কুঁচকে তাকায় সে। কাগজের আওয়াজ কোত্থেকে আসছে তা জানার জন্য চোখটা ভালো করে মেলানোর চেষ্টা করতেই সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঐশানীর মুখটা। তার মানে ঐশানীও উঠে পড়েছে। কিন্তু কি করছে ও? দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো ফাইল ঘাঁটছে। সবটা আর স্পষ্ট হতেই উঠে বসে সে। আচমকা অভয়কে জাগ্রত অবস্থায় যেন আশা করেনি ঐশানী। হাতের ফাইলটা দ্রুত পেছনে লুকিয়ে ফেলে। অভয়ের দিকে ভয়াতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। অভয় এমন দৃষ্টির কারণ খুঁজে পায় না। তার মনে হলো ঐশানী তার কাছ থেকে ফাইলটা লুকাতে চায়।

–“এভাবে আমাকে দেখে ফাইল লুকিয়ে নিলে কেন? কি আছে ওই ফাইলে?”
–“আপনার সম্পত্তি আপনার থেকে কেঁড়ে নিলাম তার ফাইল।”
জড়ো হাসি দিয়ে বলে ঐশানী। তার কম্পন তোলা কন্ঠস্বর বলে দিচ্ছে ঐশানী সব এড়িয়ে যাচ্ছে। অভয় উঠে দাঁড়ায়। ঐশানীর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নেওয়ার চেষ্টা করতেই ঐশানী তার কাছের আলমারির দরজা খুলে তা ঢুকিয়ে দেয়। গম্ভীর গলায় বলে…..
–“আপনাকে এতোসব দেখতে হবে না। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

বিষয়টা পুরোপুরি এড়িয়ে গেল অভয়। নিজেকে অভয়ের প্রশ্ন থেকে বাঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। অভয় আর ঘাঁটায় না তাকে। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে আসে। অনেকক্ষণ ধরে ফ্রেশ হবার পরেও মনে একটা প্রশ্ন বার বার আসে। কি এমন বিষয় আছে ঐশানীর মাঝে যা ঐশানী একেবারেই তার থেকে বিষয়টা লুকাতে পালিয়ে গেল? অভয়ের মন খচখচ করতে থাকে। সে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। নিজের মুখটা মুছে আবারও তাকায় আলমারির দিকে। ঐশানী আলমারিটা বন্ধ করেনি। অভয় সেই ভেবে আলমারি খোলে। সে প্রশ্ন নিয়ে থাকতে পারবে না। সে চায় ঐশানীকে জানতে। তার ইচ্ছে করে ঐশানীর সবটা জানতে। এটা তার আগ্রহ নাকি অন্যকিছু সেটা জানে না সে। তবে ওকে গভীরভাবে জানতে ইচ্ছে করে।

আলমারি খুলে একটা জামার ভাঁজে ফাইলটা দেখা যায়। অভয় ফাইলটা বের করে নিয়ে আসে। ফাইলের কভার দেখে মনে হচ্ছে কোনো হসপিটালের ফাইল। অভয় ফাইলের প্রথম পেজ খোলে। একটুখানি চোখ বুলিয়ে নিতেই ঝড়ের গতিতে এসে সেটা কেঁড়ে নেয় ঐশানী। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় অভয়ের দিকে।
–“কি করছিলেন আপনি?”
ঐশানীর কন্ঠে স্পষ্ট রাগ! অভয় বলে…..
–“আমি ওই ফাইলটা…..”
–“আপনি বোঝেন না নাকি? আমার পারসোনাল জিনিসে আপনাকে কে হাত দিতে বলেছে? আমি তো আপনার পারসোনাল কোনো কিছুতে হাত দিইনি। আপনি কেন আমার এই ফাইলের ওপর আগ্রহ দেখাচ্ছেন?”

অভয় বিস্ময়ের চোখে তাকায়। ঐশানীর এমন আচরণ তার অজানা। এভাবে ঐশানী কখনো কথা বলেনি তার সাথে। অভয় থমকায়। সে অপমানিত বোধ করে। আর কোনোরকম শব্দ না করে হনহন করে স্থান ত্যাগ করে।

চলবে……

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

রান্নাঘরে শাড়ির আঁচল নিজের কোমড়ে বেঁধে মালাই চা বানাতে এসেছে ঐশানী। বিষয়টা তার কাছে বিরক্তিকর! কারণ মিসেস. দিশা তাকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। বিয়ের পর সব কাজ না করলেও টুকটাক কাজ তো জানতেই হবে। এটা হচ্ছে মিসেস. দিশার মক্তব্য। বিয়ের আগে যেই ঐশানী রান্নাঘরে উঁকি পর্যন্ত দেয়নি সেই ঐশানীকে এখন রান্নাঘরে পাঠিয়েছে তার মা। এটা মানতে পারছে না সে। চুলোয় আগুন ধরিয়ে চুলোর ওপরে পাত্র বসিয়ে দেয় ঐশানী। বিড়বিড় করে বলে ওঠে…..
–“আমার মা টাও পাল্টে গেল। এখন জামাই জামাই করছে। এই বিরক্তিকর শ্যামলা ঘোড়ার মধ্যে সবাই কি পায় আল্লাহ মালুম। এখন কিনা চা বানাতে হচ্ছে আমাকে তাও ওই লোকটার জন্য!”

–“বলছিলাম না? জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে বিয়ের পরে? শুনিস নাই তোর এই সত্যিকারের বান্ধবীর কথা।”
কিছু চেনা কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায় ঐশানী। আবারও যেন কতদিন পর নিজের বান্ধবীদের সাক্ষাৎ পেয়ে মনটা নেচে ওঠে ঐশানীর। দিয়ার পাশে রিনি দিয়ার মাথায় টোকা দিয়ে ঝাড়ি মেরে বলে….
–“চুপ কর তো! তা ঐশানী দোস্ত কেমন আছিস? বিয়ের পর কেমন চলছে সব?”
–“সব তো ঠিকঠাকই চলছে। শুধু ওই বাড়িতে দুটো জিনিস বিরক্তিকর! প্রথমটা ওই শ্যামলা ঘোড়া আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে এইযে প্রতিদিন শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে থাকা। দুটোই অসহ্যকর।”

বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে ঐশানী। মেঘনা চোখ বড় করে পাকিয়ে বলে…..
–“বলিস কি? বাসর রাত কাটাবার পরেও তোরা দুজন নিরামিষ আর দুই প্রান্তের দুটো জীবই রয়ে গেলি? এক হয়ে যাওয়ার চান্স ছিল কাজে লাগালি না? তোর জন্য আফসোস হয় রে ঐশু!”
বান্ধবীদের লাগামহীন কথাবার্তায় রাজ্যের লজ্জা আর রাগ এসে ভর করে ঐশানীর ওপর। হাতে খুন্তি দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলে…..
–“নিরামিষ কাকে বললি রে তুই? আমার মতো আমিষ আর দুনিয়াতে একটাও পাবি না। যদি সঠিক লোক আই মিন ভালো কোনো লোকের সাথে বিয়েটা হতো বুঝিয়ে দিতাম। আমারও তো একটা রুচি আছে নাকি?”

–“সত্যিই বাসর রাতে তোদের মাঝে কিছু হয়নি??” (উৎসাহ নিয়ে)
লজ্জা যেন আর ঐশানীকে টিকতেই দেয় না। বাসর রাতের কথা শুনলেই বার বার অভয়ের ওপর আরামে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে তার। ঐশানীর নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। অথচ বিয়ের আগে নিজেই এসব লাগামহীন কথাবার্তা কতশতই না বলেছে। কিন্তু বিয়ের পর সে নিজেই লজ্জায় প্রায় নেতিয়ে পড়েছে। এখন তার বান্ধবীগন দের না তাড়ালে যে কি ভয়ানক হাসাহাসিতে মাতবে ওরা সেটা ঐশানী খুব ভালো করেই বুঝতে পারে। পেছন থেকে পানির জগ নিয়ে মেঘনাদের দিকে পানি ছিটিয়ে দেয় ঐশানী।

–“ঐশানী, কি করছিস? গোসল তো আমরা করে এসেছি। আমরা দ্বিতীয়বার গোসল করে নয় তোর খবর নিতে আসছিলাম।”
রিনির কথা ঐশানীর কানে গিয়েও যায় না। ভিজে একাকার হবার আগেই সবাই রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। ঐশানী হাফ ছেড়ে বাঁচে। ওরা থাকলে আরো কত লাগাম ছাড়া কথাবার্তা বলতো তার ঠিক নেই। ও শুনতে চায় না অভয়ের সাথে যুক্ত কোনো কথা। কথায় আছে, যেই মানুষটার কথা শুনলে লজ্জা এসে তোমার ওপর ভর করে। তবে সেই মানুষটাকে ভালোবাসতে তোমার আর মাত্র কিছুক্ষণই লাগবে আবার হয়তবা তুমি ভালোবেসে ফেলেছো!
ঐশানী এমন কাউকে ভালোবাসতে চায় না যাকে ভালোবাসলে তার সুখময় এবং হাসিখুশি জীবনে আবারও ধসে পড়বে।

পানির জগটা রেখে দিয়ে তার নজর যায় মালাই এর কৌটোর দিকে। মুখে আপনাআপনি পানি চলে আসে তার। আশেপাশে চোরের মতো উঁকি দিয়ে খপ করে ওপর থেকে পেড়ে নেয় মালাই এর কৌটো। কৌটোর মুখ খুলে দেখে ভর্তিই আছে মালাই। চায়ের জন্য গরম হওয়া দুধের পাত্রের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে….
–“মালাই তো চা তেও দিতে হবে। তাহলে কি আমার খাওয়া হবে না? একটু খেলে কিছু হবে না। খেয়েই নিই বরং।”
আস্তে আস্তে খাওয়া শুরু করে ঐশানী। মালাই জিনিসটা তার ছোট থেকেই বড্ড প্রিয়। রান্নাঘরে কতশত বার চুরি করে খেয়েছে তার ঠিক নেই।

খাওয়ার এক পর্যায়ে ঐশানীর খেয়াল হয় মালাই প্রায় শেষের দিকে। তলায় একটুখানি পড়ে আছে। ভয়ে শুকনো ঢক গিলে সে। কৌটোটা ঝাঁকিয়ে ভীতিকর সুরে বলে…..
–“মা জানতে পারলে সেদিনের মতো আমাকে দিয়ে চড় দিবস পালন করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন কি করা যায়?”
চুলোর পাত্রে দুধটুকুও গরম হতে হতে শুকিয়ে গেছে। দ্রুত চুলো নিভিয়ে দিল ঐশানী।

–“আমার যতদূর মনে আছে আমার শ্বাশুড়ি মা তোমাকে মালাই চা বানাতে বলেছিল। কিন্তু রান্নাঘরে এসে গেছি এখানে পুরো মালাই ঐশানী তৈরি হয়ে গেছে।”
চেনা পুরুষালি কন্ঠে ভয়টা বেড়ে যায় ঐশানীর। রোবটের মতো ঘুরে তাকায় অভয়ের দিকে। অভয় একটা সুন্দর হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। হাসিটা সম্ভবত দুষ্টুমির হাসি! অভয়ের শেষ কথাটা বুঝতে না পেরে ঐশানী বলে….
–“মানে?”
–“মানেটা তো আয়নার সামনে গেলেই দেখতে পাবে। তোমার বয়স বাইশ বছর। তুমি শারিরীক দিক থেকেই বড় হয়েছো। মস্তিষ্ক একেবারে যতটুকু ছিল ততটুকুই আছে। গালে, ঠোঁটে, ঠোঁটের আশেপাশে, দুই হাতে সবখানে মালাই লাগিয়ে বসে আছো। শুধু চায়েই মালাই নেই।”

বলেই হু হা করে হাসতে শুরু করে অভয়। অভয়ের প্রাণখোলা হাসিটা বেশ সুন্দর। তবে এই সৌন্দর্যটা খুব বেশি দেখা যায় না। তবে তার হাসিতে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ঐশানী। মৃদু চিৎকার করে বলে…..
–“আপনি এখানে কি করছেন?”
–“পানি খেতে এসেছিলাম। বাড়ির বড়দেরকে বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল। ভাগ্যিস আমি নিজেই এলাম পানি খেতে। নয়ত এই দৃশ্য দেখতে পেতাম না।”
–“কেন? আমার বাড়ির মালাই। আমি খেয়েছি। আপনার বাড়ি থেকে চুরি করে তো খাইনি। আমাকে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না।”

অভয় ভ্রু উঁচিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মনোযোগ হবার ভং ধরে মাথা নাড়াতে নাড়াতে শুনতে থাকে ঐশানী কথা। তারপর দুষ্টুমির সুরে বলে…..
–“তুমিও বা ভয় পাচ্ছো কেন? আচ্ছা একটা কথা বলো। মালাই চা স্পেশালি আমার জন্য বানাচ্ছিলে। এখন তুমি নিজেই সব সাফ করে বসে আছো। আমি এখন কি খাব? তোমাকে খাব?”
অভয়ের মুখে এমন কথা কখনোই আশা করেনি ঐশানী। ঐশানী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে যায়। অভয় এখনো বুঝতে পারেনি আসলে কি মজার ছলে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। সে এখনো হাসতে মত্ত হয়ে পড়েছে। ঐশানীর সাথে থেকে তার কি হয়েছে সে নিজেই জানে না। সারাদিন হাসতে মন চায় তার। একসময় ঐশানীকে দেখে হাসি থামিয়ে ফেলে সে।

–“এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? রান্নাঘরেও ভূত-পেত্নী দেখছো নাকি আজকাল?”
ঐশানী জবাব দেয় না। ও একেবারেই বোবা হয়ে গেছে যেন। অভয় এবার চিন্তিত হয়ে তার বলা কথাগুলো ভাবতে থাকে। তখনই তার স্মরণে আসে সে বেশ বেহায়া কথা বলে ফেলেছে। তৎকালীন ঝড়ের গতিতে রান্নাঘর ত্যাগ করে সে। যাবার আগে ছোট্ট করে বলে যায়…..
–“সরি। আমি ওভাবে বলতে চাইনি।”

ড্রয়িংরুমে সবার মাঝে বসে আছে অভয়। ইমতিয়াজ সাহেবের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা চলছে তার। কিন্তু ভুলতে পারেনি কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটি। বারবার বুক ধুকধুক করছে তার। পাশে অনিন্দিতা আর ঐশী দুজনে রাজ্যের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। দুজনে ইতিমধ্যে একেবারে প্রিয় বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছে।
খালি হাতে ড্রয়িংরুমে পা রাখে ঐশানী। তাকে নজরে পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলে অভয়। সে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে এখন। সে বুঝতে পারেনা সে হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন? আগে তো দরকার ছাড়া মুখ থেকে একটা কথাও বের করা যেতো না তার। কবে এতোটা কন্ট্রোল হারিয়ে কথা বলতে শিখল? এটা কি ঐশানীর প্রভাব?

ঐশানীকে খালি হাতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে উঠলেন মিসেস.দিশা।
–“এই মেয়ে! জামাই এতোক্ষণ ধরে বসে আছে চা কোথায়? বানিয়ে আনিস নি? কি করলি এতোক্ষণ?”
–“মা আমি কি করব? তোমার জামাই তো মালাই চায়ের থেকে মালাই খেতে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু বলতে না পারায় চুপি চুপি রান্নাঘরে গিয়ে সবটা মালাই খেয়ে ফেলেছেন লোভ সামলাতে না পেরে।চা কি দিয়ে বানাতাম তুমিই বলো?”
ফট করেই কথাগুলো বলে ফেলে ঐশানী। কথাগুলো কানে আসতেই থতমত খায় অভয়। কি বলছে মেয়েটা? নিজেই সবটা খেয়ে এখন কত সুন্দর করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিল!

লজ্জায় অভয়ের মুখ থেকে কথা বের হতে চাইছে না। তবুও জোর করে বলল….
–“আ…আমি খেয়েছি?”
–“লজ্জা পেতে হবে না। আমি জানি আপনি লজ্জা পাচ্ছেন। কিন্তু এটা কিন্তু ঠিক না। আফটার ওল এটাও তো আপনারই বাড়ি না?”
–“ঐশানী একদম ঠিক কথা বলেছে। এটা তো তোমারও বাড়ি। মালাই কিন্তু আমারও খুব পছন্দের। (ফিসফিসিয়ে) একটা সিক্রেট বলি শোনো। আগে জোয়ান বয়সে আমিও শ্বশুড়বাড়ি গিয়ে তোমার শ্বাশুড়ি যখন চা বানাতো আমি মালাই চুরি করে খেয়ে ফেলতাম।”

মজার ছলে কথাগুলো বলেন ইমতিয়াজ সাহেব। অভয় বেচারা তো এখনো বিস্ময় কাটাতে পারেনি। হা করে ঐশানী দিকে তাকিয়ে আছে। এটা মেয়ে নাকি আগুনের গোলা?
অনিন্দিতা খানিকটা এগিয়ে এসে অভয়ের কানে কানে প্রশ্ন করে…..
–“ভাইয়া আগে তো জানতাম না তুই মালাই খেতে এতোটা ভালোবাসিস! শেষমেশ কিনা শ্বশুড়বাড়িতে এই কান্ডটা করে বসলি তুই?”
বলেই ফিক করে হাসে অনিন্দিতা। অভয়কে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই ঐশীর সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অপমানের রাগে কটমট করে ঐশানীর দিকে তাকায় অভয়। ঐশানী সিঁড়ি দিয়ে তার রুমে যাচ্ছে। পেছন ফিরে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে উঠে যায় সে। অভয়ও তার অপমানের শোঊ তুলবে। সুদেআসলে শোধ তুলবেই তুলবে!

ঐশানীর ঘরে আড্ডা বসেছে। তার বান্ধবীরা ঐশানীকে পেয়ে নানানরকম গল্পের হাট শুরু করেছে। মাত্র একদিন ঐশানীকে না পেয়েই তাদের গল্পের আসর পানসে হয়ে গিয়েছিল। তাদের আড্ডার মূল বিষয়বস্তু হলো অভয় আর ঐশানীর সম্পর্ক।
–“এর মানে তোদের বিয়ে পরেও দুলাভাই অন্যকাউকে ভালোবাসে?”
দিয়ার প্রশ্নে মাথা নাড়ায় ঐশানী। সঙ্গে সঙ্গে রিনি হুমড়ি খেয়ে বলে…..
–“বলিস কি? এটা তো ঠিক না। তুই কি করবি এখন?”

–“কি করব আবার? আমার জন্য প্রথমে উনাদের সম্পর্ক ভাঙনের মুখে পড়েছে। সেহেতু আমিই ঠিক করব সম্পর্কটা। তারপরেই তো বিয়ের বাঁধন থেকে মুক্তি পাব।” (স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে)
–“তুই দুলাভাইয়ের বান্ধবী বা শুভাকাঙ্ক্ষী নস যে উনার প্রেমিকা আর উনার মাঝে সবটা ঠিক করে দিবি। তুই উনার বউ। বিয়ের বাঁধন থেকেও মুক্তি পেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় ঐশানী। সময় থাকতে নিজের স্বামীকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখ। যদি কখনো দুলাভাইকে ভালোবেসে ফেলিস আর উনাকে বেঁধে রাখতে না পারিস তাহলে কিন্তু দুঃখের শেষ থাকবে না।”

রিনির কথায় স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল ঐশানী। তারপর বিরক্ত হওয়ার ভাব ধরে বলল….
–“তোরা চুপ কর। তোরা জানিস বিয়েটা আমি মন থেকে করিনি। বিয়েতে আমার রীতিমতো এলার্জি। তবুও এসব কথা কেন বলছিস তোরা? জ্ঞান দেওয়া বন্ধ কর।”
–“যে করেই হক বিয়েটা কিন্তু হয়েছে। তুই অস্বীকার করতে পারিস না। তুই কেন অন্য মেয়ের জন্য নিজের অধিকার ছাড়বি? আমার কথা শোন তোরা নতুন করে জীবনটা শুরু কর। দেখ তোরা ভালো থাকবি।”
–“তোরা চুপ কর তো। আমার দ্বারা এসব সংসার হবে না।”

মেঘনা কিছু ভেবে ঐশানীর দিকে তাকিয়ে বলে….
–“আচ্ছা একটা কথা বল। দুলাভাই যখন সায়রা সায়রা করে তখন তোর খারাপ লাগে না?”
ঐশানী বলতে যায় তার খারাপ লাগে না মোটেই। কিন্তু কোথাও আঁটকে যায়। সে অনুভব করে কোথাও তারও মনের কোণে খারাপ লাগা কাজ করে। সেই সূক্ষ্ম খারাপ লাগা সে বুঝতে পারে না। প্রশ্নটা এড়াতে আড্ডার আসর থেকে উঠে পড়ে সে।
–“আমার ভালো লাগছে না এসব বলতে। ভাবলাম এতোদিন পর আমরা একটু হাসির আড্ডা দেব তোরা তা না করে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছিস। আমি বুঝি আমার জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। তোরাই কথা বল আমি যাচ্ছি।”
রাগ দেখিয়ে চলে যায় ঐশানী। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে তার বান্ধবীরা।

নিজের ঘরে আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে ঐশানী। মুখটা তার ভার। তার কারণ হচ্ছে আজ দুপুরের খাবার খাওয়ার পরেই তাকে নিজের বাড়ি থেকে আবারও চলে যেতে হবে। তাছাড়া কোনো উপায়ও নেই। কালকের পরেরদিনই আবার অভয়ের গ্রামের বাড়ি যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মিসেস. তনয়া। তাই তাদেরকে ফিরতেই হবে। দরজা লক করার শব্দে ঐশানীর ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটে। ব্যাগে জিনিস রেখে অভয়কে দেখে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে তার পা। সকালে ও যা করেছে এরপর অভয় যে তার সাথে খারাপ কিছু করবে সেটা সম্পর্কে সে জানে।

–“আপনি! দরজা আটকালেন কেন?”
কাঁপতে কাঁপতে পেছনে সরতে সরতে বলে ঐশানী। অভয় বাঁকা হাসি দিয়ে বলে…..
–“সকালে এতো ভালো কাজ করলে আমার জন্য। তার জন্য গিফট নিবে না?”
–“গি…গিফট?”
–“হ্যাঁ গিফট। কিচেনে মালাই কে খেয়েছিল?”
ঐশানী ঢক গিলে পিছুতে পিছুতে বলে…..
–“আমি।”
অভয় আরো এগিয়ে যায় ঐশানীর দিকে।
–“মালাই কার পছন্দ?”
–“আ…আমার।”
–“তাহলে আজ তোমায় না হয় তোমার পছন্দের জিনিস দিয়ে গোসল করিয়ে দিই।”

ঐশানীকে কিছু বুঝে উঠার আগেই অভয় নিজের ডান হাত আড়াল থেকে বের করে তার হাতে থাকা বড় মালাই এর কৌটোর সবটা মালাই ঐশানীর ওপর ঢেলে দেয়। সবটা গিয়ে পড়ে ঐশানীর মাথায় এবং শরীরে। রেগে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করে ঐশানী। অভয় হালকা হেলে বলে…..
–“আশা করি এরপর থেকে আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার আগে এই কথাটা মনে পড়বে।”
ঐশানী রেগেমেগে বলে ওঠে…..
–“আপনি! আপনি একটা……”
পুরোটা বলার আগেই অভয় তার গাল ডান দিয়ে স্পর্শ করে। কথায় বন্ধ হয়ে যায় ঐশানী। হালকা কাঁপুনি দিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। ডান হাতে ঐশানীর গালে থাকা মালাই উঠে আসে অভয়ের হাতে। সেটা মুখে পুড়ে নিয়ে বলে…..
–“উমম….সুইট। মেবি দ্যা গ্রেট ঐশানীর স্পর্শ পেয়ে জিনিসটা আরো সুইট হয়েছে।”
চোখ মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অভয়। ঐশানী হা হয়ে সেখানেই অভয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।

চলবে……

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]