বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-১৮+১৯

0
398

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ঐশানী, অভয় আর অনিন্দিতা। অলরেডি কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে রেখেছে ঐশানী। মুখটা তার ভার। অভয় মাঝেমাঝে বাঁকা চোখে লক্ষ্য করছে ঐশানীকে। ঐশানীর জন্য হাসিখুশি চেহারায় যেন বেশি মানায়। কান্নাকাটি যেন তার জন্য নয়। একদমই নয়। মাঝেমধ্যে অভয়ের খুব করে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে রামধমক দিয়ে বলতে….
–“এই মেয়ে এতো কাঁদতে হয় কেন? এই দেশেই তো আছো। যখন তখন ফ্যামিলির কাছে আসতে পারবে। তাহলে এতো কান্না আসছে কোত্থেকে? তোমায় কান্না মানাচ্ছে না। হাসো হাসো। একদম কাঁদবে না।”

কথাগুলো মনে মনেই অনেকবার বলে ফেলল অভয়। কিন্তু মুখ ফুটে আর ঐশানীকে বলাই হলো না। একেই হয়ত জড়তা বলে। আবার ইগোও হতে পারে। একসময় নিজের মনকে শান্ত করে জানালার বাইরের দিকে তাকায় সে। আকাশে কেমন যেন ঘন কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি আসবে নাকি? বাতাসও হচ্ছে বেশ। সামনের সিটে গানে ইয়ারফোন গুঁজে গানের তালে হালকা মাথা দুলিয়ে চলেছে অনিন্দিতা। ওর আর কাজ কি?
চোখজোড়া ঘুরতে ঘুরতে আবারও গিয়ে পড়ে ঐশানীর দিকে। দিনের আলোয় স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ছে তার গাল ও নাকের লাল আভা। চোখ বন্ধ করে সিটে আয়েশ করে বসে চোখ বন্ধ করে সে।

বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মিসেস. তনয়া ছুটে আসেন। বাড়িটা যেন তার এই তিনজনকে ছাড়া হাহাকার করছিল। তিনজনকে এক সঙ্গে পেয়ে উনার মুখে মুচকি হাসি ফোটে।
–“যাক তোরা ফিরেছিস আমার শান্তি। মাত্র একদিন ছিলি না কতটা একাকিত্ব বোধ করছিলাম তার বলার বাইরে। আর কোথাও যেতে দেব না তোদের।”
–“আমি তো যেতে চাইনি। তুমিই তো জোর করে পাঠালে মা।”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বাড়িতে ঢুকে সটান হয়ে সোফায় বসে বলে অভয়। মিসেস. তনয়া বলেন….
–“ওটা নিয়ম। যেতেই হতো তোদের। তাছাড়া বাড়িতে থাকলে আহামরি কতক্ষণ থাকতি? অফিসে ছুটে যেতিস।”

–“বাড়িতে আর কতক্ষণ থাকা যায় বলো তো? এমনিতে এই বাড়িতে থেকে থেকে বোর হয়ে গেছি। দেশে আসার পর কোথাও বেড়াতে যাওয়া হলো না।”
–“কালকের পরেরদিন তো দেশের বাড়ি যাচ্ছি। সিলেট জায়গাটায় অনেক ঘুরে বেড়ানোর জায়গা আছে। যেই গ্রামের তোদের দাদুবাড়ি সেখানেই তো চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো জায়গা।”
অনিন্দিতার কথায় বড্ড তাড়াহুড়ো করে কথাগুলো বললেন মিসেস. তনয়া। কিছু একটা ভেবে আবারও ঐশানীর উদ্দেশ্যে বলেন……
–“তোমরাও তো আগে ওখানেই থাকতে না? কবে ঢাকায় এসেছো?”
–“বেশি দিন নয় আম্মু। চার-পাঁচ বছর!”

ঐশানীর কন্ঠ বেশ দুর্বল শোনায়। মেয়েটা কেমন জানি একটু জার্নি করলেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই বেশি কথা বাড়ালেন না মিসেস. তনয়া। সরাসরি বললেন….
–“আচ্ছা যাও ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। বিশ্রাম নাও। আর অভয় তুইও যা। এভাবে বসে থাকিস না ফ্রেশ না হয়ে।”
ঐশানী মাথা দুলিয়ে ধীরেধীরে ওপরে ঘরের দিকে যায় নিজের লাগেজ নিয়ে। অভয় তা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। অন্যসব লাগেজ বা ব্যাগে হাত দিতে পারলেও ঐশানীর ওই ব্যাগটা নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছে। যেন কোনো গুপ্তধন আছে সেখানে। কিছুক্ষণ বসে থেকে অভয়ও পা বাড়ায় তার রুমের দিকে।

বিকেলের আকাশ স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। সামান্য বাতাস হবার পর মেঘ কেটে গিয়ে রঙবেরঙের মেঘের মেলা বসেছে। ঐশানী মিসেস. তনয়ার নিজহাতে বানানো প্রিয় বাগানের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। গুনগুনিয়ে গানও গাইছে। গাছগুলো পানি পেয়ে যেন আরো সজীব হয়ে উঠেছে। একসময় পাইপলাইন থেকে পানি আসা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। ঐশানী তাতে বিরক্ত হয়ে পাইপলাইন নিজের দিকে করে ঝাঁকাতে থাকে।
–“এই বাড়িতে ওই শ্যামলা ঘোড়ার মতো কি সবকিছুতেই সমস্যা আছে? উনার যেমন হাসতে সমস্যা তেমনই সবকিছুতেই সমস্যা।”
পাইপ ঝাঁকিয়েও যখন কোনো লাভ হয় না তখন পাইপটার ওপর রাগ হয় তার।

অন্যদিকে ফিরতেই অভয়কে চোখে পড়ে তার। অজান্তেই পাইপের মুখটা অভয়ের দিকে ধরে ঐশানী। অভয় ফোনে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। ওর পা দুটো পাইপের ওপর দাঁড় করানো। যার কারণে পানি আসা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখটা ছোট করে ঐশানী চিল্লিয়ে বলে….
–“চোখ ফোনে লাগিয়ে হাঁটছেন ভালো কথা। তাই বলে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাবেন নাকি?”
–“চুপ চুপ। সায়রার নম্বর বন্ধ। মেসেজ করছি। দাঁড়াও।” (ঐশানীকে খেয়াল না করে)
–“তো করুন না মেসেজ। কিন্তু আমাকে গাছে পানি দিতে দিন। সরে দাঁড়ান।”

ফোন থেকে মাথা তুলে তাকায় অভয়। নিজেকে পাইপ লাইনের ওপর দেখে এক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে….
–“ওহ হো। খেয়াল করি……”
কথাগুলো তার মুখেই রয়ে গেল। ঝর্ণার মতো পানি এসে ওপর তার ওপর। হা করে পানির মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে এই বিকেলে। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় তার। ঐশানী সেখানেই স্তব্ধ হয়ে অভয়ের পানিতে ভেজা দেখছে। সে বুঝতেও পারছে না এতো পানি কোথায় থেকে পড়ছে উনার ওপর? তার খেয়ালেও নেই ঐশানীর হাতেরই পাইপলাইন দিয়ে পানি অঝরে পড়ছে অভয়ের ওপর। অভয় বার বার ইশারায় বলছে ঐশানীকে পানির লাইন বন্ধ করতে। কিন্তু সে বুঝলে তো? অবশেষে ব্যর্থ হয়ে দাঁত কিড়মিড় করে সেখানেই ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে অভয়। ভিজেই তো গেছে সরে গিয়ে আর কি লাভ?

নিজের বোকামি খেয়াল হতেই ঝড়ের গতিতে পাইপটা সরিয়ে অন্যদিকে ধরে ঐশানী। অভয় ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। কালো পরিহিত শার্ট দেহের সাথে লেগে গিয়ে প্রশস্ত দেহের পুরো গঠন বোঝা যাচ্ছে। ঐশানী এক অদ্ভুত ভাবনায় মেতে উঠল। সেটা হলো অভয়কে কেমন দেখতে? শ্যামলা চেহারার অধিকারী সে। হালকা মোটা নাক, ছোট চোখজোড়া, আবছা গোলাপি আভায় ছেয়ে থাকা ঠোঁটজোড়া। লম্বা ও চওড়ায় বেশ! ঐশানী হাইট একটু খাটো হওয়ায় তাকে মুখ তুলে কথা বলতে হয়। অভয়ের সঙ্গে কোনোদিন সেভাবে পাশাপাশি দাঁড়ায়নি ঐশানী। তবে আন্দাজ করতে পারছে সে অভয়ের কাঁধের থেকেও একটু নিচু। আচ্ছা তারা যখন দুজনে একসাথে হাঁটে তাহলে কি পেছন থেকে বাবা আর মেয়ে দেখাবে?

ঐশানী এবার বেশিই ভেবে ফেলছে। সে নিজের মনে ঝাড়ি মেরে বলল….’এতো ভাবছিস কেন? ওই শ্যামলা ঘোড়ার সাথে তোকে কেমন লাগে এটা জেনে তোর কি লাভ?’
মাথা ঝাঁকিয়ে হুঁশে ফিরে অভয়ের দিকে তাকায় সে। সে বোধহয় প্রচন্ড রেগে আছে। অভয়ের রাগ দেখে নিজের কথায় ভুলে যায় ঐশানী। এখন অভয় কি করবে তার সাথে? একটু একটু করে এগিয়ে আসে অভয়। তার পায়ের ধাপও যেন রাগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঐশানী ভয়ের চোটে পিছিয়ে যেতেও ভুলে গিয়েছে। অভয় এসে এক টান দিয়ে ঐশানীর থেকে পাইপলাইন নিয়ে নেয়। তারপর ঐশানীর দিকে ধরতেই ওকে ভিজিয়ে দেয় অভয়। ঐশানী কি রিয়েকশন দেবে তাও ভুলে গিয়েছে প্রায়। অভয়ের রাগি মুখে হুট করেই ফুটে ওঠে হাসির আভা। অট্টহাসিতে মেতে ঐশানীকে ভিজিয়ে চুপসে দেয় সে।

ঐশানী অপ্রস্তুত হয়ে অভয়ের হাত থেকে পাইপলাইন কেঁড়ে দিতে ছুটে আসতেই তার পা পিছলে যায়। পড়ে গিয়ে নিজের হাড়গোড় ভেঙ্গে ফেলার আগেই তার বাহু ধরে তাকে বাঁচিয়ে নেয় অভয়।
–“সাবধানে। প্রতিবার পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য আমি থাকব না।”
–“আপনি হয়ত থাকবেন না। অন্যজন থাকবে। আমার স্বামী থাকবে।”
অভয় ভ্রু কুঁচকায়। কি বলতে চায় এই মেয়ে? ঐশানীর স্বামী বলতে একমাত্র সে নিজেকেই চেনে। হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে যায় তার কন্ঠ।
–“মানে?”

–“মানে আবার কি? আপনার আর আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে যদি কখনো আমার ড্রিমবয় পেয়ে যাই তাহলে কি চুপচাপ বসে থাকব নাকি? বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাব।”
ঐশানীর কথায় অভয়ের কি হলো তার অভয়ের নিজেরই অজানা। মাথাটা ক্রমশ গরম হতে থাকে তার। অজান্তেই সে চেপে ধরে জোরে ঐশানীর বাহু। হাসিতে চকচক করতে থাকা মুখ হঠাৎ করেই কালো করে চমকে ওঠে ঐশানী। অভয় তাকে এভাবে চেপে ধরল কেন? ভয়ে ভয়ে ভীতিকর সুরে বলে…..
–“কি হলো আপনার?”

সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় অভয় ঐশানীর বাহু। পাইপলাইনটা ওপরে ধরে রেখেছে অভয়। অসাময়িক হাসি দেয় সে। তাদের ওপর বৃষ্টির ফোটার মতো পড়ছে পানি। ঐশানিও হেসে দেয়। এক পড়ন্ত বিকেলে পানিতে খুনসুটি করতে ব্যস্ত একজন রমনী এবং একজন পুরুষ।

রাতের খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢোকে ঐশানী। অভয় ঘরে আগের থেকেই খাওয়া শেষ করে এসে বসে ছিল। লাইট ওফ করে শুধু একটা ড্রিমলাইট টাই জ্বলছে। ঘরটায় আবছা আলো। অভয় উবু হয়ে আছে খাটে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু কাজ করছে। ভ্রুযুগল হালকা কুঞ্চিত করে রেখেছে। বাবা একাই আর কাজ সামলে উঠতে পারছে না বলে আজ থেকেই কাজে হাত দিয়েছে অভয়। ঐশানী এসে বেডের ওপর বসে বালিশ শেষ প্রান্ত নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে। মাঝখানে দেয় বালিশ। অন্যপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে নেয় সে।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে কাজ শেষ করে হাফ ছাড়ে অভয়। প্রেজেন্টেশন তৈরি করা মোটেও সহজ কাজ নয়। ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার দেখে নেয় ঐশানীকে। সে গুটিশুটি মেরে ওপাশ ফিরে রয়েছে। এতোক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে হয়ত। অভয়ও ল্যাপটপ রেখে শুয়ে পড়ে। কপালে হাত ভাঁজ করে রেখে ওপরে ছাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ঐশানী আর তার বিয়ে হয়েছে। একই ঘরে একই বিছানায় তাদের বাস। কিন্তু কত দূরত্ব! অভয় কি ঐশানীকে দূরে সরিয়ে রেখে কোনো অন্যায় করছে? নাকি ও তাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে! না না তার তো সায়রার প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। ঐশানীর প্রতি নয়। কারণ ঐশানী নিজেও সুখি নয়। সুতরাং এটা তার প্রতি অন্যায় না। মনে মনে এটাই ভেবে নেয় অভয়।

–“কি ভাবলেন সায়রার ব্যাপারে? কবে ভাঙাচ্ছেন ওর অভিমান?”
ঐশানীর কন্ঠ এই সময় আশা করেনি সে। তাও সায়রার ব্যাপারে তো একদমই না।
–“এখনো ঘুমাও নি তুমি?”
–“না। ঘুম আসেনি এখনো। আমি যে আইডিয়া দিয়েছি। আই মিন একে একটু রোমান্টিকলি প্রপোজ করে অভিমান ভাঙানোর কথা। এই ব্যাপারে কি ভাবলেন?”
মেয়ে জাতি নাকি মরে গেলেও নিজের স্বামীর সাথে অন্য কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারে না। অথচ ঐশানী তার উল্টো। অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। অভয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলে….
–“ভাবছি। কাল ওর সাথে কথা বলব।”

–“শুধু কথা?”
–“আচ্ছা তুমি কেমন স্ত্রী বলো তো? স্বামীকে পরকীয়ায় জড়াতে সাহায্য করছো?”
ঐশানীর হাসির শব্দ শোনা যায়। সে ওইপাশ ফিরে আছে বলে তাকে দেখা যাচ্ছে না। ও কি তাচ্ছিল্য করে হাসছে? হাসি থামিয়ে সে বলে….
–“আমরা যদি সত্যিই এমন কোনো স্বামী-স্ত্রী এর বাঁধনে আঁটকে থাকতাম অবশ্যই আপনাকে এসব করতে দিতাম না। দরকার হলে গলায় ছুরি ধরে নিজের করে রাখতাম। তবে যেই সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেই সম্পর্কের চেয়ে ভালোবাসাময় সম্পর্ক ভালো নয় কি?”
অভয়ের নিরুত্তর। মেয়েটা এতো অদ্ভুত কেন? ওকে বোঝার ক্ষমতা এখনো হলো না অভয়ের।

অভয়কে চুপ থাকতে দেখে আবার ঐশানী বলতে শুরু করে…..
–“আপনি কালকেই না হয় সায়রার অভিমান ভাঙিয়ে দিন। অভিমান বড্ড কষ্ট দেয়। অভিমান হলে আশপাশটা বিষের মতো লাগে। ওই বিষ যন্ত্রণা থেকে সায়রাকে মুক্তি দিন।”
–“তুমি বলছো এসব করতে?”
–“হুমম। কিন্তু কাল। আজ নয়। ঘুমান এখন। গুন নাইট।”
ঐশানীর আর গলা পাওয়া গেল না। অভয় সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিল। শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে এলো যেই মেয়ে তাকে ভালোবাসতে চায় না তার ওপর মায়া বাড়িয়ে কি করবে? অন্তত অনিন্দিতার দেওয়া চ্যালেঞ্জ টা জিততে পারবে। তাই ঐশানীর ভাবনা মাথায় আনতে চায় না সে।

সকাল হতে না হতেই ব্যস্ত শহরের মানুষ নিজেকে নিজের কাজে ব্যস্ত করে তুলেছে। ঐশানী এবং তার শ্বশুড়বাড়ির পরিবারও বাদ নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত। সকালের খাবার খেয়ে রাহাত সাহেব ও অভয় একসাথে বেরিয়ে গেছে অফিসের জন্য। মিসেস. তনয়া বসে মনের সুখে কাঁথা সেলাই করছেন। ঐশানী আর অনিন্দিতাও বেরিয়েছে কিছু শপিং করতে। মিসেস. তনয়া পাঠিয়েছেন ওদের। কালকে কতবছর পর গ্রামে যাবে তারা। কিছু না নিয়ে গেলে চলে নাকি? তাই সকলের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন মিসেস. তনয়া ওদের দুজনকে।

শপিংমলে প্রচন্ড রকমের ভীড়। সকলে যেন শপিং করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আশপাশটা এতো ভীড়ের জন্য গরম ও উত্তপ্ততর হয়ে উঠেছে। তাই দ্রুত শপিং শেষ করে নিল ঐশানী আর অনিন্দিতা। দুজনেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অনিন্দিতা নিজের হাতে থাকা ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে….
–“বারোটা বাজে ভাবি। সকলের জন্য সব কেনা হয়ে গেছে?”
–“হুমম মোটামুটি হয়ে গেছে। অনেক গরম পড়েছে। ঠান্ডা কিছু না খেলেই নয়। শরীর আর চলবে না। মলের বিপরীতে একটা রেস্টুরেন্ট দেখেছিলাম। চলো সেখানে গিয়ে বসা যাক।”

ঐশানীর প্রস্তাবটা খারাপ নয়। অনিন্দিতারও পা চলছে না। তাই হেসে মাথা দুলিয়ে চলতে শুরু করে। দুজনেই মল থেকে বের হওয়ার রাস্তার দিকে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে আসে ঐশানী। সে খেয়াল করেনি অনিন্দিতা তার সঙ্গে আসেই নি। ব্যাগ চেক করতে করতে হেঁটে চলছে সে। রেস্টুরেন্টের কাছে এসে সোজাসুজি সেখানে ঢুকে পড়ে। ও এটাও খেয়াল করেনি রেস্টুরেন্টের দরজায় বুকড লিখা আছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে বেশ অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সে আশেপাশে তাকায়। অনিন্দিতাকে যখন খুঁজেও পায় না তখন ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে ঐশানীর। তৎক্ষনাৎ ওর ওপর লাইট পড়ায় চোখটা বন্ধ করে নেয় ও। চোখ খুলে দেখে আশপাশটা কত সুন্দর করে সাজানো। সফট মিউজিক চলছে। টেবিলে টেবিলে ফুল দিয়ে সাজানো।

কারো স্পর্শ পেয়ে তার হাড় হিম হয়ে আসে ঐশানীর। শরীরে বয়ে যায় এক অজানা স্রোত। কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে। ঐশানীর হাত থেকে ব্যাগ গুলো পড়ে যায়।
–“আই এম সরি সায়রা। আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি বুঝেছি তুমি আমার ডিস্টেনি। আমার ভাগ্য। ঐশানী নয়। যদি হতো তাহলে কবেই ওর সাথে আমার মিল হতো। সেটা হয়নি। আই এম সরি।”
চেনা পরিচিত কন্ঠ শুনে নিশ্বাস আঁটকে আসে ঐশানীর। জোর করে ধাক্কা দিয়ে সরে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে অভয়কে দেখতে পায় সে। অভয়ও তাকে দেখে ততটাই অবাক হয়েছে যতটা ঐশানী হয়েছে। ঐশানী মুখ ফুটে বলে ওঠে…..
–“আপনি?”

চলবে……

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯

–“আপনি এখানে? তারমানে এটা কি সায়রার জন্য ছিল? আই এম সরি। আপনি আমাকে সায়রা ভেবে জড়িয়ে ধরলেন। আমি হয়ত রেস্টুরেন্টের দরজায় নোটিশ দেখিনি। আই এম রিয়েলি সরি। সব স্পয়েল করে দিলাম। আমি যাচ্ছি।”
কাঁপতে কাঁপতে এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলল ঐশানী। তার পায়ের সাথে শপিংয়ের ব্যাগ লাগতেই হালকা নিচু হয়ে ব্যাগ গুলো তুলতে লাগল সে। এতোগুলো ব্যাগ একসাথে তুলতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে তার। একটা একটা করে ব্যাগ তুলে দাঁড়াতেই রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে প্রবেশ করে একটা মেয়ে।

ঐশানী দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ে। সায়রাকে এর আগে এক ঝলক দেখেছে ঐশানী। তাই তাকে চিনতে তার ভুল হলো না। সায়রা ভেতরে আসতেই ঐশানী আর অভয়কে দেখে তার চলা থামিয়ে দিল। হয়ত সেও প্রচন্ড অবাক হয়েছে। যার কারণে চলা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঐশানীকে একনজর দেখে সে সরাসরি অভয়কে প্রশ্ন করে…..
–“কেন ডেকেছো আমাকে?”
–“ঐশানী তোমাকে ডাকতে বলেছিল। তাও জাঁকজমক ভাবে ডাকতে বলেছিল।”
সায়রা ঐশানীর দিকে তাকায়। আর ঐশানী অভয়ের দিকে। অভয় টেবিলে হাত রেখে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে যেন সব স্বাভাবিক। ঐশানী ভেবেই পেলো না অভয় কেন এমন করছে!

চমকিত হয়ে জোরেই সে বলল…..
–“কিন্তু আমি তো শুধু আপনার আর সায়রার মাঝে যাতে…..”
কথাটা সম্পূর্ণ হতে দেয় না সায়রা। তার পক্ষে এসব দেখা খুব কষ্টের। সে ভেবেছিল অভয় হয়ত শুধু তাকে ডেকেছে। হয়ত সে চায় সায়রাকে। কিন্তু ঐশানীকেও দেখে মনটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে তার একটুও সময় লাগল না। একটা মন আর কতবার ভাঙবে কে জানে!
–“কেন ডাকতে বলেছিলে অভয়কে আমায় মিসেস. ঐশানী খান? আমি তো দূরেই সরে গিয়েছি। শান্তি হয়নি তোমাদের?

–“আমার কথা শোনো সায়রা। আমি এখানে আসতে চাইনি।”
সায়রা আঘাত পেয়েছে। অভয় ফোন করে তার বউয়ের সাথে নিজেকে এই রোমান্টিক জায়গায় দেখাবে বলে জানলে কখনো আসত না। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়তেই কারোর কথা না শুনে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায় সে। ঐশানী অনেকবার ডেকেও কোনো লাভ হয় না। পেছন ফিরে চেয়ে তাকায়। সাদা শার্ট তার ওপর কালো ব্লেজার পরিহিত অভয়ের দিকে। আজ ঐশানী কোনো অপরিচিত অভয়কে দেখছে। ক্ষীণ আওয়াজে সে জানতে চায়…..
–“আপনি এমন কেন করলেন?”
–“কে হয় সায়রা তোমার?”

–“আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি। আপনি তার উত্তর না দিয়ে উল্টে আমাকে আজগুবি প্রশ্ন করছেন? আর সায়রা কে হবে? ওকে চিনিও না।”
–“তাহলে কেন ওর প্রতি এতো দরদ দেখাচ্ছো? ওর কষ্ট, রাগ, অভিমান সব বুঝতে পারো। আমি তোমার এতো কাছে থাকি আমার ভেতরে যে ক্ষোভ, রাগ আছে তা কেন দেখতে পাও না?”
অভয়ের একটা কথাও ঐশানী ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মনের মধ্যে শুধু তার প্রশ্নই জমা হচ্ছে। উত্তর পাচ্ছে না। যার কারণে তার অস্থির লাগছে। অস্থিরতায় বার বার চোখ বন্ধ করে খুলতে থাকে ঐশানী। ক্লান্তি ভরা কন্ঠে বলে….

–“কি বলছেন আপনি? আপনি চেয়েছিলেন সায়রার সাথে আপনার সম্পর্ক ঠিক হক। আমি সেকারণে আইডিয়া দিয়েছি। আপনি সেই অনুযায়ী আজ রেস্টুরেন্ট বুক করলেন। কিন্তু ভুলক্রমে আমি চলে এলাম। তাতে আপনি আমাকে সায়রা ভেবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর……”
–“আমাকে কি তোমার কানা মনে হয়? নাকি আমি চোখে পট্টি পড়ে থাকি? তোমার আর সায়রার মাঝে পার্থক্য আমি যথেষ্ট বুঝি। সায়রা কখনো শাড়ি পড়ে না।”
–“হ্যাঁ তো?”
ভালোভাবে অভয়ের কথাগুলো না বুঝেই প্রশ্ন করে ফেলে ঐশানী। তৎক্ষনাৎ ওর খেয়ালে আসে অভয়ের বলা কথাগুলো। ও কিছুটা বুঝে উঠতে পেরে এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে তাকায়।

–“ত…তার মানে আপনি জানতেন ওটা আমি?”
–“আমি কখনো সায়রাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে পোষণও করি না। যদি ও আমার স্ত্রী হতো তাহলে হয়ত করতাম। কিন্তু ও আমার স্ত্রী নয়।”
ঐশানী আরেক দফা চমকায়। আজ অভয়ের মুখে এতো বিস্ময়কর কথাবার্তা সে আর নিতে পারছে না। মাথাটা ভনভন করছে। আজ কি সারপ্রাইজ ডে? অভয় স্ট্রেট দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে ঐশানীর দিকে এগোয়। গমগমে আওয়াজে বলে ওঠে…..
–“ব্যাস….অনেক হয়েছে ভদ্রভাবে তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা। খারাপ রুপও তোমার দেখে নেওয়া উচিত।”

ঐশানী পলকহীন চোখে তাকায় আগ্রহ নিয়ে অভয় কি করতে চায় তা দেখার জন্য। পকেট থেকে হাত বের করে হঠাৎ করেই একহাত ঐশানীর পিঠে অন্যহাত দিয়ে ঐশানীর গাল চেপে ধরে অভয়। ঐশানী নড়াচড়া করারও সুযোগ পায় না। অভয় সেই অবস্থায় বলতে শুরু করে…..
–“সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারো তুমি। সায়রাকে শুধু একপলক দেখে বুঝলে ও কষ্ট পাচ্ছে, যন্ত্রণা পাচ্ছে। সবার মনের যন্ত্রণা দূর করার চেষ্টায় মেতে থাকো তুমি। কিন্তু আমার সাথে সারাদিন থাকো। আমার সাথে ঘুমাও। তবুও বুঝতে পারো না আমার মনের অবস্থা? হয়ত আমার পাগল। আমি বুঝতে পারি না কখন আমি নিজে কি চাই। আমার ভালোবাসা কে, আমার ডেস্টিনি কে আমি এসব কিচ্ছু বুঝি না। নিজের মনকে এখনো পড়তে পারি না। কিন্তু তুমি কেন পারো না?”

ঐশানী যেন কথা বলাই ভুলে গিয়েছে। আর সত্যিই তো এসব কথার পাল্টা কি জবাব দেওয়া উচিত? অভয় কেনই বা এসব কথা বলছে? সে অস্পষ্ট কন্ঠে বলে…..
–“আপনি তো বলেছিলেন সায়রাকে ভালোবাসেন। তাই তো আমি এসব বলেছিলাম।”
অভয় আবারও ঐশানীর মুখে সায়রার নাম শুনে বিরক্ত হয়। কিন্তু একসময় এই সায়রাকে ছাড়াই সে থাকতে পারত না। একমুহূর্ত কাটানো ওর কাছে কঠিন হয়ে দাঁড়াতো। আর এখন সায়রা নামটা শুনতেও তার মাঝে তিক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে। ঐশানীর গাল আরো জোরে টিপে ধরে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে…..

–“চুপ! সায়রা বাদ। এখন শুধু তুমি আর আমি। আর যদি আমার ব্যবহার আজকে তোমার উইয়ার্ড মনে হয় তাহলে আই এম সরি। আমার এই ব্যবহারের পেছনে দোষটা তোমার। কেন সেই রিসেপশনের দিন নিজের গজদাঁতের সেই মায়াময় হাসিটা দেখিয়েছিলে? সেই হাসিটাই আমার মনের দুয়ারে কড়া নাড়িয়েছিল। আমি মনের দুয়ার খুলে উঁকি মারার সাথে সাথেই তুমি জোরজবরদস্তি করে ঢুকে পড়েছো আমার মনের ছোট্ট ঘরে। এটা তোমার দোষ। তোমার হাসির দোষ। আমি সেদিন নিজের অনুভূতিকে পাত্তা দিইনি। দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়ি তোমার সেই মালাই খেয়ে মালাই ভরিয়ে রাখা চেহারার ওপর। তৃতীয় বার প্রেমে পড়ি তোমার কাঁদার পর ফোলা চোখমুখের ওপর। তোমার সেই লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগার ওপর। চতুর্থ বার প্রেমে পড়ি গতকাল পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদে ভিজে চুপসে যাওয়া তোমার ওপর। চতুর্থ বার প্রেম দ্বারা খুন করেছো আমায়। কিন্তু…..”

ঐশানী অভয়ের কথাগুলো শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অভয় কখনো তাকেও এসব কথা বলতে পারে সেটা কখনো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তবে তার কথাগুলো ঐশানীর কাছে বড্ড মোহনীয় হয়ে ঠেকছে। আগ্রহ নিয়ে বলে…..
–“কিন্তু?”
–“কিন্তু কাল যখন তুমি বললে তোমার ড্রিমবয় পেলে তুমি তার সাথে বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাবে তখন আমার কি হলো জানি না। আগুন ধরে গেল আমার হৃদয়ে। কিন্তু নিজেকে দমিয়ে আমি তখন স্বাভাবিক আচরণ করেছি। আমার ভাবনা শুরু হয় কাল রাতে। আবার তুমি যখন বললে যে আমাদের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থেকেও নেই। তখন আমি ভড়কে গেলাম। সারারাত আমি ভেবেছি যে তুমি যদি কখনো ছেড়ে যাও আমায় তখন আমার কি হবে? সায়রা যদি আমার জীবনে ফিরে আসে আর তুমি যদি চলে যাও আমি মানতে পারছিলাম না। সায়রাকে আমি দূরে সরিয়ে দিতে রাজি আছি। কিন্তু তোমাকে আমি পারব না। জড়িয়ে গেছি তোমার মাঝে। আজ তোমার ওপর রাগ করেই একপ্রকার এসব অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি। কিন্তু তোমাকে আমি শপিংমলে ঢুকতে দেখি। আমি ভেবেছিলাম আজই সায়রাকে সরি বলব। ওকে মিথ্যে সম্পর্ক থেকে মুক্ত করব নিজেও মুক্ত হবো। তার আগেই তুমি ঢুকে পড়লে।”

কথাগুলো বলতে বলতে আলগা হয়ে আসে অভয়ের বাঁধন। ঐশানী অভয়কে হালকা ধাক্কা দিয়ে বেশ কয়েক হাত দূরে সরে আসে। বিস্মিত হয়ে চেয়ে বলে……
–“আপনি কি বলছেন আপনি জানেন? এইতো মাত্র দুদিন আগে আপনি সায়রাকে ভালোবাসেন। ওর সম্পর্ক আপনার সাথে ভেঙেছি বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছিলেন। আজ আপনাকে যখন এডভাইজ সব ঠিক করার তো আপনি উল্টো সুরে গাইছেন। আপনি ঠিক কি চান সেটা কি আপনি আদোও জানেন?”

অভয় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। ঐশানীর দিকে এগিয়ে এসে অসহায় নয়নে চেয়ে বলে…..
–“আমি তোমাকে চাই ঐশানী। আজ আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি বিয়ের বন্ধনে আমি বাঁধা পড়ে গেছি। মরার আগ পর্যন্ত আমার ছাড় নেই এই বাঁধন থেকে। আর সায়রার কথা বললে আমি বলব ও সত্যিই আমার কাছে একটা মোহ ছিল। মায়া ছিল। আর্কষণ ছিল। জেদ ছিল। ভালোবাসা কোনোকালেই ছিল না। একটা মানুষের সঙ্গে যদি দৈনন্দিন যোগাযোগ করা হয়। কথা হয়। তবে সেই মানুষের প্রতি মায়া তো জন্মাবেই। সায়রার সঙ্গে আমার কথা হতো। ভালোবাসা আর ভালো লাগার তফাত না বুঝেই সেটাকে ভালোবাসা বলে চিল্লাতে শুরু করি আমি। ওর জন্য আমার খারাপ লাগছে। ওর কাছে আমি ক্ষমা চাইব। অবশ্যই চাইব। কিন্তু তোমাকে হারাতে পারব না।”

–“আর কয়েকদিন পর যদি আমার ওপর থেকে আপনার মন উঠে যায়? যদি আপনার মনে হয় আমিও আপনার মোহ? যদি তখন মনে হয় সায়রাই আপনার সত্যি ভালোবাসা ছিল? সেদিন কি আমাকেও সরি বলবেন বা ক্ষমা চেয়ে সায়রার হাত ধরবেন?”
একনাগাড়ে প্রশ্ন গুলো অভয়ের দিকে ছুঁড়ে দিল ঐশানী। অভয় মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে….
–“না ঐশানী। বিলিভ মি! আমি বুঝেছি আমি কাকে ভালোবাসি আর কাকে বাসি না।”

–“আজকে যখন আপনি উল্টো সুরে গাইছেন তারপর থেকে আপনাকে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে একটু কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাল যদি আপনি আবার উল্টো সুরে গাইতে থাকেন তাহলে আপনাকে চরিত্রহীন ছাড়া কিছুই ভাবতে পারব না আমি।”
কথাটা শুনে বেশ রাগ হয় অভয়ের। কাল থেকেই ওর রাগ চড়ে আছে। তবে অভয়ের একটি ভালো স্বভাব হচ্ছে ও সহজে নিজের রাগ প্রকাশ করে না। কারোর সাথে চিল্লাপাল্লা করে কথা বলে না। কাউকে আঘাত করে না। কিন্তু কাল বিকাল থেকে ও রাগ কমাতে পারেনি। উপরন্তু এসব কথায় রাগটা আরো বাড়ে তার।

–“আমি এমন করবি না ঐশানী।”
–“গ্যারান্টি কি? হয়ত আপনি করবেন। সেদিন সব হারিয়ে বসে থাকা ছাড়া আমার উপায় নেই। আর আপনি আজ ওই মেয়েকে কষ্ট দিলেন। আমার এটা ভালো লাগেনি।”
–“আমার কথাও ভাবো ঐশানী প্লিজ।”
–“পারছি না আপনার কথা ভাবতে আমি। আর না আপনার এসব কথা বিশ্বাস হচ্ছে।”
অভয় চোখ বন্ধ করে বলে…..
–“স্ট্রাস্ট মি!”
–“সরি আই কান্ট। ইউ আর এ লায়ার। ইউ আর এ চিটার।”

আর রাগ দমন করতে পারে না অভয়। হুট করেই চোখ খুলে ডান হাত দিয়ে ঐশানীর বাম গালে চড় বসিয়ে দেয়।
–“আই এম নট চিটার। আই এম নট লায়ার। মায়া, মোহ সবার জন্মায়। আমি বুঝতে পারিনি। এটা কি স্বাভাবিক নয়? তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। বার বার একই কথা বলছি। কিন্তু তুমি একই কথা বলছো। ফলস্বরূপ আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।”
ঐশানী গালে হাত দিয়ে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা যেন চেনা থেকে বড্ড অচেনা হয়ে উঠেছে। অভয় এগিয়ে আসতে নেয়। কিন্তু ঐশানী সরে যায়। বাইরে ছুটে বেরিয়ে যায়। অভয় পিছু ডাকলেও শোনে না।

বাইরে বের হতেই রাস্তার ওপারে অনিন্দিতাকে দেখতে পায় ঐশানী। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে করতেই অনিন্দিতা রাস্তা পার হয়ে তার কাছে চলে আসে। নিজের ফোনটা দেখিয়ে বলে…..
–“সরি ভাবি। আসলে ফোনটা আর পার্স ভুলে মলে ফেলে এসেছিলাম। কিন্তু কোন দোকানে ফেলে এসেছি ভুলে গেছিলাম। তাই আবারও ব্যাক করতে হলো। সারা দোকান খুঁজে খুঁজে অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি কি একা রেস্টুরেন্টে ঠান্ডা খাবার ইনজয় করলে নাকি?”
–“তেমন কোনো ব্যাপার নয়।”

অনিন্দিতা খেয়াল করে ঐশানীর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। তার বাম গালে লাল দাগ পড়ে গিয়েছে।
–“তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন? আর তোমার গালে কীসের দাগ? কি হয়েছে?” (চিন্তিত হয়ে)
–“তেমন কিছু না। বাড়ি যাব চলো। সেখানেই একবারে বিশ্রাম নেব গিয়ে।”
অনিন্দিতা আরো কিছু বলতেই অভয়কে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে দেখে। জোরে ডেকে বলে…..
–“আরে ভাইয়া? তুই এখানে?”
হকচকিয়ে উঠে তাকায় অভয়। ঐশানীর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে…..
–“হুমম তো কেমন হলো তোদের শপিং?”

–“হুমম ভালো হয়েছে। কিন্তু তুই এখানে কি করে?”
–“এমনিই এসেছি। একটা কাজে।”
ঐশানী অস্বস্তি বোধ করে দ্রুত বলে…..
–“অনিন্দিতা বাসায় যাবে না? আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি গাড়ি ডেকে নিচ্ছি।”
ঐশানীর অদ্ভুত ব্যবহার দেখে সরু চোখে একবার একবার করে ঐশানী আর অভয়কে দেখে নেয় অনিন্দিতা। সে আন্দাজ করতে পারে তাদের মাঝে কিছু হয়েছে। ঐশানী দ্রুতই গাড়ি ডাকতে যায়। অভয়কে পেয়ে অনিন্দিতা সরাসরি জিজ্ঞেস করে…..
–“কি হয়েছে রে তোদের?”
–“কিছু না। আমার অফিসে কাজ আছে আমি যাচ্ছি। আর বাড়িতে যাস সাবধানে।”
অভয়ও কেমন যেন এড়িয়ে চলে যায়। অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনকে বোঝার চেষ্টা করে।

চলবে……