ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-০৩+০৪

0
219

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০৩+০৪

অন্ধকারে দেখলাম আপা পায়ের কাছের জানালায় দাঁড়িয়ে। জড়োসড়ো হয়ে! ফিসফিস করে রাফি ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। বুকের ভেতর জ্বলুনি শুরু হলো আমার। এই অন্ধকার রাতে ভয়ঙ্কর এক সত্য আবিষ্কার করলাম। রাফি ভাই আর সেজো আপা একে অপরকে ভালোবাসে। এতদিন কেন বুঝতে পারিনি আমি? নিজেকে বড্ড বোকা মনে হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরোনো দিনগুলো। সত্যি তো! রাফি ভাইয়ের দৃষ্টি সবসময় সেজো আপার দিকে ছিল। অথচ তার প্রেমে আমি এতটা অন্ধ ছিলাম যে কিচ্ছুটি বুঝতে পারিনি।

সেজো আপা আর রাফি ভাই সমবয়সী। ছোটবেলায় একসাথে পড়াশুনা করেছে। তাদের সাথে আরো একজন ছিল। আমার মেজো আপা। আমার আরেকজন ভালোবাসার মানুষ। আপার কথা মনে পড়তে কষ্ট আরো বেড়ে গেল। মেজো আপা আর সেজো আপা জমজ ছিল। মেজো আপার জন্মের মিনিট বিশেক পর নাকি সেজো আপার জন্ম। আব্বার মুখে এসব কথা শোনা। মেজো আপা আর সেজো আপা সমানে সমানে বড়ো হচ্ছিল। বাড়িতে তখন হৈ হুল্লোর লেগে থাকতো। তারা প্রাইমারি স্কুল পাশ করেছে তখন। মায়ের কথামত আব্বা দুই বোনকে হাই স্কুলে পাঠাল। তখন আমার বয়স নয় কি দশ। এক বৃষ্টির দিনে মেজো আপা একা স্কুল থেকে ফিরছিল। পথে কি হলো জানি না। পরদিন আপাকে দূরের এক ধানক্ষেতে মৃত পাওয়া গেলো। তখন ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝি আপার সাথে কি হয়েছিল। আপা আমার এক বুক দুঃখ নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছিল। তার সেই দুঃখের কিছু অংশ আমাদের পরিবারে অভিশাপ হয়ে নামে। আমরা আর ভালো থাকতে পারিনি। দুই দন্ড সুখে থাকতে পারিনি।

মেজো আপার ঘটনার পর আব্বা সেজো আপাকে আর স্কুলে পাঠায়নি। কিন্তু আপা রাফি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখে গেছে। ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো আমার। দেহের ভেতর ক্রমাগত সূচ ফুটছে। বুক ফুঁড়ে কান্না বের হতে চাইলো। আমার পনেরো-ষোলো বছরের জীবনে এত দুঃখ পাইনি যেন। কি যে কষ্ট হতে লাগলো! কিন্তু এখন তো কান্না করা যাবে না। আপাকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। হাতের আঙ্গুল কামড়ে মরার মতো পরে রইলাম আমি।

জানালা বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে রাফি ভাই কি যেন বললো। সেজো আপা চাপা সুরে হেসে উঠলো। আহা! বাচ্চাদের মতো কি প্রাণবন্ত হাসি। এতো এতো দুঃখ, মলিনতার ছাপ পড়েনি সে হাসিতে। কান পেতে শুনলাম সে হাসি। শেষ কবে আপাকে হাসতে দেখেছিলাম ভুলে গেছি। আপার হাসি কি সুন্দর! আচ্ছা, রাফি ভাই কি আপার হাসির প্রেমে পড়েছিল?

সেজো আপা এসে পাশে শুয়ে পড়েছে। আমি ঘুমের ভান ধরে পরে আছি। কিছুক্ষণ পর আপা ডান হাতটা আমার পেটের উপর রাখলো। আপা এখনো চাপা সুরে হাসছে। তার সেই হাসিতে ক্ষণে ক্ষণে শরীর দুলে উঠছে। খুব দ্রুত আপা ঘুমিয়ে পড়ল। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। তার এপাশে আমার সদ্য ভাঙ্গা হৃদয়ের দেহটা পড়ে রইলো!

________

পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একমাত্র আমার আব্বা ছিল। আব্বার একার আয়ে কোনো রকমে দিন চলতো। আব্বা চলে যাওয়ার পর সংসারে ধ্বস নেমে এলো অল্প দিনেই। পুতুলের দুধ কেনার টাকা নেই। ঘরে চাল কেনার টাকা নেই। দু চারজনের কাছে ধার চাইতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হলো মাকে। উল্টো যারা টাকা পেতো তারা রোজ আসা শুরু করলো। একটুখানি বাড়ি! সেটাও ছাড়ার হুমকি ধামকি দেওয়া শুরু করলো। মা অসহায় ভাবে তার বাবার বাড়িতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। মায়ের দিকের, না বাবার দিকের! এই দুর্দিনে কোনো দিকের আত্মীয় স্বজন পেলাম না। আগে থেকেই কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল না। আব্বার ঘটনার পর সবাই আরো মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এমনি এক দুঃখের দিনে একটা কাগজ এলো। দেখলাম ডিভোর্স পেপার। বড় আপার স্বামী ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। সাথে আরো জানতে পারলাম, ইতোমধ্যে সে আরেকটা বিয়েও করে ফেলেছে।

সেজো আপার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে দিন দুই হলো। সে খবর মা হজম করে নিয়েছিল। কিন্তু বড় আপার এত বড় দুঃসংবাদ মা মানতে পারলেন না। উঠোনে গড়াগড়ি করে কাঁদলেন। তাকে সঙ্গ দিলো বড়ো আপা। আপার পেট উচুঁ হয়ে গেছে। গর্ভের সন্তান দিন কে দিন বেড়ে উঠছে। বড় হচ্ছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আসার জন্য তার সে কি তোড়জোড়!

মায়ের কান্না দেখলে সবাই কাঁদে। বড় আপা কাঁদে, আমি কাঁদি, পুতুল কাঁদে। এমনকি আকাশ-বাতাস, প্রকৃতি কাঁদে। শুধু কাঁদে না সেজো আপা। আমার সেজো আপা খুবই কঠিন। দুঃখ পায় না, কষ্ট পায় না, ব্যথা পায় না যেন! অনুভূতিহীন পাথরের মতো আচরণ করে সবসময়। এই পাথরসম মন নিয়ে আপা রাফি ভাইকে ভালোবাসলো কি করে? নাকি সব অনুভূতি রাফি ভাইকে দিয়ে আপা এমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে!

ঘরের এক কোণে বসে অশ্রু নির্গত করছিলাম আমি। সেজো আপা পুতুলের হাত ধরে ঘরে এলো। বাহিরের উঠোনে মা আর বড়ো আপার কান্না তখনও থামেনি। সেজ আপা কাছে এসে পুতুলকে এগিয়ে দিল। বলল,

‘পুতুলের কান্না থামা তো।’

দ্রুত চোখ মুছে ফেললাম আমি। কাছে টেনে নিলাম পুতুলকে। আপার বের হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু আপা বের হলো না। আমাকে অবাক করে দিয়ে পাশে বসে পড়লো। গা ঘেঁষা স্বভাব নেই আপার। একা থাকতে পছন্দ করে সবসময়। সেজন্য বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কিছু বলবে আপা?’

‘জুঁই, তোকে যদি দুটো অপশন বলা হয়। সবচেয়ে সহজ মৃত্যু অথবা এই কঠিনতর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা। কোনটা পছন্দ করবি?’

‘বেচেঁ থাকা আপা। বেচেঁ থাকা কঠিন নয়। বেচেঁ থাকা সবচেয়ে সুন্দর আর সহজ পথ।’

আপা হাসলো। কেমন অদ্ভুত সে হাসি। ক্ষনিকের জন্য গা শিউরে উঠলো আমার। আপা বললো,

‘বেচেঁ থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। তুই বেচেঁ আছিস মানে তোকে অবশ্যই দুঃখ সইতে হবে। জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করতে হবে। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ এবং সুন্দর মুহূর্ত হচ্ছে প্রেমে পড়া। তুই যখন কাউকে ভালোবাসবি বা প্রেমে পড়বি, তখন বেঁচে থাকার মতো কঠিন কাজ সহজসাধ্য হয়ে পড়বে। জীবনে যত কষ্ট থাকুক না কেনো উপলব্ধি করতে পারবি না!’

প্রবল দুঃখ বোধে মন ছেয়ে গেলো আমার। আমি জানি প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর মুহূর্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। সারাদিন যত কষ্ট পেতাম, গালিগালাজ শুনতাম। দিনশেষে রাফি ভাইয়ের মুখটা এক নজর দেখলে মন ফুরফুরে হয়ে যেত। এ ধরায় শ্বাস নেওয়া সার্থক মনে হতো।

‘তবে জানিস জুঁই?’

আপার দিকে তাকালাম আমি। আপার মুখটা অন্ধকার মনে হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপা বললো,

‘আমি আগে এমনটা ভাবতাম বুঝলি! কিন্তু আরো বড়ো হওয়ার পর বুঝলাম, প্রেম, ভালোবাসা সব আপেক্ষিক। শুধুমাত্র দুঃখটা চিরস্থায়ী। কষ্টটা চিরস্থায়ী। তুই যতদিন বেঁচে থাকবি, এগুলো তোর পিছু ছাড়বে না। বেচেঁ থাকা সত্যি কঠিন। তোর মনে আছে? ছোটবেলায় আমি কতবার পুকুর পাড়ের নারকেল গাছে উঠার চেষ্টা করেছি! কখনো পারিনি। অসাধ্য মনে হতো। এখন বেচেঁ থাকা আমার কাছে নারকেল গাছে উঠার মতো কঠিন মনে হচ্ছে!’

‘তবুও বেঁচে থাকা সুন্দর।’

বিড়বিড় করে বললাম আমি। আপা শুনতে পেলো না হয়তো। এলোমেলো ভাবে পা ফেলে বের হয়ে গেলো।

__________

মা আজ মাংস রান্না করেছে। পাতিল ভর্তি করে ভাত রান্না করেছে। আমার সবগুলো বোনকে পাশে বসিয়ে পেট পুড়ে খাইয়েছে। একবার নিচু স্বরে টাকার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে। ঠিকমতো উত্তর দিতে পারেনি মা। শুধু বলেছে, জমানো ছিল!

খাওয়া শেষ করে ঘরে বসেছিলাম। মা গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে এলো। ছোটবেলায় পর্যাপ্ত দুধ খেতে পারিনি। সেজন্য দুধের প্রতি আমার আলাদা আকর্ষণ। উৎফুল্ল হয়ে গ্লাস ছিনিয়ে নিলাম। চুমুক দেওয়ার আগ মুহূর্তে সংবিৎ ফিরলো। গ্লাস হাতে রেখে বললাম,

‘এতো দুধ আমি খাবো মা?’

‘হ। তুই খাবি! একসের দুধ জ্বাল দিছি। খাইয়া ফেল সব।’

‘পুতুলের হবে তো?’

‘হইবো। তুই খা!’

‘আমি উঠোনে বসে খাই।’

মা প্রথম দিকে বাঁধা দিলো। পরমুহুর্তে কি মনে হতে বললো,

‘যাহ! উঠানে বইসা খা।’

আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মা হয়তো ভয় পাচ্ছে আমি দুধ ফেলে দিবো কিনা! পাগল নাকি! দুধ ফেলার জিনিস? দুধ আমার কতটা প্রিয়। প্রিয় জিনিস ফেলতে আছে? না, নেই!

আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। তার রূপালী আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমস্ত গ্রাম। গাছের পাতা ঝকঝক করছে। বাইরে হিমশীতল বাতাস। বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। আমি চাঁদের আলোয় পা রেখে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুকুর পাড় পরিষ্কার। চাঁদের আলোয় চারিদিক দিনের মত আলোকিত। হালকা ঘাসের উপর বসে পড়লাম আমি। প্রায় রাতে এখানে বসে থাকা হয়। রাফি ভাইয়ের সত্য উদঘাটনের পর আসা হয়নি। আজ আসতে প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেল। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লো।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্কুল থেকে ফেরার পথে এক দুপুর বেলা ঝড় উঠে এলো। ঝড় এসে দিনকে রাত বানিয়ে দিল মুহূর্তে! প্রকৃতিতে বেপরোয়া ভাব। বৃষ্টি পড়ছিল তুমুল বেগে। সেই ভয়াবহ ঝড়ের দুপুর বেলা দেখা হলো রাফি ভাইয়ের সাথে। সে-ও স্কুল থেকে ফিরছিল। আমাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো। আধভেজা বইগুলো নিজের কাঁধব্যাগে নিয়ে নিল। তারপর আমার হাত ধরে দিলো ছুট! সেই ঝড়ের দিনে আবারো তাকে মন দিয়ে ফেললাম।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই একটা মানুষকে আমি চিনি। আমার সমস্ত চিন্তা জুড়ে শুধু একজন ছিল! যার আমার হওয়ার কথা নয়। এর চেয়ে কষ্টের কিছু আছে?

বিড়ালের ডাকে ঘোর কাটলো আমার। সাদা রঙের বিড়ালটা গা ঘেঁষছে। গলার স্বর রিনরিনে। ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে ওকে। কয়েক বার চিন্তা করে দুধের গ্লাসটা ওর মুখের কাছে দিলাম। পেট কানায় কানায় পরিপূর্ণ আমার। ওর হয়তো সারাদিন খাওয়া হয়নি। খুদার জ্বালা জানা আছে আমার। বিড়ালটা চুকচুক করে খাওয়া শুরু করেছে। এক ফাঁকে মুখ উচুঁ করে আমার দিকে তাকালো। চাঁদের আলোতে ওর কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টি দেখতে পেলাম।

এরপর কতক্ষণ কেটে গেছে ধারণা নেই। রাফি ভাইদের রান্নাঘরের আলো বন্ধ হতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিড়ালের খাওয়া শেষ। মুখ ভার করে বসে রয়েছে। আমি খালি গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরে আসলাম। ঘর থেকে মায়ের গোঙানির আওয়াজ আসছে। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো আমার। হাতের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে মায়ের কাছে গেলাম। মায়ের মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে। মা কেমন মোচড়ামুচড়ি করছে। মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। দেখে বুঝতে পারছি মায়ের ভীষন কষ্ট হচ্ছে। মাকে জড়িয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম।

‘মা কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? মা কথা বলো! মা?’

মা কথা বললো না। কয়েক মিনিটের মধ্যে মা নিস্তেজ হয়ে এলো। শরীর টান টান হয়ে গেলো। মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। হাত পা কাঁপছে আমার। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বড় আপাকে ডাকলাম। সেজো আপাকে ডাকলাম। কেউ এলো না। এতক্ষণে খেয়ালে এলো আমার। ঘরের এদিক ওদিক আপারা অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে। বড় আপার বুকের ওড়না ঠিক নেই। অথচ আপা কখনো মাথার কাপড় ফেলতো না। দৌঁড়ে আপার কাছে গেলাম। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ডাকলাম। আপা শুনলো না। সেজো আপাকে ডাকলাম। আপা প্রতিত্তর করলো না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম, পুতুল বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে দুধের বাটি পড়ে আছে। চামচটা পুতুলের হাতে আঁকড়ে ধরা এখনো। ঠোঁটের কোণে ফ্যানার স্তূপ নিয়ে ও চিরনিদ্রায় চোখ বন্ধ করেছে।

এক চিৎকার দিয়ে আমি উঠোনে পড়লাম। দিন দুনিয়া ঘুরছে। মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়ে গেছে। হৃদপিন্ডে কি যেনো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। তার প্রতি ঠোঁকরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। শ্বাস আটকে আসতে চাইছে বার বার। চোখ বন্ধ করার আগ মুহূর্তে দেখলাম, আশপাশের সবাই বাড়িতে ঢুকছে। তাদের সবার সামনে রাফি ভাইয়ের চিন্তিত মুখ দেখা গেল। চোখ আপনা-আপনি স্মিত হয়ে এলো! আমি অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড় করলাম,

‘আমার ভালবাসার মানুষগুলো তীব্র অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে গেলো। তোমরা কেউ দেখলে না। কেউ নাহ!’

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০৪

আমি অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড় করলাম,

‘আমার ভালবাসার মানুষগুলো তীব্র অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছাড়লো। তোমরা কেউ দেখলে না। কেউ নাহ!’
___________

চোখ মেলতে দেখি ভোরের আলো ফুটে গেছে। চারপাশে চেঁচামেচি আর শোরগোলের আওয়াজ। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আশপাশের দুই তিন গ্রামের মানুষ চলে এসেছে। বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা নেই। আব্বা নতুন বউ আনার পরো এত মানুষ হয়েছিল না। আজ পরিচিত অপরিচিত মানুষ দিয়ে বাড়ি ভর্তি। আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। এতো মানুষ কেনো বাড়িতে? ঐতো মায়ের দূর সম্পর্কের বোন টা দাড়িয়ে আছে। সবার চোখ মুখ এমন শুকনো কেন! বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি।

বারান্দার ছোট্ট খুপড়িতে আছি। আমাকে ঘিরে জনা-দশেক মানুষ। মাথার উপরে স্যালাইন ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। আমাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে? কখন? আর কেন? আচমকা মস্তিষ্ক খোলাসা হলো আমার। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দৌঁড়ে বড় ঘরের দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে চোখের সামনে দেখতে পেলাম চার-চারটে লাশ। মাটিতে শায়িত। হিতাহিত বোধশূণ্য হয়ে গেলাম যেন! দৌঁড়ে মায়ের কাছে যেতে যেতে বললাম,

‘মাকে মাটিতে শুইয়ে রেখেছ কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো। মায়ের শ্বাসকষ্ট আছে! সর্দি হলে মা শ্বাস নিতে পারে না।’

মায়ের শরীর স্পর্শ করে শিউরে উঠলাম আমি। ঠান্ডা বরফের মতো হয়ে গেছে। কেমন যেন থমকে গেলাম। একে একে বড় আপা, সেজো আপাকে স্পর্শ করলাম। সবার শরীর এতো শীতল কেন? এক লাফে পুতুলের কাছে গেলাম। পুতুলের শুকনো ঠোঁট জোড়া হালকা প্রসারিত। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যে মিষ্টি কোনো স্বপ্ন দেখে হাসছে। ঘুমানোর আগে এক বাটি দুধ পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিল নিশ্চয়ই! আহারে পুতুল। আমার পুতুল!

বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো আমার। দুনিয়া এতো নিষ্ঠুর কেন! তবে কি সেজো আপার কথা সঠিক? বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন? তা না হলে মা সবাইকে নিয়ে আত্ম’হ’ননের পথ বেছে নিলো কেন! হুট করে বুকের ভেতর বিপুল শূন্যতা অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম আমার এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। এই যে চারপাশের এত লোকজন! এদের কেউ আমার আপন নয়। কেউ আমার ভালবাসা নয়। আমার প্রিয়জন নয়! সন্ধ্যা মেলাবার আগে আগে সবাই চলে যাবে। পালিয়ে যাবে। আমার কি হবে এখন?

কয়েক জন ধরে রেখেছিল আমায়। তাদের থেকে ছুটে দৌঁড়ে পুকুর পাড়ে গেলাম। বাঁকানো হিজল গাছটার গোড়ায় সাদা বিড়ালটা মরে পড়ে আছে। কাল রাতে এখানেই খেতে দিয়েছিলাম ওকে। বেচারা আর নড়বার সুযোগ পায়নি। আহারে জীবন! হাঁটু ভাঁজ করে ওর পাশে বসে পড়লাম। গায়ে হাত বুলাতে মন বলে উঠলো,

‘আমার মৃত্যুটা এভাবে নিজের করে কেন নিলি? এখন আমি এই পৃথিবীতে একা বাঁচবো কি করে? কি করে!’

কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো শুধু। আর কাঁদলাম না। কান্না পেলো না আমার। লোকজন ধরে উঠোনে নিয়ে এলো। আমি রান্নাঘরের এক কোনায় বসে সবকিছু দেখতে লাগলাম। নিজেকে কেমন অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। চারপাশের এতো কান্না, আহাজারি, লোকজনের আহা উঁহু কিছুই স্পর্শ করছিল না আমায়। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখলাম।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের জিপ আসলো। তাগড়া তাগড়া কয়েকজন পুলিশ এসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো। আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। আমি উত্তর দিলাম না। ঘৃণায় দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। এতদিন এরা কোথায় ছিল? যখন আমরা দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছি। পুতুল তার স্বরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। বড় আপাকে এত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এতদিন তারা কোথায় ছিল যখন আমাদের সাথে একের পর এক অন্যায় হচ্ছিল! কোনো উত্তর দিলাম না পুলিশকে। তাদের ডেকে নিয়ে গেলো রাফি ভাইয়ের বাবা জাকির কাকা। জাকির কাকার সাথে কি কথা হলো জানি না। অনেক তর্ক বিতর্কের পর পুলিশ চলে গেলো। সন্ধ্যার পর পর গ্রামবাসী কবর খুঁড়ে ফেললো।

গোসলের পর আমি শুধু সেজো আপাকে দেখলাম। সেজো আপার ভালো নাম জ্যোতি। আব্বা ময়না বলে ডাকতো। বোনদের মধ্যে আপাকে আমি বেশি ভয় পেতাম। আপার ভয়ংকর রাগ। এই রাগসহ আপা আমার কত আপন ছিল। ভালবাসার ছিল! আমার ভালোবাসার ময়না সাদা কাপড় জড়িয়ে শুয়ে আছে। আমার আপার চেহারায় কত অভিমান জমানো। বেচেঁ থাকতে এই অভিমান সে সযত্নে লুকিয়ে রাখত। আজ আপার কোনো লুকোচুরি নেই। সে যেনো পৃথিবী বাসীকে বলছে, দেখো আমি কত অভিমান নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তোমরা কেউ খোঁজ নেওনি!

আমার সমস্ত অভিমান গিয়ে মায়ের উপর জমলো। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম মা কম কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছাড়েনি! আমি রাফি ভাইকে নিয়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিলাম বলে মায়ের কষ্ট উপলদ্ধি করিনি। জন্মের পর থেকে মা যুদ্ধ করছে। বেঁচে থাকার জন্যে লড়াই করছে। পর পর কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় কত লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়েছে। আব্বার হাতে জখম হয়েছে। আব্বার লাঠির আ’ঘাতে পাঁজরের হাড় ভাঙ্গার পরও মা হাল ছাড়েনি। জীবনযুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করেনি। আজ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমার মা নিরুপায় হয়ে নিয়েছিল। মা যে ইতোধ্যে হাজার বার ম’রে গেছে!
রাত হতে না হতে আমার ভালবাসা গুলো চোখের আড়ালে চলে গেলো। তাদের দূরে কবর দিয়ে এলো। প্রিয়জনদের আমার অলক্ষ্যে রেখে আসলো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু। কিচ্ছু করতে পারলাম না। কয়েক ফোঁটা চোখের জলও ফেললাম না। এতো নিষ্ঠুর কেন আমি?

সেদিনের রাতটা কি বিভীষিকাময় কাটলো। আমার নতুন মা এলো পরদিন। বাড়ি তখন সুনসান। কয়েক জন স্বজন ছাড়া কেউ নেই। নতুন মা এসে আমায় সান্ত্বনা দিলেন। আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। এক ফাঁকে বললাম,

‘আমি ঠিক আছি। আপনার কিছু বলতে হবে না!’

সে তবুও থামলো না। আমার কাছ ঘেঁষে এসে বলল,

‘তুমি কি ভয় পাচ্ছো জুঁই?’

‘ভয় কেন পাবো? আশ্চর্য! আর কাকে ভয় পাবো?’

‘নতুন মা কিছুক্ষণ উসখুশ করল। পরে বললো,

‘এ বাড়িতে তোমার একা থাকা নিরাপদ না জুঁই। বুঝছো? তোমারে আমার সাথে নিয়ে যাবো ভাবতেছি। কি বলো?’

‘আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকবো।’

বলে সরে এলাম আমি। তখনও বুঝতে পারিনি, এই জীবনে ঠিক কি কি হারিয়ে ফেলেছি আমি!

___________

এতগুলো প্রাণ চলে গেলো দুনিয়া ছেড়ে। এক রাতের বিনিময়ে। অথচ তাতে পৃথিবীর কিচ্ছু হলো না। রোজকার মত সকাল হতে লাগলো, পাখিরা কিচির মিচির শুরু করলো। দখিনা হাওয়া বইতে লাগলো। দু-চারদিন কানাঘুষা করে গ্রামবাসী থেমে গেলো। তাদের কাছে সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। শুধু আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন। সবকিছু আগের মতো থেকেও আমার চারপাশে কি যেন নেই! বাতাসে মায়ের গায়ের গন্ধ নেই। হুটহাট পুতুলের কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না এখন। বড়ো আপা ঘোমটা খুলে আর ডেকে উঠে না। সেজো আপার গা ছাড়া স্বভাব আর চাইলেও দেখতে পাই না। এই এতো এতো শুন্যতা আমার ছোট্ট হৃদয় আস্তে আস্তে উপলব্ধি করতে লাগলো।

আব্বা এলো বেশ কিছুদিন পর। এতদিন অনেকটা পলাতক ছিল। পুলিশ নাকি আব্বাকে খুঁজেছে। তার জন্য পালিয়ে পালিয়ে ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আব্বা লুকিয়ে এলো। আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আব্বার প্রতি আমার ঘৃণার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতটা বেড়ে গেছে যে আমি তার মুখ পর্যন্ত দর্শন করলাম না।

রাতের বেলা বারান্দার খুপড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রাফি ভাই আসছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি বিভ্রম মনে হলো আমার। পরে দেখি নাহ! সত্যি রাফি ভাই এসেছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে আব্বা বেরিয়ে এলেন। তাড়াহুড়ো করে এসে তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ বিমূর্ত রইলাম। আব্বা রাফি ভাইকে কেন ডেকেছে কারণ উদঘাটন করতে পারলাম না।

সময় বয়ে যাচ্ছে। ওপাশের ঘরে কি কথা হচ্ছে জানা নেই আমার। কিছুক্ষণ এ ঘরে ছটফট করে বের হলাম। উচিত-অনুচিতের তোয়াক্কা না করে ভেড়ানো দরজার এপাশে কান রাখলাম। আব্বা কয়েক মিনিট এ কথা, সে কথা বললেন। হুট করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘বাবাজী তুমি কি জুঁই মাকে পছন্দ করো? ওরে বিয়া করতে পারবা?’

দরজার এপাশে বুক দুরুদুরু বেড়ে গেলো আমার। সেই সাথে আব্বার উপর রাগ হলো। আব্বা কি বলছে এসব? ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও মনের কোনো একটা অংশ রাফি ভাইয়ের উত্তর শুনার জন্য অপেক্ষায় রইলো। রাফি ভাই দীর্ঘ সময় নিল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘চাচা আমি আপনার সেজো কন্যা জ্যোতিকে পছন্দ করতাম। ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। কি এক অঘটন ঘটে গেলো।’

রাফি ভাইয়ের কণ্ঠে দুঃখ ফুটে উঠেছে। কাছের কেউ, আপন কেউ হারানোর দুঃখ। কিন্তু আব্বা হাল ছাড়লেন না। বললেন,

‘যা হইবার তা তো হইয়া গেছে। জ্যোতি মা তো আর ফিরা আইবো না। তুমি বাজান আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিতে পারবা? বাচ্চা মেয়ে আমার! জীবনটা উলোট-পালোট হইয়া গেছে। বহুত কষ্ট পাইতেছে। তুমি রাজি থাকলে আমি আইজ রাইতেই তোমার আব্বার লগে কথা কমু। তোমার আব্বা আমার বন্ধু মানুষ। ওরে তোমার হাতে তুইলা দিলে আমি এট্টু নিশ্চিন্ত হই।’

‘চাচা মাফ করবেন। আমি পারবো না। জুঁইকে আমি অন্য নজরে কখনো দেখি নাই।’

আমি আর দাঁড়ালাম না। ছুটে ঘরে চলে আসলাম। যা শোনার, যা বোঝার তা হয়ে গেছে আমার।

_________

লোকমুখে শুনতে পেলাম আব্বা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। বাড়ি ছাড়া গ্রামে আমাদের আর কোনো সম্পদ ছিল না। বাড়ি বিক্রির সব কথা কানে এসেছে আমার। কিন্তু প্রতিবাদ করিনি। কেন করবো? কার জন্য করবো? এই বাড়িতে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল! আমি এই বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, পরিচিত মানুষ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাই। এই জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাই। দূরে, বহুদূরে!

আব্বা বেশ কিছুদিন হলো আমার সাথে এ বাড়িতে থাকে। একদিন নতুন মা এলো। পরদিন ভোরবেলা মা-বোনদের কবর জিয়ারত করা হলো। বিকেলবেলা নতুন মা আমায় কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিতে বললো। বুঝতে পারলাম, পুরোনো স্মৃতি ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সেদিন রাতের আঁধারে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। প্রিয় জায়গা ছেড়ে, প্রিয় মানুষগুলো ছেড়ে! শেষ বারের মতো পুকুর পাড় থেকে রাফি ভাইয়ের বাড়ির দিকে তাকালাম। রাফি ভাই বারান্দা দিয়ে একবার হেঁটে গেলো। পূর্বের মত এবারো টের পেলো না কেউ একজন তাকে দেখে চোখের শান্তি মেলালো। শেষবারের মতো!

আমি সম্মুখে পা রাখলাম। আমার পনেরো বছরের সমস্ত আবেগ, হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আর প্রিয় মানুষগুলোর সমস্ত স্মৃতি ফেলে রেখে এগিয়ে চললাম। এতটুকু দুঃখ পেলাম না, কষ্ট পেলাম না। কাঁদলাম না! পাথর হয়ে গেছি যেন। আমার শুকনো চোখের নদীতে জোয়ার আসলো খানিক পরে। অবশেষে মায়ের কবরের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বুঝতে পারলাম, আমার ভালবাসারা ভালো নেই!

(চলবে)