ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-০৫+০৬

0
163

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা অহি
#পর্ব-০৫+০৬

অবশেষে মায়ের কবরের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বুঝতে পারলাম, ‘আমার ভাল বাসারা ভালো নেই!’

__________

অনেকটা রাত! ঘন অন্ধকার আকাশ। গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে গিয়ে আব্বা আর নতুন মায়ের ঝগড়া লেগে গেলো। বিধ্বস্ত মস্তিষ্ক আমার। এতক্ষণ তাদের কথোপকথন কিছু খেয়াল করিনি। আব্বা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠতে তাকালাম। নতুন মা-ও চুপচাপ রইলো না। প্রচন্ড রেগে গেলো। কিছুক্ষণ দৃষ্টিপাত করে বুঝতে সক্ষম হলাম ঝগড়া লেগেছে আমাকে নিয়ে। আমার থাকার জায়গা নিয়ে। নতুন মা যেখানে নিয়ে যাবে আব্বা রাজি হচ্ছে না। কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে এরা?

ছোট মা হঠাৎ আরো বেশি রেগে গেলো।মুখ দিয়ে বিশ্রী কিছু শব্দ বের করে বললো,

‘কোথায় নিয়ে যাবি তুই? তোর হিম্মত আছে? ওরে কোথাও রাখার জায়গা আছে? নিজেই তো আমার ঘাড়ে চেপে বসে আছিস।’

আব্বা চুপ হয়ে গেল। আর কোনো উত্তর দিল না। মুহূর্তে আব্বার চরম অসহায়ত্ব প্রস্ফুটিত হলো। টের পেলাম আব্বার ছটফটানি। সারাজীবন মায়ের উপর ছুরি ঘুরানো মানুষটার উপর এখন অন্য কেউ ছুরি ঘুরাচ্ছে। অন্য কেউ তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ইশ! আমার অসহায় মাকে কতটা নির্যাতন করেছে এই মানুষটা। আব্বার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একটা ছেলে সন্তানের জন্যে কতো আকুলি বিকুলি করতো মা। শুধু আব্বার ভয়ে সর্বদা কতটা তটস্থ থাকতো। আহারে মা আমার!

গাড়ির আশপাশের কিছু মানুষ ইতোমধ্যে মাথা ঘুরিয়ে তাকানো শুরু করেছে। আমি আবার গাড়িতে মাথা এলিয়ে দিলাম। জানালা দিয়ে দৃষ্টি নিপাত করলাম বাহিরের ঘন কালো অন্ধকারে। বেশ বুঝতে পারছি বাহিরের ওই নিকষ কালো অন্ধকারের চেয়ে আমার জীবনের অন্ধকার আরো তীব্র। আরো ঘন!

গাড়ি থেকে নেমেছি অনেকক্ষণ হলো। হাতে ছোট্ট এক ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছি। নতুন মা আমার পাশে। আব্বা মুখ ভার করে পেছন পেছন আসছে। আস্তে আস্তে লোকালয় ছাড়লাম। এদিকটা ফাঁকা। বাড়িঘর নেই। সরু এক রাস্তা চলে গেছে বরাবর। রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত। কাছে মাঠের মত জায়গাটা আলোকিত। মানুষ দিয়ে গিজগিজ করছে। বিয়ে বাড়ির মতো চাদর দিয়ে সম্পূর্ণ মাঠ ঢাকা।

বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো আমার। নতুন মা কি আমাকে তার যাত্রাপালায় নিয়ে এলো? তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। সাথে আব্বা আর ছোট মা দুজনই দাঁড়িয়ে পড়লো। ছোট মা বুঝতে পারলো। ভরসা দিয়ে বললো,

‘তুমি যেমন ভাবছো এমন কিছু না মা। আসো আমার সাথে। ভয় নেই!’

একপ্রকার জোর করে সে ভেতরে নিয়ে গেলো। পুরো প্যান্ডেল মানুষ দিয়ে ভরা। উচ্চ শব্দে গান বাজছে। অদ্ভুত সব গান। নোংরামিতে ভরা। আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। নতুন মা গোপন এক পথ দিয়ে প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকলো। আমাকে নিয়ে গেলো টিন দিয়ে তৈরি ছাপড়ার দিকে। দুরুদুরু বুক নিয়ে ভেতরে গেলাম। আমাদের দেখে চারপাশ থেকে জেঁকে এলো সবাই। নতুন মায়ের সঙ্গী সাথীরা। যাত্রাপালার বাকি লোকজন। সবার পোশাক-আশাক দেখে গা গুলিয়ে উঠলো আমার। অজানা আতঙ্কে মন ছেয়ে গেলো।

মোটা কাপড় দিয়ে ঝুপড়ির মতো করা একটা কোণায় বসে রয়েছি আমি। নতুন মায়ের চাচাতো ভাই বলে পরিচয় দেওয়া লোকটা ঝুপড়ির ওপাশে ঘুরঘুর করছে। লোকটার চাহনি অসহনীয়! নিঃশ্বাস আটকে পরে রইলাম আমি। প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো। আব্বা এলো অল্প পরেই। এই মানুষটাকে আমি বিশ্রী ভাবে ঘৃণা করি। তবুও এই মুহূর্তে তাকে দেখে বুকে একটু সাহস পেলাম যেনো।

আব্বা এখানকার পরিচিত মুখ। সবাই আব্বাকে চিনে। বেশ বুঝতে পারছি আব্বার এখানে যাতায়াত নতুন নয়। বহু পুরনো। আব্বা হঠাৎ ফিসফিস করে বললো,

‘দোয়েল, মা। তোরে এইহানে রাখা যাইবো না। আমি যা কইতেছি তাই হুন। ভোরবেলা এইহান থেইকা পালায় যাব আমরা। এরা কেউ টের পাইবো না। সারারাত গান বাজনা করে ওরা ভোরের দিকে ঘুমায় যায়। তোর নতুন মা পরে জানলে জানবো। সমস্যা নাইকা!’

‘পালিয়ে কোথায় যাবো?’

উত্তেজিত কন্ঠে জানতে চাইলাম আমি। আব্বা ইশারায় চুপ করতে বললো। গলার স্বর আরো নিচু করে বললো,

‘তোর কিচ্ছু চিন্তা করতে হইবো না। সব ব্যবস্থা করছি আমি। ঢাকা যাবো আমরা।’

আর কোনো কথা হলো না। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বুক ফুঁড়ে ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো। ঢাকা! নাম শুনেছি কতবার। যাওয়া হয়নি কখনো। মাঝে মাঝে রাফি ভাইয়ের পরিবারকে যেতে দেখতাম। ঢাকায় নাকি তাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। ঘুরতে যেত তারা! ঢাকা নিয়ে আমার সুখস্মৃতি নেই। রাফি ভাইয়ের ঢাকা থাকার দিনগুলো ভীষন কষ্টে কাটত আমার। টানা কয়েক দিন তাকে চোখের দেখা দেখতে পেতাম না। কি দুর্বিষহ!

________

আব্বার সাথে যখন স্টেশনে নামলাম তখন দুপুর। অবশেষে ঢাকার মাটিতে পা রাখলাম। আজ প্রথম ট্রেনে ভ্রমণ ছিল আমার। এই ভ্রমণে যদি মা আর বোনেরা সাথে থাকতো কত মজা-ই না হতো! পুতুল হাত পা ছোড়াছুড়ি করতো খুশিতে। বড় আপা আর মা গল্প করতো জমিয়ে। ক্ষণে ক্ষণে বড় আপা শব্দ করে হেসে উঠতো। আপা বড্ড সহজ সরল ছিল। ছেলেমানুষী দিয়ে ভরা! বাচ্চাদের মত অল্পতে খুশি হতো।

আর সেজো আপা? সেজো আপা গম্ভীর মুখে বসে থাকতো। গম্ভীরতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা আপার উৎফুল্লতা শুধু আমি ধরতে পারতাম।

স্টেশনে আমার চারপাশ লোকে লোকারণ্য। রোগা, পাতলা, হ্যাংলার মতো এক বাচ্চা ছেলে এসে আমার ওড়না টেনে ধরলো। বায়না করলো টাকার। আব্বা ঝামটা দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে দিলো। ছেলেটা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আমি তার চেয়েও অসহায়ত্ব নিয়ে তাকালাম। কারণ আমার কাছে এক পয়সাও নেই! দৃষ্টি বিনিময় হতে ছেলেটা বুঝতে পারলো বোধ হয়। সময় ব্যয় না করে অন্যদের পেছন ছুটলো।

কিছুদূর গিয়ে আব্বা আমায় বসিয়ে দিলেন। পুরনো মডেলের বাটন ফোনটা কানে ধরে কাকে যেন হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন। আমি চেয়ে চেয়ে আব্বার ব্যস্ততা দেখছি। চোখে মুখে তার এখন চিন্তার ছাপ। ছুটোছুটি করছে ক্রমাগত। অথচ এই মানুষটা একটা গোছানো পরিবারকে হত্যা করেছে। আস্ত এক পরিবারকে গলা টিপে হত্যা করেছে। তার জন্য আমি মা হারা, বোন হারা! তার জন্য আমি আজ বাড়ি ছাড়া, প্রিয়জন ছাড়া। এই মানুষটার উপস্থিতি কি সহ্য করা যায়? করা যায় না! কিন্তু আমাকে করতে হচ্ছে। আর তো উপায় জানা নেই। আমি পাথরের খাঁজে আটকে পড়া মাছ। তড়পানো ছাড়া কিছু করার নেই।

কিছুক্ষণ পর আব্বা আমায় নিয়ে সিএনজি তে উঠলো। গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে দেখলাম এটা কমলাপুর স্টেশন। আজ প্রথম এই নামটা জানলাম।

গাড়ি চলছে। আব্বার সাথে আমার কথা বলা হয় না। আজ সারাটা পথ একটা কথা বলিনি। কিন্তু এখন তো জানতে হবে আমি কোথায় যাচ্ছি। এই মানুষটিকেও আমি বিশ্বাস করি না! আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। এক বুক দুঃখ লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোথায় যাচ্ছি আমি?’

আব্বা যেনো এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলেন। বড্ড খুশি হয়ে উঠলেন। ঝলমলে সুরে বললেন,

‘বড় এক বাড়ি তোমারে রাইখা আসতেছি। কোনো কিছুর কষ্ট হইবো না দোয়েল। ভালো ভালো খাবার খাইতে পারবা। শুধু টুকটাক কাম করবা আর খাইবা। কামও বেশি নাই। আরো লোক আছে। কোনো চিন্তা নাই তোমার। আমি মাঝে মাঝে আইসা খোঁজ নিয়া যাবো।’

আব্বা তুই থেকে তুমি করে বলছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। ঠোঁটে শুধু তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। এই ঢাকা শহর নিয়ে আমার দুচোখে কতো স্বপ্ন ছিল। রাফি ভাইয়ের সাথে আসবো। ঘুরবো! অথচ এই শহরে আমার জায়গা হলো কাজের মেয়ে হিসেবে। এই শহর আমাকে কাজের মেয়ে পরিচয় দিল।

আব্বা নতুন বাড়ির গুণ কীর্তন করছে। আমার সেদিকে মনোযোগ নেই। আমি চলমান গাড়ি দেখছি। পাশের লেন দিয়ে বড় বড় বাস, ট্রাক যাচ্ছে। একবার মনে হলো চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ি? তাহলে তো এই জীবনের, এই দুঃখ কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে! আব্বা পাশে তখনও বকবক করে যাচ্ছে। আচমকা অন্য এক চিন্তা এলো। হঠাৎ করে মনে হলো আব্বাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই? এই মানুষটার কি শাস্তি প্রাপ্য না?

আমি কিছুই করতে পারলাম না। কোনোটারই সাহস হলো না। ছোটবেলা থেকে ভীষণ ভীতু আমি। রাফি ভাইকে ভালোবাসা ছাড়া জীবনে আর কিচ্ছু করিনি। এই জীবন কি করে পাড়ি দিবো এখন?

গাড়ি থামলো। আব্বা আমায় সাথে নিয়ে হাঁটা ধরলো। কতক্ষণ হেঁটেছি খেয়াল নেই। অবশেষে বড়ো এক বাড়ির সামনে আব্বা থামলো। বাড়ি দেখে বুক দুরুদুরু শুরু হলো। সাথে প্রচন্ড ভয়। এই আমার চিন্তা জুড়ে রাফি নামক ছেলেটা ছাড়া আর কিছু ছিল না। এখন আমি কি করে এই ঝড় সামাল দিবো? কি করে এই শহরে একা থাকব? চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে গেল।

আব্বা ফোনে দুটো কথা বলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নতুন এক জীবনে পা রাখলাম আমি। ভেতর বাড়িতে ঢুকতে একঝাঁক অচেনা মানুষ নজরে এলো। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা আমায় কাছে টেনে নিলেন। তার হাসিমুখ দেখে কিছুটা স্বস্তি মিললো।

আব্বা দেরি করলেন না। তাকে আবার ফিরতে হবে। সোফায় বসে ছিলাম আমি। আব্বা কাছে এসে বললেন,

‘আমি যাই তাইলে দোয়েল।’

চমকে তাকালাম আমি। এতক্ষণ চেপে রাখা কষ্টগুলো যেনো কুঠুরি মুক্ত হলো। একের পর এক আঘাত হানলো বুকের দেয়ালে। আমি আর শক্ত থাকতে পারলাম না। ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। এখানে আমি একা থাকবো কি করে?

__________

আমার থাকার জায়গা হয়েছে রান্নাঘরের পাশের রুমটাতে। আমি একা নই। সাথে আরেকজন মহিলা আছে। কাপড় চোপড় রেখে রুমের বাইরে বের হলাম আমি। মন ভার হয়ে আছে। আব্বা চলে গেছে অনেক আগে। যাওয়ার আগে তিনি বলে গেছেন খোঁজ খবর নিবে। কিন্তু কেনো জানি আমার মন বলছে আব্বা আর খোঁজ নিবে না।

আশা ছেড়ে দিয়েছি। নিজেকে বুঝিয়েছি এই দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই। রক্তের কেউ নেই। দেখি জীবন তরী আমাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যায়। আরো কি কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

এ বাড়িতে সাজ সাজ রব। সবার মধ্যে উৎফুল্লতা। সবাই ছুটোছুটি করে কাজ করছে। ঘর দুয়ার পরিষ্কার করছে। আমি টিপে টিপে পা ফেলে ড্রয়িং রুমে আসলাম। সালেহা খালা মেঝে পরিষ্কার করছিল। সে-ও এই বাড়িতে কাজ করে। খালার সাথে কথা হয়েছে। আমি কাছে যেতে বললো,

‘তুমি আইজ ঘুমাও গা! শরীল অসুস্থ না?’

‘এখন ঠিক হয়ে গেছি খালা। মাথা ব্যাথা ছিল। সেরে গেছে। আমি কি কাজ করবো?’

খালা আমায় কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে নিচ তলা দেখালো। এ বাড়িতে লোকসংখ্যা অনেক। বড়সড় পরিবার। বাড়ির কর্তা বড় দুই ভাই! তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সবাই একত্রে বাস করে। ছোটবড় সব মিলিয়ে চার-পাঁচটা সন্তান। বয়স্কা দাদী আরো লোকজন দিয়ে ভরা। এতবড় বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিবো কি করে! আমি ভীত চেহারা নিয়ে নিয়তিকে দোষারোপ করছিলাম।

সালেহা খালা আমায় জিজ্ঞেস করলো,

‘রান্না পারোনি?’

আমি মাথা নাড়লাম। অসম্মতি জানিয়ে বললাম,

‘ভালো পারি না। শিখে নিব!’

‘বড় বু’র ছেলে আইছে বাড়িত। রান্না ভালো না হইলে খাইবো না। তুমি বরং ঘর মুছে ফেলো। আমি কুটাবাছা করে বু রে সাহায্য করি।’

মেঝে মোছার দায়িত্ব দিয়ে সালেহা খালা চলে গেলো। আমি এক বুক কষ্ট নিয়ে পানির বালতি হাতে তুলে নিলাম।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ০৬

মেঝে মোছার দায়িত্ব দিয়ে সালেহা খালা চলে গেল। আমি এক বুক কষ্ট নিয়ে পানির বালতি হাতে নিলাম। ঘুরে ঘুরে কাজ করছিলাম। টাইলস করা মেঝে কখনো পরিষ্কার করা হয়নি। সারাজীবন মাটির ঘরে কাটিয়েছি। ইদে ইদে ঘর লেপা হতো। পানি দিয়ে মাটি গুলিয়ে! আজ প্রথম মেঝে মোছার কাজ। দীর্ঘ সময় লেগে গেলো ড্রয়িং রুম সহ আশপাশ পরিষ্কার করতে। ক্লান্ত হয়ে সোফার পাশের প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। হঠাৎ চোখ গেলো চেয়ারের নিচে।

ঝলমলে সোনালি রঙের একটা আংটি পড়ে আছে। দেখে স্বর্ণের মনে হচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। বসার ঘরে কেউ নেই এখন। রান্নাঘরে সালেহা খালার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আংটি টা তুলবো নাকি তুলবো না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলাম। হুট করে অন্য এক প্রশ্ন মস্তিষ্কে উঁকি দিলো। আমাকে পরীক্ষা করার জন্য তারা আংটি ফেলে রাখেনি তো? এতবড় বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। দামী জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো। যে কেউ লুকিয়ে ফেলতে পারে। হয়তো পরীক্ষা করার জন্য আংটি টা স্বেচ্ছায় ফেলে রেখেছে। তা না হলে কারো আঙ্গুল থেকে আংটি খসে পড়েছে। অথচ সে বিন্দুমাত্র টের পায়নি!

আংটি টা হাতে তুলে নিলাম আমি। পরীক্ষা হোক আর না হোক! এই আংটি কখনো চুরি করতাম না। মা শেখায়নি। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। চরম দারিদ্র্যের মুহূর্তেও মা আমার অসৎ পথে চলা শেখায়নি। উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। সালেহা খালাকে ডেকে বললাম,

‘খালা, এই আংটিটা বসার ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল।’

সালেহা খালা এগিয়ে এলো। তার পেছন পেছন এলো বাড়ির বড়ো কর্তা গিন্নি। কাছে এসে আংটি টা নিয়ে ভীষণ খুশি হলেন তিনি। স্মিত হেসে বললেন,

‘এটা তো আমার। কখন আঙ্গুল থেকে পড়ে গেছে খেয়াল করিনি।’

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি নিজে থেকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তোমার নাম কি যেনো মা?’

‘জুঁই।’

‘ওহ্। তুমি আমাকে বড় মা বলে ডেকো। সামান্তা, জাবির, জাকারিয়া সবাই আমাকে বড় মা বলেই ডাকে। তুমিও ডেকো।’

কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে এলো আমার। চোখের কোণ ভিজে উঠলো। কিছু বলতে পারলাম না। শুধু মাথা নাড়লাম। সালেহা খালা গলা উচিয়ে ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম দেখলো। বললো,

‘মোছা শ্যাষ?’

আমি মাথা নেড়ে বললাম,

‘হুঁ। শেষ!’

সদ্য বড় মা বলে ডাকার অধিকার দেওয়া মানুষটা খালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘সালেহা তুমি বরং জুঁইকে জাকারিয়ার ঘরটা দেখিয়ে দাও। গুছিয়ে রাখুক! ওদের নানুবাড়ি থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। আর ফাইজানের ঘরটাও দেখিয়ে দিয়ো। পরিষ্কার করে রাখবে।’

‘আচ্ছা বু।’

সালেহা খালার পিছু পিছু রওনা হলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে খালা বললো,

‘বড় বুয়ের দেবর বাড়ির ছোট কর্তা। তার এক মাইয়া আর দুইডা পোলা। মাইয়াডা বড়ো। কলেজে পড়ে। পোলা দুইডা স্কুলে। আর বড়ো বুয়ের দুইডা পোলা শুধু। মাইয়া নাই। বড় পোলা বিদেশে পড়াশুনা করতে গেছে। আর ছোটো পোলা খুলনায় ইঞ্জিন নিয়া পড়ে। কিছুদিন হইলো ছুটিতে আইছে।’

খুলনায় ইঞ্জিন নিয়ে পড়াশুনা করার বিষয়টা ছাড়া বাকি সব বোধগম্য হলো। জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনি কতদিন হলো এ বাড়িতে আছেন খালা?’

‘বহুত দিন। আট-দশ বছর। বাপজান ছোট্ট বেলা বিয়া দিছিলো। জামাই বতরের সময় ধান কাটতে গিয়া মইরা গেলো। ঝড়ের দিনে বাজ পইড়া! তারপর আর বিয়া-সাদী করলাম না। বাপজান অনেক বুঝাইলো। কিন্তু মানুষটারে ভুলতে পারতাম না কিচ্ছুতেই। বড় ভালা মানুষ আছিলো তো! তাই আর বিয়া করা হয় নাই। আব্বা-মা যতদিন বাঁইচা ছিল গেরামে ছিলাম। একসময় তারা পরপারে চইলা গেলো। ভাইরা তখন আর ভাত দিলো না। বাধ্য হইয়া ঢাকাতে আইলাম। কাজ নিলাম। তারপর থিকা এইখানেই আছি।’

খালা থামলো। খালার কথা শুনে মন খারাপের তীব্রতা বেড়ে গেলো। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। যার নিজেরই এক সমুদ্র দুঃখ সে অন্যকে কি সান্ত্বনা দিবে!

‘এইডা জাকারিয়া বাবাজীর রুম। আর দক্ষিণের রুমডা ফাইজান বাবাজীর। গোছগাছ কইরা নিচে আসো। কিছু খাইয়া ঘুমায় যাও। আইজ আর কাজ নাই। আমাগো রান্নাবাটা শ্যাষ।’

খালা চলে গেলো। আমি ছবির মত সুন্দর এক রুমে ঢুকলাম। জাকারিয়া নাকি বাচ্চা মানুষ। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। অথচ তার জন্য আলাদা ঘর। কি সুন্দর!

জাকারিয়ার রুম নানা রকমের খেলনা দিয়ে ভর্তি। বেশ খানিকটা সময় লাগলো গুছাতে। সব মোটামুটি গুছিয়ে বের হয়ে এলাম। গেলাম দক্ষিণ দিকে। কিনারের রুমটার সামনে দাঁড়ালাম। বাহির থেকে দরজা বন্ধ ছিল। ভয়ে ভয়ে খুললাম। বর্তমানে এ বাড়ির বড় ছেলের ঘর এটা। দুরুদুরু বুকে ভেতরে পা রাখলাম। ভেতরে ঢুকতে ভয়ার্ত দু চোখে মুগ্ধতা এসে ভর করলো। রুমে কি ছিল বুঝতে পারলাম না। শুধু মনে হলো কোনো শীতল সমুদ্রে পা রেখেছি। দেয়ালের পেইন্টিং গুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। ছোট বেলায় টেলিভিশনে এগুলো দেখতাম। বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। দূরের এক চাচীর বাড়ি টেলিভিশন দেখতাম। কত বকাঝকা করতো তারা। মুখ কালো করে রাখতো। তবুও টিভি দেখার লোভ সামলাতে পারতাম না। মাটিতে বসেই দেখতাম। আজ যেনো সব চাক্ষুষ দেখছি।

এতো বড় রুম! চোখ ঝলসানো ডেকোরেশন। চারপাশ স্বপ্নের মতো সুন্দর। হঠাৎ চোখ গেলো বিছানার পাশের টেবিলটার উপর। বাঁধাই করা এক ছবি। ছবিতে একজন সুদর্শন যুবককে দেখা যাচ্ছে। আনমনে কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। তার উজ্জ্বল চোখ দুটো আমার পানে। ছবির স্থির চিত্রটি কেমন জানি জীবন্ত মনে হচ্ছে। ভারী লজ্জাবোধ হলো আমার। মনে হলো কারও অগোচরে তার ব্যক্তিগত জায়গায় এসে পড়েছি। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম।

বিছানা গুছানো ছিল। রুম পরিপাটি! আমি শুধু বালতিতে করে পানি নিয়ে মেঝে পরিষ্কার করলাম। রুমের সাথে লাগোয়া বড়ো বারান্দা। বারান্দায় অসংখ্য চারাগাছ আর ফুল লাগানো। এর বেশিরভাগ আমি চিনি না। শুধু গোল গোল পাতার গাছটা পরিচিত মনে হলো। গ্রামের পুকুর পাড়ের জঙ্গলে একদিন দেখেছিলাম। আর দাঁড়ালাম না। বারান্দা পরিষ্কার করে সরে এলাম।

_________

এর মধ্যে কয়েকদিন কেটে গেছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত কিছু মানুষদের পাশে নিয়ে আমার দিন কাটছে। এ কয়েক দিন অনেকটা ঘর বন্দি জীবন পার করেছি। শুধু ভোরে ঘুম থেকে উঠে খালার সাথে কাজ করি। একটু বেলা বাড়তে এ বাড়ির লোকজন সব নাস্তা খাওয়ার জন্য নিচে নামে। আমি তখন আড়ালে থাকি। খেয়ে দেয়ে তারা যখন সবাই কাজে চলে যায় তখন আবার কাজ করি। সবাই স্কুল, কলেজ, আর অফিস নিয়ে ব্যস্ত। এতো বড়ো বাড়িতে সারাদিন শুধু আমি, সালেহা খালা আর বড় মা থাকি। আরো একজন থাকেন। বড় মায়ের শাশুড়ি। তাকে অবশ্য আমি এখনো দেখিনি। তিনি কিছুদিন হলো মেয়ের বাড়ি ঘুরতে গেছেন। মোহাম্মদপুর! সেটা কতদূর আমি জানি না। তবে ঢাকার মধ্যে নাকি!

বড় মায়ের একমাত্র ছোট জা মাস্টারি করে। কলেজের মাস্টার। এতো সুন্দর তিনি! একদিন রাতের বেলা তারা সবাই খাচ্ছিল। আমি লুকিয়ে দরজার আড়াল থেকে দেখলাম। মানুষটাকে দেখে মনে হয় না তিন-তিনটা সন্তান! তার বড়ো মেয়ে সামান্তা। পরীর মত সুন্দর। যে একবার চোখ রাখবে তার চোখ ফেরানো মুশকিল। সারাক্ষণ ফিটফাট পোশাক পরে থাকে। মনে হয় বাইরে বের হওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছে। কিন্তু না! তার বাড়িতে পরার জামা কাপড় দারুণ সুন্দর। আর আমার পরণে সর্বদা সুতি কাপড়ের জামা পায়জামা। সেটাও রংচটা!

জাবির আর জাকারিয়াকে চিনে ফেলেছি। সবাইকে দেখা শেষ। জাকারিয়া ফুটফুটে এক বাচ্চা। আর জাবির? জাবির বড়সড়। বয়সে আমার সমান বা একটু বড় হবে। দশম শ্রেণীতে পড়ে। ঢাকার নামকরা স্কুলে নাকি। প্রতিদিন গাড়ি করে যায় তারা। কি রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার! হুট কর মন খারাপ হয়ে গেল। আমার কি আর স্কুল যাওয়া হবে না? কোনোদিন আর পড়াশুনা করা হবে না? তাপস সার সামনের মাসে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র পড়াতে চেয়েছিল। তা আর শেখা হবে না বুঝি!

ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়লো। ভেড়ানো দরজার আড়াল থেকে বাহিরে উঁকি দিলাম। ডাইনিং রুম মোটামুটি ফাঁকা। শুধু একজন বসে আছে। ফাইজান নামের এ বাড়ির বড় ছেলেটা। ছেলেটা একেবারে সুঠাম দেহের। কি সুন্দর করে ভাত খাচ্ছে। সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে ভাত নেড়েচেড়ে খাচ্ছে। বড়লোক দের ভাত খাওয়ার দৃশ্যও কেমন চমকপ্রদ মনে হলো।

রুমের ভেতর চলে এলাম। বিছানায় গা মেলে দিলাম। আড়াল থেকে এ বাড়ির সবাইকে দেখা শেষ। শুধু দেখিনি ফাইজান ভাইয়ের বাবাকে। সালেহা খালা বলেছে তিনি বড়ো রাজনীতিবিদ। কি একটা কাজে বিদেশে গিয়েছেন। বিদেশ যাওয়া নাকি এদের কাছে দুধ ভাতের মতো সহজলভ্য।

মাটিতে বিছানো বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলাম কিছুক্ষণ। আমার মনে একটা খটকা লেগে আছে। এ বাড়িতে যে নতুন একজন কাজের লোক এসেছে সেটা অনেকে জানে না। জানলে কৌতূহল হবে! দু চারটে কথা বলবে! কিন্তু কই? কেউ তো খোঁজ নেয় না! নাকি বড়লোকদের হিসাব আলাদা? তারা কাজের লোকদের মতো এমন নগণ্য বিষয়ে জানার আগ্রহ রাখে না?

________

মাঝরাতে ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। লাফিয়ে উঠে পরলাম। ক্ষনিকের জন্য ঘর দুয়ার অপরিচিত মনে হলো। কয়েক মিনিট সময় লাগলো সব স্মরণ হতে। আস্তে আস্তে বুকের কাছে তীব্র জ্বলুনি অনুভূত হলো। মনে পড়লো এই বিশালাকার দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই। বর্তমানে কোনো এক বাড়ির আশ্রিতা আমি।

চোখের জলে দুই গাল ভেজা। ওড়নার এক অংশ দিয়ে মুছে ফেললাম। ঘুমের মধ্যে কান্না করা অভ্যাস হয়ে গেছে। সেদিন রাতে সালেহা খালা দেখি ধাক্কাচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে।

চোখ মুছে শুকনো ঢোক গিললাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পানির জন্য ভেতরে ছটফটানি শুরু হলো। বাথরুমের কিঞ্চিৎ আলো রুমে প্রবেশ করেছে। সেই আলোতে পাশে তাকিয়ে দেখলাম খালা বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে। তাকে আর ডাকলাম না। সারাদিন ভীষণ পরিশ্রম করে মানুষটা।

নিজেই উঠে পড়লাম। শিথানের কাছের জগ উচুঁ করে দেখি পানি নেই। ফের দীর্ঘশ্বাস বের হলো। জীবন এতো কঠিন কেন? আবছা অন্ধকারে দরজার ছিটকিনি খুলে বের হলাম।

রান্নাঘরের দরজা ভেড়ানো। চারপাশে নজর বুলালাম। রাতের বেলা নিচ তলায় আমি আর সালেহা খালা থাকি। এতো রাতে এই দুজন ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। আমি বসার ঘরে দুটো চক্কর দিলাম। হাত পা বসে এসেছে একদম। এ বাড়িতে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন চাইলেই প্রিয় পুকুর পাড়ে বসতে পারি না, ছুটোছুটি করতে পারি না। কি যে কষ্ট লাগে। মন খারাপ করে ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসে পরলাম। কিছুক্ষণ পর গ্লাসে পানি ঢাললাম। উচুঁ করে চুমুক দিতে আচমকা পেছন থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো।

‘কে তুমি?’

আমাকে সম্পূর্ণ পেছন ঘুরতে হলো না। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকাতে পুরুষ অবয়ব দৃশ্যমান হলো। যার হাতে মগ ধরে রাখা। মগের ভেতর থেকে ক্রমাগত ধোঁয়া উড়ছে। পুরুষ অবয়ব আর কেউ নয়। এ বাড়ির দুই নাম্বার বড় ছেলে। ফাইজান! সে ভ্রু যুগল কুঁচকে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো,

‘কে তুমি? এতো রাতে এখানে কি করছো?’

(চলবে)