ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-০৭+০৮

0
180

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০৭+০৮

পুরুষ অবয়ব আর কারো নয়। এ বাড়ির দুই নাম্বার বড় ছেলে। ফাইজান! সে ভ্রু যুগল কুঁচকে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো,

‘কে তুমি? এতো রাতে এখানে কি করছো?’

শরীর জমে স্থির হয়ে এলো আমার। হাতের গ্লাস ঢিলে হয়ে যেতে ধপাস করে টেবিলে নামিয়ে রাখলাম। মাঝরাতের অনাকাংখিত এই সাক্ষাৎ আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক নিতে পারলো না। ভয়ে, আতঙ্কে জমানো জল চোখের কিনার বেয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো। তার কণ্ঠ নরম হয়ে এলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কান্না করছো কেন? কি হয়েছে? দেখি কথা বলো তো। বাড়ির লোকজনকে ডাক দিবো? কে তুমি?’

‘আমি জুঁই।’

‘হুঁ? কি বললে? জু?’

ভেজা গাল দ্রুত মুছে ফেললাম। এখান থেকে সরে যেতে হবে। পালিয়ে যেতে হবে। তড়িঘড়ি করে বললাম,

‘জুঁই। আমি এ বাড়ির নতুন কাজের মেয়ে। কিছুদিন হলো এসেছি।’

‘হ্যাঁ?’

ফাইজান নামক ছেলেটার কুঁচকানো কপালের খাদ আরো গভীর হলো। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো! যেন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।

‘এতো পিচ্চি মানুষ? এতো বাচ্চা বয়সে কেউ কারো বাড়িতে কাজ করে? পাগল নাকি তুমি?’

‘করে তো! এই যে আমি করছি।

‘বাড়িতে কে কে আছে তোমার?’

এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। এড়িয়ে গেলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে আর প্রশ্ন করলো না। অস্পষ্ট সুরে কিছু একটা বলে চলে গেল। আমি ধপ করে বসে পড়লাম। এতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে ছিলাম যেনো! বুক ভরে শ্বাস নিলাম। পানির তৃষ্ণা মরে গেছে। রুমে যাওয়ার জন্য উঠতে গিয়ে দেখি টেবিলের উপর মগ রাখা। ফাইজান ভাই রেখে গেছে? কখন নামিয়ে রাখলো? কাছে গিয়ে উবু হয়ে দেখলাম। ভেতরে ঘন তরল পদার্থ। এখনো ধোঁয়া উড়ছে। এটা চা নাকি কফি? বুঝতে পারলাম না। কফি খাইনি কখনো। কিন্তু চা খাওয়া হয়েছে দু’বার। যদিও স্বাদ ভুলে গেছি।

ফাইজান ভাই কি মগটা ভুলে রেখে গেছে? হয়তো! এতো রাতে তো সে এসব বানানোর জন্যে নিচে নেমেছিল। চিন্তিত মুখে সিঁড়ির উপরে চোখ রাখলাম। হয়তো নিচে নামবে আবার। মগের জন্য। আমি দ্রুত রুমে ঢুকে গেলাম।

_______

ভোরবেলা মৃদু চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো। বসার ঘরে বড়ো মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে। কাকে যেন ধমকাচ্ছে। আমি উঠে পড়লাম। বাথরুম থেকে চোখ-মুখ ধুয়ে বের হলাম। সালেহা খালা ঘরে নেই। কাজ শুরু করে দিয়েছে হয়তো। খালাকে কতবার বলেছি, সে যখন বিছানা ছাড়ে আমাকেও ডেকে দেয় যেন। কিন্তু কখনো ডাকে না। খালা ভীষণ স্নেহ করে আমায়।

রুম থেকে বের হতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধলো। ফাইজান ভাই বসার ঘরে। সাথে বড়ো মা, খালা। এক কর্ণারে জাবিরকেও দেখা যাচ্ছে। আমি রান্নাঘরের পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। বড়ো মার হাতে রাতের মগ। তিনি চেঁচিয়ে বললেন,

‘রাতে কফি খেয়েছিস কে? বল!’

জাবির মাথা নাড়ল। বললো,

‘আমি তো না।’

‘ফাইজান তোর কাজ, না?’

‘আহা! একটু তো কফি বানিয়েছি। এমন করছো কেন মা?’

বড়ো মা রেগে গেলেন। বললেন,

‘তোকে কতবার বলেছি না যে রাত জাগবি না? রাত জেগে জেগে একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি মনে নাই? আবার রাত যাগা শুরু করেছিস?’

‘আচ্ছা যাও। আর কফি খাবো না। রাতও জাগবো না। এবার কি জন্যে ডাকছিলে বলো।’

বড়ো মায়ের হঠাৎ মনে পড়লো যেন! ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি। মগটা নামিয়ে রেখে বললেন,

‘তোর দাদীকে আনতে যেতে হবে। মোহাম্মদপুর গিয়ে নিয়ে আয়। একা আসবে না।’

ফাইজান ভাই লম্বা করে হাই তুলল।

‘এইটা বলার জন্য এত ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছ? আশ্চর্য! আমার সময় হবে না। যেতে পারবো না!’

ফাইজান ভাই এক মুহূর্ত দেরি করলো না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে গেল। তার পেছন পেছন জাবিরও চলে গেল। বড় মা নিজের মতো বকতে থাকলেন। আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। এঁটো থালাবাসন ধুতে হবে।

_________

শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আজ এ বাড়িতে হরেক রকমের রান্না হয়েছে। সেই সকাল দশটা থেকে শুরু হয়েছিল। শেষ করতে করতে বেলা দুটো বেজে গেলো। রান্নার যাবতীয় কাজ সালেহা খালা আর বড়ো মা করলো। আমি কুটা বাছা করেছি। আনা নেওয়া করেছি সব। এ বাড়ির কেউ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। দু একজন উঠে হালকা নাস্তা করে আবার ঘুম!

সবাই উঠলো দুপুর বেলা। পরিষ্কার হয়ে হয়ে নিচে নেমে খাবার খেলো। সবার খাওয়া শেষ হতে সালেহা খালা বের হলো। একদিনের ছুটি নিয়েছে সে। কাছে কোথায় যেন তার বোন থাকে। পাতানো বোন। কিন্তু অনেক ভালো সম্পর্ক। খালা ব্যাগে কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে গেলো। আমি খালাকে ধরে বার বার করে বলে দিলাম। একদিনের বেশি যেন না থাকে। এই মানুষটাকে কেমন আপন আপন লাগে। প্রায়ই ঘুম ভাঙতে দেখি তার বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছি। খালা মাঝে মাঝে চুল টেনে টেনে তেল দিয়ে দেয়। অগোছালো চুল বিনুনী করে দেয়। মমতা মিশ্রিত চোখে তাকায়। একটা মানুষকে আপন ভাবতে আর কি লাগে?

নিজের যত্ন নিতে ভুলে গেছি সেই কবে! আমার সাজানো গোছানো পৃথিবীটা উলোট-পালোট হওয়ার পর পর। আগে মাথার চুল পরিপাটি করে রাখতাম। প্রতিবার বাড়ির ভাইরে পা রাখার সময় আয়নায় একবার নিজেকে দেখতাম। ঠিকঠাক লাগছে কিনা! যদি রাস্তায় রাফি ভাইয়ের সাথে দেখা হয়? বেশিরভাগ সময় আমায় আশাহত হয়ে হতো। তার সাথে দেখা হতো না। মাঝে মাঝে আমি দেখলেও তার নজরে আমি পড়তাম না। তার নজরে পড়তাম কাঠফাটা রোদের দিনে। দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফেরার পথে।
যখন আমাকে পুরোদস্তুর বিধ্বস্ত লাগতো। অথবা দেখা হতো আমার চরম দুঃখের সময়ে। আব্বা মারধোর করেছে। সাথে গালিগালাজ করছে। আমি রাগে, দুঃখে বাড়ির বাইরে পা রাখতে তার সাথে দেখা হতো। সে তখন স্নো মেখে, ঝলমলে চুল উড়াতে উড়াতে পাশ দিয়ে যেত। কদাচিৎ জিজ্ঞেস করতো,

‘জুঁই নাকি?’

আমি উত্তর দিতে পারতাম না। অপমানে মুখ কালো হয়ে যেত। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়তো আব্বার উপর।

পুরোনো কথা স্মরণ হতে মন খারাপ ভাব বেড়ে গেলো। আগের আমি আর এখনের আমি’র মধ্যে কত তফাৎ। আগে সারাক্ষণ ছুটোছুটি করতাম। ছটফট করতাম। প্রচন্ড দুঃখের দিন গুলোতেও হাসি থামতো না। স্কুলে বেশ কয়েকজন বান্ধবী ছিল। তাদের সাথে কত গল্প গুজব হতো। ওরা এখন কেমন আছে? আমার পৃথিবী এক রাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেলো। তবুও ওরা খোঁজ নিল না। ওদের আমার কথা মনে পড়ে না? মিলি? অন্তত মিলির তো মনে পড়ার কথা। মিলি কেমন আছে এখন? হয়তো আগের মতো আছে। ভালো আছে।

মা, বোনেরা নেই মাস তিনেক হতে চলেছে। বুকের মাঝের ক্ষত টা পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। অথচ কি যে যন্ত্রণা সে ক্ষতে! যদি কাউকে একটু বুঝানো যেত! যদি কাউকে একটু বলতে পারতাম। আমি এই বয়সে এতকিছু সহ্য করতে পারছি না। আমার অবসর প্রয়োজন। আচ্ছা, আমার দুঃখ গুলো কি কখনো অবসর নিবে না? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে!

বিকেল বেলা একটু বিছানায় গড়াগড়ি করছিলাম। হঠাৎ দরজার বাইরে বড় মায়ের গলা শোনা গেলো। বড় মা তুই করে ডাকে আমায়। কি যে আপন আপন লাগে!

‘জুঁই ঘুমিয়ে গেছিস?’

আমি গায়ে ওড়না জড়াতে জড়াতে বললাম,

‘না বড় মা! ঘুমাই নাই।’

ভেড়ানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো বড় মা। চেহারায় প্রফুল্লতা ছাপ।

‘চা বানাতে পারিস না?’

‘হ্যাঁ পারি। খালার কাছে শিখেছি।’

‘খুবই ভালো। বেশি করে চা বানা তো। লোকজন সবাই বসে আছে।’

বড় মা চলে গেল। আমি উঠে রান্নাঘরে গেলাম। রান্নাঘরের এখান থেকে বসার ঘরের অল্প একটুখানি দেখা যায়। এক পলক দেখে বুঝতে পারলাম বসার ঘর আজ লোক সমাগম। সমস্বরে চেঁচামেচি করছে। গল্পগুজব করছে। তার আওয়াজ রান্নাঘর অবধি আসছে।

বড়সড় পাতিলে পানি গরম দিলাম। চুলার আঁচ বাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। গত কয়েকদিনে খালার থেকে অনেক কিছু শিখে নিয়েছি। কল্পনাও করিনি এই বয়সে এতকিছু করতে হবে। এতকিছু শিখে নিতে হবে!

দুধ, চিনি মিশিয়ে অনেকগুলো কাপে চা ঢাললাম। আমার শেষ না হতে বড় মা এলো। হাতে চৌকোণাকার প্লেট। যাকে ট্রে বলে ডাকে। একটা ট্রে তে চায়ের কাপ রাখলাম। আরেকটাতে বড় মা ফলমূল, মিষ্টি আর বিস্কুট দিয়ে ভরলো। ফলমূলের ট্রে টা হাতে নিয়ে তিনি বললেন,

‘আয় আমার সাথে। চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে আয়।’

হুঁ?’

বুকের ভেতর আঁতকে উঠল। সবার সামনে যাবো আমি? এই ভয়টা পাচ্ছিলাম। সালেহা খালা থাকতে এসব কাজ সে করতো। আমি আড়ালে লুকিয়ে থাকতাম। এখন উপায়? ভয়ের সাথে সাথে লজ্জাও পাচ্ছি। আমার চেয়ে ছোট, বড়, সমবয়সী সবার সামনে নিজেকে কাজের লোক বলে পরিচয় দিতে হবে। তারাও মানুষ, আমিও মানুষ। অথচ তাদের আর আমার মাঝে বিস্তর ফারাক।

‘কি হলো? আয় তাড়াতাড়ি।’

রান্নাঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বড় মা তাড়া দিলো। আর চিন্তা ভাবনার সুযোগ পেলাম না। গায়ের উড়নাটা দিয়ে লম্বা করে ঘোমটা দিলাম। অতঃপর পাহাড়সম ভয় আর লজ্জা নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হলাম।

‘সবাইকে চা দিয়ে দে জুঁই।’

সবাই গল্পে মশগুল। শুরুতে কেউ ঠাওর করেনি আমাকে। বড় মার জুঁই ডাকে সবার সংবিৎ ফিরলো। কৌতূহল নিয়ে তাকালো আমার পানে। আমি তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নত করলাম।

‘এই মাইয়া কে রে ফাতেমা?’

প্রশ্ন করলেন এই বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি। বড় মায়ের শাশুড়ী মা। আমার কিছু বলতে হলো না। বড় মা নিজে থেকে বললেন,

‘ও জুঁই। নতুন কাজ শুরু করেছে এখানে। আপনি তখন ছিলেন না মা। দারুণ মেয়ে। কয়েকদিনে আমার মন জয় করে ফেলেছে।’

‘ও। তাই তো বলি। এরে তো চিনি না!’

কয়েক মিনিট নিরব রইলো চারপাশ। পরক্ষণে আবার যার যার মতো গল্পে মেতে উঠলো। আমি বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম। কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। কোনো কিছু জানতে চাইলো না। বুঝতে পারলাম কাজের লোক নিয়োগ দেওয়া এদের কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার! নির্ধারিত কাজের লোক গুলো খুবই অসহায় আর নগণ্য।

মুখ ভার করে সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলাম। দাদীর পাশের জনের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিতে হাতে অন্য রকমের স্পর্শ পেলাম। বাজে স্পর্শ! চমকে তাকাতে মধ্যবয়স্ক এক লোক দেখতে পেলাম। বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের ঘরে। কি বাজে চাহনি! ঠোঁটে শয়তানি হাসি। কে এই লোক? এভাবে তাকাচ্ছে কেন?

ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো। দ্রুত তার সামনে থেকে সরে এলাম। সর্বশেষ কাপ দিলাম ফাইজান ভাইয়ের হাতে। তার দৃষ্টি ভীষণ শীতল। উত্তপ্ত দাবদাহে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। চা পরিবেশন শেষ হতে আমি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। হঠাৎ জাবির বললো,

‘চা টা চমৎকার হয়েছে জুঁই।’

‘হ্যা ঠিক বলেছিস জাবির।’

জাবিরের সাথে সুর মেলালো সামান্তা আপু। আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে দুইজনের দিকে তাকালাম। তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি। সেই তৃপ্তি থেকে এক বিন্দু ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়লো আমার মাঝে।

____________

আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো। বরাবরের মতো দুঃস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখলাম মা গলায় দড়ি দিয়েছে। তার পা জড়িয়ে আমি চিৎকার করে কাঁদছি। সাহায্য চাইছি সবার কাছে। কিন্তু কেউ নেই। আমার চিৎকার শুনার মতো কেউ নেই। কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ।

কিছুক্ষণ হাসফাঁস করলাম। ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। বাইরে বের হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। দরজা খুলে এক পা বাইরে রাখতে মেঝেতে চোখ গেল। ভাঁজ করা মোটা কাগজের টুকরো। পাত্তা দিলাম না। বের হয়ে বসার ঘরে হাঁটাহাঁটি করলাম। আচমকা গেস্ট রুমের দিকে নজর গেল। গেস্ট রুমে ফাইজান ভাইয়ের মামাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। মামা! তখনকার বাজে চাহনি নিক্ষেপ করা লোকটা ফাইজান ভাইয়ের ছোটো মামা। বড় মায়ের সৎ ভাই। বড় মা আর তার বাবা এক, কিন্তু মা ভিন্ন।

লোকটার চাহনি একদম ভালো না। বিকেলবেলার স্পর্শের কথা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। দৌঁড়ে রুমের কাছে এলাম। দরজা বন্ধ করার আগে বাহিরে পরে থাকা মোড়ানো কাগজটা হাতে নিলাম।

ছিটকিনি আটকালাম শক্তপোক্ত ভাবে। তবুও বুকে ভয়। কেন জানি এখন পৃথিবীর সব পুরুষকে ভয় করে। তীব্র ভয়! রুমের বাল্ব জ্বালালাম না। বাথরুমের স্বল্প আলোয় মোড়ানো কাগজ খোলার চেষ্টা করলাম। একটুখানি খুলতে বেরিয়ে এলো একটা মলম। কিসের মলম জানা নেই। কপাল কুঁচকে গেল আমার। দরজার সামনে মলম এলো কোথা থেকে? হঠাৎ চোখ গেলো কাগজের লেখার উপর। বড় বড় করে লেখা,

‘বাংলা পড়তে পারো নিশ্চয়ই। বিকেলবেলা দেখলাম হাতে ফোস্কা পড়েছে। চা বানাতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছ তাই না? একটু সাবধানে কাজ করলে কি হয়? হুঁ? এখন থেকে কোনো কাজে তারাহুড়ো করবে না। অত্যধিক সাবধানে করবে। আর মলমটা ক্ষতে লাগিয়ে নিয়ো।’

আর কিছু লেখা নেই। আমি উল্টে পাল্টে দেখলাম। কিন্তু আর কিছুই খুঁজে পেল না। কে এই লোক? আমার হাত পুড়েছে সেটাও টের পেয়েছে? বাম হাতের দিকে তাকালাম আমি। বিকেলে গরম চা ঢালতে গিয়ে হাতে পড়েছে একটু। কয়েক মিনিট পরেই ফোস্কা পরে গেছে। কিন্তু আমি তো ক্ষত লুকিয়ে রেখেছিলাম। মানুষটা টের পেল কি করে?

আমার ভাবনার মাঝে রুমের দরজায় টোকা পড়লো। মৃদু টোকা। ওপাশের লোকটা সাবধানতা অবলম্বন করছে। কেউ যেন টের না পায়। কে টোকা দেয়? বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। এতো রাতে কে নক করে? হুট করে ফাইজান ভাইয়ের মামার মুখটা ভেসে উঠলো।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ০৮

এতো রাতে কে নক করে? হুট করে ফাইজান ভাইয়ের মামার মুখটা ভেসে উঠলো। সেই লোকটা নয় তো? শরীরে কাঁপুনি সৃষ্টি হলো। দৌঁড়ে গিয়ে ছিটকিনি আরো ভালো মতো আটকালাম। দরজার ওপাশে টোকার পরিমাণ বাড়ছে। এপাশে দম বন্ধ করে পড়ে রইলাম আমি। মিনিট কয়েক গত হতে ওপাশে শব্দ মিলিয়ে গেল। হঠাৎ করেই! তবুও কান পেতে রইলাম। ওপাশে আর শব্দ হলো না। নিশ্চিত হতে অবশেষে শ্বাস ফিরে পেলাম।

গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম দ্রুত। পুরোনো কাঁথার তলায় লুকিয়ে ফেললাম নিজেকে। খুব করে কান্না পাচ্ছে। কাউকে পাশে পেতে মন চাইছে। বিশ্বস্ত কেউ! আপন কেউ। যে আমার দুঃখে দুঃখ পাবে, আমার কষ্টে যার কষ্ট অনুভূত হবে। এমন কেউ কি উপরওয়ালা আমার জন্য পাঠিয়েছেন?

বাকি রাতটুকু আর দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ঘুম এলো না। বুঝতে পারলাম, বিপদ আমার পিছু ছাড়েনি। এ বাড়িতে আরো বড় বিপদের মুখে পতিত হয়েছি।
__________

পরদিন দুপুরবেলা। সবার খাওয়া শেষ হতে অবশিষ্ট খাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলাম। এঁটো থালাবাসন গুলো রান্না ঘরে নিয়ে গেলাম। দেরি করলাম না। পরিষ্কার শুরু করে দিলাম। খালা এখনও ফেরেনি। এজন্য আমার কাজ একটু বেড়ে গেছে। আজ সারাদিন রুমের বাইরে বাইরে ছিলাম। বড় মা যতক্ষণ নিচে ছিল তার সাথে সাথে থেকে কাজ করেছি। ফাইজান ভাইয়ের মামা এখনো যায়নি। আমি নিশ্চিত গতকাল রাতে উনি দরজায় টোকা মেরেছে। দিন গড়িয়ে যত রাত হচ্ছে। তত ভয় বাড়ছে আমার। খালা এখনো ফিরছে না কেন!

‘জুঁই! এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে?’

থালাবাসন ধোয়া শেষ। গুছিয়ে রাখছিলাম। পেছন থেকে কেউ চায়ের কথা বলে উঠলো। কণ্ঠ পরিচিত। বহুবার শুনেছি এ বাড়িতে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঘুরে তাকালাম। দেখলাম জাবির দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা। এই ছেলেটা আমার সমবয়সী হবে। সবসময় হাসে। অথচ কতগুলো দিন হয়ে গেলো আমি হাসি না! আমার সবটুকু হাসি বাক্স বন্দি করে কেউ দূরের সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এসেছে। সেগুলো হয়তো সমুদ্রের তলদেশে ছটফট করছে।

আমি মাথা নাড়লাম। চাপা সুরে বললাম,

‘দিচ্ছি।’

‘কষ্ট হয়ে যাবে? তাহলে না হয় থাক।’

তার কণ্ঠে অপরাধ বোধ ফুটে উঠেছে। চেহারায় অস্বস্তি। আমি ঝটপট বললাম,

‘কষ্ট হবে না! বানিয়ে দিচ্ছি এক্ষুণি। আপনি বসার ঘরে অপেক্ষা করুন।’

চুলায় পানি বসিয়ে দিলাম। আড়ষ্ঠতা নিয়ে দেখলাম সে এখনো যায়নি। বিশালাকার রান্নাঘরে হাঁটাহাঁটি করছে। ফ্রিজ খুলে একবার মিষ্টি বের করে খেলো। আমার চোখে চোখ পড়তে তার অর্ধ খাওয়া মিষ্টির টুকরো বাড়িয়ে দিল। বললো,

‘মিষ্টি খাবে?’

‘না!’

অসম্মতি জানিয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। সে বাকি অংশ মুখে পড়লো। চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিলাম। জাবির নামের ছেলেটা যাবে না বোধ হয়। তার চেয়ে দ্রুত চা বানিয়ে দেই।

‘বাড়ি কোথায় তোমার? পরিবারে কে কে আছে? কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছ?’

জাবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার এক হাতে চায়ের কাপ। আরেক হাতে ছাঁকনি। কণ্ঠ বেশ স্বাভাবিক। কত সহজ ভাবে কথা বলছে যেন আমি তার খুবই পরিচিত। কিন্তু না! আজ প্রথমবার ওর সাথে কথা হচ্ছে।

‘নবম শ্রেণিতে ছিলাম। অধ্যয়নরত। বিজ্ঞান বিভাগে।’

বাড়ি কোথায় বললাম না। পরিবারে কে আছে সেটাও বললাম না। শুধু পড়াশুনার ব্যাপারে বললাম। সে স্মিত হেসে বলল,

‘তাই ভেবেছিলাম। পড়াশুনা ছাড়া তো এত স্পষ্ট করে কথা বলা সম্ভব না।’

‘আমি কখন স্পষ্ট করে কথা বললাম? কখন শুনলেন?’

কৌতূহল দমন করতে না পেরে প্রশ্ন টা করেই ফেললাম। কারণ আমার যতদূর মনে পড়ে এদের সামনে আমি দুটো শব্দের বেশি কখনো উচ্চারণ করিনি। জাবির লাজুক হাসলো। বাচ্চাসুলভ হাসি। বললো,

‘কবে জানি রাতে সালেহা খালার সাথে বসার ঘরে কথা বলছিলে। অনেক কথা! তার কিছু শুনে নিয়েছিলাম আমি।’

ভারী অবাক হলাম আমি। প্রায় রাতে সবাই উপরে যাওয়ার পর খালা আর আমি বসে গল্প করি। আমি অবশ্য কম বলি। খালা বকবক করে, আমি শুনি। বুঝতে পারলাম জাবির আমাকে বহুদিন হলো লক্ষ্য করেছে। এইজন্য এত সহজ ব্যবহার।

চা হয়ে গেছে। ছাঁকনি হাতে ঢালতে নিতে জাবির বাঁধা দিল। বললো,

‘আমি ঢালছি। আরেকটা কাপ নিয়ে এসো।’

পাশের তাক থেকে আরেকটা কাপ আনলাম। সে নিজেই ছেকে দুই কাপে চা ঢাললো। একটা নিজের হাতে নিয়ে আরেকটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘আমি চা খাই না।’

‘অভ্যাস করো। চা ছাড়া মানুষ বাঁচে বুঝি? ধরো!’

চা ছাড়া মানুষ বাঁচে। ভালোমত বাঁচে। তিনদিন ভাত ছাড়াও মানুষ বাঁচে। এই যে আমি বেচেঁ আছি। শুধু ভালোবাসা ছাড়া, প্রিয় মানুষদের ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তবুও বাঁচতে হয় এবং ভীষণ কষ্ট হয়। এ বাঁচাকে বাঁচা বলে না। অমত প্রকাশ করে বললাম,

‘আমি খেতে পারি না চা।’

‘আহা! খাও না খাও, কাপটা ধরো তো! হাতে গরম লাগছে।’

চায়ের কাপ ধরলাম আমি। অনিচ্ছা নিয়ে! হাত খালি হতে জাবির নিজের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সুখানুভূতি নিয়ে বললো,

‘ভারী মিষ্টি। দুর্দান্ত হয়েছে। ধন্যবাদ তোমাকে।’

চা পেয়ে কোনো মানুষ এত খুশি হয় সেটা জাবিরকে না দেখলে অজানা থাকতো। চোখে মুখে প্রগাঢ় তৃপ্তির ছায়া। মুচকি হাসি দিয়ে সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলো। কি অমায়িক ব্যবহার! বহুদিন পর ভেতরে একটু ভালো লাগা কাজ করলো আমার। চা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এতো গরম চা কেউ খায় কি করে? কাপ নিয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতে সামনে এসে দাঁড়ালেন ফাইজান ভাইয়ের মামা। ভয়ানক চমকে গেলাম। আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলেন তিনি। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

‘খুউব টেস্ট হইছে পাখি।’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

‘জুঁই আমার নাম।’

তিনি শুনলেন না হয়তো। কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিতে আমি পা চালালাম। বেশিদূর এগোতে পারলাম না। কব্জিতে টান পড়লো। উসখুস করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। তিনি বললেন,

‘এমন করছো কেন? আসো কথা বলি। আমাকে মামা বলে ডাকবা। আলতাফ মামা।’

গা গুলিয়ে উঠলো আমার। সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামছে। তার পদধ্বনি কানে আসছে। বুকে সাহস ফিরে পেলাম যেন। কয়েক সেকন্ডের ব্যবধানে বড় মাকে দেখতে পেলাম। আলতাফ মামা বড় মাকে দেখেও হাত ছাড়লেন না। উল্টো টেনে নিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। বড় মা কাছে আসতে বললেন,

‘আপা। এতো ছোট মেয়ে কাজে নিছো ক্যান? এ কি কাজ পারবে? মেয়ে তোমার বয়স কত?’

আমি নিচু গলায় বললাম,

‘পনেরো!’

‘আরে সব কাজ পারে। মা মরা মেয়ে। জন্মের সময় মাকে হারাইছে। দাদীর কাছে বড় হইছে। দাদীও আর বেঁচে নাই। নিয়ে নিলাম কাজে।’

‘আহারে! বাচ্চা মেয়ে। এই বয়সে কতকিছুর মধ্যে দিয়ে গেছে।’

বলে আলতাফ মামা আমার মাথায় হাত ছোঁয়ালো। সেই স্পর্শে ছিটেফোঁটা স্নেহ ছিল না। ছিল অন্যকিছু! তবে বড় মার কথা শুনে বুঝলাম আব্বা এদের মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে। আমার কি উচিৎ এই মিথ্যে গুলো সংশোধন করা? হয়তো উচিত। কিন্তু এতবড় সত্য বলার সাহস নেই আমার। বললেও সেই একই জায়গা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। মা মরা মেয়ে। বড় মা ফের বললেন,

‘জুঁই ঘুমাসনি? সারাদিন কাজ করলি গিয়ে বিশ্রাম নে।’

আলতাফ মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলেছিস? আসবে কবে কিছু বলেছে?’

‘আসবে আপা। কিছুদিন পর আসবে। বড় কাজে গেছে।’

বড় মার এদিকে নজর নেই। তিনি সামনের সোফায় বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাঁজ করছেন। আলতাফ মামা হাত ছেড়ে দিয়েছে আমার। সুযোগ বুঝে উঠে দাঁড়ালাম আমি। বড় মাকে বললাম,

‘আমি রুমে যাই তাহলে।’

‘যা। ঘুমা গিয়ে। আমি সন্ধায় ডেকে দিবো।’

বড় মায়ের অনুমতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলাম না। দ্রুত হেঁটে চলে গেলাম। বসার ঘরে বড় মা আর তার ভাই কথা বলছে। আমি রুমে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। এই ছিটকিনি বড় মা না ডাকার আগ পর্যন্ত খুলবো না।

___________

খুবই চমকপ্রদ হলেও সত্য যে এ বাড়িতে আমার লেখাপড়ার কথা উঠেছে। বসার ঘরে মোটামুটি সবাই উপবিষ্ট। আমি এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্কুল যাওয়ার কথা প্রথম কে তুলেছে জানি না। আমার অনুমান শক্তি বলছে, ফাইজান ভাই। ফাইজান ভাই কথা বলে না আমার সাথে। কিন্তু যতবার চোখে চোখ পড়ে বা অসাবধানতা বশত তার সামনে পড়ে যাই কেমন অপরাধবোধ নিয়ে তাকায়। যেন আমার আজকের এই দুর্দশার জন্য তিনি দায়ী। আমি যে পড়াশুনা না করে এ বাড়িতে কাজ করছি এসবের জন্য একমাত্র তিনি দায়ী। আমি অবাক হই। ভারী অবাক হই। এই মানুষটা এত ভালো কেন?

নানা মুনির নানা মত! আমার স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটাতে একেক জন একেক রকম মত দিতে লাগলো। দু-চারজন রাজি। তাদের অভিমত বাচ্চা মেয়ে। আর কিছুদূর পড়ুক। প্রয়োজনে বিজ্ঞান বিভাগে না পড়ে অন্য বিভাগে পড়ুক। তবুও পড়ুক।

আবার কারো কারো অভিমত ভিন্ন। পড়লে বাপের বাড়ি থেকে পড়তো! ঢাকা কেন এসেছে? কাজের জন্য এসেছে কাজ করুক। পড়াশুনা দিয়ে কি হবে? নাম লিখতে পারে, টুকটাক পড়তে পারে তাতেই হয়েছে।

এসব কথোপকথনে আমি নিরব দর্শকের মতো রইলাম। একসময় বৈঠক ভাঙলো। আমার হাতের চা খেয়ে। কেউ কেউ চায়ের কাপ নিয়ে উপরে চলে গেল। আমি পূর্বের জায়গা দাঁড়িয়ে রইলাম। গত পরশুদিন আলতাফ মামা চলে গেছে। জরুরী কাজ পড়েছে নাকি। এজন্য একটু নির্ভয়ে আছি। আমার চিন্তার মাঝে হঠাৎ ফাইজান ভাইয়ের ডাক পড়লো। বললো,

‘জুঁই তোমার কি ইচ্ছে? পড়াশুনা করবে নাকি করবে না?’

থতমত খেলাম আমি। কি উত্তর দিবো? পড়াশুনা করতে চাই তো। খুব করে চাই। আমি চিরকাল কষ্টে থাকতে চাই না। ঘরবন্দী থাকতে চাই না। নিজের পরিবর্তন চাই। অনেক কিছু শিখতে চাই। জানতে চাই। মানুষের জন্ম তো একটাই। সেই একজন্ম অন্যের বাড়িতে কাজ করে কাটিয়ে দিবো? কাঁচুমাচু স্বরে বললাম,

‘যদি সম্ভব হয় তাহলে পড়তে চাই।’

আর কোনো কথা হলো না। ফাইজান ভাই তার রুমে চলে গেল। এই মানুষটার সাথে কোথায় যেন রাফি ভাইয়ের মিল পাই। কিন্তু কোথায় তা ধরতে পারি না। কিন্তু কোথাও মিল আছে। ঘুরেফিরে যতবার তার দিকে চোখ পড়ে রাফি ভাইয়ের মুখটা মানসপটে ভেসে উঠে।

সব চিন্তা উড়িয়ে কাজে হাত দিলাম। সালেহা খালা চলে এসেছে। একা একা মাছ কাটছে। আমি যেতে খালা বললো,

‘পড়াশুনাডা কর ফুল। আমি বড় বু-রে কবোনে। পড় তুই। সারাডা জীবন অন্যের বাড়ি কাম করবি নাকি রে? পড় ভালো কইরা।’

আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না। এ বাড়িতে আছি অনেক দিন হয়ে গেছে। আব্বা একবারও খোঁজ নেয়নি। আমি জানতাম সে খোঁজ নিবে না। এটা নিয়ে মন খারাপ হয় না আর। আমি জানি আমার ভালো চাওয়ার মত এখনো অনেক মানুষ আছে। এ ধরাতে-ই আছে। আমার আশপাশে-ই আছে!

_________

আব্বা এসেছিল। গতকাল রাতে এসেছিল। কিন্তু আমার সাথে দেখা করেনি। বাড়ির ভেতরেও আসেনি। এ বাড়ির ড্রাইভার আর আব্বা নাকি বন্ধু মানুষ। তার সূত্র ধরে আজ আমি এ বাড়িতে। গতকাল আব্বা শুধু সেই ড্রাইভারের সাথে দেখা করে চলে গেছে। সকালবেলা নাস্তা বানানোর সময় খালা আমায় জানালো বিষয়টি। এতো কষ্ট পেলাম! আব্বার উপর চরম ঘৃণা জমে আছে। তবুও তিনি আমার সাথে দেখা না করে চলে গেছেন মানতে পারলাম না। রুমে ঢুকে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিলাম।

কান্না থামলো মিনিট বিশেক পর। বড় মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে। দ্রুত চোখ মুছে দরজার বাইরে এলাম। বড় মা কাছাকাছি এসে বললেন,

‘ঝটপট তৈরি হয়ে নে জুঁই। ফাইজান দাঁড়িয়ে আছে। তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবে।’

ভারী অবাক হলাম আমি। আমার স্কুল যাওয়ার কথা উঠেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। এতদিন এই ব্যাপারটা নিঃশব্দ ছিল বলে ধরে নিয়েছিলাম আর স্কুলে যাওয়া হবে না বোধহয়। আস্তে আস্তে সূক্ষ্ম এক খুশির অনুভুতি ভেতরে ছড়িয়ে পড়লো। দৌঁড়ে তৈরি হতে গেলাম।

ফাইজান ভাইয়ের হাতে একটা ফাইল। ফাইলে কিছু কাগজপত্র। দুজন নিশ্চুপ হেঁটে চলেছি। গেট থেকে উনি বলেছেন স্কুলটা কাছাকাছি। গার্লস স্কুল। কোনো ভয় নেই। হেঁটে রোজ আসা যাওয়া করা যাবে। ফাইজান ভাই বেশিক্ষণ নিরব থাকলো না। আশপাশের রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিল। বড় বড় বিল্ডিং এর কোনটা কি সব বুঝিয়ে দিল। একবার বলেই ফেললো,

‘হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?’

ছোট্ট একটা প্রশ্ন। অথচ তাতে আমার কি যে ভালো লাগলো! ঘন ঘন মাথা ডানে বায়ে নেড়ে বললাম,

‘না! একটুও কষ্ট হচ্ছে না।’

সত্যি কষ্ট হচ্ছে না আমার। ছোটবেলা থেকে হেঁটে অভ্যাস আছে। গ্রামে যে স্কুলে পড়তাম সেটা বেশ দূরে ছিল। নিয়মিত হেঁটে যেতাম সেখানে। যার দরুন হাঁটাহাঁটি তে বেশ পাকা আমি। কিন্তু ফাইজান ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে টা বুঝতে পারছি। উনারা বড়লোক মানুষ। গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করে সবসময়। আজ আমাকে রাস্তা চিনিয়ে দেওয়ার কারণবশত হাঁটতে হচ্ছে।

‘এইতো পৌঁছে গেছি। এটাই স্কুল।’

খানিক দূরের স্কুলটা ইঙ্গিত করে বললো ফাইজান ভাই। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতবড় স্কুলে পড়বো আমি? বাহির থেকে কি যে সুন্দর লাগছে। স্কুলের ভেতরে ঢুকে আরো অবাক হয়ে গেলাম। চারপাশ পরিপাটি, ছিমছাম। কোনো ছেলে নেই। চারিদিকে মেয়েরা স্কুল ড্রেস পরে ছুটোছুটি করছে। বেশিক্ষণ সে দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো না। উনার সাথে স্কুলের অফিস রুমে যেতে হলো।

স্কুলের প্রায় শিক্ষকেরা ফাইজান ভাইকে চিনে। চলমানরত সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করলো। বুঝলাম উনি পরিচিত সবার। পরিচিত হবে নাই বা কেন? উনার বাবা নামকরা লোক। রাজনীতি করে। উনার চাচাও কম না! আবার ফাইজান ভাই নিজে কম কিসে! খুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। পড়াশুনা শেষ দিকে প্রায়।

অফিস রুমের স্যার দ্রুত ভর্তির সব কাজ শুরু করে দিল। কাগজ পত্র দেখে বুঝলাম আব্বা গতকাল ভর্তির প্রয়োজনীয় কাগজ দেওয়ার জন্য ঢাকা এসেছিল। আব্বাকে জানালো কে? পাশের মানুষটাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পিছিয়ে গেলাম।

ভর্তির কাজ শেষ হলো দ্রুত। অবশেষে আমিও এতোবড় এক স্কুলের ছাত্রী হয়ে গেলাম। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এখানে টিকতে পারবো তো? বাড়ির কাজ সামলিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করতে পারবো তো? প্রশ্ন জাগলো মনের কোণে। জানিনা এই ভাগ্যে বিধাতা আর কি কি লিখে রেখেছে। তবে আমাকে পারতে হবে। যে মানুষগুলো এতো আগ্রহ নিয়ে আমায় ভর্তি করালো তাদের অসন্তুষ্ট করা যাবে না। কাজ শেষ হতে বের হয়ে আসছিলাম। হঠাৎ অফিস রুমের স্যারটা ফাইজান ভাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন,

‘স্টুডেন্ট কে হয় আপনার?’

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ফাইজান ভাই এখন কি উত্তর দিবে? বাড়ির কাজের লোক বলে পরিচয় দিবে? সে সময় নিলো না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

‘ছোট বোন আমার। দেখেশুনে রাখবেন প্লিজ।’

ফাইজান ভাইয়ের নির্মল, স্নেহাশিস কণ্ঠ। এতটুকু মিথ্যে নেই। কিন্তু তার এই অকপটে বলা সত্যটা বুকে তীব্র আঘাত হানলো। তার মুখের ‘বোন’ সম্বোধন শুনে অন্তরে ব্যথা অনুভূত হলো। কোথায় যেন তীব্র অভিমান জমলো। তবে কি আমার অবচেতন মন তার কাছে অন্যকিছু আশা করেছিল?

(চলবে)