ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-০৯+১০

0
168

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০৯+১০

তবে কি আমার অবচেতন মন তাকে নিয়ে অন্য কিছু ভেবেছিল? জানি না! এসব তো কখনো ভাবিনি। শুধু জানি তার ভালো ব্যবহার গুলো মনে জোর এনে দিত।

ফাইজান ভাই হাঁটছে। তার হাতে আর্টসের একগাদা বই। বিভাগ বদলে আর্টসে ভর্তি হয়েছি। তাতে অবশ্য দুঃখ নেই। পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারলেই হলো।

‘ভর্তি তো করে দিলাম। পড়াশুনা ঠিকমতো করবে তো?’

‘করবো।’

ক্ষীণ স্বরে প্রতিত্তর করলাম আমি। নিশ্চুপ তার পিছু পিছু হেঁটে চলেছি। কোনো দিকে নজর নেই আর। যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে স্কুলে পা রেখেছিলাম তা ছিটেফোঁটা বিষাদের নিচে চাপা পড়েছে। বিষাদের এতো শক্তি!

স্কুলের সামনে অসংখ্য খাবারের দোকান। ফাইজান ভাই দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,

‘কিছু খাবে ফুলি?’

চমকে উঠলাম আমি। ফুলি ডাক শুনে। এই নামে আমায় কখনো কেউ ডাকেনি। আমার স্তব্ধ ভাবকে সম্মতি ধরে নিল সে।

‘আসো। ফুচকা খাই।’

ফুটপাতে সারি সারি ফুচকার দোকান বসেছে। সিমেন্টের বাঁধানো এক বসার জায়গাতে বসে আমি। দুই বাটি ফুচকা নিয়ে এলো ফাইজান ভাই। একটা হাতে ধরিয়ে দিল। ফুচকার দিকে তাকিয়ে সেজো আপার কথা মনে পড়লো আমার। আপার ফুচকা ভীষণ পছন্দের ছিল। কি যে মন খারাপ হয়ে গেল!

‘তোমার বয়সী আমার একটা বোন ছিল জুই। মা নাম রেখেছিল ফাহমিদা। কিন্তু আমি ফুলি বলে ডাকতাম সবসময়। ফুলের মতো দেখতে ছিল তো! বাচ্চা বয়সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লো ফুলি। তিন কি চার বছর বয়স তখন। আহামরি অসুখ না। সামান্য ডায়রিয়া! অথচ সেই দুই দিনের ডায়রিয়াতে ফুলি আমাদের ছেড়ে চলে গেল। গ্রামের পরিবেশ তখন অস্বাস্থ্যকর ছিল। উন্নত চিকিৎসা ছিল না। মাও দরিদ্র ছিল! সবকিছু মিলিয়ে ফুলিকে হারালাম। ফুলি থাকলে এতদিনে তোমার মত বড় হয়ে যেত। খুব মিস করি ওকে।’

ফাইজান ভাই ফুচকা মুখে পুড়ল। মুখ লুকালো আমার থেকে। কিন্তু তার কন্ঠের গভীর দুঃখবোধ ছুঁয়ে গেলো আমায়। এই মানুষটা কখনো হাসে না। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে থাকে। ভেতরে না জানি কত কষ্ট চাপা দিয়ে রেখেছে।

‘আপনি ছোটবেলায় গ্রামে ছিলেন?’

‘গ্রামে জন্ম আমার। গ্রামে বেড়ে উঠা!’

‘কিন্তু……’

হিসাব মিলাতে পারলাম না। ফাইজান ভাইয়ের দাদু, বাবা সবাই তো ঢাকার স্থানীয়। বহু বছর ধরে এখানে বসবাস। তাহলে তার জন্ম, বেড়ে উঠা গ্রামে কেন? প্রশ্ন করলাম না। ফাইজান ভাই খাওয়ার ফাঁকে বললো,

‘পড়াশুনা করবে ভালো করে। পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নিজের শক্তি বাড়াতে হয়। সে শক্তি শিক্ষা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না তোমাকে।’

‘হুঁ।’

সে আর কিছু বললো না। তীব্র মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো, পৃথিবীর কেউ ভালো নেই। সবার কিছু না কিছু গোপন দুঃখ রয়েছে। হারানোর কষ্ট রয়েছে। এ পৃথিবীর দেয়াল জুড়ে যেন শুধু অপূর্ণতার গল্প!
__________

শনিবার থেকে আমার স্কুল। ফাইজান ভাই বৃহস্পতিবার রাতে সব গোছগাছ শুরু করে দিলো। বড় মার থেকে জানতে পারলাম তার ছুটি শেষ হয়ে গেছে কয়েকদিন আগে। আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য এতদিন ছিল। মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করলো! ভেতরে ভেতরে পুলকিত অনুভব করলাম। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল।

পরদিন ভোরবেলা সে রওনা করলো। এই প্রথম বাড়ির বাইরে গেট পর্যন্ত এলাম। তাকে বিদায় দিতে। বড় মায়ের চোখ ভেজা। বাকি সবার মন খারাপ। আমি এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেবেছিলাম ফাইজান ভাই আমাকে খেয়াল করবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কাছে এলো। মাথায় টোকা মেরে বললো,

‘ভালো মতো পড়াশুনা করিস। অনেক পিছিয়ে পড়েছিস কিন্তু।’

আমি মাথা নাড়লাম। ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘আপনি সাবধানে থাকবেন ভাই।’

‘থাকবো।’

এই প্রথম তার মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখতে পেলাম। সে চলে গেল। তার দুঃখ ভরা, আপনজন হারানো বিষণ্ণ দৃষ্টি কেউ দেখতে পেল না।

সেই রাতে আমি ডায়েরি লিখতে বসলাম। ফাইজান ভাই আমার নতুন জীবনের উপহারস্বরূপ একটা ডায়েরি আর কলম দিয়েছে। সেই কলম দিয়ে ডায়েরি লিখতে বসলাম। লিখতে বসলাম আমার জীবনের গল্প। আমার অল্প বয়সের অনুভুতির গল্প। কিভাবে পরিবার হারিয়ে এই অচেনা শহরে আশ্রয় নিলাম তার গল্প।

রাত শেষের দিকে প্রায়। লিখতে লিখতে ভোর হয়ে গেল। ঠিক গুছিয়ে লিখতে পেরেছি কি না জানি না। আমার লেখা পড়ে কেউ কি অনুভব করতে পারবে আমার দুঃখ? আমার হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোর বেদনা? হয়তো পারবে, হয়তো পারবে না! ডায়েরিতে শেষ টান দিলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি সালেহা খালা নড়চড় করছে। ঘুম জড়ানো গলায় খালা বললো,

‘ঘুমাইবি না মাইয়া? ভোর হইয়া আইলো যে।’

‘ঘুমাবো না খালা। আমার জীবনের এক নতুন ভোর আসছে। তাকে আমন্ত্রণের অপেক্ষায়।’
_________

‘এই জুঁই! বই-খাতা নিয়ে দ্রুত রুমে চলে আয়।’

দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে মুখ বের করলাম। সামান্তা আপু সিঁড়ির উপর থেকে ডাক দিয়েছে। আমি ঝলমলে সুরে উত্তর দিলাম,

‘আসছি আপু। একটু অপেক্ষা করুন।’

একহাতে বই খাতা আরেক হাতে ট্রে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সামান্তা আপুর জন্য চা বানিয়েছি। কয়েক সিঁড়ি উঠতে উপর থেকে হুড়মুড় করে জাবির নামলো। ছো মেরে আমার হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিল। কণ্ঠে অধিকার ফুটিয়ে বললো,

‘তোর কাল পরীক্ষা না? রান্নাঘরে যেতে বলেছে কে?’

‘শুধু তো চা বানিয়েছি। কত সময় আর লেগেছে!’

জাবিরের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলাম। কিন্তু তাতে ছেলেটার মুখের কাঠিন্য দূর হলো না। সে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে গটগট করে উপরে চলে গেল। হাসলাম আমি। এই ছেলেটা এমন পাগল! শুধু চা বানিয়েছি? আরো কত কাজ করে এলাম। কাজ না করে অন্যের বাড়ি থাকা যায়? কেউ থাকতে দেয়!

ইতোমধ্যে মাস ছয়েকের বেশি কেটে গেছে। বিগত কয়েক মাসে কতকিছু ঘটে গেলো। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে বর্ষা এলো। তারপর এলো প্রিয় শরৎ! সেই শরৎ ও চলে যাওয়ার পথে। এই দিনগুলোতে আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক কতশত ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো।

তবে সময়ের ব্যবধানে এ বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছি আমি। ঘরের কাজ সামলে রীতিমত স্কুল ও সামলাচ্ছি। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না। যেদিন কাজের চাপ বেশি থাকে সেদিন যাই না। না গেলেও রাত জেগে পড়া শেষ করি। বিগত দিনগুলোতে সবার সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। জাবির অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। তার এসএসসি পরীক্ষা শেষ। ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন কলেজে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছে। আর সামান্তা আপু? রাত-দিন এক করে ভর্তি পরীক্ষার পড়াশুনা করছে। আপুর কয়েক মাস পর ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। তাদের সাথে সাথে আমিও পড়ছি। সমান তালে না হলেও অনেক পড়াশুনা করছি।

সামান্তা আপুর ঘরে ঢুকে দেখলাম জাবিরও উপস্থিত। দুই কাপ চায়ের একটা নিয়ে নিয়েছে। আমি বইখাতা ছড়িয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। আপু জাবির কে বললো,

‘তুই চা খেলি কেন? ওইটা তো ওর নিজের জন্য ছিল।’

কয়েক চুমুক খাওয়া চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলো জাবির।

‘ওর নিজের জন্য ছিল তাহলে রেখে দেই।’

‘আমি চা খাবো না এখন। আপনি খেয়ে নেন।’

‘রাত জেগে পড়বি। চা টা তুই খা।’

‘তোর খাওয়া চা ও খাবে এখন? এক চড় দিবো।’

সামান্তা আপু ধমকে উঠল। অগত্যা জাবির চায়ের কাপটা ফের হাতে উঠালো। সামান্তা আপু আমাকে পড়ানো শুরু করতে সে বের হয়ে গেলো।

বার্ষিক পরীক্ষা চলছে আমার। কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা। আপু গুরুত্বপূর্ন কিছু টপিক পড়তে দিয়ে চলে গেল। আপুর ফোন বাজছে। মোবাইলে নাম্বার দেখেই তার সমস্ত মুখ জুড়ে রক্তিম এক আভা ছড়িয়ে পড়লো। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। আপু কি কারো প্রেমে পড়েছে?

‘তুই মন দিয়ে পড়। সব মুখস্ত করে ফেল। সব।’

‘হুঁ!’

আপু ফোন হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের পাশের বেলকুনিতে চলে গেল। বাহির থেকে কাচ টেনে পর্দা দিলো। আমি বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিলাম।

কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল নেই। জাবির এলো চা, বিস্কুট আর কেক নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো,

‘বুবু কই?’

‘বেলকনিতে।’

‘তোর পড়া কতদূর? ক্ষুধা লাগেনি? খেয়ে নে কিছু।’

আমি উত্তর দিলাম না। জাবির আমার সাথে অতিরিক্ত ভালো ব্যবহার করে। এই পরিবারের কিছু মানুষের তা সহ্য হয় না। হওয়ার কথা না! বাড়ির কাজের মেয়ে আমি। তার সাথে এতো সুন্দর ব্যবহার কিসের?

খাবারের প্রতি আমার অনীহা দেখে জাবির জোর করে হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল। সম্মুখের বইটা হাতে নিয়ে বলল,

‘বল কতদূর পড়েছিস।’

‘পড়া শেষ। আপনি প্রশ্ন ধরুন।’

জাবির প্রশ্ন করছে। আমি তার উত্তর দিচ্ছি। হঠাৎ সে টপিক পাল্টে জিজ্ঞেস করলো,

‘সামনে আমার জন্মদিন। কি গিফট দিবি বলতো।’

‘আপনার গিফট দেওয়ার অনেক মানুষ আছে। আমি দিতে যাবো কেন!’

‘আমি তোর বন্ধু মানুষ না? তুই তো আমার কাছের মানুষ। বুবুর পড়ে আমার জীবনে দ্বিতীয় মেয়ে তুই। তোদের বাইরে আর কোনো মেয়ের সাথে পরিচয় নেই।’

আমি কিছু বললাম না। জাবির আমার ব্যাপারে অতিরিক্ত যত্নশীল। যার বেশিরভাগ অন্যদের আড়ালে। তবুও মাঝে মধ্যে কারো নজরে পড়ে যায়। আমার ভালো লাগে না। কয়েক বার বারণ করেছি। তারপরও পিছু হটে না। জাবির আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘তোর জন্মদিন কবে রে?’

‘জন্মতারিখ, জন্মসাল কিছুই জানি না। অনেকগুলো বোন ছিলাম আমরা। আব্বা মা মনে রাখে নাই। পরে আন্দাজ থেকে নিবন্ধন করেছে। তবে বয়সে আমি আপনার বড় হতে পারি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর স্কুলে যায়। আমার তো এখনো মনে আছে। সেদিন মাত্র আব্বা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসলো। আমি ……’

হঠাৎ থামিয়ে দিল জাবির। বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘অনেকগুলো বোন মানে? তোর আরো বোন আছে?’

চমকে গেলাম আমি। আমার মা বোনদের পরিণতি সম্পর্কে এখনো এ বাড়ির কেউ জানে না। জানলে বোধহয় আর রাখবে না। জাবিরের দাদী আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। কারণ জানা নেই। তিনি সুযোগ খুঁজছে শুধু। আমাকে বাড়ি থেকে বের করিয়ে দেওয়ার। একবার জেনে গেলে আর রক্ষে নেই। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

‘ফাইজান ভাই বাড়ি আসছে না কেন? কত মাস হয়ে গেল।’

‘ভাইয়া আসবে না। বড় আব্বু বাড়ি থাকলে ভাইয়া আসে না। এর আগেরবার বড় আব্বু বিদেশ ছিল কাজে। এইজন্য ভাইয়া অনেকদিন ছিল।’

‘কেন?’

সেজন্যই কি ফাইজান ভাই খুলনা গিয়ে ভর্তি হয়েছে? হয়তো। তা না হলে ঢাকায় এতো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থাকতে সে খুলনা গিয়ে কেন ভর্তি হবে!

তবে জাবির উত্তর দিল না। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করার পর বুঝলাম ভুল হয়েছে। আমি এ বাড়ির কাজের লোক। এতকিছু জানার অধিকার নেই। বই টেনে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম।

জাবিরের ফোন বাজছে। সে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে হাসলো। হাসি হাসি মুখে বললো,

‘রাজ ভাইয়া ফোন দিয়েছে।’

ফোন রিসিভ করে কানে নিল জাবির। রাজ ভাইয়া এ বাড়ির বড় ছেলে। বড় মায়ের প্রথম সন্তান। যে বহুদিন হলো বিদেশে। সালেহা খালা বলেছিল বাবার সাথে ঝামেলা করে বিদেশ চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি। এ বাড়ির সব ছেলেই কি বাবার সাথে ঝামেলা করে? অদ্ভুত তো! তাদের বাবা মানুষটাকে তো ভালো মনে হয়। যদিও আমার সাথে কখনো তেমন করে কথা হয়নি। সারাদিন বাহিরে বাহিরে থাকেন। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।
________

আজ শেষ পরীক্ষা ছিল। শেষ হতে দ্রুত ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির কাজ করে স্কুল আসা, আবার ছুটে গিয়ে কাজ শুরু করা। অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। ভোরবেলা নামাজ পড়ার পর আর ঘুমানো হয় না। আমি আর সালেহা খালা নাস্তা বানানো শুরু করে দেই। তারপর সারাটা দিন দৌঁড়ের উপর থাকতে হয়। তবুও খালার জন্য বেচেঁ আছি। সে যদি সাহায্য না করতো এতদিনে মরে যেতাম। অনেক আগে জীবন যুদ্ধে হেরে যেতাম।

এখন যেকোনো পরিস্থিতিতে বেচেঁ থাকতে শিখে গেছি। ভালো থাকতে শিখে গেছি। আমার সাথের মেয়েগুলো কত খেলাধুলা করে। সারাক্ষণ দৌঁড়-ঝাঁপ পারে। হাসা-তামাশা করে। শুধু আমি চুপচাপ থাকি। গম্ভীর হয়ে থাকি। তাদের এসব ছেলেমানুষী মনে হয়। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বড় হয়েছি। খুব কাছ থেকে কঠিন এক জীবন উপলব্ধি করেছি। এসব আমাকে বয়সের তুলনায় অনেক বড় করে দিয়েছে যেন! চিন্তা ভাবনা পূর্ণবয়স্কদের মত হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত দুঃখ কষ্ট অন্য এক আমিতে পরিণত করেছে! এখন ওদের বাচ্ছাসুলভ আচরণ স্পর্শ করে না আমাকে। সেজন্য স্কুলের কারও সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে উঠেনি।

‘জুঁই!’

স্কুল গেট অতিক্রম করতে দূর থেকে কেউ ডাক দিল।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ১০ (বোনাস পার্ট)

‘জুঁই!’

স্কুল গেট অতিক্রম করতে কেউ দূর থেকে ডাক দিল। পেছনে তাকাতে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে গেল। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। আলতাফ মামা ডাকছে। এদিকে কেন উনি?

আমাকে এগিয়ে যেতে হলো না। তিনি দ্রুত হেঁটে কাছে এলেন। চোখে মুখে গদগদ ভাব। বললেন,

‘মা গো! কেমন আছো? পড়াশুনা কেমন চলতেছে?’

আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম,

‘ভালো।’

‘আমি কয়েক মাস হলো অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। এইজন্য যেতে পারতেছি না। ও বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

মাথা নাড়লাম শুধু। গত মাস গুলোতে উনি দুই বার মাত্র এসেছিল। থাকার সুযোগ হয়নি। কাজ পড়ে গিয়েছিল বলে চলে যেতে হয়েছে। যখন এসেছে আমি পুরোটা সময় খালার সাথে সাথে ছিলাম। একা পায়নি। আজ কি করবো?

‘চলো ওদিকে যাই। কিছু খাইবা।’

‘আমি খাবো না কিছু মামা। বাড়ি যাবো। কাজ আছে।’

‘আরে চলো। কিছু হইবো না।’

কাঁধে হাত রেখে একপ্রকার জোর করলেন উনি। তবুও রাজি হচ্ছি না বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। কান্না পেয়ে গেলো আমার। ভীষণ ভয় হতে লাগলো। মামা বেশিদূর এগোতে পারলেন না। ভোজবাজির মতো জাবির এসে সামনে দাঁড়ালো। এতক্ষণে ভরসার একজন কে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। চোখের কিনারে অশ্রুরা ভিড় জমালো।

‘মামা নাকি? কেমন আছেন? এদিকে কেন?’

ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলো জাবির। মামা হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন।ফের হাতটা মাথায় রেখে বললেন,

‘আছি ভালো। এইদিকে একটা কাজ পরে গেছিলো। ফেরার পথে দেখি জুঁই মা। পরে কইলাম আসো কিছু কিনে দেই। খেয়ে নেও। বাচ্চা মানুষ। তুমি এইদিকে কেন?’

‘লাইব্রেরিতে যাবো। বই কিনতে হবে কিছু। ভাবলাম জুঁইকে সাথে নিয়ে যাই।’

‘ও, আচ্ছা। কিছু খাও তাইলে দুজন। আসো।’

জাবির একপলক তাকালো আমার পানে। আমার মন পড়তে পারলো কিনা জানি না। শীতল সুরে বলল,

‘আজ থাক মামা। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আজ যাই। জুঁই আয়!’

অবশেষে মুক্তি মিললো। দ্রুত পা চালিয়ে জাবিরের পিছু পিছু এগিয়ে চললাম। মামার দৃষ্টির অগোচরে যেতে তবে স্বস্তি মিললো। সামনের গলিটা ক্রস করে বড় রাস্তায় উঠলাম। জাবির হঠাৎ হাঁটা থামল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত চোখে তাকাল। কড়া সুরে বললো,

‘জীবনে খাসনি তুই? একটা মানুষ বললো আর তার সাথে সাথে খেতে যাওয়া শুরু করলি?’

‘আমি কই গেলাম। উনি হাত ধরে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল।’

‘তুই হাত ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে পারলি না?’

‘এতোবড় মানুষ!’

ছাড়া ছাড়া ভাবে বললাম আমি। জাবির কড়া কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। বার কয়েক এদিক-ওদিক চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো,

‘একজন জোর করবে আর তুই চুপচাপ থাকবি? এটা ঢাকা শহর জুঁই! প্রতিনিয়ত কতশত ঘটনা ঘটছে। তোকে তো স্ট্রং হতে হবে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মনোবল থাকতে হবে। বোল্ডলি কথা বলতে হবে। মিনমিন করলে হবে?’

জাবির কে হঠাৎ বড় বড় মনে হলো। কেমন গুছিয়ে কথা বলছে। এভাবে আমার সেজো আপা বকা দিতো। ধমকাতো। আমি মাথা নেড়ে বললাম,

‘ঠিক আছে।’

জাবিরের রাগ পড়ে গেল। গাড়ি দেখে রাস্তা পার করিয়ে নিল। কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে সে। লাইব্রেরীতে গিয়ে বেছে বেছে বই কেনা শুরু করলো। আমি পুরোটা সময় ছটফট করছিলাম। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। কত কাজ জমে আছে। দুপুরের থালাবাসন পরিষ্কার করতে হবে। বিকেলের নাস্তা তৈরি করতে হবে। রাতের তরকারির জন্য কুটা-বাছা করতে হবে। এতকিছু তো খালা করতে পারবে না। তাড়া দিলাম তাকে।

ফেরার পথে দুটো আইসক্রিম কিনলো জাবির। আমি নিবো না। তবুও জোরপূর্বক হাতে ধরিয়ে দিল। কত দামী আইসক্রিম। এই ছেলের হাত খরচ মাসে যে কত যায়।

রিকশা করে দুজন বাড়ি ফিরলাম। একসাথে ঘরে পা রাখতে বসার ঘরে দাদীর সম্মুখীন হলাম। তার আবছা চোখের দৃষ্টি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল যেন। আমি দ্রুত বই খাতা রেখে কাজ শুরু করলাম।

________

সেদিন রাতের বেলা আমার ডাক পড়লো। বসার ঘরে। তখন অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত জেগে গল্পের বই পড়ছিলাম আমি। পড়া বন্ধ করে গিয়ে দেখি বড় মা, দাদী আর জাবিরের আম্মু বসে আছে। জাবিরের আম্মু কাজের প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা বলে না। আবার অহেতুক ধমকা-ধামকি করা, সেটাও করে না। তবে আজ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেলাম। কোনো ভুল করেছি কি না চিন্তা করতে লাগলাম।

‘আজ জাবিরের সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল তোমার?’

প্রশ্ন করলো জাবিরের আম্মু। ভদ্র মহিলা শিক্ষিত মানুষ। প্রচন্ড ভয় পাই তাকে। আমি কম্পিত সুরে বললাম,

‘স্কুল থেকে ফেরার পথে। ঐদিকে লাইব্রেরিতে বই কিনতে গেছিলো।’

ভদ্র মহিলা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সুশ্রী মুখটা হঠাৎ হিংস্র রূপ ধারণ করলো। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই গালে ঠাস করে চ’ড় পড়লো আমার। মাথা ভনভন করে উঠলো। চকিতে আব্বার মুখটা ভেসে উঠলো। আব্বা এভাবে পুরুষালি হাত দিয়ে চ’ড় মারত। দিন দুনিয়া ভুলে যেতাম। আজও ব্যতিক্রম হলো না। ব্যথায় কেঁদে দিলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পর তাকালাম। বড় মা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিস্ফারিত চোখে তিনি বললেন,

‘এটা কি করলি জুলি? পাগল হয়ে গেছিস?’

‘হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি। এই ছোটলোকের বাচ্চার সাহস কি করে হয় আমার ছেলের সাথে ঘোরার?’

‘তাই বলে গায়ে হাত তুলবি? কি বিশ্রী ব্যাপার! ছেলেমেয়েরা সব বাড়িতে।’

বড় মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে গর্জে উঠলো দাদী।

‘মারছে বেশ করছে। আরো মাইর দরকার। আন্ডার মতন মানুষ। বাড়ির কাম করার জন্য আসছোস কাম করবি। আবার পড়াশুনা করতে হইব। দেখেই বুঝছিলাম এই মাইয়ার বদ মতলব আছে। এই বাড়ির পোলাগো মাথা নষ্ট করবো। এই বাড়িত পাকাপোক্ত জায়গা তৈরি করতে চায়। কইলাম ঘাড় ধইরা বের কইরা দেও। হুনবা না তো কথা।’

‘আমি তো সেটাই চাইছিলাম মা। কিন্তু ফাইজান? শুনেছেন তার কথা? এমনিতে বছরে একবার-দুবার বাড়ি আসে। এই মেয়েকে বের করে দিলে নাকি জীবনে আর বাড়ি আসবে না। যত্তসব ছোটলোকের দল।’

জাবিরের আম্মু আবার তেড়ে আসতে নিতে বড় মা থামিয়ে দিলেন। সোফায় বসিয়ে শান্ত হতে বললেন। আমাকে বললেন,

‘জাবিরের থেকে দূরে থাকবি জুঁই। অল্প বয়স দুজনের। কখন কি ঘটে যায়। দূরে থাকবি।’

এতক্ষণে সব পরিষ্কার হলো। বুঝতে পারলাম সব। চোখ বেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি নিজেকে শক্ত করে মাথা নাড়লাম। সব দোষ মেনে নিয়ে ক্ষমা চাইলাম। বললাম,

‘ঠিক আছে। দূরে থাকবো। আর এমন হবে না!’

‘আচ্ছা, যা ঘরে যা।’

বড় মায়ের কথা মতো রুমে চলে আসলাম। কোনরকমে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। বুকে কি যে কষ্ট হতে লাগলো। ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে কেঁদে গেলাম। পাশে সালেহা খালার ঘুম যেন না ভাঙ্গে।

পরের দিন এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে আড়ালে আড়ালে রইলাম। এই ফোলা গাল জাবিরের চোখে না পড়ে যেন। জানতে পারলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে দিবে। ছেলেটার প্রচন্ড রাগ। খুবই জেদি। একবার মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করে তিনদিন না খেয়ে ছিল।

চ’ড় খেয়ে কারও প্রতি বিদ্বেষ জন্মেনি। কারো প্রতি অভিমান পুষে রাখি নি। এটা আমার প্রাপ্য ছিল। কিছু জিনিস থেকে দূরে দূরে থাকতে হয় সবসময়।

সারাটা দিন গেল। জাবিরের চোখ থেকে পালিয়ে পালিয়ে। সন্ধ্যার পর খালা জানালো জাবির বাড়ি নেই। ওর ছোট ভাই জাকারিয়াকে আনতে গিয়েছে। জাকারিয়া এ বাড়িতে খুব কম থাকে। ছোটবেলা থেকে নানাবাড়ি বড় হয়েছে। তার মা নানুর কাছে রেখে কলেজে যেত। সেটা অভ্যাস হয়ে গেছে। মায়ের থেকে নানু প্রিয় বেশি। যাক! জাবির তাহলে বাড়ি নেই। অবশেষে একটু স্বস্তি মিললো। চিন্তামুক্ত হয়ে কাজ করতে লাগলাম।

_______

তারপরের কিছু দিন একই রকম কাটলো। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতে স্কুল ছুটি দিয়েছে। যার দরুণ সারাদিন বাড়িতে। জাবিরকে এ কয়েকদিন তেমন চোখে পড়লো না। আমিও নিজের মত কাজ করে গেলাম।

সপ্তাহ খানেক যেতে এক অবিশ্বাস্য খবর কানে এলো। জাবিরকে নাকি কলেজ হোস্টেলে পাঠানো হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তার নতুন কলেজ বাড়ি থেকে বেশ দূরে হয়ে গেছে। তাই বলে হোস্টেলে চলে যাবে? ভয়াবহ মন খারাপ হয়ে গেল আমার। নিজের ভেতর অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো। বার বার মনে হলো আমার জন্য ছেলেটাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমার জন্য পরিবার ছাড়া থাকবে সে।

সেদিন সারা বিকেল চিন্তা করলাম। সারা সন্ধ্যা, সারা রাত্রি চিন্তা করলাম। উপায় খুঁজলাম। শেষ রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। আমি চলে গেলেই তো সব ঝামেলা শেষ। ইদানিং সবাই আমার জন্য ফাইজান ভাইকেও কথা শোনায়। মানুষটা নেই, তবুও প্রতি মুহূর্ত কথা শুনছে। থাকবো না আমি এই বাড়ি!

মুদ্রার উল্টো পিঠের মতো পরক্ষণে মনে প্রশ্ন জাগলো, কোথায় যাবো আমি? যাওয়ার তো জায়গা নেই। আব্বা খোঁজ নেয় না বহুদিন। এ বাড়িতে কাজ করে, খাওয়া বাদে মাস শেষে কয়েক হাজার টাকা দেয়। সে টাকা থেকে পড়াশুনা বাবদ খরচ রেখে বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখি। ফাইজান ভাইয়ের কথামতো একাউন্ট খুলেছি। তাতে আর কত টাকা হয়েছে! ওই দুই পয়সা নিয়ে কোথায় যাবো?

ভোর হতে হতে আমার চিন্তারা উড়াল দিলো। বুঝলাম আমার এই বাড়ি ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা নেই।

_______

দিন চারেক পর জাবির হোস্টেল চলে গেল। সত্যি সত্যি গেল। কেউ বাঁধা দিলো না। হোস্টেলে নাকি পড়াশুনা ভালো হবে। জাবির যদি সুস্থ মতো হোস্টেলে যেত আমার আফসোস ছিল না। কিন্তু আমার জন্য জোর জবরদস্তি করে পাঠাচ্ছে এটা বেশি পীড়া দিল।

চলে যাওয়ার আগের দিন সন্ধায় জাবির লুকিয়ে দেখা করলো। আমার থাকার ঘরটাতে! তখন চারিদিকে আযান পড়ছে। ওযু করে বের হতে দেখি সে রুমে দাঁড়িয়ে আছে। কি যে ভয় পেয়ে গেলাম। কেউ দেখে ফেললে?

আমাকে প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ দিল না সে। ঝটপট বললো,

‘আমি কাল হোস্টেলে চলে যাচ্ছি। পড়াশুনা করিস ঠিকমত। মোটামুটি কাছে-ই কলেজ। কয়েক দিন পর পর এসে ঘুরে যাবো।’

আমার মনে তখন তীব্র ভয়। এই বুঝি কেউ দেখে ফেলবে। সালেহা খালা একটু হাঁটতে বের হয়েছে। এই বুঝি এসে পড়ল। আমার ছটফটানি দেখে কাছে এগিয়ে এলো জাবির। হঠাৎ একটা বাটন ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘এটা রাখ। লুকিয়ে রাখবি। ফাইজান ভাই, তোর বাবা এদের সবার সাথে কথা বলবি।’

একটু সময় নিয়ে বললো,

‘মাঝে মাঝে আমিও ফোন দিবো।’

‘অসম্ভব! এটা রাখতে পারবো না আমি।’

তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলাম। সত্যি অসম্ভব। আমি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। একটু বেচেঁ থাকতে চাই। বেচেঁ থাকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে আমার জন্য। জাবির কেমন আনমনা হয়ে গেল। আমি এভাবে ফোন ফিরিয়ে দিবো আশা করেনি হয়তো। ফোনটা চোখের পলকে প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে ফেলল।

‘ঠিক আছে। আসি। পড়াশুনা করিস ঠিকমতো। আর একটু কষ্ট হলেও এ বাড়িতে থেকে যাস। তোকে খুঁজে বের করার আর কোনো পথ জানা নেই আমার।’

উত্তর দিলাম না। মাথা নত করে রইলাম। জাবির ভারী কিছু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো। চেয়ে দেখি উপহার। ফুলেল কাগজ দিয়ে মোড়ানো। বাহিরের দেহাবরণ দেখে মনে হচ্ছে মোটা কোনো বই। দরজার পানে তাকালাম আমি। আস্তে আস্তে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বেচেঁ থাকা এতো অদ্ভুত কষ্টের কেন?

_________

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আজ। পৃথিবী কাঁপিয়ে বাতাস বইছে। রুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে সেসব দেখছিলাম আমি। বিষণ্ণ দৃষ্টি বার বার ঝাসপা হয়ে আসছে। ভেতর জুড়ে হাহাকার শুধু। এই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে মন চাইছে। এই জীবন ছেড়ে দূরে, বহুদূরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

বৃষ্টির ছাঁটে অর্ধভেজা হয়ে গেলাম প্রায়। ভাগ্যিস খালা রুমে নেই। বসার ঘরে সে বড় মায়ের মাথায় তেল দেয়। নয়তো বকা দিতো। জানালা বন্ধ করে সরে এলাম। পুরনো ব্যাগ থেকে বের করলাম উপহার। জাবিরের দেওয়া। খুলে দেখা হয়নি। ছেলেটা মাস দেড়েক হলো হোস্টেলে গেছে। বলেছিল, কিছুদিন পর পর আসবে। কিন্তু আসছে না। কার উপর অভিমান করেছে?

মোড়ানো কাগজ সরাতে বই দেখতে পেলাম। মোটাসোটা, পুষ্ট বই। সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’। মাঝে কিছুদিন টুকটাক গল্পের বই পড়তে দেখেছে। তার থেকে ধারণা করে কিনে দিয়েছে। আনমনে হেসে উঠলাম। ভেতরে ভালো লাগার সৃষ্টি হলো। বইয়ের পাতা উল্টাতে গুটি গুটি অক্ষরের কিছু লেখা ভেসে উঠলো। পড়ার আগেই বাহির থেকে সামান্তা আপুর গলা ভেসে এলো।

‘জুঁই! দ্রুত বের হ।’

বই লুকিয়ে রেখে দৌঁড়ে বের হলাম আমি।উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,

‘হ্যাঁ আপু।’

‘চল বৃষ্টিতে ভিজবো। ছাদে যাই।’

আমার মনটা নেচে উঠল। কিন্তু পরমুহুর্তে থেমে গেলাম। আপুর আম্মু যদি আবার রেগে যায়! মন খারাপ করে বড় মায়ের দিকে তাকালাম। চোখের ইশারায় তিনি যেতে বললেন। তার প্রয়োজন পড়লো না। সামান্তা আপু ততক্ষণে আমার হাত ধরে ছুট দিয়েছে।

বাড়ির ছাদে প্রায়ই আসা হয়। কাপড় চোপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তখন কাজের চাপ থাকে বলে চারিদিক খেয়াল করা হয় না। আজ বাদল মুখর দিনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। কি চমৎকার প্রকৃতি! আপু একটানে ছাদের মাঝে নিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দিল। বৃষ্টির শীতল স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠলো আমার। বহুদিন পর আলাদা প্রশান্তিতে দেহ-মন ভরে উঠলো। আপু বৃষ্টির পানি দিয়ে ছোড়াছুড়ি করছে। কিছু পানি আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। ঝলমলে সুরে বলল,

‘জুঁই জানিস। আমি একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। দীর্ঘদিন হলো। অথচ মানুষটা কিচ্ছু বুঝে না। এত্তো গর্দভ! গাধাটাকে কি করে বুঝানো যায় বলতো?’

‘কোন গাধা?’

‘তোদের পরিচিত এক গাধা!’

(চলবে)