ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৬

0
200

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৬]

অস্তমান চন্দ্রের ন্যায় অন্তিকের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে রুহিয়া।অন্তিক ভ্রুযুগল কিঞ্চিত কুঁচকে তাকায়।রুহিয়া মৃদু স্বরে বলে,
‘একজন মা জেনেশুনে কখনোই সন্তানের ক্ষ তি করতে পারে না।সানফি আমার মেয়ে,আমার দ্বারা কখনোই ওর খা রাপ হবে না।’

বাক্যদ্বয় বলেই রুহিয়া দ্রুত পায়ে চলে যায়।অন্তিক কিয়ৎক্ষণ উদাস দৃষ্টিতে রুহিয়ার প্রস্হানপথের পানে চেয়ে থাকে।
______________________________
শুক্রবার সপ্তাহের ছুটির দিন।দুপুরে আহার শেষে সবাই যখন ভাতঘুম দিতে ব্যস্ত অন্তিক তখন ল্যাপটপ আর ফাইলপত্র নিয়ে অফিসের কাজে বসেছে।বেশ মনোযোগ দিয়েই কাজ করছে অন্তিক।তবে তার মনোযোগ ভ ঙ্গের জন্য সানফির একটা ডাক‌ই যথেষ্ট।গুটিগুটি পায়ে সানফি এসে বললো,
‘বাবা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’

মেয়ের ডাকে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাকালো অন্তিক। মুচকি হেসে বললো,
‘বলো‌ বেবি কি বলবে বাবাকে।’

সানফি আবদারের সুরে বলে,
‘আজকে শুক্রবার।প্রতি শুক্রবারে আমার বন্ধুরা ঘুরতে যায়।আমি‌ই শুধু কোথাও যেতে পারি না।আজকে আমায় ঘুরতে নিয়ে যাও না বাবা।’

মেয়ের কথায় বেশ মায়া হয় অন্তিকের।কিন্তু তার তো সময় নেই,কাজের দরুণ বাইরে যাওয়া তো দূর কাজ রেখে ওঠাই দুষ্কর।অন্তিক সানফিকে কাছে টেনে বলে,
‘আজকে যে বাবার অনেক কাজ।বাবা তো আজ কোথাও যেতে পারবে না।বাবা তোমায় কাল নিয়ে যাবে।’

সানফি মলিন মুখে বললো,
‘না বাবা আমি আজ‌ই যাবো।কাল তুমি নিয়ে যাবে না আমি জানি।’

‘না সোনা আমি নিয়ে যাবো।সত্যি নিয়ে যাবো।’

‘উহু আমি আজ‌ই যাবো।’

সানফি বারবার জেদ করতে থাকে।অন্তিক নিজের রাগকে নিয় ন্ত্রন করতে ব্য’র্থ হয়ে ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
‘সানফি একদম আমায় বির ক্ত করবে না।সবসময় তোমার জেদ ভালো লাগে না।’

ব্যাস নিমিষেই সানফির দুচোখ গড়িয়ে জল পড়তে আরম্ভ করলো।সানফি কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘তুমি খুব ব্যাড বাবা,তুমি আর আমাকে একটুও ভালোবাসো না।’

বাক্যদ্বয় বলেই সানফি দৌড়ে চলে যায়।অন্তিকের এতোক্ষণে বোধগম্য হয় যে সে ঠিক কি করে ফেলেছে।তৎক্ষণাৎ সে ল্যাপটপখানা কোনোরকম বিছানার ওপর রেখে সানফির পেছন পেছন পা বাড়ায়।নিজ ঘরে গিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থেকে চোখের জল ফেলছে সানফি।অন্তিক’কে দেখে সে অন্যদিকে মুখ ঘোরায়।অন্তিক এগিয়ে যায়।সানফি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার প্রয়াস করতেই তার পথ আটকায় অন্তিক।হাঁটু গেড়ে বসে সানফির দু কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘আ’ম স্যরি সোনা।বিশ্বাস করো বাবা তোমাকে ধমক দিতে চাই নি।ভুল করে হয়ে গিয়েছে।বাবাকে ক্ষ মা করে দাও বেবি,বাবা আজ‌ই তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।’

মুখখানি অসহায় করে সানফির দিকে তাকালো অন্তিক।সানফি গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো।কিছুটা হতাশ হলো অন্তিক।সে জানে তার মেয়ের রাগ এতো সহজে কমবে না।সেজন্য‌ই অন্তিক দু কান ধরে কাঁদো কাঁদো মুখে বললো,
‘দেখো আমি কান ধরছি।এবার তো ক্ষ মা করে দাও বাবাকে।প্রমিস করছি বেবি আমি আর কখনো এমন করবো না।’

অন্তিক’কে কান ধরতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সানফি।অন্তিকের ঠোঁটের কোণে দৃশ্যমান হয় প্রাপ্তির হাসির রেখা।তবে পরক্ষণেই সানফি সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘ওকে আমি তোমাকে ক্ষ মা করতে পারি কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।’

কিঞ্চিত বিস্মিত হয় অন্তিক।কৌতুহলী কন্ঠে শুধায়,
‘শর্ত!কি শর্ত বেবি ?’

‘আমাদের সঙ্গে মাও ঘুরতে যাবে।তোমাকে আমায় আর মা’কে নিয়ে যেতে হবে।বলো তুমি কি রাজি?নয়তো তোমার সঙ্গে আড়ি।’

দু সেকেন্ড ভাবনায় নিমজ্জিত হলো অন্তিক।তৎপর শান্ত কন্ঠে বললো,
‘আমি রাজি।যাও তোমার মা’কে গিয়ে বলো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে।’

খুশিতে রুহিয়ার ঘরের উদ্দেশ্য ছুটে বেরিয়ে গেলো সানফি।অন্তিক উঠে দাঁড়িয়ে দুর্বোধ্য হাসলো।
_____________________________
অপরাহ্নের মাঝামাঝি।সূর্য তেজহীন হয়ে পড়েছে।কমলাটে আলোয় ছেয়েছে মেদিনী।বৃক্ষের পল্লবরাশি দুলছে হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে।নির্মল প্রকৃতি।পার্কের পরিবেশ বেশ সুন্দর।মা-বাবার হাত ধরে পার্কে হাঁটছে সানফি।সানফির মতো আরো অনেক বাচ্চাই তাদের মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে এসেছে।সবার‌ই হাসি হাসি মুখ।অনেকেই বিভিন্ন রাইডে চড়ছে।সানফি চারদিকে ঘুরে রাইডে ওঠার জন্য বায়না করে।অন্তিক মেয়ের ইচ্ছায় সম্মতি দেয়।ভীষণ খুশি হয় সানফি,সগ্রাহে গিয়ে বসে অক্টো’পাস নামক রাইডটিতে।মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে এসে এক সাইডে দাঁড়ালো অন্তিক।অন্তিকের পাশেই রুহিয়া দাঁড়িয়ে আছে।আকাশি রঙের থ্রিপিস পরেছে রমণী,চুলগুলো একপাশে ছেড়ে দেওয়া,মুখে হালকা পাতলা সাজ।বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।হঠাৎ অন্তিকের দৃষ্টি থমকায় রুহিয়ার দিকে।মুগ্ধতায় ছেয়ে যায় হৃদয়,নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় সে রমণীর বদনপানে।কিয়ৎকাল অতিবাহিত হয় এভাবেই।কিছু একটা মনে করে রুহিয়া পাশে তাকাতেই অন্তিকের সঙ্গে তার দৃষ্টি মিলিত হয়।অন্তিক চটজলদি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।রুহিয়া মৃদু হাসলো।বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার কিয়ৎদংশ পূর্বে পার্ক থেকে বের হলো তিনজনে।ধীরে ধীরে বাকি সবাই‌ও বেরিয়ে যাচ্ছে।পূর্বের ন্যায় বাবা-মায়ের হাত ধরে অগ্রসর হচ্ছে সানফি।সহসা হাঁটতে হাঁটতে সে দাঁড়িয়ে যায়।অন্তিকের দিকে তাকিয়ে আবদারের সুরে বলে,
‘বাবা আইসক্রিম,আমি আইসক্রিম খাবো।’

‘না বেবি এখন আইসক্রিম খাওয়া যাবে না,ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।’

অন্তিকের থেকে নাকচ পেয়ে মুখ ভার করলো সানফি।রুহিয়া সানফির গালে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
‘সোনা তুমি আমার সঙ্গে এসো,আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি।’

লহমায় সানফি পুলকিত চাহনিতে তাকালো।অন্তিক বির’ক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করলো।রুহিয়া সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দুটো আইসক্রিম কিনে আনলো।একখানা সানফিকে দিলো আর আরেকটা নিজের জন্য।মা আর মেয়ে বেশ আনন্দ করেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে।অন্তিক নীরব দর্শকের ন্যায় দুজনের কাহিনী দেখছে।আইসক্রিম খাওয়া শে ষে রুহিয়া সানফির মুখ মুছিয়ে দিলো।সানফি হাসিমুখে বললো,
‘থ্যাংক ইউ মা তুমি খুব ভালো।’

বিনিময়ে মুচকি হাসে রুহিয়া।অন্তিক আড়চোখে তাকায় রুহিয়ার আননপানে।বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘নিজের বাচ্চা আইসক্রিম খাওয়া শিখে গেলো আর উনি এখনো আইসক্রিম খাওয়া শিখলেন না।ঠোঁ টের চারদিকে যে আইসক্রিম লেগে আছে সেদিকে তো তার হুঁশ-ই নেই।’

গম্ভীর মুখে অন্তিক এগিয়ে এলো‌ সানফি এবং রুহিয়ার নিকট।পকেট হতে একখানা টিস্যু বের করে রুহিয়ার পানে এগিয়ে দিলো।রুহিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘কি করবো এটা দিয়ে?’

অন্তিক রেগে চোয়ালদ্বয় শ ক্ত করে বলে,
‘তোমার মা থা আর আমার মু ন্ডু।মুখটা মোছো ইডিয়েট,পুরো জোকারের মতো লাগছে দেখতে।’

ভ্যাব লার মতো তাকায় রুহিয়া।সানফি হো হো করে হেসে দেয়।রুহিয়াও হেসে ফেলে।অন্তিকের হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে গলার স্বর নামিয়ে বলে,
‘আয়না হবে?না মানে একটু মুখ দেখতে পারলে মুছতে সুবিধা হতো।’

আরেকদফা বি র ক্ত হলো অন্তিক।বির ক্তির সাথে রাগ‌ও হচ্ছে তার।তবুও মুখে কিছু বললো না সে।রাগা’ন্বিত হয়ে রুহিয়ার হাত থেকে টিস্যুখানা নিয়ে নিজেই রুহিয়ার মুখ মুছিয়ে দিলো।কিঞ্চিত ল জ্জা পেলো রমণী।নত মস্তকে বললো,
‘ধন্যবাদ।’

‘ইটস্ ওকে চলো এবার।তোমাদের জন্য সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।’

ফের বাক্য বাড়ালো না কেউ‌ই।চুপচাপ দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসলো।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে অন্তিক গাড়ি স্টার্ট দিলো।
__________________________________
ঝুমঝুমি এক সন্ধ্যা নেমেছে।সূর্য অস্ত গিয়ে অম্বরে দেখা মিলেছে শশীর।বিহঙ্গরা ফিরেছে আপন নীড়ে।রাস্তার দুধারে জ্ব ল ছে সোডিয়ামের হলুদ বাতি।বাইরে থেকে ফিরে ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হলো রুহিয়া।টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে রান্নাঘরে এলো সবার জন্য চা বানাতে।বসার ঘরে সোফায় বসে টুকটাক কথা বলছেন শামীম আহমেদ এবং মিসেস সাবিনা।বাকিরা যে যার ঘরে রয়েছে।রুহিয়া উনাদের চা দিয়ে বাকিদের চায়ের কাপগুলো ঘরে দিয়ে এলো।অন্তিক চা খায় না সেজন্য রুহিয়া কফি বানিয়েছে তার জন্যে।সবাইকে চা দেওয়া শে ষে রমণী এবার কফির মগ হাতে নিয়ে প্রবেশ করলো অন্তিকের ঘরে।বিছানায় হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে অন্তিক।রুহিয়া কফির মগটা বেড সাইডে টেবিলে রাখে।ঠক করে শব্দ হ‌ওয়ায় মুখ তুলে তাকায় অন্তিক।রুহিয়া মৃদু স্বরে বলে,
‘তোমার কফি।খেয়ে নাও নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

অন্তিক রুহিয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাশভারী কন্ঠে বলে,
‘এক সময় কফি খাওয়া আমার অভ্যেস ছিলো কিন্তু বর্তমানে সময়ের সাথে সাথে তা হারিয়ে গিয়েছে।নিয়ে যাও এটা,আমার বিষয়ে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।’

খানিকটা ব্য থিত হলো রুহিয়া।অন্তিকের দিকে তাকালো অসহায় দৃষ্টিতে।অন্তিক পুনরপি মনোনিবেশ করলো আপন কাজে।কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না রুহিয়া,মলিন মুখে বেরিয়ে এলো ঘর হতে।দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বিষয়খানা দেখে সানফি।অতঃপর সে ছুটে আসে গুঞ্জন আর অতুলের কাছে।অফিসের ফাইল দেখছিলো অতুল,আর তার পাশেই বসে রয়েছে গুঞ্জন।সানফি এসে ডাকে তাদেরকে,
‘কাকাই,মামনি তোমাদের সাথে আমার একটা কথা আছে।’

অতুল ও গুঞ্জন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে,কিন্তু কিছু বোধগম্য হয় না।অতুল সানফিকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
‘কি কথা সানফি?’

বিছানার ওপর উঠে বসলো সানফি।মুখে একটা সিরিয়াস ভাব এনে বললো,
‘বাবা আর মায়ের ঝগড়া হয়েছে।ওরা দুজন একে অপরের সাথে কথা বলে না।বাবা সবসময় মা’কে বকে।আমার ভালো লাগে না কাকাই।আমাদের কিছু একটা করতে হবে,বাবা আর মায়ের মধ্যে ভাব করাতে হবে।’

চলবে
[ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।]
ধন্যবাদ ____________🧡