মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১০

0
368

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#দশম_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“দেখ দেখ জয়ি আকাশটা কিরকম রঙিন হয়ে যাচ্ছে।আমাদের ছোটবেলায় এত বাজির বাড়াবাড়ি ছিলোনা বল?” আজ অনেকদিন পর কালীপুজোর রাতে স্বামী স্ত্রী দুজনে ছাদে এসে বসেছে।
বিয়ের পর পর প্রায় রাতেই জয়ি বায়না করতো ছাদে আসার।এমনকি চেন্নাই গিয়েও যে বাড়িতে ওরা ভাড়া থাকতো তার ছাদে উঠে বসে থাকতো দুজনে।
তারপর আসতে আসতে ব্যস্ততা এসে ওদের এই ছোট ছোট ইচ্ছে গুলোকে কোথায় হারিয়ে দিলো।
এখন রাতের আকাশ দেখা বলতে নিজের ঘরের ব্যালকনি থেকে যা চোখে আসে।
আজ এই কালীপুজোর রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে হঠাৎ ঋষি বলেছিল,”চল ছাদে যাই”।জয়ি তো এক কথায় রাজি।
ঘন্টা খানেক হলো ওরা এসে বসে আছে ছাদে।
“ঋষি আমি ভাবছি এবছর ভাইফোঁটা করবো বাড়িতে”,রণ আর রাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে পোকাটা আবার মাথা চারা দেয় ওর।
চুপ করে থাকে রণর বাবা।
-“কিরে কিছু বলছিস না।”
-“জয়ি ছাড় না।তোর থেকে এগুলো আশা করিনি।কেন সেই একই জিনিস নিয়ে পরে আছিস?”
-“পরে আছি কারণ রাই পরের মেয়ে।ওর একটা ভবিষৎ আছে।আজ আমার একটা মেয়ে থাকলে আমি ভাবতাম না,কিন্তু একই ছাদের তলায় একটা প্রায় সমবয়সী ছেলে মেয়ে থাকলে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠবে।হয়তো প্রশ্নের মুখে পড়বে মেয়েটার আগামী জীবন।”
ঋষি কোনো কথা বলতে পারেনা।কারণ ও নিজেও জানে আমাদের সমাজের কথা।একে অনাত্মীয় বাড়িতে এসে একটা ইয়ং মেয়ে থাকছে তাতেই লোকের কৌতূহলের শেষ নেই।তারওপর রণর উপস্থিতি।কি বলবে বুঝতে পারেনা ও।
কিন্তু ঋষি ওর নিজের ছেলের বন্ধু হওয়ার সুবাদে এটাও বোঝে রণ রাইকে স্নেহ করলেও তাতে বড় দাদার মনের ভাব নেই।
ও নিজেও কথা বলে দেখেছে রণ রাইকে শুধুই বন্ধু বলে মনে করে,এই বয়সে তা আর অন্য অনুভূতি যোগ করেছে কি রণ বুঝতে দেয়না।কিন্তু ঋষি ছেলে হিসেবে বোঝে রাইকে আলাদা একটা প্রটেকশনে রাখে রণ।
পুজোর ছুটিতে রাই জয়ন্তর কাছে গেছিল,জয়ন্ত ওদের সকলকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আসলে,কিন্তু ঋষিদের যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
একদিন ঋষি দেখে ফেলেছিল রণ রাইয়ের ফাঁকা ঘরে গিয়ে চুপ করে বসে কিছু ভাবছে।
ঋষি পায়ে পায়ে ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতে চমকে উঠেছিল রণ।
বাবাকে দেখে হেসে ফেলেছিল ও,”একজন বাড়িতে এসে থাকলে সে যখন আবার চলে যায় বাড়িটা একটু ফাঁকা লাগে তাই না বাবা?”
হেসেছিল ঋষি,”তুই রাইকে মিস করছিস! অন্যবার তো পুজোর কদিন তোর বন্ধুদের বাড়ি কেটে যায়।এবার কি হলো?”
“আরে না না,ঠিক মিস করিনি।এই ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম,রাই প্রায় সময় এই জানলার ধারে বসে থাকে নাহলে পড়ার টেবিলে পড়ে দেখতে পাই…তাই আজ দেখতে না পেয়ে…ঢুকে পড়েছিলাম ওর ঘরে”,লজ্জা চাইলেও লুকোতে পারেনা ও।
“ফোন করেছিলি রাইকে?”ঋষির মনে পড়ে জয়ি রাইকে আনার সময় সবচেয়ে বেশি চিন্তায় ছিল রণকে নিয়ে।
“না,ওখানে ওর ফোনে টাওয়ার নেই।মম বলছিল জয়ন্ত আঙ্কেলের ফোনে ওর সাথে কথা বলে।” সারাদিনে রণ যে কতবার চেষ্টা করে ওর নম্বরে,যদি একবার ফোনটা লেগে যায়,একবার গলা শুনতে পায় ওর।
“রাইকে তোর এখন আর খারাপ লাগে না,না রে রণ?যে অনিশ্চয়তা ছিল পরের মেয়ে নিয়ে সেটা নেই তো আর?” ঋষি ইচ্ছা করে খোঁচা মারে।
উত্তর দেয়না রণ প্রথমে।ও কি বলবে! রাই যে একদম আলাদা ওর দেখা মেয়ে গুলোর থেকে,কিন্তু বড্ড বেশি সরল।তাই জীবনে ভুল করার চান্স ও বেশি।
রণ খেয়াল রাখে যাতে এখনকার অতি চালাক কিছু মানুষের দ্বারা ও প্রতারিত না হয়।তাও ভয় থেকেই যায় অবচেতনে,ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে কেউ যদি ঠকায়।

“কিরে কিছু বলছিস না?রাই কিন্তু ওরকম মেয়ে না।” ঋষি হাত রাখে রণর কাঁধে।
“বাবা আমি নেহাতই ছোট।কিন্তু যেটা মনেহয় অতিরিক্ত সরল সাদাসিধে মেয়েদের নিয়েই ভয়টা বেশি।যে কেউ ঠকিয়ে দিতে পারে,বিশেষ করে রাইয়ের মত চুপচাপ মেয়ে যে মনে মনে এই মুহূর্তে খুব একা।আমি তাই চেষ্টা করি মম বিজি থাকলে ওকে সময় দিতে,যাতে ও লোনলি ফিল না করে।ওর এতটাই কাছের বন্ধু হতে চাই যাতে ও সবটা বলতে পারে আমায়।” রণ খুব ধীর স্বরে কথা গুলো বলে।

অবাক হয় ঋষি রণর পরিণত বোধ দেখে।সত্যি বলতে কলেজ লাইফ অবধি ঋষি ছিল উচ্ছ্বল, চঞ্চল একটা ছেলে।রণর মত এই বয়সে এসব ভাবার পরিণত বোধ তো ওর ছিলই না,উল্টে ও নিজেই প্লে বয় টাইপ ছিল।জয়িতার সাথে সম্পর্ক ওকে পরিণত করেছিল।হয়তো জয়িতার ম্যাচিউরিটি পেয়েছে রণ,গর্ব হয় ঋষির।
সেদিনের ওই কথাবার্তায় ঋষি বুঝেছিলো রণ রাইকে অনেকটা ইম্পট্যান্স দেয় নিজের জীবনে।তবে সেটা কিধরণের বুঝতে পারেনি ও।
ছেলেটা রণ বলেই হয়তো মনের তল পেতে পারেনি ঋষি,ওর বাবা হয়েও।
তাই জয়ির কথায় ও চুপ করে থাকে।ও জানে রণ না চাইলে ওকে দিয়ে জোর করে কিছু করানো যাবেনা।তাই ওর ওপর ছেড়ে দেয় সিদ্ধান্তটা।

কথা ঘোরাতে ঋষি বলে,”জানিস জয়ি সেই বাচ্ছা ছেলেটা,রণজয়,ও সুস্থ হওয়ার পথে।ওর বাবা বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের জন্যে বেশ কিছু সংস্থার কাছে ফিনান্সিয়াল হেল্প চেয়েছিল,অনেকটা টাকাই উঠে এসেছে।আর বেশ কিছু মানুষ পার্সোনাল হেল্প করেছে।লাস্ট উইক ওর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে।এখন শুধু ঠিক করে অবসার্ভ করা,যাতে কোনো রকম ইনফেকশন না হয়।তুই তো জানিস এই সময়টা কতটা ক্রিটিকাল।কিন্তু আমি শিওর ও সেরে যাবে।”
“দারুন একটা গুড নিউজ শোনালি।বাচ্ছাদের রিকোভারি রেট বেশি জানতাম,তাও চিন্তায় ছিলাম।বিশেষ করে আমার রণর নামে নাম যেদিন শুনলাম,একটা দুর্বলতা জন্মেই গেছিল ওর ওপর।উফ আজকের দিনে খুব ভালো একটা খবর।” পাশে বসা ঋষির কাঁধে মাথা নামিয়ে দেয় জয়িতা।
নিজের থেকেও বেশি খুশি হয় ঋষির জন্যে।
কদিন ধরেই ঋষি একটু মনমরা ছিল।শোভনের বাবার ফুসফুসে ক্যান্সার লাস্ট স্টেজে চলে গিয়েছিল।ফার্স্ট কেমো দেওয়ার পর সারভাইভ করতে পারলেন না।রোগ ধরা পড়ার দুমাসের মধ্যে এক্সপায়ার করে গেলেন।ঋষি যতই অভ্যস্ত হয়ে যাক মৃত্যুর সাথে,আজও পরিচিত,কাছের মানুষের এই রোগে চলে যাওয়া ওকে কষ্ট দেয়।
জয়ি জানে একদিনের জন্য হলেও মানসিক অবসাদ ঘিরে ধরে ওকে।কেউ বুঝতে না পারলেও জয়িতা অনুভব করতে পারে আজও ঋষি কে।আর শোভনের বাবার সাথে ঋষির ছোটবেলার স্মৃতি জড়িয়ে তাই মন খারাপটা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।শোভনের পাশে থাকতে আজ এত গুলো বছর পর ওরা ছুটে গেছিল ওদের গ্রামে।
তারপর যখন জয়ন্ত এলো রাইকে নিতে ওকে দেখেও ঋষি জয়ি একটু মানসিক ভাবে আহত হয়েছিল।নিজের কোনো খেয়াল যে জয়ন্ত রাখেন স্পষ্ট হয়েছিল ওর বাইরের চেহারা দেখেই। সারাজীবন পরিষ্কার করে দাড়ি কেটে ফিটফাট থাকা জয়ন্ত কে যখন একগাল দাড়িতে দেখেছিল চিন্তেই পারেনি ওরা,ওর হাসি গোঁফ দাঁড়ির জঙ্গলে হারিয়ে গেলেও সেটা যে ম্লান তা চোখ এড়ায়নি জয়ির।ওর চোখের হাসিতে যে কষ্ট তখনও স্পষ্ট ছিল তা রাইয়ের মুখটাও ছোট করে দিয়েছিল।
জয়ি রাইকে আড়ালে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছিল কিছু কথা,ফল মিলেছিল।লক্ষ্মীপুজোর পর যখন রাইকে আবার কলকাতায় পৌঁছে দিতে এলো জয় অনেকটা ভালো লেগেছিল ওকে।
“চল এবার নীচে যাই, অনেক রাত হলো।ছেলে মেয়ে দুটোকে কাল সকালে যা বলার বলবো যাতে পরশু বাড়ি থাকে রণ”, জয়ির কথা শুনে ঋষি বুঝতে পারে এ পোকা এখন নড়বে।ওর নিজেরও কৌতূহল আছে রণর মত জানার,তাই মুচকি হেসে জয়িকে অনুসরণ করে নিচে নেমে আসে।

“রণ ওঠে পর।প্রায় আটটা বাজে।কাল কখন ঘুমলি?” অনেকদিন পর জয়ি ছেলেকে সকালে ঘুম থেকে তুলতে ওর ঘরে এসেছে,উদ্দেশ্য আর একটা আছে যদিও।
রণ এসি চালানো বন্ধ করে দিয়েছে অনেকদিনই।কিন্তু জানালাটা একটু ফাঁক থাকে,তাই ভোরের দিকে শেষ হেমন্তের ঠান্ডায় গায়ে একটা হালকা চাদর টেনে নেয়।আর ওর স্বভাবে সেই চাদর মাথা অবধি না ঢাকলে ওর ভোরের ঘুম ঠিক গাঢ় হয়না।
সেই চাদর আরো টেনে ও ঘুরে শুলো জয়ির গলার আওয়াজে।
জয়ি বুঝলো ছেলে ঘুম ভেঙে মটকা মেরে শুয়ে আছে।ধীরে ধীরে ওর খাটে গিয়ে বসে।
“রণ একটা কথা বলার ছিল তোকে।কাল সকালে কোথাও পড়া নেই তো তোর?কাল বাড়ি থাকবি।”

মায়ের কথায় ঘুমের ঘোর কেটে চোখ অল্প খুলে ধরা গলায় বলে রণ,”কাল!!কেন কাল কি আছে?”
“কাল ভাইফোঁটা।রাখির দিন আমার এমার্জেন্সি ডিউটি এসে গেছিল,কিন্তু কাল সকাল আমি ফ্রি রেখেছি।কাল রাই তোকে…”,জয়ির কথা শেষ হয়না,রণ ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানায়।
“মম প্লিজ।প্লিজ ডোন্ট ফোর্স মি টু ডু দিস।য়্যূ নো আই’ম নট ইন্টারেস্টেড টু ডু দ্যাট টাইপ অফ হিপোক্রেসি…সো প্লিজ মম।মম রাই ইস ওয়ান অফ মাই গুড ফ্রেন্ড এন্ড আই থিংক ফ্রেন্ডশিপ ইস বেস্ট রিলেশনশিপ অ্যাবভ এভরিথিং।প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।…”,রণ নিজের ইমোশন কে কন্ট্রোল করতে পারেনা।বারবার পালানোর চেয়ে ফেস করাকে অনেক ইজি মনে হয় ওর কাছে।

জয়ি চুপ করে থাকে।ওর একটা আন্দাজ ছিল রণ এরকমই কিছু বলবে,কিন্তু রণ কি বয়সের ধর্ম অনুযায়ী রাই কে অন্যভাবে কিছু ভাবছে?কিন্তু এখন কি এমন বয়স ওর!
জয়িতা জানতো ওর ছেলে প্রথম থেকে এমন পরিবেশে বড় হয়েছে,কোয়েড স্কুলে পড়েছে তাই রাইকে এবাড়িতে আনার সময় অন্য কোনো চিন্তা ওর মনে আসেনি।এমনকি রাই এবাড়ি আসার পরও রণর ওর প্রতি নরম মনোভাব দেখে জয়ি ভেবেছিল হয়তো রাইয়ের জীবনের ট্রাজেডি এর কারণ।
কিন্তু রাখির কথা বলার পর থেকে ওর মনে একটা সন্দেহ উঁকি মারা শুরু হয়েছিল।এরপর ও লক্ষ্য করেছিল রণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি কেয়ারিং রাইয়ের প্রতি।
জয়ি এই ব্যাপারে চিন্তিত না,ওর চিন্তা অন্য জায়গায়।ও জানে ওর ছেলের প্রকৃতি,আর রাই সম্পূর্ণ উল্টো প্রকৃতির এক মেয়ে।তাছাড়া রাইয়ের মা ওকে বড় করেছে ঘরোয়া সংস্কারে,ওর প্রকৃতি খুব নরম।আজ রণ যখন বাইরের জীবনে মিশবে,বাড়ি ছেড়ে পড়তে চলে যাবে দূরে তখন কি আদৌ রাই ওর মনে থাকবে?তাছাড়া রাই যেন কখনো না ভাবে কোনো কিছু জোর করে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হলো,ওকে মেনে নিতে বাধ্য করা হল।হতেই পারে সেই অর্থে ওর পছন্দ ‘রণ’ হলো না।
“রণ রাইয়ের একটা ভবিষৎ আছে।আমি চাইনা লোকে ভুল বুঝুক।ও অনাত্মীয় বাড়িতে বিনা পরিচয়ে আছে,যেখানে একটা ওর বয়সী ছেলে আছে।আমাদের সমাজ খুব খারাপ বাবা,একটু বোঝার চেষ্টা কর।তুই কি…মানে… রাই কে…দেখ তোর বয়সই বা কি!আর কত দেখার বাকি।তাই…”,জয়ি কি বলবে ঠিক বুঝতে পারেনা।
জয়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই রণ বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়।
“লিসেন মম আমি এই একই কথা তোমায় বোঝাতে চাইছি।কি এমন বয়স আমাদের যে জোর করে আমাদের বন্ধুত্ব টা একটা সম্পর্কের নাম দিতে চাইছো।এই যে ব্রাদার সিস্টার বা অন্য যাহোক রিলেশন সবের একটা নিজস্ব বিউটি আছে,জোর করলে সেটা নষ্ট হয়।তুমি কেন এটা করছো?আর তুমি যদি নিজে নিজের কাছে ক্লিয়ার থাকো তাহলে কারোর কোনো ক্ষমতা নেই যে কিছু বলে।কিন্তু তুমি নিজেই হয়তো কনফিউসড।তাই তোমায় আমি বলছি আমি রাইকে খুব ভালো বন্ধু ভাবি,যেমন রুদ্র-শীর্ষা কে ভাবি।কি সমস্যা যদি আমরা বন্ধু হয়ে একই ছাদের তলায় থাকি,তোমরা তো আছো?আর আমি জয়ন্ত আঙ্কেলের সাথে কথা বলে যেটা বুঝেছি জয়ন্ত আঙ্কেল এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।তুমি বলো তোমরা তিন বন্ধু ছিলে,বাবা তোমার বয়ফ্রেন্ড হওয়ার পর তোমাদের দুজনের সম্পর্ক বদলেছিলো।কিন্তু জয়ন্ত আঙ্কেলের সাথে তো তোমার আজও সেই পুরোনো রিলেশন আছে,বন্ধুত্ব।তাহলে সেটাকে কি কোনো নাম দেওয়ার দরকার হয়েছিল?” রণ নিজের মত বোঝাতে ডেসপারেট হয়ে ওঠে।

জয়ি বুঝতে পারে রণ কোনোভাবেই এরকম সম্পর্কে বাঁধতে চাইছে না।আসলে রাইকে ও হয়তো সেই চোখে দেখেনি।সত্যি তো আজ ও আর জয়ন্ত খুব ভালো বন্ধু,একসময় বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।ওদের যখন অন্য কোনো নামের দরকার হয়নি তাহলে রাই-রণ কে কেন ও ফোর্স করছে!
কারণ জয়ি জানে দুটো পরিস্থিতি এক না।আর এই মুহূর্তে এটাও বুঝতে পারছে রণ কিছুতেই ভাইফোঁটার মত পবিত্র সম্পর্ক কে অবমাননা করবে না।ওর মনে রাই আর যাইহোক ওই সম্পর্কের দাবি করে না।
আর জোর করেনা জয়িতা।মনে মনে ভাবে যা হওয়ার হবে,যখন সেরকম অবস্থা আসবে ভাবা যাবে ।
ওর ছেলেকে ও ভালো করে চেনে।সাধারণত অবাধ্য হয়না ও,কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে একবার জেদ ধরলে ওকে বোঝানো কারোর পক্ষেই সম্ভব না।
কথা না বাড়িয়ে উঠে পরে ও রণর খাট ছেড়ে।
“রণ শুধু একটা কথা মনে রাখিস সন্তান সবাইকে বোকা বানাতে পারলেও মা কে পারেনা।আর পরের মেয়েটার দায়িত্ব আমি নিজে যেচে নিয়েছি তাই ওর কথার গুরুত্ব,ওর গুরুত্ব আমার কাছে সবার আগে।আজ তোর ওপর যেমন কিছু চাপিয়ে দিলাম না,ভবিষ্যতে ওর ওপরও কিছু চাপাবো না।এটা তুই সবসময় মাথায় রাখবি।ও যেন কোনোদিনও বাধ্য ভেবে কিছু না করে,সেটা আমি খেয়াল রাখবো।তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস,সব দিক বিবেচনা করে মনের লাগাম ছাড়বি।” রণর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জয়িতা।

মা বেরিয়ে যেতেই নিজের খাটে ধপ করে বসে পড়ে রণ।বুঝতে পারে মায়ের কাছে যতই চেষ্টা করুক ধরা পড়ে গেলো হয়তো।
ছোট থেকে কনভেন্টে পড়া রণজয় মায়ের কথা লাইন ধরে বুঝতে না পারলেও কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়না।
হয়তো ওর মনের দুর্বলতা ওকে আটকে দেয় মাকে জবাব দিতে কিন্তু ওর প্রতিবাদী মন কঁকিয়ে ওঠে।
‘আজও কতটা পিছিয়ে আমাদের সমাজ।একটা ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব মেনে নিতে ভয় পায়’।
রণ নিজেও জানে রাইয়ের ঘাড়ে জোর করে কোনো কিছুই ও চাপাবে না,তাই মায়ের কথায় ও বিশেষ বিচলিত হয়না।আর মা’ও এক বিশ্বাসে বিশ্বাসী বলে রাই ওর মনভাব নিজে না চাইলে জানতে পারবে না এটাও অনুভব করে।
ছোট থেকে ওর একটা বোনের খুব শখ।কিন্তু রাইকে যখন ও প্রথম দেখে ওর মধ্যে অন্য এক অনুভূতির নাড়া খায়।সে অনুভূতির ব্যাখ্যা ও নিজেও জানেনা।সেই দিন মেয়েটা কে দেখে মনে হয়,’পুরো পৃথিবী লড়ে যেতে পারি আমি তোমার মুখের হাসির জন্যে।মুঠো ভর্তি আনন্দ আনতে পারি তোমায় খুশি করতে’।
কখনো কোনো মেয়েকে দেখে আর ওই অনুভূতি আসবে বলে রণ মনে করে না।ওর বয়স হয়তো কম,অভিজ্ঞতা নেই।তাও জানে রাইয়ের জায়গা ওর জীবনে আর কেউ নিতে পারবে না।তাতে যদি ও কোনো দিনও রাইয়ের মনে জায়গা না পায় তাও ঠিক আছে।
কিন্তু রাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ও একদিন ঠিক হয়ে উঠবে এটা ও বিশ্বাস করে ।’বন্ধু’ সবথেকে বড় ভরসার স্থল।আর ও তাতেই খুশি।

রুদ্র নিজের ঘরের দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে জানলার কাছে চেয়ারটা টেনে এনে বসে।দুপুরবেলা মা ঘুমোচ্ছে,বাবা অফিসে।মনের মধ্যে এক অদ্ভুত বিবেক দংশন হচ্ছে।কাল কালীপুজোর রাতে ওর পুরোনো ব্যাচমেট সুহৃদ এসেছিল।এখন ও অন্য স্কুলে চলে গেছে বলে আগের মেলামেশা আর নেই,তবে ফোনে যোগাযোগ আছে।মা কে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে জোর করে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়।কেউ ছিলোনা ওদের বাড়ি কাল,সেই সুযোগে সুহৃদ বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করেছে ।
জীবনে প্রথমবার একসাথে বেশ কিছু নিষিদ্ধ কাজ করেছে রুদ্র।সেই সময় বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল,কিন্তু আজ সকালে ঘুম ভেঙে থেকে অদ্ভুত এক বিবেক দংশন হচ্ছে ওর।
ও জানে ও যে স্কুলে পড়ে, যাদের সাথে মেশে তাদের কাছে এগুলো কোনো ব্যাপার না।এমনকি বোর্ড এক্সাম হওয়ায় বছর দুই তিন আগে থেকেই তারা এগুলো এনজয় করছে।কিন্তু রুদ্র কখনো এধরনের কাজ করেনি শুধু বাবা মার মুখ চেয়ে।ও জানে ওই স্কুল পড়লেও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ওর পক্ষে সম্ভব না।
বিয়ার পার্টি তে প্রথমবার বলে ও গেস্ট থেকেছে পরে থাকলে ওকেও কন্ট্রি করতে হবে।
কিন্তু ওই ভিডিও গুলো।এমনি নেটে দেওয়া ভিডিও ও নিজেও আগে এক দুবার দেখেছে,কিন্তু তাই বলে নিজেদের বান্ধবীর ভিডিও,বৌদির ড্রেসিং রুমে হিডেন ক্যামেরা রেখে তোলা ভিডিও…না না রুদ্র মেনে নিতে পারছে না।ও দেখতে চাইছিল না সুহৃদ আর ওর এখনকার এক স্কুল মেট বিয়ার খাইয়ে জোর করে…বড্ড মনে চাপ পড়ছে ওর।কাকে যে কথা গুলো বলে একটু হালকা হবে।
নিজের চিন্তায় ডুবে ছিল রুদ্র হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল।
“হ্যাঁ রণ বল”,ফোনের স্ক্রিন দেখে ফোন ধরে বলল রুদ্র।
“তুই বাড়িতে আছিস?আমি আসছি।একটু ডিসটার্বড আছি।তোর কাছে ফ্যাগ আছে ?” এখনো নেশায় পরিণত হয়নি ব্যাপারটা,কিন্তু আজ প্রচন্ড অস্থিরতার মধ্যে মনে হচ্ছে মগজে একটু ধোঁয়া দিলে মাথাটা ঠান্ডা হত।
“না নেই রে।বাড়িতে আমি আনিনা।আমারও তোকে কিছু বলার আছে কিন্তু বাড়িতে হবে না।আমাদের বাড়ির সামনে,না না…উমম…হ্যাঁ ওই বড় রাস্তার ধারে যে নতুন মলটা হয়েছে ওখানে আয়।আমিও পৌঁছছি দশ মিনিটে”,রুদ্রর মানসিক চাপ একটু কমে।
“ঠিক আছে ভাই।আসছি”,ফোন ছেড়ে দেয় রণ।

“দেখ রণ আমি জানি খারাপ ভালো বলে কিছু লিমিট হয়না।কিন্তু তাই বলে নিজের বৌদি?!আর চঞ্চলের গার্লফ্রেন্ড ও তো ওকে বিশ্বাস করেছিল ও সেটা ভিডিও করে এনে…আমি জাস্ট ডাইজেস্ট করতে পারছিনা”,সিগারেটের ধোঁয়াও রুদ্রর মন মাথা ঠান্ডা করতে পারেনি বুঝতে পারে রণ।
আসলে রুদ্র ছেলেটাই এরকম,আজকের যুগের তুলনায় বড় বেশি সৎ।হয়তো বাড়ির শিক্ষা সংস্কার আছে বলেই বিবেকটা আছে।নাহলে ওদের জেনারেশন ‘মস্তি’র নামে সব লিমিট ছড়িয়ে যায়।
রণ এই কারণেই ছেলেটা কে এত পছন্দ করে।ওর বাবার অবস্থার কারণে ওকে অনেকে হেও করে শুধু না,ছেলেটার নিজেরও একটু স্ক্রু ঢিলে আছে,কোথায় কখন কি বলতে হয় ভেবে বলেনা।ওই মনটা পরিষ্কার বলেই হয়তো প্যাঁচটা এখনো রপ্ত হয়নি।
কালই সুহৃদদের যা বলে এসেছে ও আর কোনোদিনও ওর মুখ দেখবে বলে মনে হয়না।
রণ কাউন্টারে একটা টান দিয়ে হাসতে থাকে।
“কিরে হাসছিস কেন শুধুশুধু!তুই কি বলবিলি বলছিলিস,মুড অফ বললি”,রুদ্র রণর হাসিটা দেখতে পেয়ে বলে।
“না রে আমার এমনি মুড অফ ছিল।তোর সাথে কথা বলে ঠিক হয়ে গেল”,এড়িয়ে যায় রণ ওর মানসিক অস্থিরতার কারণটা।
আজ খাবার টেবিলে মায়ের গম্ভীর মুখ বুঝিয়ে দিয়েছে মা ওর ওপর সন্তুষ্ট না।কিন্তু এটা ওকে মেন্টালি ইরিটেড করছে।
বহুবছর আগে যদি মা-বাবার সম্পর্কে কেউ জোর করে ঢুকে কিছু জোর করে চাপাতে চাইতো মা কি মেনে নিত?

-“আচ্ছা রণ তোকে একটা প্রশ্ন করবো?”
-“কর”।
-“তোদের বাড়ি একজন অপরিচিত মেয়ে এসে আছে,তোর প্রাইভেসি হ্যাম্পার হয়না?আঙ্কেল আন্টির কথা বাদ দিলাম।তোর প্রবলেম হয়না?”রুদ্র বেশ কদিন ধরে মনে আসা প্রশ্নটা করেই ফেলে।
-“কিকরে হবে?রাই যে কারোর প্রাইভেসি তে নাক গলাতেই জানেনা।নিজের ঘরেই বেশিরভাগ থাকে,মা বাড়ি থাকলে আর ও ফ্রি থাকলে একটু মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে।ওর মা’ই ওর সব ছিল।প্রচন্ড চাপা ও,কাউকে প্রবলেমে ফেলা দূর নিজের প্রবলেম অবধি শেয়ার করেনা”।

রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রণর দিকে।ও আশা করেনি এরকম আনসার পাবে।রণ যে মেয়েটাকে একটু বেশিই ইম্পট্যান্স দেয় রুদ্র আগের দিনই বুঝেছিলো।আজ তাই যেচেই জিজ্ঞেস করলো ।
লোকে ভাবে ও বোকা,তাই ও বোকা সেজেই থাকে ।কিন্তু অন্য অনেক জিনিয়াস স্টুডেন্টের তুলনায় ওর অবসার্ভেশন অনেক শার্প।তাই ওর মোটা বুদ্ধি বুঝতে ভুল করেনা ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।কিন্তু বন্ধুকে আর প্রশ্ন করেনা।
শুধু একটু অবাক হয়।দেখতে সুন্দরী মেয়েটা,কিন্তু বড্ড সিম্পল।রণর উজ্জ্বল ভবিষৎ ওকে যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে আদৌ এই মেয়েটার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটাই ভাবে।
রণর ইনফ্রাচুয়াশনকে তাই বিশেষ পাত্তা দেয়না রুদ্র।
উঠে পড়ে দুজনে পার্কের বেঞ্চ ছেড়ে।

“এসো দিদি।” ফ্ল্যাটের দরজা খুলে জয়িতা কে দেখে সুলেখা বলে।
দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সুলেখার হাতে সাথে করে আনা ফল আর অন্য দরকারি জিনিসের ক্যারিব্যাগ গুলো ধরিয়ে দেয় জয়ি।
“মা কি করছে সুলেখাদি”,দরজার পাশের ছোট ঘরে চটি ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করে জয়ি।
“মাসিমা আজ দুপুরে একটু সেলাই নিয়ে বসেছে।ওই শখ করে করে গো।যাও না ঘরে।চা খাবে তো দিদি?” সুলেখা জয়িকে বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
জয়িও নিজের মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।
নিজের মনে একটা টেবিল ক্লথের সাইজের কাপড়ে সূঁচ সুতো দিয়ে মনের মত কলকা বানাচ্ছিলেন মমতা।হঠাৎ পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে মেয়েকে দেখে একগাল হাসিতে মুখ ভরে যায়।
জয়ি গিয়ে বসে মায়ের পাশে।
সেলাই পাশে সরিয়ে রেখে হাসি মুখে তাকান মেয়ের দিকে।
“কিরে এই দুপুর রোদে এলি?আজ হসপিটালে যাসনি?”

“না আজ ছুটি নিয়েছিলাম,ভাইফোঁটা বলে।কিন্তু তোমার আদরের নাতি আমার কথা শুনবে না বুঝতে পারিনি।”জয়িতার গলায় মিশ্র একটা স্বর শোনা যায়।
সেলাই থেকে মুখ তোলেন মমতা।
“কি হয়েছে?কি করেছে দাদুভাই?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়না জয়ি।ও নিজেও জানেনা কি করেছে রণ।যদিও বিষয়টা আর টানতে ওর নিজেরও ইচ্ছা করছে না।কিন্তু ওই যে মায়ের ইগো,সেটাই হয়তো কারণ এই চাপা অসন্তোষের।

“কিরে বলবি তো দাদুভাই কি করলো?” মমতা বয়সজনিত অস্থিরতায় তাড়া দেন।
“আমি চেয়েছিলাম ভাইফোঁটা অনুষ্ঠান করবো বাড়িতে,তোমার আদরের নাতি রাজি হয়নি।সে এইভাবে কোনো সম্পর্কে রাজি না।মেয়েটার মুখ চেয়ে বলেছিলাম,যাতে লোকে কোনো কথা না বলে।কিন্তু…”,জয়ির কথা বাধা পায়।
“তুই কি কারণে এটা চাইছিস?শুধু লোকের ভয়ে না নিজের মনের ভয় থেকেও?বিশ্বাস নেই তোর নিজের ছেলের ওপর?”মমতার গলার স্বরে চমকে ওঁর দিকে তাকায় জয়িতা।
“কিন্তু মা আমাদের সমাজ যে ভালো না।তাই পরের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবেই…”,আবার জয়িতা কে থামতে হয়।
“পরের মেয়েকে বাড়িতে এনে রাখার আগে এটা ভাবিসনি কেন?তখন তো দাদুভাই ই তোকে ভাবতে বলেছিল।তোর বাবার মত তুইও খালি নিজের ডিসিশন গুলো সবার ওপর চাপিয়ে দিস।দাদুভাই প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক হতে চললো।তুই না সেদিন বলেছিলি সায়েন্স বলছে একটা ছোট বাচ্চার মতকেও গুরুত্ব দিতে।জোর করে মায়ের ইচ্ছেতে বেশি বেশি না খাওয়াতে।তাহলে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের ওপর জোর করছিস কেন?বিশেষ করে এরকম সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।” অভিজ্ঞ মমতা সেদিন দুপুরে প্রিয় নাতির চোখে যে আবেগ অনুভূতি দেখেছিলেন উনি বুঝতে পারেন রণর এই সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক।
কিন্তু নিজের নাতিকে উনি ছোট থেকে চেনেন তাই ভয় না পেয়ে বিশ্বাসটা বেশি জায়গা করে নিয়েছিল মনে।
জয়িতা কোনো উত্তর দিতে পারেনা।আসলে ওর উত্তর দেওয়ার জায়গাও নেই।ও রণ কে বলেছিল রণর মনে যাই থাক রাইয়ের ওপর জোর করে চাপাতে দেবে না।কিন্তু ও নিজেই যে রণর সাথে সাথে রাইয়ের ওপর মত চাপিয়ে দিচ্ছে সেটা ভাবেনা।
জয়িতা কে ভাবতে দেয় মমতা।
এসময় সুলেখা চা নিয়ে ঢোকে।মা মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই যেচে বলে,”বললে নাকি মাসিমা খবরখানা?”
সুলেখার কথায় জয়ি ভ্রু কুঁচকে তাকায় মায়ের দিকে।
মমতার মুখ দেখেও মনেহয় কিছু ভাবছেন।
সুলেখা বুঝতে পারে বয়সের কারণে মনে করতে পারছে না ‘বুড়ি’।
“আরে সেই যে কাল সক্কালবেলা কার যেন ফোন এলো…খারাপ খবর ন্যেয়ে… তুমি বললে…দিদি রে ফোনে পেলে না কো।সারাদিন কান্নাকাটি করলে…”,সুলেখা মনে করানোর স্বরে বলে।
অবাক হয় জয়ি,সারাদিন কেঁদেছে তাহলে ওকে ফোন করেনি কেন!

“ও ও হ্যাঁ হ্যাঁ”,মনে পড়ে মমতার।তারপর জয়ির দিকে তাকিয়ে বলেন,”তোর শোভাপিসিকে মনে আছে?বাগনানের?”
“শোভা পিসি!!ওই যাঁর স্বামী বছর দুয়েক আগে মাইলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম-এ মারা গেলেন?ঋষির সাথে যোগাযোগ করে ওর হসপিটালেও এনেছিল।”

“কি নাম মনে নেই।ওই খালি রক্ত কমে যাচ্ছিল রে।রক্ত দিলেও একমাসও থাকতো না।তারপর ঋষি হসপিটালে নিয়ে এসে মনেহয় বোনম্যারো টেস্ট করলো,আশা নেই বুঝে ফিরিয়ে দিয়েছিল।তাও তো সে ছমাস বেঁচে রইলো কিন্তু ওর ছোট জামাইটা, কত আর বয়স বল!শোভার বড়মে ফোন করেছিল কাল।বললো ওর ভগ্নিপতির বয়স বড়জোর চল্লিশ,ভগবানের কি বিচার,ওইটুকু ছেলেটাকেও টেনে নিল।” বলতে বলতে গলা বুজে আসে মমতার।

“কি বলছো মা! কি হয়েছিল তাঁর?মেয়েটা তো অনেক ছোট আমার থেকে”,জয়ি আঁতকে ওঠে।
“হ্যাঁ গো দিদি।মাসীমাও তাই বলছে।একটা ছোট মেয়ে আছে বছর আটের।ওই দাদাবাবু যে হসপিটালে কাজ করে সেই রোগেই মরেছে গো।সময় দেয়নি মোটে।এক সপ্তাহের জ্বরে নাকি চলে গেল।” সুলেখা গতকাল মমতার কথা থেকে যা শুনেছে বললো।
“কি হয়েছিল মা”,জয়ি মমতার দিকে তাকায়।
“ব্লাড ক্যান্সার,শেষ সময়ে নাকি ধরা পড়ে।একমাস আগেও সুস্থ ছিল,তেমন কোনো সিম্পটম ছিলোনা।শুধু শেষে জ্বর এসেছিল কদিন। বড়মেয়ে বলছে হয়তো কষ্ট ছিল,কাউকে বলেনি।জামাইয়ের বাবা মা নাকি গুরুত্ব দেয়নি ছোটমেয়ের কথা।এখন নাকি বৌমা নাতনি কেও রাখবে না বলছে। শোভা খুব ভেঙে পড়েছে।” মমতা এখনো নিজেকে পুরো সামলাতে পারেন না।
মনে মনে ভাবে জয়ি,সত্যি কি অদ্ভুত দুনিয়া।বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে নিজের কোন পরিচয় নেই।ছেলের বাবা মা’র কাছে সে খালি ছেলের বউ।ছেলে নেই,সম্পর্কও নেই।বৌমা পরের মেয়ে তারা ভাবুক,আর নাতি হলে নিজের বংশের,নাতনি থেকেই লাভ কি! তাই তার দায়ও নেই।
এসব কথা শুনলে জয়িতার মাথায় আগুন জ্বলে।

সত্যি রোগটা আজ ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে।দোষটা তো রোগের না।যে কোনো রোগের ক্ষেত্রে দায় মানুষের সচেতনতার।কিছু ক্যান্সারে বংশগত একটা ভয় থাকেই, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের সচেতনতার অভাব।
ওই ‘রেডি টু ইট’ খাবার গুলো,মানুষ ফার্স্ট ফরোয়ার্ড লাইফ চালাতে ওগুলো খাচ্ছে,কিন্তু আসলে তো ওগুলো বিষ।এরকম কিছু খাবার,অনিয়মিত জীবন,অত্যধিক স্মোকিং,না বুঝে কিছু কেমিক্যাল এর টাচে আসা।অত্যধিক কসমেটিক ব্যবহারও তো ঠিক না,অতিরিক্ত ওই সফট ড্রিংক্স খাওয়া।

আগের কার দিনে এই রোগটা কটা মানুষের হত? তার কারণ জীবন যাত্রাই।এখন মানুষের ননভেজ খাওয়া মাত্রারিক্ত বেড়েছে,বিশেষ করে রেডমিট।এটাও কারণ একটা।কিন্তু মানুষের পক্ষে তো সম্ভব না আগের লাইফস্টাইলে ফিরে যাওয়া, তাই রোগটাও বাড়বে,হয়তো দশবছর পর প্রতি পরিবারে গড়ে একজন এই রোগে আক্রান্ত হবে।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জয়ির মধ্যে থেকে।তবে একটাই ভরসা সায়েন্স ও এগোচ্ছে।হয়তো রোগটা কে কন্ট্রোল করার ওষুধও এসে যাবে কয়েক বছরে ।
আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো ছাড়া কিছু করার নেই।একমনে মায়ের ব্যালকনির দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সেটাই ভাবতে থাকে ও।

ক্রমশ…