মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৯

0
394

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#নবম_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

ঘুমটা আজ অনেক ভোরে ভেঙে গেছিল রাইয়ের।তাও চুপ করে বিছানায় পরে ছিল ও।কাল রাতে থেকে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।রাতে মেঘও ডাকছিল।ভয়েতে দুচোখ বন্ধ করে পাশ বালিশে মুখ গুঁজে পড়েছিল।
আগের বছর অবধি বাজ পড়লে মা কে আঁকড়ে ধরেছে,আর এবছর নিজে শিখে গেছে কিকরে ভয়ের সাথে মোকাবিলা করতে হয়।
রাইয়ের আজকাল মনে হয় ও রোজ বড় হচ্ছে।রোজ নতুন করে কত কিছু শিখছে।এই শেখা গুলো জীবন থেকে শেখা।হয়তো ওর জীবন নরমাল হলে এত তাড়াতাড়ি সবটা শিখতে পারতোনা।মায়ের ভালোবাসা এখনো ওকে ছোট হয়ে থাকতে দিত।মায়ের কাছে আগের মতোই আবদার করতে পারতো খাইয়ে দেওয়ার,এরকম বাজ পড়ার রাতে চমকে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরতে পারতো।স্কুল থেকে ফিরে বায়না করতে পারতো নতুন নতুন খাবারের।আর ওর প্রিয় ইলিশ মাছও কাঁটা বাছার ভয়ে খাইনা বলতে হতোনা।
ওর মা’ই শুধু জানতো,বৃষ্টি ওর খুব একটা পছন্দের,ওর সমস্যা হলো বাজ পড়া।তাই বাজ পড়ার রাতগুলো ওকে জড়িয়ে নিত বুকের গভীরে।
এসব চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
আরও প্রায় পৌনে একঘন্টা পর ও ধড়মড় করে উঠে বসে,মায়ের স্বপ্ন দেখছিল।ওদের কোয়ার্টার,ব্যালকনি থেকে বৃষ্টি,আবার কিছুক্ষনের মধ্যে রোদ ঝলমলে আকাশ,বাকিটা আবছা।
মোবাইলটা তুলে টাইম দেখতে যায় ও,এলার্ম বাজেনি,তার মানে সাড়ে ছটা বাজেনি এখনো।হমম সবে পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ।ফোনটা বালিশের পাশে রেখে চোখটা একটু বোজে রাই।
পুজোর আর মাস তিনেক বাকি।বাবা বলেছে পুজোর ছুটিতে নিয়ে যাবে বাবার কাছে ,এই আনন্দটা ও কারোর সাথেই শেয়ার করেনি।এমনকি রণর সাথেও না।আজকাল এমনিতেও রণর সাথে কথা প্রায় হয়ই না।রণর সারাদিন কেটে যায় নিজের স্কুল,প্রাইভেট টিউশন,নিজের পড়া নিয়ে।আগের মত আড্ডা গল্প কিছুই আর হয়না।আজকাল একটু একলা লাগে রাইয়ের,তাই বাবার কাছে যাওয়ার দিন গুনছে ও।
জয়ি আন্টি ওর খেয়াল রাখে খুব,তাও ওর যে একাকীত্ব সেটা রণদা থাকলে শুধুমাত্র কম লাগে।আন্টির ব্যস্ততা শুধু না,মেশার ধরণটা অনেকটাই আলাদা ওর মায়ের থেকে।হয়তো সংসার ছাড়াও বাইরের জগৎ টার সাথেও সমতা বজায় রাখতে হয় বলে রণদার সাথে ওর সম্পর্কটা অন্যরকম ভালো।অন্য একরকম বোঝাপড়া।রাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করে।
তবে এটা হয়তো অনেকটাই ঠিক কথা বয়স বাড়ার সাথে সাথে মা-মেয়ের সম্পর্কে বন্ধুত্ব বাড়ে,আর একটা ছেলে মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও তার একটা নিজের জগৎ হয়,যেখানে মা চাইলেও সবসময় ঢুকতে পারেনা।রণদা আর জয়ি আন্টির সুন্দর সম্পর্কেও রাই এটা বুঝেছে।

উঠে পড়ে রাই বিছানা ছেড়ে।জানলার পর্দা সরিয়ে দেখে বৃষ্টির তেজ কমলেও পুরোপুরি থামেনি।সারারাতের পর দিনের শুরুও প্রকৃতি গোমড়া মুখে করলেও রাইয়ের খারাপ লাগেনা,বৃষ্টি দেখতে যে বড্ড ভালো লাগে ওর।
ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নেয় রাই।বেরিয়ে আবার ফোন দেখে ছটা বেজে গেছে।
একটু একটু খিদে পাচ্ছে,কিন্তু রমা পিসি কি এখন উঠেছে?উঠলেও ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে তো সময় লাগে।বোতল থেকে জল খেয়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে ও।
পনেরো মিনিট পর আর থাকতে পারেনা।অন্যদিন এত তাড়াতাড়ি খিদে পায়না।
পায়ে পায়ে নীচে নেমে আসে।রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দিয়ে অবাক হয়,জয়ি আন্টি!!এত সকালে!!!
কিন্তু কিন্তু করে চলে আসতে যাবে বলে পিছন ঘুরেছে জয়ি মাথা ঘুরিয়ে ওকে দেখে বলে ওঠে,”কিরে রাই কিছু বলবি? খিদে পেয়েছে?”
থমকে দাঁড়ায় রাই, ঘুরে দাঁড়ায় জয়ির দিকে ।কিন্তু কিন্তু করে বলে,”রমা পিসি কোথায় আন্টি?তুমি এত সকালে রান্নাঘরে ?”
“হ্যাঁ রে ,রমার কাল রাতে দেখলাম শরীরটা ভালো ছিলোনা।তাই আমি বারণ করেছিলাম আজ তাড়াতাড়ি উঠতে ।ব্রেকফাস্ট আমি বানিয়ে নেব বলেছিলাম”।
রাই আস্তে আস্তে জয়িতার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আমি কিছু হেল্প করবো তোমায়?”

“কি হেল্প করবি তুই আমায়?” ডিম পোচ বানাতে বানাতে মুখে হাসি টেনে বলে জয়ি।
কিছুটা সময় নিয়ে রাই বলে,”মা তো আমায় কিছু করতে দিতনা।কিন্তু যখন অসুস্থ হয়ে হসপিটালে গেল আমি টুকটাক নিজেরটা বানাতে শিখে গেছিলাম।আমি ওমলেট, ডিম সেদ্ধ,টোস্ট,ম্যাগি এগুলো পারি।বাবাকে চা’ও বানিয়ে দিয়েছি।তারপর বাবা মিনুদিদি কে নিয়ে এলো।তুমি বলো,আমি পারবো”,একটা পনেরো বছরের মেয়ের মধ্যে এই সরলতা আজও যে বেঁচে আছে সেটাই জয়িতার মনে নাড়া দেয়।
ও নিজেও রণকে অনেক কিছু শিখিয়েছে,ইচ্ছা করে।যাতে কখনো একা থাকতে হলে ও অসহায় বোধ না করে।আর ছেলে মানেই সংসারের কাজে হাত লাগাতে হবে না জয়ি এই চিন্তা ভাবনার সম্পূর্ণ বিপক্ষে।
কিন্তু রাইয়ের কথাগুলোতে কোথাও একটা সূক্ষ্ম বেদনা ছিল,যা ওকে স্পর্শ করে।
রণর জন্যে ওমলেট বানাতে যাচ্ছিল ও,ঘুরে দাঁড়িয়ে রাই কে বুকে জড়িয়ে একটু আদর করে বলে।,”নে ওমলেট বানা”।
নিজে পাশে সরে গিয়ে ওকে জায়গা করে দেয়।
হাসি মুখে আস্তে আস্তে আনাড়ি হাতে রাইমা ওমলেট বানাতে থাকে,আর জয়ি ওর পাশে দাঁড়িয়ে কিছু ব্রেডে বাটার আর কিছু ব্রেডে ব্রেডস্প্রেড লাগাতে লাগাতে গল্প করতে থাকে।

সকালে প্রাইভেট পড়া আছে বলে রণ ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌঁছে গেছিল।কিচেনে মম আর একটা আস্তে গলা শুনে কিচেনের দরজায় এসে দেখে মা আর রাই মিলে গল্প করছে আর ব্রেকফাস্ট রেডি করছে।
ও ধীরে ধীরে ফিরে যায় ডাইনিং টেবিলে।এখনো সময় আছে হাতে,তাই তাড়া দিয়ে ওদের আড্ডাটা নষ্ট করতে মন চায়না।
আজকাল পড়ার চাপ এত বেড়ে গেছে রাইয়ের সাথে রেগুলার কথাও হয়না।রোজ মন হানটান করে ,কিন্তু সুযোগ করে উঠতে পারেনা কিছুতেই,মনটা খারাপই লাগে রণর।
ও জানে রাই এমন একটা মেয়ে যে একা চুপচাপ ঘুরে বেড়ালেও অন্যকে বিরক্ত করবে না,একাকিত্বে ভুগবে তাও যেচে কথা বলবে না।
ওর চিন্তার মাঝেই মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।শীর্ষা ফোন করছে।উফ এই এক মেয়ে হয়েছে ,সময়ের আগে সব জায়গায় পৌঁছে যাবে আর তারপর থেকে রণ কে জ্বালাবে।
এখনো ব্যাচ স্টার্ট হতে আধ ঘন্টা বাকি।শীর্ষা কি বলবে আন্দাজ করেই ফোন ধরে ও।
-“হ্যাঁ বল শীর্ষা”।
-“ওই আজ আমার পেটে খুব পেইন হচ্ছে।পিরিয়ডের ফার্স্ট দিন।আজ আমি টিউশন যাবোনা,স্কুল তো যেতেই হবে প্রাক্টিক্যাল স্টার্ট হবে আজ।প্লিজ কোচিংয়ের টাস্ক গুলো একটু জেরক্স করে আনিস।ওকে?”
-“ওকে।নো প্রবস।তুই এটা বলতে ফোন করেছিলি?আমি ভাবলাম পৌঁছে গিয়ে গালাগাল দিবি বলে ফোন করছিস।ওকে তুই ভাবিস না।আমি নিয়ে আসবো জেরক্স,তুই রেস্ট নে”। হাসতে হাসতে বলে রণ।

টুকটাক কথা বলে যখন ফোন রাখে রণ দেখে মম আর রাই এসে গেছে খারাব নিয়ে।
“মর্নিং”,ওদের দুজনের উদ্দেশে বলে রণ।
“হমম মর্নিং।কে ফোন করেছিল রে এত সকালে ?”মায়ের মন,প্রশ্ন না করে পারে না।।
“শীর্ষা।বলছিলাম না আমাদের স্কুলে নতুন এডমিশন নিয়েছে।ওর বাবা কার্ডিওলজিস্ট।তুমি বললে নাম শুনেছ।” রণ হাত বাড়িয়ে নিজের প্লেটটা নেয়।
“রাই তুইও বোস।আমি জানি তোর অনেক্ষন খিদে পেয়েছে।” জয়ি রাইকে একটা প্লেটে টোস্ট আর পোচ দেয়।
“তোরা খা।আমি দেখি ঋষি রেডি হলো কিনা।আজ ওর একটু সকাল সকাল বেরোনোর কথা।রাই, রমা উঠে এলে বলিস ওর ব্রেড আর ডিম গ্যাসের ওভেনের পাশে রেখে দিয়েছি।” জয়ি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যায়।

“কিরে রাই কি খবর তোর? আজকাল তোর সাথে কথাই হয়না”,রণর কথায় মুখ তুলে তাকায় রাই।
“তোমার পড়ার চাপ বেড়ে গেছে।তাই আর ডিসটার্ব করিনা।” রাইয়ের কথায় রণ হালকা হাসে।যদিও পড়তে যাওয়ার তাড়া আছে তাও রাই এর সাথে একটু কথা বলার ইচ্ছে ওকে বসিয়ে রাখে।
“তোকে বলেছিলাম তোর প্রিয় বাংলা বাদে কোনো সাবজেক্টে,বিশেষ করে সায়েন্স গ্রুপে প্রবলেম হলে আসবি। তুই তো যেচে কিছু বলিসনি।এই রবিবার দুপুরে লাঞ্চের পর আসবি ম্যাথস নোটবুক আর বই নিয়ে আমার ঘরে “,রণ সিনিয়ারের সুরে বলে হাসতে হাসতে।
মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় রাই,”তোমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।এখন বৃষ্টিটা একটু কমেছে।ছাতা নিয়েছো?”
“হ্যাঁ রে পাকা গিন্নি নিয়েছি।”রাইয়ের উদ্বেগ ভালোই লাগে রণর।আর বসে থাকলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে,তাই উঠে পড়ে ও চেয়ার ছেড়ে।
যাওয়ার সময় রাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দেয়,প্রত্যুত্তরে রাইও হাসে ।
নিজের একতলার ঘর থেকে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় রমার চোখে পড়ে রাই-রণর হাসির বিনিময়।একটু ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা দেখে ও।

“হ্যালো ঋষি।আমি শোভন বলছি,বলাগড় থেকে।চিনতে পারছিস?” ঋষি অচেনা নম্বর সাধারণত হসপিটালে থাকতে ধরেনা।আজ ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই কথা গুলো শুনতে পেল।

কিছুক্ষন ভাবতে সময় নিলো,তারপর হঠাৎ প্রায় উত্তেজিত হয়ে বললো,”আরে শুভ বলবি তো।আমি ভাবছি কে শোভন!বল বল কি খবর?”
ফোনের উল্টোদিকে শোভন নামের মধ্যবয়সী একটু আশ্বস্ত হলো।এতদিন গ্রামে না এলেও বদলায়নি ওদের ঋষি।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ,”আসলে এত বছর পর চিন্তে পারবি কিনা!তাই আর কি…”।
-“দূর! ছোটবেলা কেউ ভোলে না রে।বল কি খবর?নম্বর পেলি কোথা থেকে?”
-“ওই তোদের বাড়ি গেছিলাম।এখনকার যে ভাড়াটে বাগ বাবু দিলেন”।
-“ভালো করেছিস।কিন্তু কেন গেছিলি,কোনো দরকারে ?”
-“হ্যাঁ রে।বাবার একটু সমস্যা হয়েছে।মাস ছয়েক হলো কাশি কিছুতেই কমছিলো না,শুকনো কাশি ছিল প্রথমদিকে।মাস খানেক আগে হঠাৎ কাশতে কাশতে কফের সাথে রক্ত এলো ,রক্তের ছিটে।তারপর পরিমান বাড়লো।”

উদ্বিগ্ন স্বরে ঋষি বললো,”ডাক্তার দেখিয়াছিস?”

চুপ করে থাকলো ঋষির বাল্যবন্ধু শোভন প্রামানিক। তারপর ভাঙা গলায় বললো,”হ্যাঁ প্রথম দিনই ডাক্তার দেখিয়েছিলাম।আমি ভেবেছিলাম টিবি জাতীয় কিছু।কিন্তু বলাগড়ের ডক্টর হাজরা একটা চেস্ট এক্সরে আর কফ পরীক্ষা করার পর রিপোর্ট দেখে স্ক্যান করতে দিয়েছিলেন।স্ক্যান রিপোর্ট দেখে অঙ্কোলজিস্ট দেখাতে বললেন।” আর কিছু বলতে পারেনা শুভ।
আর ঋষিও বুঝে যায় যা বোঝার।তারপর শুভকে শুধু জিজ্ঞেস করে কিছু ডিটেইলস, যেমন টিউমার আছে কিনা,থাকলে কোন ফুসফুসে,কতদিনের পুরোনো কাশি,শ্বাসকষ্ট আছে নাকি?এছাড়া জ্বর,বুকে ব্যথা সহ ফুসফুসে ক্যান্সারে যা যা সিম্পটম কিছুটা খুঁটিয়ে জেনে নেয় ফোনেই।কাকাবাবুর সামনে যাতে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে না হয়।
“তুই এক কাজ কর শুভ,দেরি করিস না।কাল পরশু করে কাকাবাবুকে নিয়ে চলে আয়।হয়তো আমি এডমিট করে নেব,সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে আসবি”,ঋষি মোটামুটি জেনে নিয়ে বলে।
“ভাই ঋষি এ রোগের তো অনেক খরচ।বিশেষ করে তোর বেসরকারি হাসপাতালে আমাদের মত মানুষ টিকতে পারবে না রে।” হতাশা ঝরে পড়ে পাড়ার ছোট মুদিখানা দোকানি শুভর স্বরে।
“দেখ শুভ,আমি তো আছি।আগে তুই নিয়ে আয় কাকাবাবু কে,তারপর ওসব কথা হবে।দরকারে সরকারি হসপিটালেও আমি ব্যবস্থা করতে পারবো।আগে তুই রিপোর্ট আর কাকাবাবু কে নিয়ে আয়।আমার ওপর ভরসা রাখ”,ঋষির কথা শেষ হতেই ও বুঝতে পারে ফোনের উল্টোদিকে ওর বন্ধু নিজেকে আর সামলাতে পারেনি,ভেঙে পড়েছে কান্নায়।
চুপ করে থাকে ঋষি।মনে পড়ে কাকাবাবুর বিড়ির নেশা ছিল সাংঘাতিক।দিনে দু-তাড়া বিড়ি কোনো ব্যাপারই ছিলোনা।খৈনির নেশাও ছিলো অল্প।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঋষি।আবার একটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি।লড়াইটা কতটা কঠিন রিপোর্ট না দেখলে বুঝতে পারছেনা ও।কিন্তু আবার নিকট বন্ধুর শোক।নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নেয় ঋষি।
আজই সকালে একটা খবর মনটা ভালো করেছিল,আরো একটা খবর এসে সেটা খারাপ করে দিল।

সেই রণজয় বলে বাচ্ছা ছেলেটা,যার অ্যাকিউট লিম্ফোব্ল্যাস্টিক লিউকেমিয়া হয়েছে,আজ একটু ভালো আছে।
আসলে এক্ষেত্রে ইনফেকশনের চান্সটা বড্ড বেশি থাকে।
বাচ্চাটার প্রাইমারি টেস্ট রিপোর্ট ALL এর ইঙ্গিত দিয়েছিল।রিপোর্টে ছিল ডিটেইলস আরো টেস্ট বা ইনভেস্টিগেশনের ইঙ্গিত।
বাচ্চাটার পেডিয়াট্রিশিয়ান রিস্ক না নিয়ে অঙ্কোলজিস্ট রেফার করেছিলেন।
ঋষি টেস্ট করিয়ে বুঝেছিলো বাচ্ছাটা লো রিস্ক গ্রুপে আছে।দেরি করেনি ও,মেডিকেল অঙ্কোলজিস্টের সাথে কথা বলে দুদিনের মধ্যে শুরু করে দিয়েছিল ইন্ডাকশন কেমোথেরাপি।উদ্দেশ্য ছিল অ্যাবনর্মাল ক্যান্সার সেল গুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা।সেই দিন থেকে হসপিটালের বেডই হয়েছিল বাচ্চাটার বাড়ি ঘর।ওর বাবা মা’ও একভাবে প্রায় পরে আছে।
সব ঠিক ছিল,সুস্থ হচ্ছিল রণজয়,কিন্তু বাদ সাধলো ইনফেকশন।যা এই রোগের সবচেয়ে সাধারণ ব্যাপার।
এ রোগে হোয়াইট সেল বা শ্বেত কণিকা সংখ্যায় অস্বাভাবিক বাড়লেও সেটা আসলে অ্যাবনর্মাল রক্ত কণিকা ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ।তারপর কেমোথেরাপি শুরু হলে সেটা ক্যান্সার সেলের সাথে সাথে সুস্থ সেলও ধ্বংস করে ফলে আরো অবস্থা ভয়াবহ হয়।এরপর যে ইনফেকশন হয় তাতে জীবন বাঁচানো মুশকিল হয়।
রণজয়ের ক্ষেত্রেও পেটে ইনফেকশন হয়।তার সাথে নাক আর মাড়ির রক্ত পড়া বেড়ে যায় প্লেটলেট কাউন্ট কমে যাওয়ায়।একটা ছোট প্রাণ সব মিলিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।ডাক্তার টিমও কিছুটা ভয়েই পেয়ে গেছিল।
সেকেন্ড সার্কেল কেমোথেরাপি বেশি দেরি করাও সম্ভব ছিলোনা,কারণ এই ধরণের ক্যান্সারের সারভাইভাল রেট বেশি হলেও ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত।
আজ সকালে ঋষি যে রিপোর্ট পেয়েছে তাতে রণজয়ের শরীর ইনফেকশন অনেকটাই সামলাতে পেরেছে।তাই মেডিকেল অঙ্কোলজিস্ট কেমোথেরাপির সেকেন্ড সার্কেল শুরু করার ব্যাপারে অনেকটাই আশাবাদী।

ঋষি চুপ করে বসে থাকে নিজের চেয়ারে ।শোভনের ফোনটা মন ভারী করে দিলো।সারাক্ষন এই রোগ নিয়ে থাকলেও নিজের পরিচিতদের মধ্যে কারোর এই রোগ হলে আজও ঋষি পুরোপুরি আশাবাদী হতে পারেনা।ও জানে কিছু কিছু ক্যান্সার একটু দেরিতে ধরা পড়লেও সেরে যাওয়ার চান্স থাকে ,আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রথম দিকে ধরা পড়লেও হতাশ হতে হয়।
অল্প বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়ে জীবনের প্রতিপদে তার অভাব অনুভব করেছে ঋষি,তাই মা’ই ছিল ওর দুনিয়া। মায়ের উদার মনোভাব,জীবনের শেষ দিন অবধি খুশি থাকতে চাওয়ার ইচ্ছা ওকেও ছোট থেকে অনেক পজিটিভ মানসিকতার বানিয়েছে।আজ ক্যান্সারের মত রোগের স্পেশালিস্ট ও হতে পেরেছে শুধু ওর মায়ের জন্য।ওকে মা শিখিয়েছে কিভাবে মনের চাপ কমিয়ে জীবনের লড়াই গুলো লড়তে হয়। ছোটবেলায় ও সমস্যায় পড়লে মা ছেড়ে দিত ওকে ওর সমস্যায়।এমনকি বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের মনের জোরে সব কিছু সামলানো ওকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল।কাকারা থাকলেও মা ব্যবসার ক্ষেত্রেও দায়িত্ব নিয়েছিল যতটা নেওয়া সম্ভব।বাবা অংশটা কিছুদিন নিজে সামলানোর পর বেচে দিয়েছিল কাকাদের কাছে।না হেরে গিয়ে না,স্বেচ্ছায়।যাতে ঋষি মন দিয়ে ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতে পারে,ব্যবসার চিন্তা না করে।

এত বছর পর শোভনের বাবার অসুখ ওর মনে পরোক্ষ একটা কষ্ট তৈরি করেই দিলো।ঋষির বাবা ব্যবসায়ী মানুষ হলেও পড়াশোনায় ভালো ছিলেন খুব।নিজের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন ওর মধ্যে দিয়ে।পারিবারিক ব্যবসার জন্য নিজের পড়া মাঝপথেই থামিয়ে দিতে হয়েছিল তাঁকে,বাড়ির বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে।কিন্তু ঋষির পড়ায় কোনোদিনও আঁচ আসতে দেননি।ঋষি ফাইনাল সেমিস্টার দেওয়ার পরেই হার্ট অ্যাটাকের অতর্কিত আক্রমণে ওর বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে,দেখে যেতে পারেননি ছেলের ডাক্তার ডিগ্রি।কিন্তু মা বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছিল,ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেয়নি কোনো দিন।

উঠে পড়ে ঋষি নিজের চেয়ার ছেড়ে।বসে বসে মন খারাপ করার চেয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে একবার চিলড্রেন ওয়ার্ড ঘুরে যেতে ইচ্ছা করে।
রণজয়ের কেমো চলছে,কিন্তু বোন ম্যারো ট্রান্সফার করাটা হয়তো দরকার হতে পারে।দেখা যাক।ওর বাবার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না ঋষি জানে।তাছাড়া ওর নিজের কন্ডিশনের ওপরও নির্ভর করছে।
নিজের কেবিন লক করে চিলড্রেন ওয়ার্ডে রাউন্ডে চলে যায় ডাক্তার ঋষি মুখার্জী।

“আচ্ছা রণ তোর কোনো বোন আছে ?” শীর্ষা হঠাৎ মনে পড়েছে সেই টোনে প্রশ্ন করে রণকে।
রণ,রুদ্র আর শীর্ষা লাইব্রেরিতে আটকে গেছে বৃষ্টির জন্যে।আজ ওদের প্রাক্টিকাল ক্লাস হয়নি,তাই টিফিনের পর একটা পিরিয়ড হয়ে ছুটি হয়ে গেছিল।কিন্তু রণর একটু লাইব্রেরিতে দরকার থাকায় তিনজনেই এসেছিল লাইব্রেরিতে।বর্ষাকালে আকাশ বেশিরভাগ সময়ই ঘোর করে থাকে।তাই বৃষ্টি যে এভাবে ওদের এতক্ষন আটকে দেবে ওরা নিজেরাও বুঝতে পারেনি।
শীর্ষার কথায় রণ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।এই মেয়েটা সবসময় বকবক করে,তাই কখন কি বলে নিজেও ভেবে বলেনা।
রণ কোঁচকানো ভ্রু আর রুদ্রর কৌতূহলী চোখ দেখে শীর্ষা আবার বলে,”না মানে সানডে দুপুরে তোকে যখন ফোন করেছিলাম তুই কথা বলতে বলতে কাউকে একটা ম্যাথ বোঝাচ্ছিলি।আমি তোকে ফোনেও জিজ্ঞেস করলাম কে আছে তোর সাথে।তুই উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলি।একটা মেয়ে ছিল আমি শিওর,কিন্তু এড়িয়ে কেন গেলি?” সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করতে শীর্ষা ভট্টাচারিয়ার কোনো অস্বস্তি হয়না এতদিনে রণ-রুদ্র বুঝে গেছে।কিন্তু ওর এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভাবতে থাকে রণ,বিশেষ করে রুদ্রর সামনে।

“তোর বাবার বন্ধুর মেয়ে এখনো আছে তোদের বাড়ি না কি রে?আর তুই তাকে অঙ্কও করাচ্ছিস?” রুদ্র এবার যোগ দেয়।
“ওর নাম রাইমা।হ্যাঁ ওর বাবা হঠাৎ ট্রান্সফার হয়ে নর্থ বেঙ্গল চলে গেছে,তাই আমার মা ওকে নিজের কাছে এনে রেখেছে।” রণ এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে।মনে মনে আফসোস করে সেদিন রাই থাকার সময় শীর্ষার ফোনটা রিসিভ করাই ভুল হয়েছে।
কিছুক্ষন চুপ থেকে শীর্ষা আবার বলে,”ওর মা?”
‘এই মেয়েটার কৌতূহলের যেন শেষ নেই’,মনে মনে যায় বলুক মুখে রণ বলে,”ওর মা নেই।লাস্ট জানুয়ারিতে এক্সপায়ার করে গেছেন”।
“ওহ মাই গড!” বাকি দুজন আঁতকে উঠলেও কথাটা বের হয় শীর্ষার মুখ থেকে।
“তাহলে ও এবার থেকে তোদের বাড়িতেই থাকবে?” রুদ্র কিছুটা অবাক হয়েই বলে ।
“আপাতত।কিন্তু এটা যাতে ওকে মানসিক চাপ না দেয় তাই কারোর সাথে এটা নিয়ে আলাদা করে কোনো ডিসকাশন করিনি।আর তোরাও প্লিজ করিসনা।মেয়েটা এমনিতেও প্রচন্ড মেন্টাল ডিপ্রেশনে থাকে মা কে হারানোর পর।আর কোনো চাপ ওর ওপর আমরা পড়তে দিতে চাইনা।” রণ একটু কঠিন মুখেই কথাটা বলে।

রুদ্র আর শীর্ষা দুজনেই ব্যাপারটা বুঝলেও শীর্ষা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রণর দিকে।
একমাস হল ছেলেটার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে।হাসি মজা হালকা চালে থাকতেই দেখেছে ।আর প্রথম দেখলো ওকে সিরিয়াস হতে ।
“মেয়েটা কোন ক্লাসে পড়ে রে?অনেকটা ছোট নাকি?কোন স্কুল?” শীর্ষা কৌতূহল আটকাতে পারেনা।
“না খুব ছোট না।আমার থেকে দুবছরের ছোট।ও ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে বাংলা মিডিয়ামে পড়ে।”রণ চায়না বেশি ডিটেইলস আলোচনা করতে।
বৃষ্টিটা একটু ধরতে ওরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসে।
তিনজনের বাড়ির রাস্তা তিনদিকে,যদিও রণ-রুদ্র কিছুটা পথ একসাথে যায়।
আজ হঠাৎ শীর্ষা বললো ,”রণ সেদিন তো তুই নোটের জেরক্স আনলি না।ওয়ান উইক হতে চললো।চল আজ সময় আছে আমি তোর বাড়ি গিয়ে নোটস কপি করে নিই।রুদ্রও চল”।
আগে রণ বন্ধুরা কেউ বাড়ি যাবে ভাবলে খুশি হত কিন্তু আজকাল রাইয়ের কারণে এড়িয়ে যায় বন্ধুদের বাড়ি আসা।কিন্তু ও জানে শীর্ষা কে এড়ানো সম্ভব না।ও একবার যখন ভেবেছে ও যাবেই ওদের বাড়ি।তাই আর কথা বাড়ায় না,সম্মতির ঘাড় নেড়ে উঠে পড়ে নিজের সাইকেলে।শীর্ষাও মাঝে মাঝে স্কুলে সাইকেল আনে, আজও এনেছিল তাই কোনো সমস্যা হয়না।

রণ নিজের মনে সাইকেল চালাতে চালাতে আগে আগে চলতে থাকে।
সেদিন রাই দুপুরে আসেনি,রণ গেছিল ওর রুমে। চুপ করে জানলার ধারে বসেছিল মেয়েটা।চুলে বেনি ছিলোনা,বদলে এলোচুল ছড়িয়ে ছিল ওর পিঠ জুড়ে।জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল।রণ ভেবেছিল নিশ্চই আবার মন খারাপ করছে।
ওর ঘরের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে রণ গলা খাকরানী দিয়ে বলেছিল,”কিরে আজ দুপুরে আমার কাছে ম্যাথ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না তোর?কি করছিস জানলার ধারে বসে?আবার মন খারাপ?”
চমকে ঘুরে তাকিয়েছিল রাই।না ওর মুখে কোথায় কষ্ট তো ছিল না,বদলে ছিল একটা অন্য আনন্দ।
রণ কে দেখে হঠাৎ মনে পড়েছে এমন মুখ করে রাই বলেছিল,”সরি রণদা।বৃষ্টি দেখতে গিয়ে ভুলে গেছি”।
অবাক হয়েছিল রণ!বৃষ্টি! জানলা দিয়ে বসে বসে বৃষ্টি দেখছিল ও!সত্যি পারে বটে মেয়েটা।নিজের জগতে ব্যস্ত থাকা রণ বুঝতে পারেনা বৃষ্টি দেখার মধ্যে কিসের আনন্দ থাকতে পারে!
রণর অবাক হয়ে যাওয়া মুখ দেখে রাই নিজেও অবাক হয়েছিল।
“কি হলো রণদা?কি ভাবছো?” ততক্ষনে ম্যাথস খাতা বই হাতে গুছিয়ে নিয়েছিল ও।
“চ তোর ঘরেই বসি।বৃষ্টি দেখতে দেখতে ম্যাথস কর”,রণ নিজেই এগিয়ে গেছিল ওর বিছানার দিকে।
ছুটে ওর আগে নিজের বিছানার কাছে পৌঁছে গেছিল মেয়েটা।একটা খোলা ডায়েরি মুড়ে বেডসাইড টেবিলে ঢুকিয়ে হেসেছিল ও।
“তুই ডায়েরি লিখিস?” রণ প্রশ্ন করেছিল মুখে,কিন্তু অন্যের প্রাইভেসিকে সম্মান করা ওর মন হঠাৎ চেয়েছিল রাইমার ডাইরিটা পড়তে।কিছু কি লেখা আছে ওর বিষয়ে ওর একান্ত গোপনীয় পাতাগুলোতো।
উত্তর মেলেনি,কারণ পরের প্রশ্নটা করেই উঠতে পারেনি ও।
বদলে অঙ্কের খাতা খুলে বসেছিল মেয়েটা।

রণ আদপে প্রচন্ড প্রাক্টিক্যাল একটা ছেলে।কয়েকমাস আগেও ও ভাবতো এই বয়সটা কেরিয়ার তৈরির আর বন্ধুদের সাথে হৈহৈ করে কাটানোর বয়স।ওই অন্য যে অনুভূতি আজকাল ওর মনে বাসা বেঁধেছে ও ভাবতো সেসব বোগাস।এই বয়সে বন্ধুত্বের কোনো বিশেষ ধরণ হওয়া বোকামির লক্ষণ।কিন্তু কেন কিকরে মনে ভালোলাগা,কেয়ারিং এগুলোর জন্ম হয় ও আজ নিজেও জানেনা।শুধু জানে রাইমা কে কাঁদতে দেখতে ওর ভালোলাগেনা, ও শুকনো মুখে ঘুরলে রণর বুকের মধ্যেটা অদ্ভুত একটা দমচাপা হয়ে থাকে।
কিন্তু ও জানে ওদের বাড়িতে এসে থাকতে চাওয়া সরল অসহায় মেয়েটা এসব কিছুই ভাবেনা।হয়তো ভাবার বয়সও এটা না।ওর জীবনে বন্ধুর অভাব ছিল,রণ সেই অভাব পূরণ করেছে এটাই ও বিশ্বাস করে।
রণ চায় রাই সেই বিশ্বাসটা নিয়েই থাকুক।তাতে বন্ধু হয়েও রণ থেকে যেতে পারে ওর সাথে।

শীর্ষা আর রুদ্রকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে রণ বুঝতে পারে মা নেই।ওহ,আজ তো মায়ের বিকেলে চেম্বার।
রমা পিসিকে বন্ধুদের কিছু খেতে দিতে বলে ওপরে উঠে যায় ওদের নিয়ে।
রাই এর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে দিয়ে দেখে ওর ঘরের দরজা খোলা।মানে রাই এখনো ফেরেনি।নিজের হাতঘড়ির দিকে চোখ চলে যায়,প্রায় সাড়ে চারটে বাজে।ভ্রু দুটো জড়ো হয় আপনাআপনি।কি হলো!রাইয়ের তো সাড়ে তিনটে ছুটি হয়,এতক্ষনে তো ও ফিরে পরে।তাহলে কি বৃষ্টিতে আটকে গেলো!চিন্তা বাড়ে।
“আয় বোস।” শীর্ষা আর রুদ্রকে ওর ঘরে রাখা চেয়ার দুটো এগিয়ে দেয় ও।তারপর একটু খুঁজে শীর্ষার দরকারি নোটবুকটা বের করে এগিয়ে দেয়।
শীর্ষা রুদ্র টুকটাক কথা বলতে বলতে নোট কপি করতে থাকে।রণ যেন ওদের মধ্যে বসেও কানটা দরজার বাইরে আটকে রাখে।রমা পিসি মাঝে এসে টোস্ট আর মিল্কসেক দিয়ে যায় ওদের জন্যে।রণ পিসিকেও জিজ্ঞেস করে রাই ফিরেছে কিনা! উত্তরে আসে ‘না’।
ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা পেরোতে রণ আর স্থির হয়ে বসতে পারেনা।উঠে পড়ে নিজের বিছানা ছেড়ে।
বাইরে তখন আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
“কিরে কি হলো?কি ভাবছিস কি তুই তখন থেকে?”শীর্ষা অবাক হয়ে জানতে চায়।
“বৃষ্টি আসছে।হলো তোর?বাড়ি ফিরবি কিকরে?” রণ অন্যমনস্ক হয়ে বলে।
“কোথায় ছিলি ভাই এতক্ষন!শীষ ওর বাড়িতে ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বললো।বললো আমায় নামিয়ে দেবে ।সাইকেল দুটো থাক,পরে নিয়ে যাবো….এত কথা হলো।” রুদ্র যেন আকাশ থেকে পড়ে।সাথে শীর্ষাও অবাক হয়ে রণর দিকে তাকায়।
অপ্রস্তুতে পরে যায় রণ।কিছুটা সামলে বলে,”হ্যাঁ.. আসলে একটু চিন্তা করছিলাম…তাই হয়তো খেয়াল করিনি”।
“ভাই এই বয়সে কি এত সংসারের চিন্তা ভাই!আর তোকে তো আগে কোনোদিনও এত অ্যাবসেন্ড মাইন্ড হতে দেখিনি।আজ দেখছি ঘরে ঢুকে থেকে কিছু ভাবছিস?”রুদ্র স্বভাবতই অবাক হয়।
“না সেরকম কিছু না।ছাড় আমার কথা,তোদের হলো”,ওদের সাথে কথা বলতে বলতে কানে আসে পাশের ঘরে কেউ দরজা দিলো।শীর্ষা কিছু বলতে যাচ্ছিল ওকে থামিয়ে দিয়ে রণ বলে,”এক মিনিট।আসছি”,ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
রাইয়ের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ,মানে মহারানী ফিরেছেন।কোথায় ছিল এতক্ষন জানতেই হবে রণ কে।রাই ওদের দায়িত্ব,তাই ওর কোনো অনিয়মই উপেক্ষা করা ঠিক না।কোনো ভুল কিছু হলে দায় এসে পড়বে ওর বাবা মা’র ঘাড়ে।এসব চিন্তা করতে করতে রাইয়ের দরজায় টোকা দেয় ও।
কিন্তু অবাক হয় কোনো সাড়া আসেনা।
আবার দরজা ধাক্কায় রণ,চারটের বদলে সাড়ে পাঁচটা কেন বাজলো ওকে জানতেই হবে।
বার দুয়েক দরজা ধাক্কানোর পর দরজার লক ভেতর থেকে খুলে যায়,কিন্তু দরজা ভেজানো থাকে ।
অবাক রণ নিজেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে জানলার পর্দা সরিয়ে অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে রাই।
“রাই এত দেরি হলো কেন তোর?আজ তো তোর কোচিং থাকেনা”,রণর কথায় রাই উত্তর দেয়না।ওর পরনে তখনো ওর স্কুলের সালোয়ার।এত চুপ কেন ও,উত্তরও দিচ্ছে না।
এগিয়ে যায় রণ ওর দিকে।
“কিরে কিছু জিজ্ঞেস করছি তো তোকে”,রাইয়ের কাঁধে প্রথমবার হাত রাখে রণ কিন্তু কিন্তু করে,ওকে এদিকে ঘোরাতে।
হঠাৎই রণকে চমকে রাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে।এতদিন ঠোঁট চেপে নীরবে কাঁদতে দেখেছিল যে মেয়েটা কে,সে ওকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে।
রণ হকচকিয়ে যায়।বুঝতে পারে রাইয়ের কান্না ওর ঘরে গিয়েও পৌঁছেছে,তাই ওর দুই বন্ধুও ছুটে এসেছে রাইয়ের ঘরের দরজায়।কিন্তু সব কিছুর ওপরে এই মেয়েটার ওরকম কান্না ওকে বিহ্বল করে দেয়।ওর বুকের মধ্যে রাই কাঁদছে,কিন্তু ও কিছু করতে পারছে না ছটফট করে ওঠে রণ।
“কি হয়েছে রাই।বল আমায়,প্লিজ বল”,ওর কাঁধের কাছটা ধরে ঝাঁকাতে গিয়ে কাঁধের ওপর এক পাল্টা করে ফেলে রাখা সিন্থেটিক ওড়নাটা খসে যায় রাইয়ের কাঁধ থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে নজর যায় রণর ওর জামার হাতার দিকে,কেউ যেন ওকে কারেন্ট মারে।হাতাটা টেনে ছেঁড়া।
দুহাত দিয়ে রাইকে নিজের বুক থেকে টেনে তুলে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে প্রায় উন্মাদের মত চেঁচিয়ে ওঠে ও,”রা-ই-ই!কে,কে করলো বল আমায়।…”,রাইয়ের কান্নায় ভেসে যাওয়া মুখ ও সহ্য করতে পারেনা।প্রানপনে আবার ওকে বুকে চেপে ধরে।যেন ওর বুকের মধ্যে আগলে নিতে চায় সারা জীবনের জন্যে।
ধীরে ধীরে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে ওকে ওর বিছানায় বসায়।
রুদ্র আর শীর্ষা কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসেছে ওদের দিকে।
কান্নায় সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়া রাইকে সামলাতে সামলাতে জোরে হাঁক দেয় রণ,”রমা পিসি এক গ্লাস দুধ আনো।” সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষনের মধ্যে ও বুঝতে পারে রাইয়ের জামা প্রায় ভিজে,চুলও শুকনো না।

রমা পিসি ওপরে আসতে ওকে রণ বলে,”পিসি তুমি রাইকে চেঞ্জ করিয়ে দাও।ওর ড্রেস কোথায় আছে দেখো।আমি দেখি মা কে ফোনে পাই কিনা”।ঘরের দরজা টেনে বেরিয়ে যায় রণ।
অবাক রমা পিসি ঘরের আলো জ্বালাতেই বুঝে যায় ঘটনাটা।জড়িয়ে ধরে রাইকে।তখনও অঝোরে কাঁদতে থাকা রাই মুখ গুঁজে দেয় রমার বুকে।
গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুটা শান্ত করে রমা রাইকে বাড়িতে পড়ার একটা সালোয়ার বের করে দেয়।

রণর যেন পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে।ও জানেনা কতটা কি হয়েছে,শুধু জানে রাইয়ের সাথে কিছু একটা অঘটন ঘটে গেছে।কেন রাইয়ের দেরি দেখেও ও বাড়িতেই বসে রইল ভেবে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করে ওর।
জয়ি চেম্বারে থাকলে ফোন ধরেনা জেনেও চেষ্টা করে মায়ের ফোনে।কারণ এই অবস্থা কিকরে সামলাবে ওর মাথায় কিছুই আসেনা।অসহায় রাগে ওর অস্থির লাগে।
এতক্ষন নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করতে থাকা রুদ্র আর শীর্ষা দেখে ঘরের দেওয়ালে একটা অসহায় ঘুষি মারে রণ।রাইয়ের পোশাক ওদের কিছুটা আন্দাজ দিয়েছিল দুর্ঘটনার।কিন্তু রণর এতটা অস্থিরতার কারণ ওদের মাথায় ঢোকেনা।পরের মেয়ে এরকম দুর্ঘটনা ওদের কে সমস্যায় ফেলতে পারে বলে রণ চিন্তা করছে বলে মনে হয় না ওদের,বিশেষ করে শীর্ষা অনুভব করে রণর মধ্যে দুশ্চিন্তার থেকেও অসহায় আস্ফালন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে।
কিছু না বলে ওরা চুপচাপ রণর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখে একই সাথে ওর চোখে প্রকাশ পাচ্ছে আগুন আর জল।জ্বলন্ত চোখে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার চোখের কোন কোনো অজ্ঞাত কারণে চিকচিক করছে।

জয়ি আজ শুতে চেয়েছে রাইয়ের কাছে,রাই আজ আর বারণ করেনি।আজকের বিকেল ওকে আগের মত ভীতু আর দুর্বল করে দিয়েছে সাময়িক,তাই একা শোয়ার মনোবল সত্যি ও পাচ্ছেনা।
জয়িতা জয়ন্ত কে বলতে চেয়েছিল রাইয়ের মনের অবস্থাটা,কিন্তু রাই নিজেই বলতে দেয়নি।
এখনো ঘটনাটা মনে পড়লেই ওর হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।
ওর স্কুলটা জয়িতাদের বাড়ি থেকে পনেরো-কুড়ি মিনিটের হাঁটা রাস্তা।জয়ি বাড়ি থাকলে বেশিরভাগ দিন স্কুটি নিয়ে চলে যায় রাইকে আনতে।ও যে জয়ির বিশাল দায়িত্ব রাই বোঝে ।
আগে সপ্তাহে দুদিন ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে ও চেম্বারে যেত।কিন্তু বিকেল চারটের চেম্বারে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে চারটে হয়ে যেত।রাই সেটা বুঝতে পেরে শেষ সপ্তাহে থেকে ওই দুদিন জয়িকে আসতে বারণ করে দেয়।বড় রাস্তা দিয়ে সোজা রাস্তা,রাই তাই নিজেই জোর করে সপ্তাহে দুটো দিন মঙ্গলবার আর শুক্রবার হেঁটে চলে আসতো।
আজ বৃষ্টির জন্য রাস্তা ফাঁকা ছিল আর বৃষ্টিতে স্কুলে আটকে রাইয়েরও বেরোতে দেরি হয়েছিল।

অনেক চেষ্টা করছে রাই সন্ধ্যে থেকে ঘটনাটা ভুলতে কিন্তু কিছুতেই পারছে না।নিজের চিন্তায় নিজেই ডুবে ছিল ও।জানলার কাঁচের ওপারে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বুঝতেও পারেনি ওর ঘরে রণ এসে ঢুকেছে।
হঠাৎ মাথায় একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চিৎকার করতে যাবে কল্পনার সাথে বাস্তবকে গুলিয়ে, একটা হাত এসে শক্ত করে ওর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ওর বিছানার পাশে এসে দাঁড়ানো রণর কোমরটা জড়িয়ে আবার ডুকরে উঠলো ও।
রণ দুহাতের বেষ্টনীতে জড়িয়ে ধরলো রাইয়ের মাথাটা।

“দূর বোকা মেয়ে এখনো ভয় পাচ্ছিস?ওটা একটা খারাপ স্মৃতি ভেবে ভুলে যা।আর দেখ এটা তো কোনো স্বাভাবিক মানুষ করেনি,তাই ওকে কোনো শাস্তি কেউ দিতে পারবে না।” রণ চেষ্টা করে রাইমা কে স্বাভাবিক করতে।কিন্তু স্বভাব দুর্বল মেয়েটা কিছুতেই বেরোতে পারেনা ওই কয়েক মুহূর্তেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে।
রাইকে বন্ধনমুক্ত করে রণ ওর পাশে বসে।মুখ নিচু করে মেয়েটা তখনও ফোঁপাচ্ছে।
“দেখ রাই আমি জানি আমি তোর ওই খারাপ এক্সপেরিয়েন্সটা পুরোটা রিয়ালাইজ করতে পারবোনা।কিন্তু তুই চেষ্টা কর ওটা ভুলতে।একজন পাগল খেয়াল বসে তোর কাছে গেছিল,তুই ভয় পেয়েছিস দেখে আরো এগিয়ে এসে হাতটা চেপে ধরে।কিন্তু তার কোনো খারাপ ইন্টেনসন নাও থাকতে পারে।তুই ভয় পেয়ে হাত ছড়িয়ে ছুটতে গিয়ে তোর ড্রেসটা ছিঁড়েছে।তুই নিজেও সেটা বলেছিল।তাহলে….”,রণর কথার মাঝে রাই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,”আমি পাগলদের খুব ভয় পাই রণ দা, প্রচন্ড ভয় পাই…রোজ স্কুল যাওয়ার রাস্তায় ওকে দেখলেই বুক ঢিপঢিপ করতো।কিন্তু…আমি খেয়ালই করিনি ও ওই এলাকার আশেপাশে থাকে…ঝেঁপে বৃষ্টি আসায়,ছাতায় আটকাতে পারছিলাম না,তাই ওই গাছের নিচে কিছুক্ষন দাঁড়াতে গেলাম…আর…”,দুহাত দিয়ে চোখ ঢাকে ও।
“প্লিজ রাই তুই নিজেই পারিস এই ভয়টা কাটাতে।পাগলরা কিন্তু সাধারণ অনেক মানুষের থেকে অনেক সেফ।এইসব মানুষ গুলোর সবার যে হিস্ট্রি থাকে সেগুলো জানলে দেখবি এদের আর ভয় করবে না।জটিল মনের মানুষ কিন্তু পাগল হয়না রাই, তারাই এরকম অবস্থায় সাধারণত যায় যাদের একটা মন থাকে।প্লিজ তুই ভাবার চেষ্টা কর কোথাও একটা মিসান্ডারস্টান্ডিং হয়েছিল।আমার বিশ্বাস কোনো মেন্টালি ডিসবাল্যান্স মানুষ স্বেচ্ছায় এটা করবে না।”
রণর কথায় মুখ থেকে হাত সরিয়ে ওর দিকে তাকায় রাই।
রণ হয়তো ভুল বলছে না।কিন্তু ওই যে সেই পাগলটা ইঁট ছুঁড়েছিলো ওর মা’র মাথা লক্ষ্য করে।
কিন্তু আজ,না রণদা ভুল বলছে না।লোকটা ওকে ভয় পেতে দেখেই তো কিছু বলতে চাইছিল।তাই ও ছুটে পালিয়ে আসতে গিয়েই তো…
ওর দিকে জলের বোতল টা এগিয়ে দেয় রণ।
“আমি সন্ধ্যেবেলা ঘটনাটা না জেনেই ভেবেছিলাম যে তোর গায়ে হাত দিয়েছে তার হাত ভেঙে দিয়ে আসবো।কিন্তু মা’কে যখন তুই ঘটনাটা বললি…ভুলে যা রাই।আমি ঐ পাগল লোকটাকে আগে দেখেছি।একদিন দেখেছি কোথাও থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট পেয়েছিল খেতে সেটা রাস্তার কুকুরগুলোকে ভাগ দিয়ে খাচ্ছিল।সাধারণ মানুষের থেকে ওই মানুষটা অনেক সেনসেটিভ।তাই…ভুলে যা ঘটনাটা”,রাই অবাক হয়ে তাকায় রণর দিকে।
সত্যি অনেকটা ভয় কমে গেছে।সন্ধ্যে থেকে আন্টি কত বুঝিয়েছে,বলেছে আর ওকে একা ফিরতে দেবেনা স্কুল থেকে।আঙ্কেল বুঝিয়েছে,রমা পিসি বলেছে,তাও ভয় কাটেনি রাইয়ের।
রণ সেই সন্ধ্যের পর থেকে আর আসেনি ওর ঘরে,আন্টিকে ফোন করে ডেকে নিয়ে নিজে সরে গেছিল।এখন এসে কি সুন্দর করে বোঝালো আর ভয়টা অনেকটা কমে গেল।রণর কথাগুলো আজকাল ম্যাজিশিয়ানের মত লাগে রাইয়ের।ও অবাক হয় বয়সের তুলনায় ওর পরিণত বোধ দেখে।
“থ্যাংক য়্যূ রণদা।তুমি হয়তো ঠিক বলেছ।আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম।আসলে আমি তখন অনেকটা ছোটো, আমাদের ওখানে একজন পাগল মানুষ ঢিল ছুঁড়ে মায়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।সেই থেকে পাগল লোক দেখলে আমি খুব ভয় পাই।”রাই অনেকটা স্বাভাবিক গলায় বলে।

একটা চওড়া হাসি হেসে রণ রাইয়ের গালে হাতটা ছুঁয়ে উঠে পড়ে ওর বিছানা ছেড়ে।
“গুড নাইট রাই।ঘুমিয়ে পর।মা আজ তোর কাছে শুচ্ছে ভালো করছে।কিন্তু ভয়টা যেন ফিরে না আসে।ওকে?” রণ ওর মন ভালো করা হাসিটা হেসে বেরিয়ে যায় রাইয়ের ঘর থেকে,রাইকে আর একবার জড়িয়ে ধরে ওর ভয়টা পুরোপুরি শেষ করার ইচ্ছাটা মনেতেই চেপে রেখে।রণ জানে রাইয়ের শান্তি শুধু না,ওর মনের অস্থিরতার ওষুধও ও আজ সন্ধ্যায় খুঁজে পেয়েছে।কিন্তু না,ওই অনুভূতিটা শুধুই ওর,ওর একার।
ঘরের বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখে মম দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ের দরজার বাইরে।ওকে দেখে ওর মা একটা শান্তির হাসি হাসে ,তারপর আলতো করে ওর চুলটা ঘেঁটে দেয় সেই ছোটবেলার মত।
রণও নীরব হাসি হেসে ইশারায় মাকে রাইয়ের কাছে যেতে বলে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।বুঝতে পারে মম সবটা শুনেছে,কিন্তু দেখেছে কি রণর চোখটা।একটা উৎকণ্ঠা বোধ করে ও,মা’রা যে সব বুঝতে পারে সন্তানের মুখ দেখে।

ক্রমশ…