মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১৩

0
384

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#ত্রয়োদশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

অনেকদিন বাদে ডায়েরিটা খুলে বসে জয়ন্ত।আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যখন আর জীবনটা টানতে পারছিল না।নির্জন পাহাড়ি গ্রামের একা ঘরে অবসাদে ডুবে ইচ্ছা হয়েছিল জীবনটা শেষ করে দিতে,একরাতে স্বপ্নে এসেছিল রেশমা।না জীবনান্তের ক্ষয়ে যাওয়া রেশমা না,সেই শুরুর দিনের প্রাণবন্ত রেশমা।হয়তো জয়ন্ত ওই মেয়েটা কেই শেষ দিকে মিস করতো,ওই এক্টিভ অন্যের দরকারে ছুটে বেড়ানো মেয়েটা,তাই রাইয়ের মা কে উপেক্ষা করতো ওর অভাবে।
রেশমা ওকে অনেক আদর করেছিল,মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বুঝিয়েছিলো রাইয়ের কথা।জয়ন্ত কে বলেছিল রেশমা কে যা বলতে চায় ও,যেগুলো বলতে না পেরে কষ্ট পায়,সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে শেষ করতে চায় নিজেকে,সেই কথাগুলো একটা ডাইরিতে লিখতে।
রেশমা দেখতে পাবে লেখা গুলো,জানতে পারবে ওর মনের কথা।
আত্মহত্যা করলে রেশমাকে ফিরে পাওয়ার ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছিল স্বপ্নের তরুণী।রাইয়ের জন্যে আজও হয়তো সে মুক্তি পায়নি।যেদিন জয়ন্ত রাইকেও আপন করে কাছে টেনে ওর মনের শূন্যতা ভরবে, সেদিন সমস্ত যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবে রেশমা।
সেই থেকে শুরু ডায়েরি লেখার।সত্যি নিজের আত্মজার কাছে এত সুখ রাখা ছিল ভাবেনি জয়।রেশমা ছাড়াও কারোর কাছে ওর ভালোবাসার এত মূল্য রাইয়ের কাছে ফিরে না আসলে জানতেই পারতো না।
রাইয়ের সাথে এত বছরে একটা মানসিক দূরত্ব হয়তো তৈরি হয়েছে কিন্তু জয়ন্ত নিশ্চিন্ত হয়েছিল রাইয়ের মনে ওর বিরুদ্ধে অভিমান সেভাবে বাসা বাঁধেনি।উল্টে জয়ন্তর মনে একটা বিবেক দংশন আজকাল মাঝে মধ্যে পিন ফোটায়।জানে জয়ির কাছে মেয়েটা খারাপ ছিল না,তাও কোথাও একটা একাকীত্ব ছিল হয়তো,স্বাভাবিক উচ্ছ্বলতা প্রকাশ পেতনা।এমনকি ছুটিতে ওর কাছে গিয়ে যখন থাকতো মেয়ে সারাক্ষন চুপচাপ ই থাকতো। যেদিন থেকে নিজের বাবার কাছে এসেছে মেয়ের স্বাভাবিক রূপ যেন প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে জয়।
রাই ছোট থেকেই চুপচাপ ভীতু গোছের,তবে জয়ির কাছে পাঁচ বছর থেকে আর বয়সের পরিণত বোধের কারণেই হয়তো এখন বেশ স্মার্ট হয়েছে।

জয়ন্ত মৃত স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখতে শুরু করে,

‘অনেকদিন তোমায় লেখার মত বিশেষ কিছু ঘটেনি রেশম।আজ আবার কিছু উপলব্ধি হলো,মনে হল তোমায় না বললে শান্তি পাবনা।
জানো রেশম আজ হঠাৎ একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম।বড় চেনা একটা চোখের ভাষা।এই ভাষা জয়িতার চোখে দেখেছিলাম ঋষিকে মনে মনে মন দেওয়ার সময়।এই ভাষা পড়েছিলাম নিজের চোখেও,আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে,তুমি যখন বাইশ বছর আগে চেম্বারে আসতে তোমার দরকারে।আজ সেই ভাষা দেখলাম ঋষি-জয়ির ছেলে রণর চোখে।
একবার দেখতে চাওয়ার আকুলতা ছিল সেই দৃষ্টিতে।
আমি জানিনা আমার ভুল কিনা,কিন্তু রাইকে আমাদের অনুপস্থিতিতে জয়ির থেকেও বেশি হয়তো আগলে রেখেছিলো রণ,রাই নিজে আমায় বলেছে।
তুমি জানো তোমার মৃত্যুর পর মৃতদেহ দেখার সাহস হারিয়েছিল তোমার মেয়ে,তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করেছে রণ।
আমার দোষ যে কাজ আমার করার কথা ছিল,রণজয় সেই সব কাজ করেছে।আজ রাই অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল,ওর চোখে অনেক কনফিডেন্স।কিন্তু সব কিছুর পেছনে আছে রণ।
আমি রাইকে অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু রণ ছাড়া যে মেয়ে এক পা চলতে পারেনা,সে সরল ভাবে বিশ্বাস করে রণ ওর শুধুই বেস্ট ফ্রেন্ড।ও বোঝেইনা ব্রেস্ট ফ্রেন্ড না হলে বেস্ট পার্টনারও হওয়া যায়না।আমি আজও বিশ্বাস করি,রাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হতে গিয়ে তুমি আমার থেকে দূরে সরে গেছিলে।
যাইহোক সত্যি যদি রাইও রণকে সেই চোখে দেখে সেটা রাইয়ের ভাগ্য।না,রণ ঋষি-জয়ির ছেলে বলে না,বা রণর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যেও না।রণর মত ভালো রাইকে কেউ রাখতে পারবে না,এটা আমি উপলব্ধি করেছি ওর সাথে মিশে।
আমি রণর চোখে যে ভালোবাসা দেখেছি তাতে ভালোলাগা,স্নেহ,শ্রদ্ধা,সম্মান সব কিছু ছিল।তার পরও ছিল একটা পাগলামো।রাত ন’টার পর একটু দেখার টানে ছুটে আসার পাগলামো,রাই পায়েস বানাতে গিয়ে ওর কথা ভেবেছে সেটা শুনে চোখ চকচক করে ওঠার পাগলামো।
বলতে দ্বিধা নেই ঋষি বা আমার ভালোবাসা রণর ভালোবাসার কাছে হয়তো হেরে যাবে।কারণ কোনো চাওয়া পাওয়ার হিসেব না করে নিঃশব্দে পাঁচবছর ভালোবাসার ক্ষমতা আমাদের কারোর ছিলোনা,এমনকি জয়িরও না।
রণর একটা সুন্দর মন আছে,তাই জন্যেই তোমার মেয়ে লাকি।
আমি জানিনা রাইয়ের মনের খবর।আমি ছেলে হয়ে একটা ছেলেকে বুঝেছি আমার মত করে।তোমরা মায়েরা হয়তো বুঝতে পারতে মেয়ের মনটা।
তোমায় বললাম যাতে তোমার ইচ্ছেতে তোমার মেয়ের জীবনে ওর প্রাপ্য ভালোবাসা যেন আসে।রণ যেন তোমার মেয়ের জীবনে ধ্রুবতারা হয়ে রয়ে যায় সারাজীবন।’

লেখা শেষ করে ‘তোমার জয়’ লিখে তারিখ দিয়ে ডায়েরি বন্ধ করে জয়ন্ত।
তখনও লেখার ঘোর কাটেনি ওর।ও এখনো বিশ্বাস করে রেশমার ভালোবাসা এখনো ওদের,বিশেষ করে রাইকে ঘিরে আছে।রেশমার ইচ্ছেতে রাইয়ের জীবনে অনেক কিছু ঘটে।ও চাইলে রাইকে বোঝাতে পারে রণর ভালোবাসা।জয়ন্ত সেই আশাতেই অপেক্ষায় থাকে।

রণ কে নিয়ে একটা সন্দেহ জয়ন্তর মনের মধ্যে ছিল বেশ অনেকদিন আগে থেকে।আজ রণর অকারণে অতো রাতে ছুটে আসা জয়ন্তর মনের সন্দেহকে বিশ্বাসে পরিণত করেছে।
সেদিন জয়ি বলছিল এতদিন রণ বারবার চেয়েছে সাইক্রিয়াটিস্ট হতে।কিন্তু মাস তিনেক আগে রাইয়ের স্ক্রিনিং টেস্ট হওয়ার পর থেকে ওর ইচ্ছা বদলেছে।ও এখন পাখির চোখ করেছে অঙ্কলজিস্ট হওয়া কে।
হয়তো এখনো বেশ কিছু বছর বাকি রণর লক্ষ্যে পৌঁছতে।কিন্তু ঠান্ডা মাথার জয়ন্তর দুয়ে দুয়ে চার করতে বেশি সময় লাগেনি।আজ পুরো অঙ্কই মিলিয়ে ফেলেছে ও।

জয়ন্ত জানে ওর মেয়ের বয়স সবে কুড়ি।পুরো জীবন ওর পরে,কিন্তু তার চির দুঃখী,লড়াকু মেয়ের হাত রণর মত ছেলের হাতে দিতে পারলেই ওর মুক্তি।তারওপর আছে ঋষি-জয়ির মত অভিভাবক।
জয়ন্ত ভেবে নেয় রাইয়ের মন জানতে তাড়াহুড়ো করবে না।রণর তো জেনেই গেছে,আর ওর রাই হিরে চিনতে কখনো ভুল করবে না।কিছুটা সময় দিতে ও রাজি।যাতে রাই নিজেই রণ কে উপলব্ধি করতে পারে।

“রমাদি রণ ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছে?” দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হাতখোঁপা বাঁধতে বাঁধতে প্রশ্ন করে জয়ি,ডাইনিং রুমে রণকে দেখতে না পেয়ে ।
“কই রণবাবা তো নামেনি আজ।আজ কলেজ যাবেনে?” নিজের কাজে ব্যস্ত রমা হাতের কাজ সারতে সারতেই উত্তর দেয়।
বিস্মিত জয়ি ডাইনিং স্পেসে লাগানো ঘড়ির দিকে তাকায়,সাতটা দশ?!
‘রণ যে কাল বললো সাড়ে সাতটার মধ্যে ওকে বেরোতেই হবে।নটার মধ্যে কলেজ পৌঁছতে হবে’,মনে মনে ভাবতে ভাবতে জয়ি আবার পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে।
রণর ঘরের সামনে পৌঁছে একটু নিশ্চিন্ত হয়,দরজা ভেতর থেকে লকড।তার মানে ওয়াশরুমে গেছে ছেলে।
নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছিল।তাও কি ভেবে দরজা ধাক্কায় জয়িতা।
দু তিনবার ধাক্কানোর পর জড়ানো গলায়,বিরক্তির সুরে রণ জিজ্ঞেস করে,”কে?কি চাই?”
চমকানোর মনে হয় বাকি ছিল জয়ির,এ কার গলা শুনছে ও!!এই টোনে আজ অবধি রণ কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না।আর ও এখনো ঘুমোচ্ছে কেন! টেস্ট কি বাতিল হলো।মনের হাজারটা প্রশ্ন নিয়েই ও বাইরে থেকে ছেলেকে বলে,”রণ তুই এখনো ঘুমোচ্ছিস?হোস্টেল ফিরবি না?কটা বাজে দেখেছিস?”
কোনো উত্তর আসেনা রণর ঘর থেকে।
জয়ি দরজা ধাক্কায় আবার।কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর দরজাটা খুলে যায়।বুঝতে পারে ও জাস্ট লক খুলে আবার বিছানায় ফিরে গেছে ওর ছেলে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে নাক কুঁচকোয় ও।আজ অনেকদিন পর এসি চলছে ছেলের ঘরে,কিন্তু ঘরের মধ্যে সিগারেটের গন্ধ শুধু না হালকা ধোঁয়াও আটকে।চোখ যায় বেডসাইড টেবিলে,সেখান থেকে খাটের নিচে।একটা ভাঙা কাপ টেম্পোরারি অ্যাস্ট্রে হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে,যেটা একরাতে অর্ধেক প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে।

পাগল হয়ে গেছে নাকি রণ! এত সিগারেট ও খেয়েছে,তারওপর বদ্ধ ঘরে!!
রাগে মাথা গরম হয়ে যায় জয়ির।এগিয়ে গিয়ে রণর মুখ থেকে চাদর সরিয়ে ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করে,”কি ব্যাপার কি তোর?আজ হোস্টেল ফিরলি না।সারারাত সিগারেট পুড়িয়ে ঘর গন্ধে ভরে ফেলেছিস।কি ভেবেছিস কি?”

মায়ের দিকে রণ চোখ খুলে সরাসরি তাকায় এবার।কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকে অপলকে,যেন বোঝার চেষ্টা করে মা কি বলছে।
জয়িতা অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষনের জন্য। এ কি দেখছে সে তার প্রিয় ছেলের চোখে,সব হারানোর এক তীব্র যন্ত্রনা।তার হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলের চোখ এরকম প্রাণহীন কেন।রক্তবর্ণ চোখে সারারাত না ঘুমানোর চিহ্ন স্পষ্ট।
বসে পরে জয়ি ছেলের বিছানার পাশে,দুহাতে মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে মাতৃস্নেহে জড়িয়ে বলে,”কি হয়েছে রণ।প্লিজ আমায় বল।এক রাতে কি অবস্থা হয়েছে তোর?কি হয়েছে বাবা বল।”

কিছু না বলে রণ দুহাতে আঁকড়ে ধরে মা’কে।কি বলবে ও!কি করে বলবে! আজ বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার দাম চোকাচ্ছে ও।তাই গুমরোলেও বলতে পারবে না রাইয়ের বলা সিক্রেট কথা গুলো।তাহলে যে বিশ্বাস ভাঙবে ও ওর ভালোবাসার।কথা দিয়েছে ও রাইকে এখন কাউকে কিছু বলবে না,এমনকি মা’কেও না।নিজের বুকে চেপে রাখবে অব্যক্ত যন্ত্রণাটা।যতদিন না খবরটা ‘গুড নিউজ’ হয়ে ছড়িয়ে যায় সবার মধ্যে।

জয়ি বুঝতে পারে ছোট থেকে বয়সের তুলনায় পরিণত তার ছেলে আজ যন্ত্রনাও হজম করতে শিখে গেছে।তাই মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপালেও কারণটা ও কিছুতেই বলবে না।বারবার ঘাড় নাড়িয়ে ‘কিছু না,কিছু না’ বলা সেটারই প্রমান দিচ্ছে।মা কে আঁকড়ে কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাইছে ওর ছেলেটা।
হঠাৎ জয়ির মনে ভেসে ওঠে একটা মুখ,’রাই’,রাইয়ের সাথে কিছু হয়নি তো ছেলের?ভালো আছে তো মেয়েটা?
কিন্তু প্রশ্নটা করতে গিয়েও মুখে আটকে যায়।রাইকে যতই ভালোবাসুক,নিজের ছেলের এই যন্ত্রণার দিনে পরের মেয়ের খবর জিজ্ঞেস করে ওকে খোঁচাতে মন চায়না।
“রণ আমায় বলবি না তুই?শত কাজের মাঝেও তোর মনের খেয়াল রেখেছি,বন্ধু হয়ে মিশেছি।তুই যে কাজে মন থেকে করতে চাসনি জোর করিনি কখনো।প্লিজ বল বাবা”,জয়ির একপ্রকার আবেদনের সুরে বলে।
নিজেকে সামলে মায়ের স্নেহের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে বের করে এনে রণ গলা পরিষ্কার করে।তারপর বিছানায় উঠে বসে খুব ঠান্ডা স্বরে বলে,”কি হয়েছে আমি চাইলেও তোমায় বলতে পারবো না মা।আমি কারোর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।আমায় কদিন সময় দাও,ঠিক নিজেকে সামলে নেব।শুধু আমার এই অবস্থার কথা কাউকে বলো না,বাবা কেও না।”
জয়িতা কিছুটা বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে ছেলের বিছানায়।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধ জানালার কাঁচের মধ্যে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা রণর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,”ঠিক আছে তাই হবে।কোনোদিন তুই নিজে বলতে চাইলে বিনা দ্বিধায় চলে আসিস।এখন চল নীচে ব্রেকফাস্ট করে নে।”

“মা আমি হোস্টেলে পৌঁছে খেয়ে নেব।এখন গলা দিয়ে খাবার নামবে না।” রণর গলা নিষ্প্রাণ শোনায়।
“না রণ,কিছু অন্তত খেয়ে যা।একে এই অবস্থায় তুই যাবি।সারা সপ্তাহ উৎকণ্ঠায় থাকবো,তারওপর কিছু না খেয়ে গেলে…”,মায়ের কথা শেষ হয়না।
“ঠিক আছে।যা দেবে দাও।আমি নিচে আসছি।” মম কে কথা বাড়াতে না দিয়ে রণ খাট থেকে নেমে তোয়ালে টা টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।
জয়ি ধীর পায়ে শরীরটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায় রণর ঘর থেকে।অগোছালো ঘর পরিষ্কার করার কথাও খেয়াল হয়না।

আজ কমোডে বসে জীবনে প্রথম ফোন বাদ দিয়ে নিজের চিন্তার জগতে হারিয়ে যায় রণ।মনে পড়ে গতকাল রাতের ফোনের কথাগুলো।
-“রণদা দশ মিনিট দাও আমি তোমায় রিং ব্যাক করছি”,রাত এগারোটায় রণজয় অনেক অপেক্ষার পর ফোন করে রাইমার থেকে শুধুই এটুকু শুনতে পায়।
উৎকণ্ঠা কে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করিয়ে ও ফোনটা কেটে দেয়।
দশ মিনিটের বদলে আধঘন্টা পরে আসে রাইয়ের ফোন।

-“বল রাই কি বলবি বলে ফোন করতে বলেছিলি?”
-“রণদা…।”
-“হ্যাঁ বল।” নিজের উত্তেজনা চেপে স্বাভাবিক গলায় বলে রণ।
-“তোমায় এজি র কথা বলেছিলাম।মনে আছে?”
-“এজি?কে এজি”
-“আরে হ্যাঁ গো।অনিকেত গাঙ্গুলী,আমাদের বাংলার সবচেয়ে ফেভারিট লেকচারার গো।ওঁর পড়ানোর গল্প তোমায় কদিন আগে করলাম না?উনি ইউনিভার্সিটি তে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর পোস্টে সুযোগ পেয়ে গেছেন।”
-“মানে!তুই এটা বলতে এত রাতে ফোন করতে বলেছিলি?!”
-“আরে না রে বাবা।” জয়ন্তর সাথে থাকার পর থেকে রাইমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে,অতটাও আর গুটিয়ে চুপচাপ থাকেনা।তাই সহজেই নিজের অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করে ফেলে।
-“তাহলে কি বলবি বল না।” রণ অধৈর্য্য হয়ে পড়ে।কি বলতে চাইছে কি রাই, মনে মনে অন্য একটা আশঙ্কা মাথা চাড়া দিলেও ও গুরুত্ব দেয়না।
-“স্যার আমাদের কয়েকজনকে ,মানে যারা বাংলা ভালোবেসে পড়ে ভালো মার্কস পায়,তাদের মাঝে মধ্যে প্রাইভেটে আলাদা নোটস দিতেন।মানে ওঁর কাছে আমাদের সবার নম্বর ছিল।বেশ কিছুদিন ধরেই কারণে অকারণে আমার সাথে গল্প করতেন।আসলে স্যার ভীষণ গম্ভীর তো।আজ আমায় সিটি সেন্টার নিয়ে গেছিলেন।” রাই ভূমিকা আর না বাড়িয়ে সোজা ঘটনায় ঢুকে পড়ে।
আপাত শান্ত,চাপা মেয়েটা নিজের জীবনের এত বড় ঘটনা রণকে না বলে শান্তি পাচ্ছিল না যেন।
রণর হার্টবিট বাড়তে শুরু করেছিল এজির গল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই।কিন্তু রাই যতক্ষন না আসল ঘটনা বলছে….
-“রণদা মানে তোমায় না বলে থাকতে পারবো না… অনিকেত স্যার আমায় প্রপোজ করেছেন,আমি যদিও কিছু বলতে পারিনি।…”,আর কোনো কথা কানে ঢোকেনা রণর।এতক্ষনের উত্তেজনার সাথে রাইয়ের কথা গুলো ওর মাথায় একটা ধাক্কা মারে।মাথাটা এক নিমেষে ধরে যায়।কান গুলো হঠাৎ গরম হয়ে গলা শুকিয়ে যায়। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনা।শুধু ওই একটা লাইন মাথায় অনুরণিত হতে থাকে বারবার।জিজ্ঞেস করার সাহস হয়না অনিকেত স্যার কে রাই কি চোখে দেখে।
অনেকদিন আগে কলেজে ঢোকার পরপরই রাই বলেছিল বটে ওই স্যারের কথা।তবে শুধুই গুণের কথা,শিক্ষার কথা,পড়ানোর কথা…রণ শুনলেও গুরুত্ব দেয়নি।
আজ বুঝলো অনিকেত স্যার রাইয়ের কাছে একটা আলাদা জায়গায় ছিল।নাহলে তার সাথে সিটি সেন্টার চলে যেতনা ও।
-“রণদা শুনতে পাচ্ছো…ও রণদা।”
-“হ্যাঁ বল।” চেষ্টা করে রণ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে।
-“কিছু বললে না! আমার তুমি ছাড়া মনের কথা বলার কে আছে বলো।আমি কখনো ভাবিনি অনিকেত স্যার আমায় প্রপোজ করবেন।কাল রাতে মেসেজ করেছিলেন ‘এমার্জেন্সি দরকারে মিট করতে চান’ বলে।আমি ভাবিওনি এরকম হবে।উনি তো মেয়েদের আলাদা করে নোটিসও করেন না।সারাক্ষন পড়াশোনার জগতেই ডুবে থাকেন।শুনেছিলাম বছর খানেক আগে সেই সময়কার থার্ড ইয়ারের একজন ওঁকে প্রপোজ করেছিল,স্যার তাঁকে জাস্ট ভালো করে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।বলোনা রণদা কি বলবো?”
-“রাই কাল আমার একটা টেস্ট আছে কলেজে।তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।এবার শুতে হবে রে,নাহলে উঠতে পারব না।” রণ অনেক চেষ্টা করেও পারেনা ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে।ওর মনেহয় হঠাৎ করে ওর জীবনটা শুন্য হয়ে গেল।
একবার ভাবে রাই কে বলে দেয় ওর অনুভূতি,তারপর সামলে নেয়।অনিকেত স্যারকে রাই ভালোবাসে কিনা এখন এই অবস্থায় বুঝতে পারছেনা রণ।তাই থামিয়ে দেয় নিজেকে।
আচ্ছা রাই ওকেই বা কেন বললো অনিকেত স্যারের কথা।ওকে খুঁচিয়ে জানতে চাইছে না তো ওর মনের কথা।একটা আশার ফুলকি মনে জ্বলে উঠতে যাবে তখনই রাই বলে,
“সরি রণদা।তুমি এত ব্যস্ত থাকো আমি সেখানে অহেতুক…সরি সরি অনেক রাত হয়ে গেল।আসলে তোমায় কোনো কথা না জানানো অবধি আমার ঘুম আসেনা।মা চলে যাওয়ার পর কবে তুমি সেই জায়গাটা নিয়ে নিলে নিজেও জানিনা।তুমি মায়ের অভাবটা তো পূরণ করেছ।আমার সাথে মায়ের যা সম্পর্ক ছিল আজ তাকে এটা বলতাম হয়তো,জীবনের প্রথম ভালোলাগা আমায় নিজে প্রপোজ করেছে।কিন্তু…ছাড়ো।তুমি শুয়ে যাও।পরে আবার কথা হবে।কিন্তু প্লিজ এটা এখনই কাউকে বলোনা।আমি জানি তুমি বলবে না,আন্টিকেও বলোনা।আসলে অনিকেত স্যার আমার কাছে কিছুটা সময় চেয়েছেন,অন্তত দু বছর।…”,আরো অনেক কিছু বলে যায় রাইমা।অর্ধেক কথা কানে ঢোকেনা রণর।এই যে রাই বললো ও কিছু বলেনি ওর স্যার কে।আবার এদিকে বলছে সময় চেয়েছে।
কিছু ভাবার ক্ষমতা আর ওর থাকেনা।কখন ফোন কেটেছে ঘোরের মধ্যে তাও মনে করতে পারেনা ও।
ড্রিংক ও বিশেষ পছন্দ না করলেও হোস্টেলে থাকলে হয়তো ওর অপছন্দের মদও ও আকণ্ঠ খেত।সেটা না হওয়ায় বন্ধুদের জন্যে সবসময় নিজের রিজার্ভে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা শেষ করে ফেলতে চায়।বাইরে যা তে গন্ধ না ছড়িয়ে যায় সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে এসি অন করে দেয়।অনেকদিনের বন্ধ এসির ঠান্ডা ক্ষমতা কমে গেছে বুঝতে পেরে তাপমাত্রা নামিয়ে দেয় প্রায় সর্বনিম্নে।

এখন ওয়াশরুমে বসে গতকালের ঘটনা মনে পড়তে আর নিজেকে সামলাতে পারেনা রণজয়।চোখ বুজে চারিদিক শুধু অন্ধকার দেখে।হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে বাইশ বছরের পরিণত যুবক।কোনোদিন কিছু আশা করে ভালোবাসেনি,কিন্তু বোঝেনি সেটা কখনো হারিয়ে গেলে সব কিছু এক থেকেও জীবন এত মরুভূমি হয়ে যাবে।অসহ্য একটা যন্ত্রনা যেন কুড়ছে মনটা।কষ্টটা ঠিক কোথায় হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছেনা।এক রাতে চোখের কোলে কালি পরে জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেছে ওর।ওর জীবনের বিগত পাঁচ বছরের ধ্রুবতারাকে হঠাৎ মরীচিকা মনে হচ্ছে।যার পিছনে ছুটেও আর কোনোদিনও পৌঁছতে পারবে না তার কাছে।
‘ভগবান কিকরে কমবে এ জ্বালা।কিকরে বাঁচবো আমি!রাইয়ের বিয়ে হবে,আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো! আমি আর ভাবতে পারছিনা’,বাথরুমের বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ধরে রাখতে পারেনা দুর্বল মনের শরীরটা।বেসিন ধরেই বসে পড়ে মেঝেতে।দুটো হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে দেয়,কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে রণর শরীরটা।

অ্যালার্মের আওয়াজে চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে চমকে যায় রাই।এত সকালে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ।
অ্যাপ খুলে মেসেজ পড়ে লজ্জা পেয়ে যায় একটু।

‘মর্নিং।ঘুম ভাঙলো আমার সোনার।উঠে পর শিগগিরি।সামনে পরীক্ষা,পড়তে বোস মন দিয়ে।মুয়াহ!…অনিকেত”।

রাই কোনোদিনও এরকম মেসেজ আগে পায়নি।লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।গম্ভীর স্বভাবের স্যারের থেকে এরকম মেসেজ ওকে এক আলাদা অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়।জীবনে প্রথম ও অনুভব করে অন্য রকম এক অনুভূতি।মেসেজের শেষে নিজের নাম লেখার অর্থও স্পষ্ট হয় ওর কাছে,স্যার না এবার থেকে ওই মানুষটা শুধুই অনিকেত ওর কাছে।
বয়সে প্রায় আট ন’বছরের বড় অনিকেত কে স্যারের বদলে নাম ধরে ডাকার চিন্তাতেই আরো একবার লজ্জা পায় ও।
তারপর সংক্ষেপে লেখে,”মর্নিং।এই উঠলাম,এবার ফ্রেস হয়ে পড়তে বসবো।…রাই”।
আজকের সকালটা সত্যি যেন অন্যরকম।বৃষ্টি প্রিয় রাইয়ের রোদ ঝলমলে আকাশ আজ হঠাৎ খুব ভালো লাগে।
ফ্রেস হয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখে সুলেখা মাসি চলে এসেছে বাড়ি থেকে।
বাবা!বাবা এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল?
সুলেখা কে জিজ্ঞেস করতে যাবে দেখে বাবা ঘর থেকে রেডি হয়ে বেরোচ্ছে ব্রেকফাস্ট খেতে।
রাইকে দেখে জয়ন্ত একটু থমকায়,অন্যদিনের থেকে যেন বেশি উজ্জ্বল লাগলে রাই-মা কে!
ভ্রু আর নাক কুঁচকে একটু হেসে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,”মর্নিং ডিয়ার”।
বাইরে থেকে বাঙালি বাবা একটু বেশি ফরমাল হয়েছে বুঝে রাইও হেসে ফেলে।গলায় জোর এনে ও উত্তর দেয়,”মর্নিং বাবা”।
না আজ সব কিছুই বড্ড ভালো লাগছে।আর রণদের বাড়িতে থেকে এমনিও ওর এসব কায়দা গুলো আগেই রপ্ত হয়ে গেছে,তাই অসুবিধা হয়না।

জয়ন্ত বেরিয়ে যেতে রাই ফিরে আসে নিজের ঘরে।পার্ট ওয়ান পরীক্ষার বেশি দেরি নেই,তাই বই খুলে বসে।
কিন্তু সব কিছু ভালো লাগা মন আজ বিশেষ কারণে অস্থির।অনিকেত স্যার অনেক অনেক মেয়ের হার্টথ্রব।প্রথমদিন ওদের ক্লাসে এসে যখন কথা বলেছিল অনেক ক্লাসমেটের মতোই ওর হৃদয় যে কাঁপেনি সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে।
তারপর ওদের কয়েকজনকে প্রাইভেট পড়ানোর অফার দেওয়া,ওকে মাঝে মাঝে মেসেজ করা,বা মাস খানেক আগে থেকে দরকারে অদরকারে পিং করে গল্প শুরু করা সবটাই যেন রাইয়ের কাছে স্বপ্ন।
রণ ছাড়া কোনো ছেলের সাথে কখনো না মেশা রাই বুঝতেও পারেনা স্যার কবে এতটা এগিয়ে গেলেন।

দূর! কত পড়া বাকি আর ও খালি উল্টোপাল্টা ভাবছে।
হঠাৎ মনে পরে আগের রাতের কথা।আবার নতুন করে অবাক হয় রাই।
রণদা এতদিন ওর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে ওর সব কথা মনে দিয়ে শুনেছে।সেই বিশ্বাসেই রাই ওর জীবনের এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ওকে বলতে গেছিল।কিন্তু এই প্রথমবার ও কোনো উৎসাহ তো দেখালো না,এমনকি কংগ্রাচুলেট অবধি করেনি।রাই বুঝতে পারেনা কারণটা।রণ ওর প্রিয় বন্ধু শুধু না ওর অভিভাবকও বলা যায়।সে কিকরে কাল এড়িয়ে গেল বিষয়টা! রাই ভাবে আজ রাতে একবার ফোন করবে রণকে,এখন নিশ্চই রাস্তায় আছে।
উঠে পড়ে রাই নিজের চেয়ার ছেড়ে।ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা।রেডি হতে হবে ওকে,আর কদিন বাকি কলেজের প্রথম বছর শেষ হতে।টেবিলে ফোনটা রেখে কলেজে পড়ার সালোয়ার নিয়ে পা বাড়ায় ও ঘরের অ্যাটাচ্ছড বাথরুমের দিকে।
টেবিলে পরে থাকে স্মার্ট ফোনটা,যেটা রণ দুবছর আগের জন্মদিনে ওকে গিফট করেছিল নিজের জমানো টাকা দিয়ে।একটা মেসেজ ঢোকে রাইয়ের ফোনে,ওর অনুপস্থিতিতে,রণর মেসেজ।লকড স্ক্রিনে পপ আপ করা মেসেজ দেখায় শুধু একটা লাইন,”অভিনন্দন রাই।অনেক শুভেচ্ছা….”।আর সাথে লকড স্ক্রিনের ওয়ালপেপার জ্বলে ওঠে,রণ রাইয়ের এক সাথে তোলা রাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় ছবিটা,ওর গত জন্মদিনে ওকে কেক খাওয়াচ্ছে রণ।

এখন বাইরে থেকে ফিরে কেউ ওপরে নিজেদের ঘরে সরাসরি যায়না।নিচের ওয়াশরুমে ফ্রেস হয়ে বাইরের জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে ফেলে দিয়ে ওয়াশরুম সংলগ্ন ঘরে রাখা কাচা ড্রেস পরে তারপর মুক্তি।করোনা মানুষকে এগুলো শিখিয়েছে।
ঋষি সেইসব নিয়ম মেনে, নিজের সঙ্গের ল্যাপটপ ব্যাগটা স্যনিটাইজ করে যখন ওপরে এলো দেখলো জয়ি ঘরে নেই।নিজের তলাতেও আওয়াজ পায়নি ওর।তাহলে কি জয়ি ফেরেনি? ওপর থেকে চেঁচিয়ে রমাকে জিজ্ঞেস করবে বলে বারান্দায় এসে দেখলো রণর ঘরে আলো জ্বলছে।
কি মনে হতে রণর ঘরে এসে উঁকি মেরে দেখলো জয়ি অন্যমনস্ক হয়ে ওর খাটে বসে।
ধীর পায়ে ওর গায়ের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো।

-“আরে তুমি?কখন এলে বুঝতেই পারিনি”,জয়ির স্বরে অন্যমনস্কতা স্পষ্ট।
-“তুই কি এত চিন্তা করছিস?তাও এঘরে বসে?”
-“না সেরকম কিছু না।ঘরটা গুছতে এসে বসে পড়েছিলাম।পুরোনো কথা ভাবছিলাম।রণর ছোটবেলার কথা।ছেলেটা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল।” উঠে পরে জয়িতা বিছানা ছেড়ে।
-“কি হয়েছে জয়ি?আমাকেও বলবিনা?”

চুপ করে থাকে রণর মা।আজ অবধি ঋষিকে কিছু লুকোয়নি ও,কিন্তু আজ যে ছেলে অনুরোধ করলো বাবাকেও কিছু না বলতে।
“আচ্ছা আমি বুঝেছি সমস্যাটা রণ কে নিয়ে।এবার বল কি হয়েছে?” ঋষি জয়ির হাতটা ধরে।

” রণ ভালো নেই ঋষি।কোনো কারণে খুব ডিপ্রেসড ছিল সকালে।কারণটা আমায়ও বলেনি।কিন্তু বলেছিল তোকে কিছু না বলতে”,পারেনা জয়ি ঋষিকে লুকোতে।

ভ্রু কুঁচকে জয়ির দিকে তাকিয়ে থাকে ঋষি।রণ তাকে জানাতে বারণ করেছে!!কি এমন ঘটলো ওর জীবনে যা বাবাকেও বলা যায়না।
ছোটবেলায় জয়ির শখ ছিল রণ ঋষিকে ড্যাডা বলুক অথবা বাবি।কিন্তু ঋষি মনে মনে চাইতো বাবা ডাক শুনতে।রণ বিস্ময়কর ভাবে ওকে প্রথম থেকেই বাবা বলেছিল।
ওদের বন্ডিং সেই শুরু থেকে বন্ধুর মত,আজও তা বদলায়নি।এমনকি রাইকে নিয়ে রণর চিন্তাভাবনা ঋষি বোঝে অনেক আগে থেকে।আর রণও আজ অবধি সমস্যায় পড়লে,কষ্ট পেলে বাবার কাছেই এসেছে সবার আগে।আজ তাহলে কি হলো? রণ ডিসটার্বড ই বা কেন?

“কি হয়েছে আমায় প্লিজ বলবি।তুই শিওর থাক আমি রণকে কিছু বলবোনা।কিন্তু তুই আমার সামনে ছেলেকে নিয়ে টেনশন করবি আর আমি কিছু না জেনে তোকে টেনশন করতে দেখে টেনশন করবো।তার থেকে বেটার কি তুই আমায় বল,কথা তোর আমার মধ্যেই থাকবে।” ঋষি কথায় ফাঁক রাখেনা।
জয়ি জানে ঋষিকে একটু হিন্টস দিলেই ও ঠিক কথা বের করে নেবে,কিন্তু ওকে না বলেও জয়ি যে থাকতে পারছিল না।
জয়ি সকালের ঘটনা আর কিছু লুকোয়না ঋষির কাছে।
শোনার পর ঋষিও চুপ করে যায়।
রণর মত ছেলে,যে হেসে খেলে মজা করে থাকে,অন্যের ডিপ্রেশন কমায়,সে এতটা ভেঙে পড়েছে?!
মুখে বলতে না পারলেও রণ ওর হৃদপিন্ড।ওর মুখে তাই কখনো হাসি হারাতে দেয়নি।আর রণ সত্যি বড় হয়ে গেছে,নাহলে নিজের বাবাকে এড়িয়ে গেল এত খারাপ সময়েও।
মা বাবা হওয়ার অনেক জ্বালা।এতদিন ছেলে কাছে থাকতো,আর বয়সের তুলনায় বরাবর ছেলে বুঝদার হওয়ায় ওদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।আজ বড় চিন্তা হচ্ছে দুজনের।
ঋষি কি ভেবে ফোনটা বের করলো।রণর নম্বরে ফোন করে দেখল ফোন অফ।টেনশন বাড়লো।
সবে দুজনে কিছু আলোচনা করতে যাবে,জয়ির ফোনে রিং হতে শুরু করলো।ফোন হাতে নিয়ে নামটা দেখে তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরলো ও,”হ্যাঁ রাই বল”।
রাইয়ের কথা শুনতে শুনতে জয়িতার মুখে চিন্তার মেঘ কমার বদলে যেন বাড়লো মনে হলো ঋষির।
রাইয়ের ফোনটা রেখে জয়িতা কিছুটা ভাঙা গলায় বললো,”সেই দুপুর থেকে রণর ফোন অফ।রাই কোনো দরকারে ওকে বারবার ফোন করেও না পেয়ে আমায় ফোন করেছিল জানতে রণ কোথায়?আমি বুঝতে পারছিনা কি হলো রণর!এতক্ষন ভাবছিলাম রাইয়ের সাথে হয়তো কিছু হয়েছে।কিন্তু ওর কথায় তো সেসব কিছু মনে হলোনা।…”,ধরে আসে একজন মায়ের গলা চিন্তায়।
ঋষি আর কথা না বাড়িয়ে ফোন থেকে একটা অফিসিয়াল নম্বর বের করে সেই নম্বরে ফোন করে।ফোন কানে ধরে অপেক্ষায় থাকে অন্য প্রান্তের কথা শোনার জন্য।ফোন বেজে যায়।

ক্রমশ…