মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-১৪

0
372

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#চতুর্দশ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“কিরে রাইমা বাড়ি যাবিনা?” রাইয়ের কলেজ ফ্রেন্ড অজন্তা পিছন থেকে এসে ঠেলা মারে হঠাৎ করে।
রাই কলেজের মেইন গেট থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল অনিকেতের জন্যে।আজ অনিকেত ইউনিভার্সিটি জয়েন করলো।কলেজ আসা বন্ধ করেছিল মাস খানেক আগেই।তার আগে রাইয়ের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা ছিল।সব মিলিয়ে ওদের সম্পর্কের ভূমিকা শেষ হওয়ার পর আর দেখা সেভাবে হয়নি,যা কথা হত ফোনে, বিশেষ ভাবে বললে হোয়াটস অ্যাপে।আজ তাই অনিকেতের ইচ্ছাতেই দুজনে দেখা করবে ঠিক হয়েছে।
“না রে আমার এক বন্ধুর আসার কথা আছে।একটু মিট করবো।তুই চলে যা”,অজন্তাকে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে রাই।অনিকেত আর ওর সম্পর্ক কোনোভাবেই পরিচিত গণ্ডিতে ছড়াতে চায়না ওরা এই মুহূর্তে।বিশেষ করে কলেজে।
“কে আসবে?তোর রণ দা?” মাস্কের আড়ালে মুখ টিপে হাসে অজন্তা।
শান্ত রাই অজন্তার কথায় ওর চির পরিচিত স্বভাব বদলে বিরোক্তিতে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে,”হঠাৎ রণদার কথা বললি?”

“তোর বন্ধু কলেজের বাইরে তো ওই একজনের নামই আমরা শুনেছি।ইদানীং কম বলিস যদিও তার কথা কিন্তু তোর রণদা কে চোখে না দেখেও তোর মুখে গল্প শুনেই আমরা কজন চিনে গেছি।” অজন্তার আসলে একটু বেশি কৌতূহল রাইয়ের রণদা কে নিয়ে।
“না রণদা না।অন্য একজন বন্ধু আসবে।তুই চিনিস না”,মনে মনে একটু অস্থির হয়ে ওঠে রাই।ওর কলেজ আর অনিকেতের ইউনিভার্সিটি প্রায় গা ঘেঁষা।এক্ষুনি এসে পড়লে কেলেঙ্কারি হবে।রাইয়ের সাথে অজন্তা আছে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে নেবে অনি,হ্যাঁ মনে মনে আজকাল এই নামেই ডাকে রাই।
মুখচোরা শান্ত মেয়েটা আজকাল একটু ডেসপারেট হয়েছে মনে মনে।অনিকেত স্যারের মত মানুষ ওকে জীবনসঙ্গী করতে চেয়েছে যেন জীবনটাই ধন্য হয়ে গেছে ওর।এমনকি ওর নিজের কেরিয়ারের ভারও যেন তুলে দিয়েছে অনিকেতের হাতে।
“ঠিক আছে তুই এই রোদে অপেক্ষা কর।আমি চললাম।” অজন্তা বাসস্টপের দিকে হাঁটা লাগায়।
রাই অপেক্ষা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
রণর ব্যবহার শেষ দুমাসে ওকে একটু অবাক করেছে। অনিকেতের সম্পর্কে জানানোর পরেরদিন রণর একটা মেসেজ আসে বেলার দিকে।ওকে অভিনন্দন জানিয়েছিল রণদা।তারপর সারাদিন ফোন অফ রেখেছিলো,এমনকি জয়ি আন্টি বা ঋষি আঙ্কেলের সাথেও কথা হয়নি।
শেষে হোস্টেলের অফিসে ফোন করে রণজয় মুখার্জী কে মেসেজ ড্রপ করে আঙ্কেল।
সেদিনের পর থেকে রণ যেন কেমন বদলে গেছে।রাই অনেক ভেবেও হিসেব মেলাতে পারেনি।ও রণ কে যতটা চেনে-জানে জোরাজুরিতে মুখ খোলার ছেলে ও নয়।কোনোদিন নিজে চাইলে তবেই বলবে কারণটা।আজকাল রাইয়ের সাথে বিশেষ কথাও হয়না ওর।
ওর চিন্তার মাঝে একটা ফোন ঢোকে।হাতে ধরা ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে একটু হেসে ফোন ধরে রাই,”হ্যাঁ বলো”।
“একটু এগিয়ে এসো।দেখো আমি বাঁ ফুটপাতে গাড়ি পার্ক করেছি।চুপচাপ এসে গাড়িতে উঠে পড়ো।” রাইকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দেয় অনিকেত।
ফোনটা ব্যাগে আর ঢুকিয়ে নেয় রাই, হাতে ফোন নিয়ে চলাচল করতে ও ঠিক অভ্যস্ত না।রণ কত যে বলেছে,কিন্তু তাও পারেনি রাই অভ্যস্ত হতে।শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে ও।

দূর থেকে অনিকেতের নতুন কেনা চেরি রেড আই-টেন দেখে দ্রুত পা চালায় রাই।চার চাকা নিয়ে রাইকে কিছুটা হলেও প্রো করেছে রণ।এখন দূর থেকে গাড়ি দেখে মডেল বুঝতে পারে ও।
অনিকেতের পাশের সিটের দরজা খুলে উঠে বসে রাই।কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট করে দেয় অনি।
কিছুক্ষন গাড়ি চলার পর কথা শুরু করে ও নিজেই।

-“বলো কোথায় যাবে?”
-“আমি বলবো?”
হেসে ফেলে রাইয়ের স্যার।মেয়েটার এই সরলতাই তো ওকে মুগ্ধ করেছিল।আজকের শহুরে আদবকায়দা জেনেও একটা সারল্য মেশানো ব্যবহার রয়ে গেছে ওর মধ্যে।বাংলা মিডিয়ামে পড়া মফস্বলে মানুষ হওয়া অনিকেত রাইমার মধ্যে গ্রাম্য প্রকৃতির সতেজতা খুঁজে পেয়েছিল।আজও মনে পড়ে প্রথমদিন দেরিতে ক্লাসে ঢোকার জন্যে ওর কড়া কথা শুনে আজকের জেনারেশনের একটা মেয়ের চোখ ছলছল করে উঠেছিল।রূপের অহংকারে আজকের বেশিরভাগ মেয়ে হয়তো ওই কথাটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনতো না,শুকনো ‘সরি’ দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দিত,কিন্তু রাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চুপচাপ হজম করেছিলো ওর লেকচার।
আজ বলা যায় ওদের প্রথম ডেটিং,কিন্তু রাইমা আজও অন্যদিনের মতোই সাধারণ।

-“হাসছো কেন?” এই ‘তুমি’ বলাতেও কম কসরত করতে হয়েছে নাকি অনিকেত কে।
-“হাসছি না ভাবছি আমার ভবিষ্যতের কথা।এভাবে যদি সব বিষয়ে আমার বউ আমার ওপর নির্ভর করে তো মুশকিল।কি খাবো,কোথাও যাবো…সব আমার দায়িত্ব নাকি?” হাসতে হাসতেই বলে টল, ডার্ক হ্যান্ডসম অনি।

চুপ করে থাকে রাই।ও কয়েকবার রণর সাথে কয়েকটা জায়গায় গেছে।তবে শুধু রণ না এক দুবার আঙ্কেল আন্টিও ছিল।বেশিরভাগ ডিনার করতে।একবার রণকে বলেছিল অত বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টে ওর একটু অস্বস্তি হয়।চুপ করেছিল রণ সেই মুহূর্তে।তারপরের দিন বিকেলে ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়েছিল শহর ছাড়িয়ে হাইওয়ের ধারে এক ধাবাতে।বিশাল মজা হয়েছিল সেদিন।

“কি হলো বলো কিছু।কোথায় যাব?” অনিকেত ইচ্ছে করে জোর করে রাইকে।যদিও ওর ঠিক করাই আছে কোথায় যাবে। ওর বিশ্বাস রাই আগে কখনো এরকম জায়গায় যায়নি,তাই বুঝতে চাইছে ওর মানসিকতাটা।

কিছুক্ষনের মধ্যে অনিকেতের গাড়ি এসে থামে একটা পাঁচ তারা হোটেলের সামনে,এরমধ্যে আছে সেই চীনা রেস্তোরাঁ যেখানে রাইমা কে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হলো অনিকেতের স্ট্যাটাস বোঝানো,যাতে ভবিষ্যতে রাইমা এগুলো নিজেই বুঝে যায়।না অনি এইসব জায়গায় নিয়মিত আসেনা,কিন্তু গার্লফ্রেন্ড কে ট্রিট দেওয়ার জন্যে এটাকেই পছন্দ করেছে কাল রাতে অনেক ভেবেচিন্তে।
সবে হোটেলের মধ্যে গাড়ি ঢোকাতে যাবে রাই কাতর স্বরে বলে ওঠে,”প্লিজ এখানে না”।
অনিকেত কিছু না ভেবেই হোটেলের বাইরের পার্কিং লটের একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা সেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে রাইয়ের মুখের দিকে তাকায়।

“প্লিজ কিছু মনে কোরোনা।আমি ভাবিনি তুমি এরকম রেস্টুরেন্টে আজ আসবে।আমি খুব সাধারণ ভাবেই চলে এসেছিলাম।এরকম ভাবে এখানে গেলে…আসলে…।” রাই তার পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানে এই ধরণের রেস্তোরাঁয় কিরকম পোশাক পড়ে যাওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
অনিকেত নিজে এবার খেয়াল করে রাইমার পোশাক।আসলে ও এতো সুন্দর যে আলাদা করে ওর পোশাক নজরে আসেনা।কিন্তু ও তো ভুল কিছু বলেনি।অন্যদিনের সাধারণ রাইমার তুলনায় আজ সাজ পোশাকে ওর পরিপাটি বেশি হলেও তা এই ধরণের পরিবেশের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
কিন্তু অন্য কারণে অনিকেতের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যায়।
“তুমি আগে এখানে এসেছ ?”
হসপিটালের ডাক্তার সাধারণ এক মানুষ,যিনি কখনো চেম্বার অবধি করেননি তার মেয়ে এই রেস্টুরেন্টে এসেছে এটা কিছুতেই বিশ্বাস হয়না ওর।
“হমম আমি তো লাস্ট পাঁচ বছর বাবার বন্ধুর বাড়িতে থেকেছি।তাদের সাথে এসেছিলাম বার দুয়েক।” রাই সংক্ষেপে উত্তর দেয়।আসলে অনিকেত ওর সম্বন্ধে কখনো কিছু জানতেই চায়নি।
অনিকেতের বাড়ি গোঁড়া ব্রাহ্মন।তাই ও রাইমার সারনেম দেখেই ওকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছিল।
কথা না বাড়িয়ে ও গাড়ি ঘোরায় বুঝতেই পারে রাইমা ভুল কিছু বলছে না,কিন্তু ওকে নিয়ে কৌতূহল বাড়ে।

“এনে তোর টোস্ট ওমলেট”,নিজের চাউমিনের প্লেটটা নিজের সামনে রেখে রণর টা ওর সামনে বসিয়ে দেয় শীর্ষা।
চুপচাপ টোস্টে কামড় দেয় রণ।
আজ মাস দুয়েকের কাছাকাছি হলো সেই হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলেটা চুপচাপ হয়ে গেছে স্বাভাবিকের তুলনায়।
সেদিনটা আজও মনে আছে শীর্ষার,বারবার করে ফোনে না পেয়ে ও চলে গিয়েছিল ছেলেদের হোস্টেলে।ভেতরে ঢোকার পারমিশন পায়নি,কিন্তু দু একজন মারফত জেনেছিল রণ হোস্টেল রুমে চুপচাপ শুয়ে আছে বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে।
ভীষণ অবাক হয়েছিল শীর্ষা।মেলাতে পারেনি নিজের চেনা রণজয়ের সাথে।ইম্পরট্যান্ট টেস্ট না দিয়ে হোস্টেলে শুয়ে আছে!!ফোন করলে ধরছে না!! কেন?
ফিরে গেছিল ও নিজের হোস্টেলে।
গভীর রাতে ফোন এসেছিল রণর নম্বর থেকে। শীর্ষা লাফ মেরে ধরেছিল ফোনটা।’হ্যালো’ বলার পর ওপাশ থেকে আওয়াজ পায়নি,কিন্তু গভীর নিঃশ্বাসের আওয়াজ আসছিল। একবার মনে হয়েছিল ‘ওয়ান ওয়ে’,ওর আওয়াজ ওপাশের মানুষটা শুনতে পাচ্ছেনা। যেমুহূর্তে ফোন কেটে দেবে বলে কান থেকে সরাতে যাবে রণ কথা বলেছিল,”বিকেলে আমার খোঁজে হোস্টেলে এসেছিলি?”
গলার স্বর ছিল অস্বাভাবিক ঠান্ডা।
শীর্ষা কি বলবে বুঝতে না পেরে বলেছিল,”কি হয়েছে রণ?আজ টেস্ট দিতে এলিনা তুই,অথচ হোস্টেলে ছিলি?”

চুপ করে ছিলো রণ।আজও সেই চুপ করেই আছে।এই দুমাসে শীর্ষা অনেকবার জানতে চেয়েছে রণর কথা কিন্তু ও কিছুই বলেনি। একদিন শুধু বলেছিল,”আমায় একটু সময় দে শীর্ষা।একটা ব্যাপার নিয়ে আমি একটু ডিসটার্বড আছি,হয়তো কোনোদিন আবার আগের মত হয়ে যাবো।”

“কিরে খা”,টোস্টে একটা কামড় দিয়ে চুপ করে হাতে ধরে বসেছিল রণজয়।শীর্ষার কথায় সম্বিৎ ফেরে,ওর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে আবার একটা কামড় দেয় ও।
রণ নিজেকে নিয়েই আজকাল বেশি ভাবে।এই দুমাসে রাইয়ের অভ্যেস থেকে অনেকটাই বের করে এনেছে নিজেকে।কিন্তু পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি।আজও মাঝরাতে উঠে বসে পড়ে হোস্টেলের বিছানায়।বাড়ি যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে ।রাইয়ের এত স্মৃতি চারদিকে যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে।
কোনোদিনও রাইকে বলতে পারেনি,কিন্তু ভেবেছিল রাই ওর মনটা ঠিক বুঝবে।নিজের মনে অনেক অলীক কল্পনারও জন্ম দিয়েছিল কিছু দুর্বল মুহূর্তে।
কিশোরী রাই যুবতী হওয়ার সাথেই তাকে কল্পনার বউ সাজিয়ে স্বপ্ন গুলো ফিরে আসতো।
রণ মনে মনে ভাবতো শীতের দুপুরের কথা,চোখ বুজে শুয়ে শুনতে চাইতো নব বধূ রাইয়ের ঘুঙুরের আওয়াজ।
রাইয়ের স্ক্রিনিং টেস্ট ওর মনে অদ্ভুত ভয় ঢুকিয়েছিলো।নিজের হৃদপিন্ড কে অন্যের দায়িত্বে ছাড়বে না বলে এক আশঙ্কা থেকে ঠিক করেছিল ও নিজে অঙ্কলজিস্ট হবে।রাই কখনো ওকে বোকা বানাতে পারবে না তাহলে।

“ওই রুদ্রর কি খবর রে?” রণর মনটা অন্যদিকে ঘোড়ানোর জন্যে অন্যমনস্ক রণকে যা মাথায় আসে প্রশ্ন করে শীষ,ভুলে যায় দুদিন আগেই কথা হয়েছে ওর রুদ্রর সাথে।
“বলতে পারবো না।বেশ কিছুদিন কথা হয়নি ওর সাথে”,উত্তর দেয় রণ।

“ওহ!আমার সাথেও কিছুদিন আগে কথা হয়েছিল।ও সম্ভবত এমবিএ করার প্রিপারেশন নিচ্ছে।জানিনা হঠাৎ গভর্মেন্ট জবে কি অনীহা হলো।বলছিল প্রাইভেট জবে উন্নতি বেশি,প্রসপেক্ট বেশি।আমি বললাম, ‘হঠাৎ কি হলো তোর?তুই তো ব্যাঙ্কের জব এর জন্যেই মেইনলি প্রিপেয়ার হচ্ছিলি।’ কিন্তু ওর জানিনা কি লক্ষ্য আপাতত এমবিএ নিয়ে মেতেছে।নেক্সট বার ফোন করলে বুঝতে পারব।” শীর্ষা কাঁটা চামচে করে বেশ কিছুটা চাউমিন মুখে চালান করে।
চুপচাপ শোনে রণজয়।
শীর্ষা আড়চোখে ওকে লক্ষ্য করলেও কিছু বলেনা।ও জানেনা রণর কি হয়েছে কিন্তু বুঝতে পারে রাইয়ের সাথেই কোনো কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে ওর,তাই নিজের চারপাশে একটা খোলস বানিয়ে তাতে ঢুকে গেছে।
খুব রাগ হয় শীর্ষার,রাগ হয় রণর ওপর।ও তো রণ কে ভালোবাসে,রণর প্রত্যাখ্যান ওকেও ভেঙে দিয়েছিল ভিতরে ভিতরে।কিন্তু ও তো তার বহিঃপ্রকাশ করেনি।তাহলে রণ কেন এভাবে নিজেকে ক্ষয় করছে একজনের জন্যে। ভালোবাসলেই অন্যজনও একই রকম ভাববে তার তো কোনো কারণ নেই।ও জানেনা রাই রণকে কিছু বলেছে কিনা,বললেও কি বলেছে,কিন্তু রণর ওই পরিবর্তন ও মানতে পারে না।আবার ওর মত পরিণত মেয়ে মুখেও বলতে পারেনা কিছু।
“রণ তোকে একটা কথা বলবো?” শীর্ষা আজ কি ভেবে বলেই ফেলে।
“হমম বল না।” গা ছাড়া উত্তর আসে।

-“প্লিজ অনেকদিন হলো।এবার বলবি কি হয়েছে যার রেশ এখনো তুই বয়ে বেড়াচ্ছিস? বিশ্বাস কর আমি খুব মিস করি আমার সেই বন্ধুটা কে।আই হোপ,তুই সেদিন আমার বলা কথা গুলোতে এতদিন মাথায় নিয়ে ঘুরছিস না।আমিও ভুলে গেছি সেদিন গঙ্গার ধারের ইভিনিং টা।তুইও প্লিজ ভুলে যা”,নিজের মনের গভীরে সেদিনের সন্ধ্যের কষ্টটা চেপে শীর্ষা রণকে স্বাভাবিক করতে কথাগুলো বলে।

আজও আগের মতোই চুপ থাকে রণ।কিন্তু শীর্ষা যে ওর দিকে থেকে নজর সরায়নি ও অন্যদিকে তাকিয়েও বুঝে যায়।ওদের বন্ধুত্বের বয়স পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে।তাই শীর্ষার এই অধিকারবোধটা রণ স্বাভাবিক ভাবেই নেয়।কিন্তু কি বলবে ও! ওর যে কিছুই বলার নেই।লাস্ট সেমিস্টারটা অবধি মনের মত হয়নি।
ও জানে ও ভুল করছে।এই হতাশা,এই উদাসীনতা ওকে মানায় না।ও যেরকম ছেলে তার জীবন দর্শন আরো অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল।এই ভালোবাসা বা তার জন্যে অনুরাগ এসবের জন্যে ওর জীবন না।ছোট থেকে বাবা মা কে দেখেছে ডাক্তারি পেশা হলেও শুধু টাকার জন্য ডাক্তারি পড়েনি দুজনের কেউ।রোগী সুস্থ হলে আনন্দ পেয়েছে, আবার তাদের সুস্থ করতে না পারলে দুঃখটাও চোখে পড়েছে।তাই ও জ্ঞান হওয়া থেকেই অন্য কোনো পেশার কথা দ্বিতীয়বার ভেবেও দেখেনি।
কিন্তু পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ও অনুভব করেছে মানুষের শরীরের সাথে মনের অদ্ভুত যোগ,আর সেই মনে কোনো রোগ বাসা বাঁধলে তার চিকিৎসা করা শুধু কঠিন না,একটা বেশ চ্যালেঞ্জ ও।মানুষের একাদশতম ইন্দ্রিয় সেই মন মানুষের জীবনকে সবসময় নিয়ন্ত্রণ করে।তাই ওর বরাবর লক্ষ্য থেকেছে মনের ডাক্তার হওয়া।
কিন্তু আজ যখন ও নিজে বুঝেছে মন কতটা নিয়ন্ত্রণ করে শরীর বা আশপাশের দুনিয়াকে তখন ওর ইচ্ছা বদলে গেছে।আর সেটা বদলেছে যে মেয়েটার জন্যে সেই ওর জীবন এই মুহূর্তে।
ওই দুদিকে বেনি করা মেয়েটাই তো বছর ছয়েক আগে এসে বদলে দিয়েছে ওর জীবন সম্বন্ধে ধারণাটা।
ওর যদি কখনো কোনো দরকার পড়ে,সেই কারণে আজ রণ অঙ্কলজিস্ট হতে চায়।
“বলবি না রণ আমায়?আজও আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারিনি বল?” অভিমান ফোটে শীর্ষার স্বরে।

“কিছু বলার নেই রে শীর্ষা।আসলে আমি নিজেকে হঠাৎ করে হারিয়ে ফেলেছি।নিজের ভালোলাগা,ভালোবাসা,শখ কিছুই আর মনে নেই।তাই…তাই অনেক দিন পর যখন সেগুলোর দরকার পড়ছে কিছুই যেন খুঁজে পাচ্ছিনা।অন্য একজনের জন্যে পড়ার বাইরে সবটা সময় দিতে দিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, বেরোতে পারছিনা সেখান থেকে।” রণর কথা শীর্ষা পুরো না বুঝলেও কিছু কিছু বুঝতে পারে সহজেই।
তাও খোলাখুলি উত্তর পেতে মজার ছলে বলে,”জানিসই তো আমি লিটেরেচার-এ পুরো মাথা মোটা।তাই এত কঠিন কথা পুরোটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল বস।বলবি না ঠিক আছে,কিন্তু এভাবে মাথায় চাপ দিসনা।”

একটা উদাসীনতার হাসি গোটা রণর ঠোঁটে।
“লিটারেচার ই হারিয়ে দিয়ে গেল রে।গো হারান হারিয়ে দিলো।সাহিত্যের ছাত্রী সাহিত্যের মাস্টারকেই বুঝলো,ডাক্তারের মন থেকে গেল আড়ালে।কিন্তু ওই যে অভ্যেস।ওটা যে মানে না।তাই…কদিন আর সময় দে।সবটা আগের মত হয়ে যাবে দেখিস।আমি অনেকটা সামলে নিয়েছি,আরো নেব।পালাবো না যেকোনো ভাবেই।”

শীর্ষা কি বলবে বুঝতে পারে না।ও ভেবেছিল হয়তো রাইমা কে বলতে পারছে না তাই কষ্ট পাচ্ছে রণ,অথবা কোন সমস্যা হয়েছে ওদের মধ্যে।কিন্তু চালাক শীর্ষার এই মুহূর্তে রণর ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হলোনা।
সেদিন রণকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ও চেয়েছিল রণ আবার ফিরে আসুক,কিন্তু যাকে ভালোবাসে সে ওর মতোই কষ্ট পাক এটা কখনোই ও চায়নি।জোর করে পাওয়াতে কোনো আনন্দ,কোনই প্রাপ্তি নেই ও জানে। রণ রাইকে ভুলতে পারবে না এটা ওর অভিজ্ঞতায় বুঝেছে,যেমন ও নিজেও পারবে না রণ কে ভুলতে।
এধরণের ঘটনায় দায় আসলে কারোর থাকেনা, সবই ভবিতব্য।কিন্তু জীবনটা উল্টে পাল্টে যায়।অনেকে এই কষ্টটা নিতেও পারেনা।সময় মলমের কাজ করলেও সেই মুহূর্তটা এটাকে সামলানো অসহনীয় হয়ে যায়।
শীর্ষা সেই রাতে কেন পরের দুরাতও ভালো ঘুমোতে পারেনি।ওর বাবা মেয়ের চোখ মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করে তিন নম্বর রাতে হালকা ঘুমের ওষুধ দেন।
শীর্ষা পরিণতমনস্ক একটা মেয়ে,আজ দুমাসে ও কিছুটা সামলে উঠেছে নিজেকে।ও জানে রণ ওর থেকেও বেশি বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন,তাই ও নিজেকে সামলে উঠবে খুব তাড়াতাড়ি।কিন্তু একটা ক্ষত সারাজীবন রয়ে যাবে ওর মনে।
রণ আজ দুমাসে বার তিনেক বাড়ি গেছে,আগে প্রতি সপ্তাহে বাড়ি না গেলে ওর মনের মধ্যে ঝড় চলতো। ওই দুদিনে একবার রাইকে দেখার ঠিক কোনো না কোনো ব্যবস্থা ও করেই নিত।আর এখন প্রতি মুহূর্তে পালাতে চায় রাইয়ের থেকে।
রাই উইকেন্ডে ঠিক একবার জয়ির সাথে দেখা করতে আসেই।তাই রণ বাড়ি ফেরেনা আজকাল।
রাই ফোন করলেও ধরেনা, ব্যস্ততার মেসেজ পাঠিয়ে ফোন ধরে অপেক্ষা করে যদি কোনো রিপ্লাই আসে।
রাই কে বছর তিন আগে একটা ফেসবুক প্রোফাইল রণই খুলে দিয়েছিল।এখন রোজ রাতে ওই প্রোফাইলে গিয়ে ওর আর রাইয়ের পুরোনো ছবি গুলো দেখে।ছবিগুলোর পেছনের ঘটনা গুলো মনে করে কখনো হাসে,কখনো মন খারাপ করে।
রণ জানেনা রাইমার বিয়ে ও কিকরে অ্যাটেন্ড করবে!কিকরে হাসি মুখে ওকে অন্যের হয়ে যেতে দেখবে! কিন্তু ও এটুকু জানে ওর প্রথম ভালোবাসার যখনই ওকে প্রয়োজন পড়বে ও ছুটে যাবে তাকে আগলাতে।
ও দেখেনি অনিকেত স্যার কে,কিন্তু রাইয়ের পছন্দের ওপর পুরো বিশ্বাস আছে ওর। ও চায় ওর ভালোবাসা আনন্দে থাকুক।ভালোবেসে ভালোবাসা ফেরত না পাওয়ার যে যন্ত্রনা ও পাচ্ছে,ওর প্রিয় মানুষটা যেন সেটা না পায়।এমনকি ওর অনুভূতি জানলে অনিকেত গাঙ্গুলী কে আপন করতে কষ্ট হবে তাই ও নিজের অনুভূতিটুকুও গোপনে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে দিনরাত।যাতে কখনো ধরা না পড়ে কারোর কাছে।
হঠাৎ টেবিলে ওর রাখা হাতের উপর শীর্ষা নিজের হাত দিয়ে চাপ দেয়।নিজের মনের এলোমেলো চিন্তা ছেড়ে রণ চোখ রাখে শীর্ষার চোখে।
“রণ আমি জানিনা আমার মত একই কষ্ট তুই পাচ্ছিস কিনা।শুধু এটুকু বলবো সময় দে, সময়ের চেয়ে ভালো মলম আর কিছু হয়না।” শীর্ষা স্পষ্ট বক্তা আর সেটাই ও আবার প্রমান করে।

মৃদু হাসে রণ,”তোকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কারণ আমি রাইকে ভালোবাসি বলে শুধু না,তোর প্রতি ফিলিংস টা শুধুই বন্ধুত্বের ছিল।অন্য কোনোভাবে কোনোদিনও তোকে ভাবিনি,ট্রু লি স্পিকিং,কোনোদিন ভাবতেও পারবোনা।রাইকে ভালোবাসি তুই গেস করেছিলি, সত্যি বলে তোর কথাটা এড়িয়ে যায়নি।হ্যাঁ খুব ভালোবাসি আমি রাইকে,সারাজীবন বাসবো। রাই জানবেও না।এমনকি কেউ যদি জানিয়েও দেয়,আমি ওর সামনে সত্যিটা ইগনোর করবো।আমার এই কষ্ট সারাজীবনের, সেখানে কোনো মলম লাগবে না।শুধু রাই অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা মানতে একটু সময় লাগবে।তোকে আমি বলেছিলাম আমার থেকে বেটার কাউকে তুই ডিসার্ভ করিস,শুধু সেই কথাটা ফিরিয়ে নিলাম।আমি যেমন মুভ অন করতে পারবো না,তেমন তুই করবি কিনা সেটা সম্পূর্ণ তোর ডিসিশন।কিন্তু আমায় আর কোনোদিনও সেটা মনে করাবি না।তোকে খুব ভালো বন্ধু ভাবি,আর আমি সেই সম্পর্কটাই কন্টিনিউ করবো।আর রাইকে সারাজীবন মনের মধ্যেই রেখে দেব,সেই জায়গাটা কাউকে দেব না।” ওর কথার মধ্যে এই দৃঢ়তা শীর্ষা কে স্তব্ধ করে দেয়।হঠাৎ ওর চরিত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে ওর রাইকে ভীষণ হিংসা হয়।
পরমুহূর্তে ও বুঝতে পারে রণ হয়তো ভুল না।রণ যেমন রাইকে ভালোবেসে ওকে পাবেনা সত্যি, তেমন শীর্ষা ও পাবে না রণ কে।
শারীরিক ভাবে পাওয়াটাই তো সব না,আসল পাওয়া মন।সেটা কিকরে রণ ওকে দেবে!
শীর্ষা নিজের হাতটা রণর হাত থেকে সরিয়ে নেয়।কিন্তু কথাগুলো বলেই ফেলে,” রণ জানিনা আমার চাওয়াতেই তোর সম্পর্কটা গড়ে উঠলো না কিনা?কিন্তু আমি বন্ধু হয়ে সারাজীবন তোর পাশে থাকবো। হয়তো তোর মত এভাবে ভালোবেসে থেকে যেতে পারবো না,মেন্টালি উইক,মুভ করেই যাবো।কিন্তু তোর বন্ধু শীর্ষা সব ব্যাপারে তোর পাশে থাকবে।” মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে শীর্ষার।

রণর মুখেও ছড়িয়ে যায় সেই হাসি।
“আইম সো লাকি,তোর মত বন্ধু যার আছে। তুই সবটা জানিস বলেই তোকে অনেক কিছু বলতে পারি।বাকি সব জায়গায় চুপচাপ শুনে যাই।সত্যি বলছি বন্ধু শীর্ষাকে আমি কখনো হারাতে চাইনা”,ও নিজে এবার হাতটা বাড়িয়ে দেয় শীর্ষার দিকে।
শীর্ষা দুহাত দিয়ে ধরে রণর হাতটা।দুজনের হাসি হয়তো ভবিষ্যতের অনেক জটিলতার সমাধান করে দেয় স্পষ্ট কিছু কথার মধ্যে দিয়ে।

অনেকদিন পর আজ জয়ি আর ঋষি দুজনেরই একসাথে অফ।উইকেন্ডে একসাথে অফ আজকাল আর প্রায় হয়েই ওঠে না।বিশেষ করে করোনার পর থেকে।
আজ রণও ফিরেছে।ছেলেটা আজকাল পড়ার চাপের দোহাই দিয়ে বাড়ি ফেরেনা বিশেষ।জয়ি কিছুদিন আগে দুঃখ করছিল,তাই এই সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরেছে ও।
আজ অনেকদিন পর জয়ি নিজেই হাত লাগিয়েছিল রান্নায়।রমারও বয়স হচ্ছে,আজকাল সেভাবে সবটা করে উঠতে পারেনা।আজ দুজনে মিলে বাঙালি রান্না করেছিল গুছিয়ে।
জয়ি,ঋষি বা রণ আজকাল এতই ব্যস্ত থাকে কোনো উপলক্ষ্যেই আর বাড়িতে গুছিয়ে খাওয়া দাওয়া হয়না।আজ তাই উপলক্ষ্য ছাড়াই রান্না খাওয়ায় মেতেছিল ওরা।
ঋষির কথা রাখতে জয়ন্ত আর রাইয়ের ও পাত পড়েছিল ওদের বাড়িতে।
খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে ডাইনিং স্পেসে জমিয়ে আড্ডা হচ্ছিল।
রণ এই কমাসে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে,স্বাভাবিক করতে পেরেছে নিজেকে সবার সামনে।হয়তো বাড়ি থেকে দূরে থেকে নিজেকে গুছোতে সুবিধেই হয়েছে।
সামনে পুজো সেই নিয়ে চলছিল আলাপ আলোচনা।

“ঋষি তোদের দেশের বাড়ির পাশে বারোয়ারি তলায় যে পুজো হত এখনো হয়?” জয়ন্তর মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগে ও ঋষির জোরাজুরিতে সেই পুজোটা কাটিয়েছিলো ওর সাথে ওর দেশের বাড়িতে।
ওখানকার মানুষগুলোর ভালোবাসা আজও ওর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।
“হ্যাঁ রে আজও একই ভাবে হয়।আমি তো নিজেই যায়নি কতবছর।ওই চাঁদা টুকু পাঠিয়ে দি।এখন আর পুরোনো লোকজন নেই,কিন্তু জানিস এখনকার জেনারেশন একই ভাবে পুজো করে। ওই অত্যধিক হৈচৈ করে সাবেকিয়ানা হারিয়ে ফেলেনি।আমি খবর তো রাখি।আর আগের বার রমা গেছিল,ও এসেও বলছিল।” চোখ চকচক করে ঋষির।

এবার মুখ খোলে জয়ি,”কতবার বলেছি চলো যাই।কিন্তু বাপ-ছেলে কলকাতার পুজো ছেড়ে নড়বে না।ঠাকুর দেখতেও বেরোয়না।খালি খাবে-দাবে আর আড্ডা মারবে।রাই এসেও তো দেখে গেছে।” জয়ি রাইয়ের দিকে তাকায়,কিন্তু একটু অবাক হয়ে যায়।কিরকম যেন বদলে গেছে মেয়েটা,সারাদিন আজকাল ফোনের দিকে নজর।একটু অস্বস্তি হয় ওর,কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনা।

“চ তাহলে এবছর।সবাই মিলে যাই।” ঋষি উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
“এবছর?” জয়ির গলা একটু নিষ্প্রভ শোনায়।
“হ্যাঁ, কিসের অসুবিধা এবছর?কিরে জয়,রণ তোরা কি বলিস?”ঋষির উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
এতক্ষন চুপচাপ রণ বসে সবার কথা শুনছিলো।রাই যে সবার মাঝে থেকেও ফোন দিয়ে শুধু একজনের সাথেই জুড়ে আছে রণ বুঝতে পারছিল।কিন্তু দীর্ঘ অভ্যাসে চেষ্টা করছিল নিজের মনে চাপ না নিতে। চেনা রাইকে বড্ড অচেনা লাগলেও সেটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল ও।
এত বছর পর একদম নিজের কাউকে পেয়েছে ও,এটা কি স্বাভাবিক না তার সাথে জুড়ে থাকতে চাইবে!সবচেয়ে বড় কথা নিশ্চই হ্যাপি আছে।নাহলে যে রাইয়ের ফোনের হুঁশ থাকতো না,রণর চাপে পড়ে ওর দেওয়া ফোন নিয়েছিল আজ তার কাছে ফোনটাই ইম্পরট্যান্ট হয়ে যেতে পারে!
রণ তাই চেষ্টা করছিল মনটা রাইয়ের থেকে সরিয়ে রাখতে।
তাও ঋষির কথায় নিজের মনের রাজ্যে ডুবে থাকা রণ একটু চমকে তাকায় বাবার দিকে।
ঋষি বুঝতে পারে রণ অন্যমনস্ক ছিল,কারণটাও একদম যে বোঝে না তা নয়।কিন্তু বাকিদের বুঝতে না দিয়ে আবার রিপিট করে,”আরে যাবি নাকি এবছর আমার দেশের বাড়ির পুজোয়?”
“হমম।যাওয়াই যায়।প্রতিবার তো সেই একই নিয়মে পুজো কাটে,এবার নাহয় একটু আলাদা হবে।তাছাড়া জন্ম থেকে কোনোদিন বাবার জন্মস্থান দেখিনি,সেটাও দেখা হবে।” রণ মুখে হাসি টেনে বলে,যদিও জয়ি ছেলের হাসিতে সেই জৌলুস দেখতে পায়না।ঋষি যে কেন ওকে ওতো জোর দিয়ে বারণ করলো রণকে কিছু না জিজ্ঞেস করতে!

“আরে তোর মনে নেই ছোট বেলায় অনেকবার গেছিস তুই,এমনকি পুজোতেও গেছি আমরা।তবে তোর জ্ঞান হয়ে থেকে আর যাওয়া হয়নি,এটা ঠিক।” জয়িই কথা বলে।

“তাহলে ব্যাস প্রোগ্রাম ফাইনাল।পুজোয় তাহলে এবার দেশের বাড়ি?এখন তো আর ভাড়াটে নেই,কেয়ারটেকার সোমেনকে খবর দিলেই ও সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখে দেবে।কি রে রাই, তুই তো কিছু বলছিস না? যাবি তো আমার জন্মভিটে দেখতে?” ঋষি এমনি হৈহৈ করা মানুষ, এধরণের কথাবার্তায় আরো উৎসাহী হয়ে পড়ে।

এতক্ষন পর ঋষির কথায় মুখ তোলে রাইমা।এতক্ষন সবার সাথে বসে থাকলেও এদের আলোচনায় কান বা মন কিছুই ছিলোনা।হঠাৎ ঋষির গলায় নিজের নাম শুনে বোঝার চেষ্টা করলো কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।ওকে চুপ থাকতে দেখে জয়ন্ত বললো,” পুজোয় ঋষি আঙ্কেলের দেশের বাড়ি বলাগড়ে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে।তাই ঋষি জিজ্ঞেস করছে তোর কোনো অসুবিধা নেই তো?তুই তো গ্রাম ভালোবাসিস।তোর খুব ভালোই লাগবে।”

“কিন্তু বাবা আমার পুজোর প্ল্যান তো হয়ে গেছে।এখন কিকরে না বলবো? আমি তো এই প্ল্যানের ব্যাপারে জানতাম না।তাই…”,রাইকে বিব্রত লাগলেও ওর কথায় দৃঢ়তা প্রকাশ পায়,যা কারোর কান এড়ায় না।

“সেকি রে,এতক্ষন আলোচনা হচ্ছে তুই কিছু বলিসনি তো?” জয়ী স্বভাবতই অবাক হয়।আসলে এতদিন কোথাও কখনো রাই কে না বলতে শোনেনি,তাই ওর তরফ থেকে সমস্যা আসবে কেউ ভাবেওনি এতক্ষন।

“আমি আসলে খেয়াল করিনি আন্টি।একটু হোয়াটস অ্যাপে কথা বলছিলাম,তাই…”,রাই কার সাথে কথা বলছিল এড়িয়ে গেলেও রণর বুঝতে অসুবিধা হয়না,আর ও খেয়াল করে জয়ন্তর চোখেও স্বল্প বিরক্তি।

“দেখনা যদি বন্ধুদের ম্যানেজ করা যায়।এ সুযোগ বারবার আসবে না।আর তুই কবে বলতে কবে অন্যের বাড়ি চলে যাবি তখন আমরা গেলেও হয়তো তুই যাওয়ার পারমিশন পাবিনা।” জয়ন্ত তীর টা ছুঁড়েই দেয়,আর তার সাথে চোখটা রাখে রণর দিকে।
রণর একই মুহূর্তে জয়ন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে জয় আঙ্কেল ওকে জরিপ করছে।রাইয়ের লজ্জা আরক্ত মুখের ওপর চোখ সরানো হয়না রণজয়ের। তার আগেই জয়ন্তর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ও ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পারে।
জয়ন্ত বুঝে যায় ওর অনুমান ভুল ছিলোনা।শেষ কমাস রাইয়ের অত্যধিক ফোন প্রীতি,রাত জেগে কারোর সাথে ফিসফিস করা যে আসলে জীবনের করা কোনো ভুল প্রথমে বুঝতে পারেনি জয়ন্ত।ভেবেছিল ফোনের অন্যদিকে থাকা ছেলেটা হয়তো রণ,হয়তো ও বলতে পেরেছে ওর মনের কথা ওর মায়ের মত করে।কিন্তু ভুল ভাঙল সেদিন যেদিন একজন কলিগ বললো রাইমা কে দেখেছে একজন টল, ডার্ক,হ্যান্ডসম কিন্তু বয়সে বেশ অনেকটা বড় এক ছেলের সাথে।
অবাক জয়ন্ত মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি কিছু,কারণ রাইয়ের মনের সবচেয়ে কাছে যে থাকে এতদিন সেই ছিল ভরসা।
জয়ন্ত সে রাতে একটা অজুহাত বানিয়ে ফোন করেছিল রণজয় কে।বুঝতে পেরেছিল ছেলেটার জীবনে কোথাও সুর কেটেছে।অপেক্ষা হয়তো অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে ওকে।কিন্তু ওকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি,কিই বা জিজ্ঞেস করতো!
আজ সেই উদ্বেগের অবসান হলো।রাই হিরে চিনতে পারেনি সেই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না জয়ের।

মুখ নামিয়ে নিলো রণ।কি দেখছিল জয়ন্ত আঙ্কেল ওর দিকে!!!

“ঠিক আছে আমি দেখছি কিকরে ম্যানেজ করা যায়!।আমারও খুব ইচ্ছে ঋষি আঙ্কেলের দেশের বাড়ি দেখার।এখানে থাকার সময় অনেক গল্প শুনেছি।আচ্ছা পুজোর প্রথম দুটো দিন এখানে কাটিয়ে সপ্তমী বা অষ্টমীতেও তো যেতে পারি আমরা?” রাই যে পুরোপুরি বদলায়নি ওর এই সমঝোতা আবার প্রমান দেয়।আসলে ওর অনিকেতের সাথে ষষ্ঠী তে প্ল্যান বেরোনোর।তাই ও সেই মত চিন্তা করে কথাটা বলে।

“কেন হবেনা? একদম ঠিক বলছিস তুই।তাহলে কলকাতার পুজো প্যান্ডেল গুলোও ফাঁকায় ফাঁকায় দেখে নেওয়া যাবে।তুই শুধু আমায় দুদিনে একটু কনফার্ম কর,তারপর আমি সোমেনের সাথে কথা বলবো”, ঋষি খুশি হয়ে যায় রাইয়ের কথায়,আরে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’।

রাই খুশি হয়ে ফোনটা এবার সরিয়ে রাখে।যোগ দেয় ঘরোয়া আড্ডায়।মেতে ওঠে সবাই পুজোর আলাপ আলোচনায়।
করোনা পরিস্থিতি শেষ ক’বছর কেড়ে নিয়েছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আনন্দকেও।মানুষ ঘরবন্দি থেকেছিলো প্রথম দুটো পুজো।তারপরের পুজোও ছিল শ্রীহীন।এবার মানুষ অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে মহামারীর অস্থিরতা।তাই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা থাকলেও পুজো এবার সেই আগের মত হবে,অনেকগুলো বছর পর।
আড্ডা আলোচনায় ছেদ পরে রণর ফোনের রিংয়ের আওয়াজে।

-“এক্সকিউজ মি”,ফোনটা রিসিভ করে আড্ডা ছেড়ে বেরোতে বেরোতে খোলা গলায় রণ বলে,”হ্যাঁ শীর্ষা বল…”।

থেমে যায় জয়ন্ত।তাহলে কি রণ কে নিয়ে ভুল ভাবছিল ও।কিন্তু ওই চোখের ভাষা!
আসলে আজকের ছেলে মেয়েদের বোঝা খুব কঠিন।যদিও মেয়ের ফোনটা কোনো ব্যাপার না।রণর চোখের ওই ঝিলিক,ফোনটা ধরেই…
একটু গুলিয়ে যায় জয়ন্তর।আজকেই মেয়ের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত পোস্টপন্ড করে ও মনে মনে।
মা মড়া মেয়েটাকেই ভালো বুঝতে পারলো না,পরের বাড়ির ছেলের কি বুঝবে?
একটা স্বপ্ন,তিন মাস ধরে আগলে রাখা স্বপ্ন সরিয়ে রাখে জয় মন থেকে।সময়ের জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে,মনে মনে ভাবে ও।

ক্রমশ…