মাই এক্স পর্ব-০৬

0
213

মাই এক্স (৬ষ্ঠ পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


‘কফি হাউজ’ মানে ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের নির্দিষ্ট একটা কফি হাউজটা। এখানে মাঝে মাঝে আমরা আসতাম। আর সেকারণেই কোন কফি হাউজ, তার ডিটেলস সুমন দেয়নি। সময়টা অফিস ফেরতা জ্যামের। তাই একটু আগেই বেরিয়েছিলাম। ফলে ছ’টার কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম। তেমন ভীড় নেই। ভেতরের গেট আপ তেমন পাল্টায়নি। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফাঁকা দেখে একটা টেবিলে বসলাম।
একজন ওয়েটার এগিয়ে আসলে ওকে জানালাম, ‘ওয়েটিং ফর সামওয়ান’। এবার চারিদিকের টেবিল গুলোর দিকে তাকালাম। খুব বেশি ভীড় নেই। যে ক’জন আছে বেশিরভাগই যুগল। নিজের অজান্তে পুরুষগুলোর দিকে এক নজর বুলিয়ে নিলাম। ওদের মধ্যে সুমন নেই। আসবার আগে একটা ফোন করে আসলে কি ভাল করতাম? সুমন কি সত্যিই আসবে? আমার ধারণা আসবে। দরজার দিকে পিঠ করে বসেছিলাম, উঠে গিয়ে উল্টোদিকের চেয়ারে বসলাম। যেন দরজা দিয়ে ঢুকলে দেখতে পাই।
নাহ, লুকিয়ে আসিনি। শাহেদকে সবকিছু জানিয়েই এসেছি। যখন শাহেদ জানাল ও দুপুরে আসছে, তখন লাঞ্চ একসাথে করার জন্য অপেক্ষা করলাম। এরপরের ঘটনা গতানুগতিক স্টাইলেই ঘটল। বাসায় এসে শাওয়ার সেরে বেশ স্বাভাবিকভাবেই ও খেতে বসল। আমিও তেমন কিছু জানতে চাইলাম না।
খাওয়া শেষে ও বেডরুমে ফিরে গেল। আমি দ্রুত হাতে টেবিল গুটিয়ে ফেললাম। সময় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। যদি যেতেই হয়, ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই বেরোতে হবে। কাজ সেরে বেডরুমে ফিরে এলাম।
শাহেদ ভাতঘুম দেয়ার মুডে আছে। বিছানায় বসে মোবাইলটা চেক করছে। এখনই শরীরটা এলাবে।
ঘরে ঢুকতেই আমার দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে রোমান্স। মনে হচ্ছে নটি হতে চাইবে। বাট এখন সম্ভব না। তাই দ্রুত জানতে চাইলাম,
— এবার?
শাহেদ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। সম্ভবতঃ আমার প্রশ্নে নটি হওয়ার কোন ইঙ্গিত আছে কি না বোঝার চেষ্টা করল। আমার চেহারায় তখন অন্য কিছু ছিল। চেহারার অস্থিরতাটা বুঝতে পারল কি না জানি না, তবে উত্তরে বুঝিয়ে দিল, ‘আমি যে রোমান্টিক মুডে নেই, সেটা ও বুঝে গেছে’। বলল
— একটা মজাদার ঘুম দেব।
বেডরুমের বিছানার পাশেই একটা স্টাডি টেবিল আছে। ল্যাপটপে কোন কাজ থাকলে ওটায় বসে শাহেদ কাজ করে। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে স্টাডি টেবিলের চেয়ারটায় বসলাম। এরপরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম শাহেদের দিকে। আমার এভাবে বসা দেখে শাহেদ খানিকটা অবাক হল। বিছানায় গা এলাতে গিয়েও, এলালো না। কি মনে করে জানতে চাইল
— কিছু বলবে?
মাথা ওপর নীচে করে ব্যাপারটায় সম্মতি দিলাম। বললাম
— আমার কিছু বলার আছে।
শাহেদ আমার দিকে তাকাল। শুরুতে হয়তো ভেবেছিল শপিং টপিংয়ের জন্য বড় অ্যামাউন্ট চাওয়া জাতীয় কোন আবদার করব। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়েই বুঝে যায়, দ্যাট ইজ নট দ্যা কেস। ইট’স সামথিং সিরিয়াস। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল। কিছুক্ষণ ভাবল। এরপরে বলল
— আমারও।
হেসে ফেললাম। বললাম
— দেন? টস? ওর লেডিস ফার্স্ট?
শাহেদও স্মিত একটা হাসি উপহার দিল। হাসিটা কেমন একটু ফ্যাকাশে। বলল
— তুমিই শুরু কর।
অনেকটাই গুছিয়ে রেখেছিলাম। তাই আর তর্ক না করে সুযোগটা নিলাম। কথাগুলো বলতে শুরু করলাম।
— আমার কিছু কনফেস করার আছে।
কথাগুলো মাথা নীচু করে বলা শুরু করলেও ঠিক এই মুহূর্তের রিয়াকশানটা জানতে ইচ্ছে করছিল। তাই শাহেদের দিকে তাকালাম। তেমন কোণ রিয়াকশান নেই। মনোযোগ দিয়ে ও শুনছে। বলে চললাম
— স্টুডেন্ট লাইফে, আই হ্যাড অ্যান অ্যাফেয়ার।
কথাটা বলে থেমে থাকলাম। আর কিছু বলব? না ওর প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করব? আমার চুপ থাকা দেখে শাহেদ জানতে চাইল
— শেষ?
মাথা দুদিকে নেড়ে না সুচক উত্তর দিলাম। এরপরে শাহেদের দিকে তাকালাম।
— বিয়ের আগে যখন তুমি জানতে চেয়েছিলে, আমি তোমাকে তখন মিথ্যে বলেছিলাম, আমার জীবনে কেউ নেই। সরি ফর দ্যাট। আই স্যুড হ্যাভ টোল্ড ইউ দ্যা ট্রুথ।
কথাগুলো বলার সময় চোখ নামিয়ে ফেলেছিলাম। বোধহয় লজ্জায়। কিংবা কিছুটা অপরাধবোধে। যাইহোক, কথাগুলো বলতে পেরে কেমন রিলিভড লাগল। আবার চোখ তুলে শাহেদের দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুনছে। আমি বলে চললাম
— আসলে সেদিন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা হয়তো ভয়ও পেয়েছিলাম, সব জানলে তুমি হয়তো…
কথাগুলো শেষ না করেই মাথা নীচু করে চুপ করে থাকলাম। আসলে ওর রেসপন্সের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। ওর রেস্পন্সের ওপরই নির্ভর করছে, বাকীটা কিভাবে বলব। ও কিছু বলছে না দেখে চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম শাহেদ এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা গম্ভীর।
মনে হল ব্যাপারটাকে ও সহজভাবে নেয়নি। এটা এক্সপেক্ট করিনি। কি বলব, কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অসহায়ের মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখে হয়তো স্পস্ট লেখা ছিল, ‘কিছু একটা বল’। কথাটা শাহেদ বুঝল। এরপরে বলতে শুরু করল
— আমার ধারণা, দ্যাট ইজ নট দ্যা স্টোরি। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, ইউ আর ইন ট্রাবল। সম্ভবতঃ ছেলেটা তোমাকে কোন সমস্যায় ফেলেছে। অ্যাম আই রাইট?
এক মুহুর্তের জন্য মনে হল, আমি তলিয়ে যাচ্ছি। বিয়ের সময় কথাগুলো জানালে, ব্যাপারটায় যতটা সততা থাকত, আজ কথাগুলোতে আর যাই থাকুক, সততা নেই। আছে অসহায়ত্ব। কথাটায় সরাসরি কিছু না বললেও ও স্পস্ট বুঝিয়ে দিল, সমস্যায় না পড়লে, এই কথাগুলো আমি কখনই ওকে জানাতাম না। সম্পর্কের ভেতরের মিথ্যেটা আমার সারাজীবন লুকিয়ে রাখতাম। বুঝতে বাকী থাকল না, আমার সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাত দুটো কোলের ওপর ছিল। সেখানে হঠাৎ পানির ফোঁটা পড়ল। বুঝতে পারলাম, আমি কাঁদছি। চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। মনে হচ্ছে, সরি বলার অধিকারও আমার নেই। এমন সময় কাঁধে একটা আস্থার হাত টের পেলাম। অনুভব করলাম একটা হাত আমার চোখ মুছিয়ে দিল। এরপরে আমার হাতের ওপর ওর হাত দুটো রাখল। বলল
— পাস্ট নিয়ে পরে আলাপ করলেও চলবে।
কথাটা বলে আমার মুখটা উঁচু করে ধরল। এরপরে বলল
— তুমি যত বড় সমস্যায় থাকো না কেন, আমি তোমার পাশে আছি। নো ম্যাটার হাও গ্রেভ দ্যা প্রব্লেম ইজ, আই উইল নট লিভ ইউ অ্যালোন। ওকে?
কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল। অবাক হয়ে শাহেদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এমন সময় শাহেদ আবার বলল
— অ্যান্ড দ্যা সেকেন্ড থিং ইজ, প্রব্লেমটা বোঝানোর জন্য যদি অতীত সম্পর্কে বলা প্রয়োজন হয়, তাহলে বলতে পার, আদারওয়াইজ ওসব বলা জরুরী না। বিয়ের সময়েই তোমার সম্পর্কে ভালমত খোঁজখবর করেছিলাম। সুমন সম্পর্কে কিছুটা জানি। সো, ইফ ইউ উইশ, ইউ ক্যান কাট দ্যা স্টোরি শর্ট।
শাহেদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। সাহস ফিরে পেলাম। বললাম
— সুমন ফিরে এসেছে।
কথাটা শান্তভাবে শুনল। এরপরে বলল
— তো?
শাহেদের দিকে তাকিয়েছিলাম। চোখ নামিয়ে ফেললাম। বলতে শুরু করলাম
— দেখা করতে বলেছে, আজকে বিকেলে।
কথাটা শান্ত ভাবে শুনল। মাথা আবার নিচু করে ফেলেছিলাম। টের পেলাম একটা হাত আবার আমার মুখটা তুলে ধরল, বলল
— আই থিংক, দ্যাট ইজ নট দ্যা প্রব্লেম। কোন থ্রেট দিয়েছে? দেখা না করলে কিছু করবে, এমন বলেছে?
শাহেদের চোখে একরাশ আশ্বাস ছিল। নিজের অজান্তেই গড়্গড় করে সব বলতে লাগলাম
— শেলির বিয়েতে ও এসেছিল। শেলির হাজব্যান্ডের ফ্রেন্ড। বিয়েতে আমাকে দেখতে পায়। এরপরে আমাকে ম্যাসেজ করে জানায়, যেন আজকে আমি বিকেলে ওর সাথে দেখা করি। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না, এমন সময় আজকে ও একটা মোবাইল ফোন পাঠায়। কুরিয়ারে।
কথাগুলো একটানা বলে থামলাম। এরপরে কিছুটা সময় চুপ থাকলাম। গুছিয়ে নিচ্ছি। হয়তো অপেক্ষা করছি, ‘এরপরে’ শোনার জন্য। শাহেদ বলল না। ওর দিকে তাকালাম। শান্তভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আবার বলতে শুরু করলাম
— মোবাইলের সাথে একটা চিঠিও ছিল, সেটায় লেখা ছিল, মেমোরি কার্ড চেক কর। চেক করলাম।
এবার শাহেদ রিয়াক্ট করল। কিছুটা ভীতু স্বরে জানতে চাইল
— কি ছিল?
এবার অসহায়ের মত শাহেদের দিকে তাকালাম। বললাম
— তোমার টার্মিনেশান লেটার।
কথাটা শুনে শাহেদ এবার যারপর নাই চমকে উঠল। ঝট করে উঠে দাঁড়াল। অস্থিরতা স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণ যতটা স্থির ছিল, এই এক কথাতে সব এলোমেলো হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পায়চারী করল। একসময় থামল। এগিয়ে এসে বিছানায় বসল। আমার হাতের ওপর হাত রাখল। আমার চোখে চোখ রেখে বলল
— ইয়েস। আই হ্যাভ বিন স্যাকড। কারণ হিসেবে শুধু জানান হল, ওপর মহল থেকে নির্দেশ এসেছে। এমডির কথাবার্তায় বুঝে গিয়েছিলাম, বড় কোন সুপারিশ আছে। ভেবেছিলাম, সিনিওর ম্যানেজার পোষ্টে পরিচিত কাউকে ঢোকাতে হবে, তাই আমাকে সরানো হল। এখন ক্লিয়ার হল ব্যাপারটা।
ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম
— এখন?
শাহেদ স্মিত হাসি দিল। এরপরে বলল
— ভয় পেয়েছো?
শাহেদের দিকে তাকালাম। ওর দৃষ্টিতে একরাশ সাহস। কিছুটা জেদও। বুঝলাম, ও লড়বে। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বললাম
— পেয়েছিলাম। তবে এখন আর পাচ্ছি না।
— দেন?
— দেন… সুমনের সাথে আজ বিকেলে দেখা করতে যেতে চাই।
শাহেদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আমি বলে উঠলাম
— একা।
আমার কন্ঠে কিছু একটা ছিল। শাহেদ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বাধা দিল না, শুধু ছোট্ট করে বলল
— সিওর?
বেশ শান্তভাবেই উত্তর দিলাম
— মোর দ্যান সিওর।

চলবে