মাই এক্স পর্ব-০৭

0
187

মাই এক্স (৭ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


বাসায় যখন পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় আটটা। শাহেদই দরজা খুলল। আমার চেহারা দেখেই বুঝল, ভয়ংকর কিছু হয়েছে। মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে ছিল। দরজা খুলেই ও আমার দিকে এগিয়ে এল। ধরে ধরে আমাকে লিভিং রুমের সোফায় বসাল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। বোঝার চেষ্টা করল, এখনই সবকিছু জানতে চাইবে কি না। এরপরে কি মনে করে লিভিং রুম লাগোয়া ডাইনিং রুমে গেল। এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে এল।
এতোটা অফ ব্যালেন্স যে হব, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এর একটা কারণ বোধহয়, সুমনের পুরনো স্মৃতি। ও সবসময় পুরো ক্যালকুলেশান করে মাঠে নামে। আর যাকে শেষ করতে চায়, তাকে শেষ করে ছাড়ে। প্রথম দিকে কিছু গেস করেছিলাম, ‘আমাকে কিভাবে শেষ করবে’ সে ব্যাপারে। সহজ যে সম্ভাবনাগুলো মাথায় এসেছিল, তা ছিল, শাহেদের কাছে আমাদের রিলেশানের ডিটেলস জানানো কিংবা অন্তরঙ্গ ছবি দেখানো আরও নীচে নামলে সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেয়া। এতোসব কিছুর পরে শাহেদ আমার ওপর ভয়ানক ক্ষিপ্ত হবে। হয়তো ঘৃণাও করবে। এরপরে হয়তো আমাকে ডিভোর্সও করতে পারে।
টার্মিনেশান লেটারের খেলাটা দেখবার পরে বুঝতে পারি, ও রিসার্চ করেই মাঠে নেমেছে। শাহেদ কেমন মানুষ, সেটা ও জানে। পুরনো কাহিনী শুনিয়ে শাহেদের মন বিষাতে যে পারবে না, সেটা ও বুঝে গিয়েছিল। তাই অন্য পথ ধরেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর আল্টিমেট চাওয়া হচ্ছে, আমি যেন ওর পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি। যেন আমি বলি, আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও।
মনে মনে আমি সরি ছিলাম না, এমন না। যদি ওর সাথে খুব সাধারণভাবে সাক্ষাৎ হত, আমি সত্যিই হয়তো ওকে সরি বলতাম। কিন্তু এভাবে আমাকে বাধ্য করার চেষ্টা, কেন যেন মনটা বিষিয়ে দিল। একটা জেদ তৈরি হল। ‘ওর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা আমি করব না’। আমার যত ক্ষতিই ও করুক, সহ্য করব।
বাট এই মুহূর্তে প্রতিশোধটা ও আমার ওপর নিচ্ছে না। আঘাত হেনেছে শাহেদের ওপর। ওর স্টাইলটাই এমন। আমাকে অসহায় করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ও শাহেদের চাকরী নট করিয়েছে। যদি ভুল না করি, এরপরে হয়তো নতুন চাকরী পেতে বাধা দেবে। ব্যাবসা করতে চাইলেও, পদে পদে ঝামেলা করবে। প্রাইম মিনিষ্টারের অফিসে আছে, সো ওর একটা ফোন এখন অনেক ক্ষমতা রাখে। ওর যেকোন প্ল্যান, একোন স্টেজে আঁটকে দেয়া ওর জন্য কোন সমস্যাই না।
ব্যাপারটা যখন শাহেদকে বললাম, ও তখন একটাই কথা বলল,
— দেখা করতে তো যাচ্ছই, নিজের কানেই শোন, কি বলতে চায়। শুধু শুধু গেস করছ কেন?
কথাটা মেনে নিতে গিয়েও মেনে নিতে পারলাম না। বললাম
— গেসটা ঠিক করতে চাইছি না, এসে যাচ্ছে। হয়তো প্রিপেয়ার্ড থাকতে চাইছি।
শাহেদও দেখলাম ব্যাপারটা মেনে নিল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল
— যদি সত্যিই তেমন হয়, বাইরে চলে যাব। কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতে ইমিগ্রেশান ট্রাই করব। ওখানে আত্মীয় স্বজন আছে, হেল্প লাগলে উনারা করবে, আই থিংক।
শাহেদের কথাগুলো শুনে কিছুটা আস্বস্ত লাগলেও, পুরোপুরি সাহস পাচ্ছিলাম না। কেন যেন মন বলছিল, সুমন এতো সহজে আমাকে ছাড়বে না। যাওয়ার পথে তাই পুরো রাস্তাটাই দোটানায় কেটেছিল, ক্ষমা চেয়ে নেব? না কি না। মনের এক অংশ বলছে, না। এভাবে জোর করলে, কখনই রাজী হওয়া উচিৎ না। মনের আর এক অংশ বলছে, এই সাইকোপ্যাথের সাথে কোন রকম ডুয়েলে যাওয়া বোকামী ছাড়া আর কিছু হবে না। আত্মসম্মানে লাগবে, বাট, ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত তো হবে। ঝামেলাটা ঘাড় থেকে তো অন্ততঃ নামবে।
মনের কোনে আরও একটা সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলাম। শাহেদকে ডিভোর্স দিয়ে যদি ওকে বিয়ে করতে বলে ? এভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা অবশ্য সুমনের সাথে যায় না। সম্ভাবনা কম। তারপরও হতে পারে। আর তেমন কিছু বললে, সোজাসুজি ‘না’ বলব। এই সম্ভাবনার কথাটা অবশ্য শাহেদকে বলিনি।
এসব চিন্তায় হয়তোবা বেশি মগ্ন ছিলাম, তাই সুমন কখন এসে সামনে দাঁড়িয়েছে, লক্ষ্য করিনি।
— কি ভাবছো?
চমকে উঠে সামনে তাকালাম। সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে সুমন। অ্যাজ ইউজুয়াল, লুকিং গর্জিয়াস। ঠোঁটে স্মিত হাসি। এতোটাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম যে মুখে কোন কথা আসছিল না। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। সেই হতবাক চেহারার দিকে তাকিয়ে আবার জানতে চাইল
— কিছু অর্ডার করেছো?
মন্ত্রমুগ্ধের মত উত্তর দিলাম
— না।
ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল
—আগের মত?
সুমনের এই সাবলীল ভাব দেখে সত্যিই আশ্চর্য্য হয়ে যাচ্ছিলাম। এতো কিছুর পরেও এক ফোঁটাও গ্লানি নেই এই মানুষটার? এমনভাবে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, আমি এখনও হতবাক ভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই নিজেই দুটো কফি বলল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল
— হোয়াট হ্যাপেন্ড?
সুমনের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। ফিল করছি, নিজেকে সামলে নেয়া জরুরী। এভাবে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা… পারছি না। নিজেকে সামলে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বুঝলাম সময় লাগবে। আপাততঃ কিছু একটা উত্তর দেয়া দরকার। কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিলাম
— কিছু না।
কথাটা বলতে পেরে দেখলাম, ভয় অনেকটাই কেটে গেল। এরপরে সুমনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে জানতে চাইলাম
— কেমন আছ?
উত্তরে আমার দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকল সুমন। এরপরে টিপিক্যাল প্রেমিকের মত আবেগঘন কন্ঠে বলল
— সুন্দর লাগছে।
এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। দ্রুত ভাবছি। মুল আলোচনায় আসব, না প্রাথমিক ফর্মালিটি যেভাবে চলছে, সেভাবে আরও কিছুক্ষণ চলতে দেব। দ্বিতীয়টা করব সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা হাসি দিয়ে ব্যাপারটায় সায় দিলাম। বললাম
— তোমাকেও।
এমন সময় কফি এল। ধোঁয়া উঠছে। সুমন এমন গরম কফিই খায়। আমি প্রথমে ফোমটা খাই, এরপরে একটু ঠান্ডা হলে কফি খাই। আমার মগটা কাছে টেনে নিলাম। ফোমটায় চুমুক দিলাম। মন বলছে, মূল আলোচনায় যাওয়ার সময় এখনও হয়নি। তাই স্বাভাবিক আলোচনা চালিয়ে গেলাম। বললাম
— তারপর?
সুমন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। চোখে এখনও হাসি। এরপরে ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দিল। আবার আমার দিকে তাকাল। চোখে এখনও প্রেমিক টাইপ দৃষ্টি। অবাক লাগছে, প্রতিশোধের চাহনি আশা করছিলাম। সেটা নেই। হেসে বলল
— চলে যাচ্ছে। তোমার খবর বল। সেদিন এমন করলে… ইচ্ছে ছিল তোমার হাজব্যান্ডের সাথে পরিচিত হব। সুযোগই পেলাম না। কি করে হাজব্যান্ড?
ইচ্ছে করেই কি টপিকটা আনল? মূল আলোচনায় আসতে চাইছে? ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হচ্ছে আপাতঃ স্বাভাবিক প্রশ্ন হিসেবেই কথাটা বলেছে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তাছাড়া, হঠাৎ করেই যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছ। মনে হল, চোখে চোখ রেখে সাহসের সাথে ব্যাপারটা ফেস করতে পারব। অবশ্য এমনটা করা ছাড়া উপায় নেই। একটু ভয় পেয়েছি কি, ও পেয়ে বসবে। বিজয়ের হাসি হাসবে।
খুব ঠান্ডা গলায় স্পস্টভাবে বললাম
— জাস্ট গট স্যাকড টুডে।
আমার গলার আওয়াজে কিছু একটা ছিল। সুমন কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও দিল না। মগটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। মনে হল, হেজিটেট করছে। কি বলবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আমি নিস্পলক ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ফোম খাওয়া শেষ। এতক্ষণ কফিতে চুমুক দেয়ার জন্য চোখ নামাচ্ছিলাম। এবার কফির দিকে চোখ না নিয়েই প্রথমবারের মত আমি কফিতে মগে চুমুক দিলাম। কফির মগটা নামাতে নামাতে বললাম
— লেটস কাম টু দ্যা পয়েন্ট।
সুমন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ নামিয়ে নিল। কফির মগের দিকে তাকিয়ে নিজের মগে চুমুক দিল। গুছিয়ে নিচ্ছে। ওর প্ল্যান অনুযায়ী সম্ভবতঃ কাহিনী এগোচ্ছে না। এক ভীত সন্ত্রস্ত তৃণাকে আশা করছিল। হয়তো ভেবেছিল কাঁদো কাঁদো চেহারায়, ‘আমাকে প্লিজ ছেড়ে দাও।’ জাতীয় কিছু বলে ওর কাছে অনুনয় বিনয় করব, ক্ষমা চাইব। তেমনটা না দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাক হয়েছে।
কেমন যেন একটা বিজয় অনুভব করতে শুরু করলাম। শাহেদ আমার পাশে আছে। এই অনুভুতিটাই হয়তো একরাশ আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, যত সমস্যাই হোক, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
সুমন কিছুক্ষণ আমার কনফিডেন্ট চেহারা দেখল। হয়তো বুঝতে পারল, ভুল অনুমান করে ফেলেছে। অবিশ্বাস ভরা চোখে দেখছে, সেই উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি পেয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকা নরম সরম মেয়েটিকে। সাহসে টইটুম্বুর এক তৃণাকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবার পরে, শান্তভাবে নিজের কফির মগে দ্বিতীয় চুমুক দিল। মগটা নামিয়ে রেখে বলল
— ওকে। লেটস কাম টু দ্যা পয়েন্ট।
এবার আমি সুমনের চোখে চোখ রাখলাম। ওর চোখে এখন সেই স্মিত হাসি আর নেই। নোংরা প্রতিহিংসা জ্বলজ্বল করছে। একদিক দিয়ে ভালোই হল, ওর হাসি মাখা, ভন্ড চেহারার সাথে ডিল করতে ভাল লাগছিল না। ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, কতটা ক্রোধ ওর ভেতরে কাজ করছে। বুঝতে চেষ্টা করলাম, প্রতিশোধের জন্য কতটা নীচে ও নামতে পারে। মনে হল, হি ইজ ডেসপারেট। হি ক্যান ডু এনিথিং। সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করে ফেললাম। মনের কোণে যে সন্দেহ ছিল, শাহেদকে ছেড়ে ওর কাছে ফিরে যেতে বলবে, সেটা ফিরে এল। মনে হল, এই সাইকোপ্যাথ যেকোন কিছু করতে পারে। যতটা সম্ভব কন্ঠকে স্বাভাবিক করে জানতে চাইলাম
— কি চাও?
এমন সরাসরি কথা বোধহয় ও আশা করেনি। মনে হল এক মুহুর্তের জন্য চমকে উঠল। বুঝে গেল, ব্যাকফুটে খেলার আদৌ কোন ইচ্ছে আমার নেই। ওর প্রতিহিংসার মুখোমুখি হতেই আমি এসেছি। ঘাড় কাত করে ব্যাপারটার খানিকটা প্রশংসা করল মনে হল। কফির মগটা নিজের ঠোঁটের কাছে নিয়ে তৃতীয় চুমুক দেয়ার ঠিক আগে ছোট্ট করে জানতে চাইল
— দেন আই হ্যাভ টু নো, হোয়াট ইজ ইয়োর অফার? স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে কি কি করতে রাজী আছ তুমি?

চলবে