মায়ার বাঁধন- ৩য় পর্ব
©শাহরিয়ার
তখনি আমার মনে হলো কুরআনের একটা আয়াত “ভেঙে পড়ো না, নিরাশ হয়ো না। সাহায্য আসবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা। মনে রেখো নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” ( সূরা বাক্বরাহ: ২১৪ ), মুহুর্তেই আমারর মাঝে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসলো।
জয় ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসতেই হাসি মুখে বললাম চলুন নাস্তা করতে যাবেন। জয় কোন কথা না বলে হাতেও তোয়ালেটা খাটের উপর ছুড়ে মেরে ঘর থেকে বের হলো। আমিও উনার পিছু পিছু বের হলাম।
নাস্তার টেবিলে মা বাবা অপেক্ষা করছে আমি যেয়ে দু’জন কে সালাম জানালাম। তারা উত্তর নিয়ে বসতে বললো। তাদের সাথে বসলাম মা প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো।
মা: মেয়ে না খেয়ে মুখটা কেমন শুকিয়ে ফেলেছে। শোন মা এটা তোমার নিজের বাড়ি, পুরুষের বাড়ি হয় একটা আর মেয়েদের বাড়ি হয় দু’টো। একটা বাবার বাড়ি আর একটা নিজের বাড়ি। তাই মনে রাখবে তুমি বাবার বাড়িতে যেমন আদর যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়েছো। ঠিক তেমনি এখানেও সেই আদর যত্নেরর পুরোটাই তুমি পাবে আর এটা তোমার অধিকার।
বাবা: শোন মা আমাদের একজন ছেলে ছিলো আর এখন একজন মেয়ে এসেছে তোমরা দু’জন আমাদের কাছে সমান।
বাবা মায়ের কথায় মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। মুখে খাবার তুলবো এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিতেই শাকিল বাড়ির ভিতর ঢুকলো। শাকিলকে দেখে খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালাম। সবাইকে সালাম দিয়ে শাকিল টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
আমার ভীষণ রকম ভয় লাগছিলো এতো সকাল সকাল ওকে এ বাড়িতে আসতে দেখে। বাড়িতে বাবা মা ঠিক আছেতো?
মা: আরে শাকিল তুমি আসো আসো নাস্তা করো।
শাকিল: না না খালাম্মা ঠিক আছে, আমি নাস্তা করেই বের হইছি। আসলে আপু ওর মোবাইলটা নিয়ে আসেনি। তাই দিতে আসলাম।
উপমা: বাবা মা তুই আপুরা সবাই ভালো আছিস?
শাকিল: ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে হ্যাঁ ভালো আছি। জয়ের দিকে তাকিয়ে দুলাভাই কেমন আছেন?
জয়: মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে হ্যাঁ ভালো আছি বসো তুমি।
আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে, একদম মনে ছিলো না নিয়ে আসতে, তাইতো তোদের ফোন দিতে পারি নি আসার পর।
জয়: আমাকে বলতে আমি ফোন দিয়ে দিতাম। কথাটা বলতে বলতে নাস্তার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো জয়।
বাবা: কিরে তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস?
জয়: কোথাও না বাবা একটু ছাঁদে যাচ্ছি।
মা: আচ্ছা যা। শাকিলের দিকে তাকিয়ে, বাবা তুমিও নাস্তা করো আমাদের সাথে।
শাকিল: খালাম্মা আমি নাস্তা করে এসেছি আপনারা করুন।
নাস্তা শেষ করে শাকিলকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।
শাকিল: আপু তোর কি মন খারাপ?
উপমা: নাতো তোর এমন মনে হচ্ছে কেন?
শাকিল: না এমনি।
উপমা: আসলে তোদের ছেড়ে কখনো কোথাও কি থাকি নাই, তাই একটু খারাপ লাগছিলো। এখন তুই এসেছিস মন ভালো হয়ে গিয়েছে।
শাকিল: বাবা মা বললো তোকে আর দুলাভাইকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য। বিয়ের পর নাকি এটাই নিয়ম।
উপমা: কিন্তু তোর দুলাভাই যাবে কিনা কে জানে। আসলে বাবা মা তো কিছু বলেনি। আচ্ছা আমি তোর দুলা ভাইয়ের সাথে কথা বলছি, দেখি কি বলে। আর তুই যেয়ে বাবা মায়ের সাথে কথা বল যেয়ে।
শাকিল: আচ্ছা ঠিক আছে।
দু’জন এক সাথে রুম থেকে বের হলাম। শাকিল নিচে চলে গেলো আর আমি ছাঁদের দিকে উঠতে শুরু করলাম।
দারুণ ভাবে ছাঁদটা সাজানো, ছাঁদের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে রয়েছে জয়। হাতে থাকা সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে চলছে। আমি আস্তে আস্তে তার পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। সিগারেটের ধোঁয়া গন্ধ আমার সহ্য হয়না। তাই ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম।
জয়: আমার দিকে তাকিয়ে কি কিছু বলবেন?
উপমা: আপনাকে না বলেছি আমাকে তুমি করে বলবেন। আর হাতের সিগারেটটা ফেলে দিন আমার সহ্য হয়না সিগারেটের ধোঁয়া।
জয়: হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে, আমার ঠিক একই রকম আপনাকে সহ্য হয় না এটা বুঝেন না?
উপমা: আচ্ছা আমার অপরাধটা কি আমি কালো এটাই কি আমার অপরাধ?
জয়: হ্যাঁ এটাই আপনার সব চেয়ে বড় অপরাধ। আপনি কেন বুঝেন না আপনার সাথে আমার যায় না। কোথায় আপনি কালো আনসম্মার্ট এক নিজে থেকে ভাবুনতো আমার সাথে কোথায় আপনাকে মানায়।
উপমা: একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, আপনি হয়তো জানেন না সৃষ্টিকর্তা আপনার জন্য আমাকে আর আমার জন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া আল্লাহ প্রতিটা মানুষকেই নিজ হাতে তৈরি করেছেন এবং তিনি বলেছেন “নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি! “শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে!” [সূরা আত-তীন:-০৪], এখন বলুন আমার অপরাধ কোথায়?
জয়: দেখুন এসব বলে আপনি আমার মনে জায়গা পাবেন না। স্রেফ তিন মাস আপনি এ বাড়িতে থাকতে পারবেন। তারপর আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
উপমা: হেসে বেশতো, আমি না হয় এই তিন মাসে আপনার মনে জায়গা করে নেবার চেষ্টা করবো। ভয় পাবেন না আমি জোড় করে কোন কিছুই করবো না। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ চাইলে পাথরের বুকেও ফুল ফুটতে পারে। আর আপনি আমি মানুষ। আমাদের মন নরম হতে পারে এটাই স্বাভাবিক।
জয়: আপনি হাজার চেষ্টা করেও কোন দিনও আমার মনে জায়গা করে নিতে পারবেন না। এখন বলুন কেন এসেছেন এখানে?
উপমা: শাকিল এসেছে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য। বাবা মা আমাদের নিয়ে যেতে বলেছে। বিয়ের পর নাকি এটা নিয়ম। আমি শাকিলকে বলেছি আমি আপনার সাথে কথা বলে জানাবো।
জয়: কিসের নিয়ম? এসব নিয়ম মানার মত সময় আমার নেই।
উপমা: মাত্রতো নব্বইটা দিনই, আপনার সাথে আমি থাকবো। আর আপনি বলেছেন এই নব্বই দিন আপনার মা বাবাকে যেন বুঝতে না দেই আমাদের সম্পর্কটা খারাপ। তাই আপনার ও উচিৎ একই ভাবে আমার পরিবারের লোকজনকে না বুঝতে দেওয়া আমাদের মাঝের দূরত্বটা। আর এই তিন মাসে আমি আপনার মনে জায়গা করে নিতে না পারলে আমি নিজ থেকেই আপনার জীবন থেকে সরে যাবো কথা দিলাম। এতে করে আপনার উপরও কোন দোষ হবে না।
জয়: বেশ তবে তাই হবে, কিন্তু যে কথা দিয়েছেন তার যেন ব্যতিক্রম না হয়।
উপমা: হাসি দিয়ে আমি কখনো মিথ্যা কথা বলি না। কাউকে মিথ্যা ওয়াদা করি না কেননা আমার আল্লাহ বলেছেন “কাউকে কথা দিলে অবশ্যই কথা রাখবেন, কারণ আপনার দেয়া সব অঙ্গীকারের হিসেব নেয়া হবে l” (সূরা বনি ইসরাইলঃ ৩৪), আমি আমার আল্লাহর সব কথা বিশ্বাস করি। তাই আমি যা বলেছি তাই করবো ইনশা আল্লাহ। হয় আপনার মনে জায়গা করে নিবো, নয়তো নিজ থেকেই আপনার জীবন থেকে চলে যাবো।
কথাটা বলে আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো তাই দ্রুত নিজের চোখের পানি লুকাতে দৌঁড়ে নিচে নেমে আসলাম। রুমে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বালিশে মুখ চেঁপে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম। আমি জানি না এ যুদ্ধে আমি জিতবো কিনা? তবে আমার আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। সে কখনোই আমাকে নিরাশ করবেন না।
হুট করেই দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে সেদিকে ফিরে তাকাতেই জয়ের দিকে চোখ পরলো।
জয়: রুমের ভিতর ঢুকে এতো ন্যাকা কান্না করার কিছু নেই তৈরি হয়ে নিন।
আমি কথা না বাড়িয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। জয় ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলো। গোসল শেষ করে রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। বাবা মা কেন যে এতো সুন্দর একজন মানুষের সাথে আমার বিয়ে দিতে গেলো। কেন দেশে কি কালো ছেলের অভাব ছিলো। তাদের মেয়ে যে দেখতে কালো এটা কেন তারা বুঝলো না? আচ্ছা জয়ের মন কি সত্যিই এতোটা কঠিন নাকি আমার সাথেই এতোটা কঠিন ব্যবহার করছে? ভাবতে ভাবতে রেডি হয়ে নিচের দিকে নেমে আসলাম। আমাকে দেখে জয় উঠে উপরে চলে গেলে রেডি হবার জন্য।
মা: দেখো বেশী দিন কিন্তু থাকা যাবে না ঐ বাড়িতে যেয়ে।
উপমা: জ্বী মা ঠিক আছে।
মা: ঠিক আছে না মাত্র দুই দিনই ও বাড়িতে থাকতে পারবা।
আচ্ছা মা ঠিক আছে দুই দিনই থাকবো মাত্র। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
মা: এইতো আমার লক্ষী মেয়ে।
আমি একটু হাসলাম, এ হাসির পেছনে যে কত কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে তা হয়তো তারা বুঝলো না। তাদের বুঝতেও দেয়া যায় না। এ ব্যথা যে শুধুই আমার। তাইতো সবার অন্তরালে লুকিয়ে কাঁদি। অল্প সময় পরেই জয় রেডি হয়ে চলে আসলো।
বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসলাম। জয় নিজেই গাড়ির চাবি নিলো ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে। আমাকে বললো সামনে পাশের ছিটে বসো। এই প্রথম মানুষটা আমাকে তুমি করে বললো মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। আমি কোন কথা না বলে তার পাশে বসলাম। শাকিল বসলো পেছনের ছিটে। গাড়ি ছুটে চলছে। আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখছি জয়ের দিকে আর জয় তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। যুগ যুগ তাকিয়ে থেকেও হয়তো এই মানুষটাকে দেখার স্বাদ মিটবে না।
চলবে….