মায়ার বাঁধন পর্ব-০৪

0
242

মায়ার বাঁধন-৪র্থ পর্ব
©শাহরিয়ার

সময় যে কত দ্রুত চলে যায়, তা আজ বুঝতে পারলাম। মনে হলো এইতো গাড়িতে জয়ের পাশে বসেছি। আর এরই মধ্যে চলেও আসলাম বাড়িতে।
তিনজনই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতর চলে আসলাম। বড় আপু মেজ আপু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। শাকিল জয়কে নিয়ে আমার রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। আপুরা আমাকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে আসলো।

বড় আপু: কিরে কেমন কাটলো বাসর রাত?

উপমা: মানে কি কেমন কাটবে আবার? প্রতিদিন যেমন যায় তেমনই গিয়েছে।

মেজ আপু: গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঢং এর কথা বলিস না। মনে হয় তুই এখনো ছোট বাচ্চা আছিস যে তোকে সব খুলে বলতে হবে।

উপমা: একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোমরা যা ভাবছো আসলে তেমন কিছুই হয়নি। আসলে আমার শরীর খুব ক্লান্ত লাগছিলো অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে এসেছিলো বুঝতেই পারিনি। যখন ঘুম ভাঙলো তখন ফজরের আযান দিয়েছে মসজিদে। উনি কখন এসে পাশে শুয়েছিলো তার টেরও পাইনি আমি।

মেজ আপু: কি বলিস এসব। আচ্ছা তোকে মেনে নিয়েছেতো ঠিকমত? নাকি আবার সমস্যা করেছে কোন রকম?

উপমা: আমতা আমতা করে আপু জানি না ভাগ্যে কি আছে, আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা লেখে রেখেছেন তাই হবে। আমি আমার আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছি। আল্লাহ আমাকে কখনো হতাশ করেনি।

বড় আপু: দেখ উপমা তোর কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। তুই একটু পরিষ্কার করে বলতো কি বুঝাতে চাচ্ছিস।

উপমা: তোমরা দু’জন আমাকে কথা দাও, আমি এখন যা বলবো তা তোমরা মা বাবা আর শাকিলকে বলবে না।

মেজ আপু: তুই আমাদের বিশ্বাস করতে পারিস। তুই আমাদের আদরের বোন।

উপমা: চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আপু জয় আমাকে পছন্দ করেনি। আমাকে বলেছে ডিভোর্স দিয়ে দিবে তিন মাস পর।

বড় আপু: কি বলছিস এসব? বিয়েটা কি ছেলে খেলা নাকি? যখন ইচ্ছে বিয়ে করবে, যখন ইচ্ছে ছেড়ে দিবে? হ্যাঁ আমরাও কষ্ট করেছি স্বামীর সংসারে তার মানে এই নয় যে তা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়িয়েছে বা এমন কথা হয়েছে। কালো বলে কথা শুনেছি কিন্তু এখন আর তা নিয়েও কোন কথা হয়না। স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই আছি।

মেজ আপু: আর এমন নয় যে আমরা লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছি। উনারা দেখে শুনেই বিয়ে করিয়ে নিয়ে গেছেন, তাহলে এখন কেন এসব কথা আসবে। ওদের নামে মামলা করবো জেলের ভাত খাওয়া। চেহারা সুন্দর বলে যা ইচ্ছে তা করবে তা বলবে। এটা কখনোই মেনে নিবো না।

উপমা: উফ আস্তে তোমরা থামো, এ জন্যই তোমাদের কিছু বলতে চাইনি। চুপ করে থাকো, বাবা মা জানতে পারলে কি থেকে কিয়ে হয়ে যাবে বলা মুশকিল। তাদের বয়স হয়েছে হুট করে এসব জানলে তারা এই আঘাত সহ্য করতে পারবে না। আর সেতো আর আমাকে এখুনি ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে না। আমার হাতে এখনো পুরো তিন মাস সময় রয়েছে। এর ভিতর আল্লাহ নিশ্চই সব ঠিক করে দিবে। আর যদি ঠিক না হয় তবে আমি ভেবে নিবো। আল্লাহ ঐ বাড়িতে আমার সংসার কিংবা সুখ লেখে রাখেনি। আমার সুখ হয়তো অন্য কোথাও লেখে রেখেছে।

বড় আপু: দেখ উপমা তুই দুনিয়াটাকে যত সহজ মনে করিস, দুনিয়াটা তত সহজ নয়। এখানে বেঁচে থাকতে হলে লড়াই করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। আঘাতের বিপরীতে পাল্টা আঘাত করতে হয়। দাঁতে দাঁত চেঁপে সহ্য করার দিন এখন আর নেই। সমাজ ব্যবস্থা পাল্টেছে। এখন নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। আইনি ব্যবস্থাও এখন খুবি কঠিন।

উপমা: আপুরে জোড় করে আর যাই হোক, সংসার হয় না। যেখানে দু’জনের জন্য দু’জনের মনে বিশ্বাস আর ভালোবাসা থাকবে না। সেখানে সংসার করা যায় না। তোমরা এতো ভেবোনা আমি যদি জয়ের সাথে সংসার করি, তবে ওর মনে আমার জন্য ভালোবাসর সৃষ্টি করেই সংসার করবো ইনশা আল্লাহ।

মেজ আপু: দোয়া করি আল্লাহ তোর সকল মন বাসনা পূর্ণ করুক। আমীন। এখন তুই তোর রুমে যা জয় হয়তো একাই বসে আছে।

উপমা: হুম তোমরা থাকো আমি যাচ্ছি আর হ্যাঁ যা যা বলছি তা যেন মনে থাকে।

বড় আপু মাথা নেড়ে বুঝালো ঠিক আছে, আমি নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম।

রুমে আসতেই জয় বলে উঠলো,

জয়: দরজাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে আসবে? আর লকটাও লাগিয়ে দিয়ে এসো।

আমি দরজাটা বন্ধ করে লক লাগাতেই জয় পকেট থেকে সিগারেট বের তা জ্বালালো। আমি বুঝতে পারছি জয় আমাকে সহ্য করতে পারে না, তাই ইচ্ছে করেই এমন করছে।

জয়: এমন হা করে কি দেখছো? আমি ধুমপান করি এটাতো তুমি ভালো করেই জানো।

উপমা: হুম, সমস্যা নেই আপনার যা ইচ্ছে করেন।

কথাটা বলে আমি ওয়াশ রুমে চলে আসলাম, যোহরের আজান দিয়েছে মসজিদে ওযু করে বের হতেই দেখলাম জয় সিগারেট শেষ করে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি তাতে উদ্দেশ্য করে বললাম আপনি কি নামায পড়বেন? জয় কোন কথা বললো না, দেখে আমি আবার বললাম নামায পড়লে মনের অশান্তি সব দূর হয়ে যাবে। মনে শান্তি ফিরে আসবে ওযু করে এসে নামায পড়ে নিন।

জয়: কিছুটা রেগে তোমার মনে শান্তি দরকার আমার না। তুমি যতদিন আমার জীবনে থাকবে ততদিন অশান্তির শেষ হবে না।

আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম। আল্লাহ চাইলে খুব শিগ্রই আপনার জীবনে শান্তি ফিরে আসবে। জয়ের দিকে আর তাকালাম না, নামাযে দাঁড়িয়ে পরলাম।

নামায শেষ করে সালাম ফেরাতেই দরজার ওপাশ থেকে শাকিলের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। উঠে যেয়ে দরজা খুলে দিতেই শাকিল বললো সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে তোমাকে আর দুলা ভাইকে খাবার জন্য ডাকলো। আর দুলা ভাইয়েরাও এসেছে।

উপমা: তুই যা আমরা আসছি।

শাকিল চলে যেতেই আমি জয়কে খেতে যাবার কথা বললাম। জয় বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো আমার ক্ষুধা লাগেনি তুমি একাই যেয়ে খেয়ে নাও।

উপমা: সে কি করে হয় বলুন, আপনি বাড়ির জামাই আপনাকে রেখে কি করে যাই। আর বিয়েতে বড় দুলাভাই মেজ দুলাভাই উপস্থিত ছিলো না, তারাও একটু আগেই এসেছি আপনাকে রেখে তারাও খেতে বসবে না।

জয়: বেশ বিরক্ত হয়ে তোমার দুলা ভাইয়েরা এসেছে তাতে আমার কি? আমার ভালো লাগছে না এটাই আসল কথা। তোমার বোনরা তুমি যেমন, ঠিক তাদের স্বামীরাও নিশ্চই আহামরি কিছু হবে না। কোথায় কি না কি করে যে শালীর বিয়েতেও আসতে পারেনি।

উপমা: দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কারো বিষয়ে অনুমানের উপর কিছু বলা মোটেও ঠিক না। কেননা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ কারো সম্পর্কে বলতে পারেন না। তাই অনুমানে কিছু বলা ঠিক না হাদিসে বলা হয়েছে “আকাশ এবং জমিনে আল্লাহ ছাড়া গায়েবের সংবাদ অন্য কেউ জানে না।” (সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬৫), তাই গায়েবি কথাবার্তা বলা ঠিক নয়। একজনের সম্পর্কে সঠিক ভাবে না জেনে।

জয়: এবার এক লাফে বিছানার উপর উঠে বসে মুখে মুখে তর্ক করছো তুমি আমার? অবশ্য তোমাদের মত মেয়েদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী কিছু আসা করাটাও বোকামি। কেউ যখন বিয়ে করেনি তখন আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে তোমার মা বাবা। ইচ্ছে করছে সব কিছু তছনছ করে দেই।

বলেই রাগি রাগি চোখে তাকালো।

উপমা: ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ করা ঠিক নয়, রাগ নিয়ন্ত্রন করতে শিখুন, কেননা রাগের সময় আমরা অনেক রকম উল্টা পাল্টা কথা বলে ফেলি যা ভুল। এবং এর মাশুল আমাদের পরে দিতে হয়। এজন্য বলা হয়েছে “তোমরা রাগকে গিলে ফেলো” সূরা ইমরান- আয়াত:১৩৪।

জয়: চুপ আর একটা কথাও আমি শুনতে চাচ্ছি না। কেন যে বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান হতে গিয়েছিলাম তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

উপমা: একদম ঠিক বলেছেন আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া কোন কিছুই ঘটেনি বা সামনেও যা ঘটবে তাও আল্লাহর ইচ্ছেতেই ঘটবে। তাই ফ্রেশ হয়ে চলুন।

জয় কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলো বুঝতে পারলো এই মুহুর্তে আর কথা বলে পারা যাবে না। তাই ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসতেই তোয়ালেটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। এরপর দু’জন এক সাথে রুম থেকে বের হয়ে নিচে নেমে আসলাম। ডাইনিং এ সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, নিচে নেমে আসতেই দুলা ভাইয়েরা এগিয়ে এসে জয়ের সাথে হাত মেলালো আর সরি বললো বিয়েতে উপস্থিত না থাকতে পেরে। বড় দুলা ভাই আর মেজ দুলাভাই দু’জন মামাতো ফুপাতো ভাই। আর ব্যবসাও করে একই সাথে, সেই সুবাদে দু’জনই একই সাথে ব্যবসার একটা কাজে বিদেশে ছিলো। অল্প সময়ের ভিতর আমাদের বিয়েটা হওয়াতে তারা সেদিন উপস্থিত হতে পারেনি। তাদের কথা শুনে জয় কিছুটা অবাক হলো। কেননা ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, আর আমার দুলা ভাইয়েরাও দেখতে খারাপ না আল্লাহ তাদের যথেষ্ট্য সুদর্শন করেই বানিয়েছেন। দু’জনের মুখ ভর্তি চাপ দাঁড়ি এবং দু’জনের গায়ের রং ফর্সা।

সবাই মিলে এক সাথে খেতে বসলাম। আপুরা কিছুটা অবাক হয়েছে আমাদের এতোটা স্বাভাবিক ভাবে দেখে। অন্যদিকে আমার একটু হাসি পাচ্ছিলো জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিলো এক রকম আর হলো আরেক রকম।

চলবে…