মায়ার বাঁধন পর্ব-০৯

0
212

মায়ার বাঁধন-৯ম পর্ব
©শাহরিয়ার

আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, আমার রব যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্যে। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেন,
“পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে আমি সেগুলিকে ওর শোভা করেছি মানুষকে এই পরীক্ষা করবার জন্য যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম।”
(সূরা কাহফ ১৮, আয়াত ৭)।

একদিন আমাদের এই দেহ মাটির নিচে চলে যাবে। তাই বাহিরের এই সু্ন্দর্য্য আসলে কিছুই না। বরং আমি মনে করি আল্লাহ যাদের সুন্দর করে এই পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন তাদের আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। কেননা, তিনি বলেছেন। ” তুমি তোমার রবের কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে”-সূরা আর রাহমান। আমরা আল্লাহর কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করতে পারবো না। অবশ্য সবাই এসব বুঝে না। কেননা আমাদের বাহিরের সুন্দর্য্য আমাদের এমন ভাবে অন্ধ বানিয়ে ফেলে যে। আমরা কুরআন হাদিস মানতে নাড়াজ।

জয়: দীর্ঘ সময় চুপ থেকে তোমরা প্রতিটা কথাই সঠিক। কিন্তু মানুষের ভালো লাগা মন্দ লাগার একটা বিষয় রয়েছে। আর জোর করে কাউকে ভালোবাসাও যায় না।

হ্যাঁ তা ঠিক বলেছেন। আল্লাহ যার জন্য যাকে সৃষ্টি করেছেন নিশ্চই তার জন্য তার মনে ভালোবাসার ও সৃষ্টি করেছেন। আর আমি হয়তো আপনার জন্য সঠিক না, তাই হয়তো আপনার মনে আমার জন্য ভালোবাসার সৃষ্টিও হয়না। সে যাই হোক অল্প কিছু দিনের ব্যাপারতো দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যাবে। তখন আপনি একদম স্বাধীন।

জয়: আমি দুঃখিত, আসলে আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।

না না দুঃখিত হবার কিছু নেই। বরং আমাদের বিচ্ছেদের পরেও আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবো কেউ একজন আপনার জীবনে আসুক আমার চেয়ে অনেক ভালো যাকে আপনি মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে পারবেন। যাকে সত্যি সত্যি আল্লাহ শুধু আপনার জন্যই তৈরি করেছেন।

জয়: আমার জন্য তোমাকে অনেক ছোট হতে হবে পরিবার প্রিয়জন, সবখানে।

আরে না না কি বলেন? ভাগ্যের লিখন কেউ কি বদলাতে পারে? আর তাছাড়া আপনাকে আগেইতো বললাম এসবের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে আমার। বরং হয়তো আপনাকে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে, আপনাদের সভ্য সমাজে। আমি না হয় সবাইকে বলতে পারবো আমি কালো আপনার মন মত হতে পারিনি। কিন্তু আপনি কি বলবেন? মানুষজন বলবে বিয়ের আগেই কেন না করেন নি। তাই আমি মনে করি আগে থেকেই সব গুছিয়ে নিন, মানুষকে কি বলবেন। অবশ্য আপনি চাইলে আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নিজের দায় সারতে পারবেন। কেননা যেহেতু আমি আপনার জীবনে থাকবো না, সেহেতু আমার নামে অপবাদ দিলে কোন সমস্যা হবে না।

কথাটা বলার সাথে সাথেই হঠাৎ করেই খুব দ্রুত জয় ব্রেক চাপলো। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। জয় খুব ঠাণ্ডা মাথায় বললো।

জয়: তোমার কি আমাকে এতোটা খারাপ মনে হয়? নিজের অপরাধের জন্য আমি তোমাকে কেন খারাপ বানাতে যাবো? যা সত্যি তাই বলবো।

কথাটা বলে জয় গাড়িটা সাইডে চাপিয়ে গাড়ি থেকে নেমে, পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে জ্বালালো। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হায়রে দুনিয়া। আমরা সব জানি, সব বুঝি কিন্তু মানি না। এ জন্যই হয়তো অনেকে বলে যে যত জানে সে তত কম মানে।

জয়: গাড়ি থেকে নেমে আসো।

কেন?

জয়: নামতে বলেছি নেমে আসো।

আমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে নেমে আসলাম।

জয়: ঐ যে দেখ একটা নদী দেখা যাচ্ছে চলো হেঁটে আসি।

আমি অবাকের শেষ চূড়ায় যেন পৌঁছে গেলাম। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।

জয়: কি হলো এসো হেঁটে আসি ভয় নাই। বিশ্বাস করতে পারো।

না না ভয় পাবো কেন? কিন্তু গাড়ি রেখে ঐদিকে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

জয়: কিছু হবে না। গাড়ি সাইড করাই রয়েছে। চলো কিছুটা সময় হেঁটে আবার ফিরে আসবো।

জয়ের সাথে সাথে নদীর দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। নদীর যত কাছে এগিয়ে যাচ্ছি মনের মাঝে তীব্র এক আনন্দ অনুভুত হচ্ছে। এটা কিসের আনন্দ আমি জানি না। হয়তো আপন মানু্ষটার সাথে এক সাথে একান্ত কিছু স্মৃতিময় মুহুর্ত কাটাবো এটা ভেবে। নিজের মনের ভিতর থেকেই চাপা এ আনন্দটা বের হয়ে আসছে।

বেশ সুন্দর একটা বহমান নদী। নদীতে বহমান পরিষ্কার পানি। ঢাকা শহরে এতোটা পরিষ্কার পানি দেখা যায় না। মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ।

জয়: দারুণ না জায়গাটা?

হুম খুব সুন্দর, আগে কখনো এসেছিলেন?

জয়: আরে না, এদিক দিয়ে বহুবার গিয়েছে, কখনো ওভাবে চোখে পরেনি। আসলে কখনো এভাবে এখানে কখনো গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো হয়নি তাই দেখাও হয়নি।

যাক তাহলে বেশ ভালোই হলো, কোন এক উছিলায় দেখা হয়ে গেলো এতো সুন্দর নদীটা।

জয়: হাঁটতে হাঁটতে হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছো। সত্যিই আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি অতুলনীয়। এই যে জনমানবহীন একটা নির্জন এলাকা আসেপাশে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার খুব কাছে কত সুন্দর একটা প্রবাহমান নদী।

হুম আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য এই সুন্দর দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা আমার, আপনার আমাদের কারোর নেই।

জয়: হুম তা ঠিক বলছো।

বেশ কিছুটা সময় দু’জন এক সাথে গল্প করতে করতে নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ালাম। দুপুর হয়ে এসেছে। রোদের তাপ ও কিছুটা বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। জয়ের সাদা মুখটা ঘেমে লাল হয়ে আসছে। তাই বললাম চলুন আর হাঁটতে হবে না। বেশী সময় হাঁটলে অসুস্থ হয়ে পরবেন। আমার আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবার মত শক্তি নেই।

কথা শুনে জয় হেঁসে দিয়ে, কিছু হবে না, যদিও গরম লাগছে, আর গরম আমি সত্যিই খুব একটা সহ্য করতে পারি না।

আমি হাসি মুখে ড্যাশবোডের উপর থাকা টিসু বক্স থেকে দু’টো টিসু বের করে জয়ের দিকে এগিয়ে দিলাম। জয় ধন্যবাদ দিয়ে টিসু গুলো নিয়ে মুখ মুছে গাড়ির সব কয়টা গ্লাস উচু করে দিয়ে এসিটা অন করে দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। সত্যিই কখন থেকে যে আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছি বুঝতে পারেনি। দু’জন খুব স্বাভাবিক কথা বলছি গল্প করছি। হাসাহাসি করছি বিচ্ছেদের কথা দিব্যি বলে গিয়েছি। হয়তো মানুষ এজন্যই বলে ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে সমস্ত পৃথিবীকে তুচ্ছ মনে হয়। হায়রে মানুষ আমরা ভালোবাসার কাঙাল, অথচ যে মানুষটাকে ভালোবাসি সেই মানুষটাই বুঝতে চায় না। হাসি মুখে আমরা তার সাথেও ভালোবাসার নিঁখুত অভিনয় করে যাই। অথচ গোপনে অন্তরটা পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়।

জয়: গাড়ি আবার সাইড করে, এখনো যেতে আরও অনেকটা সময় লাগবে। এসো এখান থেকেই দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেই।

গাড়ি থেকে নেমে দু’জন মিলে একটা রেস্টুরেন্টের ভিতর প্রবেশ করলাম। কিছুটা আনইজি লাগছিলো আমার কাছে। বিয়ের পর এই প্রথম জয়ের সাথে এতো কোলাহলের মাঝে আসা। ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখি জয় দাঁড়িয়ে বাহিরে। আমাকে দেখে হেসে দিয়ে আসো বলে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলো। দু’জন টেবিলের দু’পাশে বসলাম।

জয়: কি খাবে?

আমার তেমন ক্ষুধা লাগেনি, হাল্কা কিছু অর্ডার করুণ।

জয়: একজনকে ডেকে কিছু খাবারের অর্ডার করলো।

দু’জন গল্প করছি এর মাঝে খাবার চলে আসলো। চুপচাপ খেতে শুরু করলাম দু’জন। খাওয়া শেষ করে আবার রওনা হলাম গ্রামের দিকে। সে কি গল্প শুরু হলো আমাদের মাঝে। কে বলবে এই মানুষটাই সব সময় আমার সাথে গম্ভীর ভাবে কথা বলতো। মানুষটাকে এই মুহুর্তে আমার কতদিনের চেনা কত আপন মনে হচ্ছে।

সময় খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিলো। একটা সময় গাড়ি নেমে গেলো গ্রামের মেঠো পথে। দুই পাশে বড় বড় গাছের মাঝ দিয়ে গ্রামের রাস্তা, তার চেয়ে একটু নিচে বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ ধান ক্ষেত মুহুর্তেই চোখ জুড়িয়ে আসে। বাতাসে ধানক্ষেত দুলে চলছে। এক অপূর্ব দৃশ্য যা থেকে চোখ সড়ানো যায় না। একটা সময় পুড়াতন এক অট্রালিকার সামনে এসে গাড়ি থামলো। গাড়ির হর্ণ বাজানোর কয়েক মিনিট পর কেউ একজন এসে গেট খুলে দিতেই জয় গাড়ি ভিতরে ঢুকালো।

খুব সুন্দর করে সাজানো বাড়ির ভিতরটা মেইন দরজায় একজন মহীয়সী নারী দাঁড়ানো, তার পেছনে আরও দু’জন বধু দাঁড়ানো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না সামনের জন জয়ের বড় খালা। কিন্তু অপর দু’জন কারা? সকলের হাতেই বরণ ডালা। জয় আমার হাত স্পর্শ করতেই আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। হাসি মুখে সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো চলো। দরজার সামনে আসতেই জয় ইশারায় বললো আমার বড় খালা।

আমি তাকে সালাম করতেই সে খুশি হয়ে আমাকে বরণ করতে শুরু করলো। গলায় সোনার একটা হার পড়িয়ে দিয়ে। পাশে দাঁড়ানো দু’জন ডালা থেকে ফুলের পাপড়ি ছিঁটিয়ে দিচ্ছিলো আমাদের উপর সব কিছু যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। মনে হচ্ছিলো আমি কোন ঘোরের মাঝে রয়েছি। একটু পরেই ঘুম ভেঙে সব তছনছ হয়ে যাবে।

জয়: কি করছো খালা তুমি? এতো কিছুর কি কোন প্রয়োজন আছে?

খালা: অবশ্যই আছে তুই ভুলে গেছিস হয়তো, ও হচ্ছে জমিদার নেওয়াজ চৌধুরির একমাত্র নাত বউ। আর তাই এ বাড়ির নিয়মনীতি অনুযায়ীই আমি আমার বউ মাকে বরণ করে নিবো।

মনের ভিতর এক অন্য রকম আনন্দ অনুভুত হচ্ছে জানি না এ আনন্দ কত সময় স্থায়ী হবে। ভাবতে ভাবতে দূর মসজিদ থেকে মাগরীবের আজানের সুর ভেসে আসলো। আমি খালার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি নামাজ পড়বো। খালা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন মাশা আল্লাহ, আমার সাথে চলো আজ দু’জন এক সাথেই নামাজ আদায় করবো।

চলবে…