মায়া পর্ব-০১

0
801

#মায়া
পর্ব ১
লেখা – #Alisia_Amber (ছদ্মনাম)

অদ্ভুত ভাবে বিয়ের দিন থেকেই তাকে দেখলে আমার হৃদপিন্ড তড়িৎ গতিতে লাফানো শুরু করে। এক পলক দেখা আর একটুখানি হৃদয় নিংড়ানো কন্ঠ শুনেই কি প্রেম হয়ে যায়? আচ্ছা আমি কি তার প্রেমে পড়েছি! কথাটা ভাবতেই সারা শরীর মন জুড়ে আদ্ভুত এক শিহরণ দিয়ে যায়!

এই যে এই মুহুর্তে সে আমার সামনে দাঁড়ানো। খুব সুন্দর ভাবে তার গ্যাজদাতের হাসি দিয়ে আমাকে ঘায়েল করছে প্রতিনিয়ত। আমার ছোট বোনের সাথে তার হাজার হাজার কথা থাকলেও আমার সাথে তার কেমন ফরমালিটির কথা বার্তা! কায়া চলে যেতেই এবারে তিনি আমার দিকে ফিরলেন। আমি কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মাথায় ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দিয়ে মাথা নিচু করে রাখলাম। আমি জানি এই মুহুর্তে আমার কাপা কাপি দেখে তিনি মুচকি মুচকি হাসছেন! আচ্ছা আমি কি হাসির বস্তু? সব সময়ই কেনো তাকে হাসতে হবে!

আমার ধ্যান ভংগ করে তিনি আমাকে বললেন,
‘কেমন আছো মায়া?’

এতক্ষন পর উনার মনে পরলো আমি কেমন আছি? আমার ভীষণ অভিমান হলো। মুখ দিয়ে টু শব্দটাও করলাম না। কেনই বা বলবো। বলবো না। এই যে সকাল থেকে উনি আমাদের বাসায় আছে কই একটি বারের জন্যও তো আমাকে এসে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। এখন আমি এসে দাড়াতে আমার কথা স্মরণে আসলো?

আমি চুপ করে থাকাতে উনি হালকা কেশে আবারো বললেন, ‘আচ্ছা তুমি কি আঠাযুক্ত চুইংগাম সেবন করেছো?’

আমি অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম, ‘মানে?’

উনি হুহু করে হেসে উঠে বললেন, ‘যাক খাও নি তাহলে। আমি আরো ভাবলাম ঠোঁট দুটো আলাদা হচ্ছে না কেনো? ভীষণ টেনশনে পরে গিয়েছিলাম বুঝেছো?’

উনি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন? ফাজিল ছেলে আমি আর এক মুহুর্তুও দাড়ালাম না। দৌড়ে চলে আসলাম। আর এদিকে তিনি আমাকে পেছন থেকে ডাকছেন, ‘মায়া শুনো কথা ছিলো’

শুনলেও প্রত্যুত্তর করলাম না। কেমন লজ্জায় ফেলে দিলো লোকটা আমায়!

বিয়ের দিন সহ আমাদের মোট তিনবার দেখা হয়েছে। এই তিনবারে গুনে ছটা বাক্যের আদান প্রদানও হয়তো ঘটে নি! তবে তাকে প্রথম দেখে আমার মনের আকা রাজকুমারের সাথে কেমন মিল পেয়েছিলাম। ঠিক তখনই মনে হয়েছিলো সেই আমার প্রেমিক পুরুষ!

আমার বিয়েটাও খুব অদ্ভুদ ভাবে হুট করে হয়ে গিয়েছিলো। একদিন বাবা এসে বললো আজকে তার বন্ধুর পরিবার আমাদের বাসায় নিমন্ত্রন খেতে আসবে। আর এই আসার মানে যে ছিলো আমাকে দেখতে আসা তা আমি গুণাক্ষরেও টের পাই নি। বাবা আমাকে ভীষণ আদর করেন। আমার মা নেই! উহু নেই নয় মানে পৃথিবীতে নেই এমন নয়। থেকেও নেই আর কি! উনি উনার দ্বিতীয় সংসারে বেশ সুখী। দাদীমা থেকে কেবল এইটুকই জেনেছি যে আমার পাচঁ বছর বয়সে মা বাবা থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন।

বাবা আমার দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকেন না। আমার দিকে তাকালেই নাকি উনার মা’য়ের কথা মনে পরে যায়। আমি নাকি অবিকল মায়ের মতই দেখতে। আচ্ছা আমিও কি মায়ের মতই হবো? বাবা কখনো আমার সাথে মায়ের গল্প করে নি। তবে দাদীমার কাছে শুনেছি বাবা মা’কে ভীষণ ভালোবাসতো।

আমার দ্বিতীয় মা আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। তবে তিনি আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যাবহারও করেন নি আবার কখনো হেসেও কথা বলেন নি। কেমন যেনো অদ্ভুত সম্পর্ক আমাদের। মাঝে মাঝে উনার কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘মাগো শুনছো? আজ কেমন মা মা আদর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে!’

কিন্তু পারি না। আমার মনের কথাগুলো মুখ অবদি আসে না। এই যে কায়া সারাদিন বাসা মাথায় তুলে রাখে। যা মনে আসে বলে। কিন্তু আমি চাইলেও বলতে পারি না। এই যে বাবা যখন বললেন, ‘শুদ্ধ ছেলেটা ভীষণ ভালো মা। তোকে উনারা পছন্দ করেছেন। আগামী শুক্রবারই উনারা আকদ করে ফেলতে চাইছেন’

আমি একটাবারের জন্যও বাবাকে বলতে পারি নি। বাবা শুদ্ধ কে? আজ যারা এসেছিলো তাদের মধ্যে কি শুদ্ধ নামের ব্যাক্তিটিও উপস্থিত ছিলো? সবচেয়ে ইম্পোরটেন্ট কথাটা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না বাবা। আমি মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড নই। আমার আরো কিছু সময় চাই বাবা। কিন্তু নাহ! বলতে পারি নি। কেবল মাথা নত করে চুপ করে বসেছিলাম। দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলো মামনি। উনি আমার চুপ করা দেখে চলে গিয়েছিলেন। বাবাও সুন্দর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে চলে গেলেন। একটাবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেন নি, ‘আচ্ছা মা আমার বলতো তোর কি অমত আছে?’

সেই মুহুর্তে আমার মা উপস্থিত থাকলে কি করতো? উনিও কি মামনির মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন? বাবা উঠে যেতেই আমার বা চোখ থেকে টুক করে এক ফোটা জল নির্গত হলো। মুছলাম না। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস ছেড়ে মনকে শান্তি দিতে হয়। কাদতে হয়। কিন্তু এই কান্না নামক বস্তুটাও বড্ড অদ্ভুত আমার জীবনে। সহযে ঝড়তেই চায় না। বিয়ের দিনও কেমন কবুল বলে দিয়েছিলাম বিনা বাধায়। সেদিন মামনিও কেমন মুখ ঝামটা মেরে চলে গিয়েছিলেন। হয়তো বা বলেওছিলেন, ‘কেমন বেহায়া মেয়ে একটুও কাদলো না!’

এই না কাদার জন্যই তো আমিও কারো মন গলাতে পারি না। কায়ার মত আমিও যদি বায়না ধরে হাওমাও করে কাদতে পারতাম। তাহলে তো মামনি আর বাবাও গলে যেত। মেনে নিত আমার সকল ইচ্ছে!

দাদীমা মারা যাওয়ার পর থেকে বাসাটা কেমন ফাকা ফাকা লাগতো। আমি কথা কম বলি বলে কায়াও আমার কাছে কম ঘেষে। দূর থেকে আমি দেখি মামনি কেমন কায়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। চুলে বিনুনি পেকে দিচ্ছেন। আফসোস হয় না। কেমন খালি খালি লাগে। তাদের হাসি ঠাট্টায় নিজেও গিয়ে যোগ দিতে ইচ্ছে হয়। পারি না। কেমন জানি জড়তা কাজ করে। আমার রুম আমার বারান্দা আর আমার প্রিয় বই। এসবেই আমার জীবনের বিশ বসন্ত কাটিয়ে দিলাম।

কলেজে একবার বিরাট কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম। এলাকার এক বকাটে একবার আমায় প্রপোজ করে বসেছিলো। কিছু না বুঝেই চড় মেরেছিলাম। আর সে টান মেরেছিলো আমার উড়নায়। হুলস্থুল কান্ড। আশেপাশের মানুষ আমায় সেদিন শান্তনা আর বাহবা দিলেও আমার মামনি বলেছিলো, ‘বেহায়া মেয়ে’

সেদিন একটুও কান্না আসে নি। উলটো হাসি এসেছিলো। তবে হাসতে যে মানা! হাসি নি। নিজেকে নিয়ে প্রাউড ফিল হয়েছিলো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যদি বেহায়া হতে হয়। আমি বেহায়া হতে রাজি!
.
.
শুদ্ধর কোনো আপন ভাইবোন নেই। সে হিসেবে বিয়ের দিন খুব একটা মানুষ উপস্থিত হয় নি। বিয়ের পর আমার শ্বশুড় মসাই খুব সুন্দর করে আমায় বলেছিলেন, ‘আমার মায়াটা একদম আমার মায়েরই মত!’

চোখ তুলে মানুষটার দিকে তাকিয়েছিলাম। মানুষটাকে ভীষণ আপন লেগেছিলো। এভাবে তো বাবাও কখনো বলেনি।

দরজায় কড়াঘাত শুনতেই ধ্যান ভংগ হলো। কায়া ডাকছে।

‘আপা শুনছিস? শুদ্ধ ভাইয়া তোর সাথে দেখা করতে চান’

বুকটা ধ্বক করে উঠলো আবার। সে দেখা করতে চায়? কেনো? আবারো লজ্জায় ফেলে দিতে চলে এসেছে নাকি লোকটা। আমি যে তার সামনে গেলেই নিজেকে হারিয়ে ফেলি। চট করে উঠে বসে শাড়িটা ঠিক করে সুন্দর করে ঘোমটা টেনে দরজা খুলে দিলাম। উনি ভেতরে এসে হালকা কেশে বললেন, ‘চলে যাচ্ছি মায়া। আপাদত কবে দেখা হবে বলতে পারছি না। ভালো থেকো’

কেমন গড়গড় করে সব বলে দিলো। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। বুঝাই কি করে, দেখা যদি নাই হয় তবে তারে দেখার তৃষ্ণা আমার মিটবে কি করে?

চলবে কি?