মায়া পর্ব-০৭

0
388

#মায়া
পর্ব ৭
লেখা – #Alisia_Amber
[কপি করা নিষেধ]
.
পাখির কলতানই জানান দিচ্ছে ভোর হচ্ছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই সুমধুর আজানের ধ্বনি এসে কাজে বাজলো। বাস স্ট্যান্ডে মানুষের আনাগুনা কম। কেমন গা শিরশির করা অনুভূতি হচ্ছে। ভাবতে লাগলাম। কপালের কি লিখন! যে শহরে ভালোবাসার মানুষ ঘুরে ফিরে সে শহরেই যাচ্ছি!

কাগজের লেখা ঠিকানার সাথে ভালো করে মিলালাম। হ্যাঁ ঠিক জায়গায়ই এসেছি। কপালে ল্যাপ্টে থাকা ঘাম মুছে কলিং বেল বাজালাম। কোনো সারা শব্দ নেই।
আবার কলিং বেল দিতেই হাফ প্যান্ট পড়া এক কিশোর বালক এসে দরজা খুলে দিলো। চোখের চশমাটা ঠেলে ভেতরে নিয়ে সুন্দর করে বললো,
‘আসসালামুয়ালাইকুম কাকে চাই?’

আমি মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দিয়ে বললাম, ‘মিসেস খন্দকার বাসায় আছেন?’

ছেলেটা কিছুক্ষন ভেবে বললো, ‘আম্মু তো স্কুলে।’

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এবারে! কখন আসবো জিজ্ঞেস করতেই বললো লাঞ্চ আওয়ারে আসেন উনি। আমি ইস্ততবোধ করে বললাম, ‘আমি যদি অপেক্ষা করি কোনো সমস্যা আছে?’

ছেলেটা ভেতরে ঢুকতে বললো। আলিশাল ড্রয়িংরুমে উদুম গায়ে একটা ছেলে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। আমাকে দেখেই উঠে বসলো। রাগ নিয়ে আমাকে দরজা খুলে দেয়া কিশোর বালকের উপর চেচিয়ে বললো, ‘এসব কি নিয়ন? পড়ালেখা নেই? সারাদিন ঘুরাঘুরি। আর কাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়েছিস?’

আমি ঘাবড়ে গেলাম। ছেলেটা কি অতিরিক্ত মেজাজী? নাকি প্রতিবন্ধি? এমন ভাবে ধমকাচ্ছে কেনো? বাচ্চা নিয়নের উপর এমন চড়াও হওয়ার কি আছে!

আমি আস্তে করে বললাম, ‘আসলে আমি মিসেস খন্দকারের কাছে এসেছিলাম। উনি বাসায় নেই তাই অপেক্ষারত সময়টুকু একটু বসবো। আপনাদের অসুবিধা হলে বলেন আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ‘

ছেলেটা রাগী গলায় বললো, ‘বসুন’

বলেই চলে গেলো। আশ্চর্য! এমন মানুষ আমার জীবনেও তো আমি দেখি নি।

ছেলেটা যেতেই নিয়ন আমার কাছে এসে বললো, ‘আপু আপনি কিছু মনে করবেন না। এই আমার ভাইয়াটার মাথার স্ক্রু একটু নষ্ট। হুটহাট রেগে যায়। এই যে দেখুন আমি স্কুলের টপ বয়। আর ভাইয়া হলো ফেল্টুস! এখনো এক ভার্সিটি থেকেই বেরুতে পারলো না। অথচ আমাকে এমন ভাবে পড়তে বললো যেনো আমি গাধা।’

শেষের কথাটা ভীষণ অসহায় হয়েই বললো। আমি হালকা হাসলাম।

‘আপু আপনি বসুন। আর বলুন তো পড়াশুনা কদ্দুর। আর এখানে কেনো!’

নিয়নের মাত্রাতিরিক্ত কথায় বুঝলাম। ছেলেটা বাচাল। এত তাড়াতাড়ি যদিও কাউকে উপাধি দেয়া যায় না। তবুও তার একের পর এক প্রশ্নে আমার বিরক্তবোধ হচ্ছিল।

ঠিক দুপুর দুটো পনের এ মিসেস খন্দকার আসেন। সোফায় হ্যালান দিয়ে থাকা অবস্থায় কখন দুচোখের পাতা লেগে গিয়েছিলো বলতে পারি নি। নিয়নের ডাকে হুশ ফিরে।
‘আপু আপনি সোফায় বসে বসে ঘুমুচ্ছেন কিভাবে? আমি শুনেছি ঘোড়া দাঁড়িয়ে ঘুমায়। কিন্তু কোন প্রাণী বসে ঘুমায় তা এই মুহুর্তে স্মরণ করতে পারছি না।’

মিসেস খন্দকারের ধমকে নিয়ন চুপ হয়ে গেলো। মুখটা বাকিয়ে মেয়েদের মত রাগ করে চলে গেলো। হুট করেই আমার হাসি পেলো। আমার দেয়া উপাধিটা তবে ঠিকই ছিলো!

মিসেস খন্দকার আমার কাছে এসে বললেন, ‘তুমি কে মা! ঠিক চিনতে পারলাম না। অয়ন ফোন দিয়ে বললো আমার কাছে এসেছো?!’

অয়ন কে! ঐ রাগী ছেলেটা? হবে হয়তো! সেদিকে না ভেবে আমি আস্তে করে বললাম, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না মনিমা? আমি মায়া।’

মিসেস খন্দকার হুট করে অবাক চাহনী নিক্ষেপ করেন। আমার কাছে এসে মুখে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘নীলুর মেয়ে?’

আমি মাথা কাত করে হ্যাঁ বুঝালাম। উনি আমাকে তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরেন। কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘কতদিন ভেবেছি তোকে দেখতে যাবো! কিন্তু সাহস হয়ে উঠে নি। নীলিমা চলে যাওয়ার পর তোর বাবার সামনে যাওয়ার আর কোনো মুখ ছিলো না। তার মাঝে একবার গিয়েও কত অপমানিত হলাম! তবে তোর বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর আমরা তোকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম তোর বাবা আর দাদী আনতে দেয় নি। যতই হোক আমার শরীরেও তো নীলিমার রক্তই বইছে!’

মনিমার কথা শুনে খারাপ লাগলো। আস্তে করে বললাম, ‘আমি কি এখন আপনাকে মনিমা বলে ডাকতে পারি?’

মনিমা কান্না মুখে হেসে বললেন, ‘পাগলী। আমি সারাজীবন তোর মনিমাই থাকবো!’

কথাটায় বিরাট প্রশান্তি দিলো। বললাম, ‘আমি জানিনা মনিমা আপনি কেমন। তবে মায়ের পরে আপনাকেই দেখেছি। আর তাইতো দেখেন চুলে পাক আর চোখে চশমা লাগিয়েও আপনাত চেহারা কেমন চিনে ফেললাম। আর বিপদে সবার আগে আপনার কথাই মনে পরলো।’

মনিমা হঠাৎ করে বললো, ‘তুই আমার ঠিকানা কিভাবে পেলি?’

‘বাবার পরে দাদীমাই আমাকে আগলে রেখেছে। বাবা তো সময় দিতে পারতো না কাজের ব্যাস্ততায়। আমার বেড়ে উঠা দাদীমার কাছেই। মামনি, মানে বাবার স্ত্রী আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না দাদীমা বুঝতে পারতেন। দাদীমা যখন মৃত্যু সহ্যায় কাতরাচ্ছিলো সেদিন একটা বাক্স আমার হাতে দিয়ে বলেন জীবনে কখনো বিপদের মুখোমুখি হলে এই ঠিকানায় সাহায্য চাইবি। আসা করি নিরাশ হবি না। ওখানেই উপরে বড় অক্ষরে লেখা ছিলো মিসেস খন্দকার। মায়ার মনিমা। সাথে আপনার আর মায়ের একটা ছবি।’

মনিমা চোখের জল মুছে বললেন, ‘ তোর যখন আট বছর বয়স তখন গিয়েছিলাম তোকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে তোর বাবা মানা করলেও আমি মাওয়াই মার কাছে আমার ঠিকানা দিয়ে আসি। এসেছিস ভালো করেছিস। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া কর। বাকি কথা পরে হবে।’

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

মনিমা ফোন দিয়ে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নিলেন। নিয়নকে উনার বড় ছেলের রুমে শিফট করে আমাকে নিয়নের রুমে থাকতে দিলেন। খাওয়া দাওয়া শেষে আমি দেরী না করে মনিমার কাছে সরাসরি জানতে চাইলাম, ‘মনিমা আমার মায়ের খবর জানেন? আমি আসলে মায়ের খোজ পাওয়ার জন্যই আপনার কাছে এসেছি। আমি জানি মা খারাপ। তবুও আমি একবার উনার সাথে দেখা করতে চাই। আমার কিছু জানার আছে।’

মনিমা আমার কথায় চুপ হয়ে গেলেন। বললেন, ‘কাল তোকে নিয়ে যাবো’

‘আজকে কি সম্ভব না! আসলে আমার খুব তাড়া আছে’- আমার দ্রুত উত্তর।

মনিমা হাতে পার্স নিয়ে জোড়ে অয়ন বলে ডাকলেন। সাথে সাথেই সকালের সেই রাগী ছেলেটা উপস্থিত। সে যথেষ্ট নম্র গলায় বললো, ‘বলুন মাতাজী!’

মনিমা বললেন, ‘রেডী হয়ে গাড়ী বের করো। এক জায়গায় যেতে হবে’

ছেলেটা বিরক্তিতে ব্রু যোগল একত্র করে বললো, ‘এখন সম্ভব না মা। আমার আজ সন্ধ্যায় ক্লাস আছে।’

মনিমা বললেন, ‘সন্ধায় কিসের ক্লাস তোমার?’ কন্ঠে হালকা রাগ বিদ্যমান।

‘মাস্টার্সের ক্লাস মা! মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি ভুলে যাও যে আমি একজন লেকচারার ছাত্র নই!’

মনিমাএকটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তৈরি হয়ে এসো আর্লি’

ছেলেটি চলে গেলো। পাচ মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে এসে বলল, ‘চলো!’

মনিমা আমার হাত শক্ত করে চেপে বেড়িয়ে পরলেন। গাড়ি এসে থামলো। সন্ধ্যা ঠিক হবে হবে ভাব। বাহিরে প্রচুর ঝড়ো হাওয়া। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। আমি বাহিরে আসতে মনিমাকে অয়ন নামের ছেলেটা কি যেনো চোখের ইশারা করলো। কেমন ভয় লাগলো আমার! এমন নিরব শুনশান জায়গায় আসার মানে!

ভেতরে প্রবেশ করতেই একজন বয়স্ক দাড়ি ওয়ালা লোক মনিমাকে সালাম করলো। অয়ন গাড়ি পার্ক করতে চাইলেও পারলো না। মুহুর্তে ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলে দৌড়ে সবাই ছাউনির নিচে গিয়ে দাড়ালাম। অয়ন মনিমাকে বললো, ‘মা ইনি কি নীলিমা…’

আন্টি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। ছেলেটা এক হাত মুখে রেখে লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন। হুট করে আমার একহাত ধরে আমাকে সহ বৃষ্টির মধ্যে হাটা শুরু করলেন। একটা সুন্দর বাগান বিলাশ ফুল গাছের সামনে এনে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন,

‘তোমার মা!’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।গাছের পেছনে হালকা উচু স্তম্ভ। বুঝতে পারলাম এটা কারো কবর। হালকা ঢুক গিললাম। অয়নের দিকে তাকাতে সে বললো, ‘এই টুকুনি মেয়ে ছিলে অথচ কত জেদ তোমার। টেনেও নিয়ে আসতে পারিনি। ইচ্ছে করছিলো ঠাটিয়ে দুটো চড় দেই তখন। নিজের মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণে কেউ এমন পিছ পা হয় জানা ছিলো না!’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিসব আবুল তাবুল বলছে ছেলেটি! আমার কিছুই বোধ গম্য হচ্ছে না। বৃষ্টির ফোটা গুলো আমার মুখ বেয়ে পড়ছে। কবরের দিকে তাকাতেউ মনে হলো হুট করে জানা হৃদয়ে রক্তক্ষরণে প্রকৃতি কি তবে কাদছে?

চলবে….