মায়া পর্ব-০৮

0
426

#মায়া
পর্ব ৮
লেখা – #Alisia_Amber
[কপি করা নিষেধ]
.
ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। মনিমা অয়নকে ডাকছেন বেশ উচু গলায়। সে যেভাবে আমাকে নিয়ে এসেছিলো সেভাবেই আবার মনিমার কাছে নিয়ে গেলো। মনিনা উচ্চস্বরে ধমক মেরে অয়নকে বললো, ‘এটা কি ধরনের অসভ্যতা অয়ন! তুই মেয়েটাকে এভাবে নিয়ে যেতে পারিস না। বেচারী তো জানতোও না যে তার মা বেচে নেই’

‘মা তুমি সেদিনকার কথা ভুলে গেলে। যেদিন হাজার অকুতি মিনুতি আদরও সে বুঝে নি!’ অয়নের স্পষ্ট জবাব।

‘একটা পাচ ছয় বছরের মেয়ে কিই-বা বুঝবে! তাছাড়া সেদিন ওর বাবা ওকে আসতে দিলে আমরা ওকে আনতে পারতাম। এখানে বাচ্চা মেয়েটার কোনো দোষ দেখছি না আমি’- মনিমার তেজি উত্তর।
অয়ন ফোসফাস করতে করতে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়িতে চলে গেলো। আমার সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ল্যাপ্টে আছে। আমি যেনো হুশ হারিয়েছি। সাডেন শক নামক একটা বস্তু আমাকে ঘায়েল করেছে। আমি নিজের ভারসাম্য রক্ষা করায় ব্যার্থতা বরণ করে নিলাম।

পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতে সামনে নিয়নকে দেখতে পেলাম। সাথে সাথেই তার চিল্লি স্বরুপ ডাক, ‘মা ভাইয়া জলদি আসো আপু তো ঘুম থেকে উঠে পরেছে।’

মনিমা তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে আমার কপাল চ্যাক করে বললেন। রাতে কি জ্বর টাই না এসেছিলো। আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি মা। হাত মুখ ধুয়ে নে ভালো লাগবে। আমি গরম গরম রুটি সবজি নিয়ে আসছি।’

আমি মাথা কাত করে সায় জানালাম। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম।

‘মনিমা আপনি দেখতে খানিকটা আমার মায়ের মত। আচ্ছা আমি কি দেখতে মায়ের মত?’

মনিমা আমার কথায় গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার দিকে তাকালেন তারপর বললেন, ‘হুবহু তোর মায়ের মতই তুই!’

লম্বা একটা দম নিলাম। ‘আমার উনাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো। আমি একবার উনাকে সরাসরি দেখতে চেয়েছিলাম। উনাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম উনি আমাকে ফেলে রেখে কেনো চলে গিয়েছিলেন। আমাকে সাথে করে আনেন নি কেনো?’

মনিমা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই বড্ড অবুঝরে মায়া। পরের ঘরে কি আর সুখ থাকে’

মনিমা আবারো বললেন, ‘তোর নতুন মা, মানে…’

আমি বুঝতে পেরেছি উনি কি জানতে চাইছেন। তাই বললাম, ‘ভালো মনিমা। আমিই ভালো না। দেখেন না মা বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তাইতো আমাকেও আমার বর চায় না।’

মনিমা অবাক হয়ে বললেন, ‘তোর বিয়ে? দেখতো কিছুই জানি না’

‘আর জেনে কিই বা হবে মনিমা। আমার ভাগ্যটাই ভীষণ খারাপ। না মা পেলাম, না পরিবার, না বর কিছুই না। সবশেষে আমি বড্ড একা! বাবা হুট করেই বিয়েটা ঠিক করেছিলো। বিয়ের কিছুদিন পর আমার শশুড়মশাই মারা যায়। আমি তখন ও বাড়িতে গেলে সেদিনই ওরা চায় মানে আমার শাশুড়ি, আমার আর শুদ্ধর যেনো ডিভোর্স হয়ে যায়। সেদিন শুদ্ধ যখন আমাকে সাপোর্ট দিয়ে ও বাড়িতে থাকতে দেয়। মনের ভেতর এক টুকরো আশা স্বপ্ন এসে ধরা দেয়। এই বুঝি আমার ছোট্ট একটা সংসার বুননের স্বপ্ন সত্যি হলো। কিন্তু! সবই ভাগ্য।
শুদ্ধ নিজের মতের বিরুদ্ধেই আমার শশুড়ের কথা ভেবে এ বিয়েতে রাজি হয়। যেখানে আমার শাশুড়ি আর শুদ্ধ কেউই রাজি ছিলো না। সবকিছুর পরও শুদ্ধর ব্যাবহার আমাকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছে যে সে এ সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে চায়! কিন্তু আমার কপালে এত সুখ নেই মনিমা। একদম নেই।’

মনিমা হুট করেই আমাকে জড়িয়ে নিলেন। ‘কিচ্ছু হবে না তোর মা। কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

________

দুদিন কেটে যাওয়ার পর এ বাড়িতে নিজেকে কেমন আলাদা মানুষ হিসেবে মনে হচ্ছে। এমন না যে মনিমা আমাকে কিছু বলেছেন। কিন্তু তাদের সুখের সংসারে আমার নিজেকে বার্তি ঝামেলা বই আর কিছুই মনে হচ্ছে না। তবে অয়নের সাথে মনিমার যেদিন ঝগড়া হলো। তাও আমায় নিয়ে সেদিন মনে হলো এ বাড়িটা আমার জন্য নয়। আর এক মুহুর্ত দেরী করলে এই সংসারে অশান্তি সৃষ্টির কারণ হয়ে দাড়াবো আমি। আমি ব্যাগ নিয়ে মনিমার রুমে গিয়ে বললাম, ‘আমি যাচ্ছি মনিমা।’

মনিমা আমার কথায় অবাক হয়ে বললেন, ‘যাচ্ছিস মানে? কোথায় যাবি’

আমি হালকা হেসে বললাম, ‘যেতে হবে মনিমা’

মনিমা আমার কাছে এসে বললেন, ‘অয়নের ভার্সিটিতে ভর্তি হবি তুই। অয়ন সব ব্যাবস্থা করে দেবে।’

আমি হাসলাম। বললাম, ‘একবার আপনায় জড়িয়ে ধরি মনিমা?’

মনিমা কিছু বলার আগে টাইট করে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর বললাম, ‘আসি। ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয় দেখা হবে।’

মনিমার হাজার বলা উপেক্ষা করে আমি বেড়িয়ে পরি। আমার গন্তব্য কোথায় আমার জানা নেই। তবে আমি চাই না কিছুতেই চাই না আমি কারো সংসারে অশান্তির কারণ হই। আমি স্পষ্ট শুনতে পাই মনিমা অয়নকে বিয়ে করার জন্য প্রেশারাইজ করছিলো। ইন ফ্যাক্ট আমাকে বিয়ে করার জন্য বলছিলো। অয়ন চায়না এখন বিয়ে করতে এক পর্যায়ে উচ্চ বাক্য ব্যায়ে সে প্রস্থান করে। যা মনিমার চোখের কোনে জল এনেছিলো। আমার কষ্ট লেগেছে। মনিমাকে দেখলে আমার মায়ের মত লাগে। আমি চাই না সে কষ্ট পাক।

আকাশের দিকে তাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম৷, ‘আমার কি কোথাও জায়গা নেই? আমি কি খুব অসহায়? মা নামক মানুষটিকে একটিবার দেখার সুযোগ আল্লাহ আমাকে কেনো দেয় নি? আমি উনার কাছে জানতে চাইতাম সে কেনো আমাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। আচ্ছা মা যদি বেচে থাকতেন এতদিন পর নিজের মেয়েকে দেখতে পেয়ে কি আবেগে আপ্লুত হয়ে পরতেন? আমাকে জড়িয়ে ধরতেন? উনার কাছে সারাজীবন রেখে দিতেন? বড্ড জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।

মনিমা সেদিন মায়ের কথা যখন বলছিলো। আমার ভীষন আফসোস হচ্ছিলো। আমার সেসবের কিছুই মনে নেই। বাবার কাছ থেকে মা উনার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে ফিরে আসলেও উনি আর দ্বিতীয় বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নি। উনি প্রেমিকের কাছেও যান নি। তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে বাবার কাছে ফিরতে চাইলেও বাবা গ্রহণ করেন নি। এর কিছুদিন পরই মায়ের ব্রেন টিউমার ধরা পরে। মায়ের অপারেশনের আগে মা একটি বারের জন্য আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই অভাগা আমি শেষ বারের জন্য মায়ের দর্শনে আসি নি। অয়ন ছিলো মায়ের চোখের মনি। মায়ের মৃত্যুর আগ অবদি সেই মায়ের সেবা করতো। আর তাইতো তার আমার উপর এত এত রাগ!
অপারেশনের পরদিনই মা মারা যায়। বাবা নাকি মায়ের লাশ দেখতেও আসেন নি। আচ্ছা বাবা না মাকে ভালোবাসতেন! তবে কি ঘৃনার পরিমানটা ভালোবাসাকেও ছেড়ে গিয়েছিলো!’

বিলবোর্ডে ছোট করে লেখা, ইলাস হোস্টেল। নিচে ঠিকানা দেয়া। আপাদত একটা হোস্টেলে উঠাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। বাসে উঠবো এমন সময় হাতে টান পরায় পিলে চমকে উঠলাম। একি অয়ন!

সাথে সাথেই বললাম, ‘অয়ন ভাই আপনি!’

অয়ন দাতে দাত পিষে বলল, ‘হ্যা আমি। কোন সাহসে একা একলা মেয়ে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছো! ডু ইয়্যু হেভ এনি আইডিয়া আমি কতক্ষন যাবত তোমাকে খুজে যাচ্ছি? স্টুপিড মেয়ে কোথাকার।’

উনার এত এত কথার পেছনে আমি কোনো যৌক্তিকতা খুজে পেলাম না। আমি তো মনিমাকে বলেই বেড়িয়ে আসলাম। তবে?

অয়ন আমার হাত ধরে এনে গাড়িতে বসাতে চাইলে আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘সব সময় এভাবে টানবেন না। আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া আমি মনিমাকে বলেই বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছি। আমি আমি বাসায় যাবো’

অয়ন আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বাসায় যাবে মানে? কোন বাসায় যাবে? এই মুহুর্তে যাওয়ার মত কোনো জায়গাই তোমার অবশিষ্ট নেই মায়া। সারাদিনে তোমাকে নিয়ে রিসার্চ করা আমার শেষ! কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলো!’

আমি হালকা রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে এভাবে জোর করতে পারেন না অয়ন ভাই।’

উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। গাড়ির চাকায় জোড়ে একটা লাথি দিয়ে বললেন, ‘ওকে ফাইন কোথায় যাবে বলো। আমি দিয়ে আসছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একা যাওয়া রিস্কি হবে তোমার জন্য’

‘আপনার সঙ্গে আমি সেইফ তার কি নিশ্চয়তা আছে!’

উনি আমার কথায় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বললেন, ‘আজকে নাহয় বাসায় চলো! তারপর তারপর…

কেমন হয়ে যেনো বললেন, ‘সকালে চলে যেও’

আমি একরোখা হয়ে গো ধরে বললাম, ‘নাহ! তা আর সম্ভব নয়!’

এরপর উনি যা করলেন তা ছিলো চরম অবাকের। দড়ি দিয়ে আমার দুহাত বেধে ঠোটে কস্টেপ চেপে দিয়ে বললেন। যাও যেথায় খুশি যাও। তারপর কোলে করে এনে গাড়ির ব্যাক সিটে বসিয়ে দুপাও বেধে দিলেন। আমি মুখ দিয়ে উম সাউন্ড করলে উনি গাড়ি লক করে চালানো শুরু করলেন। আশ্চর্য উনি কি আমাকে কিডনাপ করলেন?

চলবে কি?