মৃণালিনী পর্ব-০৩

0
373

#মৃণালিনী
#পর্ব ৩
ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা থেকেই একের পর এক পর্ব চলছে, একটুও শ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছিলো না মৃণালিনী। বৌভাতের বিভিন্ন রকম নিয়ম কানুনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছিলো সে। সকালের পর্বগুলো যাও বা ননদের চুপি চুপি করে দেওয়া সাহায্যে উতরে যাচ্ছিলো সে, তাল কাটলো পরিবেশনের সময়।

অতবড় হাঁড়ি থেকে ভাত তুলে পরিবেশন করা তার মতো মেয়ের পক্ষে বেশ দুষ্কর, তার ওপরে রান্নাঘরের দিক সে এর আগে কোনো দিনও মাড়ায়নি। ফলত সারি দিয়ে বসে থাকা গ্রামের গণ্য মান্য ব্যক্তিদের সামনে নিজের হাতে থালায় ভাত দিতে গিয়ে রীতিমত নাকানি চোবানি খেলো সে। বাম হাতে ভাতের হাঁড়ি ধরে ডান হাতে পরিবেশনের পর সেই হাত নিজের কাপড়ে মুছে ফেললো। কড়া চোখে নজর রাখছেন পারুলবালা, কুমুদ দেখছিলেন। ছেলের বউ কে সতর্ক করার আগেই চেঁচিয়ে উঠলেন বড়ো জা,

মা কি তোমার কিছুই শেখায়নি বাছা, শকড়ি হাত কাপড়ে দিলে?

মুহূর্তের মধ্যেই চোখ জলে ভরে উঠলো মৃণালের, জন্ম থেকেই মাতৃহারা সে, মৃত মা কে নিয়ে টানাটানি তার ভালো লাগলো না। চোখে জল দেখেই এগিয়ে এলেন কুমুদ, পুত্রবধূর হাত ধরে কাপড় পাল্টাতে নিয়ে যেতে যেতে কড়া চোখে এই প্রথম বড়ো জায়ের দিকে তাকালেন তিনি,

আজকের দিনেও মা কে নিয়ে না টানলে চলতো না দিদি!

তীক্ষ্ণ গলায় বড়ো জা কে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন কুমুদ, পারুলবালা থতমত খেলেন, কোনো কথা না বলেই চুপ করে গেলেন এই প্রথম, তার কতটা মৃণালিনীর জন্যে কষ্টে, কতো টা ছোটো জায়ের ধৃষ্টতায়, বলা মুশকিল।

ঘরে এসেও কান্না থামছিলো না মৃণালের, শাশুড়ি, ননদ দুজন মিলেই তাকে অনেক স্বান্তনা দিচ্ছিলো। কিন্তু ওর কাছে ব্যাপার টা অন্য রকম, বাবার কাছে সে কোনোদিনও বকুনি খায়নি। আর রমণী বাবুর অনুমতি ছাড়া তার আদুরে মেয়ে কে শাসনের সাহস কোনো কাজের লোক দেখায় নি। তাই এই প্রথম বার কারোর কাছে বকুনি খেয়ে সে একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলো, তার অপরাধ টা কোথায় বুঝে উঠতে পারছিলো না কিছুতেই।

এদিকে আর কিছুক্ষন পরেই মেয়ের বাপের বাড়ির লোকজন উপস্থিত হবে, একমাত্র কন্যার কান্না দেখে রমণী বাবু ক্ষুব্ধ হবেন এটা ভেবেই মনের মধ্যে একটু অশান্তি কাজ করছিলো পারুল বালার। কেনো কে জানে মিষ্টি মুখের মেয়েটির প্রতি একটু মায়া পড়ে গেছে তাঁর, তাই তিনি এবার নিজেই মৃণালের ঘরে উপস্থিত হলেন।

শাওড়িরা যা বলে সে তোমার ভালোর জন্যেই বলে বুঝেছ বাছা, আমার বাড়ির বউ কে গাঁয়ের লোক নিন্দে মন্দ করলে কি আর আমার ভালো লাগবে বলো?

মৃণালের পাশে গুছিয়ে বসে বললেন তিনি।

তোমার যাতে নিন্দে মন্দ না হয় তাই এসব বলা বুঝলে? আমি তো বাপু তোমায় ভালো করেই বলেছি, আমার শাওড়ি তো আমায় এক রাত খেতে দেয়নি, আচার চুরি করেছিলুম বলে!

আচার চুরি! মুহূর্তের মধ্যেই কান্না মুছে কৌতুকের ছাপ মৃণালের মুখে, নতুন গল্পের সন্ধান পেয়ে চোখ মুছে বড়মার দিকে ঘুরে বসলো সে।

আমিও শুনবো বড়মা! কি হয়েছিলো বলো?

সরমা ও খুব উৎসাহ নিয়ে বসলো পাশে এসে, মৃদু হেসে উঠে গেলেন কুমুদ, বড় জা কে কড়া গলায় কথা বলার পর থেকেই মনের মধ্যে বড্ড খারাপ লাগা কাজ করছিলো তাঁর, এতক্ষনে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি।

হারুর মা, বামুন মেয়ে কে গিয়ে বল, ছোটোর হাতে হাতে বাকি ভাত টুকু বেড়ে দেবেখন,

নিজে গুছিয়ে বসে বললেন পারুল বালা, গল্প বলতে তিনি বড্ড ভালোবাসেন।

গাঁয়ে ঘরে রাত শুরু হয় বড্ড তাড়াতাড়ি, যতক্ষন কুপি, লন্ঠন জ্বলবে ততক্ষনই তেলের খরচ, তাই সব মিটিয়ে তাড়াতাড়ি তেল খরচ বাঁচানোই প্রধান লক্ষ্য সব সময়। আর আজ তো সকাল থেকেই বৌভাতের জন্যে যথেষ্টই ক্লান্ত সবাই, তাই প্রায় সন্ধ্যে রাতেই খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে মৃণাল কে তার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো সরমা। খানিকক্ষন পরেই মায়ের দেওয়া আংটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো সৌম্য সুন্দর, সেই বউ নিয়ে বাড়ি ঢোকা ইস্তক বড়মার কড়া শাসনে একবারের জন্যেও নতুন বউয়ের মুখোমুখি হতে পারেনি সে।

শাশুড়ির শেখানো উপদেশ মেনে স্বামী কে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ানোর পরে বউয়ের হাতে আংটি পরিয়ে দিলো সৌম্য। কিন্তু আংটি তো তার মায়ের দেওয়া, শুধু আংটি দিলে চলবে কেনো! নতুন বউ কে ভালোবেসে কিছু নিজের থেকে উপহার দিতে ইচ্ছে হলো তার, আশা ছিলো আরও কিছু শাড়ি, গয়নাই চাইবে মৃণাল। পরের বার কলকাতা থেকে ফেরার সময় সেগুলো নিয়ে আসবে এরকমই কিছু ভেবে রেখেছিলো মনে মনে।

কিন্তু মৃণালের আবদার শুনে প্রায় চমকে উঠলো সে, মৃণাল আরও পড়তে চায়! কিন্তু এ বড়ো কঠিন মুহূর্ত, একে ফুলশয্যা, তায় নতুন বউয়ের প্রথম আবদার কোনো কিছু আর না ভেবেই কথা দিয়ে ফেললো মৃণাল কে, আজকের রাত টা সে কোনো ভাবেই নষ্ট হতে দিতে পারে না।

স্বামীর এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়া বোধহয় মৃণাল নিজেও ভাবতে পারেনি, খুব খুশি হলো সে। তার অনেকদিনের ইচ্ছে আরও পড়াশোনা করার, বাবা বলেছিলেন তাঁর ছাত্র নিজে পড়াশোনায় ভালো ছিলো, অধ্যাপক হয়েছে এখন, বউয়ের পড়াশোনা সে বন্ধ হতে দেবে না কোনো মতেই। সেই ভরসাতেই সৌম্যর কাছে পড়তে চাওয়ার আবদার করেছিলো সে, এক কথায় সে আবদার পূরণ হওয়ায় স্বামী কে অদেয় তার আর কিছু রইলো না।

বিয়ে বৌভাত পর্ব সমাধা হলো, পরের দিন সকাল থেকেই রান্না ঘরে ডাক পড়লো মৃণালের। আগের দিনের তার কাণ্ড কারখানা দেখেই পারুল বালা তার সাংসারিক জ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্টই অবহিত হয়েছিলেন, তাই এ যাত্রায় আর কোনো বিপদ বাড়াতে চান নি তিনি। ঘর কন্নার কাজ শেখা শুরু হলো তার। মৃণাল এমনিতে চুপ চাপ তাই কোনো বিবাদে না গিয়েই সেও শিক্ষায় মন দিলো, যতই হোক চৌধুরী বাড়ির বউ বলে কথা! কিছু না জানলে গাঁয়ের লোকেদের কাছে মান যায় যে!

দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটলে ছাদে চাটাই পেতে বসে গল্প গুজব করা এই বাড়ির রীতি, সেখানে যেমন আশে পাশের বাড়ির বউ মেয়েরা উপস্থিত হয় তেমনি কাজের বউ ঝিরাও থাকে। সেখানে আজকের আলোচনার বিষয় ছিলো মৃণালিনীর মতো কলকাতার ধিঙ্গী মেয়ে আদৌ চৌধুরী বাড়ির বউ হবার উপযুক্ত কিনা!

সবে হারুর মা কালকের তার এঁটো হাত কাপড়ে মোছার গল্প জমিয়ে শুরু করেছিলো এমন সময় সেখানে পারুল বালা প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখেই একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হারুর মা কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর একটা নিদারুণ প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো,

এবাড়ির খেয়ে পরে, বাড়ির বউয়ের নামে কুচ্ছ করাই যদি তোর কাজ হয় তাহলে বরং কাল থেকে তাই কর গিয়ে, কাজে আসার আর দরকার নেই ,

খুব শান্ত গলায় বলতে বলতে চাটাইয়ের ওপর বসে পড়লেন পারুল বালা, হারুর মা আর এক মুহুর্তও দেরি না করে তাঁর পায়ে ধরে কেঁদে পড়লো।

বড়ো ভুল হয়ে গেছে কর্তা মা, আর কোনো দিনও হবে নি গো, এবারের মতো মাফ করে দাও!

এবাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া মানে যে গ্রামের আর অন্য কোনো বাড়িতেও কাজ না পাওয়া সেটা তার থেকে বেশি আর কেই বা জানে! চৌধুরী বাড়ির বিরাগ ভাজন হওয়া মানেই ধোপা নাপিত বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্যাম সুন্দর কে চটিয়ে এ গ্রামে থাকা মুশকিল!

এমনিতে সে পারুল বালার খাস লোক, কুমুদ এর ওপর নজরদারীর কাজ সেই করে, এমনকি যেকোনো গোপন কাজে অনেক সময়ই সেই পারুল বালার পরামর্শদাতাও বটে, কিন্তু তা বলে বাড়ির বউ এর নিন্দে পাড়ার লোকের কাছে করা পারুল বালা একটুও সহ্য করবেন না।

শোনো বাছা রা, এখানে গল্প করার অনেক কিছু আছে, আমারই ছাদে বসে আমার বউয়ের নিন্দে কোরো না,

বাটার থেকে বার করা পান সাজতে সাজতে মুখ নিচু রেখেই কড়া গলায় বললেন পারুল বালা, সবাই চুপ করে রইলো। তাঁর নিজের যে খুব বেশি বউ পছন্দ হয়েছে এমনটা নয়, সে যথেষ্টই অকাজের সেটা তিনিও মনে মনে মানেন, কিন্তু তাই বলে বাইরের লোকের সমালোচনা তিনি বরদাস্ত করবেন না।

এতক্ষনে কুমুদ উপরে উঠে এসেছেন, হারুর মা পারুল বালার পায়ে ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে দেখে তিনি খুবই অবাক হলেন। হারুর মা যে বড়ো জায়ের একদম নিজের লোক সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, এবং যতদূর সম্ভব নিজের কোনো গোপন কথা ভুলেও তার সামনে প্রকাশ করেন না। সেখানে আজকের এই ঘটনার কোনো কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

আ মলো যা! তুই আবার মরা কান্না জুড়েছিস কেনো লা! কি হলো তোর!

হারুর মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কুমুদ, সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন পারুল বালা, তাঁর খাস ঝিয়ের ব্যাপারে কুমুদ কোনো কথা বলবেন এটা তিনি একেবারেই চান না। যদি বা তাঁর ক্ষমা করতে দেরি দেখে হারুর মা আবার কুমুদকেই কত্রী ঠাউরে ফেলে, তাই তিনি আর এক মুহুর্তও দেরি করলেন না,

যা এখান থেকে, কাঁসার বাসন গুলো পড়ে আছে কাল থেকে, বামুন মেয়ের সঙ্গে হাতে হাতে তুলে দে গিয়ে,

বলার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মুছে সিঁড়ির দিকে পা চালালো হারুর মা, এ বাড়িতে তার কাজ যে টিকে গেলো এ যাত্রায়, সেটুকুই আপাতত নিশ্চিন্ত করলো তাকে।
ক্রমশ