মৃণালিনী পর্ব-০৪

0
316

#মৃণালিনী
#পর্ব ৪
দুপুরের ঘটনার কিছুই সরমা বা মৃণালিনী জানতে পারলো না। এবাড়িতে দুপুরে ঘুমানোর কোনো উপায় নেই, পারুল বালা পছন্দ করেন না। দুপুরে মৃণাল কে তিনি বিশ্রাম নেবার অনুমতি দিয়েছিলেন শুধু আজকের দিনটার জন্যে, গত কয়েকদিনের ধকলে সে ক্লান্ত আছে তাই। কিন্তু দুপুর বেলা স্বামীর সঙ্গে এক ঘরে থাকা তাঁর পছন্দ নয়, তাই তাকে সরমা র ঘরে যেতে হয়েছে বিশ্রামের জন্যে, কিন্তু পরের দিন থেকে তাকেও ছাদে আসতে হবে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো, হারুর মা প্রতিদিনের মতোই লন্ঠন মুছে, তেল ভরে, একের পর এক লন্ঠন জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো। দুপুরের গল্প গুজব শেষ করে পাড়ার বউ ঝিরা এক এক করে বিদায় নিয়েছে, শ্যাম সুন্দর আর সৌম্য চাটাইয়ে বসে চা খাচ্ছেন, এমন সময় পারুল বালা বারান্দায় পাতা চাটাইয়ে এসে বসলেন।

বউ দিদি তুমি বসো একটু, আমি লন্ঠন টা নিয়ে আসি,

সরমা লন্ঠন আনতে নিচে যাচ্ছে দেখে মৃণালও পিছু পিছু নেমে এলো, এই অন্ধকারে ওর পক্ষে একা ওপরে বসে থাকা কোনো মতেই সম্ভব নয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শ্বশুর এবং স্বামী কে বসে থাকতে দেখে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো মৃণালিনী, না হলেই বড়ো মা রেগে যাবেন!

হারুর মা আর এ সংসারের কাজে খুব বেশি মন দিতে পারছে নে, আমি বামুন মেয়ে কে বলেছি তার ভাইঝি কে এনে দিতে,

শান্ত গলায় চাটাইয়ে বসে চা খেতে থাকা শ্যাম সুন্দর কে উদ্যেশ্য করে বললেন পারুল বালা, এসব ব্যাপারে শ্যাম সুন্দর খুব বেশি মাথা ঘামান না, তিনি শুধুই মাথা হেলালেন। হারুর মা চমকে তাকালো, দুপুরের রাগ যে পারুল বালার পড়েনি সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারছিলো সে। তার জায়গা যে নতুন কেউ নিতে চলেছে এটা বুঝেই মুখটা করুণ হয়ে গেলো তার।

কুমুদ বেশ খানিকটা দূরে তুলসিমঞ্চে সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরের দিকে আসছিলেন, বড়ো জা এর কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

আই বুড়ো মেয়ে, ওকে কি বাড়িতে এনে রাখা ঠিক হবে দিদি!

কুমুদ এর কথা আর কবেই বা গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর বাড়িতে, তাঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন পারুল বালা,

সব কথায় কথা কি না বললেই নয় ছোট!বয়স হয়েছে আমার, ছোটাছুটির কাজ করতে পারিনে, হারুর মার অন্য কাজও তো থাকে নাকি! আর তোমার বিদ্যের জাহাজ বউ যে কতো কাজের সেতো বোঝা হয়েই গেছে!

কুমুদ চুপ করে গেলেন, হারুর মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, বামুন দিদির ভাইঝি যে তার চাকরির বিনিময়ে এখানে আসছে না সেটা জেনে সে শান্তি পেলো।

পারুল বালা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, নিজের পছন্দের কাজের লোক কে তিনি কখনোই ছাড়াবেন না, কিন্তু তার ওপর থেকে চাপ একটুও হালকা করতে চান না তিনি! আজকের চাপের ফলস্বরূপ হারুর মা যে আরও বেশি করে তাঁর কথায় উঠবে বসবে, সেটা তিনি ভালোই জানেন।

আ মরণ! এখানে বসে হা করে কথা গিলছে দেখো! যা এখান থেকে, লন্ঠন গুলো কি ঘরে ঘরে আমি দে আসবো?

কড়া গলায় হারুর মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলতেই তাড়াতাড়ি লন্ঠন হাতে উঠে গেলো সে, এবার দেওরের দিকে ঘুরে বসলেন পারুল বালা।

তখনই পই পই করে বলেছিলুম ঠাকুর পো, কলকেতার মেয়ে এনো নে, আমাদের ঘরে দোরে এসব মেয়ে চলে নে। সামান্য এঁটো কাটার জ্ঞান টুকুও নেই গা! কতো লোকের মুখ তুমি বন্ধ রাখবে বলো তো! আজ বাড়ির ঝি বলছে, কাল পাড়ার লোকে বলবে! একে বিদ্যের জাহাজ তায় বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে! এর দ্বারা আর যাই হোক ঘরের কাজকর্ম হয়না, আর যে জন্যে বড়লোক বড়লোক করে হেদিয়ে মরলে, তারই বা কি হলো? গায়ের গয়না দেখেছো! হাভাতে ঘরের মেয়েকেও এর থেকে বেশি সোনা দেয়।

বড়ো জার প্রবল বাক্যবাণে র মধ্যেই একটু মৃদু গলায় বলার চেষ্টা করলেন কুমুদ,

আহা! মা মরা মেয়ে, তার বাপ অতো দেওয়া থোওয়ার কথা বোঝেন নাকি! তিনি নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকেন! আর আমার গয়নাই কি কিছু কম আছে দিদি, সেতো ও আর সরমাই পাবে!

ওই বউ নিয়ে একটু সোহাগ কম কর ছোটো! বাপ না হয় বোঝে না, কিন্তু সংসারে কি আর কোনো আত্মীয় কুটুম নেই গা! তত্বের জিনিস পত্র দেখেছিস! ওসব কাপড় আমাদের বাড়ির ঝিদেরও দিই না আমরা! যদি ভাবিস বিদ্যেধরী বউ কে তেল দিলে সে তোকে সংসারের গিন্নি বানাবে, তাহলে সে গুড়ে বালি, এই এক্ষুনি তোকে বলে দিলুম!

ছোটো জা কে থামিয়ে দিয়ে বললেন পারুল বালা, মুখে স্বীকার না করলেও এই ভয় যে তাঁর মনের মধ্যে বিলক্ষণ রয়েছে সেটা তিনি মনে মনে জানেন নিজেই। কুমুদ স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন, শ্যাম সুন্দর এক মনে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছেন, কুমুদ কে বৌদি র বলা কথার কোনো প্রতিবাদ তিনি কখনই করেন না।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই নিজের আর তার বাবার নিন্দে শুনছিল মৃণালিনী, সে এইসব গ্রাম্য কুট কাচালি তে খুব বেশি অভ্যস্ত নয়, সরমা আস্তে করে তার হাতে চাপ দিলো। সে ছোটো থেকেই বড়ো মার কথা শুনে অভ্যস্ত কিন্তু বৌদি যে যথেষ্টই দুঃখ পেয়েছে সেটা সে বুঝতে পারছিলো। বৌদি কে ওখানেই দাঁড়াতে বলে লন্ঠন আনতে নিচের দিকে নামতে লাগলো সরমা, সে নিচে নামতেই চাটাইয়ে বসে থাকা সবার চোখই ওপরের দিকে উঠলো, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা মৃণালিনী কে প্রথম কুমুদ ই দেখতে পেলেন!

ওমা! ওখানে একা দাঁড়িয়ে কেনো! নিচে নেমে এসো!

মৃণাল এর চোখ ততোক্ষনে জলে ভরে গেছে, এই মুহূর্তে সেটা লোকাবার জন্যে এই অন্ধকার সিড়িই সব থেকে নিরাপদ বলে মনে হলো ওর। বউ কে ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পারুল বালার কোনো হেলদোল না হলেও, সৌম্য যথেষ্টই অস্বস্তিতে পড়লো। একবারের জন্যে শ্বশুর মশাইয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, অষ্টমঙ্গলাতে কলকাতায় ফিরে গিয়ে মৃণাল তার বাবার কাছে কি বলে সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলো সৌম্য সুন্দর।

নিজেকে শিক্ষিত আধুনিক মনস্ক দাবি করে আসা সৌম্য রমণী বাবুর মুখোমুখি কি ভাবে হবে তার ভাবনা ভাবতে লাগলো। সে নিজে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, কিন্তু পারুল বালা কে থামানো মুশকিল। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মাও তার দিকেই তাকিয়ে আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে বড়ো মা কে থামানোর কোনো উপায় সে খুঁজে বের করতে পারছিলো না।

আহ! ছাড়ো এসব এখন! তাদের কলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি, ফিরে এসে আবার সৌম্য কে কলকাতা ফিরতে হবে তো! কলেজের ছুটি তো শেষ হয়ে এলো প্রায়,

এতক্ষনে বৌদির দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর, তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, ভবিষ্যতে যে ছেলের শ্বশুরের সম্পত্তি তাঁর হাতে আসবে তিনি জানেন সেটা, তাই সামান্য তত্বের কাপড় আর বউয়ের গায়ের সোনার মতো তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাথা ঘামান না। তিনি আরো বেশি কিছুর আশায় আছেন। নিজেকে গিন্নি মানলেও দেওর কে মনে মনে যথেষ্ট সমীহ করে চলেন পারুল বালা, দেওরের বিরক্ত গলা অবশেষে তাঁর মুখ বন্ধ করলো।

আমার সঙ্গে একটু ঘরে এসো তো মা,

শাশুড়ির কথায় সিঁড়ি থেকে নেমে তাঁর ঘরে গেলো মৃণাল,

চোখে জল কেনো! বাবার জন্যে মন কেমন করছে বুঝি!

মৃণাল কে উদ্যেশ্য করে বললেন কুমুদ, যদিও চোখে জলের আসল কারণ তাঁর কাছে অজানা ছিলো না, তবুও কথাটা ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন তিনি। মৃণাল মাথা নাড়লো ঠিকই কিন্তু চোখের জল বন্ধ করা তার নিজের হাতে ছিলো না।

এটা শ্বশুর বাড়ি মা গো, মেয়েদের কতো কিছু সহ্য করতে হয়, আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবে দেখো! আর এটা তো তোমার নিজের বাড়ি, বাড়ির লোকেরা তো কতো কিছুই বলে সব মনে রাখতে নেই, তাতে নিজেরই কষ্ট বাড়ে,

কুমুদ এর গলায় সহানুভূতির সুর কষ্ট করে চেপে রাখা কান্না কে বাইরে এনে ফেললো এতক্ষনে, শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো মৃণালিনী।

বড়ো মার কথায় কিছু মনে করো না, উনি পুরনো দিনের মানুষ, অতো ভেবে কিছু বলেন না!

রাতে বউ কে একা ঘরে পেয়ে বললো সৌম্য, সন্ধ্যে থেকেই মৃণালিনীর গম্ভীর মুখ লক্ষ্য করে খুবই অস্বস্তিতে আছে সে। মৃণাল চুপ করে রইলো, মুখে কিছু না বললেও সে যে মনে মনে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছে সেটা বুঝতে পারছিলো সৌম্য।

দেখতে দেখতে অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি ফেরার দিন এসে গেলো। সরমা কোনো দিনও কলকাতা দেখেনি, মৃণালিনীর কাছে এ কদিনে অনেক গল্প শুনেছে সে, তারও সঙ্গে যাবার ইচ্ছে মৃণাল বুঝতে পারলো।

চলো না সরমা আমার সঙ্গে, তোমায় কলকাতা দেখাবো,

মৃণালিনীর প্রস্তাবে উচ্ছসিত হলো সরমা, এক কথায় রাজি সে, কলকাতায় তার অন্য আকর্ষণও আছে যে! কিন্তু বড়মা! তাঁর অনুমতি ছাড়া তো কিছুই সম্ভব নয়, তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব কে নেবে! স্বামী কে ধরে পড়লো মৃণাল, বড়মার কাছ থেকে সরমা কে নিয়ে যাবার অনুমতি আদায় করে দিতে হবে। বেচারা সৌম্য সুন্দর পড়লো আতান্তরে, একদিকে বড়মার ভয়, অন্যদিকে বউয়ের আবদার। তাও সাহস করে বড়মার কাছে প্রস্তাব পেশ করতে গেলো সে,

ভেতরে আসবো বড়ো মা?

নিজের ঘরের খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন পারুল বালা, সৌম্যর গলা শুনে উঠে বসলেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এসো বাছা, বলো কি বলবে?

দেওরের এই পুত্রটি কে সত্যিই ভালোবাসেন তিনি, বাড়ির সবাই কে যথেষ্ট শাসনে রাখলেও এর বেলায় খুব বেশি জোর তিনি খাটাতে পারেন না।

সরমা র খুব কলকাতা দেখার শখ, অনেকদিন থেকেই আমাকে বলেছে সে, কিন্তু আমি মেসে থাকি, সেখানে তো আর তাকে রাখা সম্ভব নয়, তাই এতদিন হয়ে ওঠেনি। এখন তো থাকার জায়গা আছে, তাই সে আমাকে ধরে বসেছে এবার, নিয়ে তাকে যেতেই হবে, কিন্তু তোমার অনুমতি না নিয়ে তাকে আমি হ্যাঁ বলি কি করে।

মৃণাল এর নাম একদম সামনে আসতে না দিয়েই বললো সৌম্য, যদি বড়ো মা জানেন যে বউয়ের কথায় সে বলতে এসেছে, তাহলে সরমা র যাওয়া আটকে দিতে তিনি একটুও সময় নেবেন না।

তা সেতো ভালো কথা বাবা, বৌমার বাড়ি তো আছেই এখন, নিয়ে যাও তাকে, চোখে চোখে রেখো একটু, যতই হোক আই বুড়ো মেয়ে তো!

বড়ো মা র কথায় ঘাড় হেলালো সৌম্য, বড়মা এক কথায় রাজি হলেন দেখে একটু অবাকই হলো সে। কিন্তু অনুমতি তো পাওয়া গেছে, তাই আর বেশি মাথা খাটাতে চাইলো না সৌম্য।

পারুলবালা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, একা বউ কে সৌম্যর সঙ্গে তিনিও পাঠাতে চান না, তাই মনে মনে সঙ্গে নিজের পছন্দের কাজের লোক হারুর মা কে পাঠাবেন বলে ঠিক করেই রেখেছিলেন। এবাড়ির গোপন খবর তাঁকে সেই দেয় নিয়মিত, বউয়ের সঙ্গে কি কথা সৌম্য বলছে, সেটার খোঁজ রাখাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যেই তো পড়ে নাকি! কিন্তু হারুর মা চলে গেলে আবার তাঁর এদিকের রাশ যে আলগা হয়ে যায়, কুমুদের খবর তাঁকে কে দেবে!

তাই সৌম্য যখন সরমা কে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইলো কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলেন তিনি, যাক কেউ তো সঙ্গে যাচ্ছে! বউ তো আর ননদের সামনে খুব বেশি হাত করতে পারবে না স্বামী কে। শেষ পর্যন্ত যে ভাবেই হোক না কেনো, সরমা র কলকাতা দেখার আর্জি মঞ্জুর হলো।
ক্রমশ