মৃণালিনী পর্ব-০৫

0
295

#মৃণালিনী
#পর্ব ৫
যাবার দিন এসে এলো, সকাল বেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা পৌঁছতে প্রায় রাত হয়ে গেলো। বৌদির বাড়ির দরজায় নেমে অবাক হয়ে গেলো সরমা, এতো বড় বাড়ি! চারিদিকে এতো আলো! ইসস ভাগ্যিস ও এলো, না হলে ওর কতো কিছু না দেখাই থেকে যেতো!

মেয়ে জামাই কে দেখে রমণী বাবু এগিয়ে এলেন,

কেমন আছো মা?

বাবা কে দেখে চোখে জল এলো মৃণালের, এর আগে কোনোদিনও বাবা কে ছেড়ে থাকেনি। বউ এর চোখে জল দেখে সৌম্য একটু চিন্তায় পড়লো, পাছে বড়ো মা র বলা কথাগুলো শ্বশুর মশাইয়ের কানে পৌঁছে যায়।

কিন্তু মৃণালিনী যথেষ্টই বুদ্ধিমতী, সে তার দুঃখের কথা বলে বাবা কে একটুও কষ্ট দিতে চায় না। আর শ্বশুরবাড়ি র নিন্দে করা মানে যে কোথাও গিয়ে সেটা সৌম্য কেও ছোটো করে ফেলা হবে বাবার কাছে, সেটা বুঝেই সে একটুও মুখ খুললো না। রমণী বাবু জানতেও পারলেন না যে তাঁর আদরের মেয়ে মাত্র কয়েকদিন শ্বশুর বাড়িতে থেকেই যথেষ্ট সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে।

সৌম্য এবার অষ্টমঙ্গলায় এসেছে, তাই মেস বাড়ি ছেড়ে সে আপাতত শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদর খেতে ব্যস্ত। মৃণাল তার নিজের বাড়িতে ফিরে খুব খুশি, শ্বশুরবাড়ি কেমন, বাড়ির সবার কাছে সে গল্পই করে চলেছে সারাদিন। শুধু সরমা যেনো একটু চুপ চাপ, ওর কি বাড়ি ছেড়ে এসে মন খারাপ! ঠিক বুঝতে পারছে না মৃণাল।

কি হয়েছে তোমার? মায়ের জন্যে মন খারাপ? কলকাতা ভালো লাগছে না?

দুপুর বেলায় ছাদে বসে ননদ কে জিজ্ঞেস করে ফেললো মৃণালিনী। সরমা খুব একটা মুখচোরা নয়, বৌদির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো,

কি হয়েছে গো?

বেশ বিস্মিত হলো মৃণাল, ননদের মুচকি হাসির রহস্য সে কিছুতেই ধরতে পারছে না।

বিমল দা কে চেনো? দাদার বন্ধু?

হ্যাঁ, ঘাড় নাড়লো মৃণালিনী, চিনবে না কেনো, তার বাবারই তো ছাত্র, সেও তো প্রায় আসে এ বাড়িতে! কিন্তু তার খবরে সরমা র দরকার কি! সরমা হেসে ফেললো আবার।

তুমি তো কিছুই বোঝনা বউ দিদি, তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই যে আমার কোলকেতা আসা গো, একবার খবর দিতে বলো না দাদাকে। কিন্তু আমার নাম যেনো না আসে কোথাও!

মৃণালিনী আকাশ থেকে পড়লো, সে কি ভাবছিলো তার ননদ কে! গ্রামের মেয়ে হয়েও যে সে যথেষ্টই চালাক চতুর, তা এখন ভালোই টের পাচ্ছে সে। সে তো এই শহর কলকাতায় বসেও, বিয়ে ঠিক হবার পরেও কোনোদিনও সৌম্যর সঙ্গে একবারও কথা বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি!

এতক্ষনে তরুণী বয়সের ধর্মে ফিরে গেলো মৃণাল, খুব উৎসাহ নিয়ে ধরে বসলো সরমা কে, সব টা তার জানা চাই! সরমাও তো বলতেই চায়, না বললে বৌদির সাহায্য সে পাবে কি করে। তাই দাদার বন্ধু যে তাদের বাড়িতে প্রায় বেড়াতে যায়, এবং তার সেখানে যাবার কারণ যে সেই, সেটা সে ফলাও করে বলে ফেললো, শর্ত একটাই দাদার কানে পৌঁছবে না সে কথা!

সন্ধেবেলায় সৌম্য খাটে বসেছিলো বই হাতে নিয়ে, মৃণাল ঘরে এসে ঢুকলো। বউ কে দেখেই সৌম্যর অভিমান হলো, শ্বশুরমশাই যেহেতু স্যার, তাই তাঁর বাড়িতে খুব বেশি স্বচ্ছন্দ থাকতে পারছে না সে, আর তাঁর উপস্থিতি তে বউ কে সারাদিনে ঘরে ডেকে পাঠানোর সাহসও সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি সৌম্য।

আজ তোমার মেসে যাবে না?

বরের পাশে একটু ঘনিষ্ট হয়ে বসে বললো মৃণাল, আজ সরমা র কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে!

তুমি তো আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচো! তোমার আরও বেশি করে গল্প করার সুবিধা হয়!

সৌম্য র অভিমান বুঝতে পারলো মৃণাল, কিন্তু বেচারা সেই বা কি করবে! এতদিন পরে বাপের বাড়ি এসে সবার সঙ্গে গল্প করেই কেটে যাচ্ছে যে, আর তাছাড়া সে সরমা কে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, তাকে তো আর দাসী চাকরের ভরসায় ছেড়ে দিতে পারেনা! মা থাকলে তো এসব নিয়ে তাকে একটুও ভাবতে হতে হতো না। মায়ের কথা ভাবলেই সব সময় চোখ জলে ভরে আসে ওর, আজও তাই হলো! বউয়ের চোখে জল দেখেই থমকালো সৌম্য, সে এমন কি বলে ফেললো!

আরে! কি হলো? কি এমন বললাম আমি! তুমি সারাদিনে একবারও আসোনি, শুধু এই টুকুই তো বলেছি!

চোখের জল মুছে হাসলো মৃণাল,

কিছু না! এমনই! তোমাকে একটা কথা বলবো? রাগ করবে না তো?

রাগ করবো কেনো! বলো না!

মৃণালের মুখে হাসি আনতে চাওয়া সৌম্য তখন যে কোনো কথায় রাজি হতে প্রস্তুত!

আজ বিমল দাকে আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করবো ভেবেছি, বেচারা তো সারা বছর মেসে থাকে, সেভাবে তো খেতে পায়না। আর সেতো তোমারও বন্ধু তাই না, তুমি এখানে ভালো মন্দ খাচ্ছো, তারও তো ইচ্ছে হয় নাকি!

হটাৎ বিমলের জন্য বউয়ের এই দরদ কেনো বুঝতে চেষ্টা করছিলো সৌম্য। বিমলের অনেক দূরের গ্রামে বাড়ি, বাড়ির অবস্থা সেরকম ভালোও নয়, তাই জন্যেই তো সে নিজেও মাঝে মাঝেই সঙ্গে করে তার বাড়ি নিয়ে যায় বিমল কে। কিন্তু এখানে নিয়ে আসা! বাবা বা বড়মা যদি জানতে পারে, অবিবাহিত বিমল কে সে মৃণালের কাছে নিয়ে এসেছে তাহলে ভীষণ গন্ডগোল হবে। সরমা কে যে তাদের সঙ্গে সেই জন্যেই বড়মা পাঠিয়েছে, সেটা ভালোই বোঝে ও!

আবার বাড়িতে কেনো! তুমি বরং একটা কাজ করো, তুমি বামুন মাসি কে বলো রান্না করে কাউকে দিয়ে মেসে পাঠিয়ে দেবে,

মৃণালের এই আবদার রাখতে পারা কিছুতেই সম্ভব নয় সৌম্যর পক্ষে, অন্তত যতদিন সরমা আছে এখানে! কিন্তু মৃণাল কে সেকথা বলতেও রুচিতে বাধছিলো সৌম্যর, ও জানে এবাড়িতে অতো কড়াকড়ি নেই তাদের বাড়ির মতো, মৃণালিনী কোনোদিনও পর্দানশীন ছিলো না। কিন্তু মৃণাল কে দুঃখ দিতেও চাইছিলো না ও, তাই মোটামুটি একটা মধ্য পন্থা বেছে নিলো।

মৃণাল খুব আশাহত হলো, সরমা কে সে কথা দিয়ে ফেলেছে, যে করেই হোক বিমল দার সঙ্গে দেখা করাবেই, তাও আবার দাদার অজান্তে, এই মুহূর্তে তার কোনো উপায় আর সে খুঁজে পাচ্ছিলো না! দুজনেই যে সরমা র কথাই ভেবেছে নিজেদের মতো করেই, সেটা দুজনেই আর দুজন কে বলে উঠতে পারলো না। অগত্যা উঠেই পড়লো মৃণালিনী, ননদের সঙ্গে নতুন করে শলা পরামর্শ করতে হবে!

কি হলো উঠলে যে! আর একটু বসো না, এবারের মতো কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও, পরের বার ঠিক ডেকে নিয়ে আসবো,

মৃণালের মন রাখার জন্যে বললো সৌম্য, কিন্তু পরের বার তো আর সরমা থাকবে না, তাই তখন আর এসে কি হবে! মৃণাল একটু চিন্তা করলো,

আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি ব্রজ দাদাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো না হয়! তুমি বই পড়, আমি আসছি সরমার কাছ থেকে, ও বেচারা একদম একা বসে আছে!

মৃণাল প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলো, তার মাথায় অন্য পরিকল্পনা এসেছে।

একবার ঘরে যাও মা, কর্তা বাবু তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন,

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামছিলো মৃণালিনী ব্রজ দাদার কথায় ঘুরে দাঁড়ালো,

বাবা ডেকে পাঠিয়েছেন? কেনো?

তা তো জানিনে, আমাকে ডেকে দিতে বললেন,

ব্রজ চলে যাবার পরে বাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো মৃণালিনী, রমণী বাবু ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছেন সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মৃণাল। বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে মেয়েকে দেখেই বইটা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে হাত তুলে বসতে বললেন।

সৌম্য আমার কাছে এসেছিলো, বলছিলো তুমি পরীক্ষা দিতে চাও,

সেদিনের বলা কথাগুলো মনে রেখেছে সৌম্য, মনটা আনন্দে ভরে উঠলো মৃণালের, কিন্তু বড়ো মা কে কি বোঝানো সম্ভব হবে! ওকে অন্য মনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন রমণী বাবু,

কিছু ভাবছো মা?

না, বাবা কিছু না,

তাড়াতাড়ি বলে উঠলো ও, এই মুহূর্তে বড়ো মার কথা বলা সম্ভব নয়, তাতে বাবা কষ্ট পাবেন।

আমি তোমার সব বইপত্র গুছিয়ে দিতে বলেছি ব্রজ কে, ওখানে এসব পাবে না কিন্তু! তুমি নিজে একবার দেখে নিও সবটা, বাকিটা সৌম্য পরে নিয়ে যাবে বলেছে,

মাথা নাড়লো মৃণালিনী, প্রতি সপ্তাহেই তো সৌম্য বাড়ি যাবে, কিছু বাকি থাকলেও পরে পেয়ে যেতে অসুবিধা হবে না। বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে সরমা র কাছে যেতে গিয়েও আবার সৌম্যর ঘরে ফিরে এলো সে, সৌম্য খাটে পেছন ফিরে বসেছিলো, পেছন থেকে গিয়ে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরলো মৃণাল,

তুমি বলোনি তো বাবার সঙ্গে আমার পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে কথা হয়েছে!

সৌম্য হাসলো,

আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছি তুমি পড়বে, তাই বাবার সঙ্গে কথা তো বলতেই হতো!

কিন্তু বড়ো মা! উনি কি অনুমতি দেবেন?

জানলে নিশ্চয়ই দেবেন না, তবে যদি জানতে পারেন তবেই তো! কি ভাবে ওনার অজান্তে পড়বে, সেই সময়টুকু না হয় তুমি নিজের মতো করেই বার করে নিও!

স্বামীর কথায় নিশ্চিন্ত হলো মৃণালিনী, বড়ো মা র অজান্তে সময় ও নিশ্চয়ই বার করে নিতে পারবে, বিশেষ করে সরমা যেখানে ওর সঙ্গে আছে। সরমা র কথা মনে হতেই লজ্জিত হলো ও, ইস, সরমা যে নিচে ওর অপেক্ষায় বসে আছে, একদম ভুলেই গিয়েছিলো ও।

সরমা, বিমল দাদা কে আনতে পারা যাবে না, তুমি বরং চিঠি লেখো একটা, আমি ব্রজ দাদার হাতে পাঠিয়ে দেবো,

সরমা র ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো মৃণালিনী,

চিঠি! আমি তো লিখতে জানিনা বউ দিদি!

অবাক হয়ে গেলো মৃণাল, লিখতে জানে না সরমা! সে আবার কি কথা! তারই বয়সী একটা মেয়ে, যার দাদা কলকাতায় থেকে পড়ালেখা করেছে, সে কিনা লিখতে জানে না!

তুমি লেখাপড়া জানোনা!

বিস্মিত গলায় বললো মৃণাল,

বড়মা যে চান না আমি পড়ি, তাই বাবা আমাকে পড়তে দেননি,

খুব দুঃখের গলায় বললো সরমা,

তুমিই লিখে দাও না বৌদি দি, আমার হয়ে!

সরমা র প্রস্তাব টা মন্দ নয়, একটু ভাবলো মৃণাল। লিখে সে দিতেই পারে, কিন্তু সৌম্য তো তার হাতের লেখা চেনে! যদি কোনো দিনও দেখে ফেলে! একটু দোনোমনা করছিলো মৃণাল।

ঠিক আছে! কিন্তু শুধু এই বারটাই কিন্তু, তোমার দাদা জানতে পারলে খুব রাগ করবেন। তুমি বরং আমার কাছ থেকে লেখাটা শিখে নাও, এরপর তুমি নিজেই লিখো কিন্তু।

আপাতত সমস্যার সমাধান তো হলো! হাঁফ ছাড়লো সরমা! তার কলকাতায় আসা বৃথা হতে যাচ্ছিলো প্রায়! একটু পরেই চাকর ব্রজ কে হাত করে বামুন দিদির রান্নার সঙ্গে চিঠিটাও পাঠিয়ে দিলো মৃণালিনী,

চিঠি পেয়ে সে আসবে তো বউ দিদি, ঠিক করে সব লিখে দিয়েছো তো তুমি?

সরমা র আশঙ্কা কে হেলায় উড়িয়ে দেয় মৃণাল, আসবে না মানে! যা মন প্রাণ দিয়ে সে চিঠি লিখেছে, বিমলের এখানে ছুটে আসা শুধুই সময়ের অপেক্ষা!
ক্রমশ