মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-২৭+২৮

0
58

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – সাতাশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

ডাকে পাখি, খোলো আঁখি
দেখো সোনালী আকাশ,
বহে ভোরের বাতাস…।

ভোর পাঁচটা। পাখির কলতান নয়, শিশিরের টুপটাপ শব্দও নয়, ভোরের স্নিগ্ধ, শীতল বাতাসও নয়, এক মায়াবী কন্যার ঘুম ভাঙল আজ, একটা মিষ্টি সুর শোনে। মৃদুস্বরে ভেসে আসা গানের লিরিক শোনে। রাতে ফোন ভাইব্রেশনে রেখে ঘুমিয়েছিল উজমা। আধোঘুমে, আধোজাগরণে ফোনের কাঁপাকাঁপি টের পেয়ে স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি না বুলিয়েই ফোন কানে ঠেকিয়েছিল সে। তখুনি কানে এলো, এই লিরিকটা। ঘুমঘোরেই মুচকি হাসলো উজমা। শব্দ না করে মনোযোগ দিয়ে গান শুনতে চাইল। কিন্তু হলো না। এইটুকুর পরই ফারশাদ বলল,

-‘ঘুমকন্যা কি ঘুমোচ্ছে?’

-‘এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু এখন জেগে গিয়েছে।’

-‘তাই? কী করে ঘুম ভাঙল?’

-‘অচিনপুরের এক রাজকুমার ঘুমকন্যার কানের কাছে এসে চুপিচুপি একটা গাইছিল। সেই গান শোনে। তবে আমি রাগ করেছি ভীষণ।’

-‘কেন?’

-‘রাজকুমার খুব স্বার্থপর। পুরো গান শুনায়নি।’

-‘ঘুমকন্যার কি গান শুনতে ইচ্ছে করছে আরও?’

-‘হ্যাঁ, কিন্তু এইভাবে নয়। এত দূরে থেকে নয়। আমি চাই, রাজকুমার আমার খুব কাছে এসে, ফিসফিসিয়ে গানের সুরে ঘুম ভাঙিয়ে যাক।’

-‘আচ্ছা, মনে থাকবে। এরপর আর ফোনে নয়, একদম সামনে থেকে, গান গাইব, ঘুম ভাঙাব। হবে?’

ঘুমঘুম আবেশে ফারশাদের এই কথাগুলো এত চমৎকার শোনাচ্ছিল। উজমা শুধু শুনেই যাচ্ছিল। জবাব দিতে ইচ্ছে করছিল না তার। সারারাত এক অদ্ভুত স্বপ্নের সাগরে ডুবে ডুবে ভেসে থেকেছে। এত সুন্দর স্বপ্ন, এত সুন্দর ইচ্ছেরা বুঝি এতদিন গোপনে, নীরবে, ঘুমন্তই ছিল। ভালোবাসাটা মন উপলব্ধি করা মাত্রই সব স্বপ্ন ও ইচ্ছেরা ডালপালা মেলে মনের নীরব শান্ত অবস্থাকে উড়ুউড়ু করে দিয়েছে। মন তার ডানা মেলে উড়ছে তো উড়ছেই। এত নির্ভার, এত সুন্দর সব অনুভূতিকে এতদিন সে লুকিয়েছিল কীভাবে! ইশ, ভাবতেই তার শরীর-মন অজানা অনুভূতির ভাবাবেগে ভেসে যেতে শুরু করেছে। সুখ সুখ একটা স্বচ্ছ-সুন্দর ইচ্ছে মনের প্রবেশদ্বারে লুটোপুটি খাচ্ছে। তাকে উপলব্ধি করতে গিয়েই আনচান করে উঠছে মন। কী অদ্ভুত ক্ষমতা এই ভালোবাসার! কী অদ্ভুত সব অনুভূতিতে ঘিরে থাকতে বাধ্য করে সবসময়। চঞ্চলা প্রজাপতির মতো ডানা জাপটে এদিক-ওদিক উড়ে বেড়ায় আর সারাক্ষণ রঙিন রঙিন সব ইচ্ছেস্বপ্ন বুনে যেতে সাহায্য করে। পুরো রাত যে কখনও এত মধুময়, এত সুখকর হতে পারে জানা ছিল না তার। সে কণ্ঠ রোধ করে বেসালাম অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরেছিল মাত্র। অমনি ভেসে এলো,

-‘আবারও ঘুমিয়ে পড়েছেন?’

উজমা বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘না… ঘুমোইনি।’

-‘তাহলে? চুপ করে আছেন কেন? কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? বিরক্ত করে ফেললাম?’

-‘উঁহু, এরকম কিছু নয়। আমি ভাবছিলাম।’

-‘কী?’

-‘আপনার কথা।’

-‘রিয়্যালি? কী ভাবছিলেন?’

-‘আমি চাইছিলাম, আমার জীবনে যে আসবে সে যেন আমার খুব ভালো বন্ধু হয়। যার সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হওয়ার আগে, বন্ধুত্বের মতো একটা বিশ্বস্ত সম্পর্ক তৈরী হবে। যে আমাকে বুঝবে। আমার বিশ্বাস, ভরসা ও সাহস হবে। জীবনের প্রতিটা কঠিন ও জটিল মুহূর্তে যে আমাকে ধৈর্য ধরতে সাহায্য করবে। আপনি জীবনে আসার আগেও আমি কখনও বুঝিনি, আমার ভাবনার রাজ্যে সারাক্ষণ কেউ নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে, প্রতিটা উপলব্ধিতে, শয়নেস্বপনে কেউ একজন এত গভীরভাবে নিজের ছাপ রেখে যাবে। আমি জানি, ভালোবাসা একটা সুন্দর অনুভূতি। আর ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরা পৃথিবীর অন্যতম বিশুদ্ধ অনুভূতির একটা। গতদিন আপনি ওই কথাটা বলার পর থেকে আমি শুধু ভাবছিলাম, এই সুন্দর অনুভূতি ঠিক কত দূরে! আমার সমস্ত অনুভবে এখন শুধু আপনি আর এজন্যই ঘুমঘোরে একটা অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছি। ব্যস, এটাই ভাবছিলাম।’

স্বপ্ন হোক কি একান্তই গোপন চাওয়া, গতকাল রাতে চোখ বন্ধ হওয়া মাত্রই যে অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতির সাক্ষী হয়েছিল উজমা তা ছিল, একটা কঠিন মুহূর্তের মধ্যেও একটা আবছা অবয়ব এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে, তার হাতে হাত রেখেছিল। ভীষণ ভরসা ও ভালোবাসার সাথে বলেছিল, ‘ভয় নেই, আমি আছি।’ উজমা জানে না এই স্বপ্নের মানে কী! তবে এটা বুঝতে পেরেছে, ইচ্ছে হোক কি অনিচ্ছে, সে ফারশাদকে ভরসা করতে শুরু করেছে। সব কথা শেয়ার করার পর ফারশাদ নিজেও উজমার দেখা স্বপ্ন নিয়ে ভাবল। এমন একটা মুহূর্তকে খুব করে ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষায় আছে সে নিজেও। কবে এই মুহূর্ত জীবনে আসবে, ঠিক কত ঘণ্টা, কত সেকেন্ড ধৈর্য্য ধরতে হবে! তার সমস্ত মন কেবল সত্য, সুন্দর অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে চাইছে। সে ভীষণ আবেগে বলে উঠল,

-‘কোনো সম্পর্ক কিন্তু একদিনেই তৈরী হয় না। পর্যাপ্ত সময়, ধৈর্য্য, যত্ন, মমতা, বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসা দিয়ে একটু একটু করে একটা সম্পর্ককে গড়ে নিতে হয়। আজ থেকে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে পর্যাপ্ত সময়, যত্ন, মমতা, বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসার সাথে বাঁচিয়ে রাখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাদের দু’জনার। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সদাপ্রস্তুত। আপনি প্রস্তুত তো, বাটারফ্লাই?’

এই সামান্য কথার অর্থ পুরোপুরি বোধগম্য হওয়া মাত্রই অন্তরাত্মা, শীতল, সুখের আবেশে বিবশ হয়ে উঠল উজমার। সে চুপিচুপি বলল,
-‘হুম…।’

-‘কথা দিচ্ছি, আজ থেকে আমাদের সম্পর্কটা শুধু ভালোবাসার নয়, বন্ধুত্বের হবে। আমি আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু হব, ভরসা ও বিশ্বাসের অংশ হব, যার কাছে আপনি সবসময় নির্ভার ও নিরাপদ থাকবেন।’

-‘থ্যাংক ইউ।’

-‘এই কিপ্টামি মেনে নিব না। শুকনো মুখের থ্যাংকস দিয়ে আমার পোষাবে না।’

-‘তাহলে কী চাই?’

-‘এখুনি না, সামনে এসে চাইব। সব আবদার জমা থাকুক।’

-‘ঠিক আছে।’

-‘আমি এখন একটু দোয়া চাইব আপনার কাছে। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের দোয়া আসল। তাদের দোয়া কবুল হয় বেশি। অথচ আমার জন্য দোয়া করার কেউ নেই। আপনি আমার আত্মারও আত্মীয়, তা-ই আপনার কাছে দোয়া চাইতে আমার সংকোচ হচ্ছে না। বিদেশের মাটিতে দেশের হয়ে খেলতে এসে হেরে যাওয়া লজ্জার। প্রতিনিয়ত হার মেনে নেয়াটাও ভীষণ ধৈর্যের একটা ব্যাপার। খেলায় জিতাটা আসলে ভাগ্য। পরপর তিনটে ম্যাচে জয় না এলে এই সিরিজে হারটাই মেনে নিতে হবে। জয়-পরাজয় এগুলো সৃষ্টিকর্তার পূর্বনির্ধারিত জানি। তবুও দোয়া চাই। শুনেছি, দোয়ায় ভাগ্য পরিবর্তন হয়। আমার জন্য, দেশের জন্য, ক্রিকেট পাগল কিছু ভালোবাসার মানুষের জন্য, একটু দোয়া করতে পারবেন?’

এমন কাতর স্বরে কেউ কিছু আবদার করলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া যায়? উজমার প্রার্থনায় শুধু খেলায় জিত কেন, সর্বক্ষণ ফারশাদের সুস্থতা, দীর্ঘায়ু জীবন কামনা এখন তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটা যদি ফারশাদ জানত! সে মুচকি হেসে বলল,

-‘এটা আপনাকে বলে দিতে হবে না। আমার সবসময়ের প্রার্থনা, দেশে-বিদেশে আপনার সম্মান বজায় থাকুক। সিরিজে হার হোক কি জিত, আপনি আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা দিবেন। জিত না হোক, সম্মানটা বেঁচে থাকুক, এটাই চাওয়া।’

-‘আপনি ক্রিকেট খেলা দেখেন?’

-‘আগে দেখতাম না। এখন দেখি। খেলার আগামাথা কিছু বুঝি না। শুধুমাত্র আপনাকে দেখার লোভেই, টেলিভিশনের সামনে অথবা ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি।’

আজকের দিনের সেরা জোকস বোধহয় এটাই ছিল। উচ্চস্বরে হেসে উঠল ফারশাদ। বলল,
-‘আমি এত দামী কেউ না যে, আমাকে দেখার জন্য টেলিভিশনের সামনে অথবা ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে।’

-‘আর কার কাছে আপনি কী, আমি জানি না। তবে আমার কাছে আপনি সবসময়ই দামী। আমার জীবনে অমূল্য রত্ন ও দুর্লভ কোনোকিছু যদি থেকে থাকে, সেটা হলেন আপনি। ধন-সম্পদ কিংবা অর্থ দিয়ে আপনাকে বিচার করতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমার নেই।’

যে মন ক্ষতবিক্ষত, যে হৃদয় অসহনীয় ব্যথায় জর্জরিত, যে দেহে প্রাণ থাকলেও প্রাণের অস্তিত্ব এখানে সীমিত, সে মনে হাজারও ব্যথার মধ্যে প্রিয়জনের এই সামান্য কথা ব্যথানাশক ঔষধের মতো কাজ করতে সক্ষম। বাবা-মা যদি তাকে নিয়ে এরকম একটা পজেটিভ ভাবনা মনে ঠাঁই দিত, যদি তাদের তিন ভাই-বোনকে সুন্দর একটা পরিবার দিত, যদি প্রতিনিয়ত রবের নিকট দু’হাত তুলে সন্তানদের জন্য দোয়া করত, তবে তার জীবনে এত ব্যর্থতা নেমে আসত না। যে জীবনে আপনজনদের ছায়া নেই, তাদের দোয়া নেই, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা নেই, সে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা কতখানি কষ্টের হয়, সেটা যদি মানুষকে বোঝানো যেত। তাহলে ডানে-বামে এত আলোচনা-সমালোচনা ও বিভিন্ন যুক্তিতর্কের সৃষ্টি হতো না। এই পৃথিবীতে সবাই-ই স্বার্থের পিছনে ছুটে, স্বার্থের জন্য ভালোবাসে, স্বার্থের জন্যই কাছে আসে। কারও ভালোবাসাই স্বার্থহীন ভালোবাসা হয় না। জীবনের এতগুলো দিন পেরিয়ে, বহুদিন পর এই স্বার্থহীন ভালোবাসার দেখাসাক্ষাৎ পেয়ে ফারশাদ নিজেকে ভাগ্যবানদের একজন মনে করছে। উজমার কথা, চিন্তাভাবনা সবকিছুই তাকে শান্তি ও সুখ দিচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে গভীর করে দম নিয়ে বলল,

-‘আমার হৃদয় এতদিন অসুস্থ ছিল। ভীষণ ব্যথায় কাতর ছিল। আপনার অল্প সময়ের উপস্থিতি এতদিনের জমায়িত সব ব্যথা ও অসুস্থতা সারিয়ে দিয়েছে। আপনি শুধু আমার ভালোবাসা নোন, আমার সব ব্যথা নিরাময়ের ঔষধ হয়ে যাচ্ছেন। আপনাকে পেয়ে আমি সব ব্যথা, দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাচ্ছি। রবের নিকট অসংখ্য শুকরিয়া, তিনি আমাকে শূণ্য রাখেননি। পরিপূর্ণ করেছেন।’

***

এই বছরই ঊষার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হবে। এজন্য সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছে। চাকরি-বাকরি করার ইচ্ছে থাকলেও একটা যোগ্য সার্টিফিকেট না হলে ছোটোখাটো একটা চাকরিও পাওয়া যাবে না। এজন্য ক্লাস করার পাশাপাশি কোচিংও করে। যেন রেজাল্টটা ভালো হয়। সব চেষ্টারা যেন সুখের মুখ দেখে। বোনের মতো সে-ও পরিবারের পাশে থাকতে চায়, ভাইয়ের ভরসা ও সাহস হতে চায়। সপ্তাহে তিনদিন কোচিং হয়। আজ ক্লাস শেষে কোচিং হবে না, তা-ই দু’জন বান্ধবীকে নিয়ে পিকনিক ক্যাফেতে এসেছে একটু গল্পগুজব করে সময় কাটাবে বলে। মূলত এখানে আসা হয়েছে তার বান্ধবী রুমানার কারণে। সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে বলেই বান্ধবীদের নিয়ে এসেছে। রুমানা ও তার বয়ফ্রেন্ড আলাদা একটা টেবিলে বসেছে। একেবারে পিছনের কর্ণারে। ঊষা ও তার অন্য বান্ধবী শিপা আছে আরও একটা টেবিলে, ক্যাফের একদম মাঝখানে। টম্যাটো সস মিশিয়ে খুব আয়েশ করে ফ্রেঞ্চফ্রাই খাচ্ছিল ঊষা। খেতে খেতে হঠাৎই তার চোখ গেল ক্যাফের প্রবেশদ্বারের সামনে। অমনি মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি এসে ভর করল। ভেতরের দিকে এগিয়ে আসা পুরুষকে নাকানিচুাবানী খাওয়াতে ইচ্ছে করেই হাতের ঠ্যালায় সম্পূর্ণ টম্যাটোর সস ও পাশে থাকা কাপ ভরা গরম কফি ফেলে দিল উপরে। অসময়ে এরকম একটা সিচুয়েশনে পড়ে তড়িঘড়ি লাফ দিয়ে দু’পা পিছাল তানজীম। লাভ হলো না। জিন্সের প্যান্ট ইতিমধ্যে মাখামাখি। সে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে সামনে তাকাতেই ঊষা বলল,

-‘স্যরি, একদমই খেয়াল করিনি।’

রাগে ফুঁসতে শুরু করল তানজীম। বকতে গিয়েও থেমে গেল। এটা সেদিনের রিভেঞ্জ ছিল দিব্যি বুঝে গেল। ওইদিন ওয়াশরুমে গিয়ে সে শুধু নিজের পরনের পোশাক পরিষ্কার করেনি, ঊষাকে দিয়ে তার পরনের পাঞ্জাবী পরিষ্কার করিয়েছিল। বলেছিল,

-‘এটা আপনার জন্য নোংরা হয়েছে। আপনিই পরিষ্কার করে দিবেন আর শুকিয়েও আনবেন। ভেজা পাঞ্জাবী পরতে পারব না। ভাগ্যিস ভেতরে স্যান্ডো টি’শার্ট ছিল, নয়তো এখন আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হয়ে যেত।’

মেহমান দেখে কিছু বলার সুযোগ পায়নি বলে, পুরো পাঞ্জাবী ধুয়ে, সেটা আবার হিটারের নিচে শুকিয়েও দিতে হয়েছিল ঊষাকে। আজ তানজীমের রাগ, মেজাজ ও চুপসানো মুখ দেখে খুব মজা পাচ্ছিল ঊষা। টিস্যু হাতে নিয়ে অতি আদিখ্যেতা দেখিয়ে জিন্সে লেপটে থাকা সামান্য সস খুব যত্ন করে মুছে নিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,

-‘আপনার ভাবীকে গিয়ে বলবেন, উমাইরা ওয়াজেদাহ্, ওরফে ঊষা আপনাকে রিজেক্ট করেছে।’

তানজীম ভীষণ অবাক হয়ে বলল,
-‘হোয়াট! আমার বিয়ে তা-ও আপনার সাথে? স্বপ্ন দেখছেন না-কি ম্যাম?’

-‘স্বপ্ন নয়, সত্যিই। আপনার ভাবী ও মা ওইদিন আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ওনাদের এক কথা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাক। কিন্তু আমি এক্ষুণি বিয়ে করতে চাইছি না। আর যাকে চিনি না, জানি না, বুঝিও না, তাকে তো কোনোভাবেই বিয়ে করতে পারব না। তাছাড়া, আমার বোনের বিয়েটা এখনও আটকে আছে। আপুর বিয়ের আগে আমি নিজের কথা ভাবতে পারব না। যদি বাড়িতে আপনার মতামত জানতে চান ওনারা, তখন আপনি ফারিশাবুকে বলবেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। আপনি এই বিয়ে করতে পারবেন না। প্লিজ…।’

হাত জোড় করে মিনতির সুরে কথাগুলো শেষ করল ঊষা। তানজীম হতবাক হয়ে শুনল। তার মতো একটা পাত্রকে রিজেক্ট করার মতো সাহস ও মনের জোর এই পুচকি মেয়েটা পেল কোথায়? যদিও দেখতে পিচ্চি, কিন্তু কাজে বদের হাড্ডি। কীভাবে নাজেহাল করে দিল তাকে! সে চোখভরা বিস্ময় ও দ্বিধা নিয়ে বলল,

-‘আপনি কি শিওর, আমার সাথেই আপনার বিয়ের কথা হচ্ছে?’

-‘আশ্চর্য! আমি কি মিথ্যে বলছি না-কি? বিশ্বাস না হলে আপনার মা ও ভাবীকে জিজ্ঞেস করুন।’

একটা পুচকি মেয়ে তাকে রিজেক্ট করছে, ভাবা যায়? যত সহজে ঊষা এই কথাগুলো বলুক, তত সহজে তানজীম সেটা মেনে নিতে পারল না। সে শক্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,

-‘আমাকে বিয়ে করতে আপনার আপত্তি কোথায়?’

-‘আপত্তি একটাই, আপনাকে আমি চিনি না। দূর দূর পর্যন্ত আপনার সাথে আমাদের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই।’

ঊষার কথা শোনে কিছু একটা ভাবল তানজীম। এরপর মুচকি হেসে বলল,
-‘শুনেছি সিলেটীরা শুধু আত্মীয়ের মধ্যেই বিয়েশাদী করে। কখনও বিশ্বাস করিনি। এখন বিশ্বাস হলো। আমি আপনার আত্মীয় নই বলেই আমাকে রিজেক্ট করার একটা অজুহাত পেয়ে গেলেন। তবে আজ, এখানে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলছি, যদি কোনোদিন বিয়ে আমি করি, তাহলে সেটা সিলেটী মেয়েকেই করব আর সে-ই মেয়েটা হবেন, আপনি। ক্লিয়ার?’

বোকার মতো তানজীমের দিকে তাকিয়ে রইল ঊষা। কাঁধের বোঝা সরাতে গিয়ে যদি সেটা আবার কাঁধে চেপে বসে, কেমন লাগে? অসহ্যকর একটা অনুভূতি নিয়ে বান্ধবীদের রেখে ক্যাফে ত্যাগ করতে চাইল ঊষা। দু’পা এগোতেই পিছন থেকে তানজীম বলল,

-‘আমার হাতে সময় খুব কম। আজকের আগেও আমি কখনও ভাবিনী, এত তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। ভেবেছিলাম, ক’দিন পর দেশ ছেড়ে চলে যাব, ফিরব আর দুই থেকে তিন বছর পর। এরকম সিচুয়েশনে বিয়ে নিয়ে কোনোকিছু ভাবিইনী আমি। আজ, এখানে এসে আপনাকে দেখে ও আপনার কথা শোনে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বিয়ে আমি আপনাকেই করব। হোক সেটা এক সপ্তাহ কিংবা মাস খানেকের মধ্যে অথবা দুই তিন বছর পর।’

ঊষা সব কথা শোনার অপেক্ষায় রইল না, সে ক্যাফের বাইরে চলে এলো। তানজীম আবারও বলল,
-‘এই মিফতাহুল আলম যা বলে, তা করে। আজ হোক বা কাল, বিয়ে আপনি আমাকেই করবেন। আমি প্রেমিক হতে চাই না, তা-ই অপেক্ষা করব। আমার অপেক্ষাকে খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী করবেন না যেন। এত অপেক্ষা করার ধৈর্য আমার নেই।’

কথাগুলো কানে এলেও পাত্তা দিল না ঊষা। রিকশা থামিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। তানজীম মুখভরা হাসি নিয়ে ফারিশার নম্বরে কল দিল। রিসিভ হওয়ার পর বলল,

-‘মা কোথায়, ভাবী?’

-‘ঘরেই, দরকার?’

-‘শুনলাম তুমি না-কি মেয়ে দেখছ?’

-‘হ্যাঁ। একটা মেয়ে তো পছন্দ হয়েছিল। পারিবারিক একটু ঝামেলা আছে, তবে এটা বড়ো কিছু না। তুমি রাজি হলে ভেবে দেখতাম। যদিও মেয়ের পরিবার এইমুহূর্তে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছে না।’

-‘যেভাবে পারো, রাজি করাও। আমি এতকিছু জানি না। এই মেয়েকেই বিয়ে করব।’

-‘মেয়ে তো দেখলেই না। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ?’

-‘আমার আর দেখতে হবে না। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। আমি চাই বিয়েটা দেশ ছাড়ার আগেই হোক।’

-‘এত তাড়াতাড়ি? তুমি বোধহয় পাগল-টাগল হয়ে গেছো। এত তাড়াতাড়ি কীভাবে সম্ভব?’

-‘অসম্ভব তো নয়। প্লিজ, ভাবী।’

-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ফোন রাখো। মায়ের সাথে কথা বলে দেখি।’

ফারিশা ফোন রেখে দিলেও নিশ্চিন্ত হতে পারল না তানজীম। সে ক্যাফেতে এসে কফি অর্ডার করে নিজস্ব ভাবনায় ডুব দিল। ভাবতে ভাবতেই আশ্চর্যরকমভাবে খেয়াল করল, ঊষার ওপর তার আর কোনো রাগ নেই। অভিযোগ নেই। এত সহজেই সব রাগ গলে গেল কী করে?

***

অফিস থেকে ফিরে টেনশনে রুমের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় পায়চারী করছে উসাইদ। মিশকাত বাচ্চাকে সামলাচ্ছে। ছোট্ট মাশিয়াত হাত-পা ছুড়তে শিখেছে। বিভিন্ন শব্দ শিখেছে। যদিও তার একটাও বোঝা যায় না। বোঝার মতোও না। সব শব্দই ঠোঁট ও জিহ্বার সাথে বাড়ি খেয়ে উল্টাপাল্টা উচ্চারণ হচ্ছে। মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে স্বামীর দিকেও নজর দিল সে। তাকে ওরকম চিন্তিত দেখে বলল,

-‘কী হয়েছে, তোমার?’

উসাইদ স্থির হলো। বিছানায় এসে বসলো। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বলল,
-‘ফারিশাবু ফোন করেছিল।’

-‘কী বলল?’

-‘তানজীম না-কি দেশ ছাড়ার আগে বিয়ে করতে চাইছে। এত দ্রুত কীভাবে সম্ভব? এদিকে উজমার কথাও…।’

উজমা হসপিটালে যাবে বলে ভাই-ভাবীর থেকে বিদায় নিতে এসেছিল। ছোট্ট মাশিয়াতকে আদর দিয়ে দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘আমি তোমাদের আগেই বলেছি, আমার কথা ভাবা ছাড়ো। ঊষার কথা ভাবো।’

-‘আমি তোদের দু’জনকে নিয়েই ভাবছি, উজমা। একজনকে রেখে অন্যজনকে নিয়ে ভাবা অসম্ভব।’

এক্ষুণি ভাইকে নিজের মনের ভেতরের চাওয়াটা বলতে পারল না উজমা। কিছুটা লজ্জা ও সংকোচের কারণে চেপে গেল। ফারশাদ বন্ধু হলেও মুনমুন হক্ব তো দু’চোখের বিষ। কীভাবে তেলে ও জলে যে মিশবে, সেই চিন্তায় দিক হারাচ্ছে সে। অনুভূতিকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আবার এত সহজে গ্রহণ করে নিতেও কেমন ভয় হচ্ছে। ফারশাদের কাছে সে কেমন এটা পরিষ্কার হলেও মুনমুন হক্বের কাছে সে কী, এটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তাছাড়া অভিভাবক ছাড়া বিয়ে হবে কী করে? এতকিছু ফারশাদ কীভাবে ম্যানেজ করবে সেসব ভাবতে গেলেই পাগল পাগল লাগে নিজেকে। এই কারণে ভাইকে এইমুহূর্তে কোনোপ্রকার টেনশন দিতে চাইল না উজমা। বলল,

-‘আচ্ছা ছাড়ো। এসব নিয়ে খামোখা এত চিন্তা কোরো না। পরিস্থিতি যা বলে সেটাই কোরো। আমি আসছি, সকালে ফিরব।’

বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় এলো উজমা। একটা সিএনজি থামিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দিল। খেলার পরিস্থিতি কী সেটা জানতেই নিউজে মনোযোগ দিয়েছিল মাত্র, এরমধ্যেই চোখদুটো ঘোলা হয়ে উঠল। আঙুল দিয়ে চোখ ঘঁষে চারপাশে তাকাতে গিয়েও গভীরঘুমের কারণে অন্ধকার হয়ে এলো সবকিছু। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে গোটা পৃথিবীতে আঁধারে তলিয়ে গেল।

যখন তার জ্ঞান ফিরল, সাথে সাথে হাত-পা নাড়িয়ে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সে একটা বিছানায় শুয়ে আছে আর তার হাত-পা বাঁধা। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে গিয়ে বুঝল, মুখে স্কচটেপ। চিৎকার দিয়ে কাউকে ডাকবে, সেই শক্তিও হারিয়ে ফেলল। এখানে কীভাবে এলো, কিছুই মাথায় ঢুকল না। শুধু মনে পড়ল, ঘুমঘোরে সিএনজির সামনের সিটে শামীমকে দেখেছিল। রাত কত হলো কে জানে! অস্ফুটস্বরে বেশ কয়েকবার গুঙিয়ে গেল। কেউ শুনল না, পাত্তাও দিল না। একটা সময় দরজায় শব্দ হলো। ভেতরে প্রবেশ করল শামীম। উজমার সামনে এসে গাল চেপে ধরে বলল,

-‘কী বলেছিলাম মনে আছে? আমি ছাড়া অন্য কাউকে তুই কবুল বলতে পারবি না। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। তা-ই একটু আঙুল বাঁকালাম। এবার কি ভালো লাগছে?’

হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ উজমা তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। মনে মনে রবের নিকট নিজের ইজ্জত ভিক্ষা চাইল। এখান থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে? নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে এখানে। এমন অবস্থাতেও উজমার এই তেজ শামীমের সহ্য হলো না। অক্ষম আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,

-‘আমার সাথে বেশি তেড়িমেড়ি করবি না। এখনও সময় আছে ভালোয় ভালোয় বিয়েতে রাজি হয়ে যা। নয়তো এখান থেকে তোকে আমি সম্মানে ফিরে যেতে দিব না।’

মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করছে উজমা। ইজ্জত হারানোর চেয়ে মৃত্যুও ঢের সুখের। এখন তার যে পরিস্থিতি, শামীম যেকোনো সময় আক্রমণ করবে নিশ্চিত। এখান থেকে বেঁচে ফিরা যত কঠিন, তত কঠিন নিজের ইজ্জতকে বাঁচিয়ে রাখা। কলঙ্ককে না ছুঁয়েও সমাজের চোখে সে কলঙ্কিনী হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। এবার বোধহয় সত্যি সত্যিই কলঙ্কিনী হয়ে যাবে। যদি এমন হয়, ফারশাদের সামনে দাঁড়াবে কী করে? আর তো মাত্র এক সপ্তাহ। তারপরই ফারশাদ ফিরে আসবে। ততদিন বেঁচে থাকবে তো সে? ভাবনারত উজমাকে অবাক করে দিয়ে শামীম বলল,

-‘কিছু খাবি?’

বিস্ফোরিত চোখে তাকাল উজমা। যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে। শামীম কী বুঝল কে জানে! মুখের স্কচটেপ খুলে দিল। মুক্তি পেয়ে আগে শ্বাস নিল মেয়েটা। পরপরই একগাদা থুতু ছুঁড়ে মারল শামীমের মুখের ওপর। চিৎকার করে বলল,

-‘জানোয়ার কোথাকার। তোর মতো অমানুষকে বিয়ে করার চেয়ে মরে যাওয়াও সুখের।’

টিস্যু দিয়ে থুতু পরিষ্কার করে নিল শামীম। জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে উজমার দিকে ঝুঁকে দু’হাতে চেপে ধরল গলা। বলল,
-‘চিৎকার করবি না। এখানে এমন কেউ নেই, যে তোর গলার আওয়াজ শোনেই তোকে বাঁচাতে আসবে।’

-‘কোন স্বার্থ উদ্ধার করতে বাঁচিয়ে রেখেছ?’

-‘বিয়ে! বিয়ে কর আমায়। তাহলেই ছেড়ে দেব। সত্যি বলছি।’

-‘যদি না করি?’

-‘আমি কী করব তুই ভাবতেও পারছিস না।’

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দুর্বল ও অসহায় উজমা। কিছু করার মতো ক্ষমতা তার নেই। নয়তো এরকম অমানুষকে দু’হাতে চড়-থাপ্পড় মারার অভ্যাস ও সাহস তার আছে। সে কোনো আওয়াজ করার আগেই তার গায়ের ওড়না সরিয়ে নিল শামীম। ঠোঁটেমুখে তৃপ্তিভরা হাসি ফুটিয়ে বলল,

-‘বিয়ে করবি না?’

-‘না…।’

-‘ভেবে বলছিস তো?’

উজমা জবাব দিল না। দাঁত কিড়মিড় করে তাকাল শুধু। শামীম সময় নষ্ট করল না। খুব সাবধানে উজমার গলায় মুখ ডুবাল। ঘৃণায় সমস্ত শরীর ঘুলিয়ে উঠল উজমার। ভেতর ফাটা আর্তনাদে দম আটকে এলো। চোখের পর্দায় ভেসে উঠল ফারশাদের চেহারা। ভেসে উঠল তার দেয়া স্ট্যাটাস। স্মরণে এলো কিছু ভরসা ও ভালোবাসার বাণী। হাত-পা মুচড়াতে শুরু করল। নিজেকে ছাড়ানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে গেল। শামীম থেমে থাকল না। একটু একটু করে তার নোংরামো সে বাড়িয়েই গেল। সুযোগ পেয়ে শামীমের শরীরেও দাঁত বসিয়ে দিল উজমা। মুখটা যেহেতু খোলা ছিল, সেটাই ব্যবহার করল। ব্যথা পেয়ে সামান্য শব্দ করে সোজা হয়ে বসলো শামীম। বলল,

-‘কামড় দিস না তো। পারলে চুমু দে।’

-‘তুই আর কুত্তা সমান।’

-‘ভদ্র মেয়েরা এত গালিগালাজ জানে। জানতাম না তো।’

-‘আমি আরও অনেককিছুই জানি। শুধু হাতের বাঁধন একবার খোল। দেখাব…।’

-‘সিরিয়াসলি? দাঁড়া, খুলছি। এভাবে আসলে মজা পাচ্ছি না। দু’দিক থেকে সাপোর্ট না এলে, ঠিক জমে না।’

শামীমের মাথায় তখন উজমাকে পুরোপুরি ভোগ করার চিন্তাই ঢুকেছিল। বেহুঁশের মতো কথাবার্তা বলে সে হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দিল। দরজা যেহেতু লক, উজমা বাইরে যেতে পারবে না। তাছাড়া উজমা নারী, তার সাথে ধস্তাধস্তি করেও জিতে যেতে পারবে না। মোটকথা সে আজ উজমাকে ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারবে না। এজন্যই এরকম একটা জায়গায় এনেছে, যেটা একদম লোকচক্ষুর অন্তরালে। এই বাড়িটা সে-ই বানিয়েছে কেবল অসহায় কিছু মেয়েদের ভোগ করার জন্য। এখানে এ পর্যন্ত অনেক মেয়েই ইজ্জত হারিয়েছে। এরপর প্রত্যেকেই আত্মহত্যা করেছে। এখান থেকে শহরের রাস্তাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাঁধন খুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্তমনে উজমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলল। নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে বলল,

-‘বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে, আমাকে এই পথে আসতে হতো না।’

উজমা কোনো কথা বলল না। সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল। একটা সময় চোখের সামনে কিছু একটা পেয়েও গেল। দুর্বোধ্য হাসিতে ভরে উঠল ঠোঁট। শামীম যখন পুরোটাই তার মাঝে হারিয়ে যেতে মরিয়া, তখনই হাত বাড়িয়ে সেন্টার টেবিল থেকে ফল কাঁটার ছুরিটা হাতে নিল। শামীম খেয়াল করল না। বেখেয়ালি হয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করেছিল মাত্র। এরমধ্যেই তাকে বেসামাল অবস্থায় ফেলে তার উপরে উঠে গেল উজমা। শামীম বলল,

-‘বাহ, সুমতি হলো তাহলে।’

উজমা শুধু হাসলো। কালক্ষেপণ সময় ব্যয় না করে যে কাজ করল সে, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শামীম। সে ভয়ানক এক চিৎকার করে নিজের শরীরের দিকে তাকাল। এ কী ঘটে গেল তার সাথে? রক্তাক্ত ছুরি হাতে নিয়ে উজমা বলল,

-‘এটাই তোর শাস্তি। তুই আমার শরীর ছুঁয়েছিলি না? আমি হয়তো এইসব স্পর্শ মুছে ফেলতে পারব না, তবে তোর সব বাহাদুরি আজ শেষ করে দিয়েছি। কী ভেবেছিলি, সমাজের চোখে আমাকে কলঙ্কিনী করবি? দেখ এবার, দশজনের সামনে মুখ দেখাতে পারিস কি-না। আমাকে এত দুর্বল ভাববি না। নিজের সম্মানের জন্য আমি যেমন লড়তে জানি, তেমনি একটা পুরুষকে নপুংসক করতেও জানি।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – আটাশ

কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!

নিকষকালো আঁধার ঠেলে, আলপথ ধরে ছুটতে ছুটতে পিচঢালা রাস্তায় এসে পৌঁছেছে উজমা। সমস্ত শরীরে ও জামায় ছোপ ছোপ রক্ত লেপটে আছে। পালানোর সময় কোনোদিকেই ফিরে তাকায়নি সে। বিছানার পাশে নিজের ভ্যানিটিব্যাগ পেয়ে সেটা হাতে নিয়েই বেহুঁশের মতো দৌড়েছে। সেই দৌড় থেমেছে এইমাত্র, একটা রাস্তায় এসে। এটা কোথায়, কোন জায়গা কিচ্ছু জানে না সে। কাছেপিঠে কোনো ঘরবাড়ি নেই, নেই কোনো দোকানপাট। চারিদিকে শুধু ঘনকালো আঁধার ও কুয়াশার তীব্রতা। ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল ফোন খুঁজতে গিয়ে দেখল, সেটা ব্যাগে নেই। শামীম নিশ্চয়ই তার ফোনটা সরিয়ে রেখেছে। আগে কেন খেয়াল হলো না, এই আফসোস পেয়ে বসলো উজমাকে। রাত কত হয়েছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। একা আর কতদূর হাঁটবে? শরীরে জোর নেই, মনে সাহস নেই। তবুও ভয় ভয় মন নিয়ে তাসবীহ ও দরূদশরীফ পাঠ করতে করতে যেদিকে দিশা মিলে সেদিকেই হাঁটতে শুরু করল সে। আধঘণ্টা হাঁটার পর ছোট্ট একটা টংদোকানের দেখা মিলল। দু’চারজন মানুষ শীতের রাতকে উপভোগ করছে দোকানে বসে বসে। দোকানী চা-বিস্কুট দিচ্ছে পাশাপাশি গল্পও করছে। গুটিকয়েক পা ফেলে সাহস নিয়ে সামনে এলো উজমা। দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘এটা কোন জায়গা?’

দোকানী তার দিকে বড়ো অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘আপনি কিডা? কন থাইক্যা আইছেন? জামা-কাপড়ের এই অবস্থা ক্যান?’

-‘জি, আমার বাড়ি মৌলভীবাজার। সদরেই। আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। রাস্তায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল।’

দোকানী মুরব্বি মানুষ। পঞ্চাশোর্ধ বয়স। উজমাকে দেখে তার মায়া হলো। তিনি বললেন,
-‘এইডা তো কুলাউড়া থানা, আম্মাজান।’

-‘এখান থেকে গাড়ি পাওয়া যাবে? ভাড়া যত লাগে দিয়ে দিব।’

দোকানে একজন ছিল যে তার মালিকের প্রাইভেট কার চালায়। রাতে গাড়ি বাসায় রেখে এই দোকানে এসে চা খায়। রাত জেগে আড্ডা দেয়। সে উজমাকে বলল,

-‘আমি গাড়ি চালাই। আপনাকে নিয়ে যেতে পারব, তবে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। গাড়িটা মালিকের বাসায়। ওনাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসতে হবে। অপেক্ষা করতে পারবেন? না পারলে আপনারই ক্ষতি। এই রাস্তায় এত রাতে গাড়ি পাওয়া যায় না।’

-‘রাত কত এখন?’

লোকটা ঘড়ি দেখে জবাব দিল,
-‘দেড়টা।’

-‘আপনি গাড়ি নিয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।’

লোকটা চলে যাওয়ার পর দোকানের ছোট্ট বেঞ্চে বসলো উজমা। দোকানী গরম চা দিল। ঝিমিয়ে পড়া শরীরকে শক্তি দিতে পরপর দু’কাপ চা ও বিস্কুট খেল সে। শরীরের সব শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনটাও দুর্বল। মধ্যরাতের ওই সময়ে শামীমের সাথে সে কী করেছে, এতক্ষণ এটা মাথায় না এলেও এখন এই নীরব মুহূর্তে সবকিছু চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। ভয়ে তার সারাশরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। কী করল এটা? এখন কী হবে? শামীম বাঁচবে তো? না বাঁচলে, তার কী হবে? ফাঁসি, জেল, জরিমানা? ঠিক কী হতে পারে? দুঃশ্চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা হলো তার। দু’হাতে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কাঁদল। এরমধ্যেই ওই লোকটা ফিরে এসে বলল,

-‘আসুন, ম্যাডাম। দেড় ঘণ্টার রাস্তা। আপ-ডাউন ভাড়া দিবেন।’

টাকার হিসেবে যেতে চাইল না উজমা। সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠল। সদরের ঠিকানা বলে মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে লাগল, এরপর কী হবে! ড্রাইভার জানতে চাইল,

-‘এতরাতে এই শহরে কেন এসেছিলেন?’

উত্তর দিতে বিরক্ত লাগছে উজমার। সত্য বলতেও বাঁধছে। আবার চুপ থাকাটাও মানাচ্ছে না। লোকটা এতে তাকে সন্দেহ করতে পারে। নিজেকে বাঁচাতেই বুদ্ধি করে বলল,

-‘ঘুরতে এসেছিলাম।’

-‘একা?’

-‘জি, আমার ট্রাভেল করার শখ। এজন্য সময় পেলে একা একাই ট্রাভেল করি।’

ড্রাইভার কী বুঝল কে জানে! আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। কিছুদূর এগোনোর পর বলল,
-‘গান বাজালে অসুবিধা হবে?’

-‘না…।’

মৃদু সাউন্ডে গান বেজে উঠল। ড্রাইভার বাড়তি কোনো আওয়াজ করল না আর। এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে শহরের মূল রাস্তায় এলো। এরপর একটানে চলে এলো মৌলভীবাজার সদরে। সেখানে এসে বাড়ির ঠিকানা চাইলে উজমা চালাকি করে গ্রামের রাস্তায় নেমে গেল। লোকটা দুই হাজার ভাড়া চাইলে ব্যাগ খুঁজে এরচেয়ে বেশি-ই পেল। হিসেব করে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ড্রাইভারকে বিদায় করে বাড়ির রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল, এইযে সে একা হাঁটছে, এখন যদি কেউ পাশে থাকত, হয়তো এই সামান্য রাস্তায় হাঁটতে তার এত ভয় ও একা অনুভব হতো না। আফসোস, আজকের পর, কোনোদিন কেউ তার পাশে থাকবে কি-না এ-ও নিশ্চিত নয় সে! অথচ কত ইচ্ছে ছিল, একদিন এই রাস্তা ধরে প্রিয় মানুষের হাত ধরে অসংখ্য কথা ও গল্পের মেলা বসিয়ে বাড়ি ফিরবে। একসাথে তারা গুনবে, চাঁদ দেখবে, মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি দেখবে। কী অদ্ভুত! ইচ্ছেগুলো নিজেদের মেলে ধরার আগেই খুব গোপনে ঝরে যাচ্ছে।

***

ছোট্ট মাশিয়াত আজ খুব কাঁদছে। তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। মেয়েকে সামলাতে গিয়ে মিশকাত ও উসাইদ কারোরই ঘুম হচ্ছে না। কান্নাকাটিতে ঘুমোতে পারছে না ঊষাও। সে বাচ্চাকে শান্ত করতে কোলে নিয়ে বসার ঘরে এসে, বাচ্চার শরীরে কম্বল পেঁচিয়ে দু’পায়ের মাঝখানে রেখে গল্পের ছলে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। এত জোরে শব্দ হওয়াতে ঊষা প্রথমে ভয় পেল, পরক্ষণেই উজমার গলায় ‘ভাইয়া, গেটটা খুলো’ আওয়াজ শোনে নিশ্চিত হলো, ওটা উজমাই। ঊষা ভাইকে ডাকল। তড়িঘড়ি ঘর ছেড়ে বের হলো উসাইদ। আওয়াজ শোনে সে অবাক হওয়ার পাশাপাশি ভয়ও পেয়েছে। এত রাতে তো উজমার ফিরে আসার কথা নয়! ওর তো রাতের ডিউটি। চিন্তিত মন নিয়েই উঠোনে গিয়ে তালা খুলে গেটের পাল্লা মেলতেই হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল উজমা। দ্রুত এসে হাতের ব্যাগ রেখে নিজের রুমের দিকে ছুটল। উসাইদ পিছন থেকে বলল,

-‘কী হয়েছে তোর? শরীরের এই অবস্থা কেন?’

উজমা উত্তর দিল না। ততক্ষণে সে নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিয়েছে। সবার চোখেই বিস্ময় নেমে এলো। ভাই-বোনের গলার আওয়াজে মিনারা খাতুনের ঘুমটা ভেঙে গেল। তিনি রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে। কেউ কিছু বলতে পারল না। সবাই-ই হতবাক চোখে উজমার রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। দশ-পনেরো মিনিট পরও উজমার নড়চড় পাওয়া গেল না। উসাইদ ছুটে গেল দরজায়। ভয় জড়ানো গলায় ডাক দিল,

-‘উজমা, কী হয়েছে? দরজা খোল। ভাইয়াকে বল। এত রাতে তুই বাড়িতে? তোর তো হসপিটালে থাকার কথা।’

ভাইয়ের ডাক, কথা কিছুই কানে যাচ্ছে না উজমার। সে বাথরুমের শাওয়ারের নিচে পড়ে নিজেকে পরিষ্কার করছে। যত জায়গায় শামীম ওর নোংরা স্পর্শ দিয়েছে, তত জায়গায়ই ভালোমতো ঘষেমেজে পরিষ্কার করছে। বার বার পরিষ্কার করার পরও মনে হচ্ছে, এখানে-ওখানে শরীরের সবখানে এখনও নোংরা লেগে আছে। নিজেকে তার এখন এত অপবিত্র, অচ্যুত মনে হচ্ছে, যা আগে কোনোদিন হয়নি। ঘৃণায় ঘুলিয়ে উঠছে শরীর। বেশ কিছু সময়ের ঘষামাজা শেষে এই রাতের বেলায়ও ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল শেষ করে, একদম ঝরঝরে শরীরে রুমের বাইরে এলো উজমা। দরজা খুলতেই ভাইয়ের মুখোমুখি পড়ল। উসাইদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ভাইকে। ভীষণ ভয় পেল উসাইদ। বোনের মাথায় হাত রাখল। চোখের পানি মুছে দিল। জানতে চাইল,

-‘কী হয়েছে?’

-‘একটা অঘটন ঘটে গেছে, ভাইয়া। হসপিটালে যাওয়ার পথে শামীম ভাইয়া…।’

কাঁদতে কাঁদতেই সব ঘটনা খুলে বলল উজমা। এ-ও বলল, সে শামীমের সাথে কী করেছে! ভয়ে-আতঙ্কে জমে যাচ্ছে। সব শোনে উসাইদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা পশুকে এতদিন নিজের ভাই বলে জানত! কী জঘন্য মানুষ! এমনভাবে কেউ নিজের আপনজনদের সাথে এসব করে? লজ্জায় মাথা নুয়ে আসছে তার। সে বোনকে সাহস দিয়ে বলল,

-‘ভয় পাস না, যদি পুলিশ কেস হয়, আমি সামলে নেব।’

-‘তুমি পারবে? আমার ফোন বোধহয় ওখানে ফেলে এসেছি। ব্যাগে নেই।’

-‘ওটার কথা ছাড়। এখন একটু ঘুমো। যা হয় পরে দেখা যাবে।’

-‘আমার খুব ভয় হচ্ছে, ভাইয়া।’

-‘একদম ভয় পাস না তো। তুই অন্যায় কিছু করিসনি। অন্যায়ের উপযুক্ত জবাব দিয়েছিস। এটা যদি অপরাধ হয়, তাহলে সব ধর্ষকেরা জঘন্য সব অপরাধে অপরাধী। ওদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত আগে, এরপর এই অন্যায়ের শাস্তি হবে।’

বোনকে সাহস দিতে আরও অনেকক্ষণ তাকে বুঝাল উসাইদ। এ-ও বলল,
-‘সবসময় অন্যায়কে মুখবুঁজে সহ্য করতে নেই। কখনও কখনও এভাবেই একেকটা অন্যায়ের জবাব দিতে হয়। নারী কেন নিজেদের দুর্বল বুঝাবে? প্রতিবাদের সুরে প্রতিটা নারীই, এটা বুঝিয়ে দিক যে, তারা নিজস্ব শক্তিতে জ্বলে উঠতে জানে। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে। আত্মরক্ষার্থে নিজেরাই সাহসী হতে জানে। কোনো নারীই দুর্বল নয়। প্রতিটা নারীই সাহসী, প্রতিবাদী।’

***

সকাল দশটায় বাড়ির গেটে পুলিশের একজন কনস্টেবল নক দিলে গেট খুলে দেয় উজমা নিজেই। ঊষা ভার্সিটিতে আর উসাইদ অফিসে। এইমুহূর্তে বাড়িতে শুধু তিনজন নারী ও উসমান ওয়াজেদ। আইনের লোকজনদের দেখে ভয় পাওয়া উচিত ছিল উজমার, অথচ সে ভয় পায়নি। কনস্টেবল জিপ থেকে নেমে গেটের দেয়ালে লাগানো নেমপ্লেট ও বাড়ি নম্বর দেখে নিশ্চিত হয়, এটাই সে-ই বাড়ি। সে তার সিনিয়রকে নেমে আসার অনুমতি দিলে গাড়ি থেকে নেমে গেটের ভেতর দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে লোকাল থানার বর্তমান এস আই সৌরভ। গেটের সামনে থাকা নারীমূর্তিকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,

-‘আপনি নিশ্চয়ই উজমা ওয়াজেদাহ।’

খুব কনফিডেন্টের সাথেই কথা বলল সৌরভ। তার কথাতেই স্পষ্ট যে, সে উজমাকে চিনে। চেহারা দেখেই চেনা স্বাভাবিক। অন্য কেউ হলে এক বাক্যেই তাকে চিনে ফেলাটা স্বাভাবিক কি-না জানে না উজমা। তবে একজন এস আই এর মুখে নিজের নাম শোনে ভীষণ অবাক হতে হলো তাকে। বিস্মিত চোখজোড়া নিয়ে জানতে চাইল,

-‘আপনি আমার নাম জানেন?’

এস আই সৌরভ কেবল হাসলো। পকেট থেকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা আপনার?’

পুলিশের হাতে নিজের ফোন দেখে এই শীতেও দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করল উজমা। ইতিমধ্যেই হাতের তালু ঘেমে উঠেছে তার। মারাত্মক ভয় চেপে বসেছে মনে। তবুও সাহস নিয়ে বলল,

-‘জি, এটা আমারই।’

-‘গতকাল রাতের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ ছিল। আশাকরি সত্যি বলবেন।’

ভেতর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এলো উজমা। উঠোনেই রাখল। এস আই সৌরভ চেয়ারে বসে এক গ্লাস পানি চাইল। উজমা সেটাও এগিয়ে দিল। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে ভালোমতো তাকিয়ে বলল,

-‘রাতে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?’

-‘আমি একটা হসপিটালে জব করি। রাতের শিফটে ডিউটি ছিল গতকাল। হসপিটালে যাওয়ার পথে আমার কাজিন…।’

আস্তেধীরে সব ঘটনা খুলে বলল উজমা। কীভাবে শামীমকে সামলে বাড়ি অবধি পৌঁছেছে সবটাই বলল। সব শোনে এস আই সৌরভ বলল,
-‘গতকাল চোর ধরতে গিয়ে একটা বাংলো বাড়ির দিকে আমাদের কনস্টেবল ছুট দিয়েছিল। ওরাই একটা আর্তনাদ শোনে ভেতর থেকে আবিষ্কার করেছে আপনার কাজিন শামীমকে। উনি এখন হসপিটালেই আছেন। চিকিৎসা চলছে। আমরা ওনার বাড়িতে খবর পাঠিয়েছি। শামীমকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে, প্রথমে সে দোষটা নিজের কাঁধে নেয়, পরবর্তীতে সব সত্য স্বীকার করে। ওর কথামতো বাংলোবাড়িতে তদন্ত করতে গিয়ে আজ সকালেই আপনার এই ফোনটা আমরা পেয়েছি। এন্ড দ্যান, আপনার কাজিনের মাধ্যমেই বাড়ির ঠিকানা ও আপনার বায়োডাটা সংগ্রহ করেছি।’

উজমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে খুব নীরবেই এস আই সৌরভের কথাগুলো শোনে যাচ্ছে। যা সত্য তাই শুনছে, এতে ভয় কী! তাকে নীরব দেখে এস আই সৌরভ বলল,

-‘নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপনি যা করেছেন, সেটা বাহ্বা পাওয়ার যোগ্য হলেও আপনি আইনের চোখে অপরাধী। সে বেঁচে আছে এবং অপারেশনের মাধ্যমে তাকে সুন্দর জীবন দেয়ার চেষ্টা করা হবে। যে ছুরি ব্যবহার করেছেন সেটা খুব ছোটো ও আঘাতের পরিমাণ সীমিত ছিল বলে, তাকে পূণরায় জীবন দেয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন, কর্তব্যরত চিকিৎসক। কিন্তু তবুও, সবচেয়ে কম অপরাধের শাস্তি যদি আপনাকে দেয়া হয়, তাহলে আপনার কী হতে পারে জানেন?’

উজমা উত্তর দিল না। সে জানে, কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু এছাড়া উপায় কী ছিল। এমন পুরুষ বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই তো ভালো। গ্রহণযোগ্য কোনো মতামত না পেয়ে এস আই সৌরভ বলল,

-‘আপনার কাজিনের পরিবার সম্ভবত আইনের আশ্রয় নিতে পারে। এক্ষেত্রে আপনাকেও যথেষ্ট সাজা ভোগ করতে হবে।’

-‘যে পুরুষ অসংখ্য মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে, তাকে অঙ্গহীন করার অপরাধে যদি আমাকে জেল কাটতে হয়, আমি তাতে ভয় পাব না মোটেও। এরকম জানোয়ার যতদিন পৃথিবীতে বাঁচবে, ততদিন কোনো না কোনো মেয়ের ইজ্জত নষ্ট হবে। একটা জানোয়ারকে আঘাত করে আমি শুধু আমাকে বাঁচাইনি, আরও অনেক মেয়ের ইজ্জত হারানোর বিচার করেছি। আপনার যদি মনে হয়, এই কারণে আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত, আপনি সেটা করতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।’

এস আই সৌরভ চমৎকৃত হলো। এরকম বাঘিনী যদি ঘরে ঘরে জন্মায়, ধর্ষকদের যোগ্য শাস্তি দেয়, তাহলে এই সমাজ থেকে ধর্ষণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য অসহায় মেয়ের ইজ্জত বেঁচে যাবে। আইন যেহেতু সবার জন্যই সমান তা-ই তাকে তার কাজ করতে হবে। এখনও কোনোপ্রকার মামলা হয়নি, শামীমও বেঁচে আছে, সে নিজের অপরাধ স্বীকার করলেও উজমাকে দোষী সাজায়নি বা এটা বলেনি যে, উজমাই তাকে এরকম সিচুয়েশনে ফেলেছে। উজমাকে এই কাজের শাস্তি দিতে হবে এটাও বলেনি। বরংচ বলেছে, যা হয়েছে সব তার নিজের দোষে। অপরাধের বোঝা কমাতে নিজেই নিজেকে শাস্তি দিয়েছে। এটা নিয়ে অলরেডি একটা নিউজও তৈরী হয়েছে। নিউজের কোথাও উজমার নাম নেই, কথা বা দোষও উল্লেখ নেই। তবে সে অবাক হলো এইভেবে যে, পুলিশকে সামনে রেখেও এই মেয়েটা এত সাহস নিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে যাচ্ছে। শামীম বলছে নিজেই নিজেকে শাস্তি দিয়েছে আর এই মেয়ে বলছে, সে অপরাধী। সবদিক ভেবে, বুঝে সৌরভ বলল,

-‘যদি মামলা হয়, কী করবেন?’

-‘আমি কোথাও পালাব না। আপনি এসে আমার হাতে হাতকড়া পরাতে পারবেন। আমি এখানেই থাকি।

-‘আপনি অনেক সাহসী। অপরাধ করলেও মানুষ সহজে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে চায় না। অথচ আপনি করলেন, তা-ও নির্ভয়ে। এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে আসিনি। শামীম বলেছিল, সে নিজেই নিজেকে শাস্তি দিয়েছে। ওর কথা বিশ্বাস হয়নি, তাই আমরা বাংলোতে খোঁজ চালিয়েছিলাম। ওখানে শুধু আপনার ফোন নয়, আরও অসংখ্য মেয়ের জামা-কাপড়, ব্যবহৃত ফোন, জুতা, চিরুনি এগুলো পেয়েছি। নিজের সাহস ও সততাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আর যদি কোনো বিপদ দেখেন কিংবা কোনো সমস্যা দেখেন, আমাকে জানাবেন। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে, আপনার পাশে থাকার।’

এস আই সৌরভ পকেট থেকে নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিলে উজমা সেটা নিজের হাতে এনে চোখ বুলাল। ‘সৌরভ চ্যাটার্জি’ নাম পড়তে পড়তে হঠাৎ করেই সামনে থাকা পুরুষটার চেহারাটা ভালো মতো দেখল। এরপরই ফিক করে হেসে ফেলে বলল,

-‘এখানে কবে পোস্টিং হলো?’

অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা শ্বাসটা এবার নির্ভার মনে ত্যাগ করল সৌরভ। ঠোঁটভরা হাসি নিয়ে বলল,
-‘চিনতে পারলে, তাহলে!’

সৌরভ চ্যাটার্জি উজমার স্কুল ফ্রেন্ড। ছোটোবেলা থেকেই তার পুলিশ হওয়ার ভীষণ শখ ছিল। একই স্কুলে পড়াশোনা করলেও কলেজে গিয়ে আলাদা হয়ে যায় দু’জনে। খুব বেশি ক্লোজ নয় ওরা, তবুও এক সময়ের ক্লাসমেট। ভালো বন্ধু ছিল বলা যায়। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটতে গিয়ে সৌরভ চলে যায় অন্য শহরে। উজমা থেকে যায় এখানে। নিজের পরিবারের সাথে। সময়ের সাথে সাথে চেনা-পরিচত মানুষদের সাথে বিচ্ছেদ যেমন ঘটে, সময়ই আবার কোনো না কোনো বাহানায় তাদেরকে কাছে নিয়ে আসে। দীর্ঘদিন পর এই দাড়িগোঁফওয়ালা ছেলেকে দেখে তার অচেনা কেউ-ই মনে হয়েছিল। কিন্তু ভিজিটিং কার্ড পড়ে যখন তাকে ভালোমতো লক্ষ্য করল, তখনই বুঝল, এ তো সে-ই সৌরভ, যে প্রতিবার ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়ে সবাইকে শাসাত। কত-শত রুলস দিত। রুলস না মানলে স্যারের কাছে নালিশ চলে যেত। এতদিন পর সৌরভকে এই শহরে, তার বাড়িতে দেখে অবাক হলো উজমা। খুশিও হলো। বলল,

-‘এত দাড়িগোঁফ থাকলে চেনা যায় না-কি? অনেক পালটে গিয়েছ তুমি। ভেতরে এসো।’

-‘এ্যা, এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে এখন ভেতরে এসো। যাব না ভেতরে। আমার অনেক কাজ আছে।’

-‘আরেহ্, রাগ কোরো কেন?’

সৌরভ হেসে ফেলল। বলল,
-‘রাগ করিনি। কাজ আছে। আমি কিন্তু ভয় দেখাতে আসিনি। সিরিয়াস কথা বলতে এসেছি। মামলা হলে কিন্তু তোমার জেল-জরিমানা হতে পারে।’

-‘আমি আগেই বলেছি, আমি এসবে ভয় পাই না।’

-‘তুমি এত সাহস পাও, কোথায়?’

-‘এই সমাজে টিকে থাকতে হলে, প্রতিবাদী হতে হবে। অন্যায়কে মুখবুঁজে সহ্য করা মানেই, অপরাধীকে সুযোগ দেয়া। জেনে-বুঝে আমি কোনো অপরাধীকে সুযোগ দিতে পারব না।’

-‘তুমি পুলিশ হলে আমি তোমাকে এক্ষুণি একবার সেল্যুট করতাম।’

-‘এখনও করতে পারো। আমি রাগ করব না।’

শব্দ করে হেসে ফেলল সৌরভ। সময়ের অভাব ও কাজের ব্যস্ততা তাই বেশিক্ষণ দাঁড়াল না সে। বিদায় নিয়ে চলে গেল। উজমা পড়ল দুঃশ্চিন্তায়। শামীম এখনও বেঁচে আছে। এ তো কৈ মাছের প্রাণ। যাই যাই করেও যাচ্ছে না। তবে তার সৌভাগ্য এটাই যে, একটা খুন, একটা জঘন্য অপরাধ ও অপরাধবোধের দায়ভার থেকে বেঁচে গেছে। শামীম বেঁচে আছে, সুস্থ আছে, ভবিষ্যতে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারবে, এরচেয়ে সৌভাগ্যের আর কিছুই হয় না। যদি আরও ধারালো ছুরি হতো, সাইজ আরও বড়ো হতো, আঘাতের পরিমাণ সামান্য না হয়ে আরও বেশি হতো, নির্ঘাত তার অপরাধটাও তখন ক্ষমার অযোগ্য হয়ে যেত।

***

সন্ধ্যে ছ’টায় রুমে ফিরল ফারশাদ। গতকালকের ম্যাচে জয় লাভ করার পর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আজ ঘুরতে যাবে। যেহেতু আজ খেলা নেই, তাই না বলার কোনো উপায় ছিল না। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর থেকেই ফারশাদের মন খারাপ। সে ভেবেছিল, রুমে এসে উজমার কাছ থেকে একটা সারপ্রাইজ ম্যাসেজ পাবে। বেশিকিছু না হোক ছোট্ট একটা অভিনন্দন আশা করাই যায়। অথচ উজমা শুধু অভিনন্দন কেন, কোনো ম্যাসেজও পাঠায়নি, কলও করেনি। সারাদিন ব্যস্ততা ছিল বলে, সে নিজেও ফোনের ধারেকাছে ছিল না খুব একটা। এত আনন্দ-উল্লাস করে ফিরে এসে মনে একফোঁটা শান্তি পাচ্ছে না সে। কেবলই সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে। আর মাত্র দুটো ম্যাচ শেষ করেই দেশে ফিরবে। কত অব্যক্ত অনুভূতি, কত উচ্ছ্বাস মনের কোণে জমা রেখে দিন অতিবাহিত করছে। প্রতিনিয়ত মন ছুটে যেতে চাইছে প্রিয়জনের কাছে। মনের আঁকুপাঁকু অবস্থাকে সামলাতে না পেরে কল দিয়ে বসলো হোয়াটসঅ্যাপে। রিসিভ না হওয়াতে ম্যাসেজ লিখল,

-‘আর ইউ বিজি, বাটারফ্লাই?’

সৌরভকে বিদায় দিয়ে ঘরে এসেছিল উজমা। টেলিভিশন ছেড়ে বসেছিল মাত্র। এরমধ্যেই ফোনের স্ক্রিনে ফারশাদের এই ম্যাসেজ দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। গতকাল গাড়িতে বসেই দেখেছিল, বাংলাদেশ টিম জয়ের দ্বারপ্রান্তে। সম্পূর্ণ খেলা শেষ হওয়ার আগেই যা হলো…। স্মরণে এলেই শরীর শিউরে উঠে উজমার। এখনও মনে হয়, সে ভীষণ অচ্যুত, অপবিত্র। শরীরের প্রত্যেকটা অংশে শামীম নিজের হাত ছুঁয়েছে, ঠোঁট ছুঁয়েছে, দাঁত বসিয়েছে। কী বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি! এসব থেকে শুধু ভাগ্যের জন্য বেঁচে ফিরেছে। ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ শো করেও চুপ করে বসে রইল উজমা। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরপরই কল চলে এলো। ফোন রিসিভ না করে, কেটে দিল। কাঁপা কাঁপা হাতে লিখল,

-‘কিছু বলার আছে আপনাকে। কিন্তু এখুনি সম্ভব নয়।’

ম্যাসেজের আগামাথা কিছু বুঝল না ফারশাদ। লিখল,
-‘এখন বলতে অসুবিধা কী?’

-‘আপনি দেশে ফিরুন, তারপর বলি।’

-‘আমি এখুনি শুনতে চাইছি, আপনি ফোন রিসিভ করুন।’

-‘এখুনি বলা যাবে না তো।’

-‘ফোন রিসিভ করবেন কি-না?’

মুহূর্তেই শব্দ করে বেজে উঠল ফোন। রিসিভ করে ফারশাদকে কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না উজমা। টেনশন দিতেও ইচ্ছে করছে না আবার তাকে ঠকাতেও বাঁধছে। এইযে, সমস্ত শরীরে একটা অমানুষ নিজের হিংস্রতার ছাপ রেখেছে, এটা যদি ফারশাদ জানে, কী করবে? ভুল বুঝবে, দূরে ঠেলে দিবে? আবার যদি লুকোয়, সেটাও তো তাকে ঠকানো হবে। জঘন্য সব অনুভূতি সারাজীবনেও কি মুছে ফেলা যাবে? ভাবতে গিয়ে গলার স্বর বসে গেল উজমার। কষ্টগুলো কণ্ঠনালীর কাছে একত্রিত হয়ে গেল। উপচেপড়া চোখের পানিতে ভেসে গেল গাল। ননদিনীর এই কাণ্ড দেখে পাশে এসে বসলো মিশকাত। একাধারে বেজে চলছিল ফোন। কোনোভাবেই উজমাকে মানানো গেল না। সে ফারশাদের সাথে কথা বলতে চাইছে না। তবুও মিশকাত জোর করল। বলল,

-‘আশ্চর্য, ওনার সাথে কেন কথা বলবি না? দোষটা তো তোর না।’

-‘আমি পারব না, ভাবী। এই মানুষটার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস আমার নেই। কী বলব আমি? একটা পুরুষ আমাকে নোংরাভাবে ছুঁয়েছে। আমার সমস্ত শরীর…।’

কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল উজমা। হেঁচকি উঠে গেল তার। মিশকাত আর জোর করল না। সে ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল,

-‘ভাইয়া, জরুরী কিছু হলে আমাকে বলুন। আমি উজমাকে জানিয়ে দিব।’

-‘ওর কী হয়েছে, ভাবী?’

মিশকাত ফোন রিসিভ করেছে মানে, বড়োসড়ো কোনো সমস্যা হয়েছে। নয়তো উজমা কেন তার ফোন ইগনোর করবে? ভয়ে-আতঙ্কে প্রশ্ন করে চুপ হয়ে গেল ফারশাদ। মিশকাত বলল,

-‘গতকাল একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, ভাইয়া। ও যে বেঁচে আছে, এটাই আমাদের জন্য আনন্দের। আপনাকে কী বলি বলুন তো। লজ্জার বিষয়।’

-‘ভাবী, ধোঁয়াশায় না রেখে স্পষ্ট করে বলুন প্লিজ।’

মিশকাত কিছু চেপে রাখল না। খুব ভদ্রতার সাথে গতকাল রাত থেকে ঘটে যাওয়া একেকটা ঘটনা বলে গেল। সব শোনে ফারশাদ বলল,
-‘ফোনটা একটু ওর কাছে দিবেন, প্লিজ ভাবী। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।’

জোরপূর্বক উজমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল মিশকাত। টেনেটুনে তাকে রুমে ঢুকিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলতে বলল। কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেছে উজমার। জোর আসছে না। ফোন কানে ঠেকিয়ে চুপ করে রইল সে। ভাঙা ভাঙা কন্ঠস্বর ও কান্নার শব্দ কানে এলে ফারশাদ বলল,

-‘গতকাল কী কথা হয়েছিল আমাদের? বলেছিলাম না, আমি আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু হব, যার কাছে আপনি নির্ভার ও নিরাপদ থাকবেন? ছত্রিশ ঘণ্টা পেরিয়েছে মাত্র, এরমধ্যেই আপনি আমার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন?’

এই কথায় উজমার কান্না আরও বেসামাল অবস্থায় চলে গেল। বাঁধভাঙা জলের মতো অধৈর্য হয়ে এদিক-ওদিক গড়িয়ে পড়তে লাগল। বিরক্তিকর কণ্ঠে ফারশাদ বলল,

-‘কাঁদতে বলিনি, প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছি।’

-‘আমার কিছু বলার নেই।’

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই উত্তর দিল উজমা। মেজাজ হারিয়ে ফেলল ফারশাদ। রেগেমেগে আগুন হয়ে শক্ত কণ্ঠে শোনাল,
-‘সামনে থাকলে এই কথার জন্য গুনে গুনে দশটা চড় মারতাম।’

উত্তরে শুধু কেঁদেই গেল উজমা। কোনোকিছু বলার সাহস পেল না। উজমার এই কান্না, এই চুপচাপ আচরণ সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রিয়জনকে এত দুর্বল ও কষ্টকর মুহূর্তে দেখে কোনোকিছুই ভালো লাগছে না তার। কেমন অস্থির, অশান্ত মনে হচ্ছে সবকিছু। উজমাকে একটু সাহস, ভরসা ও মনের জোর বাড়িয়ে দিতে ফারশাদ বলল,

-‘কেউ ছুঁয়ে দিলেই কাউকে নোংরা করতে পারে না, বাটারফ্লাই। কেউ ছুঁয়ে দিলেই মানুষ অচ্যুত ও অপবিত্র হয়ে যায় না। নোংরা তো সে, যে আপনার শরীরে নোংরা স্পর্শ দিয়েছে। নোংরা তো তার মন, যে আপনাকে নোংরা করতে চেয়েছে, আপনাকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছে। একটা নোংরা মানুষের জন্য, তার নোংরা কাজের জন্য আপনি নিজেকে দোষী ভাবছেন, খারাপ ভাবছেন? এত বোকা আপনি?’

উজমা নিরুত্তর রইলে ফারশাদ আবারও বলল,
-‘আমার বাটারফ্লাই তো এত দুর্বল ও ভীতু নয়। সে ভীষণ সাহসী ও শক্ত মনের একটা মেয়ে। তার চোখে দুর্বলতা ও ভয়ের অশ্রু একদমই মানায় না। সাহসী মেয়েদের এত কাঁদতে হয় না, নিজেকে এত দুর্বল ও ভীতু প্রমাণ করতে হয় না। সবসময় সাহস ও মনের জোর দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। সাহসী মেয়েরা অন্যকারও কাছ থেকে সাহায্য আশা করে না। বরং কঠিন বিপদে তারা নিজেরাই নিজেদের সাহস হতে জানে। আমার বাটারফ্লাইকে আমি সবসময়ই এমন সাহসী ও প্রতিবাদী নারী হিসেবে দেখতে চাই। তাকে অকারণ ভয় পেতে দেখলে, দুর্বল হতে দেখলে, আমারই ভীষণ খারাপ লাগে।’

কান্না থেমে গেলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না উজমা। ফারশাদের প্রত্যেকটা কথা তার মনে জিয়নকাঠির মতোই প্রভাব ফেলেছে। ভাঙাচোরা দুর্বল, নিস্তেজ মনকে শক্তি দিয়েছে। গতকাল থেকে অদৃশ্য এক অপরাধবোধ চেপে বসেছিল মনে। সেটা থেকেও ধীরেধীরে মুক্তি পাচ্ছে। সে মনে জোর এনে থেমে থেমে বলল,

-‘এই অপরাধের জন্য যদি আমার শাস্তি হয়?’

-‘সেটাও ভাববার বিষয়। এখনও তো মামলা হয়নি, তাই না?’

-‘শামীম ভাইয়া না-কি দোষ নিজের কাঁধে নিয়েছে। যদিও আমি পুলিশের কাছে সত্যিটা বলে দিয়েছি। কিচ্ছু লুকোইনি। অপরাধ যেমনই হোক, ছোটো হোক বা বড়ো, ছুরি তো আমি-ই চালিয়েছি।’

-‘আপনি ভয় পাবেন না, যা হবে দেখা যাবে। এখন আপনার ওই এস আই এর ফোন নম্বরটা আমাকে দিন। আমি ওনাকে একটা কল করি।’

-‘আপনি কী বলবেন?’

-‘দেখুন, আপনি ছুরি চালিয়েছেন, তাকে নপুংসক করতে চেয়েছেন, সেটা হয়নি। ভাগ্যগুণে সে বেঁচে গেছে, সুস্থ আছে। আপনার অপরাধটাও কমে এসেছে। এখন যদি মামলা হয়, বড়োজোর পুলিশ আপনাকে একদিন আটকে রাখতে পারবে। কিন্তু পরদিন সুড়সুড় করে ছেড়ে দিবে।’

-‘কেন? পুলিশ কি আমার আত্মীয় লাগে, অপরাধী জেনেও ছেড়ে দিবে?’

-‘সেই চিন্তা তো আপনার নয়, আমার। মামলা হলে ভয় পাবেন না। দূরে থাকলেও আমি আপনার পাশে থাকব। আপনি এস আই’য়ের নম্বরটা দিন। বাকি কাজ আমি সামলাব।’

হাতে থাকা ভিজিটিং কার্ডের ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফারশাদের ইনবক্সে সেন্ড করল উজমা। ফারশাদ সেটা দেখেই বলল
-‘ওনাকে তো আমি চিনি। তাহমীদ ভাইয়ার ইনফরমেশন দিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল।’

মামলা ও শাস্তি নিয়ে উজমার মনে কোনো ভয় নেই। তার শুধু ভয়, ফারশাদ তাকে ভুল বুঝে কি-না এই নিয়ে। বিশ্বস্ত মানুষ যদি ভুল বুঝে, অপরাধী ভাবে, খারাপ ভাবে, দূরে সরিয়ে দেয়, মুহূর্তেই যদি ভালোবাসাকে মিথ্যে বলে সব অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলে, কষ্ট তো তখনই দ্বিগুণ হয়ে বিঁধবে। এইমুহূর্তে তার কী করা উচিত, কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা উচিত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না উজমা। সে নীরবে ভেবে যাচ্ছে জটিল সব বিষয়াদি নিয়ে। ভাবতে ভাবতেই বলল,

-‘আমি কী করব, বুঝতে পারছি না।’

ফারশাদ চমৎকার হেসে বলল,
-‘আপাতত আপনি নির্ভয়ে থাকুন আর আগামী সপ্তাহেই ‘কবুল’ বলার প্রস্তুতি নিন। দেখা হচ্ছে, শীঘ্রই।’

এত টেনশনের মাঝেও একটা মানুষ এত চিল মুডে থাকতে পারে কীভাবে, ভেবে পেল না উজমা। চিন্তায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, অথচ ফারশাদ মজা নিচ্ছে। ফারশাদের এই কথাকে গুরুত্ব না দিয়েই বলল,

-‘ফাজলামি রাখুন। আমি সত্যিই ভীষণ চিন্তায় আছি।’

আবারও ভরাজয়ের হাসি ও সুখ সুখ অনুভূতি নিয়ে ফারশাদ বলল,
-‘আপনার যত চিন্তা, দুঃশ্চিন্তা, মনের ভয়, যা কিছু আছে সব আমায় দিন আর আপনি নির্ভার থাকুন। এত ভয়ে ভয়ে থাকলে আপনার মুখ দিয়ে তো ‘কবুল’ই বের হবে না। আমার প্রতি এত নির্দয় হবেন না প্লিজ। একটু সদয় হোন। আমি সত্যিই আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।’

***

চলবে…