মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-২৫+২৬

0
73

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – পঁচিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

চেনাপরিচিত ক্যাম্পাসের মাঠে দীর্ঘদিন পর আজ আবারও আগের মতো দলবেঁধে সলাপরামর্শ কর‍তে বসেছে সবাই। মূলত সামনে যে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করেছে, তা নিয়েই প্রয়োজনীয় কিছু আলোচনা হচ্ছে সবার মাঝে। সবাই যে যার মতো একেকটা সমাধান ও যুক্তি পেশ করছে, অথচ সবার মাঝে বসেও উজমা ফোন হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছিল। শীতের এই দুপুরে, ঝিরিঝিরি হাওয়া ও হালকা মেঘমেদুর পরিবেশে সবুজ শ্যামল ঘাসের বুকে কনুই ঠেকিয়ে, ঠোঁটে একচিলতে হাসি নিয়ে মুক্তমনে নিজেকে কেবল মেলে ধরেছিল সে। সবাই যে এটা-সেটা নিয়ে আলোচনা করছে, সেসব তার কানেই যাচ্ছে না। সে একমনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে কিছু নিজস্ব সময় ও মুহূর্তকে দু’চোখ ভরে দেখার লোভে। আলোচনা শেষে সবাই যখন উজমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইল, তখন সে শুধু ‘হু’ বলে ফের মনোযোগ দিল ফোনের স্ক্রিনে। তার এই বেখেয়ালি আচরণ সবাইকে রীতিমতো অবাক করে দিল। মাইসারা চট করে তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে দৌড় দিল। উজমা চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-‘এ্যাই ফাজিল, ফোনটা দে।’

-‘কী আছে এখানে, আমাকে দেখতেই হবে। মাঘ মাসের শুরুতে আমরা ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করব বলে দিনতারিখ পাকা করে বসে আছি। আর তুই হু হা জবাব দিয়ে ফোনের ভেতরেই ডুবে রয়েছিস। আশ্চর্য মেয়ে তো তুই! দিনদিন এত বেখেয়ালি কেন হচ্ছিস?’

উজমা ভীষণ বিরক্ত হলো এতে। ফোন কেড়ে নিতে মাইসারাকে ধাওয়া করল। দুই বান্ধবী পুরো মাঠজুড়ে ছোটাছুটির মেলা বসিয়ে দিল, তবুও কেউ দৌড় থামাল না। এক পর্যায়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দৌড় থামিয়ে মাইসারা বলল,

-‘তুই ক্রিকেট খেলা দেখছিস!’

আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হলো সবার। উজমা আর খেলা দুটো কোনোদিন এক হওয়ার নয়, এ বিষয়ে সবাই অবগত। যে রমণী খেলার নাম শুনলে নাকমুখ কুঁচকে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়, সে এতক্ষণ ধরে নিজের ফোনে ক্রিকেট খেলা দেখছিল! ভাবা যায়। প্রত্যেকেই অবাক হয়ে উজমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অসহায় উজমা কপাল চুলকোতে চুলকোতে বলল,

-‘হ্যাঁ, দেখছি। তো কী সমস্যা? ফোনটা দে, সারা।’

-‘দেব না। আগে বল, হুট করে ক্রিকেটের প্রতি তোর এত আসক্তি কেন তৈরী হলো? গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং করছি আমরা, সেখানে তুই ফোন হাতে নিয়ে গভীর আয়েশে খেলা দেখছিস। সামথিং ইজ রং…।’

-‘আরেহ্, সিরিয়াস কিছু না। ইচ্ছে হয়েছে, তা-ই দেখছি। এখানে এত রং-রাইটের কী হলো! তোরা একটু বেশি বুঝিস।’

-‘উঁহু, আমরা বেশি বুঝি না। আমরা ঠিকই বুঝি। তুই অস্বীকার করিস।’

উজমা কোনো জবাব না দিলে সবাই-ই মাইসারার কাছে এগিয়ে গিয়ে ফোনের স্ক্রিনে নজর দিল। তখন নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে ওয়ানডে ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের খেলা চলছিল। প্রথমদিনের ম্যাচে ফারশাদ উপস্থিত থাকতে পারেনি, অসময়ে বাবার মৃত্যুর কারণে। ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে আজ ব্যাটিংয়ে আছে ফারশাদ ও মাফিন। ছেলেরা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে খেলাটা লক্ষ্য করেও কেউ কিছু বুঝতে পারল না। কাইফ বলল,

-‘খেলা দেখুক, অসুবিধা কী? তুই ওর পিছনে লাগছিস কেন?’

মাইসারা সহাস্যে বলল,
-‘এমনি-এমনি তো লাগিনি রে ভাই। এই মেয়ে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরকে মন-প্রাণ দিয়ে বসে আছে। অথচ জানতে চাইলে অস্বীকার করে। না হলে ভাব, খেলার নাম মুখে নিলেই বিরক্ত হয় যে-ই মেয়ে, সে-ই এখন খেলা দেখছে!’

আরেকদফা চমকাল তিন বন্ধু। তিনজনেই ঘটনার সত্যতা জানতে উজমার দিকে তাকাল। উজমা মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চাপছে বার বার। হাতের আঙুল দিয়ে পরনের ওড়না প্যাঁচাচ্ছে। তার এই নীরবতা, শান্তশিষ্ট আচরণ সবার মনেই সন্দেহ জাগিয়ে দিল। তিনজন একসাথে এসে দাঁড়াল উজমার সামনে। অনিক জিজ্ঞেস করল,

-‘ও যা বলছে সব সত্যি?’

এবারও চুপ রইল উজমা। তাক্বদীম জানতে চাইল,
-‘ঠিক কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলবি? ফারশাদ তো এখানে এসেছিল, তখন কী কোনোভাবে…।’

উজমার নীরবতাতে সবাই-ই বিরক্ত হলো। কাইফ বলল,
-‘এ্যাই, তোর সমস্যা কী? ঠিক করে বলবি কিছু না-কি কানের নিচে দিব একটা?’

-‘আমি আছি আমার জ্বালা নিয়ে আর তোরা আমাকে নিয়ে মজা নিচ্ছিস। সারা প্লিজ, ফোনটা দে একবার। রেগে যাচ্ছি কিন্তু।’

উজমা হাত বাড়ানোর সাথে সাথে মাইসারা ফোন দিয়ে দিল। মেয়েটার মনের অবস্থা হয়তো ভালো না। এজন্য আর রাগাতে চাইল না। উজমা ফোন হাতে নিয়ে ডাটা বন্ধ করে অফলাইন চলে এলো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বলল,

-‘আমি যাচ্ছি, প্রয়োজনে কল করিস।’

তড়িঘড়ি তার পথ আটকে দাঁড়াল কাইফ। বলল,
-‘কথাটা ক্লিয়ার কর। যদি কোনো সমস্যা থাকে, আমাদের বল। সমাধান করার জন্য আমরা আছি।’

-‘এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই।’

-‘বোকার মতো কথাবার্তা বলিস না। সব সমস্যারই সমাধান আছে। তোর এসব বোকা বোকা কথা শোনে, মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেও ভাইয়া বলেছে তোর জন্য ভালো পাত্র খুঁজতে। আমি খোঁজ লাগিয়েছি। যদি কোনো দিকে পেয়ে যাই, এবার আর থামব না। সিরিয়াসলি বলছি, উজমা। যদি মনে কিছু থেকে থাকে, সেটা স্পষ্ট করে বল আমাদেরকে।’

-‘তোরা কি আমাকে শো-রুমের পণ্য পেয়েছিস? এভাবে একেকজন একেকদিক থেকে…। আমি মানুষরে ভাই। এত চাপ আর নিতে পারছি না।’

যে মেয়ে হাজারও যন্ত্রণায় শক্ত থাকতে জানে, তাকে আজ সামান্যতেই ভেঙে পড়তে দেখে সবারই খারাপ লাগল। কষ্ট হলো। তাক্বদীম বলল,

-‘তুই শুধু বল, তোর মন কী চায়? বাকি যা সমস্যা তৈরী হবে, সব আমরা সমাধান করে নিব।’

-‘তোরা এটাকে এত ইজি করে ভাবছিস কী করে? তাছাড়া আমি কেন ফারশাদকে ভালোবাসতে যাব? সে একজন ভালো প্লেয়ার, খেলা তো দেখাই যায়। যে কেউ দেখে। তার মানে কি এই যে, তাকে ভালোবাসতেই হবে? আমার সাথে তার যায়? কীসের সাথে কী মিলাচ্ছিস, তোরা?’

নিজের দুর্বলতা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে চাইল না উজমা। মনে এক থাকলেও মুখে বলল আরেক। অথচ ফারশাদকে যতবার ভুলতে চায়, ততবারই ভীষণভাবে মনে পড়ে। যতবারই ভাবে, এরপর আর মনে করব না, ততবারই তীব্রভাবে মনে করে একাকী ছটফট করে। যতবারই সব স্মৃতি মুছে ফেলতে চায়, ততবারই স্মৃতিগুলোর মাঝে তাকে খুঁজে ফিরে বার বার। কিছু স্মৃতি মুছে ফেলা এত কষ্টের হবে, আগে কখনও বুঝেনি সে। প্রতিনিয়ত তার স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করতে গিয়ে, তাকে ভুলতে গিয়ে সীমাহীন যন্ত্রণায় মন তার জ্বলেপুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে। সব চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে। কোনোভাবেই স্মৃতি মুছে ফেলা যাচ্ছে না, তাকে ভুলা যাচ্ছে না। সব স্মৃতি মুছে দিয়ে তাকে ভালো না বেসে থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে কখন যে মনের অতলান্তিক সীমানায় তার উপস্থিতি আবিষ্কার করেছে, সেটা শুধু তার মন জানে। মুখে যতই ভালোবাসি না, ভালোবাসব না বলুক না কেন, মন তো অনেক আগেই ফারশাদ মুনতাসীর নামের সাথে জড়িয়ে গেছে। সম্পূর্ণ অস্তিত্বে মিশে আছে মানুষটা। খুব গোপনে অথচ ভীষণ যত্নে তাকে মনের ভেতর অন্তহীন ভালোবাসার আবেশে মুড়িয়ে রেখেছে উজমা। ফারশাদের শূণ্যতাই তার মনকে পরিপূর্ণ করেছে। বুঝিয়েছে, শূণ্যতার মাঝেও কিছু পূর্ণতা লুকিয়ে থাকে। আর এই পূর্ণতাটাই হচ্ছে, ভালোবাসা। এই ভালোবাসা অপ্রত্যাশিত বলেই তাকে অপ্রকাশ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে সে। মন তো অনেক আগে থেকেই জানে, এই ভালোবাসা কোনোদিন সুখের মুখ দেখবে না। যে ভালোবাসা সারাজীবন না পাওয়ার আক্ষেপ দিয়ে যাবে, তাকে প্রকাশ করে নিজেকে কোনোভাবেই দুর্বল প্রমাণ করতে পারবে না সে। থাক তার অনুভূতি গোপন, থাক তার সব আবেগ, সব ভালোবাসা অপ্রকাশিত। কিছু ভালোবাসা এভাবেও সুন্দর। নিজের অনুভূতি লুকোতেই আকাশ-পাতাল সব যুক্তি দেখাতে শুরু করল সে। তার সেইসব যুক্তি ও কথা কারোরই পছন্দ হলো না। উজমা যত যা-ই বলুক, তার মুখ ও চেহারা আলাদা আলাদা সাক্ষ্য দিচ্ছে। ছেলেরা কেউ এটা না বুঝলেও মাইসারা ও রাইদাহ বুঝে নিল মুহূর্তেই। উজমাকে পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দিতে, তাকে আরেকটু সাহস ও মনের জোর দিতে রাইদাহ বলল,

-‘আচ্ছা বাদ দিই এসব কথা। ফারশাদ মুনতাসীর হচ্ছে আকাশের চাঁদ। যাকে শুধু দু’চোখ ভরে দেখা যায় অথচ ছোঁয়া যায় না। হাত বাড়িয়ে ওই চাঁদটাকে ছোঁয়ার ক্ষমতা আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধুটির না থাকলেও চাঁদের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার ইচ্ছে ও আগ্রহ দুই-ই আছে। আপাতত আকাশের চাঁদ আকাশেই থাকুক, তাকে মাটিতে নামানোর দরকার নেই। যদি কোনোদিন স্বেচ্ছায় মাটিতে নেমে এসে আমাদের সবার কাছে সে উজমাকে চায়, তাহলেই ব্যাপারটা ভেবে দেখব, আমরা। কী বোলো সবাই?’

রাইদাহ’র কথায় হেসে ফেলল সবাই। এরপর ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে যা কিছু আলাপ-আলোচনা বাকি ছিল, সেসব শেষ করে বাড়ি ফিরল।

***

বাড়ি ফিরে উজমা ভীষণ অবাক হলো। ফারিশা, তাম্মি ও আরও একজন ভদ্রমহিলাকে বসার ঘরে দেখে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মুচকি হেসে সালাম দিয়ে, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। ফারিশা নিজের শাশুড়ি মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে উজমা তাঁকেও সালাম দিয়ে প্রাথমিক আলাপ সেরে বলল,

-‘আপনারা গল্প করুন, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

নিজের রুমে এসে ভ্যানিটিব্যাগ রেখে পরনের স্কার্ফ, স্যু খুলে ওয়াশরুমে যেতে চাইলে মিশকাত ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে তার রুমে এসে বলল,

-‘উজমা, একটু শোন।’

মিশকাতকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। উজমা তাকে একটু লক্ষ্য করে বলল,
-‘জরুরী কিছু বলবে?’

মাথা নেড়ে বিছানায় বসলো মিশকাত। উজমাও তাকে অনুসরণ করল। তার গুরুগম্ভীর মুখখানি ইতিমধ্যেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল মনে। ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করল উজমা। মিশকাত কিছুটা আমতা-আমতা স্বরে বলল,

-‘ধর, ভালো কোনো ফ্যামিলি থেকে ঊষার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলো। এখন, বড়োবোন রেখে ছোটোবোনের বিয়ে দেয়াটা কেমন হবে? এমনিতেও পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে তোকে নিয়ে অনেক নেগেটিভ মন্তব্য ছড়াচ্ছে। এটা যদি হয়, এতে আরও বেশি ছড়াবে। সবার কাছে তুই ছোটো হয়ে যাবি। এদিকে ভালো পাত্র পাওয়া কঠিন। সুযোগ সবসময় আসে না। যেহেতু একবার একটা ভালো সুযোগ এসেছে, সেটাকে কাজে লাগানো উচিত কি-না বুঝে উঠতে পারছি না।’

পুরো কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনল উজমা। বুঝল। ভাবল। নিজের জন্য বোনের জীবন নষ্ট হবে, এটা সে কোনোকালেই চাইতে পারবে না। তার কপালে বিয়ে নেই, তার ভাগ্যে স্বামীসুখ নেই, তাইবলে ছোটোবোন কেন এসব থেকে বঞ্চিত হবে? বিষয়টা খোলাখুলিভাবে জানার জন্য বলল,

-‘প্রস্তাবটা কে এনেছে?’

-‘তোদের ফারিশাবু। ওনি ওনার দেবরের জন্য আলাপ নিয়ে এসেছেন। তোর ভাই এইমুহূর্তে ঊষার বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছে না। কেন রাজি হয়নি, সেটা হয়তো তুই বুঝতে পারছিস। আর যদি না বুঝিস, আমি-ই বলি।’

ভাবীর দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকাল উজমা। মিশকাত বলল,
-‘ফারশাদ না-কি বলে গেছে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আর কোনো কথা না তুলতে। আমি জানি না, উনি এমন কথা কেন বলেছেন। কেন-ই বা, তোর প্রতি অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও কোনোপ্রকার সম্মতি জানানোর আগে, নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিয়েছেন। তোর ভাই শুধু চাইছে, অন্যত্র বিয়ে দেয়ার আগে এই ব্যাপারে তোর কাছ থেকে নেগেটিভ বা পজেটিভ একটা সিদ্ধান্ত শুনতে। তোর বিয়ে দিলে তবেই ঊষার কথা ভাবা যাবে।’

-‘তুমি ঠিক কী বুঝাতে চাইছ?’

-‘তুই কি ফারশাদকে বিয়ে করতে রাজি আছিস? যদি হ্যাঁ হয়, আমাকে বলতে পারিস। আর যদি না হয়, সেটাও বলতে পারিস। ফারশাদের চাওয়ায় আমি কোনো ভুল দেখিনি, বরং ওনার সাহসী সিদ্ধান্তটা আমার ভালো লেগেছে। উনি তোর ভাইঝিকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছেন, যদি তার ভাগ্যে তুই থাকিস, কোনোদিন তোর অমর্যাদা করবেন না। পিছনের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে তুই যদি বর্তমান হারিয়ে ফেলতে চাস, তাহলে আমি বলব তুই এখনও বোকাই আছিস। অতীত ধরে বসে থেকে জীবন থেকে বর্তমানের সুখ, ভালোবাসা ও ভালোবাসার মানুষকে স্বেচ্ছায় যারা হারিয়ে ফেলে, নিঃসন্দেহে তারা অনেক বেশি বোকা।’

-‘তুমি আমাকে কী করতে বোলো, ভাবী?’

-‘এখনও সময় আছে, যদি মনে হয়, ফারশাদের অনুভূতিকে মূল্যায়ন করা উচিত, তাহলে তার দেয়া প্রস্তাবে রাজি হতে পারিস। আমি তোকে সুখী দেখতে চাই। চাই তোরা দুইবোন, স্বামী-সংসারে দু’হাতভরা সুখ নিয়ে নিজেদের জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখিস।’

-‘এ-ও কি সম্ভব?’

-‘অসম্ভব কেন? তুই কী ভাবিস? আমি তোকে বুঝি না? তোর মনের খবর টের পাই না? আমি হয়তো তোর ভালো বন্ধু হতে পারিনি, কিন্তু ভালো বোন তো হতে পেরেছি। নিজেকে ঠকে যেতে দিস না, উজমা। মনে যা আছে, প্রকাশ করে ফেল। একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ভালোবাসা যদি জীবন থেকে একবার হারিয়ে ফেলিস, সারাজীবন মাথা ঠুকে মরলেও সেই ভালোবাসা ফিরে পাবি না। জেনে-বুঝে নিজেকে তুই কেন এত কষ্ট দিচ্ছিস?’

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করল উজমা। তার কী করা উচিত, কী সিদ্ধান্ত জানানো উচিত, সেটাই বুঝে উঠতে পারল না। মিশকাত নিজের ফোনের সেইভ নম্বর থেকে খুঁজে খুঁজে ফারশাদের নম্বরটা বের করে উজমার মোবাইলে সেইভ করে দিয়ে বলল,

-‘কিছুদিন ধরেই তোর মাঝে যে পরিবর্তন আমি দেখেছি, তাতে নিশ্চিত, তুই প্রেমে পড়েছিস। প্রতি সকালে তোর ফোলা ফোলা চোখ, মনমরা মুখ, জোরপূর্বক হাসি-আনন্দে মজে থাকার মিথ্যে অভিনয়, এগুলো সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও আমার চোখ এড়ায়নি। মনে আছে, সেই বৃষ্টিভেজা রাতে যখন ফারশাদ তোকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে এলো, তা-ও পর্যাপ্ত ভরসার সাথে? সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, একটা যোগ্য মানুষ তোর জীবনে এসেছে। যেখানে বন্ধুবান্ধব ছাড়া অন্যসব পুরুষের দৃষ্টি ও ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে নিজেকে তুই বাঁচিয়ে রাখিস, সেখানে অচেনা এই পুরুষটাকে ভরসা করেছিলি কেন? কেন তার হাত ধরে বাড়ি ফিরেছিলি? কেন ওই মুহূর্তে, সে তোর সাহস হয়ে দাঁড়িয়েছিল? এই সবকিছুর উত্তর কী, উজমা?’

মন যা চায়, তা কী পাওয়া হয়? সব চাওয়াই কি জীবনে পরিপূর্ণ সুখ হয়ে ধরা দেয়? এত ভয়, এত সংশয় মনে নিয়ে কীভাবে কাউকে ভালোবাসার মতো ভুল করে ফেলল সে? এভাবে তো কাউকে ভালোবাসার কথা ছিল না। তবে কেন হলো? কেন সে কারও মায়ায় পড়ে গেল? কেন ভালোবাসার মতো মরণফাঁদে পা দিয়ে ফেলল? এত কথা ভাবতে গিয়ে সীমাহীন যন্ত্রণায় মন ডুকরে উঠল। কী উপায়ে নিজেকে লুকোবে এখন, দিশা খুঁজে পেল না। মিশকাত তাকে বুঝানোর বাহানায় আবারও বলল,

-‘ফোন নম্বরটা সেইভ করে গেলাম। যদি কিছু বলার থাকে, নিজেই বলিস। আমি ঊষার দিকটা সামলাই। তোর ভাইকে বলি যে, আপাতত তানজীমের সাথে ঊষার অ্যানগেজমেন্টের কথাবার্তা এগিয়ে রাখুক। বিয়ে পরে হবে। তানজীম না-কি দুই মাসের ছুটিতে দেশে এসেছে। এর ভেতরেই সব আয়োজন করতে না পারলে…।’

অনেকক্ষণ নীরব থেকে উজমা বলল,
-‘আমার জন্য তোমরা ঊষার জীবন থামিয়ে রাখবে কেন? ওর কথা ভাবতে পারো, ভাবী। আমি একটুও কষ্ট পাব না।’

-‘এতটাও স্বার্থপর হওয়া যায় না, উজমা। লোকজনের কথা বাদ দিলাম। আমরা তো পরিবারের মানুষ। একজনকে রেখে অন্যজনকে সুখী দেখব কীভাবে? এমন যদি হয়, পরবর্তীতে তোকে বিয়ে দেয়া অনেক কষ্টের হয়ে যাবে।’

-‘না হোক বিয়ে, ক্ষতি তো নেই।’

-‘তুই আমার কথা কী বুঝতে পারছিস না?’

-‘আমি বুঝতে চাইছি না।’

-‘কেন?’

-‘তুমি ফারিশাবুকে বোলো, ঊষাকে যদি ওনাদের পছন্দ হয়, বিয়ের ব্যাপারে এগোতে। আমার কথা ছাড়ো। আমি যেমন আছি, ভালো আছি।’

নিজের বোন হলে হয়তো উজমার এই ঘাড়ত্যাড়ামি আচরণে তাকে একচোট শক্ত কথা শুনিয়ে দিত মিশকাত। শত হলেও ননদ। একটু দূরত্ব তো আছেই। এই দূরত্বই কিছু সহজ কাজে বাধাপ্রদান করছে। অধিকার থাকলেও যথাসময়ে অধিকার দেখানো যায় না। উলটে দূরত্বের কারণে সামান্য ভুল থেকে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। অকারণ মনমালিন্য ও দ্বন্দ্ব ভালো লাগে না মিশকাতের। যতটুকু বুঝানোর বুঝিয়েছে, এরচেয়ে বেশি বুঝাতে গেলে সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারও ওপর মাত্রাতিরিক্ত অধিকার ফলানোর আগে তাকে বোঝার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দিতে হয়। এই কারণেই সব কথার ইতি টেনে মেহমানদের তদারকি করতে রুম ত্যাগ করল সে।

***

হাত-মুখ ধুয়ে, ফোন হাতে নিয়ে আবারও লাইভ খেলা দেখতে বসেছিল উজমা। এক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার আগেই দেখা গেল, রানআউট হয়ে গেল ফারশাদ। মুহূর্তেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল উজমার। যুতমতো খেলাও দেখতে পারল না। যখন একটু সময় পেল দেখার, তখনই আউট। এটা কোনো কথা? ফারশাদের চেহারাটা এমনিতেও মলিন ছিল। ছেচল্লিশ রানে রানআউট হয়ে ঘনকালো আঁধারে তলিয়ে গেল তার মুখবয়ব। হেলমেট সরিয়ে পরাজিত সৈনিকের মতো মাঠ ত্যাগ করল সে। ফোন রেখে বসার ঘরে এলো উজমা। মেহমানদের সাথে কিছু সময় গল্প করল। ফারিশা তখন উসাইদকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘তুমি যদি চাও, আমি সপ্তাহ দশদিনের মধ্যে সব আয়োজন শুরু করতে পারি।’

উসাইদ এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও বোনের সুখী জীবনের কথা চিন্তা করে সম্মতি জানানোর মনস্থির করল। এদিকে এক বোন রেখে অন্য বোনের বিয়ে নিয়ে ভাবতে মন থেকে সায় পাচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, উজমার প্রতি অন্যায় হচ্ছে, অবিচার হচ্ছে। আরেকদিকে ফারশাদও পথচেয়ে আছে। মাঝখানে উজমা নির্বিকার। সবমিলিয়ে তার এখন দুঃশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সে ফারিশার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার সাহস পেল না। শুধু বলল,

-‘বুবু, তুমি তো বুঝতেই পারছ, উজমাকে রেখে ঊষার কথা ভাবতে পারব না। আমি চাইছিলাম, আরও দু’বছর পর ঊষার কথা ভাবতে।’

-‘অসুবিধা নেই। জীম যদি আগামী মাসে চলেও যায়, দু’বছর পর আবারও আসতে পারবে। এর ভেতরে উজমাকে তুমি বিয়ে দিতে পারবে, ইনশা’আল্লাহ্। তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে, উজমাকে রেখে আমি ঊষাকে কেন চাইলাম?’

-‘স্বাভাবিক। এটা আমি প্রথম থেকেই ভাবছি।’

-‘উজমার জন্ম তারিখ তো আমি জানি। জীমেরটাও। হিসেব করে দেখলাম, ওরা প্রায় সমবয়সীই। মাস, দেড় মাস আগেপিছে। জুনিয়র-সিনিয়র নিয়ে আমার মতামত পজেটিভ হলেও জীমের দিক থেকে নেগেটিভই হবে। ও এটা নিয়ে গাইগুই শুরু করবে। মাঝখানে একটা কনে দেখেছিলাম আমাদের আত্মীয়ের মধ্যে। মেয়ে মাত্র এক সপ্তাহের বড়ো। আমি শুধু ওকে বলেছিলাম, ‘রূপার জন্য পাত্রের খোঁজ চলছে। তুমি যদি ওকে পছন্দ কোরো, তাহলে আমাকে বলতে পারো। দুটোকে একসাথে বেঁধে দেব।’ ও এমনভাবে নাকমুখ কুঁচকে আমাকে শাসাতে শুরু করল, ভয় পেয়ে আমি আর ওই বিষয় নিয়ে শাশুড়ি মায়ের সাথে কোনো আলাপ করতে পারিনি। তাছাড়া, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের একটু পার্থক্য থাকলে বোঝাপড়াটা চমৎকার হয়। যদিও একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম, তবুও আমার মনে হয়, একটু পার্থক্য থাকা উচিত। এজন্যই আমি ভেবেচিন্তে উজমার বদলে ঊষাকে চাইলাম। দু’জনকে মানাবেও ভালো। এখন বাকিটা তোমাদের ইচ্ছে।’

-‘বুবু, তাড়াহুড়ো না করে আরেকটু সময় নিয়ে ভাবা উচিত না?’

ভাইয়ের এই কথায় উজমার রাগ হলো। ভাই সবসময় তাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে, ঊষার কথা ভাবতে ভুলে যাচ্ছে। অথচ তানজীম ছেলে হিসেবে ভালো। যতটুকু দেখেছে, চিনেছে, খারাপ মনে হয়নি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে বলল,

-‘বুবু, ভাইয়ার কথা ছাড়ুন। আপনি আপনার দেবরকে নিয়ে আরেকদিন আসুন। উনি সরাসরি ঊষাকে দেখুক, তারপর সিদ্ধান্ত নিক। তার নিজেরও একটা পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে।’

উজমার কথার যুক্তিতে মাথা নেড়ে ফারিশা বলল,
-‘তুমি ঠিকই বলেছ। ও চলে যাবে ভেবে আমি-ই তাড়াহুড়ো শুরু করেছি। ভেবেছি, দেশ ছাড়ার আগে ওকে ঘরমুখো করব। এমনিতে কোনো রিলেশন নেই ওর, এজন্যই আমাদের এই তাড়াহুড়ো আরকি।’

-‘হ্যাঁ, আর আপনার দেবরের যদি ঊষাকে পছন্দ হয়, তখন নাহয় বিয়ে ও অ্যানগেজমেন্ট নিয়ে ভাবলেন। এখানে দু’জনের সম্মতিরও দরকার আছে।’

আজকের মতো কথাবার্তার সমাপ্তি হলো এখানেই। মেহমানদের বিদায়ের পর, সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই এক হয়ে বসলো। সোফায় আধশোয়া হয়ে বাংলাদেশের খেলা দেখতে বসেছে উজমা। খেলার শেষ মুহূর্ত এখন। হারজিতের একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। সব খেলোয়াড়দের চেহারায় উৎকণ্ঠা নেমে এসেছে। এমন মুহূর্তে মামীমাকে নিয়ে ঊষার দিকটাও ভেবে দেখার আলোচনা শুরু করল উসাইদ। বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘তুই রুমে যা তো।’

-‘কেন?’

-‘সাউন্ডের জন্য কথা বলা যাচ্ছে না।’

উজমা ভীষণ অবাক হলো। মন খারাপ করে টেলিভিশন বন্ধ করে, রুমে এসে ফের মোবাইলের লাইভেই খেলা দেখতে বসে গেল। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল, দ্বিতীয় দিনের ম্যাচেও বাংলাদেশ বিশাল ব্যবধানে হেরে গেছে। খেলা শেষ হওয়া মাত্রই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান খারাপ মন্তব্যের ছড়াছড়ি শুরু হলো। যে যেভাবে পারল, প্রত্যেকটা ক্রিকেটারকে বাজে ভাষায় গালিগালাজ করল। উজমার ইচ্ছে হলো একেকটার নাকমুখ চ্যাপ্টা করে দিয়ে বলুক, ‘বেশি বাহাদুরি থাকলে নিজেরা গিয়ে খেলে দেখা না, খেলা কত আরামের।’ বিড়বিড়িয়ে বকেও গেল কিছুক্ষণ। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, এই হারজিত, ভক্তদের আক্রমনাত্মক মন্তব্য, পারিবারিক কিছু জটিলতা ও নিজস্ব কিছু দুঃখ-যন্ত্রণার ভারে ফারশাদ ভয়ানক এক কঠিন মুহূর্ত কাটাচ্ছে। যতই স্বাভাবিকভাবে খেলুক না কেন, মনে নিশ্চয়ই চাপা একটা আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। যার জন্য খেলার মাঠে সে থেকেও পরিপূর্ণ মনোযোগী ছিল না। হয়তো মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো কিছু মানসিক চাপের কারণে সে ঠিকমতো প্রাকটিস করতে পারেনি। এরকম হাজারও কূল-কিনারাহীন ভাবনা ভাবতে গিয়ে, নিজের মনের সাথে আরও সাত-পাঁচ জটিলতার হিসেব সামলে ফোন হাতে নিল সে। সেইভ করা নম্বর চেক করতে গিয়ে দেখল, মিশকাত ক্রিকেটার দিয়ে একটা নম্বর সেইভ করে রেখেছে। হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করেও অনেকক্ষণ ধরে বসে রইল। মাথায় কিছু আসছে না। এইমুহূর্তে কী লিখে ম্যাসেজ করা যায়? কী লিখলে একটা মানুষের মন-মেজাজের পরিবর্তন ঘটতে পারে, সে মানসিক শান্তি পেতে পারে, তার অনেকদিনের জমানো কষ্ট দূর হতে পারে, তার চোখের পানির মূল্যায়ন হতে পারে? ঠিক কী লেখা উচিত তার! এলোমেলো অনেক কথাকে মনে ঠাঁই দিয়ে, ভয়, লজ্জা, সংকোচ নিয়ে, কম্পরত আঙুলের সাহায্যে টাইপ করল,

-‘জীবন খুব ছোট্ট, এটা আমরা জানি। এই ছোট্ট জীবন অনেকভাবেই আমাদের পরীক্ষা নেয়। হারজিতের মতো একেকটা লড়াইয়ে আমাদের টেনে নিয়ে কখনও হোঁচট খাওয়ায়, কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করে। কঠিনসব পরীক্ষা দিতে দিতে আমরা একসময় ক্লান্তও হয়ে যাই। অনেকসময় মনে হয়, জীবন আমাদের থেকে শুধু কেড়ে নেয়, বিনিময়ে কিছু দিতে পারে না। তবুও আমরা এই জীবনটাকে ভালোবাসি। বাঁচতে চাই। হার হোক কি জিত, শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাই। বেঁচে থাকতে গেলে নেগেটিভ, পজেটিভ সব ধরনের মন্তব্যকেই আমাদের গ্রহণ করে নেয়া শিখতে হয়। কিছু মন্তব্য আমাদের কাঁদায়, কিছু মন্তব্য হাসায়, আবার কিছু মন্তব্য অনুপ্রেরণা জোগায়। পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে। মনের জোর বাড়ায়। আমি জানি, আপনি এইমুহূর্তে ভীষণ ক্লান্ত। চোখজুড়ে ঘুম নেমে এসেছে আর মনজুড়ে আছে যন্ত্রণা। এই ম্যাসেজটা আপনার বিরক্তি বাড়াবে কি-না জানি না, তবে আমার মনে হচ্ছে, আজ আপনাকে কিছু কথা বলা উচিত।’

এতটুকুর পর একটু স্পেস রাখল উজমা। এরপর লিখতে শুরু করল,
-‘আপনি চলে যাওয়ার পর থেকে নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি আমি। একা একা অনেক হিসেব করেছি। একটা সময় উপলব্ধি করলাম, আমি হেরে গিয়েছি। ভীষণভাবে হেরে গিয়েছি। আর এই হেরে যাওয়ার মাঝেই আমি আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি সবকিছু পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছি, পারিনি। ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছি, সেটাও পারিনি। দূরে সরাতে চেয়েছি, এ-ও সম্ভব হয়নি। আপনাকে ভুলার চেষ্টা করেছি, ঘৃণা করে বাঁচতে চেয়েছি, আপনার নাম-নিশানা, সব মুছে ফেলতে চেয়েছি, তা-ও পারিনি। এত এত ব্যর্থতার হিসেব যখন মিলাতে গেলাম, তখনই মনে হলো আপনাকে ভুলে থাকা অসম্ভব। আমি পারছি না ভুলতে। আপনাকে ভুলে থাকার উপায় কী বলবেন? কেন আপনাকে ভুলতে গেলে এত কষ্ট পাচ্ছি? কেন আপনাকে ঘৃণা করতে গিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি? কেন আপনার স্মৃতি মুছে ফেলতে গিয়ে সেগুলোকে আরও যত্ন করে নিজের কাছে আগলে রেখেছি?’

এরপর আরেকটু স্পেস দিল উজমা। পরবর্তী লাইনে লিখল,
-‘আপনি জানতে চেয়েছিলেন, আপনাকে বিশ্বাস কেন করেছিলাম! আমার আটাশ বছরের জীবনে অনেক কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছি। পরিবার, সমাজ, আত্মীয়স্বজন সবকিছু দেখে, বুঝে, তিক্ত কিছু বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেছি। আপনি হয়তো জানেন, মেয়েরা দুর্বল। কিছু কঠিন মুহূর্তে মেয়েরা আসলেই দুর্বল। বিশেষ করে, রাস্তাঘাটে, অচেনা পরিবেশে, যাত্রীবাহী বাস কিংবা অটোতেও। চলতে পথে অনেক সময় মেয়েরা হেরেসমেন্টের শিকার হয়। কেউ কেউ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে, কেউ কেউ সয়ে নেয়। সব পুরুষেরা মেয়েদের যোগ্য সম্মান দিতে জানে না। ওইদিন রাতে, সাকিবের মধ্যে আমি যে লালসা দেখেছিলাম, তাতে আমি ভয় পেয়েছিলাম ভীষণ। মনে হচ্ছিল, ওইটুকু রাস্তা আমার জন্য শত মাইলের দূরত্বের হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এগোতে পারছিলাম না। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে ভাসছিল, শৈশবের সে-ই জঘন্য স্মৃতি। বাড়িতে জানানোর পর ভাবী আপনাকে পাঠাবে ভাবিনী। তবে ওই রাতে, আপনাকে দেখার পর সৎ ও অসতের মধ্যে যে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে, সেটা খুব করে উপলব্ধি হলো। ট্রাস্ট মি, ওই মুহূর্তে আমি আপনাকে ব্যবহার করিনি। একজন পরোপকারী মানুষ হিসেবে আপনার কাছ থেকে উপকারটা গ্রহণ করেছি। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত, অথচ খুবই বিব্রতকর, তবুও আপনি যে ধৈর্য্য, সাহস ও সদাচরণের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তাতে আপনাকে বিশ্বাস ও ভরসা না করে উপায় ছিল না। আপনি দূরে চলে গেলেও আপনার প্রতিটা কাজ, কথা ও অনুভূতির প্রভাব রেখে গিয়েছেন। আমার মতো ঘাড়ত্যাড়া মেজাজের মেয়েটাকেও দুর্বল করে দিয়েছেন। এলোমেলো করে দিয়েছেন। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। দিনের স্বস্তি, শান্তি কেড়ে নিয়েছেন। দিনরাত আমি শুধু চোখের পানি ফেলছি। একাকী কষ্টে জর্জরিত হচ্ছি। এখন আমার উপায় কী বলবেন? এসব থেকে মুক্তি কোথায় পাব আমি? কীভাবে পাব? আমার এত বছরের যত্নে রাখা মনটার এই এলোমেলো কাজকারবার মেনে নিতে পারছি না। সমস্যাটা যেহেতু আপনি তৈরী করেছেন, সমাধান দিবেন আপনি। পারবেন তো?’ – বাটারফ্লাই

অপরিচিত নম্বর বলে, ম্যাসেজের শেষে বাটারফ্লাই লিখে দিল উজমা। যেন এই ম্যাসেজদাতাকে ফারশাদ চিনতে পারে। খেলা শেষে সবে মাত্র রুমে ফিরেছিল ফারশাদ। বিছানার ওপর ফোন রাখা মাত্রই টুং করে একটা শব্দ হয়ে স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। ক্লান্ত থাকায় ম্যাসেজ দেখার আগ্রহ ছিল না তার। কিন্তু বাংলাদেশের নম্বর দেখে কৌতূহলবশত লক খুলে ম্যাসেজ ওপেন করে তব্দা খেয়ে বসে রইল। এটা কী লেখা? সত্যি না-কি মিথ্যে? এত লম্বা ম্যাসেজ উজমা পাঠিয়েছে? বিশ্বাস হলো না। একাধারে চার থেকে পাঁচবার ম্যাসেজ পড়ল। একটা সময় বুক ধড়ফড় অনুভূতি নিয়ে কল করে বসলো। প্রথমবার কল দেয়ার পর রিসিভ হলো না। আবার দিল, এতেও লাভ হলো না। অধৈর্য্য হয়ে ম্যাসেজ লিখল,

-‘প্লিজ, পিক আপ দ্য ফোন।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ছাব্বিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

ঋতুতে বসন্ত না এলেও মনে বসন্ত এসেছে। মনের বাগিচায় ফুটেছে রংবেরঙের ফুল। প্রতিটা ফুলের রূপে-রঙে-ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে মনপাড়া। অবিরত বইছে আনন্দ উল্লাস। ভালাবাসার রঙে লেপ্টে আছে অন্তর। সেই রং ছড়িয়ে পড়েছে গোটা অস্তিত্বে। শরীরে ভয়, কাঁপন জাগানোর পাশাপাশি ঠোঁটেমুখে এঁকে দিয়েছে শব্দহীন হাসি। সাহস নিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়ে কেবলই পিছনের সময়টাকে ভেবে ভেবে নিজেকে হাজারও বকাঝকা দিচ্ছিল উজমা। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ফারশাদ এখন ব্যস্ত। এই ম্যাসেজ সে দেখবে না, খেয়ালও করব না। অসংখ্য ম্যাসেজের ভারে তার পাঠানো এই ম্যাসেজটা পড়ে থাকবে চ্যাটবক্সের তলানিতে। কিন্তু ম্যাসেজ পাঠানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই যে সরাসরি কল চলে আসবে, এটা সে ভাবেওনি। এখন এই কল রিসিভ করবে না-কি ইগনোর করবে এসব দ্বিধান্বিত ভাবনায় ভুগতে ভুগতে কল কেটে গিয়ে রিটার্ন ম্যাসেজ এলো। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়েই জমে গেল উজমা। কী কথা বলবে? কীভাবে কী বুঝাবে? বুক তো কাঁপছে, ক্রমান্বয়ে। ভয়ানক সেই কাঁপন থামানোই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুণি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। কণ্ঠ বসে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে এসেছে। হাতের প্রতিটা আঙুল কাঁপছে। এত কম্পন সামলে উঠে ফোন হাতে নেয়াও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কপালে হাত চেপে চেপে আরও কিছুক্ষণ ফোনের দিকেই তাকিয়ে রইল সে। দু’তিন সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর আবারও কল এলো। কেউ এতবার করে কথা বলার আগ্রহ দেখালে তাকে অবহেলা করাটা অপমানের শামিল। মনে জোর এনে, বুকে ফুঁ দিয়ে স্ক্রিন ঘঁষে কল রিসিভ করে কম্পনরত কণ্ঠে শুধু সালাম দিল উজমা। ব্যস, তাতেই হলো। সব শব্দ, বাক্য কণ্ঠনালির কাছে আন্দোলন শুরু করলেও বেরিয়ে আসার সাহস পেল না। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো উজমার। ফারশাদ নিজেও সালামের জবাব দিল, খুব নীরবে। কতক্ষণ চুপ করে রইল। ভালো-মন্দ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না কেউ। দু’জনেই যেন নীরব মুহূর্তটাকে উপভোগ করছিল নিজেদের মতো করে। এভাবে শব্দহীন অনুভূতির সুগভীর সুখানুভবে কেটে গেল সময়। মিনিট পেরুলো, তবুও কারও মুখে কোনো কথা এলো না। একটা সময় ফারশাদ থেমে থেমে বলল,

-‘ক্যান ইউ হিয়ার মি?’

ঠিক কতদিন পর এই কণ্ঠস্বর কানে এলো, সেই হিসেব কর‍তে চাইল না উজমা। এত দূরত্ব, তবুও যেন কানের পাশেই কেউ ফিসফিস করছে। শব্দেরা এত যত্ন সহকারে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। দুটো মানুষের মধ্যে মাইলের পর মাইল দূরত্ব থাকার পরও এই মুঠোফোনের সাহায্যে কত সহজেই একে-অপরের নিঃশ্বাসের আনাগোনাও টের পাচ্ছে। ওই থেমে থেমে আসা কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে, এই মুহূর্তটা কী পরিমাণ আবেগ ও অনুভূতির। তার নিজেরও চোখ ভিজে এসেছে। আর একটু হলেই উপচে পড়বে পানি। খুব বেশি শব্দ, বাক্য প্রকাশ না করে উজমা শুধু উত্তর দিল,

-‘হুম…।’

-‘কেমন আছেন?’

এই প্রশ্নের উত্তরে ভালো আছি বলা যায়? বললেও কি মিথ্যা বলা হবে না? আসলেই কি সে ভালো আছে? মনের কঠিন অসুখ নিয়ে ভালো থাকা যায়? সত্য-মিথ্যার হিসেব কর‍তে গিয়েই অস্ফুটস্বরে বলে ফেলল,

-‘ভালো নেই।’

-‘কেন?’

এত বড়ো একটা ম্যাসেজ লিখে, মনের সব অনুভূতি জানানোর পরও এখন এই কেন’র উত্তর দেয়ার সাহস পাচ্ছে না উজমা। কথা বলতে গেলেই গলা ভেঙে আসছে। ভেতর চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণায় মনটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেয়া তো দূরে থাক, নিজেকে সামলাতেই পারল না উজমা। মুখে হাত চেপে ফুঁপিয়ে উঠল। জোরেশোরে নিঃশ্বাস নিয়ে কান্না চেপে রাখতে চেয়েও ব্যর্থ হলো। ফারশাদ জানতে চাইলে,

-‘ইজ ইট ট্রু, বাটারফ্লাই? আপনি কাঁদছেন, তা-ও আমার জন্য! আই কান্ট বিলিভ্ ইট…। সবকিছু একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।’

ভেঙে যাওয়া গলা ও কান্নারত মুখশ্রী নিয়ে কিছু বলতেও পারল না উজমা। চুপ করে শুধু শোনে গেল। ফারশাদ মুচকি হাসলো। বুড়ো আঙুলের আলতো স্পর্শে নিজের চোখের কোণে আসা আনন্দ অশ্রুটাও মুছে নিল। কণ্ঠে অসংখ্য মায়া ও ভালোবাসা মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘যদি আপনার সামনে থাকতাম, একমুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতাম না। একদম বুকের মধ্যিখানে আগলে নিয়ে আপনার সব কষ্ট মুছে দিতাম। কিন্তু আমি নিরুপায়। এত দূরে আছি যে, চাইলেও ছুঁতে পারব না। দেখতে পারব না। আপনার চোখের পানিটাও মুছে দিতে পারব না। আমার হাতদুটো নিশপিশ করছে। এক্ষুণি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। অথচ আমি যেতে পারছি না। কতটা অসহায় আমি ভাবতে পারছেন?’

উজমা নীরব রইল। ফারশাদ বলল,
-‘একটা ছোট্ট অনুরোধ করি?’

-‘করুন…।’

-‘এক্ষুণি চোখের পানি মুছে ফেলুন। কষ্ট হলেও আর এভাবে কাঁদবেন না। আপনার চোখের প্রতিফোঁটা পানিই না বলা কত কথা বলে দিচ্ছে। আমার তৃষ্ণা, ব্যকুলতা বাড়াচ্ছে। আপনার কান্নামাখা মুখটা আমার ভালো লাগে না, অথচ আমি চাইছি, খুব কাছে থেকে এই দৃশ্যটা অনুধাবন করতে।’

ফারশাদের এমনতর কথায় ভীষণ লজ্জা পেল উজমা। কান্না ভুলে গিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ফারশাদ বলল,
-‘চাইলেই এই মুহূর্তটাকে আমি ভিডিওকলে উপলব্ধি করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করব না। কিছু মুহূর্ত আমি স্ব-চক্ষে উপলব্ধি করতে চাই। আপনার চোখের পানি, ঠোঁটের হাসি, আপনাকে দু’চোখ ভরে দেখার তীব্র ইচ্ছা বুকে নিয়েও আরও কিছুদিন আপনাকে না দেখে থাকব। বুকভরা অনুভূতি নিয়ে যেদিন আপনার মুখোমুখি হব, ঠিক সেদিনই সবটুকু মুহূর্তকে খুব যত্নে ছুঁয়ে দেব। অপেক্ষা করতে পারবেন তো?’

-‘হুম…।’

-‘শুধু হুম, হুম, হুম… আর কিছু বলার নেই?’

কণ্ঠস্বর আবারও জড়িয়ে এলো উজমার। জড়ানো স্বরেই বলল,
-‘কী… বলব?’

-‘কতকিছুই তো বলা যায়। কত কথা জমা হয়ে আছে জানেন? কত শব্দহীন কষ্টের ঢেউ বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। কত নির্ঘুম রাত, কত অনুভূতি অন্তরে লালন করেও না পাওয়ার হিসেব কষে ডায়েরির পাতা ভারী করছি রোজ।’

বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না উজমা। যা বলার ছিল, তা তো ম্যাসেজেই বলে দিয়েছে। এসবের পর আর কী বলবে? কথা খুঁজে না পেয়ে একটু জড়োসড়ো গলায় বলল,

-‘আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’

-‘আপনি ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন, এটাই আমার জন্য সারপ্রাইজ। এরচেয়ে দামী সারপ্রাইজ আর কী হতে পারে?’

-‘হ্যাঁ, এরচেয়ে দামী। ভীষণ দামী। আমার কাছে একটা পিকচার আছে, চাইলেই আমি সেটা পাঠাতে পারি। কিন্তু এভাবে নয়। আমি চাই ওই মুহূর্তটা আপনি খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করেন। যেন আপনার মনে জমে থাকা অনেক দিনের দুঃখ-কষ্ট এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আর আমি শিওর, সামনা-সামনি এই সারপ্রাইজ পেয়ে আপনি আজকের চেয়েও বেশি চমকাবেন, খুশি হবেন।’

-‘ওকে ম্যাম, দেশে ফিরে আপনার দেয়া সারপ্রাইজ উপভোগ করব। দেখব, সেটা কতখানি হজমযোগ্য হয়।’

এরপর আর কী বলা উচিত, ভেবেই পেল না উজমা। ফোন হাতে নিয়ে আবারও চুপ হয়ে গেল। ওপাশ থেকে ফারশাদ বলল,
-‘আচ্ছা, আপনি তো বলেছিলেন, আপনার মনের এলোমেলো কাজকারবার মেনে নিতে পারছেন না। সেটার কি কোনো সমাধান পেয়েছেন?’

উজমা নিঃশ্বাসের শব্দে উত্তর দিল,
-‘পেয়েছি।’

-‘এরমধ্যেই পেয়ে গেলেন?’

-‘হুম…।’

-‘কী সমাধান পেলেন?’

-‘ওইযে বললাম, সমস্যাটা আপনার মাধ্যমে তৈরী হয়েছে, সমাধানও আপনি-ই দিবেন।’

-‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো কোনো সমাধান দিইনি।’

-‘দিয়েছেন।’

-‘কখন দিলাম?’

-‘এত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে সময় দিচ্ছেন, এটাই তো সহজ ও সুন্দর সমাধান। আমি আপনার কথা শুনছি, আপনাকে উপলব্ধি করছি, আপনার প্রতিটা কথায় আমার মনের অসুখ সেরে যাচ্ছে। এতদিন ধরে মন যেভাবে প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহূর্তে শুধু আপনার জন্য ছটফট করেছে, যেভাবে চোখের পানিতে প্রতিটা রাত কেটেছে, সেভাবে আজ আপনার এই সামান্য কথা ও অনুভূতির প্রখরতা দূরে থেকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে। আমার সব ছটফটানি থেমে গেছে। আমার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করে দিয়েছেন আপনি। কঠিন সিদ্ধান্তকে সহজ করে দিয়েছেন। এতকিছুর পরও যদি বলি, সমাধান আমি পাইনি, তাহলে মিথ্যে বলা হবে।’

-‘এইটুকুতেই কি মন ভরেছে?’

-‘হুম…।’

-‘আমার তো মনে হয় না। আমি যদি সারারাত আপনার সাথে কথা বলি, তাতেও মন ভরবে না, নিশ্চিত। এরকম একটা রাত কবে আসবে আমাদের জীবনে, যে রাতে হাতে-হাত রেখে আমরা পাশাপাশি হাঁটব, কাছাকাছি থাকব, মনের কথা আদান-প্রদান করব, দু’চোখ ভরে একে-অন্যকে দেখব? জাগতিক সব নিয়ম ও বিধিনিষেধ থেকে দূরে সরে নিজেদের জন্য একটু সময় খুঁজে নেব। এমন একটা রাত কি আসবে?’

-‘জানি না। তবে আমি অপেক্ষা করব। সে রাত যত দূরেই থাকুক, যত দেরীতেই আসুক, আমি ক্লান্ত হব না, অধৈর্য্য হব না, বিরক্তও হব না। বরং আপনার সমস্ত বকবকানি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে পথচেয়ে থাকব।’

-‘এইভাবে কথা বললে তো যে কারও হৃদয় নেচে নেচে উঠবে। আমি-ই অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছি। পারলে এক্ষুণি ছুটে আসি, কিন্তু অসম্ভব ব্যাপার। এতদিন অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য্য আপনি কোথা থেকে পাবেন?’

-‘আপনার রেখে যাওয়া চিঠি, আংটি, জ্যাকেট আর কিছু সুন্দর স্মৃতিই আমাকে ধৈর্য্য ধরতে সাহায্য করবে।’

এত চমৎকার একটা কথা শোনে মন ভরে উঠল ফারশাদের। সমস্ত বিষাদ নেমে গেল। উত্তর জানা, তবুও সে হাসিমুখে জানতে চাইল,
-‘ওগুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন?’

-‘ফেলে দেয়ার সাহস পাইনি।’

-‘একটা অদ্ভুত ইচ্ছে জেগেছে মনে, শুনবেন?’

-‘কী?’

-‘আমি আপনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চাইছি, এক্ষুণি। সম্ভব?’

আচানক এই কথায় শব্দ করে হেসে উঠল উজমা। লজ্জা, সংকোচ সব পালিয়ে গিয়ে মনের আকাশের সুখ পায়রাগুলো নেচে নেচে উড়ে বেড়াতে লাগল। সে লাজুক হেসে বলল,

-‘আপনার কথাবার্তার মতো ইচ্ছেটাও ভীষণ অদ্ভুত। অথচ এটা অসম্ভব। আপনি জানেন।’

-‘এটাই তো সমস্যা, বাটারফ্লাই। আচ্ছা, আরেকটা কথা বলি?’

-‘বলুন…।’

-‘সামনে এলে আবার পালিয়ে যাবেন না তো?’

এটা তো ভেবে দেখেনি উজমা। এতক্ষণ অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে গিয়ে এটা ভুলে গিয়েছিল যে, খেলা শেষে ফারশাদ দেশে ফিরবে। এখানেও আসবে নিশ্চিত। যেহেতু তার মনের আকাশে জমা হওয়া সব মেঘ কেটে গেছে। আসতে তো পারে। যদি আসে, কোথায় লুকোবে সে নিজেকে? কোথায় পালাবে? মুখোমুখি হবেই বা কীভাবে? লজ্জায় কানে ভোঁতা ভোঁতা আওয়াজ শুনল উজমা। ফারশাদ মিটিমিটি হেসে বলল,

-‘পালালে কিন্তু খবর আছে। যেখানেই পালাবেন সোজা তুলে নিয়ে আসব।’

-‘কবে ফিরবেন?’

-‘এখন থেকে দিন গোনা শুরু করুন। আজ থেকে ঠিক আট দিন পর দেশে ফিরব। দশ দিনের দিন আমি আপনার সামনে থাকব। প্রমিস…।’

-‘আমি অপেক্ষায় থাকব…।’

কথার মাঝখানেই ফারশাদের রুমের দরজায় নক হলো। সে নব ঘুরিয়ে চেক করতেই হুড়মুড়িয়ে সবাই তার রুমের ভেতর প্রবেশ করে বিছানায় যেমনে-তেমনে শুয়ে পড়ল। একেকজন কিছু ফলমূল, স্ন্যাকস্, জুস এসব নিয়ে ঢুকল। ফারশাদ সবার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে উজমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘একটু বিজি আছি, ফ্রি হয়ে নক দেব। বাই… টেইক কেয়ার।’

ফোন রেখে সে সবার সাথে আড্ডায় জয়েন হলো। ফাঁক দিয়ে নিজের অফিসিয়াল পেইজে ঢুকে চট করে একটা স্ট্যাটাস দিল। লিখল, ‘ওয়েলকাম টু মাই লাইফ, মাই লাভ, মাই বাটারফ্লাই। টুডে আই প্রমিস এ্যাগাইন, আই উইল লাভ ইউ টিল মাই লাস্ট ব্রেথ।’

***

একটা ছোট্ট স্ট্যাটাস মুহূর্তের মধ্যেই ঝড় তুলল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফারশাদের সঙ্গীরা যার যার কাছে ফোন ছিল, যারা তখন একটিভ ছিল, সবাই-ই স্ট্যাটাস দেখে ফারশাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অথচ ফারশাদ, স্ট্যাটাস দিয়ে দিব্যি ছুরি হাতে নিয়ে ফল কাটাকুটি করছে। তাকে এত শান্ত মেজাজে কাজ করতে দেখে নিহাদ বলল,

-‘এই পোস্টের মানে কী?’

পিস পিস করে রাখা আপেলের একটা টুকরো নিহাদের মুখে ঢুকিয়ে দিল ফারশাদ। বলল,
-‘মানে খুব সোজা, ফারশাদ মুনতাসীর শীঘ্রই বিয়ের পীড়িতে বসছে।’

যেখানে বাবার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, মায়ের স্বেচ্ছায় সংসার ত্যাগ, পরিবারের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থা, সেখানে ফারশাদ এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মনের জোর হুট করে কোথায় পেল, কীভাবে পেল? সবার মনেই প্রশ্ন জমা হলো। পরশ জিজ্ঞেস করল,

-‘শীঘ্রই বলতে কবে?’

-‘নির্দিষ্ট সময় বলতে পারছি না। তবে, যত দেরী হবে, ততই তাকে হারানোর চান্স বাড়বে। জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি আমি। আর কিছু হারাতে চাই না।’

এই কথা শোনে মাফিন প্রশ্ন করল,
-‘কে সে? কার কথা বলছিস তুই? তুই তো কখনও কাউকে ভালোবাসিসনি। তবে?’

মাফিন বয়সে তার সিনিয়র। বিবাহিত ও দুই সন্তানের বাবা। ফারশাদ তাকে বড়ো ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে, ভালোবাসে। আর মাত্র হাতেগোনা কয়েকটা ম্যাচ শেষ করেই অবসরে চলে যাবে সে। মান্যগণ্য সিনিয়র ভাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে ফারশাদ বলল,

-‘আগে বাসিনি, কিন্তু এখন বাসি। যাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিলাম, সে-ই রমণীই। এমন একটা মুহূর্তে আমার জীবনে এসেছে, যাকে চিনতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে, ভীষণভাবে আমি তার মায়ায় পড়েছি।’

-‘এজন্যই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?’

-‘হ্যাঁ, দেশে ফিরেই বিয়ের কাজটা আগে শেষ করব। দেরী করা মানেই তাকে হারিয়ে ফেলা। ওয়েট…।’

সবাইকে বসিয়ে রেখে উসাইদের নম্বরে কল দিল ফারশাদ। রিসিভ হওয়ার পর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। উসাইদ জানতে চাইল,

-‘হুট করে কী স্ট্যাটাস দিলি এটা? সবাই এরমধ্যেই তোকে ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে দিয়েছে।’

মনের আনন্দকে চেপে রাখতে পারছিল না ফারশাদ। এজন্যই জানিয়েছে। তাছাড়া, ক’দিন ধরে মিডিয়া তাকে নিয়ে যেসব ফালতু নিউজ ছড়িয়েছে, সেইসব ফালতু নিউজকে মুহূর্তেই থামিয়ে দিবে এই একটা নিউজ। উজমাকে নিয়ে কোনোপ্রকার রিস্ক সে নিবে না। তা-ই নাম-পরিচয় ছাড়া, কোনো ছবি ও ঠিকানা ছাড়া, নিজের ভক্তদেরকে ব্যক্তিগত মানুষের সম্পর্কে সামান্য এই ইঙ্গিত দিতেই এরকম একটা স্ট্যাটাস দেয়া। এতে সবাই নিশ্চিত হবে, সোহানার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। ইতিমধ্যে তার এই স্ট্যাটাস যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে দিতে সক্ষম সেটা সে বুঝেছিল। এই কারণে বন্ধুর কথায় খুব একটা চমকাল না। হো হো শব্দে হেসে উঠল। উসাইদ রেগে গিয়ে বলল,

-‘আশ্চর্য! তুই কি পাগল হয়েছিস? এখনও বিয়ের নামগন্ধ নেই অথচ তুই স্ট্যাটাস দিয়ে বসে আছিস।’

-‘বিয়ে তো সময়মতোই হবে। তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?’

-‘এই স্ট্যাটাসের মানে কী বল?’

-‘তোর একটুও লজ্জা নেই? ভুলে যাস না সম্পর্কে আমি তোর বোনের জামাই। থুড়ি, বোনের হবু জামাই। কথাটথা বলার আগে একটু তো বুঝে বলবি না-কি?’

-‘থাপ্পড় দিব, ফাজিল। তোর হাতে আমি আমার বোনকে দিইনি এখনও। দেব কি-না এখনও নিশ্চিত নই।’

-‘তাই? দিবি না? কার কাছে দিবি? পাত্র খুঁজে পেয়েছিস?’

-‘পাইনি এখনও, তবে পেয়ে যাব।’

-‘খামোখা উকিল-টুকিল ধরে টাকা খোয়াস না তো। পাত্র তুই জীবনেও পাবি না।’

ফারশাদ চিল মুডে আছে। সে বন্ধুর সাথে এমনভাবে কথা বলছে, যেন উজমাকে সে বিয়ে করে ফেলেছে। অথচ সানাই বাজার দিনতারিখও পাকা হয়নি এখনও। ফারশাদের এই দুষ্টুমি বুঝতে পারল না উসাইদ। মনমরা মেজাজে বলল,

-‘তুই কি ওকে অভিশাপ দিচ্ছিস?’

-‘আরেহ্, দূর। কেন?’

-‘তাহলে এইভাবে বললি কেন? আর এমন স্ট্যাটাসই বা কেন দিলি?’

মজা করতে গিয়ে বন্ধুকে টেনশনে ফেলে দিয়েছে ফারশাদ। শুকনো মুখের এই কথাগুলো শোনে হাসিও পাচ্ছে আবার খারাপও লাগছে। হুট করে মাথায় এত দুষ্টুমি কেন চাপল, বুঝল না। তবে মন যে যথেষ্ট হালকা ও ফুরফুরে এটা বুঝে গেল। আর এই সবকিছুই হলো, উজমার কণ্ঠস্বর শোনে। তার থেকে পজেটিভ সিদ্ধান্তের কারণে। দীর্ঘদিন ধরে যে অমাবস্যার আঁধার ছিল মনে, সেই আঁধার মিলিয়ে গিয়ে সুন্দর, ঝলমলে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়েছে মনের আঙিনা। সমস্ত আঁধার কেটে গিয়েছে। সে বন্ধুকে সান্ত্বনা ও ভরসা দিতে বলল,

-‘সব বলব, দেশে ফিরে আসি। তারপর।’

-‘ঠিক আছে। তোর ইচ্ছে।’

-‘শোন, একটা সিরিয়াস কথা বলি।’

-‘বল, শুনছি।’

-‘জীবন যদি আমাকে একটা সুযোগ দেয়, তোর বোনকে পাওয়ার, আমি কি সেই সুযোগটা কাজে লাগাব না?’

-‘সুযোগটা তোকে কে দিল? তুই-ই তো বলেছিলি, বিয়ে নিয়ে আর কোনো কথা যেন তোলা না হয়।’

-‘হুম, বলেছিলাম। এখন আরেকটা কথা বলি, আমি যতদিন দেশে না ফিরছি, তোর সাথে দেখা না করছি, ততদিন উজমাকে একটু দেখেশোনে রাখিস। আমি ফিরে এসে যেকোনোদিন বিয়ের প্রস্তুতি নিব।’

-‘আর ইউ সিরিয়াস? উজমা রাজি হবে?’

-‘রাজি হবে না কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?’

-‘না সেটা নয়। আজ ঊষার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। উজমাকে রেখে ঊষাকে কীভাবে দিব? আমি ভীষণ বিপদে আছি, দোস্ত।’

-‘ডোন্ট ওয়ারি। আমি আছি তো।’

কথার মাঝখানে মায়ের নম্বর থেকে কল এলে ফারশাদ নিশ্চিত হলো, স্ট্যাটাসটা মুনমুন হক্ব অবধি পৌঁছে গেছে। সে বন্ধুর থেকে বিদায় নিয়ে, ফোন সুইচড অফ করে, সঙ্গী-সাথীদের সাথে আড্ডা দেয়ার প্রস্তুতি নিল। সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতেই তাকিয়েছিল। সবাই-ই স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। না বললে ছাড় নেই, এটা বোঝা যাচ্ছে। পরবর্তী ম্যাচে জিতবে কীভাবে এটা নিয়ে আলোচনা না করে, তার লাভস্টোরি শোনার জন্য অতি আগ্রহে বসে আছে সবাই। সবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে ফারশাদ বলল,

-‘আরেহ্ বাবা তোমরা এভাবে তাকাচ্ছ, কেন? বলছি তো।’

***

স্ট্যাটাস যেমনই হৈচৈ ফেলুক, মিডিয়ায় ঝড় তুলুক, ঊষার মনে সেটা খুশির জোয়ার তুলল না। সে মন খারাপ করে বসে রইল। বিশ্বাসই হলো না, ফার‍শাদ মুনতাসীর এরমধ্যেই অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। অথচ কী বড়ো বড়ো কথা বলছিল এখানে। সব কথা মনে করে দুঃখে চোখে পানি এলো ঊষার। বোনটা কোনোদিন কি সুখের মুখ দেখবে না? রাতের খাবার টেবিলে সাজাচ্ছিল উজমা। বোনকে দেখে সামনে এলো ঊষা। ফোনের স্ক্রিন মেলে ধরে বলল,

-‘দেখো, ফারশাদ মুনতাসীর মুভ অন করছে।’

একবার, দুইবার, কয়েকবার, স্ট্যাটাসটা পড়ল উজমা। পেট ফুলে উঠল হাসিতে। ঊষা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অনর্থক হাসির কোনো কারণ খুঁজে পেল না। বলল,

-‘তুমি হাসছ?’

-‘তো? কাঁদব?’

-‘কাঁদবে কেন? তুমি তো আর ফারশাদ মুনতাসীরকে ভালোবাসো না।’

বোনের বোকাবোকা কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠল উজমা। ঊষা আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে। এত বেরসিক কেন তার এই বোন? এত দামী একটা মানুষ ও তার ভালোবাসাকে পাত্তাই দিল না! তখন উসাইদ এসে বসলো ডাইনিংয়ে। তাকে খুব চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাল। প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে উজমা জিজ্ঞেস করল,

-‘কিছু কি হয়েছে, ভাইয়া?’

-‘আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।’

-‘কেন?’

-‘ফারিশাবু ঊষাকে চাইছে, এদিকে ফারশাদ চাইছে তোকে। একবার বলে এখুনি বিয়ে নিয়ে কিছু বলিস না, আবার বলে আমি আছি তো। এদিকে কাইফ জানাল, ভালো একটা পাত্রের খোঁজ পেয়েছে। একবার গিয়ে তার সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিয়ে আসতে বলছে। আমি এখন ঠিক কী করব বুঝতে পারছি না।’

ভীষণ আশ্চর্যান্বিত মন নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল উজমা। হাত থেকে কাজ পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। কাইফের ওপর মেজাজ বিগড়ে গেল। এই ছেলে এরমধ্যেই পাত্র কোথায় পেয়ে গেল? তাকে একবার জানাবে না? সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-‘ওর ঘটকালি আমি বের করছি।’

সবাইকে খাবার খেতে বসিয়ে চট করে রুমে চলে এলো উজমা। ফোন হাতে নিয়ে ফটাফট কাইফের নম্বরে কল দিয়ে বসলো। রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা গরম মেজাজ নিয়ে ফুটন্ত তেলের মতোই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়ার ন্যায় চ্যাতে উঠে বলল,

-‘এ্যাই, তুই কইরে?’

-‘কেন? বাসায়।’

-‘কী করছিস?’

-‘ঘটকালি করছি।’

-‘আমার কিন্তু মাথা গরম আছে। উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলতে পারি।’

-‘কেন? হঠাৎ করে তাপমাত্রা এত বেড়ে গেল কেন?’

-‘ঘটকালি করবি ভালো কথা, একবার আমার মতামত জানতে চাইবি না?’

-‘তোর আর মত কী? ভালো পাত্র পেলে বিয়ে করবি, এইতো।’

-‘তুই আমার সামনে আয় খালি। তোকে যদি আমি পঁচা ডোবায় না ডুবাই তো দেখিস।’

ধমক খেয়ে ফোন রেখে দিল কাইফ। উজমা ক্ষ্যাপেটেপে মেজাজ হারিয়ে ফেলল। ইচ্ছামতো বকে গেল একেকটাকে। তাকে নিয়ে সবাই কেন এত ব্যতিব্যস্ত হলো, বুঝল না। আর কারও কি বিয়ে হচ্ছে না? আর কেউ কি বিয়ে ছাড়া থাকছে না? সাত-পাঁচ ভাবনার ভীড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওকল এলো। বন্ধুবান্ধবরা সবাই ইতিমধ্যে জয়েন হয়েছে। উজমাও বিরক্তিকর মেজাজ নিয়ে কলে জয়েন হলো। মাইসারা বলল,

-‘ফারশাদ মুনতাসীরের স্ট্যাটাস দেখেছ, সবাই?’

সবাই-ই দেখেছে বলে মাথা নাড়ল। রাইদাহ বলল,
-‘আজব দেশের আজব এক ক্রিকেটার। তার প্রপোজ করার ধরণটাও আজবই। ওই বাটারফ্লাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে কীভাবে সে ফারশাদ মুনতাসীরকে পটিয়ে ফেলল। আশ্চর্য এক প্রতিভার অধিকারী ওই রমণী। গিনেসরেকর্ড করে ফেলল রে।’

রাইদাহ ইচ্ছে করেই এইভাবে কথা বলছিল। তার উদ্দেশ্যই ছিল উজমাকে ক্ষ্যাপানো। মুখ থেকে মনের কথা টেনে বের করা। এমন কথাতে উজমা আরও ফুলেফেঁপে উঠল। বলল,

-‘উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা খাবি না, রাইদাহ।’

-‘আহা, উল্টাপাল্টা হতে যাবে কেন? ফারশাদ ভাইয়াই তো লিখল, ওয়েলকাম…।’

কথা শেষ করার আগেই উজমা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘ফালতু টপিক নিয়ে আলোচনা বাদ দিয়ে জরুরী কথা বল।’

উজমা যে অকারণ রেগে যাওয়ার পাত্রী নয়, সেটা সবাই জানে। মাইসারা ও রাইদাহ বাটারফ্লাইটা কে বুঝে গেলেও, তিন বন্ধু এর কিঞ্চিৎ পরিমাণ রহস্য উদঘাটন করতে পারল না। অনিক বলল,

-‘আচ্ছা মুশকিল তো। তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন আজ?’

তাক্বদীম বলল,
-‘বুঝলি না তো? জেলাসি রে ভাই, সব জেলাসি। নিজে সামনে থেকেও পটাতে পারল না। সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করে ফেলল। এই দুঃখেই রেগেমেগে অ্যাটমব্যোম হয়ে আছে আমাদের উজমা। যেকোনো সময় ব্লাস্ট করতে পারে।’

দূর, আজ সবাই তাকে নিয়ে মজা করতে শুরু করেছে। চিঠিটা এই দু’জনকে দেখানোই ভুল হয়েছে। একেকটা এত ফাজিল যে তাকে আজ নাকানিচুাবানী খাওয়ানোর পণ নিয়েই লাইনে এসেছে। সে-ও কম না। সুযোগই দেবে না কাউকে। এত সহজ না-কি তাকে গোল খাওয়ানো? সে-ই সবাইকে খাওয়াবে। তবে গোল নয়, সারপ্রাইজ। ফারশাদ দেশে ফিরে আসুক, তারপর। উসাইদেরও সম্মতির একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া মুনমুন হক্ব। এই নামটা মনে এলেই তো সমস্ত সুন্দর অনুভূতির মাঝে একখণ্ড ঝড়োহাওয়া নেমে আসে। কী হবে? এই ভালোবাসা সুখের মুখ দেখবে তো? আপাতত সব কথা গোপনই থাক। সময়-সুযোগ এলে বলা যাবে। ভেবেচিন্তে রাগ ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো উজমা। বলল,

-‘ক্ষিধে পেয়েছে। খেয়ে আসি? তোরা কথা বল।’

আহা, যার সাথে ঝগড়াঝাটি করবে বলে এত আয়োজন সে-ই যদি চলে যায়, কেমনটা লাগে? উজমার এই কথায় সবার মুখই পাংশু বর্ণ ধারণ করল। সারা বলল,

-‘দেখেছিস, পাত্তাই দিল না। ওকে একটা কঠিন ধাক্কা দিতে হবে। কীভাবে অস্বীকার করে, এড়িয়ে যায়, দেখলি তোরা? স্বীকারই করে না। অথচ আমরা দু’জনে খুব ভালো করে জানি, ফারশাদের বাটারফ্লাই কেবল ও-ই।’

ওরা সবাই আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিল, কথা বলল, প্রিয় বন্ধুটির জন্য অপেক্ষা করল, তবুও উজমার দেখা মিলল না আর। কোথায় যে লুকোল মেয়েটা!

***

চলবে…