মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-৩৫+৩৬

0
68

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – পঁয়ত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

শৈতপ্রবাহের কাঁপন ধরিয়ে প্রকৃতি এখন শীতের তীব্রতায় কাবু। পাখি জাগানিয়া ভোর অথচ পুরো শহর কী ভীষণ নীরব, নিস্তব্ধ, শান্ত। বনেবাদাড়ে, গাছের ডালে, অতিথি পাখিরা ভীড় জমিয়ে সুরে সুরে ডেকে মুখরিত করে তুলেছে চারপাশ। সেইসব সুর ও সৌন্দর্য ছাপিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে এগিয়ে চলা চা-বাগানের অত্যাধিক রূপে মুগ্ধ হয় নয়ন। তৃষিত চোখের তৃষ্ণা মিটে প্রকৃতির এই মায়াকাড়া রং-রূপ দেখে। হিম হিম হাওয়ায় ভেসে, উঁচু উঁচু পাহাড়ের কূল ঘেঁষে, ঘন সবুজে ঘেরা চা বাগানের পথ দিয়ে ভোরের স্নিগ্ধ, সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে ওরা যখন পাহাড়ের কিনারে পৌঁছাল, তখন সূর্যটা টকটকে লাল রং ধারণ করে কেবলই আকাশের বুক ছিঁড়ে উঁকি দিয়েছে। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এই দৃশ্য নিঃসন্দেহে চমৎকার ও ভীষণরকম অনুভবের। প্রতিটা চা-পাতার মাঝে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে সাময়িক সময়ের জন্য অন্যরকম এক সৌন্দর্যের জন্ম দিয়েছিল, এক সময় রোদের ঝিলিক পরে সেই সৌন্দর্যও মিইয়ে যেতে শুরু করেছে। কচি পাতায় জমে থাকা শিশির ছুঁয়ে, আঁকাবাঁকা পথ ধরে, হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে, সূর্যের প্রথম কিরণের মাঝে, আলো-আঁধারির মায়ায় ভাসতে ভাসতে, নিজেদের মেলে ধরার একটা সুযোগ পেল ওরা। এমন একটা ভোরকে খুব কাছে থেকে ছুঁয়ে দেখার তীব্র বাসনা ছিল মনে। নতুন ভোরের রূপে, রঙে পিছনের দুঃখমিশ্রিত স্মৃতিরা সুদূরে মিলিয়ে যাক। সব অশ্রুরা সুখে পরিণত হোক। এমনই একটা সুপ্ত বাসনা মনে পুষে পাহাড়ের কিনারায় এসে প্রকৃতির মায়ায় মিশে গিয়ে দুটো হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিল উজমা। বুকভরা নিঃশ্বাসের সাথে ভোরের সবটুকু বিশুদ্ধ বাতাস শুষে নিয়ে মনে মনে কিছু প্রার্থনা করল। রাস্তার একপাশে বাইক রেখে অর্ধাঙ্গিনীর পিছনে এসে দাঁড়াল ফারশাদ। উজমা যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেভাবেই দাঁড়াল, হাতে রাখল হাত। হিমশীতল পরিবেশে দমকা হাওয়া যেভাবে শরীরে কাঁপন ধরায়, ফারশাদের এই স্পর্শে সম্পূর্ণ কেঁপে উঠল তার পরিণীতা। অবিশ্বাস্য সুখ ও আনন্দ দু’জনার কন্ঠস্বরকেই রোধ করে দিল। চোখের কোণে যে আনন্দাশ্রু জমেছিল ভোরের সবটুকু স্বচ্ছতাকে ছুঁয়ে দেখার সুখে, সেটুকুও বাঁধভাঙা জলের ন্যায় গড়িয়ে পড়ল। এরকম একটা মুহূর্তে জমায়িত সব কথাকে শাখা-প্রশাখায় মেলে ধরতে ইচ্ছে হলো। মুহূর্তটা নীরবেই সুন্দর, এইভেবে কেউ-ই কোনো শব্দ করল না। প্রিয়তমার দুটো হাত মুঠোবন্দী করে তাকে নিজের দিকে ফেরাল ফারশাদ। আলগোছে চিবুক ছুঁলো। চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা পানি বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। আঁজলাভরে মায়াবী মুখখানি কিঞ্চিৎ উপরে তুলে ঘনকালো পাপড়ি ভেজা চোখের মায়ায় হারিয়ে গিয়ে বলল,

-‘অতীত আমাদের জীবনের একটা চ্যাপ্টার মাত্র। ওখানে দুঃখ-কষ্ট, ভুল-ভ্রান্তি, সত্য-মিথ্যা, সাহসিকতা কিংবা ভীরুতা, যা কিছু থাকুক – সব ভুলে যাও। প্রতিমুহূর্ত এটা মনে নিয়ে বাঁচো যে, ওই চ্যাপ্টারটা জীবন থেকে চলে গেছে। যে দিন ক্রমাগত অতিক্রম করে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলে আমরা বর্তমানকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকতে শিখে যাই, সে দিন আর ফিরে আসবে না। ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকে মনে নিয়ে, বর্তমানটাকে নষ্ট করে দেয়া কি ঠিক হচ্ছে?’

যখন মন সত্যিকার অর্থে ফারশাদ নামক মানুষের সাথে জড়িয়েছিল, তাকে ভালোবেসতে শিখেছিল, তখন এত ভয় তার জাগেনি। ভালোবেসে ভালোবাসা প্রকাশের পর প্রতি পদে পদে ভয় তাকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। এতদিন ভয় ছিল, শামীম। আর এখন, মুনমুন হক্ব। একটাকে তো থামানো গেল। অন্যটা যে কীভাবে থামবে, কীভাবেই বা ওই জঘন্য মহিলার মুখোমুখি হবে, ভাবলেই শরীরে কাটা দিয়ে উঠে উজমার। একে তো ভয়ংকর সেই রাতের পর আবারও যে নতুন ভোর আসবে জীবনে, এটা নিয়ে পূর্বপরিকল্পিত কোনো ভাবনা মনে ছিল না। ভয়ের কারণে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হতো না। কেবলই মনে হতো, সর্বনাশা ভালোবাসা এবার তার সর্বনাশ করবে। মনটাকে শেষ পর্যায়ে ভেঙেচুরে দেবে। এই নতুন ভোর অনাকাঙ্ক্ষিত, তাই তাকে ছুঁয়ে দেখার আনন্দেই উজমার চোখে পানি। ভালোবাসাকে খুব কাছ থেকে অনুভব করার পানি। তাকে নিজের বলে দাবী করতে পারার পানি। ‘কবুল’ বলে প্রিয়জনকে নিজের একান্তই ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে পাশে পাওয়ার পানি। এটা তো আনন্দাশ্রু। এই অশ্রু অতীত স্মৃতি হাতড়ে আসেনি, বরং বর্তমানের কিছু সুখকর মুহূর্ত ছুঁয়ে দেয়ার সৌভাগ্যের কথা ভেবেই এসেছে। তবে মনে কিঞ্চিৎ সংকোচ ও দ্বিধা ছিল এইভেবে যে, শামীমের সেদিনের সেইসব নোংরা ছোঁয়া নিয়ে ফারশাদ কোনোপ্রকার অস্বস্তি অনুভব করে কি-না। যা তার জন্য অশোভনীয়, অস্বস্তির ছিল, তা ফারশাদের জন্য কতটা সহ্যকর, এটা ভেবেই মন খারাপ হচ্ছিল আরও। নিজের মনের স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা ও দৃঢ়তা বুঝিয়ে উজমা বলল,

-‘আমি সব ভুলে যেতে চাই, কিন্তু সেদিনের সেইসব জঘন্য স্পর্শ ভুলতে পারি না। মাঝেমধ্যে শিউরে উঠি। প্রচণ্ড ভয় পাই। বার বার মনে হয়, ওইমুহূর্তে দুর্বল না হয়ে আমার আরেকটু সাহস দেখানো উচিত ছিল। কেউ আমার হাত-পা বেঁধে আমাকে ছুঁয়েছে… উফফ কী অসহ্যকর মুহূর্ত।’

বলতে বলতে ঠোঁট কামড়ে ধরল উজমা। সূর্যের প্রথম কিরণ ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার কান্নাভেজা মুখাবয়ব। এই ভেজা ভেজা চোখ, এই লাল টুকটুকে মুখ, কেঁপে কেঁপে বলা প্রতিটা শব্দ, বাক্য প্রেমিক পুরুষের শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে হৃদয় রাজ্যে পৌঁছে গিয়ে হৃৎস্পন্দনের গতি ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বেসামাল হৃদয়ের স্পন্দিত অনুভূতিকে প্রগাঢ় অনুভবের সাথে ছুঁয়ে দেয়ার জন্য, নিজের একান্তই বৈধ মানুষ, তার মানসপ্রিয়া – প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর অশ্রুভেজা চোখের পাতায় পরপর দুটো চুমু এঁকে দিল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ঘঁষে, কণ্ঠে মাদকতা ছড়িয়ে বলল,

-‘খুব শীঘ্রই ভুলে যাবে। আমি ভুলিয়ে দেব। সব অসহ্যকর মুহূর্ত কেবলই একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে, আর কিছু না।’

উজমা একটু ঘোরের মধ্যে ছিল। ওমন মাতালকরা, পবিত্র স্পর্শ তাকে সুখের এক অন্য রাজ্যে টেনে নিয়ে গেছে। প্রিয় মানুষ একটুখানি ছুঁয়ে দিলে সব মন খারাপ সুদূরে মিলিয়ে যায়, আজ তা স্বশরীরে উপলব্ধি করতে পেরে সুখে, আনন্দে আনচান করে উঠল তার মন। সে বিস্মিত চোখে চেয়ে চেয়ে জানতে চাইল,

-‘কীভাবে?’

ফারশাদ আরও কাছে ঘেঁষলো উজমার। বিস্ময়ের ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘প্লিজ, ক্লোজ ইউওর আইজ এন্ড ফিল মাই লাভ।’

পুরো কথা বোধগম্য হলো না উজমার। চোখ বন্ধ করে ভালোবাসা অনুভব করে কীভাবে? কল্পনায়? কৌতূহলী চোখজোড়া মুঁদে আগ্রহী মন নিয়ে বলল,
-‘হোয়াই?’

-‘আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ, রাইট নাও।’

পরমুহূর্তেই নিজের জায়গায় জমে গেল উজমা। বাঁধা দেয়া তো দূর, শব্দ করারও সুযোগ পেল না। প্রকৃতির এই সীমাহীন সৌন্দর্যের মায়ায় ডুবে-ভেসে নবদম্পতির নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিলে গেল আজ। কাঁপুনি সামলাতে অর্ধাঙ্গ’র ব্লেজার মুঠোয় আটকাল ভীতু রমণী। দীর্ঘ প্রলম্বিত চুমুর আবেশে বিবশ হয়ে দুটো মানব হৃদয় পরিপূর্ণ জীবনের দিকে অগ্রসর হলো। সময় সম্পর্কে আর কোনো হদিস রইল না কারও। দিক-বিদিক ভুলে গিয়ে ভালোবাসার অতলান্তিক সীমানায় আকণ্ঠ ডুবে রইল তারা। অনেকক্ষণ, খুবক্ষণ, বহুক্ষণ, প্রিয়জনের সান্নিধ্য, পবিত্র সম্পর্কের তোলপাড় করা অনুভূতিতে ভাসতে ভাসতে হাঁসফাঁস শুরু হলো উজমার। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে বিশ্বস্ত জায়গায় মাথা ঠেকাল। ফারশাদ তাকে দু’হাতের মাঝখানে আগলে নিল, ভীষণ যত্নে, খুব আদরে। মাথার তালুতে অধর ছুঁইয়ে বলল,

-‘আমার জীবনের প্রতিটা ভোরে ঠিক এমনিভাবেই তোমাকে চাই, বাটারফ্লাই।’

প্রতুত্তরে কিছুই বলল না উজমা। শব্দহীন হাসিতে নিজেকে লুকিয়ে রাখল। আচমকাই মনে হলো, পার্সের কথা। মুখ তুলে বাইকের দিকে নজর দিল। বাইকের সিটে খুব আরামে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার পার্স। বাঁধন আলগা করে সেদিকে ছুটে যেতে চাইলে ফারশাদ তার হাত আটকে বলল,

-‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’

ফারশাদের চোখে স্পষ্ট দুঃশ্চিন্তা দেখা গেল। প্রশ্ন করে ব্যথাতুর চোখে চেয়ে রইল সে। আটকে রাখা হাতের দিকে তাকাল উজমা। একটু সময়ের জন্যও ছাড়তে নারাজ, এটাই বুঝিয়ে দিল তার চোখমুখ। এই দু’চোখের ভাষায় যত্নে রাখা সীমাহীন ভালোবাসা উপেক্ষা করার শক্তি উজমার নেই, মন সেটা বুঝে নিয়েছে আগেই। সে স্পষ্টবাক্যে বলল,

-‘যাচ্ছি না, ফিরে আসছি, এখুনি।’

বাইকের কাছ থেকে ফিরে আসতে উজমার এক মিনিটেরও কম সময় লাগল। ফিরে এসে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে হাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট বক্স ফারশাদের সামনে তুলে ধরে বলল,

-‘এটাই আনতে গিয়েছিলাম। তুমি সেদিন বলেছিলে, কোনোদিন যদি কাউকে ভালোবাসি, তাকে হারাতে না দিয়ে নিজের করে নিতে। আমি পেরেছি। যাকে ভালোবেসেছি, তাকে নিজের জন্য ‘কবুল’ করে নিয়েছি। সেদিন তুমি এ-ও বলেছিলে, হৃদয়ের দামে একটা হৃদয় কিনতে চাও, অথচ আমার হৃদয় তোমার হৃদয়ে রাখতে অপারগ ছিলাম আমি। এটা সে-ই আংটি, যেটা দিয়ে তুমি তোমার বাটারফ্লাইকে ভালোবাসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলে। অভিমান থেকে হোক কিংবা কষ্ট থেকে হোক, সে রাতে তুমি চেয়েছিলে হৃদয়ে জমাকৃত সবটুকু ভালোবাসাকে কবর দিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোসের কথা এটাই যে, ভালোবাসার মতো অনুভূতিকে কবর দেয়ার দুঃসাহস কেউ কোনোদিন দেখাতে পারে না। তুমিও পারোনি, আমিও পারিনি। সেদিন যে কারণে তোমাকে প্রত্যাখান করেছিলাম, তোমাকে ভালোবাসার পর সেই কারণটা খুব তুচ্ছ মনে হয়েছে আমার। ভয়কে জয় করতে না পারলে, ভালোবেসে লাভ কী বোলো?’

ফারশাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। এইমুহূর্তে তার কী বলা উচিত, কী রি’অ্যাক্ট করা উচিত ভেবে পেল না। উজমা আবারও বলল,

-‘তোমার দেয়া সেদিনের সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম ওইদিনই, যেদিন আমি উপলব্ধি করেছি, ভালোবাসার সবটুকু রং এসে রাঙিয়ে দিয়েছে আমার মনের উঠোন। সেদিন থেকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আমি অপেক্ষা করেছি, কবে আমার শহরে তুমি আবার আসবে। কবে আমাদের দেখা হবে আর কবে আমি বলব, তোমাকে ভালোবাসি। অবশেষে এইদিনটা আমার জীবনে এসেছে। এই ভোর, এই নতুন জীবন, এই জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা তুমি, তোমাকে নিয়ে রচিত হওয়া জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অপূর্ব অধ্যায়, এই সবকিছুকে নিয়ে গোটা একটা জীবন বাঁচতে চাই শুধু ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততার মধ্যে দিয়ে। যে জীবনে তুমি জড়িয়ে গিয়েছ, সেই জীবনে আর কোনো ভয় নেই আমার।’

চোখে বিস্ময় ও ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে অর্ধাঙ্গিনীর কথাগুলো শোনে গেল ফারশাদ। উজমা ফের বলল,
-‘শুধু প্রতিটি ভোর নয়, এরপর থেকে আমার জীবনে যত জ্যোৎস্নারাত ও বৃষ্টিভেজা রাত আসবে, যত কুয়াশাচ্ছন্ন ও রোদ ঝলমলে ভোর আসবে, যত গোধূলির আলোমাখা শেষবিকেল ও তারাখচিত সন্ধ্যা আসবে, যত খুশি কিংবা যত দুঃখ আসবে, প্রতিটি মুহূর্তেই আমি তোমাকে পাশে চাই, কাছে চাই। একসাথে অনেকটা পথ হাঁটতে চাই। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকতে চাই। সুখ-দুঃখের প্রতিমুহূর্তে আমার পাশে থাকবে তো তুমি?’

সাহসের সাথে অনেকগুলো কথা বলে উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল উজমা। ফারশাদ মুখ দিয়ে কোনো উত্তর দিল না। চট করে হাঁটুভেঙে রাখল শিশিরভেজা ঘাসের ওপর। অর্ধাঙ্গিনীর একটা পা হাতে তুলে, পায়ের স্নিকার্স শু খুলে, মেহেদীরাঙা পা হাঁটুর ওপর রেখে, হাত বাড়িয়ে আংটির বক্স এনে, ভেতর থেকে বের করল রূপোর সেই আংটি। যত্ন সহকারে আংটি পরিয়ে দিল তর্জনীতে। আলতোস্পর্শে অধর ছোঁয়ালো একবার। পূণরায় শু পরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অর্ধাঙ্গিনীর চিবুক ছুঁয়ে, কপালের মধ্যিখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে নিঃশ্বাসের শব্দে বলল,

-‘কবুল বলে তোমার পাশে থাকার শপৎ নিয়েছি, বাটারফ্লাই। ছেড়ে যাওয়ার জন্য নয়। যে হাত আমি একবার ধরেছি, সেই হাত সারাজীবন ধরে রাখব, ইনশা’আল্লাহ্।’

প্রকৃতির এই মায়ায় হারিয়ে গিয়ে দুটো মন কাছে এসে, সময়টাকে নিজেদের মতো উপভোগ করছিল। নীরবতার চাদরে ডুবে গিয়ে, শব্দহীন ভালোবাসায় যখন তারা বিভোর ছিল, অদ্ভুত সুখানুভবে আচ্ছন্ন ছিল, তখনই কোথা থেকে একটা আর্তনাদ শোনা গেল। ঠিক আর্তনাদ নয়, কাছেপিঠে কেউ যেন অসুস্থ হয়ে কাতরাচ্ছে, এমনই একটা আওয়াজ। আওয়াজ কানে আসতেই দু’জনেই সতর্ক হয়ে গেল। কৌতূহলী চোখ নিয়ে চারপাশে নজর দিয়েই দেখল, রাস্তার একপাশে থাকা বেঞ্চে বসে একটা মেয়ে মুখ চেপে ধরে বমি আটকানোর চেষ্টা করছে। কাউকে বিপদে দেখলে সাহায্য না করে চুপ থাকবে বা পালিয়ে যাবে, এরকম অভ্যাস উজমার নেই দেখে, খুব দ্রুতই বাইকের সামনে রাখা ব্যাগ থেকে পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে মেয়েটার কাছে পৌঁছাল সে। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

-‘আপনি কি অসুস্থ?’

যেহেতু উজমা এগিয়েছে, ফারশাদ কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। অসুস্থ-রুগ্ন শরীর নিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে শরীরে চাদর প্যাঁচিয়ে মেয়েটি বলল,

-‘জি একটু অসুস্থ।’

-‘অসুস্থ শরীরে এই ভোরে একা বেরিয়েছেন কেন?’

-‘মাকে ভীষণ মনে পড়ছিল। তা-ই। আজ মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।’

মেয়েটি আনমনা হয়ে গেল। মায়ের স্মৃতি, আদর-ভালোবাসা জীবনে পেয়ে হারিয়ে ফেলার মতো দুর্ভাগা তার মতো আর কে আছে, কে জানে। মা হারিয়েছে বলে এই দুঃখটা উজমা খুব করে উপলব্ধি করতে পারে। সে মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

-‘আমারও এমন হয়। যখনই মায়ের কথা মনে পড়ে, কষ্টে বুক ভার হয়ে আসে। মন খারাপ করবেন না। পৃথিবীতে আমরা সবাই ক্ষণিকের মেহমান। আগে-পরে সবাইকেই একদিন যেতে হবে।’

অসুস্থতা সামলাতে না পেরে হড়বড়িয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিল মেয়েটি। চোখমুখ শুকিয়ে, উজ্জ্বলতা ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেল তার। উজমা ভয় পেয়ে গেল। বলল,

-‘আপনার বাসা কোথায়? বাড়ি যাবেন না-কি হসপিটালে?’

ক্লান্তিভরা কণ্ঠে মেয়েটি বলল,
-‘ওই সামনেই আমাদের বাংলো আছে। এইযে, চা বাগান, দূরে চায়ের ফ্যাক্টরি, এগুলো আমাদেরই।’

-‘ওহ, তাই বলুন। বাংলো এখান থেকে কতদূরে? চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

মেয়েটি আগ্রহী চোখে চারপাশে তাকিয়ে উজমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘তার আর দরকার হবে না। আমাকে রুমে না পেলে মহারাজ এখানেই আসবেন। একটু বসি। প্রেগন্যান্সির তৃতীয় মাস চলছে। এই সময়ে মর্নিং সিকনেস নাজেহাল করে দেয় একেবারে। এখুনি যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে।’

উজমা বোতল বাড়িয়ে দিলে কয়েক ঢোক পানি গিলল মেয়েটি। সামনে থাকা পুরুষটির দিকে এতক্ষণ খেয়াল না হলেও এখন তাকে ভালোমতো দেখে বলল,

-‘আপনি ফারশাদ মুনতাসীর না?’

ফারশাদ মাথা নাড়লে, মেয়েটি এবার উজমার দিকেও ভালোমতো তাকাল। দু’জনের চেহারার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা লাজুক হাসি দেখে বলল,

-‘আমার স্বামী আপনার ভীষণরকম ফ্যান। দাঁড়ান, ওনাকে একটা কল দিয়ে বলি, আপনি এখানে ঘুরতে এসেছেন। ওহ, একটা কথা, সকালের নাশতাটা আমাদের সাথেই করবেন। আমি বাসায় জানিয়ে দিচ্ছি।’

মেয়েটিকে আর কল করতে হলো না। এরমধ্যেই দৌড়াতে দৌড়াতে এদিকেই ছুটে আসলো এক ত্রিশোর্ধ যুবক। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

-‘তুমি এখানে, এদিকে আমি তোমাকে সারা বাংলো খুঁজে বেড়াচ্ছি। বলে আসবে না? অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন যে একা ছোটাছুটি কোরো, বুঝি না। দেখি ওঠো।’

কোনোদিকে খেয়াল না করে হাত বাড়িয়ে বউকে পাঁজাকোলে তুলে নিল আদনান। ধুপধাপ পা ফেলে এগোতে যাবে, নোভা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-‘আরেহ্, আমি মেহমানদের ইনভাইট করেছি আজ, আমাদের সাথে নাশতা করার জন্য। আপনি তো দেখছি, ওনাদের ফেলেই চলে যাচ্ছেন।’

আদনান হুঁশে ফিরে সামনে তাকিয়ে দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে নোভাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে ফারশাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল,

-‘দুঃখিত, খেয়াল করিনি।’

ফারশাদ বলল,
-‘ইট’স ওকে। আমরা এখানে ঘুরতে এসেছিলাম। আজই রংপুর চলে যাব। তা-ই ভাবলাম, যাওয়ার আগে কাছেপিঠে কোথা থেকে ঘুরে আসি।’

-‘ভালোই হয়েছে। এখানে না আসলে আপনার সাথে দেখা হতো না। চলুন, একসাথে বসি।’

আদনান ফের নোভাকে কোলে তুলতে চাইলে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল নোভা। বলল,
-‘আপনি ওনাকে নিয়ে যান। আমি আপুর সাথে আসছি।’

দু’জন একই বয়সী পুরুষ, বকবক করতে করতে সামনের দিকে এগোলো। উজমা ও নোভা পিছনে থেকে আস্তেধীরে এগোতে লাগল। চলতে পথে অনেক কথার গল্প জমাল তারা। আজই পরিচয় হয়েছে, এটা বোঝার উপায় নেই। নির্ভার মন নিয়ে একে-অন্যের সাথে গল্প করছে, চেনা-পরিচিত টপিক নিয়ে আলোচনা করছে। নিজেদের এই চা-বাগান, ফ্যাক্টরি সবকিছু সম্পর্কে বিস্তারিত সব কথা শেয়ার করছে আদনান। ফারশাদ শুনছে, পাশাপাশি নিজের ক্যারিয়ার, প্রাকটিস এসবের গল্পও শোনাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা যখন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বাংলোর কাছাকাছি এলো, দৃষ্টিতে মুগ্ধতা নিয়ে তার আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। চারপাশে শুধু চা আর চা। মধ্যিখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলোটা। ফারশাদ বলল,

-‘ওয়াও, দিস ইজ ভেরি বিউটিফুল। এখানে বাংলো তৈরীর সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়েছেন?’

আদনান একপলক নোভার দিকে তাকিয়ে, নিজের মতো করে বলল,
-‘এটা আসলে আমার স্ত্রীর জন্যই করা। কাজ শেষে, নিজেদের জন্য একটুখানি সময় খুঁজে নিতে, প্রতিমাসে আমরা এখানে আসি। সপ্তাহখানেক থাকি আবার বাড়ি ফিরে যাই। এখান থেকে ফ্যাক্টরিটা কাছেই। এক্ষেত্রে আমার কাজে কোনো অসুবিধা হয় না।’

ওদের গল্প করতে বসিয়ে, শাপলার সাহায্যে বেশ কয়েক পদের নাশতা তৈরী করিয়ে নিল নোভা। খাবার টেবিলে নাশতা সাজিয়ে, সবাই একসাথেই খেতে বসলো। খেতে খেতে আরও অনেক গল্প হলো। নম্বর আদান-প্রদান হলো। অপরিচিত একটা জায়গা, অপরিচিত মানুষ, তবুও যেন কত আপন। নোভার আতিথিয়েতায় মুগ্ধ হলো ওরা। নাশতা শেষে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ক্লান্ত শরীরে একটুখানি জোর দিতে বারান্দার সামনের সিঁড়িতে বসলো নোভা। ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল অপলকে। কত বিশ্বস্ততার সাথে একজন অন্যজনের হাত ধরে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। এমন ভালোবাসা সামনে থেকে দেখতেও ভীষণ ভালো লাগে। ভালোবাসাদের বিশ্বাসের সাথে বাঁচতে দেখে ভালো লাগে। কী মনে করে, অস্ফুটস্বরে ওদের জন্য প্রার্থনা করল সে। আদনান পাশে বসে বলল,

-‘দুর্বল লাগছে?’

দু’দিকে মাথা নেড়ে আদনানের শরীরে জড়ানো ভারী চাদরের নিচে নিজেকে আগলে নিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে নোভা বলল,
-‘দু’জনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে, তাই না?’

আদনানও সামনে তাকাল। উপরনিচ মাথা নেড়ে বলল,
-‘হ্যাঁ, ঠিক আমাদের মতো। একেবারে, মেইড ফোর ইচ আদার।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ছত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

-‘তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি, যদি কোনোদিন এই প্রাপ্তিটা তোকে ছোঁয়, তুই তার অযত্ন, অসম্মান কিংবা অমর্যাদা করবি না। একজন ভাই ও বন্ধু হিসেবে তোর কাছে আমার অনুরোধ, তুই তোর কথা রাখবি। যদি তোর কথার একচুল পরিমাণ নড়চড় হয়, আমি মনে করব তোকে চিনতে, জানতে ও বুঝতে ভুল করেছি। আমার এতদিনের বিশ্বাসকে নষ্ট হতে দিস না, দোস্ত।’

কনে বিদায়ের আগ মুহূর্তে বন্ধুর মুখে এই কথা শোনে, দু’হাতে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল ফারশাদ। নিজের জবান ও বিবেককে শুদ্ধ রাখতে বলল,
-‘আমি আমার কথা রাখব, ইনশা’আল্লাহ্।’

ফারশাদ যখন বন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল, অদূরেই বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল উজমা। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সম্পর্কের এই বিচ্ছেদ যন্ত্রণার হলেও বাস্তবতা ও নিয়তির কাছে অনেক সময় কিছু সম্পর্ক এভাবেই হারিয়ে যায়। বিচ্ছেদ কঠিন হলেও মেনে নিতে হয়। মানিয়ে চলতে হয়। এই সত্যিটুকু বন্ধুরা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই উজমার এই যাত্রাকে সবাই সহজ করে দিচ্ছে। তাকে হাসিমুখে বিদায় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাক্বদীম বলল,

-‘আমরা কিন্তু যোগাযোগ করব। যখন সময় পাব, দেখা করার চেষ্টা করব। প্রতি মাসে না হোক, প্রতি বছর একটা কাপল ট্যুর দিব। আমাদের নেক্সট ট্যুরের সবচেয়ে স্পেশাল পারসন হচ্ছিস তুই ও ফারশাদ। তারিখটা কবে সেটা জানিয়ে দেব ফোনে। প্রস্তুতি নিয়ে রাখবি। ঠিক আছে?’

বন্ধুরা সবাই আছে, থাকবে, এটা বুঝানোই ছিল তাক্বদীমের উদ্দেশ্য। বিদায়ের মুহূর্তে শূণ্যতাকে সঙ্গী করে উজমার বিদায় না হোক, এই কারণেই ট্যুরের কথা বলে তার চেহারায় একটা প্রাণোচ্ছল হাসি ফিরিয়ে এনেছে সে। একটুখানি ভরসা পেয়ে সবটুকু বিষণ্ণতা কেটে গেল উজমার। বুকভরে শ্বাস নিয়ে বলল,

-‘তোরা যেমন চাইবি, তেমনই হবে।’

কিছুক্ষণ আগের একদফা কান্নায় উজমার চেহারাটা লালছে হয়ে উঠেছে। নাকের ডগাও সামান্য লাল হয়েছে। চোখমুখ ফুলে উঠেছে। অভ্যাসবশত অনিক তার নাকের ডগা চেপে দিয়ে বলল,

-‘আর কাঁদিস না তো। জঙ্গলের হনুমানের মতো লাগছে।’

ধুম করে অনিকের বুকে পাঞ্চ বসালো উজমা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘সবসময় ফাজলামি? আর কিছু পারিস না?’

-‘পারি তো, প্রেম করতে পারি। দেখবি? দাঁড়া দেখাচ্ছি।’

কৌতুকের স্বরে এই কথা বলে চারপাশে মাইসারাকে খুঁজল অনিক। না পেয়ে বলল,
-‘আমার বউ কোথায় গেল?’

এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে বিবাহিত প্রেমিকের মুখে এই কথা শোনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। কাইফ বলল,
-‘বউ পরে খোঁজ, আগে কনে বিদায় দে।’

ওদের হাসি ও দুষ্টুমি যেন থামতে চাইছিল না। ক্রমেই তা বেড়ে যাচ্ছিল। মাইসারা ও রাইদাহ ব্যস্ত ছিল ঊষাকে বুঝাতে। উজমার মধ্যে যতটা সাহস ও মনের জোর আছে, ঊষার মধ্যে ততটা নেই। বয়স ও বুদ্ধির তুলনায় সে তাদের সবার চেয়ে পিছিয়ে। এজন্য এই কঠিন মুহূর্তকে ফেইস করতে তার একটু সাপোর্ট দরকার ছিল বেশি। দুই বান্ধবী যখন তাকে ভরসা দিল, বাস্তবতা বুঝিয়ে দিল, তখন সে একটু হালকা হলো। ওরা ফিরে আসাতে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল উজমা। অনেকক্ষণ তিনজন একসাথে, একে-অন্যকে আঁকড়ে ধরে রাখল, সময়টা যত কঠিন হোক মেনে নিয়ে, উজমাকে সাহস দিতে রাইদাহ বলল,

-‘কখনও যদি মন খারাপ হয়, যদি একটুখানি কষ্ট এসে ছুঁয়ে যায়, যদি মনে হয় আমাদের মিস করছিস, সঙ্গে সঙ্গে কল করবি। আমরা তোর পাশে থাকব, একাকীত্বের সঙ্গী হব, দুঃসময়ের ভরসা হব, কষ্টগুলো মুছে দেব।’

বন্ধুরা পাশে থাকবে এই বিশ্বাস মনে নিয়ে উজমা বলল,
-‘আমি জানি, দূরে গেলেও তোরা আমার পাশে থাকবি।’

একে-একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভাই ও ভাবীর পাশে গিয়ে তাদের থেকে বিদায় নিল। উসাইদ বোনকে আগলে নিয়ে প্রথমবারের মতো চোখের পানি ফেলল। দুর্বল মুহূর্তগুলো পাশ কাটিয়ে জীবনে সফলতার পথে এগিয়ে চলা মানুষটার চোখে এমন বেদনাসিক্ত ও বিচ্ছেদের অশ্রু দেখে ঢোক গিলে গিলে চোখের পানি কন্ট্রোল করতে চেয়েও ব্যর্থ উজমা একসময় বাবা-মা ও পিছনের স্মৃতিগুলো মনে করে কেঁদে ফেলল। অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে কীভাবে থাকবে এইটুকু মাথায় আসতেই হন্যে হয়ে বাবাকে খুঁজতে শুরু করল। রিসোর্টের বাইরে ফারশাদের সাথেই কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন উসমান ওয়াজেদ। যদিও সব কথা ফারশাদই বলছিল, তিনি শুধু শুনছিলেন আর ঘাড় নাড়াচ্ছিলেন। অবুঝ কিশোরীর ন্যায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে ভেতর নিংড়ানো কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। থেমে থেমে বলল,

-‘তুমি নিজের খেয়াল রাখবে তো, বাবা? ঠিকমতো ঔষধ খাবে তো? তোমাকে না দেখে কী করে থাকব, বোলো তো? চিৎকার-চেঁচামেচি না করে ভাই-ভাবীর কথা মেনে নিও। তুমি অসুস্থ জানলে আমি ভালো থাকতে পারব না, বাবা। আমার ভালো বাবা, আমার কথা রাখবে তো?’

এরকম পরিস্থিতি উসমান ওয়াজেদকে খুব একটা বিচলিত করে না, কষ্ট দেয় না। তবে তিনি এটা বুঝে গিয়েছেন যে, মেয়ে চলে যাচ্ছে অন্যের ঘরে। একটু আগে ফারশাদই তাঁকে বুঝিয়েছে এইসব। বলেছে,

-‘আপনার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি বলে, আমার ওপর কোনো অভিযোগ রাখবেন না, বাবা। কথা দিচ্ছি, আপনার মেয়েকে আমি ভালো রাখব, সুখে রাখব। আপনি শুধু আমাদের প্রাণভরে দোয়া দিন।’

মেয়ের অবিরত কান্নায় পরনের পোশাক ভিজে যাচ্ছিল উসমান ওয়াজেদের। তবুও মেয়েকে তিনি থামাতে পারছিলেন না। এরকম পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয়, এই বোধশক্তি ওনার নেই এখন। মেয়ের কাছে শুধু জানতে চাইলেন,

-‘কবে আসবি, বড়ো মা?’

কান্নামাখা মলিন মুখখানি নিয়ে উজমা বলল,
-‘আসব বাবা, মাঝেমধ্যেই আসব। তুমি কিন্তু একদম ‘গুড বয়’ হয়ে থাকবে।’

এ যেন অবুঝ বাচ্চাকে বুঝানো। শিখিয়ে-পড়িয়ে তোলা। আহা, মানুষটা যদি একটু সুস্থ হতো, এভাবে বুঝানোর প্রয়োজন পড়ত না। বিদায় নিতে যেভাবে বাবাকে আঁকড়ে ধরেছিল, একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওভাবেই বাবাকে জড়িয়ে রেখেছিল উজমা। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল হতেই মিশকাত ও ঊষা এগোলো কাছে। উজমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হেলিকপ্টারে তুলতে চাইলে ভাবীকে জড়িয়ে ধরে উজমা বলল,

-‘আমার বাবা কত অবুঝ তুমি তো জানো, ভাবী। কষ্ট হলেও বুড়ো মানুষটার খেয়াল রেখো, প্লিজ। তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি জানি তুমি পারবে। এতদিন যে দায়িত্বগুলো আমি পালন করে এসেছি, সেসব আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম।’

একজন মানসিক রোগীকে সামলানো যে কত কষ্ট সেটা জানে বলেই, ননদিনীর কথাকে মূল্যায়ন করে মিশকাত বলল,
-‘বাবা কি তোর একার, আমার নয়? আমি আমার বাবাকে দেখে রাখব, ইনশা’আল্লাহ্।’

শেষ একবার বোনকে জড়িয়ে ধরল উজমা। তানজীম পাশেই ছিল। বোনের হাতটা তার হাতের মুঠোয় তুলে দিয়ে বলল,
-‘খুব ছোটোবেলা যখন মা মারা যান, এরপর থেকে ওর যাবতীয় দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। একটা সন্তান মায়ের কাছে যতটা নিরাপদ থাকে, ও আমার কাছে ততটাই নিরাপদ ছিল। এখন থেকে ওর সব ভালো-মন্দে আপনি জড়িয়ে গেছেন। আমার দায়িত্ব কমে এসেছে। আপনি জড়িয়ে গেছেন বলেই হয়তো নির্ভার হতে পারছি। ও একটু অবুঝ। যদি কখনও কোনো ভুল করে, আপনি ওর ভুল শোধরে দিবেন। আমি আশা রাখব, আপনি একজন ‘সাপোর্টিভ পার্টনার’ হবেন।’

দু’হাতের মাঝখানে ঊষার হাতখানি আগলে নিয়ে তানজীম বলল,
-‘আপনাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সেদিনই মনে হয়েছিল, আপনি এমন একজন মানুষ যার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে আশেপাশের মানুষগুলোর জীবন গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষ অচেনা মানুষের প্রতি মনুষ্যত্ব ও বিবেকবোধের টানে ছুটে আসে, তার কাছে পরিবারের মানুষ কতটা আপন ও ভালোবাসার হতে পারে, এইটুকু বোঝার পর, শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে আপনাকে বসিয়েছি আমি। আজ আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার বোনকে আমি আগলে রাখব। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টায় তাকে আমি সুখী রাখার চেষ্টা করব, ইনশা’আল্লাহ্।’

ছোট্ট মাশিয়াত, ফারিশা, তাম্মি, নিশাত, মামা ও মামীমা বাদে আরও যারা ছিলেন, সবার থেকে বিদায় নেয়া শেষ হলে, ভেঙে যাওয়া রমণীর ভরসা হয়ে হাত বাড়াল ফারশাদ। খুব সাবধানতার সাথে তাকে হেলিকপ্টারে তুলল। একপাশের সিটে তাকে আরাম করে বসিয়ে, নিজেও সবার থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিল। অনিক, তাক্বদীম, কাইফ, উসাইদ, তানজীম ও মেসবাহ সবার থেকে বিদায় শেষে ফারিশার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুটো হাত চেপে ধরে অনুরোধের স্বরে বলল,

-‘রিসেপশনে তুমি থাকবে তো, বুবু?’

পিছনের অধ্যায়কে জীবনে ফের টেনে আনার প্রয়োজন নেই হয়তো, কিন্তু তবুও ভাই-বোনদের জন্য হলেও জন্মস্থানে আবারও পা রাখতে হতো তাকে। সে ভাইয়ের মনের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছিল বলেই উপরনিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,

-‘থাকব।’

একমাত্র ভাই, ভাইয়ের বউ ও বোনকে বিদায় দিল ফারিশা। চার সিটের ছোট্ট হেলিকপ্টার। ফারশাদ ও উজমা পিছনে বসলে সামনের সিটে গিয়ে বসলো ফাবিহা। বোনকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর নিয়ে বলল,

-‘আমরা সবাই কিন্তু অপেক্ষায় থাকব। মিস দিও না, বুবু।’

মেসবাহ কাছেই ছিল। তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
-‘পিছনের সব কথা ভুলে গিয়ে সম্পর্কটাকে আবারও নতুনভাবে গড়ে তোলার এই সুযোগটাকে কাজে লাগান, ভাইয়া। এবার যদি লুকানোর চেষ্টা করেছেন…।’

বাকি কথা বলার আগেই মেসবাহ বলল,
-‘যদি লুকোই, হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যেও।’

-‘ঠিক আছে। কথাটা মনে রাখবেন। হ্যান্ডকাফ নিয়েই আসব। এবার আসি। আল্লাহ হাফেজ।’

হাত নাড়িয়ে সবাইকে বিদায় দিল ফাবিহা। বন্ধুবান্ধবরা সবাই হাত নাড়লে চোখভরা অশ্রু নিয়েও হাসিমুখে বিদায়টাকে মেনে নিয়ে দীর্ঘশ্বাসটুকু হাওয়ায় উড়িয়ে দিল উজমা। ফারশাদ তাকে একহাতে আগলে নিল। চেনা পৃথিবী ছেড়ে অচেনা পৃথিবীর আহ্বানে এগিয়ে চলল সে। হেলিকপ্টার যখন একটু একটু করে যত উপরে উঠছে, ততই উজমা পিছনে রেখে যাচ্ছে শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের সব স্মৃতি, মায়া, সুখ ও ভালোবাসা।

***

বিশ্বস্ত মানুষের হাত ধরে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল ঊষা। অচেনা এই ঠিকানায় যখন পা রাখল, তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। এই ঘর, এই মানুষজন, এই সংসার সব এখন তার। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ হলেও সবার আচার-ব্যবহার তার ভীষণ চেনা ও আপন আপন মনে হচ্ছিল। ফারিশা তাকে খুব যত্নের সাথে দেবরের রুমে নিয়ে এলো। বিছানায় বসিয়ে বলল,

-‘প্রথম প্রথম এখানে মানিয়ে নিতে তোমার একটু কষ্ট হবে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। যখন যে প্রবলেমে পড়বে, আমাকে জানাবে। আমি শুধু তোমার জা নই, একজন বোন ও খুব ভালো বন্ধুও বটে।’

লজ্জামাখা মুখ নিয়ে একটুখানি হেসে ঘাড় কাৎ করে মাথা নাড়ল ঊষা। ফারিশা বলল,
-‘এখন তুমি একটু বিশ্রাম নাও। কিছু প্রয়োজন হলে ঝটপট কল দিও। আমি রাতের রান্নাটা গুছিয়ে নিই।’

একা বসে থাকতে ভালো লাগবে না তার, এটা বেশ বুঝতে পারছিল ঊষা। একটু আনইজি লাগছিল। সে আমতা আমতা স্বরে বলল,
-‘আমি আপনার সাথে রান্নাঘরে আসি? কিছু করব না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকব।’

ঊষার মনোভাব বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসলো ফারিশা। লাগেজ খুলে একটা জামা বের করে দিয়ে বলল,
-‘এটা পরে এসো। ভারী কাপড়চোপড় নিয়ে আগুনের কাছে না যাওয়াটাই বেটার। আর শোনো, আমাকে এত আপনি-আজ্ঞে কোরো না। তুমি করেই ডেকো।’

ফারিশা যাওয়ার পর পরনের পোশাক দ্রুত পরিবর্তন করে নিল ঊষা। বলা যায় না কখন তানজীম রুমে এসে পড়ে। লজ্জার শেষ থাকবে না। এলোমেলো পোশাক ভাঁজ করে বিছানার একপাশে রেখে, ওড়না মাথায় চাপিয়ে তাড়াহুড়ো করে রুম ত্যাগ করতে গিয়েই জোরেসোরে একটা ধাক্কা খেয়ে ‘উফফ মাগো…’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। তানজীম নিজেও সে মুহূর্তে বলে উঠল,

-‘আরেহ্, সাবধানে।’

ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। জোরসে ধাক্কা খেয়ে ঊষার কপালের একপাশ ফুলে উঠেছে। ক্রমাগত সেখানে হাত ঘঁষে যাচ্ছে ঊষা। কিন্তু ব্যথা লাঘব হচ্ছে না। দুর্ঘটনা আঁচ করতে পেরে তড়িঘড়ি ফ্রিজ থেকে বরফের কিউব নিয়ে এলো তানজীম। হাত ধরে ঊষাকে বিছানায় বসিয়ে ফুলে যাওয়া জায়গায় কিউব বসিয়ে আস্তেধীরে ম্যাসাজ করে দিল, পাশাপাশি দু’ঠোঁট একত্র করে ফুঁ দিতে লাগল। এমন বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে চুপ করে বসে রইল ঊষা। তানজীম বলল,

-‘তাড়াহুড়ো করছিলে কেন?’

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়, ঊষার অবস্থা আপাতত সেরকম। পালানোর কথা চেপে গিয়ে বলল,
-‘বুবু বলেছিল রান্নাঘরে যেতে।’

-‘সিরিয়াসলি, ভাবী এই কথা বলেছে?’

তানজীমের ভ্রু বাঁকানো দেখে মিথ্যে বলতে পারল না ঊষা। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
-‘আমিই আগ্রহ দেখিয়েছিলাম।’

-‘মাত্রই এলে, এখুনি কাজ করতে হবে কেন?’

-‘একা বসে থাকলে বোর লাগতে পারে, ভেবে।’

-‘একা কোথায়? সঙ্গ দেয়ার জন্য আমি তো আছি।’

ঊষা বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,
-‘আপনি আছেন এটাই তো সমস্যা।’

কাছে ছিল বলে কথাটা কানে এলো তানজীমের। দু’পা তুলে বিছানায় বসে, হাতের কিউব বাটিতে সরিয়ে রেখে নিজের গালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
-‘আমি কী করেছি?’

-‘আসা মাত্রই ব্যথা দিলেন, এরপর তো ব্যথার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিবেন বলে মনে হচ্ছে।’

ঊষার অভিমানী কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছিল তানজীমের। সে হাত বাড়িয়ে অর্ধাঙ্গিনীর দুটো হাত মুঠোয় টেনে, উপরিভাগে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
-‘আমাকে কি খুব বেশি নিষ্ঠুর মানব মনে হয়?’

-‘তা মনে হয় না, তবে খুব বেশি দয়াবান কি-না সেটাও তো বোঝা যাচ্ছে না।’

-‘শোনো মেয়ে, স্ত্রীর ওপর যারা জোরজবরদস্তি করে, স্ত্রীর সাথে যারা গলাবাজি করে, স্ত্রীর কথা ও অনুভূতিকে যারা অসম্মান করে, আমি ওই টাইপের কাপুরুষ নই। স্ত্রীর প্রতি আমার আচরণ সবসময় নিষ্ঠুরতার না হয়ে কোমলতার হবে।’

ঊষা তাকে থামিয়ে রেখে বলল,
-‘হয়েছে আর কোমলতা দেখাতে হবে। একধাক্কায় কপাল ফুলিয়ে দিয়ে বলছেন, এটা না-কি নিষ্ঠুরতা না, কোমলতা। আমার শরীরে তো গোশত না, ইস্পাত বসানো। ব্যথা লাগে না। দেখি সরুন…।’

তানজীমকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে দ্রুতপায়ে রুম ত্যাগ করল ঊষা। বেরোতেই দেখা হলো তাম্মির সাথে। আহ্লাদী স্বরে দু’খানা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল,

-‘ছোটাম্মি, আমাকে কোলে নাও।’

তাম্মিকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে এলে ফারিশা তার কপালের ফুলে যাওয়া অংশ দেখে আঁৎকে উঠে জানতে চাইল,
-‘এরমধ্যেই ব্যথা পেলে কী করে?’

ঊষা একটু রহস্য করে বলল,
-‘আর বোলো না। ভরসন্ধ্যায় একটা পালোয়ানের সাথে ধাক্কা খেয়েছি।’

***

খোলা আকাশের নিচে মস্তবড়ো ছাদ। বাড়ির সম্পূর্ণ সীমানাজুড়ে বিস্তৃত এই ছাদের কিনারায় রংবেরঙের ফুলের গাছ। সম্পূর্ণ ছাদজুড়ে গোলাপ ও গাঁদা ফুলের পাপড়ি দিয়ে কার্পেট বিছানো। হেলিকপ্টারের পাংখার বাতাসে কার্পেটের ডিজাইনের বারোটা বেজে গেছে ইতিমধ্যে। যে মুহূর্তে হেলিকপ্টার ছাদে ল্যান্ড করল, সবগুলো পাপড়ি হাওয়ায় উড়ে উড়ে গেল। হেলিকপ্টার স্থির হলে, ডোর খুলে বের হলো ফাবিহা। সৈয়দা দিলারা রওশন বরণডালা হাতে নিয়ে সিঁড়ি ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, বাড়ির বউকে বরণ করার জন্য। তাকে ঘিরে হৈচৈ করছে ফারশাদের একগাদা কাজিন। বুক ধড়ফড় করা এক অচেনা অনুভূতি নিয়ে এতটা সময়ের জার্নি শেষ করেছে উজমা। এখনও ভেতরটা কাঁপছে। সুখের অনুভূতি এমন হয়? এত কম্পন, এত অস্থিরতা! তার সমস্ত ভয়, ধড়ফড়ানি ও অস্থিরতা দূর হয়ে গেল ফারশাদের হাতের ছোঁয়ায়। হাত বাড়িয়ে বিশ্বস্ততার সাথে সে যখন তার ছুঁলো, পূর্ণতার একটা দোলা সমস্ত শরীর জুড়ে বয়ে গেল। মনকে আনচান করে দিল। ফারশাদ বলল,

-‘এসো, তোমার ঘরে এসো, বাটারফ্লাই। বহুদিন ধরে এই ঘর তার যোগ্য মানুষের অপেক্ষায় আছে। আজ এই ঘরের যোগ্য কর্ত্রী ঘরে পা রাখছে। ঘর তোমাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে ‘ওয়েলকাম’ করছে, দেরী কোরো না, মাই লাভ। নেমে এসো জলদি।’

ফারশাদের আবেগঘন কথাতে ঠোঁটমুখে লজ্জারা ভর করল উজমার। হেলিকপ্টার থেকে নেমে হাতে-হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে, সিঁড়ি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দিলারা রওশন তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হাতে থাকা জুসের গ্লাস থেকে এক চুমুক জুস খাইয়ে দিলেন। কপালে আদর দিয়ে বললেন,

-‘সৈয়দ বাড়ির ইজ্জত তুমি। যত্ন, সম্মান ও ভালোবাসার সাথে এই ঘর, এই সংসারকে আগলে রেখো। এই গোটা বাড়ি ও বাড়ির সব মানুষজনের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার। কেউ একজন জেনে-বুঝে বংশের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, তুমি শক্তহাতে এই সংসারের হাল ধরবে এবং তাকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে।’

ভদ্রমহিলার কথায় শুধু ‘জি’ বলে ‘হ্যাঁ সূচক’ ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ল উজমা। সাহস নিয়ে মুখফুটে আর কিছু বলতে পারল না। ‘এসো’ বলে তিনি সরে দাঁড়িয়ে নিচে যাওয়ার পথ করে দিলেন। কাজিনেরা সবাই সুবাসিত ফুল ছিঁটিয়ে স্বাগত জানিয়ে নিচে নেমে আসার অনুমতি দিল। শুধু ছাদই নয়, সিঁড়িও ফুলে ফুলে সাজানো ছিল। ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে পা বাড়িয়েছিল উজমা, সিঁড়িতে পা পড়ার আগেই ফারশাদ তাকে থামিয়ে বলল,

-‘এভাবে নয়।’

থেমে গেল উজমা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ফারশাদ কোনো উত্তর দিল না। দু’হাতের শূণ্যে তুলে নিয়ে ফুলে ফুলে সাজানো সিঁড়িতে পা রাখল। নাইমুর পুরো মুহূর্তটা ভিডিও করল আর অন্যরা ফুল ছিঁটিয়ে গেল। ড্রয়িংরুম ছাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে একেবারে নিজের রুমে প্রবেশ করে, উজমাকে দাঁড় করিয়ে সম্পূর্ণ রুম দেখিয়ে বলল,

-‘এটাই তোমার ঘর। আর আমি তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ। সামলে রাখতে পারবে তো?’

ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে একহাতে চোখ ঢেকে নিল উজমা। আলতো স্পর্শে কপাল চুলকে বলল,
-‘না পারলে তুমি আছো তো। শিখিয়ে-পড়িয়ে নিও।’

ফটোগ্রাফি এখানেই থামিয়ে দিল ফারশাদ। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘তোরা একটু নিচে যা। আর গিয়ে দেখ যে, ফুপির কোনো হেল্প লাগবে কি-না।’

সবাই চলে গেলে ফারশাদ নিজের প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় বের করে উজমাকে বলল,
-‘তুমি বোসো, রিল্যাক্স হও, আমি এটা চেঞ্জ করে আসি।’

ফারশাদ ওয়াশরুমে চলে গেলে পুরো রুমে চোখ বুলালো উজমা। দেয়ালের পেইন্টিং থেকে শুরু করে রুমের এই কোণ, ওই কোণ, সম্পূর্ণটায় চোখ ঘুরিয়ে বিছানার দিকে গিয়ে দৃষ্টি আটকে গেল। শুভ্ররঙা জুঁই ও জেসমিন ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে সম্পূর্ণ বাসর। ফুলগুলোর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ও মন মাতানো সৌরভ পুরোরুমে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ ও মনের তৃপ্তি মিশিয়ে বিছানায় বসে, পার্স থেকে ফোন বের করল। বাড়িতে সবাই চিন্তায় আছে এইভেবে মিশকাতের নম্বরে ডায়াল করল। রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিশকাত বলে উঠল,

-‘পৌঁছেছিস?’

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উজমা বলল,
-‘হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই।’

ননদিনীর এই ভেজা ভেজা কণ্ঠস্বর ছুঁয়ে গেল মিশকাতকে। কষ্ট পেল সে-ও। চোখের কোণ ভরে উঠল। বলল,
-‘মন খারাপ করিস না। এটাই তাকদীর।’

-‘হুম…।’

-‘আমাদের জন্য ভাবিস না। আমরা ঠিক সামলে নেব সবকিছু।’

-‘বাবা কোথায়?’

-‘মামা ও মামীমার সাথে গল্প করছেন।’

আরও কিছুক্ষণ ভালোমন্দ আলাপ করে ফোন রেখে দিল উজমা। ফারশাদ বেরিয়ে এসে আলমারি খুলে একটা নতুন শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ, গহনাগাঁটি ও কিছু সাজগোজের সরঞ্জাম ধরিয়ে দিল উজমার হাতে। বলল,

-‘চেঞ্জ করে এটা পরো।’

উজমা নীরবে মাথা নাড়লে ফারশাদ বলল,
-‘অন্যসব পোশাকে তোমাকে দেখেছি, কিন্তু শাড়িতে দেখিনি। বউকে আজ বউয়ের সাজেই দেখতে চাই। পরবে না?’

লজ্জায় গুটিয়ে গেল উজমা। ফারশাদ তার সব ভীতি, লজ্জা সরাতে তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
-‘শাড়ি পরতে জানো তো?’

উজমা শুধু উপরনিচ মাথা নেড়ে উত্তর দিল। ফারশাদ আবারও বলল,
-‘একা পারবে না-কি কারও হেল্প লাগবে?’

-‘পারব।’

নতমুখী হয়েই মিনমিনে স্বরে উত্তর দিল উজমা। ফারশাদ তার চিবুক ছুঁয়ে বলল,
-‘এতদিন তোমাকে হাসতে দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি, রাগতে দেখেছি। আর আজ দেখছি, লজ্জায় লাল হয়ে যেতে। আমি এখুনি বেসামাল হতে চাইছি না। লজ্জা দূরে সরাও আর একটু সহজ হও। প্লিজ…।’

এই কথা শোনে লজ্জা দূর হওয়া তো দূর, আরও বেশি লাজরাঙা হয়ে উঠল উজমা। লজ্জাবতী লতার ন্যায় নেতিয়ে গেল। ফারশাদ ঠোঁট কামড়ে হেসে লাল হয়ে যাওয়া গালে টুপ করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

-‘আমি ড্রয়িংরুমে আছি। কিছু লাগলে ম্যাসেজ কোরো।’

***

চলবে…