মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-১+২+৩+৪

0
111

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – এক

কৈশোরে হারিয়ে যাওয়া পুরনো এক বন্ধুর খুঁজে, অচেনা শহরে এসে পা রেখেছে ফারশাদ। তার চোখেমুখে বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার হাজারও আকাঙ্খা, তৃষ্ণা, ব্যকুলতা। দীর্ঘ সময়ের জার্নি শেষ করে যখন একটা ঠিকানায় এসে পৌঁছাল, তখন জানল তার কৈশোরের বন্ধুটা এই শহরে থাকে না। অনেক আগেই এখান থেকে চলে গেছে অন্য কোথাও। কোথায় আছে, কেমন আছে, এইটুকু জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল ফারশাদ। ট্রলিব্যাগের ওপর বসে চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আওড়ে গেল,

-‘কোথায় হারালি উসাইদ? কী করে খুঁজে পাব তোকে?’

ব্যর্থতার সুর ফারশাদের কণ্ঠে। ব্যথাবেদনা আর দুঃশ্চিন্তা। খুঁজে না পেলে হোটেল ম্যানেজ করে আগে নিজের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে পূণরায় দারোয়ানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-‘আপনি একটু মনে করে দেখুন, কবে, কখন ওরা এখান থেকে চলে গিয়েছে! নিশ্চয়ই মনে পড়বে।’

দারোয়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আরেহ্ মশাই, আপনারে তো আমি বললামই। উসাইদ নামে কেউ এইখানে থাকে না। পাঁচ বছর ধইরা চাকরি করতাছি। আমার স্মৃতিশক্তিরে দুর্বল প্রমাণ করতে চান? ক্যান খামোখা বিরক্ত করতাছেন, কন তো?’

ফারশাদ আহত মনে ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে একটা ট্যাক্সিক্যাব থামাল। ব্যাগ পিছনে রেখে যখন নিজেও গাড়িতে উঠবে তখন পিছন থেকে একটা পুরুষালী আওয়াজ এলো,

-‘এ্যাক্সকিউজ মি! আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’

ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল ফারশাদ। চেনা চেনা একটা মুখ, তবুও অচেনা মনে হলো তার। বার দু’য়েক মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করল,

-‘আপনি…?’

-‘তাক্বদীম। চিনতে পারছ না? আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি ফারশাদ, ফয়জান আংকেলের ছেলে। ঠিক বললাম তো?’

দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ, হতাশাজনিত, মলিন চেহারায় হাসি ফুটে উঠল ফারশাদের। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাক্বদীমকে। বলল,

-‘ও মাই গড! আই কা’ন্ট বিলিভ্। কতদিন পর তোমাকে দেখছি। কেমন আছো?’

তাক্বদীমও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে আলতো চাপড় মেরে বলল,
-‘আল্লাহ্ ভালো রেখেছেন। তোমার কী খবর? বিন্দাস লাইফ কাটাচ্ছ না?’

-‘আর বিন্দাস! রোজকার একঘেয়েমি জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।’

-‘ক্রিকেট তোমার কাছে একঘেয়েমি মনে হচ্ছে? কী বলো? নামকরা ক্রিকেটারের মুখে এই কথা বড্ড বেমানান।’

-‘তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ, সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীরের প্রথম পরিচয় সে একজন মানুষ। তারও মন আছে। ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে। আছে নিজেকে মেলে ধরার কিছু সুপ্ত বাসনা। ক্রিকেট, প্র‍্যাকটিস, এই দেশ, ওই দেশ, এসব করে জীবনের অনেকগুলো সময়কে বাক্সবন্দী করে ফেললাম। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয়, সেইসব সময়কে মুক্ত করে দিই। কিন্তু সময়-সুযোগ হয়ে উঠে না।’

ফারশাদের কণ্ঠস্বরটা বিষণ্ণতায় ভরা ছিল। তাক্বদীম খানিকটা অবাকই হলো এই স্বর, এই মানুষকে দেখে। বলল,

-‘হঠাৎ এই শহরে যে?’

-‘বাড়িতে মন টিকানো দায়। শান্তি পাই না কোথাও। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি সারাক্ষণ আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। যদি একটু শান্তি খুঁজে পাই এখানে। ফেলে যাওয়া দিনকে একটু তাজা করতে, নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করতেই এখানে এসেছি। এখানে এসে আমি তো ঝামেলায় পড়ে গেলাম। উসাইদ নেই। কোথায় যে খুঁজব! টেনশনে আমার পাগল পাগল লাগছে। ও’কে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই…।’

ফারশাদের মনমরা কথা শোনে হেসে ফেলল তাক্বদীম। ট্রলিব্যাগ নামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সিক্যাব বিদায় করে দিল। ফারশাদ অবাক হয়ে বলল,

-‘করছ কী? হোটেলে যেতে হবে আমাকে।’

-‘হোটেলে কেন যাবে? যার কাছে এসেছ তার কাছে যাবে।’

-‘কিন্তু তার ঠিকানা তো জানি না।’

-‘আমি আছি না? নো চিন্তা ডু ফুর্তি।’

ফারশাদ অবাক হলো তাক্বদীমের কথায়। বলল,
-‘তুমি জানো উসাইদ কোথায়?’

প্রশ্ন করে নিজের জিহ্বায় কামড় দিল ফারশাদ। শব্দ করে হেসে ফেলল। মনে পড়ল উসাইদ, উজমা, উষা, এরা তো এখানেই ছিল। তাক্বদীমদের বাসার কাছেই। যখন তার বাবার ট্রান্সফার হয়, তারা চলে যায় রংপুরে। একই বিল্ডিংয়ে বসবাস ছিল তাদের। শুধু ফ্ল্যাট ছিল আলাদা। তখন উষা অনেক ছোটো। সবে টুকটুক পায়ে হাঁটতে শিখেছে। মাঝখানে কেটে গেছে দীর্ঘবছর। কারও সাথে যোগাযোগ হয়নি তার। স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটতে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। ক্রিকেট খেলা তার নিত্যদিনের সঙ্গী হওয়ার পর থেকে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের কৈশোরের স্মৃতিদের। এইবার শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরার পরই স্মৃতি থাকে ধাক্কা মেরেছে। ছুটে এসেছে এখানে। কে জানে, উসাইদ তাকে মনে রাখল কি-না!

তাক্বদীম নিজের গাড়ি বের করল। ট্রলিব্যাগ পিছনে তুলে সামনে বসাল ফারশাদকে। বলল,
-‘আর কী খবর? বিয়েশাদী করেছ?’

ফারশাদ সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে জবাব দিল,
-‘আরেহ্ না। এখনও পিওর সিঙ্গেল।’

-‘কেমন মেয়ে পছন্দ? বিদেশিনী? চাইলে বলতে পারো। ঘটকালি করব।’

-‘তোমার কী ধারণা, কোনো বিদেশিনীকে পটিয়ে সিঙ্গেল তকমা গুছিয়ে নিয়েছি?’

তাক্বদীম কাঁধ নাচিয়ে বলল,
-‘হতেই পারে সেরকম। অস্বাভাবিক তো কিছু না। তুমি সেলিব্রেটি মানুষ। তোমার সাথে বিদেশিনীই যায়।’

-‘ভুল বললে। নাম-যশ, খ্যাতি এসব অর্জন করা মানে বিদেশী কালচারে অভ্যস্ত হওয়া নয়। পেশাগত কাজে আমাকে এই দেশ, ওই দেশ ছুটতে হয় ঠিকই তবে আমি মন থেকে চাই, বিশুদ্ধ মনের একজন বাঙালী নারীকে। বিদেশিনীকে বিয়ে করলে একটা চাকচিক্যময় সোনার হরিণ পাওয়া যেত। কিন্তু বিশুদ্ধ মন আছে এমন কোনো রমণীকে পাওয়া যেত না।’

-‘এখন কী বিয়ে করবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ?’

-‘করতে তো হবেই। বয়স হচ্ছে। অলরেডি থার্টি টু। বাবা-মা উঠেপড়ে লেগেছেন বিয়ের জন্য। মেয়েও পেয়ে গেছেন। আমি আপাতত ওসবে নাই।’

-‘নাই মানে? বিয়ে করবে না-কি? আর কত সিঙ্গেল থাকবে?’

প্রশ্ন করে ড্রাইভে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাক্বদীম। ফারশাদ জানালার কাঁচ সরিয়ে সবুজ-শ্যামল মাঠের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আচমকাই বলে উঠল,

-‘একটা গোপন কথা শুনবে?’

-‘কী?’

ফারশাদের ফিসফিস শোনে কৌতূহল বাড়ল তাক্বদীমের। কান বাড়িয়ে ড্রাইভ সামলে আগ্রহী মেজাজে বসে রইল। ফারশাদ ফিসফিস করে বলল,

-‘আজ সন্ধ্যায় আমার এ্যানগেজমেন্ট পার্টি। মায়ের পছন্দের এক বিদেশিনী মেয়ের সাথে। আমার আবার অতিরিক্ত মর্ডান, স্মার্টনেসে মারাত্মক রকমের অ্যালার্জি আছে। এটা মা জানেন কিন্তু ওনার একটাই কথা, উনি যাকে চাইবেন, তাকেই আমার বিয়ে করতে হবে। অথচ ওনার পছন্দ আর আমার পছন্দ বরাবরই আলাদা। মা উত্তরে বললে আমি দক্ষিণে হাঁটি, এই কারণে মায়ের পছন্দকে নিজের পছন্দ বলে মেনে নিতে পারছি না। কথাবার্তা চালচলনে স্মার্ট হওয়া আর…। থাক্, বাদ দিই। আমি আসলে পালিয়েছি। নিজেকে বাঁচাতে, মুক্তি দিতে পালিয়েছি।’

কথা শেষে চোখ মারল ফারশাদ। তাক্বদীম প্রথমে শুনল, অবাক হলো, পরক্ষণেই বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,

-‘ইন্না-লিল্লাহ। কী করলে এটা? মিডিয়া জানে?’

-‘আলবাত জানে। রাতে ধামাকা একটা শিরোনাম হবে, বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীর এ্যানগেজমেন্ট আসর থেকে হাওয়া।’

হো হো শব্দে এবার হেসে ফেলল তাক্বদীম। হাসল ফারশাদ নিজেও।

***

-‘কী হয়েছে ভাইয়া-ভাবী? তোমরা এইভাবে মন খারাপ করে বসে আছো কেন?’

হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে, চৌকাঠে পা রেখে বসার ঘরে উসাইদ ও তার স্ত্রী মিশকাতকে মন খারাপ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করতে দেখে দু’জনকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্ন করল উজমা। বোনকে দেখে ম্লানমুখের মাঝেও একটুকরো ঝলমলে হাসি ফুটিয়ে তুলল উসাইদ। বলল,

-‘তেমন কিছু না। তুই যা। ফ্রেশ হয়ে আয়।’

উজমা তার আদরের ভাবীর পিছনে দাঁড়াল। সে অসুস্থ। প্রেগন্যান্সির শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছে। যেকোনো দিন হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে। হয়তো নতুন সদস্যের আগমন নিয়েই ভাই-ভাবীর মধ্যে কথা হচ্ছিল। সে বেশি ঘাটাল না। মিশকাতকে বলল,

-‘এই শরীরে তুমি কেন হেঁশেল ঠেলবে বোলো? ঊষাকে বললেই চা বানিয়ে দিত। আর ক’দিন পরই বাড়িতে নতুন সদস্যের আগমন ঘটবে। তোমার এখন বিশ্রামে থাকা উচিত ভাবী।’

মিশকাত শুধু হাসল। কাজ না করলে শরীর বসে যায়। এজন্য টুকটাক কাজে ইচ্ছে করেই হাত লাগায়। বিশেষ করে বিকেলের এই চায়ের ব্যাপারটা। বাইরে থেকে ফিরে এই সময়ে উসাইদ নিজেই বউয়ের হাতে চা খেয়ে তৃপ্তি পায়। এজন্য নিজের অসুস্থতা একপাশে ফেলে রেখে স্বামীর ইচ্ছেকে মূল্য দেয় মিশকাত। ভাবীর থেকে যথোপযুক্ত কোনো জবাব না পেয়ে উজমা ভাইয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,

-‘শোনো, তোমার যদি চা খেতে ইচ্ছে করে ঊষাকে বলবে, নয়তো নিজে বানিয়ে খাবে। এক কাপ চায়ের জন্য অসুস্থ মানুষটাকে আগুনের আঁচের কাছে যেতে বাধ্য কোরো না।’

উসাইদ হেসে বলল,
-‘আমি কিন্তু তোর ভাবীকে বারণ করেছি। তা-ও সে শোনেনি। ওসব বাদ দিই। জরুরী একটা কথা বলব বোন।’

উজমা খানিকটা চমকাল। জানত, কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। নয়তো কারও মুখে হাসি নেই কেন? সে কিছুটা ভয়ভীতি মনে আগলে নিয়ে বলল,

-‘কী কথা ভাইয়া?’

-‘বাইরে থেকে এসেছিস্, আগে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর চা খেতে খেতে বলব।’

-‘ঠিক আছে। বোসো তোমরা। আমি আসছি।’

উজমা নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েছিল মাত্র, তার মধ্যেই বাইরে থেকে হর্ণের আওয়াজ শোনা গেল। অসময়ে কে আসলো এটা দেখতেই মূল ফটকের সামনে গেল উজমা। উঠোনে এসে গেটের বিরাট পাল্লা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল। তাক্বদীমের গাড়ি চিনতে ভুল হলো না তার। উঠোনে গাড়ি থামিয়ে ডোর খুলে বের হলো তাক্বদীম। উজমা অবাক হয়ে বলল,

-‘তুই! হঠাৎ?’

তাক্বদীম মুচকি হেসে কাঁধ নাচিয়ে ট্রলিব্যাগ নামিয়ে জবাব দিল,
-‘সেলিব্রেটি মেহমান নিয়ে এসেছি। দেখ তো, চিনতে পারিস কি-না।’

ডোর খুলে মাটিতে পা ফেলল ফারশাদ। চারপাশে চোখ ঘুরাতেই একতলা বাড়ির ছাদের দিকে নজর গেল তার। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোধূলির রঙমাখা আকাশ দেখছেন উসমান ওয়াজেদ সাহেব। এত বছর পরে এসেও এই মানুষটাকে চিনতে একবিন্দুও ভুল হলো না তার। চোখের সানগ্লাস সরিয়ে নিচ থেকে গলা উঁচিয়ে বলল,

-‘আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন?’

উসমান ওয়াজেদ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালেন। ফারশাদ বুঝল, তিনি তাকে চিনতে পারছেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে নজর দিয়ে রংচঙা বিকেলের শেষ মুহূর্তে, আলো-আঁধারির মাঝে একজোড়া ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টি দেখে খানিক সময়ের জন্য থমকে গেল তার দৃষ্টি। অমন অসময়ে প্রকৃতিতে রং না লাগলেও তার মনের আকাশে সাতরঙা রংধনু এসে উঁকি মারল। ঠিক কী কারণে মনের কোণে একটুকরো প্রশান্তি অনুভব হলো, বুঝতে পারল না সে। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মন-প্রাণ আনচান করে উঠল। ভালো লাগার আবেশে ছেয়ে গেল হৃদয়পুরী। ডানহাত নাড়িয়ে আলতো হেসে বলল,

-‘হাই, সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীর।’

উজমা নাম শোনে ভ্রু বাঁকিয়ে মনে করার চেষ্টা করল, এই নামে কাউকে সে চিনে কি-না। ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীর তার পরিচিত কেউ? চিনতে না পেরে দু’দিকে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে অসহায় দৃষ্টি ফেলল তাক্বদীমের দিকে। হাত উলটে বলল,

-‘কে? আমি চিনতে পারছি না। তোর কোনো আত্মীয়?’

তাক্বদীম অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল উজমার কথা শোনে। তবে ফারশাদের মুখটা চুপসে গেল। তাক্বদীম বলল,

-‘সত্যিই চিনতে পারছিস্ না?’

উজমা ভালোমতো তাকাল। আসলেই সে চিনতে পারছে না। তবে ফারশাদ নামটা মাথায় গুতো মারছে বার বার। মনে হচ্ছে, পরিচিত কেউ। তবুও অপরিচিত। উজমার ফেইস দেখে তাক্বদীম ফের বলল,

-‘তোরা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতি, সেখানেই পাঁচ তলায় ওরা থাকত। ফয়জান আংকেলের কথা ভুলে গিয়েছিস্ তুই?’

ভুলেনি উজমা। মনে পড়াতে ভালোমতো লক্ষ্য করল ফারশাদকে। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বলল,

-‘ওহ, মনে পড়েছে।’

মিনমিন স্বরে জবাব দিল উজমা। আসলে সে চিনতে পারেনি। মাঝেমধ্যে ক্রিকেট খেলা দেখে, নাম শুনেছে, তবে এটা জানত না যে, ফয়জান আংকেলের ছেলেই এই ফারশাদ মুনতাসীর হতে পারে। উজমাকে চুপ থাকতে দেখে তাক্বদীম বলল,

-‘ফয়জান আংকেলের ছেলে ফারশাদ। আগে তো ভাইয়ার সাথে চলাফেরা ছিল তার। তুই বোধহয় ভুলে গিয়েছিস্।’

-‘যোগাযোগ না থাকলে ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।’

-‘ঠিক তাই। ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। সবাইকে খুঁজতে আগের বাসায় গিয়েছিল। কিন্তু তোরা তো কেউ ওখানে নেই। তাই আমি-ই ও’কে এখানে নিয়ে আসলাম।’

-‘ভালো করেছিস্। ভাইয়া ঘরেই আছে।’

একপলকের জন্য ফারশাদের দিকে আবারও চোখ ফেলল উজমা। ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,
-‘ভেতরে আসুন।’

***

দরজায় একজন অচেনা মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হলো উসাইদ। নামী খেলোয়াড় হলে কী হবে, বহুদিন ধরে যোগাযোগ বন্ধ হলে যে কেউ চেহারা ভুলে যাবে স্বাভাবিক। একেবারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বসবাস করলে চেনা পরিচিতদের হারিয়ে ফেলা, তাদেরকে ভুলে যাওয়া, এটাও অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু এত বছর পর, ঠিক কী কারণে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীর কৈশোরের একমাত্র বন্ধুকে স্মরণ করল, এটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো তার। কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপ রেখে উঠে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল,

-‘প্রায় দেড় যুগ পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে এসে তোর মনে পড়ল, মৌলভীবাজারের কোনো এক কোণায় একটা মানুষের সাথে তোর আত্মিক সম্পর্ক ছিল?’

ফারশাদ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে। অভিমান দূর করতে চিরচেনা অভ্যাসের মতো বুকের একপাশে পাঞ্চ মেরে বলল,

-‘আমি নাহয় ভুলে গিয়েছি। তোর তো মনে রাখার কথা ছিল। তুই কীভাবে ভুলে গেলি? পুরনো নম্বর পাল্টাবি ভালো কথা, একবার আমাকে জানাবি না? অন্তত একটা ম্যাসেজ দিয়ে রাখতে পারতি। আমি কতদিন তোর নম্বরে কল করেছি, ম্যাসেজ করেছি। কতবার তোর নাম দিয়ে ফেসবুকে সার্চ দিয়েছি। অথচ তোর নাগাল পেলাম না। হুট করে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিলি কেন? কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি?’

উসাইদ বড্ড বিব্রতবোধ করল এই কথায়। উজমা পাশে থাকাতে ভাইয়ের মনোঃকষ্ট বুঝে ফেলল। যোগাযোগ তো সে ইচ্ছে করে বন্ধ করেনি। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছিল। সে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

-‘ছাড় ওসব কথা। এত বছর পর কী মনে করে?’

-‘কেন? আমি আসতে পারি না?’

একটুবেশি-ই অভিমানী শুনাল ফারশাদের কণ্ঠস্বর। বন্ধুর অভিমান টের পেয়ে হো হো শব্দে হেসে ফেলল উসাইদ। পিঠে আলতো চাপড় মেরে বলল,

-‘একশোবার আসতে পারিস্। কিন্তু আমার মতো একটা গরীব ঘরের মানুষের সাথে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরের উঠাবসা একদমই মানায় না। তুই এসেছিস আমি অনেক খুশি হয়েছি। তারচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি এটা ভেবে যে, তুই আমাকে মনে রেখেছিস। এত বছরে পুরনো স্মৃতি, পুরনো বন্ধু এতকিছু মনে রাখার কথা নয়। তবুও…। থাক্… বাকি কথা পরে হবে। আয় বোস, বিশ্রাম নে আগে। অনেকদূর থেকে জার্নি করে এসেছিস।’

উসাইদ নিজেই বন্ধুকে টেনে নিয়ে বসাল সোফায়। তাক্বদীমকেও বসতে বলে উজমাকে বলল,
-‘একটু চা-নাশতার ব্যবস্থা কর উজমা।’

উজমা সায় জানিয়ে হাত ধরে ধরে প্রথমে মিশকাতকে তার রুম অবধি নিয়ে গেল। বাইরের মানুষের সামনে তার এই শরীরে থাকা অনুচিত। রান্নাবান্না সে সামলাতে পারবে এই বলে চটজলদি চলে এলো রান্নাঘরে। তখন গুটিগুটি পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামলেন উসমান ওয়াজেদ। তাঁকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল ফারশাদ। ঝড়েরবেগে ছুটে এলো সামনে। মুহূর্তেই কদমবুসি করে জড়িয়ে ধরল। উসমান ওয়াজেদ শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকালেন। ফারশাদ আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,

-‘কেমন আছেন আংকেল? আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি শাদ। আমরা একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। উসাইদের সাথে রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। ঘোরাঘুরি করতাম। মনে নেই আপনার?’

উসমান ওয়াজেদ চিনতে না পেরে বললেন,
-‘কী নাম তোমার বাবা?’

ফারশাদ মনে কষ্ট পেল ভীষণ। সময়ের সাথে সাথে অনেককিছু পালটে যায় এটা সে জানে, বুঝে। তবে উসমান ওয়াজেদের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে তিনি যে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়বেন, দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এই মানুষটার কাছে সে একসময় বড্ড আদরের ছিল। নিজের ছেলে ও তার মাঝে কোনো পার্থক্য করেননি কোনোদিন। একদিন যাকে স্বস্নেহে সন্তানের আসনে বসিয়েছিলেন, আজ তাকে চিনতেই পারছেন না। মন খারাপের সুরে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,

-‘আমি ফয়জান মুনতাসীরের ছেলে, ফারশাদ মুনতাসীর। এখন চিনতে পারছেন?’

-‘তুমি ফয়জানের ছেলে?’

বিষণ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন উসমান ওয়াজেদ। ফারশাদ মাথা নেড়ে বলল,
-‘জি।’

-‘তুমি ভালো আছো বাবা? তোমার বাবা-মা তারা ভালো আছে?’

-‘জি, সবাই ভালো। আপনি কেমন আছেন? অনেক রোগা হয়ে গেছেন আংকেল। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না? কী এত ভাবেন সারাদিন?’

-‘কী ভাবি আমি? কী জানি। মনে পড়ছে না আমার।’

অযথা কথা বাড়াল না ফারশাদ। উসমান ওয়াজেদকে ধরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে উসাইদের কাছে জানতে চাইল,
-‘আন্টি কোথায়? আন্টিকে দেখছি না?’

উসাইদ কিছু বলার আগেই গলা উঁচিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে ফারশাদ ডাক দিল,
-‘আন্টি, ও আন্টি। কোথায় আপনি? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি আন্টি। আপনি কি আমার ওপর রেগে আছেন? কথা বলতে চান না, এজন্যই কি রুমে বসে আছেন? দাঁড়ান, আমি আসছি। রাগ ভাঙিয়ে ছাড়ব আজ।’

প্রচণ্ড উৎসাহ ও আবেগের সাথে ডাকতে ডাকতে ফারশাদ যখন ইতিউতি চোখ বুলিয়ে ওয়াহিদা জামানকে খুঁজতে শুরু করল, তখন উসাইদ ম্লানমুখে বলল,

-‘থাম, শাদ। কাকে ডাকছিস্ তুই? মা নেই আর। কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন।’

চঞ্চল পা দুটো থেমে গেল তৎক্ষনাৎ। স্থবির হয়ে পিছু ফিরে ফারশাদ জানতে চাইল,
-‘কী বলিস্? কবে? আমাকে জানাসনি কেন তুই? আন্টি…।’

-‘মা এমন একটা মুহূর্তে মারা গেছেন, কাছেপিঠের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ছাড়া দূরের কাউকে জানাতে পারিনি।’

-‘কী হয়েছিল?’

-‘সুস্থই ছিলেন। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন অনেক। বাবার অসুস্থতার কথা তো জানিস্। মা অনেক ছোটাছুটি করেছেন, অনেক ডাক্তার, ট্রিটমেন্ট, অনেক ঔষধপত্র, তবুও বাবার সুস্থ হওয়ার কোনো লক্ষ্মণই দেখা যাচ্ছিল না। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন মা। হুট করেই একদিন স্ট্রোক করে বসলেন। ব্যস, সব শেষ।’

নিঃশব্দের সাথে কয়েকফোঁটা নোনাপানি এসে ভীড় জমাল ফারশাদের চোখে। অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে বন্ধুর আরও অনেক কথা শুনল। এককানে শুনল, অন্যকানে বেরিয়ে গেল। তার মাথায় শুধু একটা কথাই বাজল, প্রাণপ্রিয় ওয়াহিদা আন্টি আর নেই। এত আদর, এত স্নেহ-মায়া, মমতা ও ঋণের বোঝা তৈরী করে একটা মানুষ এইভাবে চলে গেল? অথচ সে জানতেও পারল না, শেষদেখা দেখতেও পারল না! বুকটা কেমন দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যেতে লাগল তার। কষ্টে জর্জরিত মন নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘তোরা আমাকে এতটাই পর করে দিলি যে, আন্টির মৃত্যুর খবরটাও জানাতে পারলি না? আমার জীবনে কি এতই ব্যস্ততা ছিল উসাইদ? ছুটে আসতে পারতাম না আমি?’
চলবে।

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – দুই

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

থমথমে পরিবেশ বেশিক্ষণ থমথমে রইল না। ঊষার আগমনে খলখলিয়ে হেসে উঠল সম্পূর্ণ বসার ঘর। প্রথমে সে মিশকাতের কাছে খবর পেল বাসায় নতুন মেহমান এসেছে, তাকে ভালোমতো আপ্যায়ন করাতে হবে। রুম ছেড়ে বেরিয়ে বসার ঘরে চোখ ফেলে পিছন ফিরতে গিয়ে দেয়ালে টুক করে একটা বাড়ি খেল। ব্যথায় সামান্য চিৎকার দিতেই উজমা বলল,

-‘ঊষা এইদিকে আয়।’

ঊষা রান্নাঘরে যাবে কী, কপালে হাত ঢলতে ঢলতে জবাব দিল,
-‘দূর, আর জীবনে ক্রিকেট খেলা দেখব না। ভরসন্ধ্যায় স্বপ্ন দেখছি।’

সবার চোখেমুখে কৌতূহল ভর করলেও ঊষার কথার অর্থ বুঝে ফেলল উসাইদ ও উজমা। মিটমিটিয়ে হেসে উজমা বলল,
-‘স্বপ্ন নয় ঊষা, ওটা সত্যিই।’

কপালে তখনও হাত ছিল ঊষার। সে ঢলাঢলির কাজ বাদ দিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল ফারশাদের দিকে। হাতে চিমটি কাটল। ঘোর সরাতে চাইল। সবকিছুর পরও যখন ফারশাদের হাসিমাখা মুখ ও কথার ঝুনঝুন আওয়াজ কানে এসে ধাক্কা দিল তখন নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে চোখেও আঙুল ঘষে নিল বার কয়েক। তারপর বোকা বোকা চেহারায় বলল,

-‘ভাইয়া, আমি চোখের ডাক্তার দেখাব। ইদানীং চোখে শুধু ভুলভাল দেখি।’

ঊষার কথায় সবার মুখে একদফা হাসি নেমে এলো। তাক্বদীম হাসতে হাসতে বলল,
-‘হায় আল্লাহ! তুই চোখে দেখিস না? এখানে আবার ভুলভাল কী দেখলি?’

ঊষা বলল,
-‘ভুল না তো কী? ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরের কি এখানে আসার কথা? কী ভুলভাল স্বপ্ন এসব! ধ্যাৎ। চোখে সমস্যা বলেই তো উল্টাপাল্টা দেখছি। উফফ, আর পারি না আমি।’

হাসির মাত্রা এবার দ্বিগুণ হলো। সবার হাসি ও ফারশাদের উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে ঊষার মাথায় এলো, বাড়িতে মেহমান এসেছিল। কোথায় সেই মেহমান? সে চঞ্চল চোখ নিয়ে চারিদিকে তাকাতেই উসাইদ বলল,

-‘তোর চোখে সমস্যা হয়নি, ঊষা। যা দেখছিস, সবটাই সত্য। এটা কোনো স্বপ্ন নয়। তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরই।’

ঊষাকে অবাক করে দিয়ে ফারশাদ বলল,
-‘যখন আমি সিলেট ছেড়ে রংপুরে চলে যাই, তখন তুমি এইটুকু ছিলে। অনেক ছোটো। ঠিকমতো হাঁটাও শিখোনি। অথচ এখন, অনেক বড়ো হয়ে গেছো। চেহারাও পালটে গেছে।’

ঊষার মনে হলো স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে ঠাস করে বিছানা ছেড়ে নিচে পড়ে গেছে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-‘আপনি আমাকে চিনেন?’

-‘হুম, চিনি তো। তুমি আমাকে চিনো না?’

আর কোনো কথা না বলে রুমে দৌড় দিল ঊষা। নিজের ফোন ও একটা নোটপ্যাড নিয়ে এলো। ছটফটিয়ে বলল,
-‘একটা অটোগ্রাফ, প্লিজ। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমাদের বাড়িতে! ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীর…। ওউ নোও!’

আবেগের কারণে কথা আটকে আটকে এলো ঊষার। সে অটোগ্রাফ ও সেল্ফি নিয়ে তবেই শান্ত হলো। সবকিছু গুছিয়ে রেখে ঝটপট রান্নাঘরে এলো। উজমা চোখ নাচিয়ে বলল,

-‘কী রে, দিবাস্বপ্ন কেমন দেখলি?’

ঊষা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলল,
-‘তুমিও না। কী যে বোলো। নাশতায় কী তৈরী করছ? দাও, হাত লাগাই।’

ঝটপট হাতে নাশতার কাজে হাত লাগাল দুইবোন। উজমা রান্নাবান্নার কাজে সবসময়ই এ্যাক্সপার্ট। মেহমান এলে একা হাতেই বেশ কয়েক পদ নাশতার আইটেম তৈরী করে নেয় সে। ফারশাদকে আধঘণ্টা বসিয়ে এরমধ্যেই ট্রে-ভরা নাশতা সাজিয়ে নিল। আনমনা হয়ে বোনের সব কাজ দেখল ঊষা। মনে মনে বিড়বিড় করল,

-‘এই সুন্দর মনের মানুষটাকে কেন তুমি সব সুখ বঞ্চিত করে দাও, আল্লাহ? কেন দাও এত কষ্ট?’

ঊষার আনমনা ভাব দেখে উজমা বলল,
-‘কী ভাবছিস?’

নাশতা পাঠানোর আগে ট্রে-তে আগে জুস দিল উজমা। জানতে চাইল,
-‘বাসায় কি কিছু হয়েছে আজ? ভাইয়া-ভাবী খুব চিন্তিত।’

ঊষার মনে হলো এক্ষুণি যদি সে সব কথা বলতে যায়, তাহলে হাত-পা ছড়িয়ে গাল ভাসিয়ে কেঁদে ফেলবে। খুব যত্ন সহকারে বোনকে জড়িয়ে ধরল ঊষা। উজমা চমকে গেল। মাথায় হাত রেখে বলল,

-‘কী হয়েছে? ভাইয়া বকেছে?’

আবেগজড়ানো গলায় ঊষা বলল,
-‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আপু। মা মারা যাওয়ার পর থেকে তোমাকেই আমি আমার বিশ্বস্ত বন্ধু ভেবে এসেছি। কারণে-অকারণে সবসময় কাজেপাশে পেয়েছি। তোমার সাপোর্ট-সহযোগিতা, ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া সবকিছু আমাকে সাহস দিয়েছে। বুঝতে শিখিয়েছে। বাঁচতে শিখিয়েছে। আমার সবসময়ের প্রার্থনা, তোমার জীবনে একটা সঠিক ও সুন্দর মনের মানুষ আসুক। যে তোমাকে পুরোপুরি বুঝবে।’

উজমা নিশ্চিত হয়ে গেল, বড়োসড়ো কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। অথচ সে জানতেও পারেনি। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলল,

-‘কী হয়েছে বলবি?’

-‘কিছু হয়নি আপু। আমি শুধু চাই, তুমি সুখী হও।’

-‘তুই এমন ভাঙাগলায় কথা বলছিস কেন? ইজ এ্যানিথিং রং? চুপ করে থাকিস না, ঊষা। বল আমায়। কী হয়েছে?’

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আলগোছে চোখের পানি মুছে নিল ঊষা। তারপর ট্রে হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে এলো বসার ঘরে। উজমা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। বিস্ময়, দুঃশ্চিন্তা, মন খারাপ, কিছু একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট, সবকিছু পেয়ে বসল তাকে। নিশ্চুপে চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে নাশতার বাকি কাজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল। কাজ এগোলেও মন ছুটে বেড়াল কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ের পিছনে।

***

নাশতা খাওয়ার ফাঁকেই ব্যোম ফাটার মতো ঘটনা ঘটে গেল। ওসমান ওয়াজেদ প্রতিদিনই সন্ধ্যার খবর দেখার জন্য টেলিভিশন ছেড়ে বসেন। মেহমান বাসায় থাকলেও তাঁর নজর সেদিকে নেই। তিনি নিজের মতো করে নিউজ দেখছিলেন। ফারশাদকে নাশতা দিয়ে ঊষা বাবার পাশে বসেছিল। একটা পুলিপিঠে ভেঙে একটু একটু করে বাবার মুখে তুলে দিচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে টেলিভিশনের পর্দায় ব্রেকিং নিউজ ভেসে উঠল। হেডলাইন জুড়ে একটা লাইনই যাওয়া-আসা করছে। পাশাপাশি সাংবাদিক একজন লাইভ পডকাস্ট করছে,

“বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীরের অ্যানগেজমেন্ট অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আজ রাতে পারিবারিকভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও কোনো অজানা কারণে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীর পরিবারের কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এখন অবধি তার বর্তমান অবস্থান জানা যায়নি। তবে এই নিয়ে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরের মা মুনমুন হক্ব খুবই দুঃখপ্রকাশ করেছেন। মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডের অন্য এক প্রতিভাবান শিল্পী, জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী সোহানা চৌধুরীই হবে তার পুত্রবধূ। শীঘ্রই তিনি বিয়ের দিনতারিখ পাকা করবেন।”

উসাইদ খুব আগ্রহচিত্তে বন্ধুর সাথে আড্ডা জমিয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এই নিউজ তার আড্ডায় এক বালতি জল ঢেলে দিল। সে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘তো, কাহিনী হচ্ছে এটা। অ্যানগেজমেন্ট অনুষ্ঠান বাতিল করার জন্যই পালিয়েছিস! আমাকে দেখতে আসা, এটা কোনো ফ্যাক্টই না। তোর উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে বাঁচানো। তুই তো দেখছি পুরোপুরি ধান্ধাবাজ হয়ে বসে আছিস।’

ফারশাদ অসহায় কণ্ঠে বলল,
-‘আরে ধুত্তোরি, ভুল ভাবছিস তুই।’

ব্যোম ফাটার পর সবাই অবাক হলেও খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ঊষা। বলল,
-‘ভাইয়া, আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন। নো বলে ছক্কা। ঝাক্কাস।’

ঊষার বকবকানি শোনে চোখ পাকিয়ে তাকাল উসাইদ। ঊষা শুকনো ঢোক গিলে, ‘এই আপু, চা কই?’ বলে ফাঁক দিয়ে উড়ে চলে গেল। ফারশাদ ফের বলতে যাবে কিছু, অমনি তার পারসোনাল ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভাসল ছোটোবোন ফাবিহার নম্বর। বাড়ি থেকে পালানোর সময় পরিচিত সিম পালটে অন্য সিম লাগিয়েছে। যে সিমের নম্বর শুধু তার বাবা ও বোনের কাছে আছে। মা ও বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কারও কাছে এই নম্বরটা নেই। সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আতঙ্কিত গলায় ফাবিহা বলল,

-‘ভাইয়া, কোথায় তুমি? বাড়িতে মিডিয়া এসেছে। সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। এদিকে মা হাউকাউ শুরু করেছে। এমন একটা পরিস্থিতি হবে জেনেও তুমি পালিয়েছ কেন? কী করব আমি এখন?’

-‘কিছু করতে হবে না, শুধু চুপ থেকে যা।’

-‘তুমি কোথায় আছো এখন? ফিরবে কবে?’

-‘সিলেট আছি। কবে ফিরব ঠিক জানি না।’

-‘সিলেট! ওখানে কোথায়?’

-‘উসাইদের বাসায়।’

-‘মাকে জানাব?’

-‘একদমই না। জানালে, এখানে ছুটে এসে আমাকে ধরেবেঁধে নিয়ে যাবে। এরপর ওই ইংরেজ মেয়েটার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। আমি আপাতত বিয়েশাদীতে নাই।’

-‘ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’

-‘ওকে, সাবধানে থাকিস।’

ফোন রেখে বন্ধুকে ম্যানেজ করতে উঠেপড়ে লাগল ফারশাদ। উসাইদ রীতিমতো ফুঁসছে। বাচ্চাদের মতো কাজকারবার করে কেউ! তা-ও এই বয়সে এসে? বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে। সে রেগেমেগে বলল,

-‘তোর আসল উদ্দেশ্যটা বল।’

ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল ফারশাদ। উসাইদের হাত ধরে টেনে নিয়ে বাড়ির বাইরে এলো। উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ানক কিছু সত্যকে বন্ধুর সামনে প্রকাশ করল। উসাইদের মনে হলো, সে ভুল শুনছে। রীতিমতো টলতে শুরু করল সে। ছোটোবেলা থেকে দীর্ঘদিন, দীর্ঘবছর একসাথে চলাফেরা করেছে। ফারশাদের মন কিছুটাও হলেও বুঝত সে। ছেলেটা নিজের মায়ের চেয়েও আপন ভাবত, ওয়াহিদা জামানকে। কোনো এক অজানা কারণে ওয়াহিদা জামানও ফারশাদকে নিজের ছেলের মতোই আদর-স্নেহ করতেন। উসাইদ আরও অবাক হলো এটা ভেবে যে, এতবছর ওইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে কীভাবে দিন অতিবাহিত করেছিল তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু! মানসিক যন্ত্রণা মানুষকে পাগল করে ছাড়ে। সেখানে তার বন্ধু, কতগুলো মনোঃকষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে। হাসছে, ঘুরছে, ফিরছে, খেলছে। ধৈর্যশীল না হলে এটা তো সম্ভবই হতো না। যেকোনোদিন এতসব চাপের বাড়ে যে কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিবে, একেবারে সহজ ও সুন্দর সমাধান হিসেবে। সে তো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল, অভিমানে, দুঃখে। এখন তো দেখছে, তার কষ্টের চেয়েও তার বন্ধুর কষ্ট আরও বেশি দগদগে। নিজের ভুল আচরণের খুবই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলো উসাইদ। চট করে জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে। বলল,

-‘আ’ম স্যরি। আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। আমার মনে হয়, জীবন সাজানোর ক্ষেত্রে অন্য সবার পছন্দের আগে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। ভালো করেছিস, বাড়ি থেকে পালিয়েছিস। তোর জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এই একই কাজ করতাম। জেনে-বুঝে কোনো অন্যায়কে আমি কখনওই সাপোর্ট করব না।’

-‘আমার দুঃখ একটাই, মা কোনোদিন আমাকে বুঝেনি। আমি জানি, সোহানাকে মা অনেক ভালোবাসে, পছন্দ করে। মেয়েটাও সেরকম, স্মার্ট, নজরকাড়া। কিন্তু একটা কথা সত্যি, সে আমার জন্য নয়। আর আমিও তার জন্য নই।’

-‘এখন কী করবি? পালিয়ে আসাটাই তো সব সমাধান নয়। বাড়ি তো ফিরতেই হবে, তাই না?’

-‘জানি। বাড়ি ফিরতে হবে। সোহানা ইংল্যান্ড ব্যাক করলে তবেই বাড়ি ফিরব।’

-‘তোর কী মনে হয়, সে ফিরে যাবে?’

-‘এত সহজে ও আমার পিছু ছাড়বে না। খালাতো বোন হয় আমার। হুবহু মায়ের মতো। মায়ের জন্য বাবা ও আমাদের তিন ভাইবোনের জীবন নরকে পরিণত হয়েছে। তুই জানিস উসাইদ, আমার জীবন থেকে আমি আমার বুবুকে হারিয়ে ফেলেছি? আমার সবটুকু ভরসা, স্বস্তি, হাসি-আনন্দ, বুবুর সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। যেদিন বুবুকে হারিয়েছি, সেদিনই আমি অর্ধেক মরে গেছি। সোহানা যদি আমার জীবনে আসে, বাকি অর্ধেকটাও মরে যাব।’

-‘আংকেল চুপ করে আছেন কেন?’

-‘সেটাই বাবার ভুল। যে ভুল ও অন্যায়ের জন্য তিনি বুবুকে বাড়িছাড়া করলেন, সেই একই ভুল ও অন্যায়ে মা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার পরও বাবা নির্বিকার। বাবার এই চুপ থাকাটাই আমাদের দুই ভাইবোনের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবা যদি ঠিক সময়ে প্রতিবাদ করতেন, আমাদের জীবনে এত অশান্তি নেমে আসত না।’

উসাইদ মনমরা মন নিয়ে বলল,
-‘ফারিশাবু এখন কোথায়?’

-‘জানি না। অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোত্থাও পাইনি।’

-‘আচ্ছা, বাদ দেই। আর মন খারাপ করে থাকতে হবে না। এখন ভেতরে চল। ফ্রেশ হবি। রাতে জমিয়ে আড্ডা দিব। আর শোন, যে ক’দিন এখানে থাকবি একদম ফুরফুরে মেজাজে থাকবি। মনের একটু এদিক-ওদিক হলেই মা//র খাবি কিন্তু।’

ছোটো করে একটা পাঞ্চ মারল উসাইদ। শব্দ করে হেসে ফেলল ফারশাদ। হাসতে হাসতে অনুভব করল, বহুদিন পর নিজেকে তার হালকা লাগছে। প্রাণপ্রিয় বন্ধু যে ব্যথা নিরাময়ের প্রধান মাধ্যম, সেটা যদি আগে জানত, অনেক আগেই নিজের দুঃখ-কষ্ট ভুলতে এখানে ছুটে আসত। দেরী করে হলেও, এখানে আসার পর, প্রিয় বন্ধুকে কাছে পাওয়ার পর, তার সাথে নিজের একান্ত গোপন কথা ও যন্ত্রণা শেয়ার করার পর, মনের মধ্যে চেপে থাকা হাজার টনের ব্যথার পাথর একটু একটু সরে দূরে যাচ্ছে। অনেকদিন পর বুকভরে শ্বাস নিল ফারশাদ। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলল,

-‘যদি তুই আজীবন আমার বন্ধু হয়ে পাশে থাকিস, আমার জীবনের সবটুকু অপ্রাপ্তিকে খুব সহজেই মুছে দিতে পারব।’

***

রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিল তাক্বদীম। উজমা ঝটপট করে একটা টিফিন ক্যারিয়ারে নিশাত ও সানজিদা মুনীরের জন্য কয়েক ধরনের পিঠে ভরে দিল। তাক্বদীম সেটা হাতে নিয়ে বলল,

-‘একদিন অন্তত ভুলে যা, এগুলো পাঠাতে হবে। কেন ভুলিস না, বল তো? এই টিফিন ক্যারিয়ার নিতে নিতে হাত ব্যথা হয়ে গেল আমার।’

-‘হোক ব্যথা। তা-ও নিবি। ভাবী কত পছন্দ করে।’

-‘সে-ই। ভাবীর দিকেই নজর। আমি কি পছন্দ করি সেটা বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস তুই। রোজ রোজ শুধু ভাবীর পছন্দের খাবার। এরপর তোর ভাবীকেই বলব, এখানে এসে খেয়ে যাক। আমি তার টিফিন ক্যারিয়ার বইতে পারব না। আমার ভাই কাঁধে প্রচুর ব্যথা।’

তাক্বদীমের কথায় হেসে ফেলল উজমা। কাঁধে চিমটি দিয়ে বলল,
-‘ফাজলামি রেখে রওনা দে। আর দশমিনিট দেরী হলে উরাধুরা কল আসবে।’

দশমিনিট যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ল না। দশ সেকেন্ড পেরোনোর আগেই নিশাতের কল চলে এলো। তাক্বদীম ফোনের স্ক্রিন উজমার দিকে বাড়িয়ে বলল,

-‘সিগন্যাল চলে এসেছে। যাই। কাল দেখা হচ্ছে?’

-‘ঠিক বলতে পারছি না। পরে জানাব।’

-‘ওকে, বাই। সি ইউ সুন।’

তাক্বদীম যাওয়ার পর সবাই রাতের খাবার খেতে বসল। উজমা আগে বাবাকে খাইয়ে দিল। ঔষধ খাওয়াল। তারপর মেহমান ও ভাইকে একসাথে খেতে বসাল। তাক্বদীমকে বলেনি। বললেও বসবে না। প্রতিদিন রাতজেগে নিশাত অপেক্ষা করে, একসাথে খাবে, এজন্য তাকে অভুক্তই ফেরত পাঠাতে হলো। দুই বন্ধুকে খাবার দিয়ে মিশকাতের জন্য খাবার নিয়ে ভাইয়ের রুমে এলো উজমা। মিশকাত একা একা নিজের অনাগত বাচ্চাটার সাথে বিড়বিড়িয়ে কথা বলছে। তা দেখে উজমা বলল,

-‘আমাকে রেখে কী কথা হচ্ছে দু’জনার?’

মিশকাত বলল,
-‘কী আবার? তোর ভাইঝি খুব তাড়া দিচ্ছে। শীঘ্রই সে মায়ের কোলে আসতে চায়।’

-‘আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে বোলো।’

-‘মানছেই না। একাধারে লাতি মারছে।’

উজমা শুধু মুচকি হাসল। খাবার সাজিয়ে বলল,
-‘তুমি নিজে খাবে না-কি আমার হেল্প নিবে?’

-‘তোর মতো একটা ননদিনী থাকতে, আমি নিজের হাত নোংরা করব কেন? আমি বরং মেয়ের সাথে কথা বলি। তুই ঝটপট মা-মেয়েকে খাইয়ে দে তো। প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে আমাদের।’

হাত ধুয়ে ধীরেসুস্থে মিশকাতের মুখে ভাত তুলে দিল উজমা। খেতে খেতে গল্প জমাল। সুযোগ বুঝে উজমা বলল,
-‘তখন কী বলতে চাইছিলে?’

খাবারটা গলায় আটকে গেল মিশকাতের। খুকখুক করে কেশে উঠল সে। উজমা পানি বাড়িয়ে দিল। সন্দিহান চোখে তাকাল। মিশকাত একটু দম নিয়ে বলল,

-‘এটা তোর জন্য দুঃসংবাদ, উজমা।’

-‘হোক, বোলো।’

-‘সহ্য করতে পারবি না।’

-‘আমি কী সহ্য করতে পারি, কতটা পারি, সে সম্পর্কে তোমাদের কারও আইডিয়া নেই ভাবী। আমি নিজেকে পাথরে পরিণত করেছি অনেক আগেই। তুমি বোলো।’

মিশকাত ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
-‘কাল তো বিয়ের শপিং করার কথা ছিল।’

-‘হ্যাঁ, তো?’

-‘সেটা ক্যান্সেল হয়েছে।’

উজমা খুব স্বাভাবিকভাবেই ভাত মাখিয়ে সেটা আবার মিশকাতের মুখে তুলে দিল। নির্বিকার গলায় বলল,
-‘শুধু শপিং ক্যান্সেল হয়েছে, না-কি বিয়েটাও?’

-‘দুটোই।’

-‘কেন?’

-‘ওরা কোনোভাবে খবর পেয়েছে তোর পুরনো অ্যাফেয়ার আছে। পাত্রের মা-বাবা জানিয়েছে, তারা কোনো নষ্টা মেয়েকে বউ করে নিবে না। তোর ভাই তো রীতিমতো ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিল। বার বার প্রমাণ চাইছিল। কিন্তু ওরা কোনো প্রমাণ দেয়নি। শুধু বলেছে, তোর গায়ে কলঙ্ক আছে।’

এই নিয়ে মোট তিনবার বিয়ে ভাঙল। মাত্র একসপ্তাহ বাকি ছিল বিয়ের। আত্মীয়স্বজন দাওয়াতের কাজও কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল। আগামীকাল শপিং এরপর বিয়ে, শুধু এইটুকুই বাকি ছিল। মিশকাতের কথায় উজমা কোনো শব্দ করল না। সে নিজেকে জানে। কতটুকু পবিত্র এ-ও স্পষ্ট। কেউ অদৃশ্য কালি ছুঁড়ে দিলেই কলঙ্কিত হয়ে যাবে তা নয়। আড়ালে থেকে কে এই লুকোচুরি খেলছে, সেটাই ধরতে পারছে না এখনও। অনেক চেষ্টা করেছে, পারেনি। কে, কোথা থেকে, এমন উটকো খবর দিয়ে বিয়ে বানচাল করে দিচ্ছে, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না তার। তবে তার আফসোস হয়, সেইসব কাপুরুষদের কথা ভেবে। যারা সত্য যাচাই না করে, অন্যের কথা বিশ্বাস করে, নিজের পায়ে কুড়াল মারার পাশাপাশি একজন নিরপরাধ মানুষের গায়ে কলঙ্ক ছুঁড়ে দেয়। তার নীরবতায় প্রচণ্ড ভয় পেল মিশকাত। হাতে হাত রেখে বলল,

-‘তোর কষ্ট হচ্ছে না?’

-‘আমার কেন কষ্ট হবে? আমি কি দোষ করেছি কিছু? পাপ করেছি? হারিয়েছি কিছু? কিছুই না ভাবী। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। আমি অখুশী নই। সব আল্লাহর ইচ্ছা ভেবেই মেনে নিলাম।’

-‘কোনো প্রতিবাদ করবি না? কে এসব করছে জানতে চাইবি না? কেউ কেন তোর পিছনে এভাবে পড়েছে সেটা তো খুঁজে বের করা দরকার।’

-‘অবশ্যই করব। খেয়ে নাও তো দেখি। সবকিছু গোছাতে হবে। কাল আবার ডিউটি আছে। চারিদিকে কত কাজ বোলো, তো। বসে থাকলে চলবে না আমার।’

মিশকাত খুব চেষ্টা করে উজমাকে বুঝতে, কিন্তু পারে না। অনেক চেষ্টা করেও এই মেয়েটাকে বোঝা হয় না তার। এইযে, এতবার বিয়ে ভাঙল। সমাজের দশজন দশ কথা শুনাল, তবুও উজমা সূর্যের উজ্জ্বল আলোর মতোই নিজস্ব সাহস ও শক্তি নিয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে বার বার।

রান্নাঘর গুছিয়ে, ঊষাকে ঘুম পাড়িয়ে, বাবার রুম চেক করে ফোন হাতে নিয়ে ছাদে এলো উজমা। কললিস্ট চেক করে কল দিল সেই ব্যক্তিটির নম্বরে, যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। রিসিভ হওয়ার পর শুধু একটা কথাই বলল,

-‘দেখা করতে চাই।’

-‘সম্ভব হবে না। আমি এই বিয়ে করব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’

-‘কেন?’

-‘আমি খবর পেয়েছি, আপনি…।’

বেশ কিছু নোংরা, অসহ্যকর, অপ্রীতিকর কথা বলে গেল ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি। উজমা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-‘কবে, কখন, কোথায়, কীভাবে আমার গায়ে কলঙ্ক লেগেছিল সেই সময় ও কলঙ্কের দাগটা স্পষ্ট দেখিয়ে, তারপর আমাকে সমাজের মুখে কলঙ্কিত করে বিয়েটা ক্যান্সেল করবেন। প্রমাণ ছাড়া একটা বাজে কথাও আমি আমার চরিত্র ও নামের পাশে বরদাস্ত করব না। আমি উজমা, কোনো অন্যায় সহ্য করি না। কোনো অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করি না। নিজের ইজ্জতকে এত সহজে বলি হতে দিব, তা-ও আপনার মাধ্যমে! ছিঃ। যদি প্রমাণ হয় আমি নির্দোষ, আমার গায়ে কোনো কলঙ্ক নেই, তবে আপনি মনে রাখুন, সমাজের সেইসব মানুষের সামনে আমি আপনার গলায় জুতোর মালা পরাব, যাদের সামনে সেদিন বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দিস ইজ উজমা ওয়াজেদাহ্। না কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবে, আর কোনো অন্যায়কারীকে উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে নিজের নামের পাশে কলঙ্ককে মেনে নিবে। মাইন্ড ইট।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে – তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – তিন

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

মন খারাপের মুহূর্তে নিজেকে একদম একা ও নিঃসঙ্গ রাখতে ভালোবাসে উজমা। নিজের একান্ত দুঃখ-কষ্ট নিজের কাছেই গচ্ছিত রেখে দিন অতিবাহিত করে। জীবনে এতগুলো বন্ধুবান্ধব থাকার পরও আজ পর্যন্ত নিজের মনোঃকষ্ট একচিমটি পরিমাণ ভাগ করেনি কারও সাথে। একা একাই গুমরে মরার স্বভাবের কারণে বাইরের সবার সামনে সবসময় নিজেকে হাসিখুশী ও পরিপূর্ণ সুখী মানুষ হিসেবে প্রকাশ করে সে। এর মানে এই না যে, তার জীবনে বিরাট দুঃখ। দুঃখের সময়টুকু ক্ষণিকের জন্য তার জীবনে আসলেও ওই ক্ষণিক মুহূর্তই তার জীবনের সাথে অভিশপ্ত অংশ হিসেবে জড়িয়ে গেছে। চাইলেও মুছা যায় না, ভুলা যায় না, অস্বীকার করাও যায় না।

সেই তখন থেকে ছাদে বসে আছে উজমা। একাধারে বাজছে ফোন। বন্ধুরা সবাই ভিডিওকলে জয়েন হতে চাইছে, অথচ উজমা নিজের মন খারাপের কারণে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়াতেও শামিল হতে পারছে না। বাজতে বাজতে কল কেটে গেলেও ডিরেক্ট সিমে কল দিয়ে বসল রাইদাহ। বাধ্য হয়ে এবার ফোন রিসিভ করল উজমা। জানতে চাইল,

-‘কী হয়েছে?’

ওপাশ থেকে রেগেমেগে গর্জে উঠে রাইদাহ বলল,
-‘কী হয়েছে সেটা তো তুই বলবি। সবাই ভিডিওকলে জয়েন হয়েছে, তুই কেন কলে আসছিস না এখনও?’

-‘এমনি। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে।’

-‘ওহ, আমাদের ইগনোর করা শিখে গিয়েছিস এখন? বিয়ে ঠিক হওয়া মাত্রই বন্ধুরা সবাই পর হয়ে গেল? তুই এত স্বার্থপর কবে হলি উজমা? কই, আমরা তো কখনও তোকে পর ভাবিনী। তাহলে, তুই কেন এত পাল্টালি?’

মনের ভেতর জমে থাকা সবটুকু কষ্ট এবার কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো। মুখে হাত চেপে একাধারে ফুঁপিয়ে গেল উজমা। রাইদাহ চমকে গিয়ে বলল,

-‘এ্যাই, কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? আমার ভুল হয়েছে পাখি। আর জীবনে ভুল বুঝব না।’

চেপে রাখা কষ্ট ও যন্ত্রণার কারণে কথাবলার মতো ধৈর্যশক্তি পাচ্ছে না উজমা। নিজেকে তার বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। এরমধ্যে রাইদাহ চালাকি করে মাইসারাকে কনফারেন্সে টেনে আনল। মাইসারাও উজমার কান্নায় বেশ অবাক হলো। ধীরকণ্ঠে জানতে চাইল,

-‘আমাদের সাহসী বন্ধুটার হঠাৎ করে কী হলো শুনি? কেন সে এত কষ্ট পাচ্ছে? আমরা কি তার কষ্টের ভাগ নিতে পারি না?’

মাইসারার কণ্ঠ শোনে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলো উজমা। নিঃশ্বাস সহজ করে বলল,
-‘আমি জানি না, ভাগ্য কেন বার বার আমার সাথে এমন খেলা খেলছে! আমি দুর্বল নই, সেটা তোরা জানিস, আমিও জানি। কিন্তু বার বার ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে দিতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

-‘বুঝতে পারছি, কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কী হয়েছে সেটা কি পরিষ্কার করে বলা যায়?’

ঠাণ্ডা মাথায় সব কথা বলে গেল উজমা। নিজের ওপর লেগে থাকা অদৃশ্য কলঙ্কের কালির কথাও বলল। সব শোনে রাইদাহ বলল,
-‘এখন তুই কি চাইছিস?’

-‘জানতে চাই, কে এই বদনাম রটাচ্ছে।’

-‘সেজন্য তো পাত্রের সাথে তোর দেখা করতে হবে।’

-‘করব। এরপর ওই কাপুরষটাকে জুতোপেটা করব।’

-‘সাবাস। হেল্প লাগলে আমরা তো আছি-ই। এই সামান্য কারণে কেউ এত কাঁদে? কষ্ট পায়? কপালে যদি বিয়ে লেখা থাকে, সেটা নির্দিষ্ট সময়েই হবে। তারজন্য এত ভেঙে পড়লে হবে না। হ্যাঁ, বিয়ে ভাঙলে সমাজের দশজন নিন্দেমন্দ বলবে। চলতে পথে কথা শোনাবে। এটাই তো সমাজ। এটাই তো এই সমাজের দশজনের মনোভাব। দশজন কথা শোনাবে ভেবে অকারণ নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস তুই? বোকার মতো কাঁদছিস? তোর মতো সাহসী, সৎ ও সুন্দর মনের মেয়ের সাথে এই দুর্বলতাটা একদমই ম্যাচ করে না উজমা। সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল দেখা করি আমরা? আমাদের একটা প্রোগ্রাম ছিল। মনে আছে?’

-‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

মাইসারা বলল,
-‘তাহলে? কান্নাকাটি শেষ। এক্ষুণি একটু ঘুমোবি। সারাদিন নিশ্চয়ই অনেক ব্যস্ততা ছিল। এখন বিশ্রাম না নিলে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বি।’

-‘ঠিক আছে। ঘুমোব।’

রাইদাহ কল রাখার আগেই উজমা ছটফটিয়ে বলল,
-‘দুটোকে থ্যাংকস্।’

মাইসারা চোখমুখ ফুলিয়ে বলল,
-‘বন্ধুদের মধ্যে নো থ্যাংক ইউ, নো স্যরি। কথাটা মনে থাকে না তোর?’

-‘তাই তো। ভুল হয়ে গেছে। ইদানীং খুব ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছি আমি।’

-‘এবারের মতো মাফ করলাম। আর ভুল হলে পিঠের ছাল তুলে নেব।’

-‘আমার পিঠের ছাল কি সস্তাদরে কিনেছিলি যে যখন-তখন তুলে ফেলবি? পারলে তোর জামাইর পিঠের ছাল তোল।’

-‘আমার জামাই তোর বন্ধু হয় কিন্তু। বন্ধুদের নিয়ে এইসব কথা বলবি কেন রে তুই? তোর মনে কি দয়ামায়া নাই? আমার জন্য মায়া হয় না একটুও?’

-‘না ভাই। কোনো দয়ামায়া নাই। আমার ভেতরে শুধু শয়তানি আর শয়তানি।’

-‘তোর কপাল পুড়বে কিন্তু। আমার না হওয়া বাচ্চা পুড়াবে। তোকে তো সোনামা ডাকতে নিষেধ করব। বলব যে, তুই একটা ডাইনী, শাঁকচুন্নি, হিংসুটি, তোকে যেন সোনামা না ডাকে। ওর সোনামা হবে শুধু রাইদাহ।’

-‘হয়েছে, থাম। না আসা বাচ্চা নিয়ে এত ভাব নিস না।’

দু’জনের এই টুকরো টুকরো দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া শোনে ফেলল অনিক। সে মাইসারার পাশেই ছিল। আচমকাই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘এ্যাই ফোন রাখ। না আসা বাচ্চাকে পার্মানেন্টলি আনার প্ল্যানিং চলছে। তুই আর কাবাবে হাড্ডি হোস না।’

মাইসারা লজ্জায় নীরব হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু উজমাকে থামানো গেল না। সে একাধারে মাইসারাকে পঁচিয়ে গেল। ওপাশে রাইদাহ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল,

-‘মাঝরাতের এই সার্কাস কি এবার থামাবি তোরা? আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’

-‘ওকে, গুড নাইট।’

বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল উজমা। আর কথা বাড়াল না। সে কাবাবে হাড্ডি হতে রাজি ছিল না কোনোকালেই। এখনও হবে না। থাকুক ওরা নিজেদের মতো করে। বাঁচুক, হাসুক, একটু সুখ খুঁজে নিক। তার মতো দুঃখী মানুষের সাথে যোগ দিয়ে দুঃখের ভাগ বইতে গিয়ে, নিজেদেরকে কেন সুখ থেকে বঞ্চিত করবে তারা? বন্ধুরা সুখে থাক, এটা উজমার সবসময়ের প্রার্থনা। এই প্রার্থনা শুধু উপরওয়ালা শোনেন। আর কাউকে জানানো হয় না, শোনানো হয় না।

***

উসাইদের সাথে রাত বারোটা অবধি আড্ডা দেয়ার পর ফারশাদের মনে হলো, বন্ধুর ওপর জোর কাটিয়ে ফেলছে বেশি। সে দেখেছিল, মিশকাত অসুস্থ। উসাইদও এতক্ষণে অনেক কথা শেয়ার করেছে। অকারণ বন্ধুকে বিরক্ত না করে, ঘুমোনোর অজুহাতে উঠে দাঁড়াল। বলল,

-‘বাকি কথা সকালে হবে। এখন একটু বিশ্রাম নিই আমি?’

ফারশাদের উদ্দেশ্য বিশ্রাম নেয়া নয়, বন্ধুকে তার অসুস্থ স্ত্রীর পাশে পাঠানো। একটা মানুষকে জেনে-বুঝে এতক্ষণ আটকে রাখা অমানবিকতার শামিল। সে নিজেকে ছোটোখাটো ভুলচুক থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তারজন্য কেউ কষ্ট পাক, এটা সে কোনোভাবে চাইল না। উসাইদও কথা বাড়াল না। বন্ধুকে গেস্টরুমে নিয়ে গেল। বিছানা, ওয়াশরুম, ওয়ারড্রব সবকিছু দেখিয়ে, বুঝিয়ে একটা মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে বলল,

-‘কষ্ট হলে বলিস।’

ফারশাদ অবাক হয়ে বলল,
-‘কষ্ট হবে কেন?’

-‘বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত তুই। এই সাধারণ ঘরে সবকিছুতেই অসুবিধা হবে। আমার আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে, তোকে কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখার।’

-‘কাদামাটিতে কুস্তি খেলেছি একসময়। নদীতে সাঁতার কেটেছি। গাছে চড়েছি। সাতছাড়া, ফুটবল, হাডুডু, কোনো খেলা বাদ ছিল না, যা শৈশব ও কৈশোরে রপ্ত করিনি। লোডশেডিং হলে মোমবাতির আলোয় পড়াশোনা করা ছেলেকে তুই বিলাসবহুল জীবনের চাহিদা বুঝাচ্ছিস না-কি এটা বুঝাচ্ছিস যে, বন্ধুত্ব শুধু সমানে সমানে হয়?’

উসাইদ অনুশোচনার স্বরে বলল,
-‘আমি ঠিক এভাবে বলিনি, শাদ। আমি জানি তোর অভ্যাস কী, পছন্দ কী। তবে অতীত ও বর্তমান দুটোতে অনেক পার্থক্য ও সময়ের বিশাল ব্যবধান আছে, এটা তো অস্বীকার করতে পারবি না।’

-‘তা করছি না। তবে আমার কাছে আমার অতীতই সুন্দর ছিল। বর্তমান তো কালো বলপেনের আদলে তৈরী করা একটা প্রাণহীন জীবন। সকাল, বিকেল কিংবা রাত, সবটাই চলে রুটিন মেনে। এজন্য এই জীবনটা আমার এখন প্রাণহীনই মনে হয়। এই জীবনে আজকাল প্রাণের আনাগোনা আমি টেরই পাই না।’

-‘জীবন অনেককিছু মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।’

-‘জানি। একটা সময় মনে হতো, বুবুর বিয়ে হয়ে গেলে আমি অত্যাধিক সাপোর্ট, সাহস, মনোবল কোথায় পাব? নির্ঘাত চলতে পথে দশবার হোঁচট খাব। অথচ বুবুকে ছাড়া কতগুলো বছর কেটে গেল। বুবুর সহযোগিতা, ভালোবাসা ছাড়া কীভাবে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম, বুঝতেই পারলাম না। কারও অনুপস্থিতি কিংবা হারিয়ে যাওয়া, এসব ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য প্রভাব ফেললেও একটা সময় আমরা ঠিকই তাকে ছাড়া থাকতে, চলতে, মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই।’

-‘তুই বুবুকে খুব মিস করিস?’

-‘অনেক। এখনও খাবার টেবিলে বসলে মনে হয়, এইবুঝি মাথার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। ফিরতে দেরী হলো কেন, কোথায় ছিলাম, কী করছিলাম এতক্ষণ, কত-শত প্রশ্ন আর বকুনি। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না, আমার চোখের সামনে বুবু কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি রাস্তা পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলাম, তবুও কোথাও বুবুর দেখা পাইনি। বুবু এত অভিমানী কবে হলো কে জানে!’

উসাইদ বন্ধুকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল। সে নিজেও একসময় ফারিশার কাছে পড়াশোনা করেছে। বিভিন্ন সাজেশন নিয়েছে। একসাথে গল্প করেছে, আড্ডা দিয়েছে। তবুও কখনও মনে হয়নি, কেউ ভেতরে ভেতরে এত অভিমান পুষে রাখতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বন্ধুকে বলল,

-‘কষ্ট পাচ্ছিস কেন? আল্লাহ যদি চান, নিশ্চয়ই কোনো একদিন বুবুর সাথে তোর দেখা হবে।’

-‘আমি সেই আশা রাখি না এখন আর। তবে দোয়া করি, বুবু যেখানে আছে, যেভাবে আছে, আমার রব যেন তাকে সেভাবেই ভালো রাখে।’

-‘তাহলে আর কী? এখন ঘুমো। আমি যাই, কেমন?’

আলতো হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ফারশাদ। উসাইদ চলে গেল। একটুকরো কালো মেঘ ও বজ্রপাতের ধ্বনি বুকের ভেতর তুমুল গর্জন তুলে, ঝুমঝুম বৃষ্টির সাথে ভাসিয়ে নিল তাকে সীমাহীন কষ্টের স্রোতে। স্মৃতিগুলোকে মুছতে চোখ বন্ধ করে খোলা জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ। ভেতরের জ্বালা-যন্ত্রণা তবুও কমল না। একসময় হাঁসফাঁস শুরু হলো। অস্থির হয়ে গেল ফারশাদ। গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে থেমে থেমে উচ্চারণ করল,

-‘আই মিস ইউ, বুবু।’

গ্রিল ধরে আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ফারশাদ। শান্তি পেল না। অস্থির মন নিয়ে পানি খেল দু গ্লাস। এরপর রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্য খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কিছু সময় খুব কাছে থেকে সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে উপলব্ধি করা। এতে যদি মনে শান্তি নেমে আসে।

***

অসময়ে কারেন্ট চলে গেলে যে কারও বিরক্তি চলে আসে। এমনিতে চাঁদনিরাত হলেও কুয়াশার কারণে চাঁদের উজ্জ্বলতা তুলনামূলক কমই। বিরক্তি নিয়ে টোল ছাড়ল উজমা। ফোনের স্ক্রিনে চোখ ফেলতে ফেলতে সিঁড়ি ঘরের কাছে এলো। নিচে নামার আগেই ধুপধাপ পা ফেলে উপরের দিকে উঠে এলো ফারশাদ। উজমা খেয়াল করল না। সে ভীষণ তড়িঘড়ি করে এগোতে গিয়ে আচমকা ধাক্কা খেয়ে টালমাটাল অবস্থায় পড়ে গেল। হাতের ফোন ছিঁটকে পড়ল দূরে। সে-ও ধপাস করে পড়ে গেল সিঁড়ি ঘরের পাশে থাকা একগাদা কনক্রিটের ওপর। শুধু সে একা পড়ল, তা নয়। ঘূর্ণিঝড়ের মতো অদেখা আস্তো একটা বিশাল সাইজের ঝড় এসে পড়ল তার ওপর। ভূত-প্রেত জীবনেও বিশ্বাস করেনি উজমা। ভয়ও পায় না ওসবে। কিন্তু আজ তার কী হলো কে জানে! বড়ো অসময়ে ধাক্কা খেয়ে ভয়ে-আতঙ্কে দু’চোখে অমাবস্যার মতোই অন্ধকার দেখল সে। ছোটোবেলার সেই অভিশপ্ত দৃশ্য কল্পনা করে জোরেশোরে চেঁচিয়ে উঠল,

-‘ভাইয়া, বাঁচাও আমায়। কেউ আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে।’

মাঝরাত্রিরে এই চিৎকার আশেপাশের দশজন মানুষ শুনলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। সেই ভয়ে তৎক্ষনাৎ উজমার মুখের ওপর বামহাত চেপে রাখল ফারশাদ। চাপাস্বরে ধমকে উঠল,

-‘চুপ করুন। কেউ আপনাকে মারতে আসেনি। এটা আমি, ফারশাদ।’

কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের আবছা আলোতে ফারশাদের চোখদুটোকে দেখে এইমুহূর্তে দূর আকাশে চাঁদের পাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠা একটুকরো শুকতারার মতো মনে হলো উজমার। স্তব্ধ দৃষ্টি ও ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে নির্মিশেষ তাকিয়ে রইল সে। ফারশাদও তাকাল। মায়াবী চোখের ঢেউ খেলানো পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে টলটলে স্বচ্ছ পানি দেখে আলগোছে সরিয়ে নিল নিজের হাত। বলল,

-‘স্যরি। আমি খেয়াল করিনি। হুট করে কারেন্ট চলে যাওয়াতে চারপাশে অন্ধকার দেখছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি টপকে ছাদে আসতে গিয়ে…।’

অন্ধকারের মাঝেও হাতে ফুঁ দিল ফারশাদ। তড়িঘড়ি সোজা হয়ে কনক্রিটের ওপরেই বসে রইল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় এদিক-ওদিক তাকাল উজমা। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে নিজের ফোন খোঁজার চেষ্টা করল। অন্ধকারে কোথাও ফোনটা দেখা গেল না। বিরক্তিকর স্বরে কিছু আওড়ে গেল। ফারশাদ জিজ্ঞেস করল,

-‘ব্যথা পেয়েছেন?’

-‘অভ্যাস আছে।’

উজমার কথা পুরোপুরি বুঝল না ফারশাদ। বলল,
-‘কীসের অভ্যাস?’

-‘ব্যথা সয়ে নেয়ার।’

রুক্ষশুষ্ক কথাটাই বুঝিয়ে দিল, কোনো কারণে সে বিরক্ত বা আপসেট। ফারশাদ কথা বাড়াল না। হাতের তালুতে চিৎ হয়ে কনক্রিটেই শুতে চাইল সে। আচমকা ‘উহ্’ শব্দ উচ্চারণ করে ফেলল। উজমা আড়চোখে তাকাল। বুঝতেও পারল। বড়োলোকের ব্যাটার এই শহরে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে আবছা আলোয় হাতড়ে হাতড়ে নিজের ফোন খুঁজে বের করল আগে। সাইট বাটনে টিপ দিয়ে আলো জ্বেলে দেখল, উপরের গ্লাস ফেটে গেলেও ভেতরটা ঠিকঠাক আছে। নিচে আসার প্রস্তুতি নিয়ে ফারশাদকে বলল,

-‘আপনি কি এখানেই থাকবেন?’

-‘থাকি, অসুবিধা কী?’

উজমা কৌতুকের সুরে বলল,
-‘মাঝরাত্রিরে চোর-ডাকাত আসলে সামাল দিতে পারবেন?’

ফারশাদ আঁৎকে উঠে জানতে চাইল,
-‘চোর-ডাকাত আসে আপনাদের বাড়িতে?’

-‘আসে তো। শীত এসেছে। চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। যেকোনোদিন, যে কারও বাড়িতে আক্রমণ করতে পারে। অবশ্য বেশি কিছু ক্ষতি করে না। শুধু সোনাদানা, দামী জিনিসপত্র নিয়ে ভাগে। আর যাওয়ার আগে, সামনে যাকে পায় তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে যায়।’

উজমা খুব মজা নিয়ে বলছিল কথাগুলো। অন্ধকারে অভ্যস্ত হলেও অসময়ে ছাদে ফারশাদের আগমন মনের ভেতরের লুকায়িত যন্ত্রণাকে মেঘের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। মনটা একটু হালকা লাগছিল তার। সতেজ, ঝরঝরে ও ফুরফুরে। এই কারণেই একটু-আধটু রসিকতার ছলে চোর-ডাকাতের কথা বলে ডাকাতির বর্ণনা দিতে লাগল সে। ফারশাদ আতঙ্কিত মন নিয়ে শুনলেও উজমার ঠোঁটের কোণায় লুকিয়ে থাকা একখণ্ড হাসির ঝিলিককে বার বার ফিরে আসতে দেখে সে-ও পালটা রসিকতা করে বলল,

-‘আসুক ডাকাত। জীবনে অনেক মানুষের মুখোমুখি হয়েছি। কখনও চোর-ডাকাতের মুখোমুখি হইনি। এবার হব। কী সৌভাগ্য আমার!’

-‘চোর-ডাকাত দেখাও সৌভাগ্যের হয়?’

-‘হয় তো।’

ফারশাদকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেল উজমা। কয়েক সেকেন্ড ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে দু’পা হেঁটে সিঁড়ির কাছে আসতেই পিছন থেকে ফারশাদ বলল,

-‘তখন ওভাবে চিৎকার দিয়েছিলেন কেন? এটা তো আপনারই বাড়ি। এখানে আপনার ভয় কীসের?’

দাঁড়িয়ে থেকে কিছু ভাবল উজমা। পিছন ফিরে মুচকি হেসে বলল,
-‘গেস্ট হয়ে এসেছেন, গেস্টই থাকুন।’

-‘প্রশ্নটা কি অবান্তর, অযৌক্তিক? আমি কিন্তু আপনার চেহারায় ভয় দেখেছি। কাকে ভয় পাচ্ছিলেন আপনি?’

-‘কাউকে না জেনে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা অবান্তর, অযৌক্তিকই।’

কঠিন গলায় বাক্যটা উচ্চারণ করে ফোনের আলো জ্বেলে দ্রুত পায়ে নিচে নামল উজমা। ঘুমানোর আগে রান্নাঘর চেক করার অভ্যাস তার। অভ্যাসবশত সেটা করল আগে। সব দরজা-জানালা বন্ধ কি-না সেটাও দেখে নিল। নিশ্চিত হয়ে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করল। বেয়াদব ঘুমটাও আজ তার সাথে মান-অভিমান দেখাচ্ছে। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল উজমার। এরমধ্যেই দরজায় নক হলো,

-‘এ্যাক্সকিউজ মি, উজমা। আপনি কি ঘুমিয়েছেন?’

ফারশাদের গলার আওয়াজ পেয়ে আরেকদফা বিরক্তি বাড়ল উজমার। অকারণ চিৎকার-চেঁচামেচি করা তার স্বভাবে নেই। বিরক্তি থাকলেও মেহমানের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে বিছানা ছেড়ে নেমে ফোনের আলো জ্বেলে দরজা খুলে জানতে চাইল,

-‘কোনো সমস্যা?’

-‘ফাস্টএইড বক্স হবে?’

-‘কেন?’

ডানহাত উপরে তুলল ফারশাদ। ছুইয়ে ছুইয়ে রক্ত পড়ছে হাত থেকে। হতবাক চোখে তাকিয়ে উজমা বলল,
-‘ব্যথা পেলেন কী করে?’

সরাসরি উজমার চোখের দিকে তাকিয়ে ফারশাদ জবাব দিল,
-‘জানি না। একজন ভীতু মেয়ের ভয়ানক চিৎকারে হুমড়ি খেয়ে যখন কনক্রিটের ওপরে পড়ি, তখন এই হাতের ওপরে ভীতু মেয়েটা ভর দিয়েছিল। আমি জানি না ওখানে বাড়তি কিছু ছিল কি-না, তবে হাতে ভীষণ লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে কেটেও গেছে।’

লজ্জায় মাথায় হাত চলে গেল উজমার। বাড়ির মেহমানের সাথে এরূপ আচরণ! তার প্রতি এত অযত্ন! সে তো এমন নয়! নিজের এই বেখেয়ালি আচরণে ভীষণ লজ্জিত হলো উজমা। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে গিয়ে বলল,

-‘আপনি ড্রয়িংরুমে একটু বসুন, আমি দুই মিনিটে আসছি।’

তাড়াতাড়ি করে রুমে এসে ড্রেসিংটেবিলের পাশে প্রয়োজনীয় যা কিছু ছিল তা নিয়ে ড্রয়িংরুমে ছুটে এলো উজমা। একটা চার্জার লাইটের আলো জ্বালিয়ে টেবিলে রাখল। ফাস্টএইড বক্স রেখে দরকারী জিনিস বের করে বলল,

-‘হাতটা দেখি।’

নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দিল ফারশাদ। আনমনে, অপলকে তাকিয়ে রইল সামনে থাকা মায়াবী রমণীর দিকে। জীবনে অনেক মেয়ে সে দেখেছে, কিন্তু উজমার মতো এত মায়াজড়ানো মুখ আগে দেখেনি। যার প্রতিটা কাজ ও কথা, চলাফেরা ও আচরণ দেখে মিনিটে মিনিটে মুগ্ধতা শুধু বাড়ছে তো বাড়ছেই। অকারণ মনে প্রশ্ন জেগে উঠছে, এই রমণী এতদিন কোথায় ছিল? কেন আরও আগে হয়নি দেখা? উজমা খুব ধীরে ধীরে যত্ন সহকারে তুলোর সাহায্যে রক্তের দাগ মুছে নিচ্ছিল। সামান্য ব্যথা পেলেও দৃষ্টিতে মুগ্ধতা এনে সেই ব্যথা সয়ে নিচ্ছিল ফারশাদ। কয়েক মিনিট একাধারে দেখার পরও ক্লান্তি এলো না চোখে। বরং মনের চাহিদা আরও প্রগাঢ় হলো। অদ্ভুত অনুভূতিতে নেচে উঠল মন। ঠোঁটের কোণ ভরে উঠল হাসিতে। গজ বাঁধা শেষ হলে উজমা বলল,

-‘একটা প্যারাসিটামল দেব?’

দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা নেই ফারশাদের মধ্যে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-‘আপনি কি ডাক্তার?’

-‘না, আমি ডাক্তার নই।’

-‘তাহলে আমাকে প্যারাসিটামল দিতে চাইছেন কেন? মেরে ফেলতে চান? একবার রক্তাক্ত করেও স্বাদ মিটেনি দেখছি। আর কত রক্ত ঝরাতে চান আপনি?’

-‘আশ্চর্য কথা তো! আমি আপনাকে মারতে যাব কেন? আপনি কি আমার শত্রু? তাছাড়া, প্যারাসিটামল খেলে কেউ মারা যায় না-কি? হাতে ব্যথা হতে পারে, এজন্যই বলেছি।’

কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে উজমা আবারও বলল,
-‘কারও রক্তকে আমি আমার খুশির কারণ ভাবি না কোনোদিন। কেউ আমার কারণে ব্যথা পেলে তাকে সুস্থ করার দায়িত্ব তো এখন আমাকেই নিতে হবে, তাই না?’

-‘ব্যথা দিয়েছেন বলেই কি সুস্থ করতে চাইছেন?’

-‘একজন নার্সের প্রথম দায়িত্ব রোগীর সেবাযত্ন করা। তাকে সুস্থ করে তোলা। আমি শুধু সেটাই করছি।’

-‘এটা তো সামান্য ব্যথা।’

-‘ব্যথা যেমনই হোক, রক্ত তো ঝরেছে।’

উজমার কথায় যথেষ্ট রাগ মেশানো ছিল। ফারশাদ হতভম্ব হয়ে বলল,
-‘আপনি এত রেগে রেগে কথা বলছেন কেন? অসময়ে বিরক্ত করেছি দেখে?’

-‘আপনি আমাকে বিরক্ত করেননি। উলটে আমি আমার আচরণে বিরক্ত। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে কষ্ট দিতে চাইছি না। অথচ…।’

-‘ইট’স অলরাইট। ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আমরা কেউ-ই কাউকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিইনি।’

কোনো শব্দ ছাড়াই উঠে দাঁড়াল উজমা। ফাস্টএইড বক্স রুমে রেখে রান্নাঘরে এলো। নিঃশব্দে চুলোয় আগুন ধরাল। কয়েক মিনিটে একমগ ধোঁয়াওঠা গরম কফি এনে রাখল ফারশাদের সামনে। সাথে সামান্য বিস্কুট ও প্যারাসিটামল। সবকিছু রেখে গম্ভীর মেজাজে বলল,

-‘খেয়ে ঘুমোবেন। ব্যথা সেরে যাবে।’

-‘আপনি খাবেন না?’

-‘ঘুম প্রয়োজন। সকালে ডিউটি আছে।’

চলে যেতে পা বাড়াল উজমা। কী ভেবে যেন পিছু ফিরল। বলল,
-‘আপনি ভাইয়ার বন্ধু, আমাদের মেহমান। অতীতের পরিচিতি থাকলেও বর্তমানে আপনি আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ। আমি চাই না, কোনো কারণে আমাদের মেহমান অসন্তুষ্ট থাকুক, কষ্ট পাক কিংবা বিরক্ত হোক। না দেখে ব্যথা দিয়েছি বলে মাফ চাইছি। আমি খুবই দুঃখিত। আমার কারণে বিরাট ক্ষতি হলো আপনার।’

-‘আরেহ্, না না। মাফ চাইতে হবে না। ক্ষতি তো পুষিয়েই দিয়েছেন। আমার কোনো অভিযোগ নেই। মাফ তো আমার চাওয়া উচিত। অসময়ে ঘুমের বারোটা বাজিয়েছি।’

-‘অনেক রাত হয়েছে, আর দেরী করতে চাইছি না। একা একা আপনার বিরক্ত লাগলে, আপনি রুমে চলে যান। শুয়ে-বসে বিশ্রাম করুন, নয়তো ঘুমিয়ে পড়ুন। গুড নাইট।’

উজমা চলে যাওয়ার পর কৃতজ্ঞতাচিত্তে তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে নির্ভার মন নিয়ে কফিতে চুমুক দিল ফারশাদ। তৃপ্তি সহকারে সবটুকু কফি শেষ করে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। ঘুম আসবে না আজ। তবে মনে একটু প্রশান্তির হাওয়া বইছে। উত্তুরের শীতল হাওয়ার মতোন সেই হাওয়া কাঁপন ধরাচ্ছে তার অস্তিত্বে।

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – চার

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

হিমশীতল ভোরে শরীরে একটা চাদর জড়িয়ে বাড়ির বাইরের ছোট্ট রাস্তা ধরে হাঁটতে বেরিয়েছে উজমা ও ঊষা। এখনও আলো ফুটেনি ভালো করে। চারিদিক অন্ধকার। তবুও এই পরিবেশে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগছে তাদের। ওয়াহিদা জামান বেঁচে থাকতে মায়ের হাত ধরে প্রতিটি সকাল এভাবেই উপভোগ করত দুইবোন। এখনও ভোরে হাঁটে ওরা। প্রতিদিন আবছা আলোতে বেরিয়ে রোদ ওঠার পর ঘরে ফিরে। অন্যদিন হলে দুইবোন বকবক করতে কর‍তে সময়টা কাটিয়ে দেয়। আজ উজমাকে নীরব থাকতে দেখে কিছুপথ এগিয়ে বোনকে বেশ ভালোমতো দেখল ঊষা। টকটকে লাল ও ফোলা ফোলা চোখ দেখে ভীষণ ভয় পেল। জানতে চাইল,

-‘রাতে ঘুমোওনি আপু?’

জীবন থেকে অনেকগুলো অধ্যায় হারিয়ে গেলেও পিছনে ফেলে আসা সুক্ষ্ম ব্যথাটা আজও আগের মতো গেঁথে আছে বুকে। অল্প বয়স ছিল বলে, সেদিন সে বুঝেনি কী তুফান গিয়েছিল উপর দিয়ে। যত বড়ো হয়েছে, বিবেক তাকে বুঝিয়েছে, তার সাথে ঠিক কী হয়েছে। সেদিনের সেই করুণ দৃশ্য যতবার চোখে ভাসে, যতবার মনে উঁকিঝুঁকি মারে, ততবারই ঘুম পালিয়ে যায়। ডুকরে কেঁদে উঠে মন। অস্থির, অশান্ত মন নিয়েই আল্লাহর নিকট জানতে চায়, সেদিন তার ভুল কোথায় ছিল? সে তো শুধু সত্য বলেছিল। যা সে দেখেছিল, যা শুনেছিল, তা-ই প্রকাশ করেছিল। এখানে ভুল কি তার? তবে বড়ো হওয়ার পর একটা কথা সে খুব করে বুঝে গেছে। সবসময় সত্য প্রকাশ করতে নেই। মাঝেমধ্যে চোখের দেখা ও জানাটাকে ভুল বলে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। এতে করে কিছু অন্যায় দামাচাপা পড়ার পাশাপাশি, কারও শত্রু হওয়ার হাত থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়া যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনা যে তার জীবনের হাসি কেড়ে নিবে, সেটা তো সে আগে বুঝেনি। মন খারাপের কারণে পুরনো স্মৃতি মনে করে সারারাত নীরব কান্নায় গাল ভাসিয়েছে উজমা। এখনও এসবই ভাবছিল। বোনের গলার স্বর শোনে আলতোস্বরে বলল,

-‘ঘুমিয়েছি তো। কেন?’

-‘তোমার চোখমুখ ফোলা আপু। বিয়ে ভেঙেছে বলে খুব বেশি কেঁদেছ?’

-‘আমাকে তোর এত দুর্বল মনে হয়?’

-‘ঠিক তা নয়, আপু। তোমাকে কষ্ট পেতে দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। কান্না পায়। আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি তোমার সব কষ্ট মুছে দিতাম।’

সমবয়সী না হলেও ছোটোবোনের এই আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে গেল উজমার। হাতে-হাত রেখে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল তারা। শিশিরভেজা ঘাসের বুকে পা ছড়িয়ে বসে উজমা বলল,

-‘মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, আমাদের নিজস্ব একটা বাড়ি হবে। খুব বেশি সম্পদ না হলেও একটু সচ্ছল হয়ে উঠব। বাবা সুস্থ হবে। ভাইয়া সংসারের হাল ধরবে। আমি ডাক্তার হব। আর তুই, একটা চঞ্চল প্রজাপতি হয়ে আমাদের সবার চোখের মণি হয়ে থাকবি। মা খুব চেষ্টা করছিলেন, সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার। একা হাতে কতটুকু আর পারা যায়? তবুও সংসার চলছিল। বাবার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে বড়ো চাচা যে নির্মম আঘাত চালিয়েছিলেন সেদিন, ওইদিনের পর মা মন থেকে ভেঙে পড়েছিলেন একদম। আমি এতটাই ছোটো যে, কিছুই বুঝতাম না। শুধু লুকিয়ে মায়ের কান্না দেখতাম। বাড়ি ছেড়ে যখন ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করি, বাবার অসুস্থতা আরও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বাবাকে সুস্থ করতে গিয়ে নিজের জমানো সব সঞ্চয় মা শেষ করে ফেলেন। জায়গাসম্পত্তি যা ছিল, সবকিছু তো চাচাদের দখলে চলে গেল। মা-ও তখন একটু একটু করে ভেঙে গুড়িয়ে যেতে শুরু করলেন। একটা সময় কাউকে কিছু না বলেই মৃত্যুকে আপন করে নিলেন।’

বোনের কথা শুনতে শুনতে চোখে পানি জমা হলো ঊষার। বলল,
-‘চাচারা এমন কেন করলেন?’

-‘বাবার অসুস্থতার জন্য। তাছাড়া বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিল। বড়ো চাচা ভেবেছিলেন, মা বাবাকে ভুল বুঝিয়ে তাদের থেকে আলাদা করে দিবেন। সব সম্পদ কেড়ে নিবেন। সব চাচিদের চেয়ে মা ছিলেন শিক্ষিতা, আধুনিকা। তারা সবাই ভয় পেয়েছিল ভীষণ। বাবার অসুস্থতাকে কাজে লাগিয়ে সবকিছু নিজেদের দখলে নেয়ার পর আমাদের সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।’

-‘বাবা কিছু বলেননি?’

-‘বাবা সুস্থ মস্তিষ্কের হলে তবে তো বলবেন? ওনার কোনো জ্ঞানই ছিল না। কবে, কখন, কীভাবে উনি দলিলপত্রে সাইন করেছেন, সেটাও বাবা জানেন না। একটা মানুষের অসুস্থতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চাচারা আমাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছেন।’

আনমনা উজমা ম্লান হেসে সুর্যোদয় দেখবে বলে আকাশপানে তাকিয়ে রইল। ঊষা নিশ্চুপে বোনকে দেখে বলল,
-‘ওনারা কোনোদিন আমাদের খোঁজ নেননি?’

-‘এতে ঝামেলা বাড়ত বৈ কমত না, ঊষা। কেউ-ই খাল কেটে কুমির টেনে নিতে চায় না। ওদের জন্য আমরা বিপজ্জনক সবসময়।’

-‘তাইবলে নিজেদের অধিকার ও সম্পদ থেকে আমরা বঞ্চিত থাকব?’

-‘ভাইয়া চেষ্টা করেছিল। মায়ের মৃত্যুর পর, আমাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে যখন টাকার প্রয়োজন পড়ে, তখন গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল, চাচারা সেই সুযোগে ভাইয়াকে অনেক অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কোনো উপায় না পেয়েই তো ভাইয়া সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়েছিল। টাকার অভাবে আমাদের কারও কোনো স্বপ্ন হয়তো পূরণ হয়নি, তবে বাবা-মায়ের ভালোবাসা, সাপোর্ট-সহযোগিতা আমাদের জীবনের অনেক দুঃখকে দূর করে দিয়েছে।’

-‘ভাইয়া আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে, তাই না?’

-‘হুম। এখনও করছে। এইযে, বার বার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে এতে ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে। অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। ভাবীও অসুস্থ। কাউকে কিছু না বললেও আমি জানি ভাইয়া কতটা চাপে আছে। ভাইয়ার কথা ভেবেই আমার খারাপ লাগছে বেশি।’

কিছুক্ষণ চুপ রইল ঊষা। বড়ো বোনকে কথাটা জিজ্ঞেস করা অনুচিত হবে জেনেও অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বলে ফেলল,
-‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমায়?’

মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে তাকাল উজমা। ঊষা তাতেই ভয় পেয়ে গেল। নিজের গাল নিজেই চুলকাল। তারপর থেমে থেমে বলল,

-‘তোমার সব বন্ধুরা, আই মিন সারাপু, রাইদাহ আপু, অনিক ভাইয়া, কাইফ ভাইয়া, তাক্বদীম ভাইয়া, সবাই-ই প্রেমট্রেম করে বিয়েশাদী করে নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছে। অথচ তুমি কোনোদিন, কখনও কাউকে ভালোবাসোনি। কেন আপু?’

শেষ কথাটুকু মিনমিনিয়ে জানতে চাইল ঊষা। উজমা ঠোঁট চেপে হাসল। বোনের মাথার হুডি নামিয়ে চুলের গোড়ায় টান দিয়ে বলল,
-‘আমার কথা জেনে কী করবি? তুই কখনও কাউকে ভালো বেসেছিস?’

-‘ছিঃ, না। আমি ওসবে নাই।’

-‘আমিও ওসবে নাই।’

-‘কেন? তোমার বন্ধুরা প্রেম করতে জানে আর তুমি জানো না? দূর তুমি খুব বোরিং, আনরোমান্টিক একটা মেয়ে। তোমাকে যে পাবে, তার কপাল নিশ্চিত পুড়বে।’

-‘পুড়লে পুড়বে, আমার কী? পুড়ে ছাঁই হয়ে যাক, তাতেও আমার সমস্যা নেই।’

-‘কার কপাল যে পুড়বে, সেই ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার।’

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল উজমা। ঊষা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-‘হাসছ কেন? এত হেসো না আপু। হাসলে তোমাকে এত মায়াবী লাগে। যে কেউ দেখলে এই হাসির প্রেমে পড়ে যাবে।’

এতে উজমার হাসি আরও বিস্তৃত হলো। সে হাসতে হাসতে বলল,
-‘সিরিয়াসলি বলছিস?’

-‘হ্যাঁ, একদম।’

-‘সাতাশ পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ এখন পর্যন্ত কেউ এই হাসির প্রেমে পড়ে বলল না, এমন করে হেসো না মেয়ে। দিলে টান লাগে।’

উচ্চস্বরে হেসে উঠল উজমা ও ঊষা। কেউ-ই টের পেল না, অসময়ে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালকে উপভোগ করতে তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল ফারশাদ। ভোরের টিমটিমে আলো ও হিমশীতল বাতাসের ফাঁকে ওই মায়াজড়ানো হাসি দেখে থমকে গেল তার সময়, দৃষ্টি, মন। রাতের সুন্দর সময়টাকে স্মরণ করে একটুকরো হাসি ফুটাল ঠোঁটে। পাশাপাশি শীতের এই মিষ্টি অথচ চমৎকার সকালটার জন্য আপনমনেই স্রষ্টার নিকট শুকরিয়া আদায় করে বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘শুধু আজ নয়, আমার জীবনের প্রতিটি সুর্যোদয় ও সুর্যাস্তকে আপনার নামে কবুল করে নিন উজমা। প্রতিটি রোদ ঝলমল হাসি ও অশ্রুভেজা আঁখির দ্বারা আমার অশান্ত হৃদয়ের প্রশান্তি হয়ে উঠুন আপনি। আজ এই শিশিরভেজা ঘাস, ভোরের রক্তিম সূর্য, এই মেঠোপথ, ঘাসপাতা, ফুল-পাখি ও বিশাল ওই আকাশকে সাক্ষী রেখে আপনাকে আমার হৃদয় সিংহাসনের রানী হিসেবে কবুল করে নিলাম। এই জীবন ও এই হৃদয়ের আধিপত্য এই মুহূর্ত থেকে সানন্দে, স্বেচ্ছায় আপনার হাতে তুলে দিলাম আমি।’

হৃদয়ের অনুভূতি নিঃশব্দে, নিজের মনের সাথে যত সহজে আদান-প্রদান করা যায়, তত সহজে মুখফুটে বলা হয়ে ওঠে না। নিজের সবটুকু আবেগকে ঝটপট নিয়ন্ত্রণ করে নিল ফারশাদ। বলল,

-‘গুড মর্নিং, ঊষা।’

ঊষার চঞ্চলতা মন কেড়েছে ফারশাদের। ভাব জমেছেও বেশ। তাকে সবসময় ছটফটে ও দূরন্ত মনে হয়। হাসি হাসি চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একরাশ মায়াবী গুণাবলীর কারণে যে কেউ খুব সহজেই আপন করে নিবে এই মেয়েটাকে। যে কারও মনে জায়গা করে নিবে অতি দ্রুত। ছোট্ট এই ঊষাকে তার নিজের বোনের মতোই আপন মনে হয় তার। ঠিক যেন ছোট্ট আরেকটা ফাবিহা এটা। এই আদর আদর চেহারার মেয়েটা তার কণ্ঠ শোনে চমকে গিয়ে পিছনে ফিরল। বিস্ময় নিয়ে বলল,

-‘গুড মর্নিং। আপনি এখানে? তা-ও এত সকালে! ঘুম হয়নি নিশ্চয়ই!’

-‘আরেহ্, না। ঘুম তো হয়েছেই। ভোরে এ্যাক্সারসাইজ করার অভ্যাস। এখানে তো প্রয়োজনীয় কোনোকিছু নিয়ে আসা হয়নি। তাই ভাবলাম, সকালের এই পরিবেশটা উপভোগ করি। অনেকদিন পর সকালটাকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। কোথাও কোনো ফাঁক নেই। এরকম পরিপূর্ণ একটা সকালকে সারাজীবন আঁকড়ে থাকার খুব শখ আমার।’

-‘তাই? কেন?’

-‘একটা বিকেল, একটা রাত ও একটা সকালের বিনিময়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে দামী একটা সম্পদকে খুঁজে পেয়েছি, ঊষা। বলতে পারো, কিছু একটার কমতি ছিল জীবনে। সেই কমতিটা এখন আর নেই।’

-‘ও, তাহলে তো খুবই ভালো।’

-‘তোমাদের এই এলাকাটা ভীষণ সুন্দর। আমার তো খুব মনে ধরেছে। ইচ্ছে করছে গোটা একটা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিই।’

মিষ্টি হেসে ফারশাদের সাথে গল্প জমাল ঊষা। তবে উজমা খুব বিব্রতবোধ করল। এই অসময়ে, নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্তে ফারশাদকে একদমই আশা করেনি উজমা। কিছুটা বিরক্তি অনুভব করল সে। ঘাসের বুক থেকে ঝটপট উঠে দাঁড়াল। হাত পরিষ্কার করে, চাদর গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-‘দেরী হচ্ছে, ঊষা। ফেরা যাক এখুনি?’

ঊষাও সম্মতি জানিয়ে বলল,
-‘ঠিক আছে। এগোও।’

তারপর ফারশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আপনি কি আরেকটু হাঁটবেন না-কি বাড়ি ফিরবেন?’

-‘আমি একটু পর আসছি।’

উজমা ও ঊষা বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলে, ফারশাদ দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটাল, নীরবে, একান্তে। মনের ভেতর সদ্য জন্ম নেয়া অদৃশ্য অথচ গভীর অনুভূতিকে আগলে নিয়ে আওড়ে গেল,

-‘প্রেম-ভালোবাসা কার জীবনে কীভাবে আসে আমি জানি না, উজমা। কে, কী দেখে, কেন, কী কারণে, কার প্রেমে পড়ে এসবের ব্যাখ্যাও জানা নেই আমার। আমি শুধু জানি, আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে, আমি আপনাকে ভালোবাসি।’

তারপর ওই জ্বলন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
-‘ইউ আর দ্য লাইট অব মাই ডার্ক ওয়ার্ল্ড।’

হেমন্তকাল শেষ হওয়ার পথে। এই সময় গ্রামের জমিগুলোতে বেড়ে ওঠা পাকা ধান ঘরে তোলার উৎসব চলে। ঘরে ঘরে নতুন ধান মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষকেরা। ফারশাদ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা পিচঢালা রাস্তা হলেও তার ডানে-বামে বিস্তৃত আছে ফসলি জমি। পাকা ধানের শীষে সোনালী রোদ্দুর উঁকিঝুঁকি মারছে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা জড়িয়ে কৃষকের মুখের মায়াভরা হাসি দেখতে দেখতে বেশ খানিকটা সময় এখানেই অতিবাহিত করল সে। ছোটোবেলার নানান দৃশ্য চোখে ভাসল। ঠিক কতক্ষণ যে পেরিয়ে গেল, টের পেল না ফারশাদ। একটা সময় শব্দ করে বেজে উঠল ফোন। উসাইদ ফোন করছে দেখে তড়িঘড়ি রওনা দিল বাড়ির দিকে।

***

উসমান ওয়াজেদকে কোনোপ্রকার টেনশনে পড়তে দেয় না উসাইদ। যা কিছু ঝামেলা, বিপদ-আপদ আসে, সব সে একা হাতেই সামলে নেয়। পরিবারের বড়ো ছেলে হওয়ার সুবাদে দুই বোন ও বাবার জন্য অনেক স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছিল তাকে। অনেক ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে সবার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ওয়াহিদা জামান মারা যাওয়ার পর থেকে তার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছু হয়ে যায় দুইবোনকে মানুষের মতো মানুষ করা। তাদেরকে পড়াশোনা করানো আর উপযুক্ত বয়সে সৎ পাত্রস্থ করা। সেই লক্ষ্যেই নিজের চিন্তাভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছিল উসাইদ। একটু একটু করে সঞ্চয় করে উকিল ধরে বোনের জন্য ভালো পাত্রের খোঁজ করছিল। একটা সময় পাত্রের খোঁজ পেয়েছিল সে। সবকিছু দেখাশোনা শেষে বিয়ের কথাও পাকাপোক্ত হয়। দিনতারিখ ঠিক হয়। বিয়ের আর কয়েকদিন বাকি অথচ ওই মুহূর্তেই সব আয়োজনে বাঁধা পড়ে যায় উড়ে আসা ঝড়ের কারণে। তিন তিনবার বিয়ে ভাঙার পর উসাইদ এবার কিছুটা ভয়েই আছে। বোনের সম্মান ও তার জীবন থমকে যাওয়ার চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকে সারাক্ষণ।

গতকাল থেকে তার মনের ওপর দিয়ে যে ঝড় যাচ্ছে, সেই ঝড়ের মাত্রা কেউ না বুঝলেও মিশকাত ঠিকই বুঝতে পারছে। নাশতার টেবিলে স্বামীকে আনমনা ও বিষণ্ণ হয়ে থাকতে দেখে পাশের চেয়ারে বসে হাতের ওপর হাত রেখে জানতে চাইল,

-‘এত কী ভাবছ তুমি?’

উসাইদ জবাব না দিয়ে উজমার দিকে তাকাল। মেয়েটা নিশিন্তমনে ঘরের কাজ করছে। বোনকে এত নির্ভার দেখে বিষণ্ণ কণ্ঠেই বলল,

-‘ওর কি একটুও খারাপ লাগছে না?’

মিশকাত নিজের ননদিনীকে একনজর দেখল। ম্লানমুখে বলল,
-‘খারাপ লাগলেও ও সেটা তোমাকে বুঝতে দেবে না।’

-‘এসব কে করছে, কিছু কি বুঝতে পারছ তুমি?’

-‘ওর তো কারও সাথে শত্রুতা নেই। কে করবে এসব? কাকেই বা সন্দেহ করব আমরা? যদি কোনো রিলেশনে জড়িয়ে কাউকে ছ্যাঁকা দিত, তবে বোঝা যেত, ওর শত্রু জন্মেছে।’

-‘তোমার কি ধারণা, ও প্রেমট্রেম করছে না?’

-‘তোমার বোনকে তুমি আমার চেয়েও ভালো চিনো। নিজের কথা ভাবার আগে পরিবারের সবার কথা দশবার ভাববে। যদি রিলেশনে জড়াত, নিশ্চয়ই আমার আগে তুমি টের পেতে।’

-‘ওর সাথে যা হচ্ছে, সেটা কি ও ডিজার্ভ করে?’

-‘সবটাই হয়তো ভাগ্য।’

-‘আমি সবকিছু ভাগ্যের ওপর ছাড়তে পারছি না, মিশকা। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, কেউ ইচ্ছে করে ওর নামে বদনাম রটাতে চাইছে, যেন ওর কোনোদিন বিয়ে না হয়।’

দু’জনের কথা বলার মাঝখানেই পাশে এসে দাঁড়াল ফারশাদ। আচমকাই বলে উঠল,
-‘কার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে?’

মিশকাত মিষ্টি হেসে বলল,
-‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন ভাই? আপনার বন্ধু অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। নিন, বসুন। আমি নাশতা পাঠাই।’

ভারী শরীর নিয়ে হাঁটাহাঁটি করাও কষ্ট। কোনোমতে পা টেনে টেনে রান্নাঘর পর্যন্ত এগোলো মিশকাত। বলল,
-‘তোর তো দেরী হয়ে যাবে। দেখি, সর। আমি হাতে হাতে করে দিচ্ছি।’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে তাকাল উজমা। ভয় ভয় সেই দৃষ্টি দেখে হেসে ফেলল মিশকাত। বলল,
-‘এই দৃষ্টি মোটেও ভয় পাই না আমি।’

-‘তুমি যাও তো। বিশ্রাম নাও। আমি করে নিচ্ছি।’

ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ তৈরী হয়েছে ঊষা। একেবারে বোরখা পরে হিজাব পেঁচিয়েই এসেছে সে। দু’জনকে একসাথে বকবক করতে দেখে বলল,

-‘আমাকে রেখে খাওয়া হয়ে যাচ্ছে?’

মিশকাত দুষ্টুমিভরা কণ্ঠে বলল,
-‘নারে সখী। তোকে রেখে খাবার কি আমার পেটে হজম হবে? ওটা তো গলা দিয়ে ঢুকবে না। মাঝপথেই আটকে যাবে।’

ট্রে-ভরা নাশতা তৈরী করে ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো উজমা। নাশতা পরিবেশন করে বলল,
-‘আমার আজ ফিরতে একটু দেরী হবে, ভাইয়া। খুব বেশি দেরী হলে দুঃশ্চিন্তা কোরো না। আমি বন্ধুদের সাথে থাকব।’

ফারশাদ সামনে থাকায় বড্ড অস্বস্তি নিয়ে কথাগুলো বলল উজমা। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ভাইকে দুঃশ্চিন্তামুক্ত রাখাই তার উদ্দেশ্য। এজন্যই বলা। বোনের কথা শোনে উসাইদ বলল,

-‘আজ না গেলে হয় না?’

-‘কেন ভাইয়া?’

-‘না মানে…।’

উজমা জানে, আজ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলেও তাকে কিছু কটুবাক্য হজম করতে হবে। যা আগেও হয়ে এসেছে। বার বার নিজের দিকে কাদা ছোঁড়াছুড়ির এই জঘন্য দৃশ্যটা হজম করা কষ্টরই তার জন্য। ভাই তার কষ্ট বুঝেই চেয়েছে, বোন যেন আজ বাড়ি থেকে বের না হয়। এতক্ষণে পাশের বাড়ির উকিল চাচা নিশ্চয়ই দশজনকে দশকথা বলে ফেলেছেন। সেই দশকথা এখন বোনের জন্য যন্ত্রণাদায়কই। সে ভাইয়ের মন বুঝতে পেরে বলল,

-‘চিন্তা কোরো না। আমি সব সামলে নেব। এত সহজে আমি ভেঙে পড়ব না, ভাইয়া।’

-‘কিন্তু দশজনকে কী বলব?’

-‘তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আগে আমি কোর্টে যাই…।’

উসাইদ ভয় পেয়ে বলল,
-‘তোর ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।’

-‘ওই লোকটা একটা কাপুরষ, ভাইয়া। এমন কাপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া অপমান আমি এত সহজে হজম করব না। ওরা সবাই আছে আমার সাথে। থাকবেও।’

-‘ব্যাপারটা কেমন দেখায়!’

-‘চুপ করে কোনো অন্যায় আমি কখনওই মেনে নিব না, ভাইয়া। নিজের চরিত্রে একফোঁটা কলঙ্কও সহ্য করব না। প্রয়োজনে আমি কতটা কঠিন হতে পারি, সেটা তুমি জানো। এরমূল্য অবশ্যই ওই অ্যাডভোকেট দিবে।’

এখানে তার আর কথা বলা সাজে না ভেবে চুপ করে গেল উসাইদ। ভাই-বোনের সব কথা মাথার ওপর দিয়ে গেল ফারশাদের। নাশতা না খেয়েই হাত গুটিয়ে বসে রইল সে। উজমা চলে যাওয়ার পর উসাইদ ধীরস্থিরভাবে বন্ধুকে বলল,

-‘ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আগামী সপ্তাহে বিয়ে হওয়ার কথা। গতকাল পাত্রের বাবা-মা জানিয়েছে, আমার বোন খারাপ, ওর চরিত্রে দোষ আছে। তাই এই বিয়েটা আর হচ্ছে না।’

মনের ভেতর কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস টের পেল ফারশাদ। নিঃশব্দে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল। উসাইদ আবারও মনমরা কণ্ঠে বলল,

-‘আমার বোনকে আমি খুব ভালো করে চিনি, শাদ। বাড়ির বাইরে এক’পা দিতে গেলে আমার অনুমতি নিয়ে বেরোয়। বাইরে দেরী হলে, কেন দেরী হলো তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যাও দেয়। কখনও, অকারণে কারও পিছনে দশমিনিট সময় নষ্ট করে না ও। যে বোন চলতে পথে এত সচেতন। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে যার দিনের শুরু ও শেষ হয়, পরিবারের সবার জন্য ব্যয় করতে গিয়ে যে বোন অল্পবয়সে উপার্জনের পথে নেমেছে, তার চরিত্রে এই কলঙ্ক আমি মেনে নিতে পারছি না। ইচ্ছে করছে ওই স্টুপিডটাকে ইচ্ছামতো বকে আসি। আমার নিষ্পাপ বোনের ওপর এত বড়ো অপমান কী করে সহ্য করি?’

বন্ধুর মুখ থেকে এরূপ কথা শোনে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেল ফারশাদ। ভাবতেই পারল না সে, উজমার বিয়ে ঠিকঠাক ছিল, সেটা আবার ভেঙে গেছে। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-‘ছেলে কী করে?’

-‘কোর্টে জব করে।’

-‘বিয়ে কবে ঠিক হয়েছিল?’

-‘পনেরোদিন আগে।’

-‘এরমধ্যে উজমার ওই ছেলেটার সাথে কথাবার্তা হয়েছে?’

-‘হওয়ার কথা। আমি-ই নম্বর আদানপ্রদান করেছি। যেহেতু বিয়ে ঠিকঠাক ছিল।’

টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে কপাল হাত রেখে দুঃশ্চিন্তায় ডুবে গেল ফারশাদ। মনে অকারণ ভয়, সন্দেহ শুরু হলো। নম্বর যেহেতু আদান-প্রদান হয়ে গেছে, এতদিনের কথাবার্তায় উজমা হয়তো ওই অ্যাডভোকেটের প্রতি সামান্য হলেও দুর্বল হয়েছে। নয়তো আজ কোর্টে যেতে চাইল কেন মেয়েটা? বিয়ে ভেঙেছে, এখানেই তো সব থামিয়ে দেয়া উচিত। কোন লেনাদেনার পিছনে ছুটল মেয়েটা? মন হারিয়ে ফেলল কী? এমন হলে তার কী হবে? সে বিরক্তিকর মেজাজ নিয়েই বলল,

-‘ভালোই হয়েছে বিয়ে ভেঙেছে।’

-‘কী বললি? ভালো হয়েছে?’

খানিকটা শক্তকণ্ঠে প্রশ্ন সুধাল উসাইদ। ফারশাদ থতমত খেয়ে গেল। নিজের মনের গোপন ভাবনাকে এলোমেলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে কথা ঘুরিয়ে জবাব দিল,

-‘হ্যাঁ, ভালো। খুব ভালো হয়েছে। ছেলেটার নিশ্চয়ই সন্দেহের বাতিক আছে।’

-‘যেমন?’

-‘ধর, বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পর সে জানল, বউয়ের চরিত্রে দোষ আছে। তখন কী হতো? ঝগড়াঝাটি, দাঙ্গাহাঙ্গামা, পরিশেষে ডিভোর্স। এই ডিভোর্সি তকমা লাগার আগে উজমার জীবন বেঁচে গেছে। এটা কি ভালো নয়?’

উসাইদ ভেবে দেখল, বন্ধুর কথায় যুক্তি আছে। বিয়ের পর এরূপ হলে, সংসারে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। এসব মানসিক যন্ত্রণায় পড়তে হয়নি বোনকে, এরজন্য আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করল। বলল,

-‘ঠিকই বলেছিস। কিন্তু এখন উপায়? মানসম্মান তো যাবে। তাছাড়া এটা মিথ্যে অপবাদ।’

-‘দূর, খামোখা ঘাবড়াচ্ছিস। এসব অপবাদে কী আসে যায়? বিয়ে ভাঙতে মানুষ কত নাটক সাজায়। এটা নিশ্চয়ই নাটকেরই একটা অংশ। কপালে বিয়ে থাকলে ওটা আপনা-আপনিই হয়ে যাবে।’

-‘বিয়ে আপনা-আপনি হয় না, ভাই। এসবের জন্য দৌড়া লাগে।’

-‘আরেহ্, আর দৌড়াতে হবে না। সময় হলে পাত্র ঠিক পেয়ে যাবি।’

-‘মাথা খারাপ তোর? আগামী সপ্তাহে বিয়ের তারিখ পাকা হয়েছিল। মেহমানদের দাওয়াত দেয়া শেষ। এখন যদি বিয়েটা নাহয়, কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এরমধ্যে পাত্র কি উড়েউড়ে আসবে?’

-‘আহা, টেনশন নিতে মানা করেছি না? কেন টেনশন নিচ্ছিস?’

-‘তুই বুঝবি না। এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো পাত্র আমি পাব না।’

ফারশাদের খুব রাগ হলো। রাগের ঠেলায় চিবিয়ে চিবিয়ে তাকাল বন্ধুর দিকে। গপাগপ নাশতা গিলে, ডগডগ করে দুই গ্লাস পানি খেল। বিড়বিড় করে উঠে দাঁড়িয়ে রুমে যেতে যেতে বলল,

-‘শালার বন্ধু, চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস। আমাকে কেন তোর চোখে পড়ে না? কেন বলছিস না, তুই আমার বোনের লাইফ পার্টনার হয়ে যা। আরেহ্ শালা, আমি থাকতে তোর এত চিন্তা কীসের, বোঝা আমাকে? বোন জামাই হিসেবে আমাকে কি খুব বেশি বেমানান লাগবে? আশ্চর্য!’

***

চলবে…