মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-৩৩+৩৪

0
57

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – তেত্রিশ ( মেহেদীসন্ধ্যা)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

রাত পোহালেই একটা নতুন জীবনের সাথে পরিচয় ঘটবে, অথচ সেই জীবনের শুরুতে বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে কোনোরূপ দোয়া পাওয়া যাবে না, এমনটা ভাবলেই প্রতিটা নিঃশ্বাসজুড়ে ভয়ানক রকমের অসহায়ত্ব নেমে আসে ফারশাদের। গত দু’দিন ধরে কাছের আত্মীয়স্বজন ও ভাই-বোনদের হৈচৈ, বিয়ে নিয়ে একটা আনন্দোৎসব শুরু হলেও এতসব আয়োজন ছিঁটেফোঁটা সুখ দিচ্ছে না তাকে। কেবলই একটা শূণ্যতা, একটা চাপা কষ্ট বুকজুড়ে বিরাজ করছে। শৈশব থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত হেঁটে আসার প্রতিটা সময়, স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে। সফলতা, ব্যর্থতা সবকিছুতেই সে একা ছিল বলে বিয়েতেও একা, এইটুকু তার অন্তরকে সীমাহীন যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছে। বার বার মন কেঁদে উঠে বিড়বিড়াচ্ছে, ‘কেন এমন হলো?’

ফারশাদ নিজের বিয়েতে বেশি জাঁকজমক বা বাড়াবাড়ি কিছু করতে চায়নি, তাই ভাই-বোনেরা অতিরিক্ত কোনোকিছুরই আয়োজন করেনি। ছোটোখাটো ও খুব সাদামাটাভাবে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েছে সবাই। বাড়ির বিশাল ছাদের একপাশে রঙবেরঙের ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে। কিছু লাইটিং করা হয়েছে। ডিএসএলআর ক্যামেরা আনা হয়েছে। এতটুকুই। সবকিছু সাজানো-গোছানো শেষে ফারশাদকে ডাকতে এলো চাচাতো ভাই নাইমুর। দরজায় নক দিয়ে বলল,

-‘ভাইয়া, সবকিছু রেডি, তাড়াতাড়ি এসো।’

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দরজার দিকে দৃষ্টি ফেরাল ফারশাদ। ভাইকে ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে বলল,
-‘সবাই তৈরী?’

-‘হ্যাঁ, সবাই তোমার অপেক্ষা করছে।’

কথার ফাঁকে ভাইয়ের দিকে একবার চোখ রাখল নাইমুর। সরষেরঙা পাঞ্জাবী ও সাদা পায়জামাতে ভাইকে দেখে প্রসংশাভরা কণ্ঠে বলল,
-‘জোস্, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। ভাবী, ফিদা হয়ে যাবে। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বোলো তো।’

নিজের সাজপোশাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফারশাদ বলল,
-‘কী?’

-‘মেয়ে পটানো শিখলে কী করে, তুমি?’

-‘তোর কী ধারণা আমি তাকে পটিয়েছি?’

-‘না, তুমি যা স্মার্ট তাতে তোমাকে দেখে যে কেউ দিনে দশবার হোঁচট খাবে। ভাবীও নিশ্চয়ই…।’

-‘তোর ধারণা ভুল। আমি তাকে পটাইনি, সে-ও আমাকে পটায়নি। আর আমরা কোনো বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে একজন অন্যজনের প্রেমে পড়িনি, ভালোবাসিনি। আমরা একে-অন্যকে চিনেছি, ভালোবেসেছি অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও গুণাবলী দেখে।’

নাইমুর আগ্রহীচিত্তে তাকিয়ে থেকে বলল,
-‘লাভস্টোরিটা শোনাবে?’

-‘এখন সময় নেই, পরে একসময় শোনাব। শোন, কাল বিয়েতে তোরা যারা ওর আর আমার ছবি তুলবি, কোনো ছবিই সোশ্যাল মিডিয়ায় দিবি না। একটা ছবি শুধু আমার অফিসিয়াল পেইজ থেকে দেব, যেটা কেবলই দুটো হাতের হবে। মনে থাকবে?’

-‘ওকে বস। এখন চলো। দেরী হচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে আবার তোমাকে মেহেদী পরাতে হবে। কুইক…।’

ফোনের স্ক্রিনে টুপ করে আলো জ্বলে উঠলে ফারশাদ চকিতে সেদিকে নজর দিয়ে দেখল, অচেনা একটা নম্বর থেকে ম্যাসেজ এসেছে। লক খুলে ম্যাসেজে চোখ বুলালো, ‘আমি খুব দুঃখিত শাদ, তোর জীবনের এমন একটা দিনে উপস্থিত থাকতে পারছি না বলে। হিসেব অনুযায়ী আজ তানজীম ও ঊষারও গায়েহলুদ। বড়ো বোন হিসেবে তোর প্রতি আমার যেমন দায়িত্ব থাকার কথা, বড়ো ভাবী হিসেবে তানজীমের প্রতিও আমার একটা দায়িত্ব আছে এখানে। ইচ্ছে থাকলেও কিছু দায়িত্বকে অবহেলা করা যায় না। তোদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে বরাবরই অপারগ আমি। জেনে-বুঝে স্বেচ্ছায় কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম। তার মানে এই না যে, তোদের প্রতি আমার ভালোবাসা নেই, দোয়া নেই। সবই আছে। একটা জীবনে, বাবা-মায়ের চেয়ে আমি তোদেরকেই বেশি ভালোবাসি। আপন মানুষদের ছেড়ে প্রতিনিয়ত দূরে থাকা, তাদের না দেখে থাকার মতো যন্ত্রণার মতো কঠিন যন্ত্রণা আর কীসে আছে বল? দিনশেষে আমাকে তোদের সবাইকে ছেড়ে থাকতে হয়েছে। যদিও এই পথটা আমি নিজের ইচ্ছেতেই বেছে নিয়েছিলাম। লোকের চোখে ভালো হোক কি মন্দ, আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটাই ছিল, তাহমীদের হাত ধরে আপনজনদের ত্যাগ করা। যাই হোক, কাল তো সিলেট আসবি। যদি সময় করতে পারিস, যদি ইচ্ছে হয়, যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারিস, তাহলে এই ঠিকানায় একবার আসিস।’

এরপরই নিচে একটা ঠিকানা লেখা আর লেখা, তোর বুবু।

***

কনের বাড়িতে সন্ধ্যে থেকে হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। যদিও এই হলুদের আয়োজন বাড়িতে নয়, রিসোর্টে হচ্ছে, বিয়েটাও সেখানেই হবে, এজন্য কনেপক্ষের আত্মীয়স্বজন দু’দিন যাবৎ রিসোর্টেই আছে। মিশকাত, ওসমান ওয়াজেদ ছোট্ট মাশিয়াত ও মিশকাতের মা বাড়িতে। ছোটো বাচ্চা ও অসুস্থ শ্বশুর নিয়ে এমন ভীড়ে থাকা মিশকাতের জন্য ঝামেলারই। তাই সে বলে দিয়েছে, সোজা বিয়ের সময় উপস্থিত থাকবে। উসাইদ দু’দিকে যাতায়াত অব্যাহত রাখছে, পাশাপাশি মেহমানদের তদারকিও করছে। উসাইদের খুব ইচ্ছে ছিল, এই আয়োজনে গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খুশি করবে। কিন্তু সেটা হওয়ার নয়। গ্রামের মানুষের তাদের বাড়িতে যাতায়াত ও ঘনিষ্ঠতা কম। যারা বিয়ের কথা শুনেছে তারাই নাক সিকটিয়েছে। এর আগেও যেমন বিয়ে ভাঙার রেকর্ড তৈরী হয়েছে, এবারও সেরকম কিছু হবে বলে, বেশ কয়েক ঘরের মানুষ নানানরকম কথাবার্তা ও নেগেটিভ মন্তব্য ছড়িয়েছে ইতিমধ্যে। উসাইদ সেসব শোনেছে, মুখ রক্ষার্থে যাকে যাকে পেরেছে, দাওয়াত দিয়ে এসেছে। এইটুকুর পর কারও আসা না আসা যার যার নিজস্ব ইচ্ছে স্বাধীনতা।

যেহেতু দু’জনেরই আজ গায়ে হলুদ হবে, তাই ঝুটঝামেলা ও ছোটাছুটি বেশি। দুই বোনকে একই রং ও ডিজাইনের মেহেদীর শাড়ি পরানো হয়েছে। লাল পাড়ের হলদে শাড়িতে দুইবোন আজ হলদেপরী সেজেছে। কাঁচা ফুলের গয়নাগাটিতে দু’জনের চেহারার উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনেরা যারা এসেছে, সবাই-ই আনন্দোৎসবটাকে উপভোগ করছে। নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড় শেষে দু’জনকে মেহেদী পরাতে বসেছে রাইদাহ ও মাইসারা। নিশাত ছোট্ট মাশিয়াতকে কোলে নিয়ে এক কোণে বসে মৃদুশব্দে তার সাথে গল্প করছে, হাসছে, খেলছে। যেন এটাই তার কাজ। মাশিয়াতকে পেয়ে গায়েহলুদের দিকেই তার নজর নেই। মেহেদী দেয়ার ফাঁকেই উজমার ফোন চাইল মাইসারা। যে কয়টা ছবি তুলেছিল, সেখান থেকে কয়েকটা ছবি বান্ধবীর ফোনে ট্রান্সফার করে দিল। রাইদাহ মৃদুস্বরে গান ধরল,

দো দিল মিল রাহি হ্যায়..
মাগার চুপকে, চুপকে..
সবকো হো রাহি হ্যায়..
খবর চুপকে, চুপকে..

ফাবিহা কল দিল উজমার নম্বরে। হাতে মেহেদী থাকায় উজমা ফোন ধরতে পারল না। রিসিভ করল মাইসারা। সাউন্ড বাড়িয়ে দিল গায়ে হলুদের ছবি চাইলে বলল,
-‘তোমার ভাইকে আরেকটু ধৈর্য্য ধরতে বোলো। এক্ষুণি কোনো ছবি আমরা দিব না।’

উত্তরে ফাবিহা বলল,
-‘ভাইয়া চায়নি তো আপু, আমি চাইছি। আমার ভাবীকে কেমন লাগছে, দেখব না?’

-‘হ্যাঁ, তুমি দেখার বাহানায়, তোমার ভাইকেও দেখাবে। এই চালাকি আমরা মেনে নিব না।’

-‘তাহলে ভাইয়ার ছবি পাঠাই? বিনিময়ে ভাবীর ছবিটা আমাকে দেখার সুযোগ দিন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।’

ফাবিহার আদুরে সুর শোনে রাইদাহ বলল,
-‘ফাজলামি করছিস কেন? দিয়ে দে। ছবিই তো।’

-‘এত তাড়া কীসের? কাল তো নিয়েই যাবে। তখন নাহয় দিনরাত ভাবীর কোলের কাছেই বসে থাকবে।’

মাইসারার কথা শেষ হতে দেরী, ফাবিহার হাত থেকে ফোন ছিঁটকে যেতে দেরী হলো না। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ফারশাদ বলল,
-‘আপনাদের মনে কি দয়া-মায়া বলে কিছু নেই? আমার জন্য কি একটু মায়া হচ্ছে না?’

এই কথা শোনা মাত্রই বন্ধুবান্ধবরা সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠল। মাইসারা বলল,
-‘ভাইয়া, অনেকদিন তো ধৈর্য্য ধরলেন। আর একদিন ধৈর্য্য ধরুন। মাত্র তো চব্বিশ ঘণ্টা। আজ এইমুহূর্তে আমাদের প্রাণপ্রিয় সই আমাদের কাছে আছে, আগামীকাল ঠিক এই সময়ে সে আপনার অর্ধাঙ্গিনী রূপে আপনার পাশে থাকবে। তা-ই বলছি, আপনার মনে যদি দয়া-মায়া থাকে, আমাদের দিকটা বিচার করে আগামী কয়েকটাঘণ্টার জন্য উজমাকে আমাদের হয়ে থাকতে দিন। আমরা প্রমিস করছি, কাল উপস্থিত সব মেহমানদের সামনে ওকে আমরা আপনার হাতে তুলে দেব।’

-‘ঠিক আছে। আগামীকাল আমিও বোঝাব।’

-‘কী বুঝাবেন?’

-‘এখুনি কিছু বলব না, শালিকা। সময় আসুক, কাজে করে দেখাব। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি…।’

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরপর সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
তাক্বদীম বলল,
-‘বেচারাকে এইভাবে ছ্যাঁকা দেয়া উচিত হয়নি, সারা।’

মাইসারা একগুঁয়ে মেজাজে বলল,
-‘বেচারা যে আমাদের ছ্যাঁকা দিচ্ছে। কত দূরে নিয়ে যাবে জানিস? ওর সাথে কাটানো আমাদের একেকটা দিন, একেকটা মুহূর্ত সবকিছুকে স্মৃতি করে দিচ্ছে। ভাবা যায়?’

উজমা মনমরা দৃষ্টিতে বান্ধবীর দিকে তাকাল। মাইসারা মুখ নামিয়ে মেহেদীর ডিজাইন তুলছে। ভেতরে ভেতরে সবাই-ই একটু একটু করে ভাঙছে, অথচ সামনা-সামনি সবাইকে কী প্রাণবন্ত লাগছে! মনেই হচ্ছে না, ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট ও আগামীর দূরত্বের কথা ভেবে সবারই মন পুড়ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনিক বলল,

-‘আহা, সারা…। এখন এসব কী কথা?’

মাইসারা মুখ তুলল না। থমথমে এই পরিবেশ ও মন খারাপের মুহূর্তকে দূরে সরাতে কাইফ লাউড স্পিকারে ডিজে গান ছেড়ে দিয়ে সময়টাকে মুঠোবন্দী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

***

মেহেদীরাঙা হাত পরিষ্কার করে রাতের শেষ প্রহরে রুমে এলো ঊষা। ঢুলুঢুলু চোখ। মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা। পুরো শরীরজুড়ে ব্যথা। এক্ষুণি একটা লম্বা ঘুমের ভীষণ প্রয়োজনবোধ করল সে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়া মাত্রই সেলফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভাসলো তানজীমের নম্বর। কথা ছিল, যা কথা হবে সব বিয়ের পরপর হবে। কিন্তু খচ্চর লোকটাকে আটকে রাখতে পারেনি ঊষা। ভুলিয়ে-ভালিয়ে ফারিশার কাছ থেকে নম্বর এনে সময়ে-অসময়ে ম্যাসেজে টুকটুক করে মনের কথা শেয়ার করছে। ফোন করলে দু’মিনিটে কতশত বকবক যে করে তার হিসেব নেই। থামানো যায় না, মুখের ওপর ফোন রেখে দেয়া যায় না, ইগনোর করাও যায় না। ঊষা এখন এই মানুষটার বকবক শোনে শোনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রিসিভ না করলে একাধারে ম্যাসেজ পাঠাবে, এজন্য আধশোয়া হয়ে ফোন কানে ঠেকাল ঊষা। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো,

-‘ফ্রি আছো?’

তানজীমের দিক থেকে সম্বোধন এখন তুমিতে নেমে এসেছে। আপনি-আজ্ঞে শোনে অভ্যাস হওয়াতে ‘তুমি’ শোনে ঠোঁট কামড়ে লাজুক হাসলো ঊষা। ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘হ্যাঁ, কেন?’

-‘মেহেদী লাগিয়েছ?’

-‘হ্যাঁ, লাগিয়েছি।’

-‘রং হয়েছে?’

-‘হ্যাঁ।’

-‘কেমন? লাল টুকটুকে?’

-‘মেহেদীর রং তো লালই হয়। নীল হয় না-কি? আপনার হাতের মেহেদীতে কি নীল রং?’

মুহূর্তেই আনন্দে আটখানা মুখ নিয়ে হেসে উঠল তানজীম। এত হাসি আগে কভু হাসেনি বোধহয়। তার হাসির শব্দ শোনেই ভীতি হরিণীর মতো বুক ঢিপঢিপ শুরু হলো ঊষার। পেঁচার মতো মুখ বানিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বলল,

-‘এখানে এত হাসির কী আছে?’

-‘হাসলাম তোমার কথা শোনে।’

-‘হাসির মতো কিছু বলিনি আমি। যেভাবে প্রশ্ন করেছেন, সেভাবেই উত্তর দিয়েছি।’

এর আগে কখনও কোনো নারীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়নি তানজীম। পায়নি বললে ভুল হবে, ইচ্ছে করেই গা ঘেঁষেনি ওসবে। কখনও মনে হয়নি, প্রেম করা প্রয়োজন। কাউকে ভালোবাসা প্রয়োজন। কিংবা কারও প্রিয়জন হওয়া প্রয়োজন। তার লক্ষ্য ছিল জীবনে শুধু প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বেকারত্ব দূর করে নিজেকে সফলতার একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এজন্য সুযোগ হলেও মেয়েদের সাথে ভাব জমানোর মতো সময় সে পায়নি। বরাবরই ডুবে থেকেছে কাজে। দেশে এসেছিল ছুটি কাটাতে। এই ছুটিটা যে তার জীবনে এত বড়ো একটা পরিবর্তন নিয়ে আসবে কখনও বুঝতে পারেনি। সেদিন উজমার সাথে সাক্ষাৎ, এরপর এই অবধি আসা, এগুলো সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা। যা সে ওই সময়ে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। সব কথা স্মরণে এনে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,

-‘কখনও ভাবিনী, আমার সিঙ্গেল জীবনে কেউ নিজের আধিপত্য দেখাতে ঝড়োহাওয়ার মতো উড়ে আসবে। নিয়তি কী অদ্ভুত সুন্দর ভাবো তো! সেদিন তোমার আপু তাম্মিকে সাহায্য না করলে, তার সাথে দেখা না হলে, জীবন থেকে এই দামী কিছু মুহূর্ত ও সুখ আমি হারিয়ে ফেলতাম। এই সবকিছুর জন্য তোমার আপুকে একটা ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল। যদিও আমার পক্ষ থেকে আপুকে একটা ট্রিট দিব বলে কথা দিয়েছি, অথচ আমার সময়ই হচ্ছে না।’

তানজীমের এত কথার পিঠে ঊষা শুধু বলল,
-‘আমি কি ভুল সময়ে এসে পড়লাম?’

-‘না… বরং এটাই সঠিক সময়। আমি-ই নিজেকে ধোঁকা দিচ্ছিলাম। বিয়ের সম্মতি না দিলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলতাম, ঊষা। তোমার নামের মতোই, আমার জীবনে ভোরের স্নিগ্ধ-সুন্দর ও শান্তিময় সুবাস ছড়িয়ে, সবটুকু আঁধার সরিয়ে, স্বচ্ছ-নির্মল আলোর পিদিম জ্বেলে তুমি এসেছ। জানি না, কীভাবে রবের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করব।’

কারও ভাবনা এত সুন্দর হয়, অনুভূতি এত পবিত্র, চাওয়া ও প্রকাধের ধরন এত চমৎকার হয়, আগে কভু টের পায়নি ঊষা। আজ হঠাৎ করেই এই সুন্দর অনুভূতি ও মুহূর্তের সাথে পরিচিত হতে পেরে আনন্দে সর্বাঙ্গে সুখের কাঁপন সৃষ্টি হলো। এই কাঁপন তাকে বুঝিয়ে দিল, প্রেমহীন জীবনে আজ প্রেম এসেছে গোপনে, খুব নীরবে, তানজীমের হাত ধরে।

***

বন্ধুবান্ধবদের সাথে আজকের আড্ডাটাই সিঙ্গেল জীবনের শেষ আড্ডা হতে চলেছে উজমার। এরপর আর ওদের কবে কাছে পাবে, কবে দেখা হবে, আদৌ এই জীবনে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আর সাক্ষাৎ হবে কি-না, এই নিয়ে নানান নেগেটিভ চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। ফেলে আসা সময়ের কথা স্মরণ করে ডুকরে কাঁদছে মন। মানুষের জীবন ও সেই জীবনে আসা মানুষ, মানুষের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত সবকিছু যেন, একটা গাছ, গাছের কুঁড়ি ও ঝরাপাতার মতো। নতুনত্ব নিয়ে তার আগমন ঘটে, কিছুদিন স্থায়ী থাকে, রূপ-গুণ ও সৌন্দর্য দিয়ে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়ে অন্তিমসময়ে এসে ঝরে পড়ে। পাতাবিহীন গাছটা নিজের সৌন্দর্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এরপর আবার একইভাবে কিছু শূণ্যতা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করে, আবারও নতুনত্বের আগমন ঘটে জীবনে। আবারও সৌন্দর্য ফিরে আসে। শূণ্যস্থান পূরণ হয়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গাছটাও দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে শিখে যায়। একটা সময় হয়তো তার বন্ধুবান্ধবরাও তাকে ভুলে যাবে, তাকে ছাড়া চলতে শিখে যাবে। মাঝেমধ্যে স্মৃতির অন্দরে খুঁজে ফিরবে তাকে। ভাবতে কষ্ট হলেও এটাই হয়তো হবে, কে জানে!

হাসিখুশি একটা মুহূর্তের মধ্যেও অদ্ভুত ভাবনাগুলো ভীষণ পীড়া দিচ্ছে উজমাকে। অদৃশ্য ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তার মন। বাহিরে ফিটফাট ও শক্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অথচ ভেতরটা কাউকে দেখাতে পারছে না সে। শুধু বন্ধুবান্ধবই নয়, বাবা, ভাই-বোন, ভাবী, ছোট্ট মাশিয়াত, কাছের-দূরের সবাই, সবার সাথে এই বিচ্ছেদ, এই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়া, এতসব কথা ভাবলেই বুকে পাথর চেপে বসে। নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ে। মেহেদী পরিষ্কার করার অজুহাতে দূরে সরে নিজেকে লুকিয়ে নেয়। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে কেঁদে মন হালকা করে। রুমে বসে বিশ্রাম নেয় কিছুক্ষণ। একটু একা থাকতে ইচ্ছে হয় তার। খানিকক্ষণ চুপ থেকে মনকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। মেহেদী তুলে, পরনের কাপড় পালটে নেয়। তবুও মন শান্ত হয় না। যন্ত্রণা কমে না। কেবলই বাড়ে।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে উজমার নড়চড় ও দেখা-সাক্ষাৎ না পেয়ে বোনকে খুঁজতে রুমে এলো উসাইদ। নক দিয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকল,

-‘উজমা, তুই কি ভেতরে?’

-‘হ্যাঁ ভাইয়া।’

টিস্যু দিয়ে চোখমুখ মুছে উত্তর দিল উজমা। উসাইদ ভেতরে এলো। জানতে চাইল,
-‘ওরা সবাই তোকে খুঁজছে।’

-‘আমি মেহেদী তুলতে এসেছিলাম।’

এরমধ্যেই বেশ কয়েকবার হাই তুলল উজমা। উসাইদ বোনকে ভালোমতো খেয়াল করে বলল,
-‘ক্লান্ত লাগলে ঘুমিয়ে পড়। আর কোনো ফটোগ্রাফির প্রয়োজন নেই। আমি ওদের সবাইকে ঘুমোতে বলি গিয়ে।’

উসাইদ চলে যেতে পা বাড়ালে, উজমাই ভাইকে আটকে রেখে আদুরে স্বরে আবদার করল,
-‘আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে, ভাইয়া?’

একা থাকতে শিখে যাওয়ার পর, এটাই বোধহয় ‘মাথায় হাত রেখে ঘুম পাড়ানোর’ প্রথম আবদার উজমার। কতদিন, কত বছর হলো, বোনের মাথায় হাত রেখে তাকে নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা বলে না সে। এই বয়সে এসে, আজ হঠাৎই এই কথা শোনে উসাইদ উপলব্ধি করল, তার এই বোনটা জীবনে কঠিন যেসব মুহূর্ত কাটিয়েছে, প্রতিটা মুহূর্তে সে মায়ের সান্নিধ্যকে মিস করেছে, আদর ও সহানুভূতি মিস করেছে। অথচ প্রতিটা কঠিন মুহূর্তে মায়ের মতো পরম মমতার ও বিশ্বাসের একটা হাত ওর প্রয়োজন ছিল। ভাই হয়ে সে পাশে থেকেছে, তবে পর্যাপ্ত ভরসার হয়তো হয়ে উঠতে পারেনি। মা যতটা আপন ও বিশ্বস্ত হয়, ভাই ততটা পারে না বলেই হয়তো ভাই-বোনের মধ্যে সামান্য একটু দূরত্ব ও সীমা থেকে যায়। আজকের পর বোন এই আবদার আর করবে না, এটা স্মরণে আসতেই মুখভার হয়ে এলো উসাইদের। বিছানার বালিশ ঠিকঠাক করে বোনকে সেখানে মাথা রাখতে বলল। উজমাও তা-ই করল। ক্লান্তি সরাতে মাথা ঠেকাল বালিশে। দু’চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে রইল। আস্তে-ধীরে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে গেল উসাইদ। বলল,

-‘মাথাব্যথা করছে?’

-‘সামান্য।’

-‘কিছু খাবি?’

-‘ক্ষিধে নেই।’

নিশ্চুপে আরও কতক্ষণ হাত বুলিয়ে গেল উসাইদ। উজমা বলল,
-‘বাবাকে সামলাতে পারবে, ভাইয়া?’

উসমান ওয়াজেদের শারিরীক ও মানসিক যত জটিলতা, তার সব সমস্যা উজমাই ভালো বুঝত। সময়ে-অসময়ে খেয়াল রাখত, ঔষধ খাওয়াত। খাবার-দাবারে কোনো অনিয়ম হতে দিত না। দুইবোনকে বিদায় দিয়ে এই দিকটা একা হাতে সামলানো হয়তো কষ্ট হয়ে যাবে, তবুও তাকে চেষ্টা করতে হবে। বোনকে নির্ভার রাখতে বলল,

-‘পারব। তুই কোনো চিন্তা করিস না।’

আর একটু কথা বললেই কেঁদে ভাসিয়ে দিবে উজমা। এইমুহূর্তে নিজেকে ও ভাইকে কোনোভাবেই দুর্বল করবে বলে নিজের মনকে বুঝাল। একটা সময় অস্থির কণ্ঠে বলল,

-‘মাকে ভীষণ মনে পড়ছে, ভাইয়া। আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন…।’

খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উজমা। চোখে পানি এলেও সেটাকে আড়াল করে ফেলল নিমিষেই। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বোনের কপালে চুমু দিল উসাইদ। বলল,

-‘মা নেই তো কী হয়েছে? মায়ের দোয়া আছে আমাদের সাথে। মন খারাপ করিস না।’

কষ্ট গিলে নিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল উজমা। বেশ কিছুক্ষণ বোনের কোনো সাড়াশব্দ পেল না উসাইদ। শিওর হলো বোন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করলে অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা অশ্রুগুলোকে নীরব বিসর্জন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উজমা। কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটোতে ব্যথা শুরু হলো। ঘুম তো হলো না উল্টে মাথাব্যথা বেড়ে গেল। ফোন হাতে নিয়ে আধশোয়া হয়ে গ্যালারিতে ঢুকে পিছনের সবটুকু স্মৃতিকে দু’চোখ ভরে দেখল। দূরে কোথাও মুয়াজ্জিনের মধুর কণ্ঠে ফজরের আযান ভেসে এলো। পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। হৃদয়প্রশান্তি করা একটা ম্যাসেজ এসে স্ক্রিনে ভাসলো। সবটুকু বিষাদ কেটে গেল তাতে। ভারাক্রান্ত মনের সব যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল। একরাঁশ সুখ, আনন্দ ও তৃপ্তি নিয়ে বার কয়েক ম্যাসেজে চোখ বুলালো,

-‘একটা ভোর আসুক জীবনে, যে ভোরে আমি ও আপনি কাছাকাছি থাকব, পাশাপাশি দাঁড়াব। হাতে-হাত রেখে আকাশের বুক ছিঁড়ে উঁকি দেয়া রক্তিম সূর্যের সবটুকু রং গায়ে মেখে হৃদয়ে-হৃদয় রাখব। ভোরের প্রতিটি শিশিরকণা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পাখিদের কলতান শুনব। সুদূরে উড়ে বেড়ানো গাংচিলের অবিরাম ডানা ঝাপটানো দেখে হাওয়ায় ভেসে আসা বুনোফুলেদের মাতাল ঘ্রাণে বিমোহিত হব। আপনার ও আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসজুড়ে ভালোবাসার সুখপাখিরা নেচে নেচে বেড়াবে। আমরা জানব, বুঝব, উপলব্ধি করব – ভালোবাসা এভাবেই আসে, প্রকৃতির রঙে, রূপে, ঘ্রাণে। এরপর থেকে আমার জীবনের প্রতিটা ভোর আমি আপনার নামে উৎসর্গ করব, ইনশা’আল্লাহ্। এমন একটা ভোরকে কি আপনি ছুঁয়ে দেখতে চান, বাটারফ্লাই?’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – চৌত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

বিয়েবাড়ির ঝামেলা ও আত্মীয়স্বজনকে আদর-আপ্যায়ন করাতে ব্যস্ত ফারিশা নিজের দিকে খেয়াল রাখার সময়ই পাচ্ছে না। সকাল থেকে শুধু এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে, বড়ো বউয়ের দায়িত্ব পালন করছে, কোনোদিকে কোনো কমতি রাখছে না। সবদিক খেয়াল করে, তানজীমকে বর সাজানোর সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। মুরব্বিদের চা-নাশতা দিয়ে মেয়েকে নতুন জামা পরিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল সবে, এরমধ্যেই মেসবাহ এসে বলল,

-‘তুমি এখনও তৈরী হওনি?’

মেয়ের চুলে ঝুঁটি বেঁধে, ছোটো ছোটো ক্লিপ আঁটকে, মেয়েকে একনজর দেখে, কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-‘দাদীর কাছে যাও। বেশি ছোটাছুটি কোরো না। আর কিছুক্ষণ পরই আমরা বের হব।’

ছুটি মেয়ে দৌড় দিল তাম্মি। ফারিশা ঘড়ি দেখল। বুকভরা অভিমান নিয়ে শাড়ি-গয়না হাতে নিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্য বলল,
-‘আমার তো বেশি সময় লাগবে না। তুমি বাকিদের তৈরী হতে বোলো।’

এরমধ্যেই আরও কয়েকবার ঘড়ি দেখল ফারিশা। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাত আটটায় আকদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। ভাইটা এখনও এলো না কেন, বুঝল না। হয়তো এখনও বোনের ওপর রাগ-অভিমান জমে আছে। এজন্যই আসেনি। সামান্য একটা ম্যাসেজে কি আর রাগ-অভিমান মিটে? সে মুখফোলা অভিমান আগলে নিয়ে বলল,

-‘শাদকে আসতে বলেছিলাম এখানে।’

স্ত্রীর কথা শোনে মেসবাহ বলল,
-‘আজ তো ওর জীবনের একটা বিশেষ দিন। এই দিনে ও আসবে, এখানে? বাদ দাও। অপেক্ষা করে লাভ নেই। দেরী হচ্ছে আমাদের। তাড়াতাড়ি না পৌঁছালে বিয়ের কাজে দেরী হয়ে যাবে। মুরব্বিরা সবাই তাড়া দিচ্ছেন।’

মেসবাহ’র কথা যুক্তিসঙ্গত মনে করে ঘাড় নাড়িয়ে নিজের সাজগোজের প্রতি নজর দিল ফারিশা। খুব দ্রুতই তৈরী হলো সে। শাড়ি পরল, সামান্য মেকাপ নিল, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে একটা হিজাব, চুড়ি, আংটি পরল। ব্যস। এইটুকু সাজেই বউকে দেখে খুকখুক করে দু’বার কাশি দিল মেসবাহ। বলল,

-‘বেনারসি পরলে তোমাকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগত।’

জীবনে একবারই বউ সেজেছিল ফারিশা। তা-ও নরমাল একটা জামা পরে। গর্জিয়াছ সাজপোশাকে বউ সাজা হয়নি তার। বিয়ে নিয়ে এত জাঁকজমক আয়োজনও হয়নি। কিন্তু তবুও মনে আফসোস নেই। সে তার জীবন নিয়ে খুশি, জীবনে ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে খুশি, তার সাথে ঘর বাঁধতে পেরে খুশি। আর কী চাই? এত প্রাপ্তির পর আর দীর্ঘশ্বাস ফেলার অবকাশ থাকে না। তারও কোনো দীর্ঘশ্বাস নেই। জীবন নিয়ে সে সন্তুষ্টই আছে। সেটা তার হাসি, কথাবার্তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। তবুও মেসবাহ’র মনে হয়, তাদের জীবনেও হয়তো এমন একটা দিন আসতে পারত! শুধু ভাগ্যের দোষেই তারা সেটা হারিয়ে ফেলেছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের ছাড়াই বিয়ে করতে হয়েছিল, ঘর বাঁধতে হয়েছিল। ভাগ্যিস সাহস নিয়ে একে-অন্যের হাত ধরেছিল, তাইতো তারা আজ একসাথে। নয়তো কে কোথায় থাকত কে জানে! সাহস না দেখালে জীবনে ভালোবাসা আসত না, ঘর বাঁধা হতো না, সুখের দেখাও মিলত না। সবটুকু মন খারাপের স্মৃতি পিছনে ফেলে মেসবাহ বউয়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। কপালের একপাশে আলতো স্পর্শে চুমু এঁকে বলল,

-‘বেনারসি পরে তোমাকে বউ সাজতে হবে না। সাজপোশাকের মাধ্যমে লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বোঝাতে হবে না, তুমি আমার বউ। লোকে না জানলেও আমি তো জানি, তুমি-ই আমার বউ। তুমি-ই আমার পৃথিবী।’

বরযাত্রী যারা যাবেন, তারা সবাই তৈরী হলেন কি-না সেটা দেখার অজুহাতেই পালিয়ে গেল ফারিশা। ড্রয়িংরুমে পা রেখে সদর দরজায় দৃষ্টি দিয়ে স্থির হয়ে গেল সে। কয়েক সেকেন্ড বিস্ময়ভরা চোখজোড়া মেলে মাস্ক পরুয়া যুবকটাকে দেখে গেল। একটা সময় অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল,

-‘ভাই… তুই!’

আনন্দে চোখে পানি জমা হলো ফারিশার। এগোতে চেয়েও পারল না। পা দুটো যেন কেউ লোহার শিকলে বেঁধে দিয়েছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে দাঁড়িয়ে রইল। লোকের হতবাক দৃষ্টিকে দূরে সরিয়ে ফারশাদই এগোলো। বোনের সামনে এসে পায়ের কাছে হাঁটুভাঁজ করে বসে পড়ল। দুটো হাতে পা ধরে অভিমানী গলায় বলল,

-‘তুমি এত পাষাণ কবে হলে, বুবু?’

পা ছাড়িয়ে ভাইকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চোখেমুখে হাত বুলিয়ে ফারিশা বলল,
-‘সময় আমাকে কঠিন হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল, শাদ।’

ফারিশার হাউমাউ করা কান্না আর থামানো গেল না। আপন মানুষদের দেখে বহুদিন পর আবেগী কান্নায় গাল ভাসালো সে। অদূরেই দেখা গেল ফাবিহাকে। কাছে ডাকতেই ছুটে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরল। বুকের কাছে আগলে রেখে ছোটো বোনকে অসংখ্য আদর দিল ফারিশা। লোকের মুখের গুঞ্জন শুরু হলো। ফারিশার শাশুড়িও ছুটে এলেন। মেসবাহ এলো। তিন ভাই-বোনের এই মিলন দৃশ্য দেখে বলল,

-‘বাহ্বা, বাড়ির লোককে পেয়ে আমাকেই ভুলে গেছো দেখছি।’

ফারশাদ এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। কৌতুকভরা কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি যে মেসবাহ নামে পরিচিত এটা আমাকে জানাবেন না? পাগলের মতো খুঁজেছি আমি আপনাকে। প্রেম করলে সাহসী হতে হয়, ব্রো। পালাতে হয় না। আপনি তো একটা ভীতুর ডিম।’

মেসবাহ হেসে উঠল এই কথা শোনে। বলল,
-‘কী করব বোলো? তোমার বাবা-মা যেভাবে আমার পিছনে লেগেছিলেন। আবার সামনে পেলে তো এক কোপে জানে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাবতেন না। যদিও তোমার বুবুকে জীবনে জড়াতে গিয়ে এই শরীর অনেক আঘাত সহ্য করেছে। তবুও, ভালোবাসার কাছে এই কষ্ট সীমিতই ছিল। আসলে যা হয়েছে, সবটাই ভাগ্য। এটা হওয়ার ছিল। ওই সময়ে না পালালে তোমার বুবুকেও হয়তো আরও অনেক কঠিন মুহূর্ত ফেইস করতে হতো।’

-‘সবকিছুর জন্য আমি খুব দুঃখিত, ভাইয়া। আমি তখন এতকিছু জানতাম না। বুবু যে আপনাকে ভালোবাসত, সেটা অনেক পরে জেনেছি আমি। সেই থেকে আপনাকে ও বুবুকে অনেক খুঁজেছি। ভাই হয়েও কিছু করতে পারিনি আমি। পাশে থাকতে পারেনি। বোনের সাহস ও ভরসা হয়ে উঠতে পারিনি। এই ব্যর্থতা আমারই।’

-‘বাদ দাও। পিছনের কথা নিয়ে মন খারাপ করার দরকার নেই আর। তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। এরকম একটা সময়ে তুমি আমাদের মনে রেখেছ, এটাই অনেক বড়ো প্রাপ্তি।’

ভাই ও বোনকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ফারিশা। গুঞ্জন শোনে বরবেশে বেরিয়ে এলো তানজীম। সবাইকে এক জায়গায় ব্যস্ত দেখে অবাক হলো। আরও অবাক হলো, ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরকে দেখে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল,

-‘কী ভাই? ভাগ্য তবে এখানেই টেনে আনলো?’

ফারশাদ হাসিমুখে বলল,
-‘টেনে তো আনলো। দেখা যাক ভাগ্যের খেলা কী!’

-‘আটটায় আকদ না? আমরা তো একটু পরই রওনা দেব। আপনি তো এখনও তৈরী হোননি। দেরী হবে না?’

-‘অসুবিধা নেই। নতুন জীবন শুরু করার আগে বুবুর দোয়া ও ভালোবাসার বড্ড প্রয়োজন ছিল আমার। বুবু ঠিকানা না দিলেও আজ আমি এখানে আসতাম।’

কাজের মেয়েকে তাড়া দিলেন ফারিশার শাশুড়ি। তাৎক্ষণিক হাতের কাছে যা পেল, তা দিয়েই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল সে। সামান্য চা-নাশতা খেয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিল ফারশাদ। মেসবাহ বলল,

-‘এখান থেকে একসাথেই রওনা দিলে ভালো হতো না? তুমি রিসোর্টে যাবে, তৈরী হবে, এতে তো আরও অনেক সময় নষ্ট হবে।’

ফারশাদ বলল,
-‘একটুও দেরী হবে না। আপনারা গিয়ে ফটোশুট করবেন, সেই ফাঁকে আমি তৈরী হয়ে নেব। এখন আসছি। দেরী হলে উসাইদ আবার চিন্তা করবে।’

***

দুই বোনের বিয়ের সাজপোশাক আজ একই। একই রং, একই ডিজাইন, একই সব জুয়েলারিও। জুতো থেকে শুরু করে মাথার ওড়না, সবকিছুই এক। সি গ্রিনের ওপর সাদা পাথরের কারুকাজে কচিত গাউন, তার সাথে ম্যাচিং করে গয়নাগাটি, মাথায় হিজাব, হিজাবের একপাশে আবার গাউনের ওড়না জড়ানো। গর্জিয়াস এই সাজে দু’জনের সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ প্রকাশ পাচ্ছে। উপস্থিত মেহমানরা দুই কনের ছবি তুলতে ব্যস্ত। তানজীম খয়েরী রং চয়েস করলেও ঊষা বারণ করে দিয়েছিল। বলেছিল, তার চকচকে রং পছন্দ না। এজন্যই বিয়ের পোশাকের রং পরিবর্তন করতে হয়েছে। দুই বরের পোশাকের রংও এটাই। তবে শেরওয়ানিতে সি গ্রিনের ওপর গোল্ডেন কারুকাজ বসানো। বরযাত্রী এলে হুলস্থুল শুরু হলো, ঊষার মুখখানা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেল। খুব ইচ্ছে ছিল তার, বোনের বিয়েতে গেট ধরবে সে। বর এসেছে অথচ সে গেট ধরতে পারছে না। বসে বসে সবার আনন্দ-ফুর্তি দেখতে হচ্ছে। একই দিনে দুই বোনের বিয়ে হবে, এই বুদ্ধিটা ভাইকে কে দিল কে জানে! তার সব ইচ্ছের মধ্যে কচুরিপানা ঢেলে দিয়ে এখন বিয়ের তোড়জোড় চলছে।

রিসোর্টের এই হলরুম বিশাল বড়ো। রুমের একদিকে দুই কনেকে বসানো হয়েছে। অন্যদিকে দুই বরকে। মাঝখানে আগত মেহমানেরা গল্পগুজব করছেন, ছবি তুলছেন। প্রথমে উজমা ও ফারশাদের বিয়ে পরানো হবে, পরে তানজীম ও ঊষার। কাবিননামা প্রস্তুত করে কাজী সাহেব কনের এ্যাজিন নিতে এলে, সাহসী মনের মেয়েটার মনের ভেতর দিয়ে ভয়ানক এক কালবৈশাখী তাণ্ডব বয়ে গেল। সমস্ত শরীরজুড়ে কাঁপুনি শুরু হলো। ‘কবুল’ বলার মুহূর্তে দুটোঠোঁটে অস্বাভাবিক কম্পন দেখা গেল। চোখভরা অশ্রু নিয়ে শক্ত করে দুই বান্ধবীর দুটো হাত খামচে ধরল উজমা। দুর্বলকণ্ঠে বলল,

-‘আমার এমন লাগছে কেন?’

মাইসারা ও রাইদাহ দু’জনেই ভয় পেয়ে গেল। উজমার দৃষ্টি স্বাভাবিক হলেও শরীরের কাঁপন ও বুক ধড়ফড় অবস্থা টের পেল দু’জনে। বুঝতে পারল, বহু আকাঙ্ক্ষিত এই মুহূর্তটা প্রিয় বন্ধুর কাছে আজ স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অবিশ্বাস্য সুখেই শরীরের এই কম্পন। দু’দিক থেকে দু’জনে সাপোর্ট দিল। বান্ধবীকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে মাইসারা বলল,

-‘এমন সবারই হয়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। শুভকাজে এত দেরী করা ঠিক হবে না। তোর মনে নেই, কতদ্রুত আমি ‘কবুল’ বলেছিলাম?’

‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’ শুধু সামান্য দুটো শব্দই নয়, দুটো মানুষের মধ্যকার সবটুকু দূরত্ব গুছানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এতে দুটো মানুষের মধ্যকার দূরত্ব যেমন দূর হবে, তেমনই নিজের জীবনের সমস্ত আধিপত্য চলে যাবে অন্যের ওপর। একটা সময় যে মানুষের ওপর বাবা-মা ও ভাই-বোনের হক্ব থাকে, দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে, আজ থেকে সে মানুষের ওপর স্বামী নামক মানুষটি জড়িয়ে থাকবে। আজ থেকে উজমার সব ভালো-মন্দে জড়িয়ে থাকা এই মানুষটাই কি-না তার জীবনসঙ্গী হতে যাচ্ছে। ওই একটা বাক্যের মাঝেই জীবনের আমূল পরিবর্তন টের পেল উজমা। সাহস নিয়ে শব্দ দুটো উচ্চারণ করেই দু’হাতে মুখ লুকিয়ে শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়ল। এরপর কাজী সাহেব ফারশাদের স্বীকারোক্তি শুনতে চাইলে খুব দ্রুত ও সাহসের সাথে সম্পর্ক ও মানুষটাকে কবুল করে নিল সে।

উজমা তো শুধু কাঁপল, ঊষার বেলায় সে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে ‘কবুল’ বের হওয়ার আগেই কেঁদেকেটে মনের জোর হারিয়ে ভাইকে আঁকড়ে ধরে বসে রইল। উসাইদ বোনকে বুঝাল, সাহস দিল, শান্ত করার চেষ্টা করল। তাতেও তারমধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে কেঁদে কেঁদে সবাইকে অস্থির করে দিল। একসময় মনকে বুঝিয়ে, মানিয়ে নিচুস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’ বলল। দু’জনের স্পষ্ট স্বীকারোক্তির মাধ্যমে দুটো মানুষের মধ্যকার সবটুকু দূরত্বকে দূরে ঠেলে দিয়ে পাকাপোক্ত একটা বন্ধনে আবদ্ধ হলো তারা। একে একে চারজনের স্বীকারোক্তি ও সিগনেচার শেষে, দোয়ার মাধ্যমে বিয়ের লিখিত ও মৌখিক আয়োজনের সমাপ্তি ঘটল। মেহমানদের খাবারের ব্যবস্থা করে বন্ধুরা সবাই নতুন এই দু’জোড়া দম্পতির ছবি উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দুটো সোফাতে পাশাপাশি, কাছাকাছি বসিয়ে বর-কনের বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা শুরু হলো।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, বসে ছবি তুললেও উজমা ও ফারশাদ এখনও একে-অন্যের দিকে সহজ হয়ে তাকায়নি। দু’জনই একটা অদৃশ্য দূরত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেদের মধ্যে। লজ্জা ও সংকোচের কারণেই এই দূরত্ব। ছবি তোলার একফাঁকে মৃদুস্বরে ফারশাদ বলল,

-‘বামহাতটা সামনে আনো, বাটারফ্লাই।’

একে তো কানের কাছে ফিসফিসানি, তারমধ্যে আবার ‘তুমি’, দুটোই ভীষণভাবে প্রভাব ফেলল উজমার মনে। লজ্জায় থুতনি মিশে গেল বুকের কাছে। ঠোঁটের কোণে দেখা গেল লাজরাঙা এক মৃদু হাসি। আস্তে করে বলল,

-‘কেন?’

উজমার বামহাতে লেডিস্ পার্স ছিল। সামনে তুলে ধরতেই হাতের পার্সটা মাইসারার হাতে ধরিয়ে দিল ফারশাদ। শেরওয়ানীর পকেটে রাখা ছোট্ট বাক্সটা হাতে এনে, ভেতরে রাখা স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের মিশ্রনে তৈরী, তিন আঙুলের আংটি বের করল। আলগোছে সেটা পরিয়ে দিল উজমার হাতে। মাঝের তিনটে আঙুলের সাথে মিশে গেল আংটিটা। চকচক করে উঠল। বুড়ো আঙুলের আলতো স্পর্শে অর্ধাঙ্গিনীর হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দু’হাতের মুঠোয় পুরে গালে ঠেকাল। কতক্ষণ এভাবেই, হাতের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে রইল ফারশাদ। কণ্ঠস্বর বসে গেল। অতিআনন্দে, খুশিতে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হলো। মুরব্বিরা কেউ আশেপাশে নেই বিধায় দৃশ্যটা কারও চোখে পড়ল না। বন্ধুবান্ধবরা ইতিমধ্যে অসংখ্য ছবি তুলেছে। এইমুহূর্তটাও তাদের কাছে আরেকটু স্পেশাল মনে হলো। দ্রুতহাতে অনেকগুলো ক্লিক দিল কাইফ। উজমা হতবাক দৃষ্টি সামলে অন্যহাতে ফারশাদের হাতে হাত রেখে নীরব চোখে চেয়ে থেকে কিছু বোঝাতে চাইল। না বলা মুখের ভাষা, দৃষ্টি দিয়েই বুঝে নিল ফারশাদ। মুচকি হেসে দুটোহাত আরও ভীষণ যত্নে আগলে নিয়ে বলল,

-‘আর কোনো ভয় নেই, বাটারফ্লাই। নেই কোনো দ্বিধার দেয়াল, বিচ্ছেদ কিংবা হারানোর ভয়। সবটুকু ভয়কে আজ জয় করে নিলাম আমরা। আজ থেকে তুমি শুধু আমার। তোমার সমস্ত ভালো-মন্দের দায়িত্ব আমার। তোমার সাথে জড়িয়ে থাকা প্রতিটা সুখ-দুঃখও আমার। জেনে রেখো, যতদিন আমার প্রাণ থাকবে, যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন কোনো কষ্ট তোমায় ছোঁবে না। কষ্টগুলো তোমার কাছে ঘেঁষার আগেই সব কষ্টকে আমি ভালোবাসা দিয়ে মুছে দেব, ইনশা’আল্লাহ্।’

***

মেহমানদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে, আগত মেহমানদের বিদায় দিয়ে সব ঝুটঝামেলা শেষ করতে গিয়ে রাত হয়ে গেল তিনটে। অতিরিক্ত কান্নার কারণে চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে গেল ঊষার। বিশ্রামের জন্য তাকে রুমে নিয়ে এলো মিশকাত। সাজানো-গোছানো বাসরঘর দেখে বুক ধকধক করে উঠল। কী অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি ও ভীষণ রকম লজ্জা, ভয় এসে উঁকি মারলো একসঙ্গে। চারপাশে তাকিয়ে কাউকেই পেল না। মিশকাত তাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,

-‘তুই ভারী পোশাকটা চেঞ্জ করেনে। আমি তোর জন্য কফি নিয়ে আসছি।’

কনেবিদায় হবে আগামীকাল দুপুরে। দু’জনকেই একসাথে বিদায় দেয়া হবে। এত রাতে বিদায়টা ঝামেলার। তাই রিসোর্টেই বাসরের আয়োজন করা হয়েছে। কাঁচাফুলের সুবাসে পুরো রুমজুড়ে বিরাজ করছে অন্যরকম সৌন্দর্য। মিশকাত চলে গেলে, ধীরেধীরে ভারী সাজ পরিবর্তন করে, নরম কাপড়ের একটা জামা পরে, হাতমুখ ধুয়ে বালিশে মাথা ঠেকাল ঊষা। চোখদুটো এখন বন্ধ হতে চাইছে। জোর করেও খোলা রাখা যাচ্ছে না। কপালে হাত চেপে চেপে মাথাব্যথা দূর করার চেষ্টা করল সে। কখন যে গভীরঘুমে ডুবে গেল, টেরই পেল না। চোখ মেলল কপালে বরফশীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে। পরক্ষণেই আঁৎকে উঠল। রুম পুরোপুরি অন্ধকার নয়, আবার আলোতে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থাও নয়। শুধু নীলচে রঙের বাতি জ্বলছে রুমে। সেই আলোতে একজোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি, অপলকে দেখছিল তাকে। ক্ষণে ক্ষণে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বিস্ময় কাটাতে সামনে থাকা পুরুষটি কৌতুকমাখা স্বরে বলল,

-‘অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফল টের পাচ্ছ এখন?’

মুখ লুকিয়ে সামান্যই হাসলো ঊষা, তবে মুখে কিছু বলল না। তানজীম তার লজ্জা ও সংকোচ টের পেয়ে বলল,
-‘কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আবার কি গরম করে দিতে বলব?’

এইটুকু বলে মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিচ্ছিল তানজীম, চটজলদি হাত আটকে সমস্ত লজ্জা ও সংকোচকে দূরে সরিয়ে ঊষা বলল,
-‘কফি লাগবে না, এই হাতটাই যথেষ্ট।’

নবপরিণীতার এই কথায় চমকিত হলো তানজীম। মুচকি হেসে নিশ্চয়তা চেয়ে বলল,
-‘তাই? আনইজি লাগছে না?’

-‘একটু একটু।’

-‘ভরসা কোরো?’

-‘হুম…।’

-‘বিশ্বাস?’

অর্ধাঙ্গ’র চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়ল ঊষা। তানজীম স্বাভাবিক হয়ে বালিশে মাথা ঠেকাল। একহাতে আস্তেধীরে ঊষার মাথায় ম্যাসাজ করে দিয়ে বলল,
-‘একটা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অনেক সেক্রিফাইস করতে হয়, জানো তো?’

-‘জানি…।’

-‘হয়তো আমি তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করতে পারব না, হয়তো তোমাকে দু’হাত ভরা সুখ এনে দিতে পারব না, হয়তো কিছু কমতি থেকে যাবে। কিছু শূণ্যতা, কিছু অপূর্ণতা, কিছু দুঃখ, কিছু হতাশা, এই সবকিছুকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব। আমাদের জীবনে যদি কখনও কোনো খারাপ সিচুয়েশন আসে, যদি কখনও দূরত্ব তৈরী হওয়ার মতো পরিস্থিতি আসে, আমরা দু’জনে সেইসব জটিল ও কঠিন মুহূর্তের সাথে, একসাথে লড়াই করব। আমাদের লক্ষ্যই হবে, সম্পর্কটাকে শেষ অবধি বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসার সাথে বাঁচিয়ে রাখা। পারবে না?’

মুখে কোনো জবাব দিল না ঊষা। চুপটি করে চলে এলো বুকের মাঝখানে। চোখ বন্ধ করে বলল,
-‘মাথাব্যথা করছে তো।’

আহ্লাদী স্বর শোনে ঠোঁট কামড়ে হাসলো তানজীম। কপালে হাত বুলানোর বদলে বিশ্বস্ততার চুমু আঁকলো একবার। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেলাল। বলল,

-‘সেরে যাবে।’

***

বন্ধুরা যে সবাই বদের হাড্ডি সেটা আস্তেধীরে টের পেল উজমা। সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলেও আড্ডার বাহানায় ফারশাদকে আটকেই রাখল ওরা। কেউ-ই ছাড়ছে না। কাল যেহেতু বিদায় দিয়ে দিবে, আজ এত তাড়াতাড়ি ছাড়াছাড়ি নেই, এই হচ্ছে ওদের আসল উদ্দেশ্য। রুমে বসে বসে বোর হচ্ছিল উজমা। সময় কাটাতে ফোন হাতে নিয়ে বসেছিল। নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে দেখল, তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলকে ট্যাগ দিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছে ফারশাদ। লিখেছে –

“টুডে আই মেট ডেস্টিনি, এন্ড এ্যাক্সেপ্টেড হার ফোর মাইসেল্ফ। মাই ডেস্টিনি ইজ মাই লাভ এন্ড হার নেইম ইজ ‘উজমা ওয়াজেদাহ’। হোয়েন উই সেইড ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’, উই মেইড অ্যা প্রমিস টু লিভ টুগেদার, ফোরেভার। প্লিজ, প্রে ফোর আস্।”

স্ট্যাটাস ও দুটো হাতের একটা পিকচার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা আনন্দ-উল্লাস শুরু হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল এটাকে ব্রেকিং নিউজ করে দিল। বসে বসে মাছি ও মশা তাড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে এই নিউজটাই দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিল সে। এটা অবশ্য একদিক থেকে ভালো হলো। নার্ভাসনেসটা লুকিয়ে রাখা গেল। ফারশাদ যত দূরে দূরে থাকবে, ততই যেন স্বস্তি। সামনে এলেই তো লজ্জায় তাকাতে পারবে না। কোথায় লুকোবে, কীভাবে লুকোবে এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরী হবে। এরচেয়ে দূরে থাকুক, ক্ষতি তো কিছু নেই।

আড্ডায় বসলেও ফারশাদের মন বার বার ছুটে যেতে চাইছে নববধূর কাছে। বধূসাজে তাকে দুচোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। অথচ ফাজিলদের জ্বালায় এখানে বসে বসে আড্ডা জমানোর ভান করতে হচ্ছে। উতলা মন নিয়ে কি আড্ডা দেয়া যায়? বিয়েশাদী করেও যদি এরা অবুঝের মতো কাজ করে, তাহলে এদের বুদ্ধি-শুদ্ধি আর কবে হবে ভেবে পায় না ফারশাদ। একাধারে বসতে বসতে তার কোমর ধরে যাচ্ছে। তা-ও ফাজিলগুলো তাকে ছাড়ছে না। তার বিরক্তি ও আনচান মনের হাবভাব টের পেল মিশকাত। সবাইকে তাড়া দিয়ে বলল,

-‘এ্যাই, তোমাদের ঘুম নেই? পরপর দু’রাত ধরে জেগে আছো। আজ একটু ঘুমোও।’

মিশকাতের এই কথা শোনে কাইফ বলল,
-‘অসুবিধা নেই, ভাবী। পরপর সাত রাত জেগে থাকার রেকর্ড আছে আমাদের। দু’রাত তো সেই তুলনায় কিছুই না। আজ সারারাত ধরে আড্ডা চলবে।’

হাত-পা ধরে লটকে থাকলেও এদেরকে আজ আর সরানো যাবে না, এটা বেশ বুঝল মিশকাত। কোনো উপায়ই সে খুঁজে পেল না। মাশিয়াতের কান্নার শব্দ শোনে ঠোঁটে হাসি টেনে রুম থেকে মেয়েকে কোলে নিয়ে সবার সামনে এসে রাইদাহ’র কোলে দিয়ে বলল,

-‘ঘুম নেই তো কারও চোখে, তাই না? ওকে সামাল দাও।’

মোমকে সামলাতে অভ্যস্ত হওয়ায় মাশিয়াতকে সামাল দেয়া খুব একটা কষ্ট হবে না ভেবে মিশকাতের কথা ফেলতে পারল না রাইদাহ। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এদিক-ওদিক পা ফেলে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেও তাকে সামলাতে পারল না। মাশিয়াত এত কাঁদছে, সেই কান্নায় সবার বিরক্তি ধরে গেছে। একবার অনিক কোলে নিচ্ছে, একবার কাইফ তো একবার মাইসারা ও নিশাত। একটা সময় দেখা গেল, মাশিয়াত কান্নার রেকর্ড তৈরী করে সবাইকে নাজেহাল করে দিল। ওর কান্নায় সবার রীতিমতো বেহুঁশ হওয়ার দশা। কেউ-ই সামলাতে পারল না। ভাইঝির কান্না শোনে উজমাও ছুটে এলো। মাশিয়াতকে নিয়ে সবার ব্যস্ততা শুরু হলো। এদিকে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে আলো ফুটছে। ছোট্ট বাচ্চার কান্নায় কোনোদিকেই কারও খেয়াল নেই। এই ফাঁকে ফারশাদ উঠে দাঁড়িয়ে অনিককে বলল,

-‘তোমার বাইক কোথায়?’

রিসোর্টের সামনেই বাইক পার্কিং-এ ছিল। আঙুল দিয়ে সেদিকে ইঙ্গিত করল অনিক। ফারশাদ বলল,
-‘চাবিটা দাও।’

-‘কোথায় যাবে?’

-‘তোমরা বাচ্চা সামলাও। দাম্পত্য জীবনের প্রথম ভোরটাকে উপভোগ করে আসি।’

ফারশাদের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মুচকি হেসে পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করে দিল অনিক। একনজর উজমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ওর খেয়াল রাখবেন।’

ফারশাদ নিশ্চয়তা দিয়ে চট করে সরে পড়ল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চোখের ইশারায় উজমাকে বাইরে যেতে বলল অনিক। দোতলা থেকে নিচে চোখ রাখতেই ফোনের স্ক্রিনে ম্যাসেজ এলো –

-‘চলো, দেশান্তরী হই।’

সবাই বাচ্চা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কেউ-ই তাকে খেয়াল করছে না। চুপিসারে, নিঃশব্দে সেই স্থান ত্যাগ করল উজমা। রুম থেকে দরকারী একটা জিনিস হাতের মুঠোয় নিয়ে সকলের অগোচরে নিচে এলো। ফারশাদ বাইকে চেপে বাড়তি হেলমেট বাড়িয়ে দিল উজমার দিকে। বলল,

-‘সাবধানে বোসো।’

কণ্ঠে একরাঁশ বিস্ময় ও ভালো লাগা নিয়ে উজমা বলল,
-‘আপনি বাইক চালাতে জানেন?’

-‘আমাকে এতটা অকর্মা ভাবার কিছু নেই।’

বাইক স্টার্ট করলে, খুব সাবধানে বাইকের পিছনে বসলো উজমা। বলল,
-‘আমি এর আগে বাইকে উঠিনি। পড়লে কিন্তু শেষ।’

ব্যালেন্স রাখতে পিছনের ক্যারিয়ার ধরেছিল উজমা। ভয় হচ্ছিল, কী জানি পড়ে যায়। বাইক চলতে শুরু করলে ভয়ে দোয়াদরুদ জপতে শুরু করল। ফারশাদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল,

-‘কাঁধে হাত রাখো।’

অনুমতি পেয়েও কাঁধে হাত রাখার মতো সাহস দেখাতে পারল না উজমা। যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই রইল। রিসোর্টের সীমানা পেরিয়ে মেইন রোডে এসে বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিল ফারশাদ। উজমা নড়েচড়ে বসলো। এভাবে আগে বাইকে চাপেনি কোনোদিন। ভীষণরকম অস্বস্তি হচ্ছিল তার। বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘দূর…। দুনিয়ার এত গাড়ি থাকতে বাইকেই কেন? পড়ে যাব তো।’

চলন্ত বাইক থামানোর মুডে নেই ফারশাদ। সে স্পীড বাড়িয়ে রেখেই বলল,
-‘কাঁধে হাত রাখো, নাহলে আরও স্পীড বাড়াব।’

-‘মারতে চান, না-কি?’

উজমার চোখমুখে স্পষ্ট ভয় ও অস্বস্তি। আয়নায় সেটা লক্ষ্য করেই স্পীড কিছুটা কমিয়ে আনলো ফারশাদ। পিছনে একনজর দৃষ্টি দিয়ে উজমার ডানহাত নিজের কাঁধের ওপর রেখে বলল,

-‘পিছনে ব্যালেন্স ধরে বসলে যেকোনো সময় ছিঁটকে পড়বে। সাহস নিয়ে বেরিয়ে এসেছ অথচ বিশ্বাস রাখতে পারছ না। আমি কি পর কেউ?’

হয়তো এই কথাতে সামান্য অভিমান মিশেছিল। কে জানে! যেভাবে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল একদিন, এখনও হয়তো দূরের একজনই ভেবে দূরত্ব মেপে চলছে তার মন। অথচ এই মানুষটা তার আপন, খুব আপন। এত আপন কেউ হতে পারে কভু? বিশ্বাস-অবিশ্বাস ও আপন-পরের হিসেব আসাতে সচেতন হয়ে গেল উজমা। একহাতে কাঁধ ধরেছিল, এবার অন্যহাত সামনের দিকে নিয়ে পেট ও কোমরের অংশ আঁকড়ে ধরে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলল,

-‘একদিন বলেছিলাম না, নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি আমি আপনাকে? যে আমি নিজেকে প্রচণ্ড ভালোবেসেছি একসময়, সে-ই আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতে শিখেছি কাউকে। যাকে আমি এত ভালোবাসি, সে আমার পর হতে যাবে কোন দুঃখে? সে তো আমার আপন, ভীষণ আপন। আমার হৃদয়ঘরের সমস্ত দখলদারি যার, তাকে আমি পর ভাবতে পারি না।’

***

চলবে…