মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-০১

0
611

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকা_আয়াত_আফরা

–কি রে মা ,একা একা বসে কি ভাবছিস? হঠাৎ মামীর গলায় সম্বিৎ ফিরে তন্দ্রার। মামী তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন,
–ইশ কি অবস্থা করেছে চুলের! দেখো দেখি মনে হয় কত যুগ তেল ছোঁয়ায়নি।আয় তো তন্দ্রা তোর চুল বেঁধে দেই।

মামীর হঠাৎ এমন ভালো আচরণে বেশ অবাক হয় তন্দ্রা।যে মামী তাকে উঠতে বসতে দূর ছাই করে সেই মামী কিনা আজ তার চুল বেঁধে দিতে চাইছে!এইতো সকাল বেলায় যখন সে খেতে বসেছিল তখন তার মামী কেমন ফোঁস করে উঠে বলেছিলেন,

–এই এলেন জমিদার বাড়ির মেয়ে।বলি কাজ না করে যে খেতে বসে গেলেন তো মহারানি বাড়ির কাজ শেষ করে কি খোওয়া যেত না নাকি?

তন্দ্রা যেই বলেছিলো,
–মামী মা আমি তো কাজ শেষ করেই…

অমনি আরও এক গাদা কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন তার মামী বীণা বেগম।সেসব কথা অবশ্য গায়ে মাখেন তন্দ্রা।মামী ওসব রোজ বলে।বাড়ির কাজ শেষ করে এই একটু এসে বসেছে এমন সময় আবার এসে উপস্থিত হয়েছেন বীণা বেগম।তবে এখন হঠাৎ মুখ দিয়ে এমন মধু ঝরছে কেন? কি এমন হলো যে সকালে ঘুঁটেকুড়ানি দাসী বলে আখ্যা দেয়া মেয়েটিকে এখন মা’ বলে সম্বোধন করছেন? বিনা বেগম একমনে বলে চলেছেন,

–তা মা এখন কি এভাবে থাকলে চলে বল্?এইযে এত রূপ তোর এভাবে হেলায় হেলায় নষ্ট করছিস? কোথায় নিজের যত্ন নিবি তা না।বিয়ের বয়স হয়েছে।এখন সাজগোজ করবি না তো কখন করবি বল?

–বিয়ে! মামীর ভালো আচরণের অর্থ এবার একটু একটু পরিষ্কার হতে থাকে তন্দ্রার কাছে।তবে কি মামী ওকে বিয়ে দিতে চাইছেন? বিনা বেগম তন্দ্রার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলেন,

–তা হ্যাঁ রে তোর জন্য না একটা ভালো পাত্র দেখেছি।

–পাত্র… তন্দ্রা মুখ থেকে একটা শব্দ বের করতেই বীণা বেগম তাড়া দিয়ে বলেন,
-হ্যাঁ রে বিশাল বড়োলোক।বাড়ি গাড়ি সব আছে।একদম রাজার পুত্তর।

তন্দ্রা একটু আমতা আমতা করে বলে,
–কিন্তু মামিমা আমি যে এখনো ভার্সিটিতে পড়ছি।আমি পড়া শেষ করে চাকরি করতে চাই।

–আরে করবি তো চাকরি।বিয়ের পর জামাই বাবা কি তোকে চাকরি করতে দেবে না নাকি?পড়ালেখা করবি চাকরি করবি সব হবে।কিন্তু এমন ভালো পাত্র হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাবি না।আর তাছাড়াও জামাই বাবার পরিবারে কেউ বেঁচে নেই।তাই তোকে শশুর শাশুড়ীর কথাও শুনতে হবে না। যত্ন-আত্তি করতে হবে না।খালি জামাই বাবার খেয়াল রাখবি আর পড়ালেখা করবি।তুই আর অমত করিস না মা।

–মা তো ঠিক বলছে তন্দ্রা, হাতে বেশ কিছু গয়নার বাক্স নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে তন্দ্রার মামাতো বোন মাইশা।আর তুই তো জানিস না তোর বিয়ে কার সাথে হতে যাচ্ছে,তাই এখন কিন্তু কিন্তু করছিস।যখন জানবি তখন দুই চোখ কপালে উঠবে,আর বলবি কখন বিয়ে হবে আমার।

তন্দ্রা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–কার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে?

মাইশা একটা বিজনেস ম্যাগাজিন তন্দ্রার চোখের সামনে তুলে ধরে বলে,
–এই দেখ শহরের সবচেয়ে বড় বিজনেসম্যান নীলাদ্রির সাথে তোর বিয়ে হতে যাচ্ছে।তুই জানিস নীলাদ্রি কত মেয়ের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে? আর সেই নীলাদ্রির একমাত্র রানী হতে যাচ্ছিস তুই।

তন্দ্রা ম্যাগাজিনটা ভালো করে দেখে। ম্যাগাজিনের কভার পেজে একজন সুদর্শন পুরুষের ছবি দেয়া।হালকা কোঁকড়া চুল,গালে চাপ দাড়ি,ধূসর চোখ,জিম করা দেহ।সব মিলিয়ে মাইশা দি যা বলেছে তার সাথে মিলে যাচ্ছে।এই তাহলে নীলাদ্রি।কিন্তু এমন পুরুষ কেন বিয়ে করতে চাচ্ছে তন্দ্রাকে? তন্দ্রা তো কোনো দিক দিয়েই নীলাদ্রির যোগ্য নয়।এত বড়ো বিজনেসম্যানের সাথে তন্দ্রার বিয়ে হবে এটা তো সে কল্পনাও করেনি।সে ভেবেছিল তার বিয়ে হবে কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভার,রাজ মিস্ত্রি কিংবা কোনো সামান্য অফিসের কেরানির সাথে। মামীও তো তাকে সেটাই বলেছিলেন। তাহলে আজ হঠাৎ সব এত বদলে গেলো কেন?

–এই দেখ দেখ এই হারটা, সুন্দর না? মামী তন্দ্রার চোখের সামনে একটা ভারী সোনার হার তুলে ধরেন।নে নে পরে দেখ।

তন্দ্রা কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে হারটা।এমন হার সে পরবে এটা তো তার কল্পনার বাইরে ছিল।আর এই হারটা তো মামীর হার।তিনি এটা সযত্নে তুলে রেখেছিলেন মাইশার বিয়েতে দেবার জন্য।আর এখন সেটা তন্দ্রাকে দিয়ে দিচ্ছেন?তন্দ্রা ছল ছল চোখে তাকায় তার মামীর দিকে।মামী সত্যিই এত ভালো? তার জন্য এত ভাবেন! তা না হলে কেন এমন সুপাত্রের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে না দিয়ে তাকে তুলে দিচ্ছেন! তন্দ্রা দুহাতে জড়িয়ে ধরে মামীর গলা।বলে,

–মামী আমাকে ক্ষমা করো।এতদিন আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম।আজ বুঝেছি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।

বীণা বেগম তন্দ্রার হাত ছাড়িয়ে বলেন,
–দেখো বোকা মেয়ের কান্ড।তোকে ভালোবাসবেনা কেন রে?তুই কি আমার নিজের মেয়ের থেকে কম নাকি? নে নে চোখ মোছ আর তৈরী হ্। বিয়ের শপিংয়ে যেতে হবেনা? কাল যে বিয়ে।

–কাল!অবাক হয় তন্দ্রা।কালই বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি?

–হ্যাঁ রে ছেলের যে আর তর সইছেনা।ঐযে ফ্রান্স না কি কোথায় যাবে ছেলে বিজনেসের কাজে।ব্যাস্ত মানুষ বুঝিস তো।নে নে আর দেরী করিসনা।মাইশা নে তোরা এবার বেরো।আমার রাজ্যের কাজ পড়ে আছে।কইগো শুনছো? বলি বাড়ি সাজানোর লোক এল? বলতে বলতে বেরিয়ে যান বীণা বেগম।

তন্দ্রা মাইশাকে জিজ্ঞাসা করে,
–আচ্ছা দিদি এমন একজন বড় মানুষ আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইলেন বলতো?

মাইশা বলে,
–তা আমি কি করে জানবো বলতো? হয়তো তোকে কোথাও দেখেছে।আর দেখেই প্রেমে পড়েছে।

–যাহঃ তাও আবার হয় নাকি?কি আছে আমার মধ্যে ? না রূপ না আর কিছু।

–আরে ভাই কে কাকে দেখে কিভাবে প্রেমে পরে তা কি কেউ জানে? তুই নাহয় বাসরঘরে তার কাছ থেকে জেনে নিস্ কেন তোর প্রেমে পড়েছে।চল চল বের হই এবার।রাত হয়ে এলো যে! তন্দ্রাকে একরকম টেনে নিয়ে শপিংয়ের জন্য বের হয় মাইশা।

দোতলার বেলকনিতে দাড়িয়ে তাদের দুজনকে দেখছিলেন বীণা বেগম আর তার স্বামী মানিক হালদার।মানিক হালদার বীণা বেগমকে বলেন,

–কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?

বীণা বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন,
–যা করছি ভালোর জন্যই করছি।আর তোমার এত দরদ কিসের হ্যাঁ? ও তো আর আমাদের নিজের মেয়ে নয়।

–নিজের মেয়ে না হোক আমার বোনের মেয়ে তো।এভাবে জেনেশুনে…

বীণা বেগম দাঁত খেঁচিয়ে উঠেন,
—এই দেখো স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি আমার সিদ্ধান্তে বাধা দেবে না একদম।ওই তো তোমার বোনের মেয়ে।না আছে রূপ না কোনো গুন।ওকে তো রিকশা ড্রাইভারও ঘরে তুলতো না।শুকরিয়া করো যে ওকে ওই নীলাদ্রি চৌধুরীর হাতে তুলে দিচ্ছি।

–কিন্তু একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করে দিবো বীণা?

–পরের মেয়ের জন্য দরদ কত!ওকে ওই নীলাদ্রির হাতে তুলে না দিলে ও এসে আমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে। তখন কিভাবে ঠেকাবে হ্যাঁ?আর বোনের মেয়ে বোনের মেয়ে বলে যদি দরদ দেখাতে যাও না তাহলে তোমাকে মেরে হাত গুঁড়ো করে দেব বললাম।কথাটা মাথায় থাকে যেন।

*****

রাত তখন দেড়টা।তন্দ্রাকে ঠেলে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছে তার মামী।কাল তো বিয়ে।তাই সকাল সকাল উঠতে হবে।বেলা অবধি ঘুমুলে চলবেনা।তন্দ্রা প্রতিদিনই সকাল সকাল এ উঠে।না সকাল নয়, ভোরে উঠে সে।উঠে সবার জন্য জলখাবার বানানো ,ঘর পরিষ্কার করা কাপড় ধোয়া, রাজ্যের কাজ করতে হয় তাকে।সব কাজ শেষ করে তবেই ভার্সিটিতে যায় সে।পৌঁছেও সবার শেষে।কতবার এমন হয়েছে স্যার তাকে ক্লাসে ঢুকতেই দেন নি।আচ্ছা বিয়ের পর কি তার স্বামী তাকে পড়তে দেবে? কেন দেবে না।মানুষটা নিজেই এত শিক্ষিত তার বউকে কি অশিক্ষিত বানিয়ে রাখবে নাকি?আচ্ছা মানুষটা সত্যিই ভালো মানুষ তো? তার মামী এমন একজন বড় মানুষের সাথে তার বিয়ে ঠিক করবেন এটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা তন্দ্রার।কিন্তু ভালো মানুষ না হলে ম্যাগাজিনে নাম ছাপবে কেন? আর ম্যাগাজিনেও তো তাকে নিয়ে খারাপ কিছু লেখেনি।তাহলে নিশ্চয় ভালই হবেন।এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গালের নিচে হাত রেখে ঘুমিয়ে যায় তন্দ্রা।

এদিকে তন্দ্রা ঘুমিয়ে যেতেই চুপিচুপি মাইশার ঘরে যান বীণা বেগম।শাড়ির আঁচল দিয়ে কি যেন আড়াল করে রেখেছেন তিনি।মাইশা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল।বিনা বেগম তাকে ধাক্কা দেন,

–মাইশা,এই মাইশা উঠ।

–কি হয়েছে মা ডাকছ কেন? মাইশার গলায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

–আরে এই উঠে না।দেখ কি এনেছি!

–কি এনেছো? উঠে বসে মাইশা।

–আরে দেখ দেখ এগুলো জীবনে চোখে দেখেছিস? বলে শাড়ির আঁচলের নিচে থেকে অনেকগুলো গয়নার বাক্স বের করে আনেন বীণা বেগম।বাক্সগুলো খুলতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় মাইশার।এ যে হীরের গয়না! কেমন চকচক করছে সব!মাইশা গয়নাগুলো হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে দিতে বলে,

–এত গয়না! এতসব তুমি কোথায় পেলে মা? উত্তেজনায় তার গলা কাঁপছে।

বীণা বেগম বলেন,
–এই সব নীলাদ্রি পাঠিয়েছে তন্দ্রার জন্য। কথাটা শুনেই মুখটা কালো করে

মাইশা বলে,
–ও তাহলে আর আমাকে দেখাচ্ছো কেন? যার গয়না তাকেই দিয়ে এসো।

–আরে ধুর পোড়ামুখী! মেয়েকে ভর্ৎসনা করেন বীণা বেগম।আরে এগুলো তো সব তোর এখন থেকে।ওই ঘুঁটেকুড়ানীকে কচু দেব।ওই কাজের মেয়ের যোগ্যতা আছে এসব পরার? এসব কখনো চোখে দেখেছে ও?

–তাহলে কি করবে? এগুলো তো ওর শশুরবাড়ি থেকে পাঠিয়েছে।ওকে না দিলে তো হুলুস্থূল বাধিয়ে দেবে।

–আরে বোকা মেয়ে, আমার সোনার গয়নাগুলো কি ওই মেয়েকে এমনি দিয়েছি? ঐগুলো পড়িয়েই শশুরবাড়ি পাঠাবো ওকে।ও তো আর জানেনা এই হিরের গয়নার কথা।

–আর ওর শশুড়বাড়ির লোক যদি জানতে চায় হীরের গয়না কেন পরাও নি?

–জানতে চাইলে বলবো তন্দ্রাই হীরের হার পড়তে চায়নি।ওর গলায় চুলকোচ্ছিলো।তাই সোনার গয়না পরিয়ে দিয়েছি।

–আর যদি গয়নাগুলো ফেরত দিতে বলে?

–ছাই দেব।বলবো এখন উঠিয়ে রেখেছি।বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে ফেরত দিয়ে দেবো।তবে আমার মনেহয় না ওরা এত ছোটলোকি করবে।

–ইশ তন্দ্রার কি কপাল! আফসোস করে বলে মাইশা।নীলাদ্রির এত টাকা পয়সা,বাড়ি গাড়ি ব্যাংক ব্যালান্স।ইশ তন্দ্রার জায়গায় যদি আমি ওর বৌ হতাম!

মেয়ের কথা শুনে ধমকে উঠেন বীণা বেগম,
–চুপ চুপ!এমন কথা মুখেও আনবিনা।ওই কাজের মেয়ে হয়তো বড় কোনো পাপ করেছিল।তাই নীলাদ্রির সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে।হাসিমুখে শশুরবাড়ি যাচ্ছে বটে,দ্যাখ্ ওই বাড়ি থেকে আর জিন্দা বের হয় কি না।অমন কথা আর মুখে আনবিনা তুই।হাতকড়া সোনার হলেও না হাতকড়াই থাকে,হার হয়ে যায় না, বলে মেয়েকে মুখ ঝামটা দিয়ে গয়নাগুলো আলমারিতে তুলে রাখেন বীণা বেগম।

চলবে…..