মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-০৩

0
436

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#তৃতীয়_পর্ব
#আয়াত_আফরা

এ আবার কেমন বিয়ে? অবাক হয় তন্দ্রা।সবার মুখের দিকে তাকায় সে।কিন্তু নীলাদ্রির আসা না আসা নিয়ে এদের কারো কোন ভ্রুক্ষেপই নেই।বীণা বেগম তন্দ্রাকে নিয়ে লোকগুলোর সামনের সোফায় বসায়।কাজী বাদে বাকি লোকগুলো একবার ভালো করে দেখে নেয় তন্দ্রাকে।তন্দ্রা অস্ফুটে জিজ্ঞাসা করে,
–উনি আসেন নি?

কাজী বলেন,
–পাত্র বিয়ের সব ফর্মালিটি পূরণ করেছেন।উনি এই রেজিস্টারে সাইন করে পাঠিয়ে দিয়েছেন।এবার আপনি কবুল বলে রেজিস্টারে সই করে দিলেই বিয়েটা হয়ে যাবে।

তন্দ্রা হতবুদ্ধি হয়ে যায়।এই প্রথম সে বর ছাড়া কোনো বিয়ে হতে দেখছে।তাও কিনা তার নিজের বিয়ে। তাই কাজী যা যা বলে সে তাই তাই করে যায়।

–এইযে এখানে সই করুন, বলে কাজী কতগুলো কাগজ এগিয়ে দেয় তন্দ্রার দিকে।

তন্দ্রা রোবটের মতো সই করে দেয় কাগজগুলোতে।সে আগেই বুঝে গেছে এখানে তার মতামতের কোনো মূল্য নেই।এখানে চালক একজনই,নীলাদ্রি চৌধুরী।তার ইশারাতেই সব হবে।সই করা শেষে কাজী একটা কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,

-এটা আপনার কাবিননামা।

তন্দ্রা হাত বাড়িয়ে সেটা নেয়।কিন্তু পড়ে দেখেনা।পাত্রপক্ষের একজন বলে,

-কাবিনের টাকা স্যার আজকেই পরিশোধ করে দেবেন।

-দেখি দেখি কত টাকা,বলেই প্রায় জোর করে তন্দ্রার হাত থেকে কাবিননামাটি কেড়ে নেন বীণা বেগম।সেটা ভালো করে পড়ে টাকার অংক দেখে চোখ কপালে তুলে বলেন,সেকি এত! তারপর নিচু গলায় বলেন, এই কাজের মেয়ে এত টাকা কখনো চোখে দেখেছে?

-এবার আমাদের ফিরতে হবে, বলে বরপক্ষের একজন।বরপক্ষের মধ্যে ইনার বয়স সবচেয়ে বেশি।মানিক হালদার তার হাত ধরে বলেন,

-জুলফিকার সাহেব আমার মেয়েটার খেয়াল রাখবেন।

জুলফিকার নামের ভদ্রলোকটি মাথা হেলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।তন্দ্রার মামা তন্দ্রার কাছে এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত রেখে বলেন,

-ভালো থাকিস মা,সুখে থাকিস।আর পারলে এই অভাগা মামাকে মাফ করে দিস।

শেষের কথাটার অর্থ তন্দ্রা বোঝেনা।শুধু বোবা চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মামার দিকে।চোখ থেকে পিতৃসম মামার জন্য দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।বীণা বেগম তন্দ্রাকে ইশারা করেন বরপক্ষের সাথে যাওয়ার জন্য।তন্দ্রা তার স্যুটকেসটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে।দুটো কালো রঙের গাড়ি নিয়ে এসেছে জুলফিকাররা।একটাতে উঠে বসে তন্দ্রা আর সামনে ড্রাইভারের সিটের পাশে জুলফিকার।অন্য গাড়িটাতে কাজী সহ বাকি দুজন উঠে।গাড়ি চলতে শুরু করে চৌধুরী ম্যানশনের দিকে।

*****

নীলাদ্রি তার প্রাইভেট মীটিং রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।রুমে বসে আছেন আর একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক।চোখে মোটা ফ্রেমের একটা সোনালী চশমা, গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি,গায়ে কালো কোট।ভদ্রলোক একজন উকিল।রুমে এসি চলছে।এরপরও ভদ্রলোকের মুখে হালকা হালকা ঘাম জমেছে।নীলাদ্রি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরে।চৌধুরী ম্যানশনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দুটো কালো রঙের এসইউভি।একটা গাড়ি থেকে নামে নীলাদ্রির দুই প্রধান সহচর বালু আর তৌসিফ।অন্য গাড়িতে থেকে প্রথমে নামে জুলফিকার এরপর ধীরে ধীরে নেমে আসে লাল বেনারসি পরা বছর বিশের একটা মেয়ে।গলায় একটা সোনার হার মাথায় সোনার টিকলি।পরনের বেনারসির রংও খুব একটা উজ্জ্বল নয়।

-এই তাহলে মানিক হালদারের মেয়ে! এত দামি শাড়ি গয়না পাঠালাম তারপরও পরে এল কিনা এইসব ময়লা আবর্জনা।আসলেই কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয়না, চাপা স্বরে কথাগুলো বলে নীলাদ্রি।

মেয়েটার মুখ মায়াবী।মোটকথা একজন পুরুষকে আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট।কিন্তু নীলাদ্রিকে সেসব ছুঁতে পারেনা।সে জানালা থেকে চোখ না সরিয়েই উকিলের উদ্দেশ্যে বলে,

-মিস্টার রহমান দাদুর উইলে কি লেখা আছে?

উকিল মিস্টার রহমান কপালের ঘাম মুছে বলেন,
–স্যার উইলে লেখা আছে আছে আপনার চব্বিশ বছর হওয়ার আগে যদি আপনি বিয়ে করেন তবে আপনার দাদুর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হবেন উনার নাতবৌ মানে আপনার ওয়াইফ।আর যদি আপনি চব্বিশ বছর বয়সের আগে বিয়ে না করেন তাহলে সমস্ত সম্পত্তি চলে যাবে একটা ট্রাষ্টের নামে।

–হুম। তাহলে এই সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র মালিক এখন ওই মেয়েটা?

–জি স্যার।আসলে আপনি একজন মাফিয়া বস এটা জানার পর থেকে আপনার দাদু মিস্টার পূর্বোত্তম চৌধুরী আপনাকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না।তাই হয়তো তিনি চান নি যে উনার এই বিশাল সাম্রাজ্য আপনার হাতে যাক।

-এই উইলের কথা আর কে কে জানে?

-আমি,আপনি আর আপনার দাদু মানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানেনা।

নীলাদ্রি তার লেদার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলে,
–আচ্ছা মিস্টার রহমান পুরো দুনিয়া জানে আমি একজন প্রতিষ্ঠিত বিজনেসম্যান।তাহলে দাদুকে কে বলেছিল যে আমি একজন মাফিয়া বস?এই সম্পর্কে তোমার কি কোনো আইডিয়া আছে?

মিস্টার রহমান একটু ভ্রূ কুঁচকে ভেবে বলেন,
–হয়তো আপনার দাদুর ছায়াসঙ্গী মানিক হালদার।

–এক্সাক্টলি! টেবিলের উপর নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দিয়ে আঘাত করে নীলাদ্রি।চোখ দুটো তার জাবন্ত।যেন এখনি গিলে খেয়ে ফেলবে মিস্টার রহমানকে।

মিস্টার রহমান একটু ভয় পেয়ে যায়।নীলাদ্রি ছেলেটা একজন গ্যাংস্টার।পুরো দুনিয়ার কাছে সে একজন তুখোড় বিজনেসম্যান।কিন্তু মিস্টার রহমান তো জানেন সত্যিটা।কি জানি রেগে গেলে যদি গুলি টুলি করে বসে।একবার ঢোক গিলেন মিস্টার রহমান।নীলাদ্রির দাদু মিস্টার পূর্বোত্তম চৌধুরী মারা যাবার পর তার শেষ উইল নিয়ে নীলাদ্রির কাছে আসেন মিস্টার রহমান।না এসেও উপায় ছিলোনা।পরবর্তীতে এই উইলের খবর জানাজানি হলে নীলাদ্রি তাকে হয়তো খুন কিরে ফেলতো।নীলাদ্রি একমনে বলে চলেছে,

–ওই মানিক হালদার,ও সব জেনে গিয়েছিলো আমার ব্যাপারে।এরপর সবকিছু এসে বলে দিয়েছিলো দাদুকে।ওর জন্য, একমাত্র ওর জন্যই আমার আর দাদুর মধ্যে একটা দেয়াল তৈরী হয়ে গিয়েছিলো।আর তাই দাদু এমন একটা উইল করে গেছেন।এবার দেখো তুমি, ওই মানিক হালদারের মেয়ের সাথে আমি কি কি করি।যে দেয়াল ও আমার আর আমার দাদুর মধ্যে তুলেছিল সেই একই দেয়াল আমি ওর আর ওর মেয়ের মধ্যে তুলে দেবো।আমার যত রাগ,ঘৃনা,অভিযোগ,কষ্ট,ব্যর্থতা সব আমি ঝাড়বো ওর মেয়ের উপর।ওই হালদারের প্রতিশোধ আমি নেবো ওই মেয়ের উপর।মেয়ের কষ্ট দেখে তিল তিল করে মরবে ও।না ওর মেয়ে মুক্তি পাবে আমার এই প্রাসাদ থেকে আর না মুক্তি পাবে আমার দেয়া নরকযন্ত্রণা থেকে।

নীলাদ্রি ক্ষোভে ফুঁসছে।ওর চোখ মুখ কঠিন।সেখানে দয়ার লেশমাত্র নেই।মিস্টার রহমান আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করেন,

–কিন্তু স্যার আমি একটা কথা বুঝলাম না আপনার এক কথাতেই মানিক হালদার কি করে আপনার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো? ও তো সত্যিটা জানে আপনার ব্যাপারে।

নীলাদ্রি একটু ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলে,
–কি করে রাজি হতোনা বলো তো? আমার দাদুর অলক্ষে ও লকার থেকে পাঁচ কোটি টাকা সরিয়েছিলো।দাদু জানতে পারেনি।কিন্তু আমার চোখ ফাকি দেয়া কি এত সহজ? ওই পাঁচ কোটি টাকা তো ও সারা জীবনেও শোধ করতে পারতোনা।জেলেই যেতে হত ওকে।তাই আমি কেবল ওই পাঁচ কোটির বিনিময়ে ওর মেয়েকে চেয়েছিলাম।মেয়ে দাও আর পাঁচ কোটি মাফ।ও জেলে গেলে হয়তো আমার প্রতিশোধ কিছুটা পূর্ন হতো কিন্তু আমি ওকে সেই কষ্ট দিতে চাই যেটা ও আমাকে দিয়েছে আমার আপনজনকে পর করে দিয়ে।

–সব ঠিক আছে তবে স্যার আমি আর একটা কথা বুঝলাম না।আপনার প্ল্যানটা কি? মানে এখন সব সম্পত্তি তো ওই মেয়ের নামে হয়ে গেলো।

নীলাদ্রি মিস্টার রহমানের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
–ওই মেয়ের থেকে প্রপার্টি আমার নামে লিখিয়ে নিতে আমার জাস্ট দু মিনিট লাগবে, জাস্ট দু মিনিট।তুমি আজকের মধ্যেই কাগজপত্র তৈরী করে ফেলো।কালকেই এই সম্রাজ্য তার আসল মালিককে দেখতে পাবে।

এমন সময় মিটিং রুমে প্রবেশ করে জুলফিকার।সে বলে,
–স্যার ওই মেয়েকে নিয়ে এসেছি।

কথাটা যেন গরম সিসার মতো প্রবেশ করে নীলাদ্রির কানে।সে গর্জন করে উঠে,
–তো কি করবো আমি? ফুলশয্যা করবো? সংসার করবো? প্রেমলীলা করবো?

জুলফিকার তথমতঃ খেয়ে বলে,
–না মানে স্যার..

তার কথা শেষ না করতে দিয়েই নীলাদ্রি বলে,
–ওই মেয়েকে বাকি সার্ভেন্টদের কাছে নিয়ে যাও।ওদের বলে দিয়ো এই মেয়ে এই বাড়ির নতুন চাকরানী।এই কথাটা ওই মেয়ের মাথাতেও ঢুকিয়ে দিয়ো।ও শুধু একজন কাজের লোক।কোনো বিয়ে টিয়ে হয়নি।এগুলো শুধু একটা খেলা ছিলো।আমি শুধু নতুন স্টাইলে নতুন কাজের লোক নিয়ে এসেছি।আর হ্যাঁ কেউ যদি ওই মেয়ের উপর কোনো দয়া দেখাতে যায় তাহলে আমি ওদের কি অবস্থা করতে পারি সেটাও ওদের বুঝিয়ে দিয়ো।

–আচ্ছা স্যার, বলে চলে যায় জুলফিকার।তার পিছন পিছন বেরিয়ে যায় মিস্টার রহমান।
নীলাদ্রি চেয়ারে হেলান দিয়ে গুনগুন করে উঠে,
‘I can see you from behind’.

*******

এদিকে তন্দ্রাকে নিয়ে বরপক্ষ বেরিয়ে যেতেই তার মামা বাড়িতে হাসির রোল উঠে।বিনা বেগম হাসতে হাসতে বলেন,

-কেমন দিলাম হ্যাঁ? খুব শখ ছিল আমার মেয়েকে বিয়ে করে তার উপর শোধ তুলবে।কেমন কাজের লোক গোছিয়ে দিলাম।কি ভেবেছিল ওই নীলাদ্রি চৌধুরী,আমরা বোকা? ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? ও কেন আমাদের মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে আমরা কিচ্ছু বুঝবোনা?এবার ওই কাজের মেয়ে নিয়ে যা খুশি করুক গে।

মানিক হালদার বলেন,
–এটা কি ঠিক হলো? আমরা জেনে শুনে তন্দ্রাকে অমন একটা খারাপ ছেলের হাতে তুলে দিলাম।ওর জীবনটা তো নষ্ট হয়ে গেলো।

–তো কি হলো তাতে? এমনিতেও আমরা ওর জন্য অনেক করেছি।ওই মেয়েরও তো দায়িত্ব আছে আমাদের জন্য কিছু করার।যদি ওই মেয়েকে নীলাদ্রির সাথে বিয়ে না দিতাম তাহলে তোমাকে জেলে যেতে হতো সে খবর আছে তো?এখন দেখো পাঁচ কোটি টাকাও তুমি পেলে, জেলের ঘানিও টানতে হলো না আর আমার মেয়েকেও ওর সাথে বিয়ে দিতে হলোনা।ওই মেয়ে যে এভাবে কাজে লাগবে সেটা কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি।আমাদের উপকারই করেছে স্বীকার করতে হবে।

–ওর জীবন এভাবে নষ্ট করে আমরা কি সুখে থাকবো বীণা?

–ওসব আমি বুঝিনা।আমি বুঝি টাকা থাকলেই সুখ কিনা যায়।আর আমি তাই কিনবো।ওই মেয়ে মরলো কি বাঁচলো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না,কিচ্ছু না।

চলবে…….