মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-০৪

0
414

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_০৪
#আয়াত_আফরা

তন্দ্রা চৌধুরী ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো।কত্তো বড়ো বাড়ি!যেনো কোনো প্রাসাদ।এত বড় বাড়িতে বউ হয়ে আসবে সেটা তো সে কল্পনাও করতে পারেনি কোনোদিন।কি জানি এখানকার মানুষেরা কেমন?এখনো তো তার স্বামীর সাথেও দেখা হলোনা।জুলফিকার সাহেব সেই যে ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে গেলেন এখনো তো আসছেন না।তন্দ্রা ঘাড় উঁচিয়ে একটু উঁকি দেয়।এমন সময় জুলফিকার বাইরে এসে তন্দ্রাকে বলেন,

–তোমার স্যুটকেস নিয়ে নাও।ভেতরে চলো।

তন্দ্রা স্যুটকেসেটা নিয়ে জুলফিকার সাহেবের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে।মনে তার ভয় আর লজ্জা মিশ্রিত অদ্ভুত অনুভুতি কাজ করছিলো।জুলফিকার সাহেব নিশ্চই এবার তাকে তার স্বামীর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন।নীলাদ্রির সাথে দেখা হলে তাকে কি কি বলবে মনে মনে সেটা ভেবে নেয় তন্দ্রা।গুছিয়ে বলতে পারবে তো সবকিছু নীলাদ্রির সামনে? যদি গন্ডগোল করে ফেলে? নীলাদ্রি কি রাগ করবেন তার উপর? ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে তন্দ্রা দেখে জুলফিকার সাহেব তাকে তার স্বামীর কাছে নিয়ে না গিয়ে কয়েকজন মহিলার সামনে নিয়ে আসেন।মহিলাগুলোকে দেখলেই বোঝা যায় ওরা এই বাড়ির চাকরানী।প্রত্যেকের পরণে সালোয়ার কামিজ আর কামিজের উপর ঘিয়ে রঙের এপ্রোন।তন্দ্রা অবুঝ চোখে তাকায় জুলফিকারের দিকে।জুলফিকার চাকরানীগুলোর সর্দারনীকে বলেন,

–বিনতি ও এ বাড়ির নতুন চাকরানী।ওকে তোমাদের সাথে রাখো আর কি কি করতে হবে বুঝিয়ে দাও।

বিনতি তন্দ্রাকে ভালো করে দেখে বলে,
–চাকরানী! তাহলে এই সঙের পোশাক কেন পড়েছে? কোনো যাত্রাপালা থেকে এসেছে নাকি?

–এত শত জেনে কি হবে? চাকরানী, কাজ বুঝিয়ে দিবে ব্যাস।আসি আমি,বলে জুলফিকার তন্দ্রাকে সেখানে রেখে চলে আসে।তার বেশ খারাপ লাগে মেয়েটার জন্য।এই বয়সী তারও একটা মেয়ে ছিল।বিয়ের পর স্বামীর অত্যাচারে মরেছিল বেচারি।ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে জুলফিকারের।

তন্দ্রা তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না।তার তো এ বাড়িতে বিয়ে হলো।নীলাদ্রি স্যার তো তাকে বিয়ে করলেন।তাহলে এখন সবাই তাকে চাকরানী কেন বলছে? তাহলে কি তারই বুঝতে ভুল হয়েছে? আসলে মামা মামি তাকে এই বাড়িতে চাকরানী করেই পাঠিয়েছেন?তাই হবে হয়তো।তাই তো বিয়েতে কোনো আয়োজন ছিলোনা,আনন্দ ছিলোনা এমনকি বরও তো যায়নি।কিন্তু এমন করে চাকরানী আনার কি মানে?হয়তো নীলাদ্রি স্যার এর কোনো শখ হবে।হয়তো এভাবেই তিনি কাজের লোক নিয়ে আসেন।তাহলে কাবিন নামা? সেটার কি মানে? ও! নিশ্চই ওটা ওর প্রাপ্প স্যালারী।হয়তো এভাবেই স্যার স্যালারি দিয়ে থাকেন।নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই মনে মনে গালি দেয় তন্দ্রা।ইশ সেও না কত বোকা!কি হচ্ছিল আর সে কি ভাবছিল!এত সেজেগুজে আসার জন্য এবার খুব লজ্জা লাগতে শুরু করলো তন্দ্রার।জুলফিকার চলে যেতেই বিনতি তন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করলো,

–তা কাজ কর্ম কিছু পারো?

তন্দ্রা উপর নিচে ঘাড় নাড়ায়।

–কি কি পারো শুনি?

–আপনি যা বলবেন তাই করে দেব।

–হু।এ বাড়িতে সব কাজের জন্যই লোক রাখা আছে।স্যার যে কেন আবার তোমাকে নিয়ে এলেন সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছেনা।তা কাপড়-চোপড় কিছু এনেছো?

–জি,তন্দ্রা ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দেয়।

–যাও কাপড় পাল্টে এস।আচ্ছা সত্যি কি তুমি কোনো যাত্রাপালা থেকে এসেছো?বেশভূষা এমন কেন তোমার?

বিনতির কথার জবাবে নিরুত্তর থাকে তন্দ্রা।কেন যে সব এমন হলো সেটা তো তারও জানা নেই। বিনতি একজন চাকরানীকে ডেকে বলে,

–প্রিয়া,যা ওকে ওর ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে আয়।

প্রিয়া নামের চাকরানীটি তন্দ্রাকে নিয়ে সে বাড়ির নিচতলার প্যাসেজের শেষে কিছু কক্ষের কাছে নিয়ে যায়।কক্ষগুলো একের পর এক পরপর তৈরী করা হয়েছে।ঠিক যেনো কবুতরের খোপ।আয়তনেও খুব একটা বড় নয়।তন্দ্রা বুঝলো যে কক্ষগুলো নীলাদ্রির চাকরানীদের জন্যই তৈরি হয়েছে।প্রিয়া এর মধ্যে একটা কক্ষ দেখিয়ে তন্দ্রাকে বললো,

–এটা তোমার ঘর।জলদি কাপড় বদলে এসো।বিনতি দি তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবেন।

তন্দ্রা একপাশে ঘাড় কাত করে প্রিয়ার কথায় সম্মতি জানায়।একটু এগুনোর পর প্রিয়া কি একটা মনে হতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়।এরপর পেছন ঘুরে তন্দ্রার দিকে একটা চাবি ছুড়ে দিয়ে বলে,

–ওঃ তোমার কক্ষের চাবিটা।

প্রিয়ার ছুড়ে দেয়া চাবিটা লুফে নিতে ব্যর্থ হয় তন্দ্রা।সেটা উড়ে গিয়ে পরে প্যাসেজের এক কোনায়।তন্দ্রা সেটা তুলে নিয়ে কক্ষের তালা খুলে ভেতরে যায়।কক্ষের ভেতরটা ছোট হলেও অবস্থা মোটেও শোচনীয় নয়।একটা পালংক, ড্রেসিং টেবিল আর একটা কাঠের দেরাজ পাতা আছে। কক্ষের এক কোনায় আছে একটা পোর্টেবল রিডিং টেবিল।তন্দ্রা নিজের স্যুটকেসটা টেনে এনে নিজের পালংকের উপর রাখে। স্যুটকেসটা কি মাইশা দি কে আবার ফেরত দিতে হবে? দিয়ে দেয়াই ভালো।মামা বাড়িতে যখন যাবে তখন সে এটা ফেরত দিয়ে আসবে মাইশা দি কে।তার কাপড় যত্সামান্য।ব্যাবহার্য জিনিসপত্রও নিতান্তই অল্প।তন্দ্রা কাপড় বদলে একটা শাড়ি পরে।শাড়িটা সে আসার সময় তার মামীর কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল।নতুন বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে।একটা শাড়ি না থাকলে কি ভালো দেখায়? যদিও ব্যাপারটার জন্য এখন নিজেরই লজ্জা লাগছে তার।শাড়ি পরে চুলে খোঁপা করে যখন সে বিনতির সামনে আসে দাড়ায় তখন বিনতি রাতের খাবারের মেন্যু ঠিক করতে ব্যস্ত।তন্দ্রা আসে দাড়াতেই সে , –একটু দাড়াও, বলে কাকে যেনো ল্যান্ডফোনে ডায়াল করে।ওপাশ থেকে যখন ফোনটা রিসিভ করা হয় তখন বিনতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

–হ্যালো তৌসিফ জি নীলাদ্রি স্যার কি আছেন? আসলে আমি রাতের মেন্যূ কি হবে জানতে চাইছিলাম।

ওপাশ থেকে কিছু একটা উত্তর ভেসে আসে।এক মিনিট বিরতিতে আবার বিনতি বলে,
— ওকে স্যার।তাই করবো, বলে ফোন রেখে দেয় বিনতি।এরপর পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চাকরানীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–নীলাদ্রি স্যার বেরিয়ে গেছেন।রাতে ফিরবেন কি না বলে যান নি।

চাকরানীটি ঠোঁট চেপে ধরে বলে,
–তাহলে তো মুশকিল হলো দেখছি।এখন রান্না কি করতে হবে স্যারের জন্য?

বিনতির মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে।সে বলে,
–এক কাজ করো স্যারের জন্যও রান্না করে ফেলো।যদি ফিরেন তাহলে খেয়ে নেবেন।

–কি রান্না করবো? জিজ্ঞাসা করে রাধুনী চাকরানীটি।

বিনতি একটু ভেবে বলে,
–মাটন,ইলিশ, ভেজিটেবল সালাদ, মুগ ডাল আর মাশরুম স্যুপ।আমার মনেহয় এতেই হবে স্যারের।

–সাদা ভাত রান্না করবো?

–হ্যাঁ ভাতই রান্না করো।

–আচ্ছা, বলে চলে যায় রাধুনী।

তন্দ্রা মেন্যু শুনে একটু অবাক হয়।এত বড়লোক বাড়ির খাবারের সে একটু বৈচিত্র্য থাকবে ভেবেছিল।আহামরি তেমন কিছু নেই দেখে সে যারপরনাই অবাক হয়।বিনতি তন্দ্রার মুখ দেখে বুঝতে পারে সে বেশ অবাক হয়েছে।তাই সে একটু মুচকি হেসে বলে,

–মেন্যূ শুনে অবাক হয়েছি বুঝি? আসলে স্যারের খাবারের ব্যাপারে তেমন একটা বাছ-বিচার নেই।একটা হলেই হলো।তবে এটা সব সময়ের রুটিনে নয়।যেদিন স্যার বাসায় ডিনার করেন সেদিন তিনি সব মেন্যু বলে দেন।তখন খাবারের একটু বেশকম হলেই খুব রেগে যান। তবে আজ যেহেতু বলে যান নি তাই কি রান্না হলো সেটা নিয়ে রাগারাগি করবেন না।হয়তো বাইরে খেয়ে আসতে পারেন অথবা বাড়ি নাও ফিরতে পারেন।

তন্দ্রা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করে,
–বাকিদের জন্য কি রান্না হবে?

–এ বাড়িতে সবার জন্য একই খাবার রান্না হয়।যা স্যার খেতে চান সেটাই সবার খেতে হয়।

তাদের কথার মধ্যে তন্দ্রা একটি পুরুষকে বেরিয়ে যেতে দেখতে পায়।পুরুষটি তৌসিফ।এতক্ষণে তকে চিনে গেছে তন্দ্রা।বিনতি তন্দ্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,

–ও তুমি একটা কাজ করো উপরে যে ঘরগুলো আছে সেখান থেকে কাপ পিরিচগুলো নিয়ে আসো।উপরে বালু জি আর তৌসিফ-জির কামরা আছে।তবে ভুল করেও নীলাদ্রি স্যারের কামরায় যেয়োনা।

তন্দ্রা আমতা আমতা করে বলে,
–বিনতি দি আমি তো নতুন এসেছি।কি করে বুঝবো কোনটা নীলাদ্রি স্যারের কামরা?

–স্যারের কামরার বাইরে নামপ্লেট লাগানো আছে।ওই কামরায় যাবেনা এমনকি ওই কামরার দরজা খুলে উঁকিও মারবেনা।মনে থাকবে?

তন্দ্রা সুবোধ বালিকার মত মাথা নাড়ে।

–হু যাও।আর সাবধানে কাজ করো।কাপ পিরিচ যাতে না ভেঙ্গে।

তন্দ্রা সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়।তার বুক একটু একটু কাঁপছিল।কি বিশাল বাড়ি।যদি সে পথ হারিয়ে ফেলে? তন্দ্রা চলে যেতেই বিনতি নিলাদ্রির শিডিউলটা নিয়ে দেখতে থাকে।নীলাদ্রির একটা শিডিউল থাকে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি তুলয়ের কাছে আর একটা থাকে বিনতির কাছে।তবে শিডিউল দুটি অবশ্য ভিন্ন। তুলয়ের শিডিউলে থাকে অফিস আর মীটিং সংক্রান্ত নির্দেশনা আর বিনতির শিডিউলে থাকে নীলাদ্রির আসা যাওয়া কিংবা কোনো গ্রোসারি সম্পর্কিত নির্দেশনা।শিডিউল দেখতে দেখতে বিনতি তার পাশে থাকা একজন সুন্দরী চাকরানীকে জিজ্ঞাসা করে,

-এই নতুন মেয়েটি বেশ ভালো কি বলিস সৃষ্টি?

সৃষ্টি একটু মুখ বেঁকিয়ে বলে,
–ভালো, কি করে বুঝলে বিনতি দি?এই কছুক্ষন হলো তো এসেছে।

–আরে দেখছিস না চেহারায় কেমন মায়া উপচে পড়ছে।চোখ দুটি কি সরল।

–হ্যাঁ তুমি চেহারা দেখে সব বুঝে গেছ তাইনা?অনেক চোরদের চেহারাও সরল থাকে।উপরে উপরে দেখে বিচার করোনা।মাত্র তো কাজে গেলো।দেখো কোথায় কি সরাচ্ছে।

–যা তোর সবেতেই সন্দেহ।

–আমি বলছি চোখে চোখে রাখো।কিছু চুরি গেলে নীলাদ্রি স্যার আমাদের কচুকাটা করবেন।

–আমাদের কেন দোষ হবে? স্যার নিজেই তো ওকে আনলেন।

–যা বলেছো।এত চাকরানী থাকতেও স্যার এই মেয়েটাকে আবার কেন আনলেন? তাও আবার মেয়েটার বেশভূষায় তেমন সুবিধার লাগছিলো না।কিছু তো একটা আছে যেটা আমাদের থেকে লুকানো হচ্ছে।

–এত জেনে কাজ নেই বাপু।বড় লোকদের ব্যাপার।আমাদের কাজ করা নিয়ে কথা।কাজ কর, কাজ কর।

দ্বিতীয় তলায় তন্দ্রা তিনটে কামরা দেখতে পায়।দুটো কামরা পাশাপাশি।সেগুলোর দরজা খোলা।অপর কামরাটি এই দুটি কামরা থেকে একটু দূরে।তার দরজা বন্ধ।তন্দ্রা একটু এগিয়ে দেখতে পায় সেই দরজার উপর নীলচে একটা নেমপ্লেটে লেখা, ‘নীলাদ্রি আহনাফ চৌধুরী’। তন্দ্রার বুঝতে অসুবিধা হয়না এটা নীলাদ্রির কক্ষ। কক্ষটির সামনে আসতেই বুকটা কেমন যেনো ধড়াস করে উঠে তন্দ্রার।সে দ্রুত সেই দরজার সামনে থেকে সরে বাকি দুটো কামরার একটিতে প্রবেশ করে।ঘরটিতে একটা বিশাল পালঙ্ক ,একটা 42’ টিভি,একটা বিশাল আয়না এবং ওয়াল আলমিরা রয়েছে।পাশে একটা বেলকনিও দেখা যাচ্ছে।দেয়ালে লাগানো আছে বিশাল এসি।দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি দেখে তন্দ্রা বুঝতে পারে এটা তৌসিফের ঘর।বেশ কয়েকটা ছবি টাঙানো আছে তৌসিফের।আর সাথে লাগানো আছে অনেক বন্দুক ,রাইফেলের ছবি। তন্দ্রা একটু বিরক্ত হয়।এসব ছবি কেউ ঘরে টাঙায়?সে বেডসাইড টেবিলে থাকা চায়ের কাপ পিরিচ তুলে নিয়ে দ্রুত সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।পরবর্তী ঘরটার কাঠামোও ঠিক আগেরটার মতোই।শুধু পার্থক্য এই ঘরের দেয়ালে বালুর ছবির সাথে টানানো আছে বিভিন্ন দেশের পতাকা আর ফুটবল টিমের ছবি।যাক বালু বোধহয় তৌসিফের মতো অত খারাপ না।সেই কক্ষ থেকেও কাপ পিরিচ উঠিয়ে নেয় তন্দ্রা।তার এই বাড়িতে কাজ করতে বেশ ভালোই লাগছে।মামা বাড়িতে সে কাজ করেও শান্তি পেতোনা।তাদের বাড়িটা খুব ছোট ছিল।একটু গতোর নাড়িয়ে কাজ করতে গেলেই এটা ওটা পরে যেত।কিন্তু এই বাড়িটা কি বিশাল।এখানে সে ছুটোছুটি করেও কাজ করতে পারবে।তন্দ্রা নিচে নেমে আসতেই তার হাত থেকে কাপ পিরিচগুলো নিয়ে বিনতি বলে,

–যাও এবার নীলাদ্রি স্যারের কক্ষটা গুছিয়ে দিয়ে এসো।

বিনতির কথা শুনে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে তন্দ্রা।একটু আগে যে কক্ষের সামনে যেতেই তার বুক কেঁপে উঠেছিলো এখন কিনা সেই কক্ষ গুছাতে হবে! বিনতি তন্দ্রাকে আদেশ দিয়ে রান্নাঘরে যেতেই সৃষ্টি একটু ভ্রূ কুঁচকে তাকে জিজ্ঞাসা করলো,

–তুমি ওই নতুন মেয়েটাকে নীলাদ্রি স্যারের ঘর পরিষ্কার করতে বললে কেন?ও কি করে ওসব করবে? তুমি জানো না স্যারের ঘর গুছানোর কত নিয়ম আছে?

বিনতি কাপ পিরিচগুলো বেসিনে রেখে বলে,
–তুই যে একটু আগে সন্দেহ করছিলি ওই মেয়েকে তাই ওকে এই কাজ দিলাম।এখন দেখা যাক ও কতটা বিশ্বাসযোগ্য।আর নিয়ম?সেটা তুই একটু ওকে বুঝিয়ে দে না।তুই তো রোজ নীলাদ্রি স্যারের ঘর পরিষ্কার করিস।আমার হাতে মেলা কাজ।নয়তো আমিই বুঝিয়ে দিতাম।

সৃষ্টি মুখ কালো করে সেখান থেকে চলে আসে।সে দেখে তন্দ্রা এখনো থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।সে তন্দ্রার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,

–দাঁড়িয়ে আছো যে ,স্যারের কামরা পরিষ্কার করতে হবে তো।

তন্দ্রা আমতা আমতা করে বলে,
–কি করতে হবে যদি একটু বুঝিয়ে বলতে…

–শুনো প্রথমে দরজায় গিয়ে তিনবার নক করবে।

–কেন? ঘরে তো কেউ নেই।

–এটাই নিয়ম।স্যার কখন আসেন কখন যান সেটা বলা খুব মুশকিল।হয়তো তুমি দেখছো স্যার আসেন নি কিন্তু হতে পারে স্যার তার কামরাতেই আছেন।স্যার খুব সাবধানী।আমাদের চোখ এড়িয়ে ঘরে ঢুকাটা অসম্ভব কিছু না।তাই ঘরের দরজায় নক করবে প্রথমে।যদি ভেতর থেকে জবাব আসে তাহলে চলে আসবে।আর যদি না আসে তাহলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকবে।

–আচ্ছা।

–এরপর চেক করবে ঘরের মেঝেতে কোনো কাঁচের টুকরো পরে আছে কিনা।

–সেটা কেন?

–আসলে স্যার অনেক রাগি তো ,রেগে গেলে হাতের কাছে যা পান সেটাই ছুড়ে ফেলেন মেঝেতে।তাই ভাঙা কাঁচ পরে থাকতে পারে।ঘরে পা রাখার আগে সেটা চেক করে নেবে।

-ঠিক আছে।

-এরপর দেখবে বিছানায় কোনো ভেজা তোয়ালে আছে কিনা।এটা স্যারের অভ্যাস স্নান শেষে ভেজা টাওয়াল বিছানাতে ফেলে রাখেন।

এই কথাটা শুনে হাসি পায় তন্দ্রার।এতক্ষন যে পয়েন্টগুলো সৃষ্টি বলেছে সেগুলো শুনে নীলাদ্রিকে অনেক রাগি গম্ভীর মনে হলেও এই পয়েন্টটা শুনে কেনো যেনো তাকে তন্দ্রার অনেক খামখেয়ালি আর বাচ্চা স্বভাবের মনে হচ্ছে।অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে তন্দ্রা।

–শুনো বিছানা চাদর আর বালিশের কভার সরিয়ে নতুন চাদর আর কভার লাগাবে।পুরাতনগুলো ওয়াশিং মেশিনে রাখবে।ওয়াশরুমে কোনো কিছু শেষ হয়ে গেছে কিনা চেক করবে যেমন সাবান ,শ্যাম্পু,কোল্ড ক্রিম।শেষ হয়ে গেলে এসে জানাবে।পুরো ঘর ঝাড়ু দেবে, মুছবে।প্রত্যেকটা জিনিসপত্র মুছে রাখবে।একটু ধুলো যেন না থাকে।স্যারের একটা গিটার রাখা আছে।খেয়াল রাখবে সেটা মোছার সময় যেনো একটু আঁচড় বা দাগ না লাগে।সেটা স্যারের খুব প্রিয়।

–আচ্ছা।

–আর হ্যাঁ শোন, কামরায় একটা শেলফে দেখবে অনেকগুলো বই রাখা আছে।তার মধ্যে অতি পুরোনো কোনো বই থাকলে সেটা ফেলে দেবে।

–আচ্ছা। মাথা হেলিয়ে চলে যায় তন্দ্রা।

একটু দূরেই কাজ করতে করতে সৃষ্টি আর তন্দ্রার কথপোকথন শুনছিল প্রিয়া।এবার সে এগিয়ে আসে উদ্বিগ্ন স্বরে সৃষ্টিকে জিজ্ঞাসা করে,

-এটা তুই কি বললি?

সৃষ্টি একটা ফুলদানি মুছতে মুছতে স্বাভাবিক গলায় পাল্টা জিজ্ঞাসা করে,
–কেন কি আবার বললাম?

–তুই ওই মেয়েটাকে কি বললি?

–ও ওকে? ওকে তো নীলাদ্রি স্যারের ঘর গুছানো নিয়ম বললাম।

–হ্যাঁ কিন্তু শেষে তুই ওটা কি বললি? তুই ওকে স্যারের বই ফেলে দিতে বললি! তুই জানিসনা ওই বইগুলোতে একটু ধুলো জমলেও স্যার কত রাগারাগি করেন? আর তুই কিনা সেগুলো ফেলে দিতে বললি! তুই জানিস ওগুলো ফেলে দিলে কি হবে?

প্রিয়ার উদ্বিগ্নতা সৃষ্টিকে স্পর্শ করতে পারে না।সে সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়,
–জানি বলেই তো বললাম।ওই মেয়ে স্যারের বই ফেলে দেবে আর স্যার ওই মেয়েকেই বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দেবেন।

–এমনটা তুই কেন করছিস?

সৃষ্টি এবার ফুঁসতে থাকে,
–কেন করছি হ্যাঁ? তুই জানিসনা আমি নিলাদ্রি স্যারকে কত পছন্দ করি? তার ঘরে ঢুকার অধিকার কেবল আমার ,কেবল আমার।না আমি স্যারের আশেপাশে কোনো মেয়েকে পছন্দ করি আর না স্যারের কক্ষে।যেহেতু ওই মেয়ে স্যারের কক্ষে গিয়েছে তাই শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে।

–বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর কথা শুনেছিলাম কিন্তু তুই তো বামন হয়ে মঙ্গল গ্রহের দিকে হাত বাড়াচ্ছিস।তুই কেন বুঝিসনা স্যার কখনোই তোকে পছন্দ করবেন না।আরে স্যার তো বড়োলোক সুন্দরীদেরও পাত্তা দেয় না আর সেখানে তুই তার সামান্য চাকরানী।

–আমার বুঝার কোনো দরকার নেই।স্যার যদি আমার না হয় তাহলে স্যারকে আমি আর কারো হতে দেবো না।ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে চলে যায় সৃষ্টি।

প্রিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।ভাবে,কিছু মানুষ এত অবুঝ কেন হয়?

******

তন্দ্রা নীলাদ্রির কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।আবার আগের অনুভুতি হচ্ছে তার।সত্যি যদি নীলাদ্রি স্যারের সাথে তার বিয়ে হতো তাহলে হয়তো এটা তার কামরাই হতো।কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় নক করে তন্দ্রা।মনের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার।যদি ভেতর থেকে কেউ বলে উঠে, কেন ডিসটার্ব করছো? যদি কেউ ধমকে উঠে? কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তন্দ্রা বুঝে নীলাদ্রি ভেতরে নেই।সে ধীরে দরজাটা খুলে আগে মেঝের দিকে তাকায়।সেখানে সৃষ্টির কথার প্রমাণ দিয়ে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাঁচের টুকরো।কি ভেঙেছিলো নিলাদ্রি স্যার?দেখে তো কাঁচের বোতল মনে হচ্ছে।কিসের বোতল? মদের! না না তা কি করে হবে?নীলাদ্রি স্যারের মতো মানুষ মদ খেতে পারেন এটা তন্দ্রার বিশ্বাস হয়না।ভাঙা কাঁচগুলো পরিষ্কার করার সময় সেখান থেকে বিজাতীয় গন্ধ এসে ধাক্কা মারে তন্দ্রার নাকে।এটা কি সত্যিই…..আর বেশি না ভেবে তন্দ্রা ভাঙা কাঁচগুলো সরিয়ে ফেলে।

এই কামরাটা দেখে রীতিমত বিস্মিত হয় তন্দ্রা।কামরাটি খুবই বিলাসবহুল।ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর পাতা আছে একটা বিশাল ধূসর বেড।বেডের দুপাশে দুটো বেডসাইড টেবিল।দেয়ালে একটা বিশাল মাথার খুলি আঁকা।দেখেই গা-টা শিরশির করে উঠে তন্দ্রার।একটা বিশাল টিভি,এসি,একটা বুকশেলফ তার পাশে রিডিং টেবিল।টেবিল দেখে বুঝা যায় নীলাদ্রি এখনো পড়তে পছন্দ করে।ঘরের দুপাশে দুটো পর্দা।একটা পর্দা সরিয়ে দেখতে পায় ওপাশে রয়েছে একটা সুইমিং পুল।তার পাশের দেয়ালে নায়াগ্রা ফলসের একটা বড়ো চিত্রকর্ম আঁকা।দেয়াল থেকে ঝুলছে আর্টিফিশিয়াল ভাইন।আরেকটা পর্দা সরিয়ে দেখতে পায় সেখানে রয়েছে বেলকনি।বেশ কিছু মানিপ্লান্ট আর পাতাবাহারের গাছ লাগানো আছে ছোট্ট ছোট্ট টবে।এই কামরার সাথে আর একটা যুক্ত কামরা আছে।সেখানে সোফা আর টিটেবিল রাখা।পুরো কামরার মেঝে মুড়ে দেয়া হয়েছে দামি মোজাইকের আচ্ছাদনে।তন্দ্রা বিছানা চাদর বালিশ কভার পরিবর্তন করে। প্রতিটা জিনিস খুব যত্নসহকারে মুছে।একপাশে থাকা জানালা খুলে তন্দ্রা।জানালার পাল্লা ধরে টানতেই কেমন যেন ক্যাঁচক্যাচ শব্দ হয়।যেনো বহুকাল খোলা হয়নি জানালাগুলো।জানালা খুলতেই দমকা হাওয়ার সাথে মিষ্টি রোদ ঘরে প্রবেশ করে।

সব গুছিয়ে শেষে তন্দ্রা যায় বুকশেলফটার দিকে।শেলফে রাখা বেশিরভাগ বই সাইকো থ্রিলার আর মার্ডার মিস্ট্রি।এছাড়াও ইনভেটরস্ ডিলেমা,জিরো টু ওয়ান-এর মতো বিজনেস নিয়ে লেখা অনেক বইও দেখতে পায়।তন্দ্রা বইগুলো মুছে পরিষ্কার করে জায়গামতো রেখে দেয়।তবে যেসব বিদেশি বইয়ের পাশে রবি ঠাকুরের লেখা সোনার তরী বইটা দেখে অবাক হয় তন্দ্রা।এই বইটাকে অন্য বইগুলোর থেকে বেশি পুরোনো মনে হচ্ছে। সৃষ্টি দি যে বলেছিলো পুরোনো বই ফেলে দিতে।তাহলে কি এই বইটাকে ফেলে দিবে?কিন্তু বই কি করে কেউ ফেলে দিতে পারে? অনেক ভাবনাচিন্তা করে তন্দ্রা সিদ্ধান্ত নেয় বইটা সে নিজের কাছে রেখে দেবে। সে পুরোনো বিছানা চাদর,বালিশ কভার,ভিজা তোয়ালে আর বইটাকে বুকে চেপে ধরে বেরিয়ে আসে নীলাদ্রির কক্ষ থেকে।

চলবে…….