মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-১৫+১৬

0
460

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_১৫
#আয়াত_আফরা

বারফিল্ড এভিনিউ ধরে নীলাদ্রির গাড়িটা চলছে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।আজ তিন দিন পর বাড়িতে ফিরেছে সে।এত দ্রুত ফেরার অবশ্য কথা ছিল না।তবে যে কাজে গিয়েছিল সে কাজটা সহজেই হয়ে গেছে।তাই দ্রুত ফিরতে পেরেছে।বাড়ির সবাই নিশ্চই খুব চমকে যাবে তাকে দেখে।বিশেষ করে তন্দ্রা।এই কয়েকদিন বেশ স্বাধীনতা পেয়েছে মেয়েটা।এখন আবার সময় এসেছে উড়ন্ত পাখিকে খাচায় বন্দী করার।

নীলাদ্রির গাড়ির সাথে সাথে চলছে দুটো একই মডেলের গাড়ি।কখনো একটা অপরটা থেকে এগিয়ে যাচ্ছে কখনো পিছিয়ে।তবে কোনটাই একে অপরকে ছেড়ে যাচ্ছেনা।যাতে নীলাদ্রির গাড়িকে কেউ টার্গেট করে কোনো হামলা না করতে পারে তাই এই ব্যাবস্থা করা হয়েছে।যতই বাড়ির কাছাকাছি আসছে ততই হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে।এমনটা তখনই হয় যখন সে ভয় টয় পায়।কিন্তু সে তো নিজের বাড়ি যাচ্ছে।তাহলে ভয় কেনো পাবে?অদ্ভুত!

বাড়িতে ঢুকে আশেপাশে একবার চোখ বুলালো নীলাদ্রি। তন্দ্রা নেই কোথাও।ওর ভার্সিটি যাবার সময় তো এখনও হয়নি।তাহলে কোথায় গেলো? আছে হয়তো কোথাও। নীলাদ্রি আর বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে চলে এলো নিজের ঘরে।

ঘরে গিয়ে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করলো সে।ঘরের সবসময়ের গুমোট আবহাওয়াটা আজ নেই।জানালাগুলো বন্ধ আছে। এসিও বন্ধ। তার মানে সে যখন ছিলনা তখন প্রতিদিন খোলা হতো এই জানালা।বেলকনির গাছগুলোও বেশি সজীব মনে হচ্ছে। সুইমিং পুলের উপরে দুপাশে দুটো বড় টবে পাতাবাহারের গাছ লাগানো হয়েছে।এ সব নিশ্চই তন্দ্রার কাজ।

একটু পরে সিড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ পেয়ে নীলাদ্রি বুঝলো তন্দ্রা আসছে।বাড়িতেই ছিল তাহলে।

তন্দ্রা ছুটে এসে এক ঝটকায় নীলাদ্রির ঘরের দরজা খুলে ফেললো।

“স্যার!”

নক করতে হবে ,মেঝে দেখতে হবে সব কিছু বেমালুম ভুলে গেছে সে।তার চোখে জল।আচমকা এ অবস্থার জন্য নীলাদ্রি প্রস্তুত ছিলো না।সে তার জামা প্যান্ট ছাড়তেই যাচ্ছিল।দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সব আবার ঠিকঠাক করে নিল।সে ভেবেছিল তন্দ্রা প্রতিদিনের মত দরজা নক করবে।কিন্তু এ তো দুদিনে সব ভুলে বসে আছে।হলোটা কি এর?

“কি হয়েছে?এভাবে ঘরে ঢুকলে কেনো?আমি মাত্র বাড়ি ফিরলাম আর তোমার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো! হয়েছে টা কি?”

“স্যার লিও কে বলুন না আমার পাখিটাকে ছেড়ে দিতে।ও মেরে ফেলবে ওটাকে।”

“পাখি!কিসের পাখি?”

“আমি একটা পাখিকে খাবার দিতাম স্যার।আজ লিও ওটাকে কামড়ে ধরেছে।ওকে বলুন না ছেড়ে দিতে।”

“তাই নাকি! লিও! কাম হিয়ার।”

বাড়ি কাঁপিয়ে হুংকার দিল নীলাদ্রি।মনিবের হুংকার শুনে তন্দ্রার ঘর থেকে ছুটে এলো লিও।তার মুখে তখনও ধরা আছে ছোট্ট চড়ুইটা।

“স্যার স্যার বলুন না ওকে ছেড়ে দিতে।” অধৈর্য্য হয়ে বললো তন্দ্রা।

“লিও, হোয়াট’স দিস বেব?”

লিও তখনও কামড়ে ধরে রইলো পাখিটাকে।

“স্যার প্লীজ ওকে ছেড়ে দিতে বলুন।ও মরে যাবে ।আমি ওকে খুব ভালোবাসি।”

“কি!ভালোবাসো?”

“হ্যাঁ স্যার।”

মুহূর্তেই বদলে গেলো নীলাদ্রির শান্ত চেহারা। তার মুখে ফুটে উঠলো একটা ক্রুর হাসি।

“লিও!”

নীলাদ্রির মুখে নিজের নামটা শুনে লিও মুখে পাখিটাকে নিয়ে আদেশের আশায় তাকিয়ে রইলো মনিবের মুখের দিকে।তন্দ্রাও অধীর আগ্রহে নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কখন সে বলবে পাখিটাকে ছেড়ে দিতে।নীলাদ্রি নিষ্ঠুর হাসি হাসলো।

“লিও, কিল ইট বেব!”

আর কিছু বলতে হলো না।আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই পাখিটার টুটি চেপে ধরে ধড় মস্তক আলাদা করে ফেললো লিও।

“না!”

তন্দ্রা চিৎকার করে বসে পড়ল মেঝেতে।তার চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তে লাগলো।লিও এখন পাখিটার দেহটা নিয়ে মেতেছে র’ক্ত উল্লাসে।নীলাদ্রি লিওর মাথায় হাত বুলিয়ে তন্দ্রার পাশে এসে বসলো।তন্দ্রা দুহাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদছিল।তার মুখের সামনে হাতের উপর এসে পড়েছিল চুলের গোছা।নীলাদ্রি তার আঙ্গুল দিয়ে সেগুলো তন্দ্রার কপালের পাশে সরিয়ে দিলো।নীলাদ্রির স্পর্শে তন্দ্র মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।নীলাদ্রি তন্দ্রার কানের কাছে মুখ এনে বললো,

“তন্দ্রা দেখলে তো আমার লিও কি করতে পারে?আর খাবার না পেলে ও কিন্তু আরো হিংস্র হয়ে যায়।সো ওর টাইম টেবিলটা মেইনটেইন করে সময়মতো ওকে খাবার দিও।বলা যায়না কখন খাবার না পেয়ে তোমাকেই আবার খেয়ে নেয়! আর হ্যাঁ ভার্সিটি যাবার আগে মেঝেটা মুছে যেও।রক্ত লেগে আছে। নাউ গেট লস্ট।যাও আমার খাবার টেবিল সাজাও।আমি ক্ষুধার্থ।”

তন্দ্রা চুপচাপ বেরিয়ে এলো নীলাদ্রি ঘর থেকে।ও এত নিষ্ঠুর কেনো?অবশ্য সে তো ভুলেই গিয়েছিল যে মানুষ খুন করতে পারে তার জন্য একটা পাখিকে মারা সামান্য ব্যাপার মাত্র।সারাজীবন তাকে এই খুনীর দাসত্ব করতে হবে!ভাবতেই শরীরটা শিউরে উঠলো তন্দ্রার।

*********

দুটোর দিকে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলো তন্দ্রা।সকালে নীলাদ্রির ঘর পরিষ্কার করে ভার্সিটিতে পৌঁছাতে লেট হয়ে গিয়েছিল।সকালের লেকচারটা এটেন্ড করতে পারেনি সে।আজ সারাদিন বেশ দৌড় ঝাঁপ করতে হয়েছে।এক্সাম চলে এসছে।ফরম ফিলাপ,রেজিস্ট্রেশন সব নিয়ে একটা ব্যাস্ত সময় পার করেছে সকাল থেকে।বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই ভেতরে সোফায় এক ভদ্রমহিলাকে বসে থাকতে দেখলো তন্দ্রা।বেশ সুন্দরী লাস্যময়ী।গলায় দামী হীরের গয়না।বেশ অভিজাত পরিবারের বলে মন হচ্ছে তাকে।তার সাথে বেশ কয়েকটি গয়নার বাক্স উপঢৌকন হিসাবে দেখতে পেলো তন্দ্রা।তন্দ্রা ঘরের দরজায় পা দিতেই বিনতি এসে তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই মহিলাটির সামনে।তার থুতনি চেপে বললো,

“এইযে ম্যাডাম তন্দ্রা যাকে আপনি দেখতে এসেছেন।”

মহিলাটি উঠে দাড়িয়ে হাতের ইশারায় তন্দ্রাকে কাছে ডাকলেন।তন্দ্রা কিছুই বুঝতে পারলো না। বিনতি বললো,

“আরে যা,উনি হচ্ছেন ইভান খানের মা মিসেস নীলিমা খান।”

চমকে উঠলো তন্দ্রা।এখানে এসব হচ্ছেটা কি।ইভানকে রিজেক্ট করার পরও ও কিনা ওর মাকে পাঠিয়ে দিল!নীলিমা তন্দ্রার থুতনিতে হাত রেখে বলল,

“বাহ আমার ছেলের পছন্দের তো তারিফ করতে হয়।”

বিনতি তড়িঘড়ি বললো,
“জি ম্যাডাম,যেমন ওর রূপ তেমন গুন।এরকম ভালো মেয়ে আপনি সারা শহর খুঁজলেও পাবেন না।”

নীলিমা একটা হীরের হার তন্দ্রাকে দেখিয়ে বললেন,
“দেখো তো মা এটা পছন্দ হয় কি না?তোমাকে তো সবগুলোতেই বেশ মানাবে।যদি পছন্দ না হয় তাহলে এইযে এগুলো দেখো।যদি কোনোটাই পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে জানিয়ে দিও।আমি অন্য ডিজাইনের নতুন গয়না বানিয়ে দেব।ঠিক আছে?”

তন্দ্রা হ্যাঁ না কিছুই বললো না। পুষ্পা এগিয়ে এসে বললো,
“আরে পছন্দ হবে না কেনো?এত সুন্দর গয়না তন্দ্রার খুব পছন্দ হয়েছে।”

“তাহলে এগুলো রেখে দিন,আর আমরা বিয়ের দিনটা পাকা করে নেই?”

বিয়ে!আবার বিয়ে!এটা নিশ্চয় নতুন কোনো ষড়যন্ত্র।ভাগ্যিস নীলাদ্রি স্যার এখন নেই।নয়তো তুলকালাম কান্ড বেধে যেত এতক্ষণে।

“হ্যাঁ হ্যাঁ তারিখটা ঠিক করে ফেলাই ভালো।শুভ কাজে দেরি কেনো?” অতি আগ্রহে বললো বিনতি।

তন্দ্রা এসে তার হাত চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল,
“বিনতি দি তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

“কি কথা বল না এখানে।উনি তো তোর ঘরের মানুষ হতে যাচ্ছেন তাইনা।”

তন্দ্রা ইতস্তত করছে দেখে নীলিমা বিনতিকে বললেন,
“আপনি যান ও কি বলতে চাইছে শুনে আসুন।”

“ঠিক আছে।”

বিনতিকে তন্দ্রা একটু আড়ালে নিয়ে এসে বললো,
“বিনতি দি আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা।”

“কেনো?কেনো বিয়ে করতে চাস না? এত ভালো সম্মন্ধ কি আর আসবে?তোর তো শত জনমের ভাগ্য যে ইভান খানের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হচ্ছে।”

বিয়ে করতে না চাওয়ার আসল কারণটা গোপন রেখে তন্দ্রা বললো,
“দেখো বিনতি দি তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি নীলাদ্রি স্যারের অধীনে কাজ করি।স্যারের অনুমতি নেয়ারও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি।”

“আরে তো কি হলো?তারিখ ফিক্স হয়ে যাক।এরপর স্যারকে জানিয়ে দিব নাহয়।আর আমার বিশ্বাস আছে স্যার ঠিক অনুমতি দেবেন।চল তো এখন।”

“আরে বিনতি দি শুনো তো….”

তন্দ্রাকে বিনতি আবার নিয়ে আসে নীলিমার সামনে।

“আমাদের মেয়ে বিয়েতে একদম রাজি।” হাসিমুখে বলল বিনতি।

তন্দ্রা সত্যিটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।সে যে কেবল একটা কাঠপুতুল।এর বেশি আর কিছু নয়।

“তাহলে আমরা বিয়েটা সামনের শুক্রবার ফিক্স করি?” হাসিমুখে বললেন নীলিমা।

“এত তাড়াতাড়ি? সামনে তো আর মাত্র কয়েকটা দিন।”

“হ্যাঁ তাতে কি হলো,আপনাদের চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।সব ব্যাবস্থা আমরাই করবো।আর আমার ছেলে নাহয় নীলাদ্রি চৌধুরীর সাথে কথা বলে নেবে।”

এমন সময় গটমট পায় ঘরে প্রবেশ করলো নীলাদ্রি।তাকে দেখে নীলিমা ছাড়া ঘরের বাকি সবাই থ হয়ে গেলো।নীলাদ্রিতো কখনো এই সময় ফেরে না।তাহলে আজ হঠাৎ ফিরলো কেনো?

নীলাদ্রি আজ বাধ্য হয়েই ফিরেছে।সারারাত জার্নিতে থাকায় তার ঘুম হয়নি।সকালে ফিরে এসে আবার অফিস ছুটতে হয়েছে। প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল তার।তাই একরকম বাধ্য হয়েই এখন বাড়ি এসেছে সে।

ঘরে ফিরে নীলিমাকে দেখে একটু চমকে গেলো নীলাদ্রি।ইনাকে সে চেনে না।আজকাল তার বাড়িতে তার অজান্তেই আগন্তুক চলে আসছে আর সে জানতেও পারছেনা।সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিনতি পুষ্পা আর তন্দ্রা।তন্দ্রার চেহারা ফ্যাকাশে।

নীলাদ্রিকে দেখে তন্দ্রা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে।এখন যে তার সাথে কি হতে যাচ্ছে সেটা আন্দাজ করতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা তার।
নীলাদ্রি নীলিমার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“হ্যালো।আপনি কে ম্যাম?”

নীলিমা অমায়িক হেসে জবাব দিলো,
“আমি মিসেস নীলিমা খান।ইভান খানের মা।”

“তো ম্যাম আমার বাড়িতে হঠাৎ কি মনে করে?”

“এইযে এই মেয়েটিকে আমার ছেলের মনে ধরেছে।” তন্দ্রার দিকে ইশারা করলেন নীলিমা।”ওকে আমার বাড়ির বউ বানাতে চাই।”

নীলাদ্রি কটমট করে তাকালো তন্দ্রার দিকে।

“কিন্তু ম্যাম ও যে বিয়ে করবেনা।”

“কেনো?” অবাক হয়ে জানতে চাইলেন নীলিমা।

“কারণ ও আমার চাকরানী।আমি ওকে বিয়ে দিতে চাইনা তাই ও বিয়ে করবেনা।”

“বললেই হলো নাকি?তন্দ্রা তুমি এক্ষুনি এই কাজ ছেড়ে আমার সাথে চলো।”

তন্দ্রা নিজের জায়গায় অনড় রইলো।বিব্রত হলো নীলিমা।

“কি হলো তন্দ্রা চলো।”

মুচকি হাসলো নীলাদ্রি।
“ম্যাম ও আপনার সাথে কোথাও যাবেনা।ও আমার চাকরানী।আমি যা বলব তাই করবে।প্রমাণ দেখতে চান?”

নীলিমা কিছু বললেন না।নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।যেনো তিনি দেখতে চান এ ছেলে কতটা নিচে নামতে পারে।নীলাদ্রি হুংকার দিল,

“তন্দ্রা!”

কেঁপে উঠলো তন্দ্রা।

“তন্দ্রা,আমার জুতোটা খুব ময়লা হয়ে গেছে।তোমার ওড়নাটা দিয়ে এটা একটু পরিষ্কার করে দাও দেখি।”

তন্দ্রা দাড়িয়ে রইলো। নীলাদ্রি এবার চিৎকার করে উঠলো,

“কি বলছি শুনতে পাচ্ছো না নাকি?”

তন্দ্রা এবার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে বসে পড়লো নীলাদ্রির পায়ের কাছে।নিজের ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে মুছতে লাগলো তার জুতো।মুচকি হাসলো নীলাদ্রি।

“দেখলেন তো ম্যাম আমার ক্ষমতা।চলে যান এখান থেকে।আর দ্বিতীয়বার আসবেন না।”

রাগে,দুঃখে,অপমানে নীলাদ্রির বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন নীলিমা।

নীলিমা বেরিয়ে যেতেই নীলাদ্রি জাবন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তন্দ্রার দিকে,

“হেই ইউ, স্ট্যান্ড আপ।”

তন্দ্রা উঠে দাড়ালো।

“কি পেয়েছটা কি তুমি?কি চলছে আমার বাড়িতে এসব?যবে থেকে তুমি এ বাড়িতে এসেছো তবে থেকে এ বাড়িটা একটা রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে।যেনো এটা কোনো বাড়ি না, কূটকচালির সদর দপ্তর।সকালে ফেরার পর থেকে দেখছি একটা না একটা কিছু লেগেই আছে।আমার নিজের বাড়িতে আমি কি একটুও শান্তিতে থাকতে পারবো না?”

তন্দ্রা মাথা নিচু করে রইলো।তার চোখ বেয়ে অঝোরে জল নেমেছে।তার কি দোষ।সে তো কিছুই করেনি।শুধু শুধু স্যার বকছেন তাকে।নীলাদ্রি আবার ধমকে উঠলো,

“এসব ন্যাকা কান্না বন্ধ করো আর এক কাপ সুগার ফ্রি ব্ল্যাক কফি বানিয়ে আমার ঘরে নিয়ে আসো।যাও!”

তন্দ্রা কাঁদতে কাঁদতে রান্নাঘরের ভেতর সেধিয়ে গেলো।নীলাদ্রি তার নিজের ঘরে চলে গেল।

ব্ল্যাক কফি নিয়ে নীলাদ্রির ঘরে গেলো তন্দ্রা।নীলাদ্রি যে তাকে কেবল কফি দিতে ডাকেনি সেটা সে আন্দাজ করতে পারলো।এবার না জানি কি হবে তার সাথে।ঘরের দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে , “আসো” শব্দটা ভেসে এলো।তন্দ্রা ভেতরে গিয়ে দেখলো নীলাদ্রি কপাল চেপে ধরে বসে আছে।

“স্যার আপনার কফি।”

“রাখো।”

তন্দ্রা কফিটা রেখে যাবার অনুমতির জন্য নীলাদ্রির পাশে দাড়িয়ে রইলো।নীলাদ্রি বেশ দ্রুত গরম কফিটা শেষ করে ফেললো।তন্দ্রা তখনও একইভাবে দাড়িয়ে আছে।নীলাদ্রি কফিটা শেষ করে তন্দ্রার দিকে তাকালো।ধক করে উঠল তন্দ্রার বুকটা।নীলাদ্রি বললো,

“আমার খুব মাথাব্যথা করছে।”

তন্দ্রা কি বললো বুঝতে না পেরে বললো,
“জি স্যার।”

নীলাদ্রি ধমকে উঠল,
“হোয়াট দা জি স্যার?তুমি জানোনা মাথাব্যথা করলে কিভাবে সেবা করতে হয়?আই ডোন্ট থিঙ্ক এ যে একটা মেয়েকে কখনো শিখিয়ে দিতে হয় কিভাবে তার স্বামীর সেবা করা উচিত।”

“স্বামী!” চমকে উঠলো তন্দ্রা।কে কার স্বামী?কি বলছেন স্যার? নীলাদ্রি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

“স্বামী মনে গৃহস্বামী।মনে মনিব।মনিবের কিভাবে সেবা করতে হয় জানোনা তুমি?”

তন্দ্রা চুপ করে রইলো।নীলাদ্রি একটা ড্রয়ারের দিকে ইশারা করে বললো,

“ওখানে একটা ওষুধ রাখা আছে।ওটা নিয়ে আসো আর আমার মাথায় লাগিয়ে দাও।”

তন্দ্রা ওষুধটা নিয়ে এসে দাড়িয়ে রইলো।নীলাদ্রি তাকে সোফার দিকে ইশারা করে বললো,

“বসো।”

তন্দ্রা বাধ্য মেয়ের মত সোফায় বসতেই নীলাদ্রি তার কোলে মাথা দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল।ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো তন্দ্রা।

“ওষুধটা আমার মাথায় লাগিয়ে দাও আর মাথাটা টিপে দাও।”

তন্দ্রা তাই করতে লাগলো।যা বলছে বিনা বাক্যে করে যাওয়াই ভালো।কি দরকার বাবা নিজের বুদ্ধি খরচ করে।

নীলাদ্রি চোখ বন্ধ করলো।সত্যিই মাথাটা তার ভীষণ যন্ত্রণা করছে।এ বাড়িতে সবাই তাকে ভয় পায়।কেউ যেচে খবর নিতে আসেনা।দাদু মারা যাবার পর সে বাঁচলো কি মরলো সেটা দেখার মতও কেউ নেই। সে যদি না খেয়েও থেকে তাতে মনে হয়না করো কিছু যায় আসবে।খাবারের হুকুম না দিলে তার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরার মত কেউ নেই।নীলাদ্রি তন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করলো,

“তুমি নাকি পুলিশের কাছে গিয়েছিলে?”

এবার আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলো তন্দ্রা। নীলাদ্রির কপাল টিপতে থাকা তার হাতগুলো যেনো অসার হয়ে গেছে।সে পুলিশের কাছে গিয়েছিল এটা নীলাদ্রি কিভাবে জানলো?তারমানে নিশ্চই ওই পুলিশের সাথে নীলাদ্রির কোনো সম্পর্ক আছে।তাই তো ওই পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইছিল না।

“তন্দ্রা আমার উপর নজরদারি করে কোনো লাভ নেই তোমার।তুমি তোমার নিজের চরকায় তেল দাও।আমার কাজের মধ্যে কেউ আসুক সেটা আমি পছন্দ করি না।”

তন্দ্রা কিছু বললো না।এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।তাকে যদি আবার খুন টুন করে ফেলে তখন? সে একমনে নীলাদ্রির কপাল টিপতে লাগলো। একসময় তন্দ্রার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল নীলাদ্রি।

এবার তন্দ্রা পড়ল বিপদে।সে থাকতেও পারছেনা আবার উঠে যেতেও পারছেনা।এ ঘরটায় মনে হচ্ছে তার দমবন্ধ হয়ে আসবে।কিন্তু উঠেই বা যাবে কি করে।রাক্ষসটা যে তার কোলেই ঘুমিয়ে আছে।নড়াচড়া করলে যদি জেগে যায়?তন্দ্রা ভালো করে দেখলো নীলাদ্রিকে। ঘুমুলে মনেই হয়না এটা এত চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে।এ কয়েকদিন বাড়ি ছিলনা বাড়িটা খুব শান্ত ছিল।তবে তন্দ্রার মনে হচ্ছিল বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে।বাড়িতে যেনো নেমে এসেছে কবরের নিস্তব্ধতা।কিছু যেনো হারিয়ে গেছে বাড়ি থেকে।আসলে বাড়ির মালিক বাড়িতে না থাকলে বাড়িও কেমন যেনো ঝিমিয়ে পরে।
একে কি মিস করছিলো তন্দ্রা? না! কেনো মিস করবে সে?এ তো তার জন্মের শত্রু।শত্রুকে কেউ মিস করে নাকি।

কিন্তু এখন সে কি করবে? দেরিতে নিচে গেলে যদি বাকিরা কিছু সন্দেহ করে?রটনা রটতে তো বেশি সময় লাগেনা।ওইদিন সুইমিং পুলের ব্যাপারটা হওয়ার পরে না জানি কি কি ভেবেছিল সবাই।কি করা যায় ভাবতে লাগলো তন্দ্রা। কিন্তু হাজার ভাবনার পরও কোনো সুরাহা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে নীলাদ্রির ঘুম থেকে জেগে উঠা পর্যন্ত সেভাবেই বসে থাকতে হলো তন্দ্রাকে।

**********

নীলিমা খান বাড়ি ফিরেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন।ইভান অফিসে ছিল।মায়ের ফোন পেয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরলো।বাড়িতে ফিরেই আগে বাড়ির চাকরানীদের মুখ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে নিল।রাগে গা টা রি রি করে উঠলো তার। কোনোভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে তার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

“ইভান!”

“জি মম বল।”

“ওই মেয়েকে আমার চাই।”

“মম তুমি কেনো ওই বাড়িতে গিয়েছিলে বলতো?আর তোমাকে তন্দ্রার কথা কে বলেছিল?”

“তুই তো কিছু বলবিনা তাই আমি মুন্সীর থেকে সব জেনে নিয়েছিলাম।”

“মম তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করতে পারতে।তন্দ্রা আমাকে পছন্দ করেনা।আর তুমি ও বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে চলে গেলে?”

“তন্দ্রা তোকে পছন্দ করে কি করেনা সেটা আমার কাছে বড় বিষয় নয়।ওই নীলাদ্রি আমাকে অপমান করেছে। নীলাদ্রি তন্দ্রাকে বন্দী করে রেখেছে।ও ওর উপর অত্যাচার করে।তাই যে করেই হোক ওই মেয়েকে তুই নীলাদ্রির হাত থেকে ছাড়িয়ে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে আসবি।”

“কিন্তু মম ও তো আমাকে….”

“এটা আমার আদেশ!আর তুই তো জানিস আমি যেটা চাই সেটা আদায় করিয়েই ছাড়ি।”

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার মায়ের কাছ থেকে চলে এলো।তার খামখেয়ালীর জন্যই এতসব ঝামেলা হচ্ছে।তবে নীলাদ্রি যদি সত্যিই তন্দ্রার উপর অত্যাচার করে তাহলে তাকে যে করেই হোক নীলাদ্রির হাত থেকে বাঁচাতে হবে।কিন্তু এ কথাটা তন্দ্রা কেনো তার কাছ থেকে লুকালো?কেনো?

চলবে……….

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_১৬
#আয়াত_আফরা

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল তন্দ্রা।কাল বেশ রাত করে ঘুমুতে গিয়েছিলো সে।সবার খাওয়া শেষে কিচেন রান্নাঘর তাকেই গুছাতে হয়েছে।বিনতি দির হঠাৎ জ্বর এসেছে।তাই অনেক রাত অবধি তন্দ্রা তাকে জলপট্টিও দিয়েছে।প্রায় রাত দুটোর দিকে এসে ঢুকেছে তার এই কবুতরের খোপে। হঠাৎ দরজায় প্রবল কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তন্দ্রার।প্রথমে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে।ডাকাত পড়ল নাকি!এখনও সকাল হয়নি। সাড়ে চারটা বাজে ঘড়িতে।তন্দ্রা কি করবে বুঝতে পারলো না।এদিকে দরজায় ধাক্কার শব্দ তীব্র হয়ে উঠেছে।যেনো ক্রমেই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে দরজার ওপাশে থাকা মানুষটি।

তন্দ্রা চোখ রগড়ে ঘরের ভেতরে তাকিয়ে একটা ছোটো লাঠি দেখতে পেলো।বিনতি দি এটা তার সাথে রাখার জন্য দিয়েছিলেন।লাঠিটা তেমন একটা মজবুত নয়।তবু কাছে রাখা ভালো।সাবধানের মার নেই।তন্দ্রা তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে লাঠিটা হাতে নিল।সতর্ক পায়ে এগুলো দরজার দিকে।তখনও একটানা কড়া নাড়ার শব্দ হয়ে চলেছে।নিশ্চই ডাকাত।নয়তো এই সময় বেয়াক্কেলের মত দরজা ধাক্কাবে কেনো?তন্দ্রা আলতো হাতে দরজাটা খুলে কিছু বিবেচনা না করেই লাঠিটা সজোরে চালিয়ে দিল দরজার বাইরে থাকা মানুষটির উদ্দেশ্যে।কিন্তু লাঠির আঘাত তার গায়ে লাগলোনা।সে বলিষ্ঠ হাত দিয়ে লাঠিটাকে শূন্যে আটকে দিল। এবার সেই মানুষটাকে লক্ষ করে লাঠিটা ছেড়ে দিল তন্দ্রা।

সর্বনাশ!এ যে নীলাদ্রি স্যার!

নীলাদ্রি লাঠিটাকে এক হাতেই মট করে ভেঙে ফেললো।রাগী চোখে তাকালো তন্দ্রার দিকে।

“ইউ ব্লা’ডি!”

একে তো অত রাতে নীলাদ্রিকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে গিয়েছিল তন্দ্রা তার উপর আবার সে এই কাহিনী করেছে।আজ তো সে শেষ!

“কি করতে যাচ্ছিলে তুমি হ্যাঁ?”

“স্যার আমি আসলে ভেবেছিলাম ডা..ডাকাত।”

“হ্যাঁ শুধু ভেবেছো আর লাঠি চালিয়ে দিয়েছো।এই বুঝি তুমি ক্রিমিনোলোজির স্টুডেন্ট?তুমি যদি সার্ভিস দিতে যাও তাহলে তো পুরো দেশ তোমার জন্য বিপদে পড়বে।মাথামোটা একটা।”

“কিন্তু স্যার আপনি অত রাতে এখনে কি করছেন?”

“এখন কি রাত আছে?ভোর হয়ে গেছে।তৈরি হয়ে নাও।”

“কেনো স্যার?”

“পার্কে যাব।”

“কেনো?”

“কি কেনো কেনো শুরু করেছ?বলছি তৈরি হতে তৈরি হও।”

তন্দ্রা আর কিছু না বলে কাপড়টা চেঞ্জ করে এলো।নীলাদ্রি তার হাতে একটা জলের বোতল ধরিয়ে দিল।

“চল।”

তন্দ্রা দেখতে পেলো নীলাদ্রির সাথী রয়েছে লিও।স্যার এটাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন! কি জানি স্যারের মতলবটা কি!

নীলাদ্রি তন্দ্রাকে নিয়ে একটা বিশাল পার্কে এসে দাড়ালো।তখন পুবের আকাশ ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।পার্কে দু একজন মানুষ রয়েছে।তারা মর্নিং ওয়াকে এসেছে। জগিং করছে ইয়োগা করছে।নীলাদ্রি তন্দ্রাকে বললো,

“তন্দ্রা এক তো তুমি দরজা খুলতে দেরি করেছিলে আর দ্বিতীয় তুমি আমার উপর আক্রমণ করেছিলে।”

“স্যার আমিতো ইচ্ছে করে করিনি এসব।”

“চুপ!ইচ্ছে করে করো আর অনিচ্ছায়।শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।”

শাস্তির কথা শুনে গলা শুকিয়ে গেলো তন্দ্রার।

“তুমি পুরো পার্কটা দৌড়ে চক্কর দিয়ে আসবে।আর তোমার পেছনে দৌড়াবে আমার বেব।যদি থেমেছো তবে…….”

“স্যার আমি পারবোনা। এতদূর দৌড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না।”

“আমার মুখের উপর না বলার সাহস আসে কোথা থেকে তোমার?লিও!”

মনিবের ডাকে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো কুকুরটি।

“তন্দ্রা ইউর টাইম ইজ স্টার্টিং ফ্রম নাউ।”

তন্দ্রা দৌড়াতে শুরু করলো।তার পেছনে কুকুরটি।ধরতে পারলে হয়তো ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।কেনো নীলাদ্রি স্যার তার সাথে এমন করছেন!

পনেরো মিনিট একটানা দৌড়ানোর পর হাঁপিয়ে গেলো তন্দ্রা।দম ফুরিয়ে আসছে তার।আর ছোটা কোনোভাবেই সম্ভব না।সে পড়ে গেলো মাটিতে।কুকুরটি তখনও এগিয়ে আসছে।সেটা তন্দ্রার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যেতেই কেউ একজন লাথি দিয়ে দূরে ফেলে দিল কুকুরটাকে।কুকুরটি ছিটকে পড়ল মাটিতে।কয়েকবার দাঁত খিঁচিয়ে কেউ কেউ করতে করতে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলো নিজের মনিবের উদ্দেশ্যে। তন্দ্রা দেখলো তার পাশে এসে দাড়িয়েছে ইভান।ইভান হাত বাড়িয়ে তুললো তন্দ্রাকে।

“তো ম্যাম আপনার কোথাও লাগেনি তো?”

তন্দ্রা ঘাড় নাড়ল।
“ধন্যবাদ।আজ আপনি না থাকলে…”

“ধন্যবাদ দিয়ে আপনি কিন্তু আমাকে ছোট করছেন।আর কুকুরটি আপনার পেছনে পড়ল কেনো?আপনি ওটাকে বিরক্ত করেছিলেন নাকি?”

“না মানে….”

তন্দ্রার কথা শেষ করার আগেই তার পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো ইভানের উদ্দেশ্যে।

“হাউ ডেয়ার ইউ!”

তন্দ্রা দেখলো তাদের পেছনে এসে দাড়িয়েছে নীলাদ্রি।রাগে তার কপালের শিরা ফুলে উঠেছে।সে এগিয়ে আসে তন্দ্রাকে একপাশে সরিয়ে ইভানের মুখোমুখি দাড়ালো।

“আপনার এত সাহস কি করে হয় আপনি আমার লিওকে আঘাত করেছেন?”

লিও তখন নীলাদ্রির পেছনে লুকিয়ে ছিল।সে ইভানকে দেখে খুব ভয় পেয়েছে। ইভান মুচকি হাসলো।

“মিস্টার নীলাদ্রি ওটার থেকে তো দেশী কুকুর ভালো।ওটার না আছে সাহস আর না আছে শক্তি।যত আস্ফালন কেবল দুর্বলদের উপর।”

“মিস্টার ইভান আপনি হয়তো জানেন না,যারা ভয় পায় তাদের ভয় দেখিয়েই কিন্তু আসল মজা।”
তন্দ্রার দিকে একবার ব্যাঙ্গের দৃষ্টিতে তাকালো নীলাদ্রি।

“তাই বলে আপনি দুর্বলদের উপর অত্যাচার করবেন? এটা কি পৌরুষ্য ধর্ম?”

“ও আমার।আমি ওর উপর অত্যাচার করি বা যাই করি আপনি বলার কে?”

“আমি বলার হয়তো কেউ নই,কিন্তু দেশে আইন কিন্তু আছে।সেটা আশা করি আপনি ভুলে যান নি।”

“কোনো আইন আমাকে আটকাতে পারবেনা যতক্ষণ না আমি ওকে মেরে ফেলছি।চলো।”

তন্দ্রার হাতে হেঁচকা টান দিল নীলাদ্রি। ইভান বললো,

“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে মিস্টার নীলাদ্রি।”

“অফিসে চলে আসবেন।সেখানেই কথা হবে।”

তন্দ্রাকে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে এলো নীলাদ্রি।

*********

নিজের অফিস রুমে বসে দ্রুত ল্যাপটপের কি-গুলো চাপছিল ইভান।তাদের কোম্পানির থেকে নীলাদ্রির কোম্পানির প্রোগ্রেস দ্রুত হচ্ছে।”খুবই তুখোড় বিজনেস ম্যান নীলাদ্রি।”মনে মনে কথাটা বললো ইভান।বেশ কিছুদিন ধরে তন্দ্রাকে নিয়ে ভেবে বিজনেসে কিছুতেই মন বসছেনা তার। নাহ এভাবে চলতে দেয়া যায় না।এবার একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।সে ল্যাপটপ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই তার কাছে ছুটে এলো মুন্সী।

“স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?”

“হুঁ,পুরো এক যুগ আগে ডেকেছি।কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

“ম্যাডাম জির সাথে।”

“মমের সাথে কি করছিলে?যা করার তা তো করে দিয়েছো।এখন আর কোন উপকার করতে গিয়েছিলে?”

“তওবা তওবা স্যার।আমি কি আপনার ক্ষতির কথা ভাবতে পারি?”

“তাহলে তন্দ্রার কথা কেনো বলেছ মমকে?”

মুন্সী মুখ বেঁকিয়ে বললো,
“স্যার আমার কি দোষ?ম্যাডাম জি তো আমাকে ভয় দেখলেন।”

“হুঁ মম ভয় দেখলো আর অমনি তুমি সব বলে দিলে।তুমি নিজেই তো দেখেছো ও আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।তাহলে ওর নাম কেনো নিলে?দুনিয়ার যেকোনো মেয়ের নাম বলে দিতে কিন্তু ওর নামটাই কেনো বলতে হলো?”

“কিন্তু স্যার দুনিয়ার যেকোনো মেয়েকে কি আপনি বিয়ে করতেন?”

“হ্যাঁ করতাম।অন্তত মম তো ওই বাড়িতে যেতো না।যাও গাড়ি বের করো।”

“স্যার আপনি কি আজই নীলাদ্রির সাথে দেখা করতে যেতে চান?”

“হ্যাঁ।ব্যাপারটার একটা সমাধান হওয়া দরকার।”

“কিন্তু স্যার যার সমাধান খুঁজতে যাচ্ছেন সে নিজেই তো আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।”

“ওর অবস্থানে থাকলে তুমিও ফিরিয়ে দিতে।আমি ওকে মুক্ত করবো।গাড়ি বের করো।আমি নীলাদ্রি চৌধুরীর সাথে দেখা করতে যাবো।”

“ওকে স্যার।”

ইভান যখন নীলাদ্রির অফিসে এসে পৌঁছালো তখন নীলাদ্রি একটা জরুরী মিটিংয়ে ব্যাস্ত ছিল।তুলয় ইভানকে দেখে বেশ অবাক হলো।নীলাদ্রি আর ইভান দুজনেই কম্পিটিটর।তাই একে অন্যের সাথে দেখা করবে এটা তুলয়ের ধারণাতেও আসেনি। সে ইভানকে বসতে অনুরোধ করলো। আধা ঘন্টা পর মিটিং শেষ হলো নীলাদ্রির।সবাই একে একে বেরিয়ে এলো মিটিং রুম থেকে।নীলাদ্রি রিলাক্স হয়ে বসলো চেয়ারে।চেয়ারে হেলান দিয়ে সে সবে একটু চোখ বুজেছে এমন সময় ছুটে এলো তুলয়,

“স্যার ইভান খান আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।”

“হুঁ ভেতরে পাঠাও।”

নীলাদ্রি এমনভাবে কথাটা বললো যেনো সে আগে থেকেই জানতো ইভান আসবে।তুলয় ভেবেছিল নীলাদ্রি কথাটা শুনে অবাক হবে।কিন্তু তেমন কিছু হলোনা দেখে সে কেমন যেনো একটা সন্দেহের গন্ধ পেলো।তুলয় ডেকে নিয়ে এলো ইভানকে।নীলাদ্রি জানতো ইভান তার কাছে আসবেই।আর সকলের ঘটনাটার পর তো অবশ্যই।

“হ্যালো মিস্টার নীলাদ্রি।”

“হ্যালো মিস্টার ইভান। প্লিজ হ্যাভ এ সিট।

“থ্যাংক ইউ।”

“তো মিস্টার ইভান,কি বলার ছিল আপনার যে আমার এক প্রস্তাবে এখানে চলে এলেন।” ইভান আসার কারণটা যে নীলাদ্রি জানে সেটা তাকে বুঝতে দিলনা সে।

“হ্যাঁ এসেছি যখন নিশ্চই কোনো একটা জরুরী কারণ আছে।”

“কি সেটা জানতে পারি কি?”

“আমি তন্দ্রার ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”

“ইন্টারেস্টিং।আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো বিজনেসের ব্যাপারে কথা বলবেন।কিন্তু আপনি একটা তুচ্ছ মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে আসবেন সেটা আমি ভাবিনি।”

“মিস্টার নীলাদ্রি আপনার কাছে তুচ্ছ হলেই সে যে সবার কাছে তুচ্ছ এমন কিন্তু নয়।”

“ওয়েল তো কি বলবেন ওর ব্যাপারে?”

“আমি ওকে চাই।আমি এর জন্য আপনাকে যেকোনো মূল্য পে করতে রাজি আছি।”

“আপনি ওকে কিনতে চান?”

“দেখুন মানুষ কেনার মতো দুঃসাহস আমার নেই।মানুষের মূল্য টাকায় হয়না।আমি কেবল ওকে আপনার থেকে মুক্তি দিতে চাই।”

“মুক্তি!আপনি জানেন ওর মূল্য কত?”

“ও অমূল্য।আপনি বলুন ওকে মুক্ত করার জন্য আপনি কত চান?”

“আপনি কত পে করতে পারবেন?”

“যত আপনি বলবেন।”

“মিস্টার ইভান,আপনার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে যে আপনি কাকে কিনতে এসেছে?”

“হ্যাঁ এমন একজনকে যে আপনার জন্য কেউ না।”

হাসলো নীলাদ্রি।সে তার ল্যাপটপ থেকে কিছু ডকুমেন্ট বের করে ইভানকে দেখিয়ে বললো,
“এটা হলো আমার আর তন্দ্রার বিয়ের রেজিস্ট্রেশন,আর এটা কাবিননামা।”

“কি!”

ল্যাপটপে ডকুমেন্টগুলো দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো ইভান।তন্দ্রা তাহলে নীলাদ্রীর স্ত্রী! কিন্তু তন্দ্রা তো কোনদিন সেটা বলেনি।আর নিজের স্ত্রীর সাথে কেউ এমন দুর্ব্যবহার করে!

“মিস্টার ইভান,আপনি তো জানেনও না, যে গল্পের অংশ আপনি পরিবর্তন করতে চান সেই গল্পের লেখক কিন্তু আমি। এটা পরিবর্তন করার ক্ষমতা আপনার নেই।”

“কিন্তু মিস্টার নীলাদ্রি আপনি যেটা করছেন সেটা কিন্তু বধূ নির্যাতন।”

“তো?তন্দ্রা কখনো অভিযোগ করেছে?আর তাছাড়াও ও এত বোকা যে নিজের স্বামীকে মনিব মনে করে।পুওর গার্ল!”

“ওকে সরল সোজা পেয়ে আপনি ঠকাচ্ছেন?”

“না,আমি ওকে ঠকাচ্ছিনা।ওকে ঠকিয়ে আমার কি লাভ।ও নিজেই এই রাস্তা বেছে নিয়েছে।”

“মানে?” “মিস্টার ইভান ,কিছু গোপন কথা জানা ভালো কিন্তু প্রকাশ করা নয়।আমার আর আমার স্ত্রীর মধ্যে আসার চেষ্টা করবেন না।”

“ওকে যে আপনি কোনোদিন স্ত্রীর মর্যাদা দেবেন না সেটা আমি জানি।বলুন কি করলে আপনি ওকে মুক্তি দেবেন?”

“মুক্তি কাউকে দেয়া যায়না।মুক্তি ছিনিয়ে নিতে হয়।পোষা খাঁচার পাখিদের আপনি যতই উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করুন না কেন তারা বেশি দূর যেতে পারবেনা।”

“আপনি কিন্তু কথা ঘোরাচ্ছেন।”

“আমি তন্দ্রাকে সেদিনই মুক্ত দেবো যেদিন ও নিজে মুক্তি চাইবে।আমি ওকে বিনা শর্তে আপনার হাতে তুলে দেবো যেদিন ও নিজে আমার কাছে এসে আপনার কাছে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করবে।এর আগে নয়।”

“ঠিক আছে মিস্টার নীলাদ্রি কথাটা মনে রাখবেন।”

হনহন করে নীলাদ্রির কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো ইভান।

**********

ইভানকে রাগান্বিত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে ছুটে এলো মুন্সী।

“স্যার কি হয়েছে?”

“যা হওয়ার সেটাতো আগেই হয়েছে নতুন করে আবার কি হবে?”

“না মানে স্যার ওই নীলাদ্রি কি বললো?”

“সেটা জানা তোমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট নয়।”

“কিন্তু স্যার কিছু তো বলুন।আপনি এত রেগে আছেন যে।”

“ওই নীলাদ্রিকে সরিয়ে দিতে হবে।”

“স্যার এ আপনি কি বলছেন?এসব আপনার চরিত্রের সাথে যায় না।”

“আরে পুরো কথা না শুনে কথা বলো কেনো?তন্দ্রার মনে নীলাদ্রির জন্য একটা সফট্ কর্নার আছে।ওর মনে যদি জায়গা করে নিতে হয় তাহলে ওর মন থেকে নীলাদ্রিকে সরিয়ে দিতে হবে।দেখো মুন্সী আমি চাইনা তন্দ্রার উপর কোনো জবরদস্তি করতে।আমি হয়তো ওকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করতাম যদিনা মম আমাকে ওভাবে বলতেন।তাই যে করে হোক তন্দ্রার মনে জায়গা করে নেয়া আমার জন্য খুব ইম্পর্ট্যান্ট।আর যতক্ষণ নীলাদ্রি ওর মনে আছে ততক্ষন সেটা সম্ভব নয়।”

“কিন্তু স্যার নীলাদ্রি তো তন্দ্রা ম্যাডামকে অপমান করেন।তাহলে উনি কেনো নীলাদ্রিকে পছন্দ করতে যাবেন?”

“কারণ ও বাঙালী মেয়ে।আর বাঙালি মেয়েদের নিজের স্বামীর প্রতি দুর্বলতা তো থাকবেই।”

“তার মানে তন্দ্রা ম্যাডাম বিবাহিত!তাও নীলাদ্রির সাথে!”

“হুম।”

“স্যার আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।যদি উনার স্বামী নীলাদ্রি হয় তাহলে সে ম্যাডামের উপর অত অত্যাচার কেনো করে?”

“সেটাতো আমিও বুঝতে পারছিনা মুন্সী।ওই নীলাদ্রি চৌধুরী অগাধ জলের মাছ।তবে ওর হাত থেকে তন্দ্রাকে ছাড়াতে হবে।”

“কিন্তু কি করে স্যার?”

“ঐযে বললাম তন্দ্রার মন থেকে নীলাদ্রিকে সরিয়ে আমাকে জায়গা করে দিতে হবে।”

“কিন্তু কিভাবে?”

“সেটাই ভাব।”

“আমি থাকতে অত ভাবনা কিসের?”

মহিলাকণ্ঠে ইভান আর মুন্সী দুজনেই চমকে দেখলো এক সুন্দরী মহিলা তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।ইভান চিনতে পারলো তাকে।এ তো তুলয়।নীলাদ্রির পি.এ।কিন্তু ও এখানে কি করছে?

“হ্যালো মিস্টার ইভান।”

“মিস তুলয় আপনি এখানে কি করছেন?আমাদের উপর নজর রাখার জন্য নীলাদ্রি আপনাকে পাঠিয়েছে নাকি?”

“আরে রিলাক্স মিস্টার ইভান।নীলাদ্রি স্যার আমাকে পাঠায়নি।আমি নিজে আপনাদের উপকার করতে এসেছি।”

“আমি অত বোকা নই মিস তুলয়।আপনি যেচে যে আমার উপকার করতে আসেন নি সেটা আমি ঠিকই বুঝেছি।আপনার স্বার্থ কি?”

“ওয়েল বুঝে যখন গেছেন তাহলে বলি আমি তন্দ্রা আর নীলাদ্রি স্যারের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিতে পারি মনে এক জনের মন থেকে অন্য জনকে মুছে দিতে পারি তার বদলে আপনাকে বিয়ের পর তন্দ্রাকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে হবে।”

“কেনো?”

“কারণ কাছাকাছি থাকলে আবার দুজনের মনে দুজনের জন্য প্রেম জেগে উঠতে পারে।”

“প্রেমটা কোন দিক থেকে?”

“দুদিক থেকেই।”

“নীলাদ্রি তন্দ্রাকে ভালোবাসে?”

“ভালোবাসে কি না জানিনা তবে একটা সফট কর্নার তো আছেই।”

“এক মিনিট আপনি দুজনের ব্যাপারটা কি করে জানলেন?”

“স্যারের অফিসে আপনাদের কথা থেকেই জেনেছি।”

“আপনি লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন?”

“হুঁ।”

“আজকে জানলেন আর আজকেই বুঝে গেলেন কে কাকে ভালোবাসে?”

“না একদিনে কি বোঝা যায় নাকি?আমি স্যারকে বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি।উনার আচরণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।কারণটা ধরতে পারছিলাম না।আজ ক্লিয়ার হলো।”

“এই সমস্ত কিছুতে আপনার লাভটা কি বুঝলাম না।”

” লাভ একটাই আমার নীলাদ্রি স্যারকে চাই।”

“হুঁ বুঝলাম।ওকে আই এম এগ্রী।তবে তন্দ্রার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।”

“ঠিক আছে।আর নিজের প্রতিশ্রুতিও মনে রাখবেন কিন্তু।আমি আসি?”

তুলোয় যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমন বেরিয়ে গেলো। মুন্সী বললো,

“স্যার কিছু বুঝলেন?”

ইভান হাসলো,
“বুঝলাম স্ত্রী বুদ্ধি ভয়ংকরী।সাবধানে থাকতে হবে ওর থেকে।যেকোনো সময় পল্টি খেতে পারে।”

চলবে……..