রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১২+১৩+১৪

0
228

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১২]

আরোভিকে নিয়ে যখন তারা রাজপ্রাসাদে ফিরলো তখন প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো ফুটেছে ধরণীতে। রাজকন্যা আরোভির জন্য কবিরাজ মশাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কক্ষে এলো তড়িঘড়ি করে। এই পোশাকে আর কারোর নজরে আসা যাবেনা। কেউ দেখলেই প্রশ্ন করে বসবে। তখন মিথ্যে বলাও জটিল হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে রাজকুমারের কাছে। সে চায়না অকারণে রাজকুমারকে মিথ্যে বলতে। কক্ষে পা রাখতেই রাজকন্যার শরীরে কিছু একটা কম্পন অনুভব করলো। তার পা নিজ গতিতেই থমকে গেলো। নাকে এসে ঠেকছে আতরের খুশবু। কক্ষে শতাধিক জ্বীনের প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু কেন এসেছে তারা?কি চাই তাদের? রাজকুমার যদি টের পায়…! আর কিছু ভাবতে পারলো না রাজকন্যা। দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। তার মাথা ভার হয়ে উঠলো আতরের খুশবুতে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেলো এই খুশবু। রাজকন্যা চারপাশে ব্যস্ত দৃষ্টিতে চোখ বোলাচ্ছে। বড় সতর্ক গলায় প্রশ্ন করলো,

“কি চাই তোমাদের?”

কোনো জবাব এলো না। হঠাৎ রাজকন্যার বুক কেঁপে উঠলো। রাজকুমারের ঘুমিয়ে থাকা জায়গাটা শূ্ন্য পড়ে আছে যে। রাজকুমার গেলো কোথায়? ছুটে গেলো খালি শয্যার কাছে। এখানেই তো শুয়ে ছিলো সে। কোথায় গেলো। রাজকন্যা ভুলে গেলো জ্বীনদের কথা। ছুটে গেলো গোসলখানায়। সেখানেও নেই। কক্ষ সংলগ্ন বারান্দা তেও নেই! নেই! কোথাও নেই। হাঁপিয়ে উঠলো রাজকন্যা। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানার কোল আগলে ধপ করে বসে পড়লো। দুশ্চিন্তায় মস্তিষ্ক দিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। এবার বিপদ কি রাজকুমারের উপর এলো!

আকস্মিক কেঁপে উঠলো রাজকন্যা। একটা জ্বীন তার পাশ ঘেঁষে বসেছে। কানের কাছে মুখ এনে বলল,

“বিপদ বিপদ বিপদ!”

রাজকন্যা কেঁপে উঠলো। হাত বাড়িয়ে জ্বীনটাকে ছুঁতে নিলেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সে। রাজকন্যা আতংকিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

“কিসের বিপদ? বলে যাও আমাকে! কিসের বিপদ.. আ্ আমার রাজকুমার কোথায়?”

কোনো জবাব এলো না। এমনকি ধীরেধীরে ঘর থেকে আতরের খুশবুও মিলিয়ে যেতে আরম্ভ করলো। রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালো। শূন্য ঘরে দৃষ্টি ঘোরালো বার কয়েক। কেউ নেই! চলে গেছে সব। তবে কি ওরাই রাজকুমারের অপহরণ করেছে। নাকি অন্যকেউ? কে আছে এই সব কিছুর মুলে?

“আ্ আচ্ছা? আরোভির অপহরণ যারা করেছে তারাই কি রাজকুমারের অপহরণ করেছে? হু.. হতে পারে!”

রাজকন্যা আর দেরী করলো না। ছুট্টে গেলো গোসলখানায়। নিজের পোশাক পাল্টে ফিরে এলো রাজকন্যার বেশে। তারপর আবারও ছুটলো আরোভির কক্ষে। আরোভি নিশ্চয়ই সবটা জানে। ওকে কে বা কারা অপহরন করেছে আর কেনই বা করেছে ও নিশ্চয়ই সবটা জানবে। আর রাজকন্যা নিশ্চিত যে রাজকুমারের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এর কোনো সূত্র ঠিকই আছে। রাজকন্যাকে তাড়াহুড়ো করে ছুটতে দেখে কোত্থেকে এসে সামনে দাঁড়ালো আদিম।

“রাজকন্যা? কি হয়েছে? তোমাকে এতো বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?”

আদিমের সাথে রাজকন্যার এক-দিনে মোটে ২বার দেখা হয়। সেটাও আহারের সময়। বাকি সময়টায় কখনও মুখোমুখি হয়নি তারা। তবে আজ হওয়াতে যেন বড় উপকারই হলো। রাজকন্যা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে চিন্তান্বিত কন্ঠে বলল,

“আদিম রাজকুমারের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে কি কোথাও?”

আদিম তার চিন্তা দেখে খানিকটা বিচলিত হলো। অতঃপর রাজকন্যার করা প্রশ্নে খানিকটা ঘোরে তলিয়ে গেলো। রাজকন্যা ওর বাহুতে হালকা চাপড় দিয়ে বলল,

“কি হলো? দেখেছো কি তাকে?”

“না।”

“ও দেখোনি!”

ক্ষনিকের জন্য কিঞ্চিৎ আসার আলো দেখতে পেয়েছিলো রাজকন্যা। কিন্তু আদিমের নাকোচ বানীতে আরও পীড়া বেড়ে গেলো যেন। হঠাৎই দমবন্ধ হয়ে এলো। তবুও সামলে নিলো নিজেকে, নিজের পীড়িত মনকে।

“রাজকুমার নিখোঁজ!”

বলল রাজকন্যা।

“সে কি!”

“হুম।”

“তোমাদের কক্ষে দেখোনি ভালো করে?”

“দেখেছি। নেই। তুমি এক কাজ করো.. কয়েক জন প্রহরী নিয়ে পুরো রাজপ্রাসাদটা ঘুরে দেখো। যদি খোঁজ না মিলে মহামন্ত্রীকে খবর পাঠাও আমি স্বরন করেছি বলে।’

“আমি এক্ষনি দেখছি।”

দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলে আদিম। রাজকন্যা কিছুক্ষন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর হঠাৎই মনে পড়লো আরোভির কথা। পূনরায় ছুটলো তার কক্ষের দিকে। কবিরাজ মশাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে আরোভির চিকিৎসা সম্পূর্ণ করেছেন। আরোভি সুস্থ হয়ে উঠবে। ওকে যে সুস্থ হতেই হবে। ওর বাবা কবিরাজ মশাইকে সে বাঁচাতে পারেনি! অমানবিক নি’র্যা’তনের স্বীকার হয়ে মৃ’ত্যু হয়েছে তার! আরোভির উপর থেকেও কম ধকল যায়নি। যদি আর একদিন দেরী হতো ওকে খুঁজে পেতে তাহলে নির্ঘাত ওরও লা’স উদ্ধার করতে হতো।

সব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। আরোভির কক্ষের সামনে পৌঁছে গেছে সে। বাহিরে প্রহরী দের পাহারায় রাখা হয়েছে। আর কোনো রকম কোনো বিপদের আচ সে আরোভির উপর আসতে দেবে না। কিছুতেই না।

“কবিরাজ মশাই কি চলে গিয়েছেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ রাজকন্যা।”

প্রহরীকে জিজ্ঞেস করতেই নত মাথায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো সে। রাজকন্যা হ্যাঁ সূচক মাথা কাত করলো। আর কিছু না বলে কক্ষের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আরোভি বিশ্রাম নিচ্ছে শয্যায়। তার চোখ বন্ধ। শরীরের বেশিরভাগ ঢাকা পড়েছে চাদরের নীচে। আগের চেয়ে ওর মুখের অবস্থার বদল ঘটেছে। এখন অনেকটাই ফুটে উঠেছো ওর স্নিগ্ধ মুখটা। গৌরবর্ণ গায়ের রঙ। ভারী পল্লবে মোড়ানো চোখ জোড়া। চিকন ভ্রু। মসৃন ললাট। ললাটে ছড়িয়ে আছে একঝাঁক চুল। পিষ্টপুষ্ট একজোড়া ঠোঁট। ভীষণ মায়াবী মুখবিবর। চোখ জুড়িয়ে এলো রাজকন্যার। ওর এতো সুন্দর মায়ায় জড়ানো মুখটা দেখেও কি ওদের একটু মায়া হয়নি?এতোটা পাষান মানুষ হয় কি করে? গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাজকন্যা। এগিয়ে যায় ঘুমন্ত আরোভির কাছে। নীরবে বসে ওর মাথার কাছে। মাথায় হাত রাখে। এই মুহুর্তে ওকে ডাকতে ইচ্ছে করেনা! না জানি কত দিন পর দু-চোখের পাতা এক করতে পেরেছে মেয়েটা। কিন্তু না ডেকেও যে উপায় নেই৷ রাজকুমারের খোঁজ পেতে হলে যে ওর থেকে সবটা জানতেই হবে।

মাথায় কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে ওর নাম ধরে ডাকলো রাজকন্যা। কিন্তু সাড়া দিলো না আরোভি। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সে। রাজকন্যার মায়া যেন আরও বেড়ে যায়। এক রকম পাষাণ হয়েই ডাকে পূনরায়।

“আরোভি? আরোভি শুনছো?”

শুনেনা আরোভি। রাজকন্যা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে। মাথায় রাখা হাতটা নামিয়ে আনে আরোভির ললাটে। শরীরে জ্বর নেই তো! কিন্তু একি! জ্বরের বিপরীতে যে বরফ হয়ে আছে আরোভির শরীর। আঁতকে ওঠে রাজকন্যা। কেমন সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায় আরোভির ঘুমন্ত মুখপানে। হঠাৎ কি মনে হতে একটানে আরোভির শরীরের উপর থেকে চাদরটা ফেলে দেয়। ওমনি দৃশ্যমান হয় আরোভির র’ক্তা’ক্ত শরীরটা। কেঁপে ওঠে রাজকন্যা! ছিটকে পড়ে খানিকটা দূরে। আরোভির খু’ন হয়েছে! কে করলো এই পা’ষা’ণী কাজ! তারই প্রাসাদে তারই আড়ালে এসব কি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। থরথর করে কেঁপে ওঠে রাজকন্যা! মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে যায় ক্ষনকালে। কেউ কি এসেছিলো এই ঘরে? এই সময়ে কবিরাজ মশাই ব্যতীত আর কারোর আসার সম্ভাবনা নেই। আর তাছাড়া প্রাসাদের কেউ জানেইনা এই কক্ষে কবিরাজ মশাইয়ের কন্যাকে এনে রাখা হয়েছে। তবে কি যাদের হাত থেকে আরোভিকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে! তারাই করেছে এই পাষাণী কান্ড!

______________

“সরদার.. আপনি কেন ঐ পুঁচকে কন্যাকে এতো সুযোগ দিচ্ছেন! ও যেকোনো মুহুর্তে আমাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এটুকু ক্ষমতা ওর আছে সরদার।”

সরদার বাঁকা হাসে। তলোয়ারে ধার দিতে দিতে মুখ উঁচিয়ে একবার দেখে জখম রেদোয়ানকে। রাজকন্যার এক আঘাতে আধমরা রেদোয়ান। তাই আরও ভয় পাচ্ছে ওকে।

“আপনি হাসছেন সরদার!”

“আমার মনে পড়ে ঐ বিশেষ ক্ষনটির কথা.. রাজকন্যার কাতর কন্ঠ,আহ্লাদী ডাক। আহ্ কি মধুর সুর রেদোয়ান!”

“আপনি তো ঐ কন্যার প্রেমে মসগুল সরদার। আপনার আব্বাজান জানতে পারলে..”

“আমি কারোর ধার ধারিনা রেয়োদান। আমি আমার দুনিয়া নিজে তৈরি করেছি। সেখানে কারোর হস্তক্ষেপ এই আমি মেনে নেবোনা।”

রেদোয়ান অজানা ভয়ে পিষ্ট হয়। বুক কাঁপে তার ভবিষ্যৎ ভেবে। কি আছে.. কি আছে তাদের ভাগ্যে।

“তুমি মিষ্টি করে দুষ্ট বলো, শুনতে ভালো লাগে..
আমার এই মন ভরে যায় গভীর অনুরাগে..
গভীর অনুরাগে..”

গুনগুনিয়ে ওঠে সরদার। তার স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। যেদিন সে স্বীকারে বেরিয়ে হঠাৎ শুনতে পায় কারোর কাতর কন্ঠের মধুর সুর। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে তার ঘোড়াটি। অথচ সে একবারও তাকে হুকুম করেনি সেখানে দাঁড়াতে। তখনই সে উপলব্ধি করে গানের প্রতিটি কথা। যেন তাকেই কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছিলো তার গানের। তাকেই বারবার ডাকছিলো সেই গানের কথা গুলো। তাকেই বারবার ডাকছিলো। সে যাবে। একদিন নির্ঘাত যাবে। সম্মুখীন হবে রাজকন্যার। নিজের ভালোবাসার জাহির করবে সে। হ্যাঁ নিশ্চয়ই করবে।

#চলবে____

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৩]

রাজকুমারকে পাওয়া গেলো আহত অবস্থায়! তখন তার জ্ঞান একেবারে ছিলো না বললেই চলে। রাজকন্যার বারান্দায় দাঁড়ালে যে ঘন জঙ্গলটা পড়ে, তার খানিকটা দূরেই আহত অবস্থায় পড়েছিলো সে। খোঁজ পেলো আদিম। দ্রুত তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে কবিরাজ কে খবর দেওয়া হলো। রাজকন্যার কক্ষে জড়ো হলো প্রাসাদের প্রায় অনেকেই। কেবল দেখা মিলল না চাচাজানের। রাজকন্যা যেন এই ঘটনায় চাচাজানকেই খুঁজছিল। যেন বারবার সন্দেহের তীরটা চাচাজানের উপরে না পরে। কিন্তু না,সেই তো বরাবরের মতোই চাচাজান সন্দেহের তালিকায় নিজের নামটা সবার আগে লেখালেন।

“একি দশা হলো জামাতার! কে করলো এই দুঃসাহস?”

প্রথমে কন্ঠে তাড়না থাকলেও পরক্ষণেই ক্ষুব্ধ হয়ে আওড়ালেন ফুপুআম্মা। রাজকন্যা বসে আছে রাজকুমারের মাথার কাছে। মাথায় হাত বোলাচ্ছিলো। হঠাৎ কানে বাজলো ফুপুআম্মার কথাটা। মুখ উঁচিয়ে দেখলো মানুষটাকে। অতঃপর ভীষণ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,

“খুব জলদিই সামনে চলে আসবে ফুপুআম্মা। এতো বড় স্পর্ধা যখন হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই আড়ালে লুকিয়ে থাকবে না। সম্মুখে তো তাকে আসতেই হবে।”

চাচীজান মুখ খুললেন। খানিক নাকি সুরেই আওড়ালেন,

“জামাতাকে একলা ফেলে কোথায় থাকো তুমি! দু’জনকে একসাথে দেখা তো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাপু। উনি তো তোমার সোয়ামি নাকি। তাকে এমন হেলায়ফেলায় রেখো নাকো।”

এমন মুহুর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো আরহাম। দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়ালো রাজকুমারের সামনে। বিচলিত দৃষ্টিতে একবার দেখলো ঘুমন্ত রাজকুমারকে। অতঃপর বলল,

“এ দশা কেমন করে হলো রাজকুমারের সঙ্গে?”

“তুমি কোথা থেকে উদয় হলে বাছা?”

ঠেস মারা গলায় বললেন চাচীজান। তোয়াক্কা করলো না আরহাম। ছুটে গেলো রাজকন্যার সামনে। নতশির করে অপরাধী গলায় বলল,

“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা! আব্বাজানের শারীরিক অবস্থা যে মোটেও ঠিক ছিলো না। তাই আমাকে যেতো হয়েছিলো।”

“তোমার আব্বাজান এখন কেমন আছেন?”

পাল্টা প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। যেন সন্দেহ করছে আরহাম কে। আরহাম ঢোক গিললো। নতশির রেখেই জবাব আওড়ালো,

“আজ্ঞে রাজকন্যা, আব্বাজান এখন ভালো আছেন।”

কবিরাশ মশাই রাজকুমারের হাতের ঘা স্থানে পট্টি লাগিয়ে দিলেন। কপালেও লাগালেন বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। বেশ সময় লাগিয়ে মনোযোগের সহিত খতিয়ে খতিয়ে দেখলেন রাজকুমারের শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন। শরীরে আগুন জ্বর। ধারণা করে জানা যায় রাজকুমারকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই অজ্ঞান হওয়ার কোনো ঔষধি দেওয়া হয়। অতঃপর ঘুমন্ত মানুষটাকে অহরন করে তারা। ঠিক কত সময় যাবত তার সঙ্গে শারীরিক নিগ্রহ হয়েছে সঠিক ভাবে অনুমান করতে পারেননি স্বয়ং কবিরাজ মশাইয়ো। রাজকন্যা প্রতিটি বাক্য গেঁথে নিয়েছে তার মস্তিষ্ক। তার রাজকুমারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই অন্যায় সে কিছুতেই মেনে নেবেনা। এর বিহিত সে অতি দ্রুত করে ছাড়বে।

“প্রহার করাতে জ্বর এসেছে মাত্রাতিরিক্ত। যা ঔষধি আমি দিয়েছি তাতে আশাকরি রাজকুমার অতিদ্রুত এই পীড়া থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু উনার সাথে সার্বক্ষণিক কাউকে থাকতে হবে। এই যে জলপট্টি রইলো। এটা খানিক বাদে বাদে পাল্টে নিয়ে পূনরায় উনার ললাটে দিয়ে রাখবেন। যদি জ্বরটা একদমই না কমে তবে আমাকে আবারও ডেকে পাঠাবেন। আমি এসে দেখে যাবো উনাকে।”

“জি কবিরাজ মশাই, আমি আছি রাজকুমারের সঙ্গে। আর সার্বক্ষনিক থাকবো।”

শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে করুন দৃষ্টিতে একবার দেখলো রাজকুমারের শুঁকনো মুখটা। বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। কবিরাজ মশাই পূনরায় বললেন,

“রাজকুমারের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করুন। জ্ঞান ফিরতে উনাকে কিছু তরল খাবার খাওয়াবেন। তেঁতো মুখে ঝাল খাবারই ঠিক হবে।”

“জি।”

“আমি এবার উঠলাম। দরকার পড়লে আমাকে খবর পাঠাবেন রাজকন্যা।”

“নিশ্চয়ই।”

কবিরাজ মশাই বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আদিম আর আরহামও বেরিয়ে গেলো। বাকি রইলেন চাচীজান আর ফুপুআম্মা। ফুপুআম্মা শুরু থেকেই কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছেন রাজকুমারকে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। রাজকন্যার চোখ এড়ালো না তা। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে ডাকলো ফুপুআম্মাকে। ফুপুআম্মা প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে রাজকন্যার দিকে তাকালেই রাজকন্যা বলে,

“উনার মাথায় একটু জলপট্টি দিয়ে দিবেন ফুপুআম্মা? আমি উনার আহারের বন্দবস্ত করে আসতাম।”

এই বলে উঠে গেলো নিজের জায়গা থেকে। ফুপুআম্মা খানিক্ষন নিশ্চুপ থেকে বুঝতে চেষ্টা করলো ঠিক কি বলতে চাইলো রাজকন্যা। পরক্ষণেই অবাক কন্ঠে আওড়ালেন,

“আমি?”

” জি ফুপুআম্মা।”

জবাব দিলো রাজকন্যা। ফুপুআম্মা বিস্মিত নয়নে এগিয়ে গিয়ে রাজকুমারের পাশে বসলো। তিনি বিস্মিত হলেও মনের মাঝে এক অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভব করলেন। যা এর আগে কখনও হয়নি।

“চাচীজান, চাচাজান কোথায়?”

চাচীজান হঠাৎ চমকে উঠলেন রাজকন্যার এহেম প্রশ্নে। তিনি ঘাবড়ানো গলায় বললেন,

“উনি! উনি তো কোথাও একটা গিয়েছেন!”

“এতো সাতসকালে চাচাজান কোথায় গিয়েছেন চাচীজান?”

“আ্ আমি জানি না।”

“কখন ফিরবেন কিছু জানিয়েছেন?”

“না বললেন নি তো।”

“প্রাসাদে ফিরতেই বলবেন রাজকন্যা আপনাকে স্বরন করেছিলেন।”

“অ্ অবশ্যই।”

চাচীজান কোনো মতে জবাব দিয়ে প্রস্থান করলেন। রাজকন্যা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।

____________

রাজকুমারের জ্ঞান ফিরেছে দুপুরের প্রথম ভাগে। রাজকন্যা কবিরাজ মশাইয়ের আদেশ মতো যাবতীয় আহার করিয়েছে রাজকুমারকে। আর তার ঠিক খানিকটা সময় পরই শরীর ঠান্ডা হয়ে জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। এখন প্রায় গভীর রাত। ঘুম আসছে না কারোরই। রাজকুমার সোজা হয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি উপরের দিকে শূন্যে। রাজকন্যা কতক্ষণ পরপরই এপাশ ওপাশ করছে। রাজকুমার না ঘুমালে তার যে বের হওয়া অসম্ভব।

“ঘুমোচ্ছেন না কেন? খারাপ লাগছে কি?”

প্রশ্ন করলো রাজকুমার। রাজকন্যা চমকে উঠলো যেন। পাশ ফিরে রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বলল,

“খারাপ লাগছেনা। তবে ঘুমও ধরা দিচ্ছে না চোখে। কিন্তু আপনি কেন জেগে আছেন? আপনাকে তো ঘুমোতে হবে। শরীরের যে বিশ্রাম দরকার।”

“আমারও ঘুম আসছেনা।”

করুন কন্ঠে বলল রাজকুমার। রাজকন্যা উঠে বসল।

“ক্ষিদে পেয়েছে কি?”

“না। পেটের খাবারই হজম হয়নি এখনও।”

“তবে কি শরীর খারাপ লাগছে?”

“উঁহু.. মন বলছে তার মন খারাপ!”

“সে কি!”

“হু। আপনি কি মন ভালো করতে পারেন রাজকন্যা?”

“জানিনা তো! কখনও কারোর মন ভালো করিনি আমি।”

“চেষ্টা করবেন একবার?”

“অবশ্যই। একবার নিশ্চয়ই করবো।”

“মনটা আপনাকে ছুঁতে চায়! বারন করলেও জেদি হয়ে ওঠে!”

রাজকন্যা লজ্জা পেলো রাজকুমারের কথায়। কিছু মুখে আটকায় না রাজকুমারের! কেমন গরগর করে বলে দেয় সবটা!

“আমি কি একবার ছুঁতে পারি আপনাকে? একটু গভীর ভাবে?”

রাজকন্যার গলায় কিছু একটা বিঁধল। ঢোক গিললো বার কয়েক। মাথা ঝুঁকে পড়লো নতজানু হয়ে। মুখ উঁচিয়ে তাকাতে পারলো না কোথাও। রাজকুমার হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো। ব্যাথায় টনটন করছে শরীর। বড় আক্ষেপ হচ্ছে তার! গুপ্তচর আক্রমণ করলো কিন্তু অজ্ঞান অবস্থাতে। জ্ঞান থাকা অবস্থায় আক্রমন করলে কি এমন অসুবিধা হতো তাদের?

“আপনি যখন লজ্জা পান তখন আপনাকে দেখতে রসগোল্লার মতো লাগে। পারি না শুধু খেয়ে ফেলতে!”

“ধ্যাৎ!”

অতিকষ্টে জবাব দিতে পারে রাজকন্যা। রাজকুমার গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকায় রাজকন্যার দিকে। মিষ্টি রঙের পোষাকে তার গৌরীকে মন্ত্রমুগ্ধ লাগছে। তার প্রনয়নী। তার মনোহরিনী।

“আপনি খুব বেশরম।”

“জানি তো।”

“জানেন না। আ্ আপনি কিছু জানেন না।”

“আপনি যে ভয় পাচ্ছেন! আমি কিন্তু ছুঁইনি আপনাকে!”

পূনরায় ঢোক গিলতে হলো তাকে। লোকটা এমন সব কথা বলে যাচ্ছে। লজ্জায় যে মরেই যাবে সে।

“চুপ করুন না।”

“লজ্জা পাচ্ছেন!”

“একদম না!”

“তবে দেখছেন না কেন আমায়?”

“আপনার মন ভালো করতে হলে কি করতে হবে বলুন না?”

“আমাকে কাছে আসতে দিন।”

কেঁপে উঠলো রাজকন্যা। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে রাজকুমারের লজ্জার বান। আপাদমস্তক শিরশির করে উঠলো এক পবিত্র অনুভূতিতে। বুকের ভেতর হাতুড়ির বারি গুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। ধক ধক শব্দ করে যাচ্ছে তারা। নিঃশ্বাস আর অক্ষিপট অনেক্ষন পূর্বেই বন্ধ হয়ে গেছে।

“তাহলে আমার মন ভালো হবে।”

পূনরায় বলল রাজকুমার। রাজকন্যা হঠাৎ ভারী নিঃশ্বাস ছাড়লো। রাজকুমার পলক ঝাপটে মাথাটা আরেকটু নীচু করে এক পলক দেখে নিলো তার রমনীকে। তার লজ্জাবতীকে।

“আপনি ও না ভীষণ লজ্জা পান।”

“আ্ আমি আসছি..”

এই বলে রাজকন্যা শয্যা ত্যাগ করতে নিলেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরে রাজকুমার। ব্যাকুল কন্ঠে বলে,

“আমার তো মন খারাপ রাজকন্যা!”

রাজকন্যা জবাব দিতে পারেনা। তার নিঃশ্বাস ভারী পড়ছে। তা বুঝতেই হাত ছেড়ে দেয় রাজকুমার। রাজকন্যা ছাড়া পেয়ে এপাশে এসে পালাতে চাইলেই পথ রোধ করে রাজকুমার। লাগামহীন কন্ঠে বলে,

“ভালোবাসি,খুব বেশি ভালোবাসি আপনাকে!”

রাজকন্যা ঘুরে যায় উল্টো দিকে। তৎক্ষনাৎ দৃশ্যমান হয় রাজকন্যার উদার পিঠ। রাজকুমার বেসামাল হয়ে হাত বুলায় রাজকন্যার পিঠে। রাজকন্যা দমবন্ধ অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে। খামচে ধরে নিজের পোষাক। চোখ বন্ধ করে শ্বাসরুদ্ধ করে নেয়। রাজকুমার মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ন্যায় রাজকন্যাকে। তার কাঁধে গাঢ় চুমু একে হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে,

“একবার বলুন না ‘ভালোবাসি!’ ”

রাজকন্যা কাঁপতে লাগে। কিছু বলতে পারেনা। রাজকুমার তার কোমর ছেড়ে বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। রাজকন্যার ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে কোমল স্বরে বলে,

“আমার সাথে পালাবেন রাজকন্যা?”

“ক্ কোথায়?”

“আমি যেথায় নিয়ে যাবো?”

“প্ পালাবো কেন?”

“জানিনা।”

“পাগল।”

“ভীষণ!”

“ভালোবাসি!”

রাজকুমার বিস্ময়ে হা করে তাকালো হঠাৎ। রাজকন্যা এভাবে হুট করে কথাটা বলে বসবে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো।

“ক্ কি বললেন!”

রাজকন্যা লজ্জায় মুখ লুকালো। কিন্তু সহ্য হলো না রাজকুমারের। ঠিক নিজের সম্মুখে স্থির দাঁড় করালো তাকে। বলল,

“আ্ আর একবার শুনতে চাই! দয়াকরে বলুন?”

রাজকন্যা করুন চোখে তাকালো। বলল,

“বড্ড জ্বালাচ্ছেন!”

“বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি যে!”

“আমিও!”

মাথা নত করে পূনরায় স্বীকার করলো রাজকন্যা। খুশিতে রাজকুমারের নেত্রকোন ভিজে উঠলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আর্তনাদী কন্ঠে বলল,

“আমি বদ্ধ উন্মাদ আপনার প্রেমেতে। একেবারে বদ্ধ উন্মাদ মনোহরিণী।”

বলতে বলতেই অধরে অধর আঁকড়ে ধরলো রাজকুমার। রাজকন্যা অনুভব করলো তবে আর কিছুই বলার সুযোগ দিলো না রাজকুমার। এই রজনী তার জন্য শ্রেষ্ঠ রজনী করে তুললো রাজকুমার। শ্রেষ্ঠ রজনী।

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🤍
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৪]

চাচাজানের সঙ্গে দেখা হলো প্রভাতে। ভীষণ ভীতু দেখাচ্ছিলো তাকে। সবার নজর এড়িয়ে চুপিচুপি ঢুকেছেন প্রাসাদে। কিন্তু আকস্মিক রাজকন্যা সামনে এসে পড়বে ভাবনাতে ছিলো না।

“কোথায় গিয়েছিলেন চাচাজান?”

শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। চাচাজান ভড়কে গেলেন। ধপ করে জ্বলে উঠলো তার ভেতরের ভয়।

“ক্ কোথাও না তো। একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।”

“গত-কাল থেকেই?”

চাচাজান থমকে গেলেন! সে যে গতকাল থেকেই প্রাসাদে নেই সেকথা জ্ঞাত হয়েছে রাজকন্যার! এবার তিনি কি জবাব দেবেন? ভয়ার্ত গলায় ঢোক গিললেন চাচাজান। দৃষ্টি অস্থির করে ভাবছেন কোনো মিথ্যে যুক্তিযুক্ত কথা। যেন না চাইতেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় রাজকন্যা।

“গ্ গতকাল!! ন্ না!! আমি তো প্রাসাদেই ছিলাম?”

“চাচীজান তো বললেন আপনি এখনও ফেরেননি। তাছাড়া দ্বার-এ পাহারারত প্রহীরাও কিছু বললো না আমায়?”

“ক্ কি করে বলবে? আমি তো পশ্চাৎ দ্বার থেকে প্রাসাদে প্রবেশ করেছি।”

“আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন চাচাজান! সেখানেও আমাদের প্রহরীরা থাকে। ওরাও আমাকে কোনো খোঁজ দেয়নি।”

“তুমি কি আমার পেছনে গুপ্তচর রেখেছো?”

“না চাচাজান। আমার আপনাকে এক বিশেষ কাজে প্রয়োজন ছিলো। যার কারনেই আপনাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। তাছাড়া, আপনি কি আমার অগোচরে এমন কোনো কাজ করছেন যার কারনে আমার গুপ্তচরের শরণাপন্ন হতে হয়?”

চাচাজান ঘাবড়ে পড়লেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের জড়ো হয়েছে। সবটাই নিখুঁত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে রাজকন্যা। চাচাজান গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়েন। রাজকন্যার সম্মুখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলেন,

“কি বিশেষ কাজ?”

“আপনাকে আমার হয়ে ছোট্ট একটা ঘোষনা দিতে হবে রাজ্যবাসীর কাছে?”

চাচাজান পূনরায় ঘাবড়ান! পরপর বার কয়েক ঢোক গিলে বলেন,

“ক্ কি ঘোষণা?”

রাজকন্যা মুচকি হাসে। আর সেই হাসিতেই লুকিয়ে থাকে হাজারও একটা রহস্যের ছাপ। নিজের মাঝে একটা দাম্ভিকতার সুর টেনে বলে,

“আপনাকে ঘোষনা করতে হবে রাজা সিরাজ উদ্দীনের শূন্য আসনে আজ থেকে বিরাজ করবেন রাজকন্যার হূরিয়া!”

রাজকন্যার কথাটায় চমকে উঠলেন চাচাজান। তিনি এমন ভাবে চমকালেন যেন এমন বিস্মিত, অবিশ্বাস্য বানী তিনি এর আগে কোনোদিন শোনেননি। রীতিমত বজ্রাহত হলেন তিনি।

“কি?”

“জি চাচাজান।”

রাজকন্যা নরম কন্ঠে জবাব দিলো। চাচাজান স্বপ্ন ভঙ্গের ন্যায় কিছুক্ষন স্থবির দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর ধীরপায়ে প্রস্থান করলেন নিজের কক্ষের দিকে।

রাজকন্যারা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। মনেমনে বলল,

“খুব শ্রীঘ্রই ফাঁস হবে চাচাজান! সবটা ফাঁস হবে।”

____________

“কি!! ঐ পুঁচকে মেয়ে এখন রাজ্য শাসন করবে? আর আমাকে সেটাও দেখতে হবে?”

বজ্রকন্ঠে হাঁক ছাড়লেন ওস্তাদজী। উপস্থিত রেদোয়ান সহ সবার ভেতরেই ভয়ের রেশ ঢুকে গেলো তার বজ্রকন্ঠে। সবাই মাথা নীচু করে জমিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। মুলত জবাব দেওয়ার দুঃসাহস নেই!

“আয়াস কোথায়?”(চেঁচিয়ে)

“ওস্তাদজী, সরদার তো তার কক্ষে নেই। স্বীকারের বেরিয়েছেন!”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ওস্তাদজী।

“এখন কি স্বীকার করার সময় হ্যাঁ? তাকে এক্ষনি ডেকে পাঠাও। জানাও তার আব্বাজান স্বরন করেছে তাকে!”

“আব্বাজান.. আমি তো এখানে!”

বলতে না বলতেই আগমন ঘটলো তাহার পুত্রের। হাতে তীর-ধনুক নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো আব্বাজানের সামনে। আশেপাশে সবার ভয়ার্ত মুখ পানে একবার দৃষ্টি রেখে হাতের তীর-ধনুকটা বাড়িয়ে দিলো রেদোয়ানের দিকে। রেদোয়ান দেরী না করে নতশির করে তীর-ধনুকটা নিয়ে নিলো। ওস্তাদজী রাগ আর ক্ষোভে এখনও আগুন প্রায়। যদিও পুত্রের আগমনে কিছুটা হলেও দুঃশ্চিন্তা কমছিলো কিন্তু হঠাৎই আবার রাজকন্যার সিদ্ধান্তের কথা মনে পড়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলেন ভেতরে। ফোঁস ফোঁস শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলেন। আয়াস হাত বাড়িয়ে আব্বাজানের দুই বাহুতে রাখলো। কন্ঠ কোমল রেখে পূনরায় শুধালো,

“কিসের এতো দুঃশ্চিন্তা করছেন আপনি?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে একপ্রকার মিইয়ে পড়লো ওস্তাদজী। পুত্রের হাতের উপর হাত রেখে ক্লান্ত স্বরে বললেন,

“হূরিয়া রাজ সিংহাসনে বসবে বলে ঘোষনা করেছে আয়াস। আমরা কি তবে হেরে যাচ্ছি আমাদের উদ্দেশ্যের পথে?”

আয়াস মৃদু হাসলো। ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

“ব্যস? এইটুকুই?”

ওস্তাদজী অবাক হলেন। খানিক রাগ মিশ্রিত গলায় বললেন,

“ব্যাপারটা তুমি এতো হালকা ভাবে নিওনা আব্বাজান! আমাদের এতো বছরের সাধনায় এমন করে জল পড়তে দিওনা।”

“রেদোয়ান..(গলা উঁচিয়ে)”

” আদেশ করুন সরদার?”

“আব্বাজানের জন্য ঠান্ডা একগ্লাস শরবতের ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ.. বন্দীশালার বন্দী রাজা সিরাজ উদ্দীনকে দিতে ভুলোনা যেন।”

“যথাআজ্ঞা সরদার।”

এই বলে চলে গেলো রেদোয়ান। আয়াস আবারও গলা উঁচিয়ে ডাকলো,

“এই মকবুল? আব্বাজানের বসার ব্যবস্থা কর।”

“আজ্ঞে সরদার।”

মকবুল নামের ছেলেটিও ছুটলো। ঠিক সিংহাসনের ন্যায় বড় একটা চৌপায়া নিয়ে হাজির হলো সে। ওস্তাদজীর সামনে রেখে মাথা নত করে সেখানে বসবার জন্য অনুরোধ করলো। আয়াস তাকে বসিয়ে দিলো সিংহাসনে। অতঃপর নিজেও বসলো আব্বাজানের পায়ের কাছে। পায়ে মালিশ করতে করতে বলল,

“আমি আপনার একমাত্র পুত্র আব্বাজান। আপনার দুই নয়নের মনি। আপনি যেমন আমায় খুব ভালোবসেন স্নেহ করেন ঠিক তেমনই আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি আর সম্মান করি আব্বাজান। আপনি আমার কাছে ছোট্ট একটা আবদার করেছেন আব্বাজান। আর আমি সেই আবদার রাখবোনা এ যে অসম্ভব! আমি যে আপনার লাগি নিজের জান টাও কবজ করতে দ্বিধা করিনা আব্বাজান। আপনি শুধু ভরসা রাখেন আপনার পুত্রের উপর। আমি আপনার আবদার পূরন করবো। করবোই করবো।”

ওস্তাদজী এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আয়াসের দিকে। উপরে স্নেহ দেখালেও ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। শত্রুর উপর ভরসা করা যায় না। তবুও সে করছে! কারন সে শত্রুকেই নিজের হাতিয়ারের ন্যায় ধারালো অস্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে এতোদিন। হ্যাঁ, আয়াস তার নিজের সন্তান নয়। সে তো ইহকালেও কাউকে বিয়েই করেনি। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের ইতিহাস তিনি একা গোপনে বহন করে এসেছেন। আজও বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। না জানি আরও কতকাল বয়ে নিয়ে যেতে হবে। নিজের স্বার্থ না থাকলে কবেই যে দি’খন্ড করতো এই অতিবুদ্ধি সম্পন্ন পুত্রের। মাঝেমাঝে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন জীবনের এই বার্ধক্যে পৌঁছে। বয়সের সাথে সাথে শক্তি বাড়েনা। যেটার আক্ষেপ রয়ে যাবে তার গোটা জীবনটায়।

“কি ভাবছেন আব্বাজান?”

ভাবনার ঘোর কাটে ওস্তাদজীর। কিছুটা চমকান তিনি। কি জবাব দিবেন ভাবতে ভাবতে হুট করে বলে উঠলেন,

“সিরাজের কন্যা বড়ই চতুর! কখন কি করে..”

“আপনার পুত্র এখনও বেঁচে আছে আব্বাজান। ছোট্ট একটা মানুষ.. একটু সখ হয়েছে পিতার সিংহাসনে বসার! বসুক.. একটু আরাম আয়েস করুক? অসুবিধা তো নেই। সময় হলে ঐ ছোট্ট মানুষটার থেকে কি করে সবটা কেড়ে নিতে হয় আপনিও দেখবেন আব্বাজান।”

“আমাদের সময় টা আসবে কোন ক্ষনে?”

“আসবে। অতিশীঘ্রই আসবে।”

“সরদার, শরবত।”

“হু.. বলে হাত বাড়িয়ে শরবতটা নিয়ে নিলো আয়াস। অতঃপর আব্বাজানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” শরবতটা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করেন আব্বাজান। আমি আসছি।”

“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

“রাজকন্যার কাছে!”

_____________

রাতের মধ্য প্রহর। রাজকন্যা কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তুললো রাজকুমারকে। রাজকুমার চোখমুখ কুঁচকে দেখছে রাজকন্যাকে। তার ঘুমের রেশ কাটেনি এখনও। তাই চোখ মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে।

“কি হলো রাজকন্যা! এই নিশীথে কি কাউকে ডেকে তুলতে হয়?”

রাজকন্যা মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে রাজকুমারের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

“আজ চাঁদনি রাত। চলুন না চন্দ্রবিলাস করবো?”

“আমার ঘুম আসছে।”

“উফফ চলুন তো।”

এই বলেই হাত টেনে শয্যা থেকে নামিয়ে আনলো রাজকুমারকে। অতঃপর টেনে নিয়ে গেলো একদম রাজপ্রাসাদের বাইরে উপবনে(বাগানশোভিত)। অম্বরের বক্ষ চিঁড়ে নিশাকান্তের আলো পড়েছে সমস্ত উপবনে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চারিধার। চোখ জুড়িয়ে এলো রাজকন্যার। এমন মধুর ক্ষন আর বুঝি হয়না। হতেই পারেনা। এটাই যেন এই বসুন্ধরার সবচেয়ে বিশেষ ক্ষন। সবচেয়ে সুন্দর, মধুর ক্ষন। এই ক্ষনের প্রেমে পড়তে চায় রাজকন্যা। গভীর প্রেমে পড়তে চায়। উপবনের ঠিক মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে রাজকন্যা। নিশাকান্তের আলো এবার সমস্তটা তার অঙ্গে বিরাজ করছে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে তুলছে তাহার সারা অঙ্গ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তার মনোহরণিকে দেখে চোখ জুড়াচ্ছে রাজকুমার। মাঝেমাঝে নিজেকে যে ঠিক কতটা ভাগ্যবান বলে মনে হয় সে নিজেও জানেনা। এই ধরণীর একমাত্র ভাগ্যবান পুরুষ সে।

রাজকন্যার চোখে চোখ পড়লো রাজকুমারের। রাজকন্যা লজ্জামিশ্রিত চমৎকার হাসলো। হাত বাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকলো তাকে। রাজকুমার দাঁড়িয়ে না থেকে এগিয়ে গেলো রাজকন্যার পানে। ঠিক তার সম্মুখে দাঁড়ালো। আত্মতৃপ্ত কন্ঠে বলল,

“উপরওয়ালা আপনাকে কি দিয়ে তৈরি করেছে বলুন তো?”

রাজকন্যা হেসে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য মান হলো তার আঁকাবাকা গজদাঁত। বাতাসের গতি খুবই অল্প। অল্প বিস্তর গতিতে কপালের উপরের চুল গুলো মৃদু তালে উড়ছে। রাজকন্যা সেগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,

“স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে নাকি স্ত্রীকে তৈরি করা হয়। সেই মাফিক আমিও আপনার অংশেই সৃষ্টি জনাব।”

রাজকুমার হাসলো। প্রশংসনীয় হাসি। হাত বাড়িয়ে রাজকন্যার দু’গালে আলতো করে রাখলো৷ ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখে বলল,

“আজ যখন আপনাকে সিংহাসনে বসতে দেখলাম, আমি ক্ষনিকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! আপনার শাসন,আপনার বারন, আপনার ন্যায় বিচার, ন্যায় বানী.. সবটাতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি আমি। আপনি যে পরিপূর্ণ নিখুঁত মনোহরণি। পরিপূর্ণ নিখুঁত। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি বড়ই কৃতজ্ঞ। কেননা আমি ভাগ্যবান।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাজকুমার যেমন মুগ্ধ হচ্ছিলো ঠিল তেমনই মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছিলো রাজকন্যা। কিন্তু হঠাৎ ঘটে গেলো এক অকল্পনীয় কান্ড। বড় অশ্বত্থ গাছটার আড়াল থেকে তীর এসে সোজা বিঁধে গেলো রাজকন্যার বাহুতে। রাজকন্যা চাপা আর্তনাদ করে লেপ্ট গেলো রাজকুমারের সঙ্গে! রাজকুমার আঁতকে উঠে রাজকন্যাকে আগলে ধরে পাশে সরে যেতেই আরেকটা তীর তীব্র তেজে ছুটে এলো। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তীরটা তাদের ছুঁতে ছুঁতে বেরিয়ে গেলো। রাজকুমার হাঁক পেড়ে প্রহরী ডাকতেই ঝোপঝাড় ভেঙে পালালো গুপ্তচর!

#চলবে