রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
204

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৫]

রাজকন্যার বাহু থেকে গলগল করে র’ক্ত ঝড়ছে। রাজকুমারের পোশাক ভিজে উঠেছে প্রায়। একহাতে শক্ত করে আগলে রেখেছে তার প্রনয়নীকে। আর অন্যহাতে তীরটা টেনে বের করার চেষ্টা করছে। রাজকন্যার ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। যন্ত্রণায় কাহিল প্রায়। তবুও তীব্র মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকুমারকে বাঁধা না দিয়ে নিজের মনোবল দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু রাজকুমার নিজেই ভেঙে পড়ছে বারবার। তার অন্তর কাঁপছে। মন কাঁদছে! নিজের ভালোবাসার মানুষটার এহেম জখম সে মেনে নিতে পারছেনা।

“আহহহহ্!”

চাপা স্বরে আর্তনাদ করে খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো রাজকন্যা! তীরটা বের করে ফেলেছে রাজকুমার। কোনো মতে সেটা দূরে ছুঁড়ে মেরে আঁকড়ে ধরলো রাজকন্যাকে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আওড়ালো,

“দুশ্চিন্তা নেই! আপনি এখন নিরাপদ।”

রাজকন্যা টের পাচ্ছে মানুষটার বুকের ভেতর ঘটতে থাকা তোলপাড়। ধুকপুক করে শব্দ করছে হৃদপিণ্ড। তার কি তীব্র তেজ। নিজের জখম ভুলে গেলো রাজকন্যা। মাথা তুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“আমি ঠিক আছি রাজকুমার। আপনি এতো ঘাবড়াবেন না দয়াকরে।”

নিশাকান্তের আলোতে দৃশ্যমান হয় রাজকুমারের অশ্রুসিক্ত নেত্রজোড়া। রক্তিম আভায় ঘিরে থাকা নেত্রকোন। শত খানেক চিন্তায় কুঁচকে যাওয়া তার ললাট। রাজকন্যা মৃদু হাসে। হাত উঠিয়ে আলতো স্পর্শ করে রাজকুমার অশ্রুসিক্ত নয়ন। মৃদু কন্ঠে আওড়াতে চেষ্টা করে,

“এই জখম তো কিছুই নয় রাজকুমার। আমি জানি এরচেয়েও ভয়ানক জখম অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আর আমি এর জন্য প্রস্তুত।”

আহত দৃষ্টিতে তাকায় রাজকুমার। তার মন মানেনা। যেন শুনেও শুনেনা রাজকন্যার বানী। হুট করে কোলে তুলে ন্যায় রাজকন্যাকে। ক্ষিপ্ত স্বরে হুকুম করে,

“কবিরাজকে খবর পাঠাও!”

এই বলে দ্রুত পায়ে চলে আসে নিজেদের কক্ষে। রাজকন্যাকে শুয়ে দেয় শয্যায়। ছুটে যায় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। কবিরাজ আসতে আসতে রাজকন্যার যতখানি র’ক্তক্ষরন হয়ে যাবে সেটা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। যার দরুন রাজকন্যার শরীরে বড় কোনো রোগ বাসা বাঁধতে সময় নিবেনা।

“আপনি জানেন আক্রমনকারীরা কারা ছিলো?”

র’ক্ত বন্ধ করার যাবতীয় উপকরণ লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলো রাজকুমার। রাজকন্যা একপলক দেখলো রাজকুমারকে। অতঃপর শূন্যে দৃষ্টি ভাসিয়ে বলল,

“ঘর শত্রু বিভীষণ। জানিনা আমি।”

রাজকুমার চমকালো। তার নয়ন উৎসুক হয়ে উঠলো। কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।

“এর মানে?”

“বিশেষ কিছু নয়!”

“শত্রুর বাস কি তবে নিজ গৃহেই?”

দৃঢ় কন্ঠে জানতে চায় রাজকুমার। রাজকন্যা ঢোক গেলে। চোখ বোঁজে। চাচাজানের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা একবার কল্পনা করতে চেষ্টা করে। ফের চোখ মেলে তাকায়। মলিন কন্ঠে বলে,

“হয়তো কিংবা হয়তো না।”

“আমি আপনার জীবনের ঝুঁকি নিতে পারবোনা রাজকন্যা।”

“ঝুঁকি! জীবনে ঝুঁকি তো তখনই এসেছে যখন থেকে আব্বাজান নিখোঁজ হয়েছেন।”

“রাজা মশাই নিখোঁজ!”

বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো রাজকুমার।

“কিন্তু আব্বাজান যে বলেছিলেন রাজা মশাই গত হয়েছেন?”

“না। আব্বাজান বেঁচে আছেন।”

“আপনি এতোটা নিশ্চয়তার সঙ্গে কি করে বলছেন?”

“আমার বিশ্বাস রাজকুমার। আমি বিশ্বাস করি। আর আমি জানি আমার মন সঠিক বলছে।”

“কিন্তু…”

“রাজকন্যা.. আপনার এ দশা কি করে?”

ছুটে এলেন কবিরাজ মশাই। সঙ্গে এলো আরহাম,আদিম, মহামন্ত্রী আরও কয়েকজন। রাজকন্যা ক্লান্ত দৃষ্টিতে দেখলো তাদের। মহামন্ত্রী এগিয়ে এলো রাজকন্যার পাশে। চিন্তান্বিত কন্ঠে বললেন,

“শত্রুরা এমন ভাবে আক্রমণ করবে আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি রাজকন্যা!”

কবিরাজ মশাই বসে পড়ে রাজকন্যার পাশে। তার চিকিৎসার সকল প্রকার সরঞ্জাম বের করে লেগে পড়ে কাজে। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মলিন হাসার চেষ্টা করে বলে,

“শত্রুরা তো যেকোনো ভাবেই আঘাত করতে পারে মন্ত্রী মশাই। কেবল আমরাই পারিনা। আমরা তাদের মতো কাপুরুষ নই। আমরা পেছন থেকে আক্রমণ করিনা। আমরা সামনাসামনি মোকাবিলা করি। আর সারাজীবন তাই করবো। কেননা, এটাই আমাদের ধর্ম।”

“মন্ত্রী মশাই, আমি এর যথাযোগ্য জবাব চাই। আগামীকালকের মধ্যেই ওদের আমি সচক্ষে দেখতে চাই। আপনি প্রহরী বাড়ান। প্রাসাদকে সুরক্ষিত রাখুন।”

“আজ্ঞে রাজকুমার।”

মন্ত্রী মশাই প্রস্থান করলেন। রাজকুমার ভেতরে ভেতরে ক্রোধে ফেটে পড়ছে। কার এতো বড় দুঃসাহস হতে পারে? রাজকন্যা পর্যবেক্ষণ করছে রাজকুমারকে। আরহাম এসে দাঁড়ালো রাজকুমারের পাশে। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,

“আমি ব্যাপারটা দেখছি রাজকুমার। আপনি শান্ত হোন।”

“আমি শান্ত হতে পারবোনা আরহাম। ওদেরকে আমার সামনে চাই। যেকোনো মূল্যে।”

“আমি দেখছি।”

এই বলে আরহাম প্রস্থান করলো। সঙ্গে গেলো আদিমও। এদিকে কবিরাজ মশাইয়ের কাজও শেষের দিকে। তিনি ঔষধি লাগিয়ে রাজকন্যার হাতে ভালো করে পট্টি লাগিয়ে দিয়ে ক্ষনিকের মাঝেই বিদায় হলেন। রাজকন্যা তার যাওয়ার পানে একবার তাকিয়ে শয্যা ছেড়ে নেমে এলো নীচে। রাজকুমার তখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকন্যা এগিয়ে গেলো সেদিকটাতে। রাজকুমারের পেছনে দাঁড়িয়ে কোমল স্বরে আওড়ালো,

“এতো ক্রোধান্বিত কেন হচ্ছেন? আপনার প্রনয়নী তো ঠিক আছে।”

রাজকন্যার গলা পেয়ে রাজকুমার চটজলদি পেছন মুড়ে তাকালো। ব্যস্ত হয়ে পড়লো হঠাৎ।

“আপনি উঠে এলেন কেন? একটু বিশ্রাম নিতে পারলেন না হু? এতো কিসের শক্তি আপনার?”

রাজকন্যা মিটমিটিয়ে হাসলো। রাজকুমারের দিকে দিকে তাকিয়ে মোহান্বিত কন্ঠে বলল,

“আপনি এতো মোহমুগ্ধ কেন?”

রাজকুমার ভড়কায় কিঞ্চিৎ। হঠাৎই রাজকন্যার কথার তাল ধরতে পারেনা সে। আমতাআমতা করে বলে,

“জানিনা তো।”

“আমি আপনার প্রণয়ে বিভোর রাজকুমার। এতো কেন ভালোবাসলাম আপনাকে? এতো কেন মাতাল হলাম আপনাতে? কেন! আপনার প্রতি আমার অতিরিক্ত চাওয়া ধ্বংস করে দিবে নাতো এই বসুন্ধরাকে? আমাকে,আপনাকে.. ধ্বংস করবে না তো?”

রাজকুমার অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। তার ভয়ার্ত মুখশ্রী ঠিক কতটুকু বোধগম্য হলো রাজকন্যার বোঝা গেলোনা। রাজকন্যার গলা ক্রমশই জড়িয়ে আসছিলো। চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠলো। রাজকুমার বুঝতে পারলো ঔষধির আচর পড়েছে তার উপর। রাজকন্যা ধীরেধীরে ঘোরে তলিয়ে গেছে। রাজকুমার আর দেরী করলো না। কোলে তুলে নিলো রাজকন্যাকে। অতঃপর শয্যায় এনে শুয়ে দিতেই ব্যাথা ভুলে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো রাজকন্যা। তবে ঘুমের মাঝেও একটা শব্দ আওড়লো,

“ধ্বংস!”

______________

ধারালো অস্ত্রে নিজের মুখটা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে রেদোয়ান। ভয়ে তার গলা শুঁকিয়ে কাঠে পরিনত হয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে ধর থেকে তার মাথা আলাদা হয়ে যেতে পারে। এই মুহুর্তে মৃত্যু চোখের সামনে তাল তুলে নাচছে।

“সরদার.. আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন!”

“খবরদার! আর একটা মিথ্যে বানী এই জবান থেকে বেরোলো দিখন্ড হবে এই মাথা!”

বজ্রকন্ঠে হুংকার ছাড়লো আয়াস। রাগে তার মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে এসেছে। ঠিক ভুলের পার্থক্য এই মুহুর্তে আর সম্ভব নয়। আশেপাশের সমস্ত চেলাপেলা ভয়ে জমে গেছে প্রায়। সরদারের হঠাৎ এই রূপে মৃত্যুর কালো ছায়া দেখতে পাচ্ছে তারা। ওস্তাদজীর কথা শোনার দায়ে এবার যে জান যাবে তাদের! কি হতো ওস্তাদজীর একটা কথা না শুনলে?

“স্বীকার কর আমার অগোচরে তোরা ষড়যন্ত্র করে রাজকন্যার উপর হামলা করেছিস! স্বীকার কর।”

আয়াস আবারও হাঁক ছাড়লো। কন্ঠ ভয়ংকর। তার এই ক্রোধে যে ধ্বংস হয়ে যেতে সবকিছু। বিবেচনা করেননি ওস্তাদজী। সেই আফসোসেই ম’রে যাচ্ছে রেদোয়ান।

আয়াসের রাগের একমাত্র কারন তারই অগোচরে তারই মনের মানুষের উপর হামলা করা হয়েছে! কেন করলো? কিসের এতো তাড়া সবার? সে তো সবটা ঠান্ডা মস্তিষ্কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে? আর কি চায় এদের?

“সরদার কসম লাগে আমার কথাটা একবার শোনেন। আমি আপনাকে সত্যিটাই বলবো।”

“সত্যিটা আমি বলছি, তুই আমার খেয়ে আমার পড়ে আমার পিছেই ছুরিঘাত করছিস! বিশ্বাসঘাতক!”

“সরদার! আমি আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমি করতে পারিনা সরদার।”

“খামোশ!”

বাজখাঁই গলায় আবারও চেঁচিয়ে উঠলো আয়াস। রাগে ক্ষোভে এবার সে পাগল হয়ে যাবে। ধারালো অস্ত্র সরিয়ে নিলো সে। রেদোয়ান যেন মরতে মরতে বেঁচে গেলো। আয়াস প্রস্থান করলো সেখান থেকে। বেরিয়ে চলে গেলো উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে। এই নরক যন্ত্রণা তার আর ভালো লাগেনা। একটু সুস্থ হাওয়ায় বাঁচতে চায় সে। এই বিষাক্ত হাওয়া থেকে বহুদূর গিয়ে।

#চলবে____

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৬]

হাতের ক্ষতস্থানে কারোর ছোঁয়া পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো রাজকন্যা। চোখ মেলে পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো জিন্নাতকে। মলিন মুখে তার হাতের ক্ষতস্থানে হাত বুলাচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দে কিছু পড়ছে। পড়া শেষ হতেই মুখটা খানিক এগিয়ে এনে ফু দিলো। রাজকন্যা স্তিমিতনেত্র দেখতে লাগলো। জিন্নাত দেখেনি রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেছে। হঠাৎ তার চাহনি বোধগম্য হতেই কাতর কন্ঠে বলল,

“দুঃখিত রাজকন্যে। আমি তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি।”

রাজকন্যার দৃষ্টি নড়ে। ভাবনার ঘোর কাটে। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করে বলে,

“অনেক ঘুমিয়েছি। আর বোধহয় প্রয়োজন হবে না।”

এই বলে উঠতে চেষ্টা করলো। জিন্নাত বিস্মিত হলো। হাত ঠেকিয়ে বাঁধা দিলো তাকে। পূনরায় শুয়ে দিয়ে বলল,

“একদম উঠবে না। এই মুহুর্তে বিশ্রাম করা ফরজ তোমার জন্যে।”

“আমি ঠিক আছি জিন্নাত। তোমরা আমায় নিয়ে এতো ভেবোনা!”

“ঠিক থাকো কিংবা না থাকো। এখন কেবল বিশ্রাম নেবে ব্যস।”

রাজকন্যা জিন্নাতের জেদের কাছে হার মেনে হাসলো। বলল,

“আচ্ছা বেশ। নেবো বিশ্রাম। তার আগে বলো দুটো দিন ছিলে কোথায়? জানো কতকি কান্ড ঘটে গেছে?”

“সব জানি রাজকন্যে। সব জানি।”

জিন্নাতের গলা কেমন শোনালো। কাতর স্বর। আবার চিন্তিত খানিক। রাজকন্যা ভ্রু কুঁচকালো। জিন্নাতের মনে কি চলছে বোঝার চেষ্টা করতে করতেই জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার হঠাৎ কি হয়েছে? এতো চিন্তিত কেন তুমি?”

জিন্নাত চিন্তার জগতে হাতছানি দিলো। অন্যমনস্ক হয়ে বলল,

“রাজকন্যে,তোমার মনে আছে আরোভিকে খুঁজে পাওয়ার দিন আমি তোমায় বলেছিলুম আমি একজনকে দেখেছি! খুব চেনা চেনা লেগেছিলো কিন্তু চিনতে পারছিলাম না?”

রাজকন্যা ভাবতে চেষ্টা করলো। তার বেশি গহ্বরে ভাবতে হয়নি। অল্পতেই স্বরন করতে পারলো জিন্নাতের কথাটা। উদগ্রীব কন্ঠে বলল,

“হ্যাঁ মনে আছে বৈ কি। তুমি কাকে দেখেছিলে জিন্নাত?”

জিন্নাত হাওয়ায় ভেসে দাঁড়ালো। মেঝেতে রাখা তার ঝুলিটা উঠিয়ে রাজকন্যার পাশে রাখলো। অতঃপর ঝুলি হাতিয়ে একখানা চিত্র বের করে রাজকন্যা সামনে ধরে বলল,

“আমি এই ব্যাক্তিতে দেখেছিলাম সেদিন।”

রাজকন্যা নিজের আগ্রহ চেপে আর শুয়ে থাকতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। চিত্রখানা নিজের হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো। চিনতে পারলো না। তবে,অচেনাও যে মনে হচ্ছে না। কারোর মুখের সাথে গাঢ় মিল। তবে মনে পড়ছে না। তার বিস্ময় পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। জিন্নাতের দিকে একবার তাকালো। ফের চিত্রখানা দেখে বলল,

“আমি চিনতে পারছিনা উনাকে। তবে কোথাও তো দেখেছি নির্ঘাত।”

জিন্নাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চিত্রখানার প্রতি স্থির দৃষ্টি রেখে বলল,

“উনি হলেন বেগমজির সোয়ামি। মানে তোমার ফুপাজান!”

রাজকন্যা হতবিহ্বল হলো। অবাকের চূড়ান্তে পৌঁছে হা করে তাকিয়ে রইলো চিত্রখানার দিকে। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠলো,

“সে কি করে সম্ভব জিন্নাত! লোকমুখে শোনা গেছে উনি দীর্ঘ পঁচিশ বর্ষ আগে মারা গিয়েছেন।”

জিন্নাত গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,

“না রাজকন্যে। লোকমুখে রটনা ছড়িয়েছে। ছড়িয়েছে বললে ভুল হবে,ছড়ানো হয়েছে। উনি মারা জাননি। উনি আজও বেঁচে আছেন। আর এটাই সত্যি।”

রাজকন্যার বুক কেঁপে ওঠে। এ কেমন রহস্যের বেড়াজাল। যে মানুষটা আজও বেঁচে আছে তাকে কেন দীর্ঘ পঁচিশ বর্ষ আগে মৃত বলে ঘোষনা করা হয়েছে? এর পেছনে কার কোন উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? কেন এমন মিথ্যে রটনা ছড়ানো হয়েছে!

“আমি সেদিন রাতেই পূনরায় ঐ জঙ্গলে যাই। তখনও এক মায়াজাল দিয়ে চারপাশ সুরক্ষিত রাখা হয়েছিলো। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ফুপাজান ওখানেই আছেন। আমি পরপর দু’দিন ঐ জায়গা নজরবন্দী করি। কিন্তু কোনো উপায়ে সে বুঝে যায়। ফের নিজে জাল বুনে। আবার নিজেকে সুরক্ষার জালে বন্দী করে। কিন্তু অবশেষে পার পায়নি। আমি উনাকে দ্বিতীয় বারের মতো দেখে নেই দুচোখ ভরে। এই চিত্রখানা আমি উদ্ধার করি রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে পুরনো চিত্রকারের থেকে। উনার কাছে এই প্রাসাদের ছয় পুরুষের চিত্র আছে। যার মধ্যে ভাগ্যক্রমে এই চিত্রখানা পেয়ে যাই। এই চিত্র তার যৌবনের। তবে এখন সে বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছে। তাই হঠাৎ দেখলে গরমিল মনে হতে পারে।”

সবটা শুনে মাথায় দুশ্চিন্তার বোঝা চাপলো রাজকন্যার। চিন্তান্বিত কন্ঠে বলল,

“উনি কি কারোর হাতে বন্দী?”

“না রাজকন্যে। উনি কারোর হাতে বন্দী নয়। বরং আমার মনে হয় উনার হাতে কেউ বন্দী।”

“কে!”

“জানিনা। আমাদের খোঁজ জোগাড় করতে হবে।”

“নিশ্চয়ই। খোঁজ তো আমরা জোগাড় করবোই।”

“কিন্তু রাজকন্যে তোমার এই শরীরে..”

“এই মুহুর্তে আমি নিজের কথা ভাবতে পারবো না! অসম্ভব!”

____”মানে! রাজকন্যা আপনি এসব কি বলছেন?”

দরজার সম্মুখ থেকে ভেসে আসে রাজকুমারের গলা। রাজকন্যা হকচকিয়ে তাকায়। রাজকুমার প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। রাজকন্যা ভীত মনে ঢোক গিলে। আঁড়চোখে নিজের পাশে দেখতেই অনেকটা নিশ্চিত হয়! নাহ্__ চলে গেছে জিন্নাত। কিন্তু.. রাজকুমার কি শুনে ফেলেছে তাদের কথা? মুহুর্তেই ভয়টা কেটে গেলেও পরক্ষণেই আবার দিগুন ভয়ে ঢোক গেলে রাজকন্যা। প্রভুর কাছে প্রার্থনা জুড়ে,যেন রাজকুমার তাদের কথোপকথন শুনতে না পায়।

রাজকুমার কপাল কুঁচকে রেখে এগিয়ে এলো। রাজকুমারের পা যত এগোচ্ছে রাজকন্যার ভয় তত বাড়ছে। একপ্রকার আতংক সৃষ্টি হলো রাজকন্যার চোখে মুখে। ঠিক একই আতংক রাজকুমারের মুখেও। সে পূনরায় আওড়ালো,

“আপনার এমন শারীরিক অবস্থায় আপনি নিজের কথা না ভেবে রাজ্যের কথা ভাবছেন? রাজকন্যা, আগে আপনার নিজের সুস্থ হতে হবে,নিজের আগে ঠিক হতে হবে। তারপরই তো আপনাকে রাজ্য সামলাতে হবে তাই না? আপনি কেন নিজর কথা ভাবছেন না?”

রাজকন্যা ঠিক ঠাওরে উঠতে পারলোনা রাজকুমারের কথা। এবারও সেও প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তাকালো। রাজকুমারের বিশেষ ভাবাবেগ হলো না রাজকন্যার চাহনিতে। সে তার মতোই বলে যেতে লাগল,

“আর একবার যদি শুনেছি আপনি নিজের কথা না ভেবে এই রাজ্যের কথা ভাবছেন তবে দেখুন কেমন করে বকি আমি? রাজকন্যা, এই রাজ্যের রাজাই যদি ঠিক না থাকে তবে রাজ্য কেমন করে ঠিক থাকবে? আপনাকে তো আগে নিজেকে ঠিক করতে হবে। তারপর তো রাজ্যের কথা ভাববেন!”

রাজকন্যা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মানে রাজকুমার তাদের মধ্যে শুনেনি। সে কেবল শেষ লাইন টুকুই শুনেছে।

“জি।”

“জি! কেবল জি? আমি যা বললাম তা কি ঢুকেছে মস্তিষ্কে।”

রাজকন্যা ঠোঁট বাঁকালো। বাচ্চাসুলভ কন্ঠে বলল,

“জি ঢুকেছে।”

রাজকুমার তার ভাবভঙ্গি দেখে হাসলো। শয্যায় রাজকন্যার পাশে বসে তার মুখবিবরে আলতো করে হাত রাখলো। অতঃপর ললাটে ভালোবাসার পরশ একে কোমল স্বরে বলল,

“শুকরিয়া।”

আকস্মিক এক শব্দ ভেসে আসলো রাজকন্যার বারান্দা থেকে। কিছু একটা পড়ে গেছে মনে হলো। রাজকন্যা এবং রাজকুমার দু’জনেই চমকে উঠলো। পরক্ষণেই সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। রাজকন্যা কপাল কুঁচকে গলা উঁচিয়ে বলল,

“কে ওখানে?”

কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। রাজকুমার উঠে দাঁড়ালো। ক্রোধে কপাল কুঁচকে এলো তার। এতোবড় স্পর্ধা.. তাদের কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ তাদের কথা শুনছিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় রাজকুমার। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। দিনের শেষ প্রহর। চারদিকে মিঠে আলো। সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু। রাজকন্যার গলা পাওয়া গেলো,

“রাজকুমার?”

রাজকুমার পূনরায় ভেতরে চলে যায়।

“কেউ নেই।”

রাজকন্যার দুশ্চিন্তা এবার আরও এক ধাপ বাড়ে। তাদের কথোপকথন রাজকুমার শুনতে না পেলেও কেউনা কেউ ঠিকই শুনেছে। কিন্তু কে?

নিকষ কালো রাত। আজ অম্বরে নিশাকান্তের দেখা নেই। অমাবস্যা হয়তো। খোলা অম্বরের নীচে ফাঁকা জমিনে ঠাঁই নিয়েছে আয়াস। ভাবছে বিভোর হয়ে।ক্রমশই এক অজানা ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে। মরমে মরে যাচ্ছে সে। আজকাল নিশ্বাস নিতে ভয় হয়। মনে হয় বিষাক্ত হাওয়া গিলে নিয়েছে। এক্ষনি মৃত্যু হয়ে যাবে। অথচ কোনো একদিন এই মৃত্যুকেই ভয় পেতো না। তার জন্মটাই তো ছিলো বিষাক্ত হাওয়ায়। সময়ের সাথে সাথে বিষাক্ত হাওয়াই হয়ে উঠলো তার অভ্যাস। পাপে পাপে জর্জরিত জীবনটা হয়ে উঠলো জাহান্নাম। কিন্তু এই জাহান্নামের ন্যায় জীবনটাই উপভোগ্য ছিলো। ভালো লাগতো। উপভোগ করতো। কিন্তু আজ! আজ যে সবটা ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। পেছনের ফেলে আসা কালো অতীতে যখন রাজকন্যার পাদচারণ ঘটে সবটা পাল্টে যায়। তার পাপিষ্ঠ জীবনটা হঠাৎ জান্নাত হয়ে ওঠে। সুখের লোভ লেগে যায় তার। একটু ভালো থাকার লোভ। কিন্তু তা যে আদৌ সম্ভব নয়। যে কন্যাকে সে মন দিয়ে বসেছে সেই কন্যাকেই যে নিজ হাতে বলি দিতে হবে তাকে। হ্যাঁ___এটাই তার বাস্তবতা। এটাই তার ধর্ম।

“সরদার? রাজকন্যা তো ওস্তাদজীর প্রানপ্রিয় বন্ধু নাজিমউদ্দীনের সন্ধ্যান পেয়ে গেছেন!”

রেদোয়ানের কন্ঠে এমন বানী শুনতেই তন্দ্রা ছুটে গেলো আয়াসের। ধপ করে জ্বলে উঠলো বুকের ভেতরটা। শোয়া থেকে উঠে বসলো। মনের মাঝে বিরাজ করলো অজানা ভয়। রাজকন্যার সম্মন্ধে আর কতশত অজানা তথ্য বেরোবে জানা নেই তার। এ যেন মেয়ে নয়। অন্য কিছু!

“রাজকন্যার সঙ্গে সার্বক্ষণিক এক জ্বীন থাকে সরদার। রাজকন্যাকে এই খবর সেই দিয়েছে।”

ফোঁস করে উঠলো আয়াস। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুকুম করলো,

“ঐ জ্বীনকে এক্ষনি বন্দী করার ব্যবস্থা করো। এমন ভাবে বন্দী করো যেন সারাজীবনের জন্য মনুষ্য সঙ্গের নাম নিতেও ভুলে যায়।”

“আজ্ঞে সরদার।”

রেদোয়ান ছুটে যায়। আয়াস চোখ বুঁজে টেনে বড় করে নিশ্বাস ছাড়ে। রাজকন্যার মুখ টা মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে পড়েনা। তার এই কালো মনে রাজকন্যার পবিত্র মুখটা যে ভাসে না। তাতে আরও বেশি যন্ত্রণা হয় তার। অসহায় কন্ঠে বলার চেষ্টা করে,

“ক্ষমা করে দিও হুরপরী। আমায় ক্ষমা করে দিও।

#____চলবে🌸

#রাজকন্যা_হূরিয়া🤍🌸
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১৭]

বাতাসের তীব্র বেগে ছিটকে পড়লো জিন্নাত। লোহার কারাগার হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো অগ্নিশিখায়। জিন্নাত ভয়ে গুটিয়ে গেলো। চারপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো এক খানা পরিচিত মুখ। জিন্নাত আঁতকে উঠল। গলা থেকে সেই আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেলো ব্যাক্তিটি। শুনতেই যেন উল্লাস বেড়ে গেলো তার। সামনের দাঁত কপাটি বের করে হাসতে লাগলো বিকট শব্দে। জিন্নাত কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। তার শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা কে’টে-ছিঁ’ড়ে নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। দেখতেই ভীষণ শোচনীয় লাগছে। অথচ কেমন করে সহ্য করছে জিন্নাত! খুড়িয়ে খুড়িয়ে দু’কদম এগোলো সে। সামনের ব্যাক্তিটার দিকে আক্রোশের সহিত তাকিয়ে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল,

“এতো বড় ধোঁকা! এতো বড় ধোঁকা আমার হলো কি করে?”

জিন্নাতের কথাটা ব্যাক্তিটির কানে কোনো হাসির বাক্য মনো হলো যেন। তার হাসির বেগ বাড়লো বৈ কমলো না। জিন্নাত আবারও কুঁকড়ে পড়লো যন্ত্রণায়। এমতবস্থায় তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকাও মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমান।

“অতি বাড় বেড়োনা, ঝড়ে পড়ে যাবে।”

ক্ষিপ্ত অথচ শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো জিন্নাত। মানুষটা হঠাৎ নিজের হাসি থামিয়ে নিলো। কিছুক্ষন গম্ভীর থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,

“ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না হু? তুমি জানো এই মুহুর্তে কোথায় আছো তুমি?”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলতে বলতে আবারও অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তুললো চারিপাশ। জিন্নাত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার রাজকন্যের এতো বড় বিপদ হতে যাচ্ছে আর সে এমন করে বন্দী হয়ে গেলো? কি করে মুক্তি পাবে এই দোজখ খানা থেকে। এর সবটাই যে আরবি হরফ দিয়ে আঁটকে দিয়েছে।

জিন্নাতের অস্থির দৃষ্টি অনুসরণ করে সে বলতে লাগলো,

“পালানোর পথ খুঁজছো? হাহাহা। তুমি এতোটাও বোকা নও! তাই এসব বোকা বোকা ভাবনা ছেড়ে দাও।”

জিন্নাত ফোঁস করে উঠলো। মানুষটা ভয় পাওয়ার নাটক করে আবারও হাসত লাগলো। যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“শোনো হে, মূর্খ পরী? তুমি মাটির একশহাত নীচে পাতালপুরীতে বন্দী। আর এই যে অগ্নিশিখায় গড়া কারাগার দেখছো? এটা একান্তই তোমার জন্য তৈরী, তোমার সাজার গন্ডি রেখা। এখান থেকে না তুমি বের হতে পারবে আর না তোমার রাজকন্যা তোমায় উদ্ধার করতে পারবে। যদি মুক্তি চাও তবে বলো? আমি তোমার চিরমুক্তির ব্যাবস্থা করবো। সত্যি বলছি।”

বলতে বলতে বিকট শব্দে হাসতে হাসতে প্রস্থান করলো মানুষটা। জিন্নাত অসহায় হয়ে বসে রইলো। রাজকন্যের কি হবে? কেমন করে বাঁচবে এই রাক্ষসদের থেকে।

রাজকন্যা রাজদরবার শেষ করলো সবে। রাজসিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তার সম্মান প্রদর্শনে উপস্থিত সকলেই উঠে দাঁড়ালো। সবাই নতশির করে আজকের মতো রাজদরবার সমাপ্ত করলো। রাজকন্যা ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয় তুলে নীচের দিকে নামার জন্য অগ্রসর হতেই কোথা থেকে ছুটে এলো এক আগন্তুক। র’ক্তা’ক্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়লো রাজকন্যার পদতলে। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে গেলো রাজকন্যা সহ রাজ্যসভার সকলে। চাপা গুঞ্জন ভেসে উঠলো বাতাসের সাথে। পাঁচ ছ’জন প্রহরী ছুটে এলো লোকটাকে ধরতে। তবে রাজকন্যার হাতের ইশারায় তাদের নিজ নিজ জায়গাতেই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। রাজকুমার রাজকন্যার পেছনেই ছিলো। লোকটাকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখেই সবার প্রথমে সে এগিয়ে এলো। রাজকন্যা তাকে বাঁধা দিলো না। বরং দু’জনে একসাথে মিলে লোকটাকে ধরে বসালো। রাজকন্যা চিন্তিত মনে একবার দৃষ্টি বোলালে লোকটার প্রতি। রাজকন্যার কিছু একটা মনে হতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। একটু দূরে বসা চাচাজানের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের লোকটার দিকে তাকালো। উদ্বেগ হয়ে আওড়ালো,

“একি! উনি তো আমার রাজ্যের সেনা। রাজকুমারের রাজ্যে যুদ্ধ ঘোষনা হওয়া কালীন উনিও গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। এতোদিন পর.. এতদিন পর এই অবস্থায় আপনি কোথা থেকে ফিরলেন?”

চাচাজান অস্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে পড়লেন হঠাৎ। অগ্রীম বিপদের আভাস পাচ্ছে সে। এই মুর্খ এখানে কেমন করে এলো?

লোকটা হা করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। রাজকন্যা ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকালো রাজকুমারের পানে। বলল,

“উনার জন্য জল আনার ব্যবস্থা করুন দয়াকরে।”

রাজকুমার দ্রুত পায়ে উঠে গেলো। রাজকন্যা আবারও তাকালো লোকটার পানে। লোকটার শরীরে তাজা র’ক্ত। যেন এক্ষনি জখম হয়ে র’ক্তা’ক্ত হয়েছে। রাজকন্যা দু’হাতে ধরে রাখলো লোকটাকে। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে বারবার চাচাজানের দিকে দেখছে রাজকন্যা। রাজকুমারের রাজ্য যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তো রাজকুমার ফিরে এলো অনেকদিন পেরিয়ে গেলো। যত সেনা পাঠানো হয়েছিলো তাদের সবাই তো ফিরে এসেছিলো। তবে এই লোকটা কেন ফেরেনি? এতোদিন যাবত কার নিকটে বন্দী থেকে এমন অত্যাচারীত হয়েছে?

“রাজকন্যা, জল।”

পেছন থেকে রাজকুমারের গলা পেতেই ভাবনার সুতো ছেড়ে রাজকন্যার। পেছন মুড়ে জলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চটজলদি লোকটাকে খাইয়ে দিলো। লোকটা জল পান করে একটু সুস্থ বোধ করলো। অতঃপর দুর্বল গলায় বলল,

“রাজকন্যা.. রাজকন্যা! আ্ আপনাকে আমার একটা তথ্য দেওয়ার আছে। আ্ আমি আপনাকে সবটা খুলে বলতে চাই।”

রাজকন্যা উদগ্রীব কন্ঠে বলল,

“অবশ্যই! আপনি বলুন? আমি শুনবো.. আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? আপনার এমন অবস্থা কি করে হলো?”

দু’চার জন দৌড়ে এলো তাদের পানে। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“রাজকন্যা… উনার দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো লোকটা বাঁচবে না নিশ্চিত।”

রাজকন্যা কথাটা বুঝলো। কিন্তু সায় দিলো না। সে চায়না আর কোনো তথ্য তার অজানা থাকুক। যেমন আরোভির বেলায় ঘটেছে!

“আ্ আপনার বিরুদ্ধে ষ্ ষ্..ষড়যন্ত্র করছে রাজকন্যা!”

রাজকন্যার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। শুকলো গলায় ঢোক গিললো সে। পাশ ফিরে একবার আঁড়চোখে রাজকুমারের দিকে তাকাতেই লোকটা আবারও বলল,

“এ্ এই যুদ্ধটাও এক্.. একটা ষড়যন্ত্র বৈ আর কিছুই ন্ ন্…”

আর কিছু বলতে পারলো না লোকটা। রাজকন্যার হাতে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লো। রাজকন্যা কেঁপে উঠলো। আতংকিত নয়নে লোকটার তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি খানায় চোখ বুলাতেই হাত থেকে পড়ে যেতো নিলো লোকটার নিস্তেজ শরীরটা। রাজকুমার ব্যাপারটা বুঝতেই তড়িঘড়ি ধরে ফেললো লোকটাকে। সবাই হাঁক পেড়ে উঠলো। প্রহরীরা ছুটে এসে সব একজোড় হলো। লোকটার প্রাণহীন দেহটাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো বাইরে। রাজকন্যা তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। তার মুখখানা নিমিষেই ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। রাজকুমার রাজকন্যার দৃষ্টি অনুসরণ করে তার কাঁধে হাত রাখলো। অভয় দিয়ে কোমল স্বরে বলল,

“রাজকন্যা, নিজেকে সামলান। লোকটার কথা গুলো এতো গুরুগম্ভীর ভাবে না নিলেও চলবে। হতে পারে ও কোনো গুপ্তচর।”

“না। ও কোনো গুপ্তচর নয়। ও আমার রাজ্যের সেনা। আমার রাজ্যের।”

দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদ করে উঠলো রাজকন্যা। রাজকন্যার এমন আচরনের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না রাজকুমার। আকস্মিক ভড়কে গেলো। রাজকন্যার সেদিকে হুঁশ নেই। সে ক্রোধান্বিত হয়ে প্রস্থান করলো। রাজকুমার কিছুক্ষন একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ চাচাজানের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরপর বার কয়েক ঢোক গিললো চাচাজান। মাথা নীচু করে আকাশপাতাল ভেবে চললেন। রাজকুমার আর দাঁড়িয়ে রইলো না। দ্রুত পায়ে ছুটলো রাজকন্যার পেছনে।

রাগে ক্ষোভে রাজকন্যার দৃষ্টি আগুনের ন্যায় আকার নিলো। যেন যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমন মুহুর্তে তার সামনে ধ্বংস হতে চলে এলো আরহাম। সেও এই পথ ধরেই যাচ্ছিলো। আকস্মিক রাজকন্যার সামনে পড়ায় থতমত খেলো। কি করবে ভেবে না পেয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। একবার নতশির করে শ্রদ্ধা জানায় একবার আশেপাশে পালানোর পথ খোঁজে। রাজকন্যা কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ। তার ক্রোধানল দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আরহামের পায়ের ক্ষতস্থানে। পায়ে জড়ানো পট্টিটা রক্ত মুখো হয়ে আছে। রাজকন্যার মস্তিষ্ক আগাম বার্তা দিলো। রাজকন্যা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

“তোমার পায়ের এমন দশা হলো কেমন করে?”

আরহাম হকচকিয়ে গেলো। ধরা পড়া চোরের ন্যায় পায়ের সরে যাওয়া কাপড়টা নীচু হয়ে দ্রুত টেনে দিলো। পট্টি বাঁধা জায়গাটা ঢেকে যায়। আরহাম রাজকন্যার সামনে কি জবাব দেবে ভেবে পায়না। ভয়ে তার গলা আঁটকে গেছে। রাজকন্যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিঁধে আছে আরহামের ভীত মুখশ্রীতে। ফের গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো রাজকন্যা,

“চুপ করে আছো যে? কি লুকোচ্ছ তুমি?”

ভয়ে চুপসে যায় আরহাম। এখনও জবাব দিতে পারেনা সে। এমন সময় পেছন থেকে আগমন ঘটে রাজকুমারের।

“গতকালই হয় ওর এই জখম।”

বলে রাজকুমার। রাজকন্যা পেছন মুড়ে তাকায়। অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কেমন করে হলো?”

এবার রাজকুমারের মুখেও বিরাজমান হয় একই ভয়। রাজকন্যার চাহনি তীক্ষ্ণ হয় ক্রমশ। কি লুকোচ্ছে তারা দু’জনে? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে আরহামের এই আঘাতের পেছনে?

“রাজকন্যা আমি বলছি?”

আদিমএর আগমন ঘটে এবার। সে বর্ননা করে গুপ্তচরদের খুঁজতে গিয়েই একটা পাহাড়ের খাদে পা পিছলে পড়ে যায় আরহাম। অতঃপর এই জখম। কথা গুলো বিশ্বাস যোগ্য হলেও একটা প্রশ্ন ঠিকই রয়ে যায় রাজকন্যার মনে। তবুও সবাইকে দেখাতে বিশ্বাস করে নেওয়ার ভান করে প্রস্থান করে।

#চলবে